(পূর্ব প্রকশের পর)
![]() |
ক্যাপশন যুক্ত করুন |
লুই
পাদানাম্
রাগ–পটমঞ্জরী
কাআ
তরুবর
পঞ্চ
বি
ডাল।
চঞ্চল
চীএ
পইঠো
কাল।
দিঢ়
করিঅ
মহাসুহ
পরিমাণ।
লুই
ভণই
গুরু
পুছ্ছিঅ
জাণ।।
সঅল
সমাহিঅ
কাহি
করিঅই।
সুখ
দুখেতেঁ
নিচিত
মরিঅই।।
এড়ি
এউ
ছান্দক
বান্ধ
করণক
পাটের
আস।
সুনু
পাখ
ভিড়ি
লাহু
রে
পাস।।
ভণই
লুই
আমহে
ঝাণে
দিঠা।
ধমণ
চমণ
বেণি
পাণ্ডি
বইঠা।।
[ শব্দার্থ:কাআ=দেহ/শরীর, তরুবর=বড় গাছ, পঞ্চবি=পাঁচটি, ডাল=শাখা, চীএ=চিত্তে,পইঠো=প্রবেশ করে, কাল= মৃত্যু রূপী দেবতা, দিঢ়=দৃঢ়/শক্ত, মহাসুহ=মহাসুখ, ভণই=বলেন,পুচ্ছিঅ=জিজ্ঞাসা করে, জাণ=জানো,সঅল= সর্বকাল, সমাহিঅ= একাগ্র ভাবে ধ্যান মগ্ন, কাহিকরিঅই= কি করিবে, নিচিত = নিশ্চিত/অবশ্যই, মরিঅই = মরিবে,এড়ি = এড়ানো/বর্জন করা, এউ=এই, ছান্দক= ছন্দের, বান্ধ = বন্ধন, করণক = ইন্দ্রিয়ের,পাটের আস = পারিপাট্যের আশা, সুনু পাখ = শূন্যপাখা, ভিড়ি=ভর করে, লাহু রে = লও রে,পাস = পাশে, আমহে = আমি, ঝাণে = ধ্যানে, দিঠা = দেখেছি, ধমণ চমণ = শ্বাস-প্রশ্বাস,বেণি –দুই রকম, পাণ্ডি = পিড়া, বইঠা = বসেছি।]
প্রাকৃত
বাংলা
ভাষায়
লিখিত
এই
চর্যাপদ
কে
বিশুদ্ধ
বাংলায়
রূপান্তর
করলে
সাধারণ
অর্থ
দাঁড়ায়
:
মানুষের
দেহ
বৃক্ষের
পাঁচ
টি
ডাল।
চঞ্চল
চিত্তে
কালপ্রবেশ
করে।
মনকে
দৃঢ়
করে
মহাসুখ
পাও।
লুই
বলে
-গুরু
কে
জিজ্ঞাসা
করে
সব
জেনে
নাও।
সুখে
বা
দুঃখেতে
মরণ
যখন
নিশ্চিত,তখন
সব
সময়ে
তপস্যা
করে
কি
হবে
? এই
ছন্দের
বন্ধন
এবং
ইন্দ্রিয়ের
পারিপাট্য
ছেড়ে
শূণ্য
পাখায়
ভর
করে
তার
কাছে
যাও।
লুই
বলে
আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের পিড়ায় বসে ধ্যানে সব দেখেছি।
কিন্তু
লুইপাদের
এই
চর্যাগীতি
র
ভাবগত
অর্থ
বিশ্লেষণ
করলে
দেখা
যায়,
মনকে
নিয়ন্ত্রণ,
ইন্দ্রিয়
দমন
এবং
গুরু
বাক্য
অনুসারে
চিত্তের
সাধন
দ্বারা
যে
নির্বাণ
লাভ
সম্ভব,
সেই
তত্ত্বই
ব্যাখ্যা
করা
হয়েছে।
“মানুষের দেহ বৃক্ষের পাঁচ টি ডাল “- মানুষের শরীর কে যদি একটা জীবন্ত গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় দেহ বৃক্ষের পাঁচটি শাখা স্বরূপ, যা মানুষের জীবন কে নিয়ন্ত্রণ করে।
“চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে” - ইন্দ্রিয় গুলি মানুষ কে ভোগময় জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করে। মানুষ যত ভোগ করে তত ভোগের স্পৃহা বাড়ে। ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত মানুষ ভোগের ব্যাঘাত ঘটলেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। তখন মন অশান্ত হওয়ার ফলে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে, অনিয়মিত ও বিশৃঙ্খল জীবন যাপনের দরুণ শরীরে কাল রূপী ব্যাধির আবির্ভাব ঘটে।
“মনকে দৃঢ় করে মহাসুখ পাও” - মনকে যত দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মন তত শান্ত হয়। অশান্ত মন কখনই ঈশ্বর সাধনার উপযোগী হয় না। এ জন্য যোগী গণ ঈশ্বর সাধনার অঙ্গ হিসাবে নানা যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়াম প্রভৃতির সহায়তায় চিত্ত সংযম করেন। কৃচ্ছ সাধনে মন যত সফল হয়,ভবিষ্যতে ঠিক সেই অনুপাতে সুখ বৃদ্ধি ঘটে।
“গুরু কে জিজ্ঞাসা করে সব জেনে নাও” - নির্বাণ লাভের জন্য যে প্রজ্ঞা ও উচ্চভাব মার্গে বিচরণের উপযুক্ত মানসিক দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তা একমাত্র ধর্ম সাধকেরাই অর্জন করতে পারেন। সে জন্য সাধন পথে অগ্রসর হতে গেলে সতত গুরু সঙ্গ প্রয়োজন । গুরুদেব জ্ঞানাঞ্জন শলাকার ছোঁয়ায় শিষ্যের জ্ঞান চক্ষুর উন্মীলন ঘটালে তবেই শিষ্য সাধনার উপযুক্ত হন। গুরুর
কাছ
থেকে
মুক্তির
উপায়
জেনে
নিলে
সাধন
পথের
বাধা
বিঘ্ন
গুলিকে
সহজেই
অতিক্রম
করা
যায়।
“সুখে বা দুঃখেতে মরণ যখন নিশ্চিত, তখন সব সময়ে তপস্যা করে কি হবে ?” - মানুষ মরণশীল। জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর হাত থেকে কারও রক্ষা নেই। বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে সর্ব প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য। নির্বাণ লাভ করতে পারলে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে এবং পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু বোধিলাভ ছাড়া নির্বাণ সম্ভব নয়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও পরম জ্ঞানকেই বোধি বলা হয়। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তপস্যার মাধ্যমে বোধি লাভ ও বোধি লাভে প্রাপ্ত জ্ঞানের সহায়তায় নির্বাণলাভের প্রয়োজনেই তপস্যা ।
“এই ছন্দের বন্ধন এবং ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য ছেড়ে শূণ্য পাখায় ভর করে তার কাছে যাও “ – মুক্ত পক্ষ পাখীর মত শূন্য মার্গ অবলম্বন করলে অর্থাৎ জাঁকজমক বা ইন্দ্রিয়ের
পারিপাট্য
সমূহের অকারণ ভার পরিত্যাগ করলে মন মুক্ত হয়, এবং মুক্ত মন মুক্তির সহায়ক হয়। মুক্তি লাভ করলে আত্মা বুদ্ধে বিলীন হয়।
“লুই বলে আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের পিড়ায় বসে ধ্যানে সব দেখেছি ” - লুইপাদ নিজেই ছিলেন
একজন
বৌদ্ধ
সিদ্ধাচার্য।
বৌদ্ধ
ধর্মের
সাধন
তত্ত্ব
তার
জানা
ছিল।
শ্বাস-প্রশ্বাসের
নিয়ন্ত্রণ
বা
কুম্ভক
সমাধি
দ্বারা
দেহের
প্রকৃতি
দোষ
খণ্ডন
করে, নির্বিকল্প সমাধিতে বোধি চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখ সঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়, এই কথাই পরিশেষে তিনি উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বজ্রযানী ও সহজযানী পন্থী সিদ্ধাচার্য গণ সন্ধ্যা ভাষায় অতি সহজ কথায় চর্যাপদগুলি রচনা করলেও বাস্তবে তা ছিল দ্বৈত অর্থবহ, দুরূহ এবং সাধন তত্ত্বের গভীর ভাবব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ।।
[তথ্যসুত্রঃ সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি ]