[ইমাম অাহমদ শেহাবউদ্দীন আল-কসতলানী (রহ:) প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ‘রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নূর’ অধ্যায় হতে অনূদিত। প্রকাশক: অাস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা; Imam Qastalani's book 'al-Mawahib al-Laduniyya' ('Light of the Prophet' chapter); from As-Sunnah Foundation of America; translated by K.S.Hossain]
বঙ্গানুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেনউৎসর্গ
আমার পীর ও মোর্শেদ আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরতুল আল্লামা শাহ সূফী সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে....।
- অনুবাদক
ইমাম মুহাম্মদ যুরকানী মালেকী (রহ:) ’আল-মাওয়াহিব’ বইটির ওপর ৮ খণ্ডের একটি
ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইমাম কসতলানী (রহ:) ’আল-মাওয়াহিব
আল-লাদুন্নিয়া’ (যুরকানী রচিত ’শরাহ’ বা ব্যাখ্যা, ৩:১৭৪) গ্রন্থে বলেন:
মহা বরকতময় নাম ‘মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ওই নামের
অর্থের সাথে যথাযথভাবে মিলে যায় এবং আল্লাহতা’লা মানুষের দ্বারা তাঁর প্রতি
ওই মোবারক নামকরণের আগেই নিজ হতে ওই পবিত্র নাম তাঁর প্রতি আরোপ করেন। এটি
তাঁর নবুয়্যতের একটি প্রতীকী-চিহ্ন প্রতিষ্ঠা করে, কারণ তাঁর নাম তাঁরই
(নবুয়্যতের) সত্যতাকে নিশ্চিত করে। অতএব, তিনি যে জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা
(সবাইকে) হেদায়াত দান করেছেন এবং (সবার জন্যে) কল্যাণ এনেছেন, সে কারণে
তিনি এই দুনিয়ায় প্রশংসিত (মাহমূদ)। আর পরকালে শাফায়াত তথা সুপারিশ করার
সুউচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত হবেন বলেও তিনি প্রশংসিত (মাহমূদ)।
[আল্লাহতা’লা সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের
নবুয়্যতকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে কীভাবে তাঁকে মহাসম্মানিত করেছেন, তার বর্ণনা;
এতে আরও বর্ণিত হয়েছে তাঁর বংশপরিচয়, ঔরস, বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) ও
(ছেলেবেলার) শিক্ষাদীক্ষা]
আশীর্বাদধন্য রূহের সৃষ্টি
আল্লাহতা’লা সৃষ্টিকুলকে অস্তিত্বশীল করার এরাদা (ঐশী ইচ্ছা) পোষণ করার পর
তিনি নিজ ‘নূর’ হতে নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে
সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি মহানবী (দ:)-এর নূর হতে বিশ্বজগত ও আসমান-জমিনের
তাবৎ বস্তু সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে তাঁর রেসালাত
সম্পর্কে অভিহিত করেন; ওই সময় হযরত আদম (আ:) রূহ এবং দেহের মধ্যবর্তী
(ঝুলন্ত) অবস্থায় ছিলেন। হুযূর পূর নূর (দ:) হতেই তখন সমস্ত রূহ
অস্তিত্বশীল হন, যার দরুন তিনি সকল সৃষ্টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে সাব্যস্ত হন
এবং সকল অস্তিত্বশীল বস্তুর উৎসমূলে পরিণত হন।
সহীহ মুসলিম শরীফে নবী করীম (দ:) এরশাদ করেন যে আসমান ও জমিন সৃষ্টির
পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই আল্লাহ পাক সৃষ্টিকুলের ভাগ্য (তাকদীর) লিপিবদ্ধ
করেছিলেন। অধিকন্তু, (হাদীসে) আরও বলা হয় যে আল্লাহতা’লার আরশ-কুরসি ছিল
পানিতে এবং যিকির তথা উম্মুল কেতাবে যা কিছু লেখা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম
ছিল সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ’খাতামুন্
নাবিয়্যিন’ হওয়ার বিষয়টি। হযরত এরবায ইবনে সারিয়্যা (রা:) বর্ণনা করেন যে
মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ বিবৃত করেন যে আমি তখনো আম্বিয়া (আ:)-এর
মোহর ছিলাম, যখন আদম (আ:) রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন (মানে
সৃষ্টি হননি)।”
হযরত মায়সারা আল-দাব্বী (রা:) বলেন যে তিনি মহানবী (দ:)-কে জিজ্ঞেস
করেছিলেন, “এয়া রাসূলুল্লাহ (দ:)! আপনি কখন নবী হন?” তিনি জবাবে বলেন, “যখন
আদম (আ:) রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন।”
সুহায়ল বিন সালেহ আল-হামাদানী (রহ:) বলেন, “আমি (একবার) হযরত ইমাম আবূ
জা’ফর মোহাম্মদ ইবনে আলী (রা:)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মহানবী (দ:) কীভাবে
অন্যান্য পয়গম্বর (আ:)-মণ্ডলীর অগ্রবর্তী হতে পারেন, যেখানে তিনি-ই সবার
পরে প্রেরিত হয়েছেন?’ হযরত ইমাম (রা:) উত্তরে বলেন যে আল্লাহ পাক যখন বনী
আদম তথা আদম-সন্তানদেরকে জড়ো করে তাঁর নিজের সম্পর্কে সাক্ষ্য (‘আমি কি
তোমাদের প্রভু নই?’ প্রশ্নের উত্তর) নিচ্ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (দ:)-ই
সর্বপ্রথমে উত্তর দেন, ‘জ্বি, হ্যাঁ।’ তাই তিনি-ই সকল আম্বিয়া (আ:)-এর
পূর্বসূরী, যদিও তাঁকে সবশেষে প্রেরণ করা হয়েছে।”
ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:) ওপরোল্লিখিত হাদীস (মুসলিম শরীফ) সম্পর্কে
মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে আল্লাহতা’লা যেহেতু দেহের আগে রূহ (আত্মা)
সৃষ্টি করেন এবং যেহেতু মহানবী (দ:) কর্তৃক ‘আমি তখনো নবী ছিলাম যখন আদম
(আ:) রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন’ মর্মে মন্তব্য করা হয়, সেহেতু
তাঁর ওই বক্তব্য তাঁর-ই পবিত্র রূহকে, তাঁর-ই বাস্তবতাকে উদ্দেশ্য করে; আর
আমাদের মস্তিষ্ক (বিচার-বুদ্ধি) এই সব বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে অপারগ হয়ে
পড়ে। কেউই সেসব বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সক্ষম নয় একমাত্র সেগুলোর স্রষ্টা
(খোদাতা’লা) ছাড়া, আর সে সকল পুণ্যাত্মা ছাড়া, যাঁদেরকে আল্লাহ পাক
হেদায়াতের নূর দান করেছেন।
অতএব, হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টিরও আগে আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর রূহ
মোবারককে নবুওয়্যত দান করেছিলেন; কেননা, তিনি তাঁকে সৃষ্টি করে অগণিত
(অফুরন্ত) নেয়ামত দান করেন এবং খোদার আরশে মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারকও
লেখেন, আর ফেরেশতা ও অন্যান্যদেরকে মহানবী (দ:)-এর প্রতি নিজ মহব্বত ও
উচ্চধারণা বা শ্রদ্ধা সম্পর্কে জানিয়ে দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর
বাস্তবতা তখন থেকেই বিরাজমান, যদিও তাঁর মোবারক জিসম (দেহ) পরবর্তীকালে
আবির্ভূত হন। হযরত আল-শি’বী (রা:) বর্ণনা করেন যে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ
(দ:)-এর কাছে আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন?”
হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, ”যখন আদম (আ:) তাঁর রূহ এবং দেহের
মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে ওয়াদা নেয়া হয়েছিল।” তাই
আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মধ্যে তিনি-ই সর্বপ্রথমে সৃষ্ট এবং সর্বশেষে প্রেরিত।
বর্ণিত আছে যে, মহানবী (দ:)-ই হলেন একমাত্র বনী আদম, যাঁকে রূহ ফোঁকার আগে
(সর্বপ্রথমে) বেছে নেয়া হয়; কেননা তিনি-ই মনুষ্যজাতির সৃষ্টির কারণ, তিনি-ই
তাদের অধিপতি, তাদের অন্তঃসার, তাদের উৎসমূল এবং মাথার মুকুট।
সর্ব-হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:) ও ইবনে আব্বাস (রা:) উভয়েই বর্ণনা করেন
মহানবী (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আদম (আ:) থেকে আরম্ভ করে সমস্ত
নবী-রাসূল প্রেরণের আগে তাঁদের কাছে আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:) সম্পর্কে এই
মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, যদি তাঁদের হায়াতে জিন্দেগীতে তাঁরা
মহানবী (দ:)-এর সাক্ষাৎ পান, তবে যেন তাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁকে
(সর্বাত্মক) সাহায্য-সমর্থন করেন; আর যেন তাঁরা নিজেদের উম্মতকেও অনুরূপ
কর্তব্য পালনের আদেশ দেন।”
বর্ণিত আছে যে আল্লাহ পাক যখন আমাদের মহানবী (দ:)-এর নূর সৃষ্টি করেন, তখন
তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-কে অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-এর নূরের দিকে তাকাতে
বলেন। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নূর সবার নূরকে ঢেকে ফেলে (অথবা সবার নূরকে
ছাপিয়ে ওঠে) ; এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক তাঁদেরকে কথা বলতে দিলে তাঁরা জিজ্ঞেস
করেন, ‘এয়া আল্লাহ, কে আমাদেরকে তাঁর নূর দ্বারা ঢেকে রেখেছেন?’
আল্লাহতা’লা জবাবে বলেন, ‘এটি সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে
ওয়া সাল্লাম)-এর নূর। যদি তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনো, তবে আমি তোমাদেরকে
নবী বানিয়ে দেবো।’ তাঁরা সবাই বলেন, ‘আমরা তাঁর প্রতি এবং তাঁর নবুওয়্যতের
প্রতি ঈমান আনলাম।’ অতঃপর আল্লাহ পাক জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কি তোমাদের সাক্ষী
হবো?’ তাঁরা উত্তর দেন, ’হ্যাঁ’। আল্লাহ পাক আবার প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কি
এই প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা মেনে নিলে?’ তাঁরা উত্তরে বলেন, ‘আমরা
তা মানার ব্যাপারে একমত।’এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা বলেন, ‘তাহলে সাক্ষী হও,
আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী হলাম।’ এটি-ই হলো পাক কালামের অর্থ যেখানে
আল্লাহতা’লা এরশাদ করেছেন: “এবং স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ আম্বিয়াবৃন্দের কাছ
থেকে তাদের অঙ্গিকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান
করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের কাছে ওই রাসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর
সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং
অবশ্যঅবশ্য তাঁকে সাহায্য করবে’।” [আল-কুরআন, ৩:৮১]
ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:) বলেন, “এই মহান আয়াতে করীমায় মহানবী (দ:)-এর
প্রতি পেশকৃত শ্রদ্ধা ও উচ্চ সম্মান একেবারেই স্পষ্ট। এতে আরও ইঙ্গিত আছে
যে অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর জীবদ্দশায় মহানবী (দ:)-কে প্রেরণ করা হলে
তাঁর রেসালাতের বাণী তাঁদের জন্যে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হতো। অতএব, তাঁর
রেসালাত ও রেসালাতের বাণী সাইয়্যেদুনা আদম (আ:) থেকে আরম্ভ করে শেষ বিচার
দিবস পর্যন্ত আগত সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্যে সার্বিক হিসেবে সাব্যস্ত হয় এবং
সকল আম্বিয়া (আ:) ও তাঁদের উম্মত-ও মহানবী (দ:)-এর উম্মতের অন্তর্গত বলে
গণ্য হন। এ কারণে ‘আমাকে সকল জাতির জন্যে প্রেরণ করা হয়েছে’ মর্মে
রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীসটি শুধু তাঁর সময়কার ও শেষ বিচার দিবস অবধি আগত
মনুষ্যকুলের জন্যে উচ্চারিত হয়নি, বরং এতে অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের
পূর্ববর্তীরাও। এ বিষয়টি আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে তাঁর নিম্নবর্ণিত
হাদীসকে, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান: ‘আমি তখনো নবী ছিলাম, যখন আদম (আ:) রূহ
এবং দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন।’ মহানবী (দ:) যে নবী (আ:)-দের নবী
(দ:), সেটি জানা যায় তখনই, যখন দেখতে পাই মে’রাজ রজনীতে সকল আম্বিয়া (আ:)
তাঁর ইমামতিতে নামায পড়েছিলেন। পরকালে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব আরও স্পষ্ট হবে,
যখন সকল আম্বিয়া (আ:) তাঁর-ই পতাকাতলে সমবেত হবেন।”
জিসম মোবারকের সৃষ্টি
হযরত কা’আব আল-আহবার (রা:) বলেন, “আল্লাহতা’লা যখন সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন তিনি ফেরেশতা
হযরত জিবরীল আমীন (আ:)-কে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু হতে মাটি আনতে বল্লেন,
যেটি হলো ওর সৌন্দর্য ও নূর (জ্যোতি)। অতঃপর হযরত জিবরীল (আ:) জান্নাতুল
ফেরদৌস ও রফীকে আ’লার ফেরেশতাদেরকে সাথে নিয়ে (ধরণীতে) নেমে আসেন এবং
মহানবী (দ:)-এর মোবারক দেহ সৃষ্টির জন্যে (বর্তমানে) যেখানে রাসূলুল্লাহ
(দ:)-এর রওযা শরীফ অবস্থিত, সেখান থেকে এক মুঠাে মাটি নেন। সেই মাটি ছিল
ধবধবে সাদা এবং নূরানী তথা আলো বিচ্ছুরণকারী। এরপর ফেরেশতা জিবরীল (আ:) ওই
পবিত্র মাটিকে জান্নাতের ‘তাসনিম’ নহরের সেরা সৃষ্ট পানির সাথে মিশিয়ে নেন,
যতোক্ষণ পর্যন্ত না তা তীব্র প্রভা বিকীরণকারী সাদা মুক্তোর মতো হয়ে
গিয়েছিল। ফেরেশতাবৃন্দ তা বহন করে সুউচ্চ আরশ, পাহাড়-পর্বত ও সাগর-মহা সাগর
ঘুরে বেড়ান। এভাবেই ফেরেশতাবৃন্দ ও সকল সৃষ্টি আমাদের আকা ও মওলা মহানবী
(দ:) সম্পর্কে জানতে পারেন, যা তাঁরা হযরত আদম (আ:)-কে জানারও আগে
জেনেছিলেন।” [অনুবাদকের জরুরি জ্ঞাতব্য: হযরত কা’আব আল-আহবারের
‘মাটি’ সম্পর্কিত ওপরের বর্ণনার ব্যাপারে উলামাবৃন্দের দ্বিমত আছে।
উল্লেখ্য যে, এটি কোনো হাদীস নয়, বরং রেওয়ায়াত তথা বর্ণনা। প্রখ্যাত আলেম
মরহুম মওলানা আবদুল জলীল সাহেব হুজুরের ‘নূর-নবী’ বইটিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত
আলোচনা করা হয়েছে। তা থেকে নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো - “উপরোক্ত
কা’আব আহবার (রা:)-এর রেওয়ায়াত খানার বিচার-বিশ্লেষণ করলে নিচের জ্ঞাতব্য
বিষয়গুলো বের হয়ে আসে। যথা: ১/ কা’ব আহবার (রা:) আগে একজন বড় ইহুদী পণ্ডিত
ছিলেন। রাসূল (দ:)-এর যুগে তিনি মুসলমান হননি। সুতরাং সাহাবী নন। তিনি হযরত
আবূ বকর (রা:) বা হযরত উমর (রা:)-এর খেলাফত আমলে মুসলমান হয়ে তাবেঈনদের
মধ্যে গণ্য হন। সাহাবীর বর্ণিত হাদীস রাসূল (দ:)-এর পবিত্র জবানে শ্রুত হলে
তাকে ‘মারফু মোত্তাসিল’ বলে। আর রাসূল (দ:)-এর উল্লেখ না থাকলে ’মাওকুফ’
বলা হয় এবং তাবেঈর বর্ণিত হাদীস যার মধ্যে সাহাবী (রা:) ও রাসূল (দ:)-এর
হাওয়ালার উল্লেখ নেই, তাকে বলা হয় ’মাকতু’। ... তাবেঈ’র বর্ণিত ‘মাকতু’
হাদীস যদি রাসূল (দ:)-এর বর্ণিত হাদীসের সাথে গরমিল বা বিপরীত হয়, তাহলে
সাহাবীর বর্ণিত ’মারফু’ হাদীস-ই গ্রহণযোগ্য হবে। কা’আব আহবারের ’মাটির
হাদীসখানা’ নিজস্ব এবং তৃতীয় পর্যায়ের। আর ইতিপূর্বে বর্ণিত হযরত জাবের
(রা:)-এর ‘নূরের হাদীসখানা’ প্রথম পর্যায়ের। গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রথম
স্থানের হাদীস-ই অগ্রগণ্য। সুতরাং উসূলের বিচারে কা’আব আহবারের ’হাদীসখানা’
দুর্বল ও ’মোরসাল’ এবং সহীহ সনদেরও খেলাফ। সোজা কথায়, তাবেঈ’র বর্ণিত
হাদীস সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের সমকক্ষ হতে পারে না। ২/ আল্লামা
যুরকানী মালেকী (রহ:) বলেন, কা’আব আহবার আগে ইহুদী পণ্ডিত ছিলেন। সম্ভবতঃ
তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থে ইসরাঈলী বর্ণনার মাধ্যমে এই তথ্য পেয়ে থাকবেন। এই
সম্ভাবনার কারণে ইসরাঈলী বর্ণনা হলে তা আমাদের শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হবে না -
যদি তা অন্য হাদীসের বিপরীত হয়। কা’আব আহবারের বর্ণিত হাদীসটি হযরত জাবের
(রা:)-এর বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী। ৩/ তদুপরি অারবী ’তীনাত’ শব্দটির অর্থ
মাটি নয়, বরং ‘খামির’। এই ‘খামিরের’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘বাহাউল আরদ্’,
‘কালবুল আরদ’ ও ‘নূরুল আরদ্’ শব্দগুলো দ্বারা। সুতরাং জিবরাঈল (আ:)-এর
সংগ্রহ করা বস্তুটি সরাসরি মাটি ছিল না। বরং মাটি হতে উৎপন্ন নূর ও তার
সারাংশ। এই নূর ও সারাংশটি-ই পরে বেহেস্তের তাছনীম ঝর্ণার পানি দিয়ে
মিশ্রিত করে এটাকে আরও অণু-পরমাণুতে পরিণত করা হয়েছিল। যেমন পানি হতে
বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। তাই বলে বিদ্যুৎকে পানি বলা যাবে না। নবী করীম (দ:)-এর
দেহ মোবারক ছিল সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্মতম। এ মর্মে একখানা হাদীস
’হাকীকতে মোহাম্মদী ও মীলাদে আহমদী’ শীর্ষক বাংলা গ্রন্থে উদ্ধৃত
হয়েছে।....(এরশাদ হয়েছে), ‘আমরা তথা আম্বিয়া (আ:)-এর শরীর হলো ফেরেশতাদের
শরীরের মতো নূরানী ও অতি সূক্ষ্ম।’ তাই তো রাসূল (দ:) সূক্ষ্মতম শরীর
ধারণপূর্বক আকাশ ও ফেরেশতা জগতের, এমন কি আলমে আমর তথা আরশ কুরছি ভেদ করে
নিরাকারের দরবারে পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাটির দেহ ভারী এবং তা
লক্ষ্যভেদী নয়। মোদ্দা কথা, ওপরের দু’খানা হাদীস পর্যালোচনা করলে হযরত ইবনে
মাসউদ (রা:)-এর বর্ণিত প্রথম হাদীসখানা জাল এবং কা’আব আহবারের দ্বিতীয়টি
ইসরাঈলী সূত্রে প্রাপ্ত বর্ণনা যা ‘হাদীসে মারফু’র খেলাফ। তদুপরি কা’আব
আহবারের হাদীসখানায় বিভিন্ন তা’বিল বা (ভিন্নতর) ব্যাখ্যা করার অবকাশ
রয়েছে। এটি মোহকাম বা স্থিরীকৃত নয়। সুতরাং হযরত জাবের (রা:)-এর ‘মারফু’
হাদীস ত্যাগ করে কা’আব আহবার (রা:)-এর ‘মাকতু’ রেওয়ায়াত গ্রহণযোগ্য নয়”
(মৌলানা এম, এ, জলীল কৃত ‘নূর-নবী’, ৭-৯ পৃষ্ঠা)।
পাঠকমণ্ডলী এই বইটি
অনলাইনে পাবেন নিচের সাইটে:
https://www.scribd.com/doc/160412604/Nur-Nabi-Peace-be-upon-him;
’হাকীকতে মোহাম্মদী ও মীলাদে আহমদী’ বইটি পাবেন এই সাইটে -
http://www.mediafire.com/view/o0sik0ve78biv4g/%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A7%87%20%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%A6%E0%A7%80%20%E0%A6%93%20%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%20%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A6%AE%E0%A6%A6%E0%A7%80.pdf]
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর (ওই) মাটির মূল উৎস পৃথিবীর
নাভি হতে উৎসারিত, যা মক্কা মোয়াযযমায় কা’বা ঘর যেখানে অবস্থিত, সেখানেই
কেন্দ্রীভূত। অতএব, সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম
সৃষ্টির উৎসমূলে পরিণত হন, আর সকল সৃষ্টি তাঁর-ই অনুসরণকারী হন।”
’আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ গ্রন্থপ্রণেতা (সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন
সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন যে (হযরত নূহ আলায়হিস্ সালামের
যুগের) মহাপ্লাবনের সময় স্রোতের তোড়ে মহানবী (দ:)-এর মৌল সত্তা মদীনা
মোনাওয়ারায় তাঁর বর্তমানকালের রওযা শরীফের কাছে এসে অবস্থান নেন। তাই তিনি
মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারা উভয় স্থানের বাসিন্দা হিসেবে পরিণত হন।
বর্ণিত আছে যে আল্লাহ পাক যখন হযরত আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি
তাঁকে এ আরজি পেশ করতে অনুপ্রাণিত করেন, “এয়া আল্লাহ! আপনি কেন আমাকে ‘আবূ
মুহাম্মদ’ (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পিতা) নামে
ডেকেছেন?” আল্লাহতা’লা জবাবে বলেন, “ওহে আদম! তোমার মাথা তোলো!” তিনি শির
মোবারক তুলে (খোদার) আরশের চাঁদোয়ায় মহানবী (দ:)-এর নূর মোবারক দেখতে পান।
হযরত আদম (আ:) আরয করেন, “এই জ্যোতি কিসের?” জবাবে আল্লাহ পাক ফরমান, “এটি
তোমারই ঔরসে অনাগত এক নবী (দ:)-এর জ্যোতি। আসমানে (বেহেশ্তে) তাঁর নাম আহমদ
(সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম), আর দুনিয়াতে হলো মুহাম্মদ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আ’লেহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁকে সৃষ্টি না করলে আমি
তোমাকে, বা আসমান, অথবা জমিন কিছুই সৃষ্টি করতাম না।”
ইমাম আব্দুর রাযযাক (রহ:) বর্ণনা করেন হযরত জাবের বিন আব্দিল্লাহ (রা:)
হতে, যিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমার
পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। (অনুগ্রহ
করে) আমায় বলুন, আল্লাহতা’লা সর্বপ্রথম বা সর্বাগ্রে কী সৃষ্টি করেন?’
জবাবে মহানবী (দ:) বলেন, ‘ওহে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ পাক সর্বাগ্রে তোমার
নবী (দ:)-এর নূর (জ্যোতি)-কে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেন। ওই নূর আল্লাহতা’লা
যেখানে চান, সেখানেই তাঁর কুদরতে ঘুরতে আরম্ভ করেন। সেসময় না ছিল লওহ, না
কলম, না বেহেশ্ত, না দোযখ, না ফেরেশ্তাকুল, না আসমান, না জমিন, না সূর্য,
না চন্দ্র, না জ্বিন-জাতি, না মনুষ্যকুল। আল্লাহতা’লা যখন সৃষ্টিকুলকে
সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন তিনি ওই নূরকে চারভাগে বিভক্ত করলেন। অতঃপর প্রথম
অংশটি হতে তিনি কলম সৃষ্টি করেন; লওহ সৃষ্টি করেন দ্বিতীয় অংশ থেকে, আর
তৃতীয় অংশ থেকে আরশ সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি চতুর্থ অংশটিকে আবারও চারভাগে
বিভক্ত করেন। ওর প্রথম অংশ দ্বারা তিনি আরশের (আজ্ঞা)-বাহকদের (তথা
শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাদের) সৃষ্টি করেন; দ্বিতীয় অংশ দ্বারা কুরসী সৃষ্টি
করেন; আর তৃতীয় অংশটি দ্বারা বাকি সকল ফেরেশতাকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি
চতুর্থ অংশকে আবারও চারভাগে বিভক্ত করেন: প্রথম অংশটি দ্বারা তিনি সমস্ত
আসমান সৃষ্টি করেন; দ্বিতীয় অংশটি দ্বারা সমস্ত জমিন সৃষ্টি করেন; তৃতীয়
অংশটি দ্বারা বেহেশ্ত ও দোযখ সৃষ্টি করেন। এরপর আবারও তিনি চতুর্থ অংশটিকে
চারভাগে বিভক্ত করেন: প্রথম অংশ থেকে তিনি ঈমানদারদের দর্শনক্ষমতার নূর
সৃষ্টি করেন; দ্বিতীয় অংশ থেকে অন্তরের নূর (তথা আল্লাহকে জানার যোগ্যতা)
সৃষ্টি করেন; আর তৃতীয় অংশ থেকে মো’মেন (বিশ্বাসী)-দের সুখ-শান্তির নূর
(উনস্, অর্থাৎ, ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কলেমাটি)
সৃষ্টি করেন।”
অপর এক বর্ণনা হযরত আলী ইবনে আল-হুসাইন (রহ:), তিনি তাঁর পিতা (রা:) হতে,
তিনি তাঁর প্রপিতা (রা:) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:) হতে রেওয়ায়াত করেন;
মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “আমি ছিলাম এক নূর আমার প্রভু খোদাতা’লার দরবারে,
এবং তা হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টিরও চৌদ্দ হাজার বছর আগে।” বর্ণিত আছে যে
আল্লাহতা’লা যখন আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি ওই নূরে মুহাম্মদী
(দ:)-কে তাঁর পিঠে স্থাপন করেন; আর সেই নূর তাঁর সম্মুখভাগে এমন আলো
বিচ্ছুরণ করতেন যে তাঁর (আদমের) অন্যান্য জ্যোতি তাতে ম্লান হয়ে যেতো। এরপর
আল্লাহ পাক সেই নূরকে তাঁরই মহাসম্মানিত আরশে উন্নীত করেন এবং ফেরেশতাদের
কাঁধে বহন করান; আর তিনি তাঁদের প্রতি আদম (আ:)-কে সমস্ত আসমান ঘুরিয়ে
তাঁরই সৃষ্টি-সাম্রাজ্যের (শ্রেষ্ঠতম) বিস্ময়গুলো দেখাতে আদেশ দেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “হযরত আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করা হয় শুক্রবার
অপরাহ্নে। আল্লাহতা’লা অতঃপর ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর বাঁ পাঁজর থেকে তাঁরই
স্ত্রী বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠে মা হাওয়াকে দেখে
স্বস্তি বোধ করেন এবং নিজ হাত মোবারক তাঁর দিকে বাড়িয়ে দেন। ফেরেশতাবৃন্দ
বলেন, ‘ওহে আদম (আ:)! থামুন।’ তিনি এমতাবস্থায় প্রশ্ন করেন, ‘কেন,
আল্লাহতা’লা কি একে আমার জন্যে সৃষ্টি করেননি?’ ফেরেশতাবৃন্দ বলেন, ‘আপনার
দ্বারা তাঁকে দেনমোহর পরিশোধ না করা পর্যন্ত নয়।’ তিনি আবার প্রশ্ন করেন,
‘তার দেনমোহর কী?’ জবাবে ফেরেশতাবৃন্দ বলেন, ‘সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি তিনবার সালাত-সালাম (দুরুদ)
পাঠ’।” [অপর রেওয়ায়াতে আছে বিশবার]
আরও বর্ণিত আছে যে হযরত আদম (আ:) বেহেশত ত্যাগ করার সময় আরশের পায়ায় এবং
বেহেশতের সর্বত্র আল্লাহতা’লার নামের পাশে মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারক
লিপিবদ্ধ দেখতে পান। তিনি আরয করেন, “হে প্রভু, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে?” আল্লাহ পাক জবাব দেন, “তিনি তোমার পুত্র, যাঁকে
ছাড়া আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।” অতঃপর হযরত আদম (আ:) ফরিয়াদ করেন, “হে
প্রভু, এই পুত্রের অসীলায় (খাতিরে) এই পিতার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন।”
আল্লাহতা’লা উত্তরে বলেন, “ওহে আদম! আসমান ও জমিনের অধিবাসীদের জন্যে যদি
তুমি মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর মধ্যস্থতায় (অসীলায়)
সুপারিশ করতে, আমি তা গ্রহণ বা মঞ্জুর করতাম।”
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ
ফরমান: “আদম (আ:) কর্তৃক নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তিনি আরয করেন, ‘এয়া
অাল্লাহ! সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর
অসীলায় আমায় ক্ষমা করুন।’ আল্লাহতা’লা বলেন, ‘তুমি তাঁকে কীভাবে চেনো, আমি
তো এখনো তাঁকে সৃষ্টি করিনি?’ হযরত আদম (আ:) উত্তর দেন, ‘হে প্রভু, এটি এ
কারণে যে আপনি যখন আপনার কুদরতী হাতে আমায় সৃষ্টি করেন এবং আমার দেহে আমার
রূহ ফোঁকেন, তখন আমি মাথা তুলে আরশের পায়ায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (কলেমা) বাক্যটি লিপিবদ্ধ দেখতে পাই। অামি বুঝতে
পারি, সৃষ্টিকুলে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কারো নাম-ই আপনি আপনার নামের পাশে
যুক্ত করেছেন।’ অতঃপর আল্লাহ পাক বলেন, ‘ওহে আদম! তুমি সত্য বলেছো। আমার
সৃষ্টিকুলে তিনি-ই আমার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন। আর যেহেতু তুমি তাঁর-ই অসীলায়
আমার কাছে চেয়েছো, সেহেতু তোমাকে ক্ষমা করা হলো। মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যদি না হতেন, তাহলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না। তিনি
তোমারই বংশে পয়গম্বর-মণ্ডলীর সীলমোহর’।”
হযরত সালমান ফারিসী (রা:)-এর এক বর্ণনায় জানা যায়, হযরত জিবরীল আমীন (আ:)
অবতীর্ণ হয়ে মহানবী (দ:)-কে বলেন: “আপনার প্রভু খোদাতা’লা বলেন, ‘আমি
ইবরাহীম (আ:)-কে আমার খলীল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করলে আপনাকেও (হে হাবীব)
তা হিসেবেই গ্রহণ করেছি। আপনার চেয়ে আমার এতো কাছের জন হিসেবে আর কাউকেই
আমি সৃষ্টি করিনি; উপরন্ত, আমি এই বিশ্বজগতকে এবং এর অধিবাসীদেরকে সৃষ্টি
করেছি কেবল আপনার শান-মান এবং আপনি আমার কতো প্রিয় তা জানাবার উদ্দেশ্যেই;
আপনি না হলে আমি এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করতাম না’।”
হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়ার ঘরে বিশ বারে সর্বমোট চল্লিশজন পুত্রসন্তানের
জন্ম হয়। কিন্তু মা হাওয়ার গর্ভে সাইয়্যেদুনা শীষ (আ:)-এর জন্ম হয়
আলাদাভাবে। এর কারণ হলো আমাদের মহানবী (দ:)-এর প্রতি তা’যিম বা শ্রদ্ধা
প্রদর্শন, যাঁর নূর মোবারক হযরত আদম (আ:) থেকে শীষ (আ:)-এর মাঝে
স্থানান্তরিত হয়েছিল। সাইয়্যেদুনা আদম (আ:)-এর ’বেসাল’ তথা খোদার সাথে
পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির আগে তিনি শীষ (আ:)-এর জিম্মায় তাঁর (ভবিষ্যত)
প্রজন্মকে রেখে যান; আর এরই ধারাবাহিকতায় শীষ (আ:)-ও সন্তানদেরকে আদম
(আ:)-এর অসীয়তনামা হস্তান্তর করেন; সেই অসীয়ত হলো, শুধু পুতঃপবিত্র ও
নির্মল (আত্মার) নারীর মাঝে ওই নূর হস্তান্তর করা। এই অসীয়ত শতাব্দীর পর
শতাব্দী ধরে চলেছিল, যতোক্ষণ না আল্লাহ পাক আব্দুল মোত্তালিব ও তাঁর পুত্র
আবদুল্লাহকে এই নূর মঞ্জুর করেন। এভাবেই আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর
পূর্বপুরুষদের বংশপরম্পরাকে মূর্খদের অবৈধ যৌনাচার থেকে পুতঃপবিত্র
রেখেছিলেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি বিবৃত
করেন: “মূর্খতাজনিত অবৈধ যৌনাচার আমার বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন)-কে স্পর্শ
করেনি। আমার বেলাদত হয়েছে ইসলামী বিবাহ রীতির ফলশ্রুতিতেই।”
হিশাম ইবনে মোহাম্মদ আল-কালবী বর্ণনা করেন তাঁর বাবার ভাষ্য, যিনি বলেন:
“আমি রাসূলে খোদা (দ:)-এর উর্ধ্বতন (বা পূর্ববর্তী) বংশীয় পাঁচ’শ জন মায়ের
হিসেব আমার গণনায় পেয়েছি। তাঁদের কারো মাঝেই কোনো অবৈধ যৌনাচারের লেশচিহ্ন
মাত্র আমি খুঁজে পাইনি, যেমনটি পাইনি অজ্ঞদের কর্মকাণ্ড।”
সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (ক:) বর্ণনা করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর হাদীস, যিনি
এরশাদ ফরমান: “আমি বিয়ের ফলশ্রুতিতেই বেলাদত-প্রাপ্ত হয়েছি, অবৈধ যৌনাচার
থেকে নয়; আবির্ভূত হয়েছি আদম (আ:) হতে বংশপরম্পরায় আমার পিতামাতার ঘরে।
মূর্খতাজনিত অবৈধ যৌনাচারের কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করেনি।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) রেওয়ায়াত করেন মহানবী (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ
ফরমান: “আমার পিতামাতা কখনোই অবৈধ যৌনাচার করেননি। আল্লাহতা’লা আমাকে
পুতঃপবিত্র ঔরস থেকে পুতঃপবিত্র গর্ভে স্থানান্তর করতে থাকেন; যখনই দুটো
(বিকল্প) পথ সামনে এসেছে, আমি সেরা পথটি-ই পেয়েছি।”
হযরত আনাস (রা:) বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (দ:) ‘লাকাদ জা’আকুম রাসূলুম্
মিন আনফুসিকুম’- আয়াতটি তেলাওয়াত করেন এবং বলেন: “আমি আমার খানদান,
আত্মীয়তা ও পূর্বপুরুষের দিক দিয়ে তোমাদের মাঝে সেরা; হযরত আদম (আ:) হতে
আরম্ভ করে আমার পূর্বপুরুষদের কেউই অবৈধ যৌনাচার করেননি।”
সাইয়্যেদাহ আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) মহানবী (দ:) হতে বর্ণনা করেন যে হযরত
জিবরীল আমীন (আ:) বলেন, “আমি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত খুঁজেও
মহানবী (দ:)-এর মতো সেরা ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাইনি; আর বনূ হাশিম গোত্রের
পুত্রদের মতো কোনো বাবার সন্তানের দেখাও পাইনি আমি।”
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর
হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আদম সন্তানদের সেরা
প্রজন্মে, একের পর এক, যতোক্ষণে আমি না পৌঁছেছি আমার (বর্তমান)-টিতে।”
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত ওয়াতিলা ইবনে আল-আসকা’ বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ
(দ:) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ পাক হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর পুত্রদের মধ্যে
কেনানাকে বেছে নিয়েছেন এবং কেনানা হতে কুরাইশ গোত্রকে পছন্দ করেছেন; অার
কুরাইশ গোত্র হতে বনূ হাশিমকে বেছে নিয়েছেন; এবং চূড়ান্তভাবে হাশিমের
পুত্রদের মাঝে আমাকেই পছন্দ করেছেন।”
হযরত আব্বাস (রা:) রেওয়ায়াত করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বাণী, যিনি বলেন:
“সৃষ্টিকুলের অস্তিত্ব দেয়ার পর আল্লাহ পাক আমাকে সেরা দলগুলোতে অধিষ্ঠিত
করেন; এবং দুটো দলের মধ্যে সেরা দলে (আমি অধিষ্ঠিত হই)। অতঃপর তিনি
গোত্রগুলো বেছে নেন এবং সেগুলোর সেরা পরিবারটিতে আমাকে অাবির্ভূত করেন।
অতএব, আমার ব্যক্তিত্ব, আত্মা ও স্বভাব সর্বসেরা এবং আমি এগুলোর সেরা উৎস
হতে আগত।”
হযরত ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ
ফরমান: “আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলকে যাচাই করে আদম সন্তানদেরকে তা থেকে
বাছাই করেন; এরপর তিনি আদম সন্তানদেরকে যাচাই করে তাদের মধ্য থেকে আরবদেরকে
মনোনীত করেন; অতঃপর তিনি আরবদেরকে যাচাই করে আমাকে তাদের মধ্য হতে পছন্দ
করে নেন। অতএব, আমি-ই সব পছন্দের সেরা পছন্দ। সতর্ক হও, আরবদেরকে যে
মানুষেরা ভালোবাসে, তা আমার প্রতি ভালোবাসার কারণেই ভালোবাসে; আর যারা
আরবদেরকে ঘৃণা করে, তারা আমাকে ঘৃণা করার কারণেই তা করে থাকে।”
জ্ঞাত হওয়া দরকার যে সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী
ওয়া সাল্লাম তাঁর পিতামাতা হতে সরাসরি (জন্ম নেয়া) কোনো ভাই বা বোনের সাথে
সম্পর্কিত ছিলেন না; তিনি ছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান এবং তাঁর খানদান
তাঁরই কাছে এসে শেষ হয়। এভাবে তিনি এক অনন্য খানদানে বেলাদত-প্রাপ্ত
হয়েছিলেন যা আল্লাহতা’লা (তাঁরই) নবুয়্যতের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার জন্যে
এরাদা (ঐশী ইচ্ছে) করেছিলেন, যে নব্যুয়ত সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী।
আপনারা যদি মহানবী (দ:)-এর উচ্চ বংশমর্যাদা ও তাঁর পবিত্র বেলাদত (ধরাধামে
শুভাগমন) সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তবে আপনারা তাঁর মহাসম্মানিত
পূর্বপুরুষদের ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। কেননা, তিনি হচ্ছেন আন্ নবী (দ:),
আল-আরবী (দ:), আল-আবতাহী (দ:), আল-হারাআমী (দ:), আল-হাশেমী (দ:),
আল-কুরাইশী (দ:), হাশেমী সন্তানদের সেরা, সেরা আরব গোত্রগুলোর মধ্য হতে
পছন্দকৃত, সেরা বংশোদ্ভূত, সর্বশ্রেষ্ঠ খানদানে আগত, সেরা বর্ধনশীল শাখা,
সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ, সেরা উৎস, সবচেয়ে মজবুত ভিত, সুন্দরতম বাচনভঙ্গির
অধিকারী, সবচেয়ে বোধগম্য শব্দচয়নকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ নির্ণায়ক মানদণ্ড,
সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গ, পিতামাতার দু’দিক
থেকেই সবচেয়ে সম্মানিত আত্মীয়স্বজন, এবং আল্লাহতা’লার জমিনে সবচেয়ে
সম্মানিত ভূমি (আরবদেশ) হতে আগত। তাঁর অনেক মোবারক নাম রয়েছে, যার
সর্বাগ্রে হলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, যিনি আবদুল্লাহ’র
পুত্র। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে রয়েছেন তাঁরই দাদা আবদুল মোত্তালিব, যাঁর
নাম শায়বাত আল-হামদ; হাশেমের পুত্র আমর, আবদ মানাআফের পুত্র আল-মুগীরা,
কুসাইয়ের পুত্র মোজাম্মী’, কিলাআবের পুত্র হাকীম, মুররার পুত্র, (কুরাইশ
গোত্রীয়) কাআবের পুত্র, লু’আইয়ের পুত্র, গালিবের পুত্র, ফিহর-এর পুত্র,
যাঁর নাম কুরাইশ, মালেকের পুত্র, আল-নাযহিরের পুত্র, যাঁর নাম কায়েস,
কিনানার পুত্র, খুযায়মার পুত্র, মুদরিকার পুত্র, ইলিয়াসের পুত্র, মুদারের
পুত্র, নিযারের পুত্র, মাআদ্দ-এর পুত্র, আদনানের পুত্র।
ইবনে দিহিয়া বলেন, “উলেমাবৃন্দ (এ ব্যাপারে) একমত এবং জ্ঞানীদের এই ঐকমত্য
একটি প্রামাণ্য দলিল যে মহানবী (দ:) তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম আদনান পর্যন্ত
উল্লেখ করেছেন এবং এর ওপরে আর যাননি।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন যে সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া আলেহী ওয়া সাল্লাম তাঁর পূর্বপুরুষদের বংশপরম্পরা উল্লেখ করার
সময় কখনোই আদনানের পুত্র মা’আদ্দ-এর ওপরে যেতেন না, বরঞ্চ এ কথা বলে শেষ
করতেন, “বংশ বর্ণনাকারীরা (উদ্ভববিজ্ঞানীরা) মিথ্যে বলেছে।” এ কথা তিনি
দু’বার বা তিনবার বলতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “আদনান ও হযরত
ইসমাঈল (আ:)-এর মধ্যে ত্রিশজন পূর্বপুরুষের নাম অজ্ঞাত রয়েছে।”
কাআব আল-আহবার (রহ:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর নূর (জ্যোতি) আবদুল মোত্তালিবের
কাছে পৌঁছুবার কালে তিনি পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন; ওই সময় এক রাতে
তিনি কা’বা ঘরের বহিঃপ্রাঙ্গনে ঘুমিয়েছিলেন। (সকালে) জেগে উঠলে তাঁর চোখ
দুটো কালো সুরমামাখা ও চুল তেলমাখা এবং পরনে সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ জামাকাপড়
দেখা যায়। কে এ রকম করেছেন, তা না জানার দরুন তিনি বিস্মিত হন। তাঁর পিতা
তাঁকে হাত ধরে দ্রুত কুরাইশ বংশীয় গণকদের কাছে নিয়ে যান। তারা তাঁর পিতাকে
বলেন পুত্রকে বিয়ে দিতে। তিনি তা-ই করেন। আবদুল মোত্তালিবের শরীর থেকে
সর্বশ্রেষ্ঠ মেশকের গন্ধ বের হতো, আর তাঁর ললাট হতে উজ্জ্বল প্রভা ছড়াতো
নূরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। কখনো খরা দেখা দিলে
কুরাইশ গোত্র তাঁকে ‘সাবীর’পর্বতে নিয়ে যেতো এবং তাঁরই অসীলায় আল্লাহর
দরবারে বৃষ্টি প্রার্থনা করতো। আল্লাহ পাক-ও তাদের প্রার্থনার জবাব দিতেন
এবং নূরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে
ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাতিরে বৃষ্টি বর্ষণ করতেন।”
ইয়েমেনী রাজা আবরাহা যখন পবিত্র কা’বা ঘর ধ্বংসের অভিপ্রায়ে মক্কা শরীফ
অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং এর খবর কুরাইশ গোত্রের কাছে পৌঁছে, তখন আবদুল
মোত্তালিব তাদের বলেন, “সে (বাদশাহ) এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছুবে না, কারণ এটি
মহান প্রভুর সুরক্ষায় আছে।” মক্কা মোয়াযযমার পথে বাদশাহ আবরাহা কুরাইশ
গোত্রের অনেক উট ও ভেড়া লুঠপাট করে; এগুলোর মধ্যে ছিল আবদুল মোত্তালিবের
মালিকানাধীন চার’শ মাদী উট। এমতাবস্থায় তিনি সওয়ারি হয়ে অনেক কুরাইশকে সাথে
নিয়ে ’সাবীর’ পর্বতে আরোহণ করেন। সেখানে নূরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর কপালে অর্ধ চন্দ্রাকারে দৃশ্যমান হয় এবং সেটির
আলোকোচ্ছ্বটা পবিত্র (কা’বা) ঘরে প্রতিফলিত হয়। আবদুল মোত্তালিব তা দেখার
পর বলেন, “ওহে কুরাইশ গোত্র, তোমরা এখন ফিরে যেতে পারো, কেননা কা’বা এখন
নিরাপদ। আল্লাহর কসম! এই কিরণ (নূর) যখন আমাকে ঘিরে রেখেছে, তখন কোনো
সন্দেহ নেই যে বিজয় আমাদেরই হবে।”
কুরাইশ গোত্রীয় মানুষেরা মক্কায় ফিরে গেলে আবরাহা রাজার প্রেরিত এক
ব্যক্তির সাথে তাদের দেখা হয়। আবদুল মোত্তালিবের চেহারা দেখে ওই ব্যক্তি
ভাবাবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং তাঁর জিহ্বা তোতলাতে থাকে; তিনি মুর্ছা যান, আর
তাঁর কণ্ঠ থেকে জবেহকৃত বৃষের আওয়াজ বেরুতে থাকে। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি
আব্দুল মোত্তালিবের পায়ে পড়ে যান এ কথা বলে, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি
সত্যিসত্যি কুরাইশ গোত্রের অধিপতি।”
বর্ণিত আছে যে আবদুল মোত্তালিব যখন বাদশাহ আবরাহার মুখোমুখি হন, ওই সময়
বাদশাহর সেনাবাহিনীতে সর্ববৃহৎ সাদা হাঁতিটি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে উট
যেভাবে হাঁটু গেড়ে নত হয় ঠিক সেভাবে নত হয়ে যায় এবং সেজদা করে। আল্লাহতা’লা
সেই প্রাণিকে বাকশক্তি দেন এবং সে বলে, “ওহে আবদুল মোত্তালিব, আপনার ঔরসে
নূর (-এ-মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি শান্তি
বর্ষিত হোক।” রাজা আবরাহার বাহিনী কা’বা ঘর ধ্বংস করার জন্যে অগ্রসর হলে ওই
হাঁতি আবারো হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারা সেটিকে দাঁড় করানোর জন্যে মাথায়
বেদম প্রহার করে, কিন্তু সেটি তা করতে অস্বীকার করে। তারা হাঁতিটিকে
ইয়েমেনের দিকে মুখ করালে সেটি উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর আল্লাহতা’লা বাদশাহর
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমুদ্র হতে এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেন, যেগুলোর
প্রত্যেকটি তিনটি করে পাথর বয়ে আনে: একটি পাথর ঠোঁটে, অপর দুটি দুই পায়ে।
এই পাথরগুলো আকৃতিতে ছিল মশুরি ডালের দানার সমান। এগুলো সৈন্যদেরকে আঘাত
করামাত্রই তারা মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকে। ফলে সৈন্যরা ভয়ে রণভঙ্গ দেয়।
এমতাবস্থায় আবরাহা এক কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার হস্তাঙ্গুলির ডগা এক
এক করে পড়ে যেতে থাকে। আর তার শরীর থেকে রক্ত ও পুঁজ-ও বের হয়। অবশেষে তার
হৃদযন্ত্র চৌচির হয়ে সে মারা যায়।
এই ঘটনাটি-ই আল্লাহতা’লা উল্লেখ করেছেন তাঁর পাক কালামে, যেখানে মহানবী
(দ:)-কে সম্বোধন করে তিনি এরশাদ ফরমান, “হে মাহবূব! আপনি কি দেখেননি আপনার
রব্ব (খোদাতা’লা) ওই হস্তী আরোহী বাহিনীর কী অবস্থা করেছেন?” [সূরা ফীল, ১ম
আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]। এই ঘটনা আমাদের
সাইয়্যেদুনা হযরতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি
ওয়া সাল্লামের উচ্চমর্যাদার এবং তাঁর রেসালাত ও তা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন
করে। এতে আরও ফুটে ওঠে তাঁরই উম্মতকে প্রদত্ত সম্মান ও তাঁদের প্রতি
(খোদার) হেফাযত (সুরক্ষা), যার দরুন সমস্ত আরব জাতিগোষ্ঠী তাঁদের কাছে
সমর্পিত হন এবং তাঁদের মহত্ত্ব ও বিশিষ্টতায় বিশ্বাস স্থাপন করেন। এটি এ
কারণেই সম্ভব হয়েছে যে আল্লাহ পাক তাঁদেরকে হেফাযত করেছেন এবং দৃশ্যতঃ অজেয়
আবরাহা বাদশাহর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদেরকে সমর্থন যুগিয়েছেন।
মায়ের গর্ভে প্রিয়নবী (দ:)
আবরাহা’র শ্যেনদৃষ্টি থেকে আল্লাহতা’লা কর্তৃক রক্ষা পাবার পর এক রাতে আবদুল
মোত্তালিব কা’বা ঘরের প্রাঙ্গনে ঘুমোবার সময় এক আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখেন।
তিনি জেগে ওঠে ভয় পান এবং কুরাইশ গোত্রীয় গণকদের কাছে গিয়ে এর বিবরণ দেন।
তারা তাঁকে বলে, “এ স্বপ্ন সত্য হলে আপনার ঔরসে এমন কেউ আসবেন যাঁর প্রতি
আসমান ও জমিনের বাসিন্দারা বিশ্বাস স্থাপন করবেন এবং যিনি সুপ্রসিদ্ধি লাভ
করবেন।” ওই সময় তিনি ফাতেমা নাম্নী এক মহিলাকে বিয়ে করেন, যাঁর গর্ভে জন্ম
নেন আবদুল্লাহ আল-যাবীহ (রা:), যাঁর ইতিহাসও সর্বজনবিদিত।
অনেক বছর পরে আবদুল্লাহ (রা:) নিজ জীবনরক্ষার সদকাহ-স্বরূপ এক’শটি উট
কোরবানি করে তাঁর পিতাসহ যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তাঁরা ফাতেমা নাম্নী এক
ইহুদী গণকের সাক্ষাৎ পান। সে কুরাইশ গোত্রের সেরা সুদর্শন যুবক আবদুল্লাহ
(রা:)-এর চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনার জন্যে যতোগুলো উট কোরবানি করা
হয়েছে, আমি ততোগুলো উট আপনাকে দেবো; তবে শর্ত হলো এই মুহূর্তে আপনাকে আমার
সাথে সহবাস করতে হবে।” তার এ কথা বলার কারণ ছিল সে আবদুল্লাহ (রা:)-এর
মুখমণ্ডলে নূরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) দেখতে
পেয়েছিল। আর সে এও আশা করেছিল সম্মানিত মহানবী (দ:)-এর মাতা সে-ই হতে
পারবে। কিন্তু আবদুল্লাহ (রা:) জবাব দেন:
হারামের মোকাবেলায় কাম্য কেবল মৃত্যু
আর আমি এতে দেখি না কোনো হালাল বা বৈধত্ব
বরঞ্চ এক্ষণে তোমার দ্বারা যা আমা হতে যাচিত
সম্মানী মানুষের তা হতে নিজ সম্মান ও দ্বীন রাখা চাই সুরক্ষিত।
পরের দিন আবদুল মোত্তালিব নিজ পুত্রকে ওয়াহাব ইবনে আবদ মানাআফের সাথে দেখা
করিয়ে দেন; ইনি ছিলেন বনূ যোহরা গোত্রপ্রধান, বংশ ও খানদানে তাদের অধিপতি।
আবদুল মোত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহ (রা:)-কে ওয়াহাবের কন্যা
আমিনা (রা:)-এর সাথে বিয়ে দেন; ওই সময় আমিনা (রা:) ছিলেন কুরাইশ গোত্রে বংশ
ও পারিবারিক দিক দিয়ে অন্যতম সেরা মহিলা। অতঃপর মিনা দিবসগুলোর মধ্যে কোনো
এক সোমবার আবূ তালিবের গিরিপথে তাঁরা দাম্পত্যজীবনের শুভসূচনা করেন এবং
মহানবী (দ:) তাঁর মায়ের গর্ভে আসেন।
তৎপরবর্তী দিবসে আবদুল্লাহ (রা:) ঘরের বাইরে বেরুলে ইতিপূর্বে তাঁর কাছে
প্রস্তাবকারিনী সেই মহিলার দেখা পান। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, “গতকাল যে
প্রস্তাব তুমি আমায় দিয়েছিলে, আজ কেন তা আমায় দিচ্ছ না?” সে প্রত্যুত্তরে
বলে, “গতকাল যে জ্যোতি তুমি বহন করেছিলে, তা আজ তোমায় ত্যাগ করেছে। তাই
আমার কাছে আজ আর তোমাকে প্রয়োজন নেই। আমি ওই নূর আমার (গর্ভ) মাঝে পেতে
চেয়েছিলাম, কিন্তু খোদাতা’লা তা অন্যত্র রাখার এরাদা করেছেন।”
মহানবী (দ:) তাঁর মা আমিনা (রা:)-এর গর্ভে আসার সূচনালগ্ন থেকেই বহু
মো’জেযা তথা অলৌকিক বা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটতে থাকে। সাহল ইবনে আবদিল্লাহ
আত্ তুসতরী (রহ:) বলেন, “আল্লাহতা’লা যখন রজব মাসের কোনো এক শুক্রবার রাতে
মহানবী (দ:)-কে তাঁর মায়ের গর্ভে পয়দা করেন, তখন তিনি বেহেশতের রক্ষক
রিদওয়ানকে সর্বসেরা বেহেশতের দ্বার খুলে দিতে আদেশ করেন। কেউ একজন আসমান ও
জমিনে ঘোষণা দেন যে অপ্রকাশ্য নূর যা দ্বারা হেদায়াতকারী পয়গম্বর
(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গঠিত হবেন, তা এই নির্দিষ্ট রাতেই তাঁর
মায়ের গর্ভে আসবেন, যেখানে তাঁর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া পূর্ণতা পাবে। আরও ঘোষিত
হয় যে তিনি সুসংবাদ দানকারী এবং সতর্ককারী হিসেবে (পৃথিবীতে) আবির্ভূত
হবেন।”
কাআব আল-আহবার (রহ:) থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী (দ:) তাঁর মায়ের গর্ভে আসার
রাতে আসমানসমূহে এবং জমিনের প্রতিটি প্রান্তে ঘোষণা করা হয় যে রাসূলুল্লাহ
(দ:)-কে যে অপ্রকাশ্য নূর হতে সৃষ্ট, তা তাঁর মা আমিনা (রা:)-এর গর্ভে
আসবেন।
উপরন্তু, ওই দিন পৃথিবীর বুকে যতো মূর্তি ছিল সবই মাথা নিচের দিকে এবং পা
ওপরের দিকে উল্টো হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশ গোত্র মারাত্মক খরাপীড়িত ও
দুর্দশাগ্রস্ত ছিল; কিন্তু এই মহা আশীর্বাদধন্য ঘটনার বদৌলতে ধরণীতল আবারও
শষ্যশ্যামল হয়ে ওঠে এবং বৃক্ষতরু ফলবতী হয়; আর আশীর্বাদ ও কল্যাণ (ওই
গোত্রের) চারপাশ থেকে তাদের দিকে ধাবমান হয়। এ সব মঙ্গলময় লক্ষণের জন্যে
সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া
সাল্লাম যে বছর তাঁর মায়ের গর্ভে আসেন, সেটিকে ‘বিজয় ও খুশির বছর’ বলা হয়।
ইবনে এসহাক বর্ণনা করেন যে আমিনা (রা:) সবসময়ই উল্লেখ করতেন মহানবী (দ:)
তাঁর গর্ভে থাকাকালীন সময়ে ফেরেশতাবৃন্দ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসার কথা;
আর তাঁকে বলা হতো, “এই জাতির অধিপতি আপনার গর্ভে অবস্থান করছেন।” তিনি এ
কথাও উল্লেখ করেন, “আমি কখনোই (মহানবীকে) গর্ভে ধারণ অবস্থায় অনুভব করিনি
যে আমি গর্ভবতী। আর আমি অন্যান্য গর্ভবতী নারীদের মতো কোনো অসুবিধা বা
খিদেও অনুভব করিনি। আমি শুধু লক্ষ্য করেছি যে আমার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে
গিয়েছে। একবার আমি যখন ঘুম আর জাগ্রতাবস্থার মাঝামাঝি ছিলাম, তখন কোনো এক
ফেরেশতা এসে আমাকে বলেন, ‘আপনি কি মনুষ্যকুলের অধিপতিকে গর্ভে ধারণ করার
অনুভূতি পাচ্ছেন?’ এ কথা বলে তিনি চলে যান। মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের সময়
ঘনিয়ে এলে তিনি আবার এসে আমাকে বলেন: ‘বলুন, আমি তাঁর (মহানবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া সাল্লামের) প্রতি প্রত্যেক বিদ্বেষভাব পোষণকারীর ক্ষতি থেকে
তাঁরই সুরক্ষার জন্যে মহান সত্তার মাঝে আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং তাঁর নাম
রাখি (সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া
সাল্লাম)’।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর দ্বারা তাঁরই মায়ের গর্ভে
আসার অলৌকিক ঘটনা (মো’জেযা)-গুলোর একটি হচ্ছে এই যে, ওই রাতে কুরাইশ
গোত্রের মালিকানাধীন সমস্ত পশুপাখি মুখ খুলে এ কথা বলেছিল, “কা’বাগৃহের
প্রভুর দোহাই, রাসূলুল্লাহ (দ:) (তাঁর মায়ের) গর্ভে এসেছেন। তিনি-ই হলেন
সারা জাহানের অধিপতি এবং এর অধিবাসীদের জ্যোতি (নূর)। এমন কোনো রাজার
সিংহাসন নেই যা আজ রাতে ওলটপালট না হয়ে গিয়েছে।” পূর্বাঞ্চলের তাবৎ পশুপাখি
পশ্চিমাঞ্চলের পশুপাখির কাছে এই খোশখবরী নিয়ে ছুটে গিয়েছে; আর অনুরূপভাবে
সাগরজলের অধিবাসীরাও একে অপরকে একইভাবে সম্ভাষণ জানিয়েছে। তাঁর গর্ভে আসার
মাসের প্রতিদিনই আসমানে এলান (ঘোষণা) দেয়া হয়েছে এবং জমিনেও এলান দেয়া
হয়েছে এভাবে: ‘খুশি উদযাপন করো, (কেননা) আশীর্বাদধন্য ও সৌভাগ্যবান আবূল
কাসেম আবির্ভূত হবার সময় সন্নিকটে।”
আরেকটি রেওয়ায়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ওই রাতে প্রতিটি ঘরই আলোকিত করা
হয়েছিল, আর ওই নূর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল; উপরন্তু, সমস্ত প্রাণিজগত-ও কথা
বলেছিল।
আবূ যাকারিয়্যা এয়াহইয়া ইবনে আইস্ বলেন, “সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর মায়ের গর্ভে পুরো নয় মাস অবস্থান
করেছিলেন, আর (ওই সময়) তাঁর মা কখনোই এমন কোনো ব্যথা বা অসুবিধা অনুভব
করেননি যা একজন গর্ভধারিনী মা গর্ভকালীন সময়ে অনুভব করে থাকে। তিনি সবসময়ই
বলতেন, ‘এই গর্ভের চেয়ে সহজ আর কোনো গর্ভ আমি প্রত্যক্ষ করিনি, এর চেয়ে
আশীর্বাদধন্য গর্ভও আমি দেখিনি’।”
আমিনা (রা:)-এর গর্ভকালের দ্বিতীয় মাসে আবদুল্লাহ (রা:) মদীনা মোনাওয়ারায়
তাঁরই বনূ নাজ্জার গোত্রীয় চাচাদের উপস্থিতিতে বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে
মিলন)-প্রাপ্ত হন। তাঁকে আল-আবওয়া’ নামের স্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময়
ফেরেশতাবৃন্দ বলেন, “হে আমাদের প্রভু ও মালিক! আপনার রাসূল (দ:) একজন
এয়াতিম হয়ে গিয়েছেন।” জবাবে আল্লাহ পাক বলেন, “আমি-ই হলাম তাঁর রক্ষক ও
সাহায্যকারী।”
মহানবী (দ:)-এর ধরাধামে আবির্ভাবে অলৌকিকত্ব
আমর ইবনে কুতায়বা তাঁর জ্ঞানী পিতা (কুতায়বা) থেকে শুনেছেন, তিনি বলেন:
“আমিনা (রা:)-এর গর্ভের চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হলে আল্লাহতা’লা ফেরেশতাদের
আদেশ দেন, ‘আসমানের সব দরজা ও বেহেশতের সব দরজাও খুলে দাও।’ ওই দিন সূর্য
তীব্র প্রভা দ্বারা সুসজ্জিত হয়, আর আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর ওয়াস্তে ওই
বছর পৃথিবীতে সকল নারীর গর্ভে পুত্র সন্তান মঞ্জুর করেন।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন যে আমিনা সবসময় বলতেন, “আমার গর্ভ যখন ছয় মাস,
তখন এক ফেরেশতা আমায় স্বপ্নে দেখা দেন এবং বলেন: ‘ওহে আমিনা, আপনি
বিশ্বজগতের সেরা জনকে গর্ভে ধারণ করেছেন। তাঁর বেলাদতের সময় আপনি তাঁর নাম
রাখবেন (সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া
সাল্লাম) এবং সেই নাম (মোবারক) গোপন রাখবেন।’ প্রসব বেদনা অনুভূত হতে শুরু
করলে কেউই জানেননি যে আমি ঘরে একা। আবদুল মোত্তালিব-ও জানতে পারেননি, কেননা
তিনি ওই সময় কা’বা ঘর তওয়াফ করছিলেন। আমি একটি প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পাই যা
আমাকে ভীতিগ্রস্ত করে। অতঃপর লক্ষ্য করতেই মনে হলো একটি সাদা পাখির ডানা
আমার হৃদয়ে (মধুর) পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, যার দরুন আমার সমস্ত শঙ্কা উবে যায়;
আর আমার অনুভূত সমস্ত (প্রসব) বেদনাও প্রশমিত হয়। আমার সামনে দৃশ্যমান হয়
এক সাদা রংয়ের শরবত, যা আমি পান করি। এরপর এক তীব্র জ্যোতি আমার প্রতি
নিক্ষেপিত হয় এবং আমি কয়েকজন মহিলা দ্বারা নিজেকে পরিবেষ্টিত দেখতে পাই।
এঁরা তালগাছের সমান লম্বা ছিলেন, আর এঁদেরকে দেখতে লাগছিল আবদ মানাআফ
গোত্রের নারীদের মতোই। আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে ভাবলাম, ‘এঁরা কীভাবে আমার
সম্পর্কে জানলেন?’ ওই মহিলাবৃন্দ আমাকে বলেন, ‘আমরা হলাম ফেরাউনের স্ত্রী
আসিয়া এবং ইমরানের কন্যা মরিয়ম।’ এদিকে আমার (শারীরিক) অবস্থা আরও তীব্র
আকার ধারণ করলে ধুপধাপ আওয়াজও বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায়
আরও ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় অামি হঠাৎ দেখতে পাই একখানি সাদা রেশমের
ফালি আসমান ও জমিনের মাঝে বিছিয়ে দেয়া হয় এবং কেউ একজন বলেন, ‘তাঁকে
লুকিয়ে রাখো যাতে মানুষেরা দেখতে না পায়।’ আমি আকাশে রূপার পানি ঢালার ‘জগ’
হাতে নিয়ে মানুষদেরকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। অতঃপর এক ঝাঁক পাখি এসে
আমার ঘর ভরে যায়; এগুলোর ঠোঁট ছিল পান্নার, আর ডানা লালমণির। আল্লাহতা’লা
এমতাবস্থায় আমার চোখের সামনে থেকে পর্দা উঠিয়ে নেন এবং আমি প্রত্যক্ষ করি
সারা পৃথিবীকে, পূর্ব হতে পশ্চিমে, যেখানে তিনটি পতাকা ছিল উড্ডীন: একটি
পূর্বদিকে, আরেকটি পশ্চিমদিকে এবং তৃতীয়টি কা’বা গৃহের ওপর। ঠিক সে সময়ই
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন)
হয়। তিনি ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই সেজদায় পড়ে যান এবং আসমানের দিকে হাত
তুলে বিনীতভাবে দোয়া করেন। অতঃপর আমি দেখতে পাই আসমানের দিক থেকে একটি সাদা
মেঘ এসে তাঁকে ঢেকে ফেলে, যার দরুন তিনি আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। একটি
কণ্ঠস্বরকে আমি বলতে শুনি, ‘তাঁকে দুনিয়ার সকল প্রান্তে নিয়ে যাও, পূর্ব ও
পশ্চিমদিকে, সাগর-মহাসাগরে, যাতে সবাই তাঁকে তাঁর (মোবারক) নামে,
বৈশিষ্ট্যে ও আকৃতিতে চিনতে পারে।’ এর পরপরই ওই সাদা মেঘমালা দ্রুত অদৃশ্য
হয়ে যায়।”
আল-খতীব আল-বাগদাদী (রহ:) বর্ণনা করেন আমিনা (রা:)-এর কথা, যিনি বলেন:
“আমার গর্ভে (সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া
সাল্লাম)-এর বেলাদত হওয়ার সময় আমি আধ্যাত্মিকতায় উদ্দীপ্ত আলোকোজ্জ্বল
একখানি বড় মেঘ দেখতে পাই, যা’তে অনেকগুলো ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, ডানা ঝাপটানোর
এবং মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ শুনি। ওই মেঘ তাঁকে ঢেকে ফেলে এবং তিনি আমার
দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। অতঃপর আমি একটি কণ্ঠস্বরকে বলতে শুনি,
‘(সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)-কে
সারা পৃথিবীতে ঘোরাও। তাঁকে জ্বিন, ইনসান, ফেরেশতা, বন্য পশুপাখির মতো
সমস্ত আত্মাবিশিষ্ট সত্তার কাছে প্রদর্শন করো। তাঁকে দাও আদম (আ:)-এর
(দৈহিক) আকৃতি; শীষ নবী (আ:)-এর জ্ঞান; নূহ (আ:)-এর সাহস; ইব্রাহীম (আ:)-এর
(মতোই খোদার) নৈকট্য; ইসমাঈল (আ:)-এর জিহ্বা; এসহাক (আ:)-এর (অল্পে)
তুষ্টি; সালেহ নবী (আ:)-এর বাগ্মিতা; লুত (আ:)-এর প্রজ্ঞা; এয়াকুব (আ:)-এর
(কাছে প্রদত্ত) শুভসংবাদ; মূসা (আ:)-এর শক্তি; আইয়ুব নবী (আ:)-এর ধৈর্য;
ইউনূস নবী (আ:)-এর তাবেদারী/আনুগত্য; ইউশা বিন নূন (আ:)-এর দ্বন্দ্বসংঘাত
মোকাবেলা করার সামর্থ্য; দাউদ (আ:)-এর প্রতি প্রদত্ত সুরক্ষা; দানিয়েল নবী
(আ:)-এর (খোদা)-প্রেম; ইলিয়াস নবী (আ:)-এর উচ্চমর্যাদা; এয়াহইয়া (আ:)-এর
নিষ্কলঙ্ক অবস্থা; এবং ঈসা (আ:)-এর কৃচ্ছ্বব্রত। অতঃপর তাঁকে অবগাহন করাও
আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর বৈশিষ্ট্যসমূহের মহাসমুদ্রে।’ এরপর ওই মেঘ সরে যায়
এবং সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)
একটি সবুজ রেশমের টুকরো হাতে পেঁচিয়ে শক্তভাবে ধরেন; আর তা থেকে অনবরত পানি
বেরোচ্ছিল। এমতাবস্থায় কেউ একজন বলেন, ‘উত্তম, উত্তম, মহানবী (দ:) সমগ্র
জগতকে মুঠোর মধ্যে নিয়েছেন; জগতের সমস্ত সৃষ্টি-ই তাঁর মুঠোর অভ্যন্তরে
রয়েছে, কেউই বাদ পড়েনি।’ এমতাবস্থায় আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁকে
জ্যোৎস্না রাতের পূর্ণচন্দ্রের মতোই (আলোকোজ্জ্বল) দেখাচ্ছিল। তাঁর কাছ
থেকে ওই সময় সেরা মেশকের সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। আর এমনই সময় হঠাৎ সেখানে
আবির্ভূত হন তিনজন। একজনের হাতে ছিল রুপার নির্মিত পানি ঢালার ‘জগ’;
দ্বিতীয়জনের হাতে পান্নার তৈরি কাপড় কাচার বড় কাঠের পাত্র; আর তৃতীয়জনের
হাতে ছিল এক টুকরো সাদা রংয়ের রেশমবস্ত্র, যা তিনি মোড়ানো অবস্থা থেকে
খোলেন। এরপর তিনি একটি চোখ ধাঁধানো আংটি বের করে তা ওই ‘জগ’ হতে পানি
দ্বারা সাতবার ধোন এবং সেই আংটির সাহায্যে মহানবী (দ:)-এর পিঠে (দুই কাঁধের
মাঝে) একটি মোহর বা সীল এঁকে দেন। অতঃপর ওই রেশম দ্বারা তিনি তাঁকে মুড়িয়ে
নিজ ডানার নিচে বহন করে এনে আমার কাছে ফেরত দেন।” [সাল্লাল্লাহু আলাইহে
ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম]
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, “মহানবী (দ:)-এর যখন বেলাদত হয়, তখন
বেহেশতের রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতা রিদওয়ান তাঁর কানে কানে বলেন, ‘ওহে
(সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম), খুশি
উদযাপন করুন। কেননা, অন্যান্য পয়গম্বরের যতো জ্ঞান আছে, তার সবই আপনাকে
মঞ্জুর করা হয়েছে। অতএব, আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মধ্যে আপনি-ই সর্বাধিক
জ্ঞানী এবং সাহসীও’।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন আমিনা (রা:)-এর কথা, যিনি বলেন: “আমার
গর্ভে মহানবী (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) হলে তাঁর সাথে আবির্ভূত হয়
এক জ্যোতি, যা পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে অবস্থিত সমস্ত আকাশ আলোকিত করে। এরপর
তিনি মাটিতে নেমে হাতের ওপর ভর দিয়ে এক মুঠো মাটি তুলে নেন এবং শক্তভাবে
ধরেন; অতঃপর তিনি আসমানের দিকে তাঁর মস্তক মোবারক উত্তোলন করেন।”
আত্ তাবারানী (রহ:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) যখন মাটিতে নামেন, তখন তাঁর
হাতের আঙ্গুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ ছিল এবং তাঁর তর্জনী আল্লাহতা’লার একত্বের
সাক্ষ্য দিতে ওপরদিকে ওঠানো ছিল।
উসমান ইবনে আবি-ইল-আস্ বর্ণনা করেন যে তাঁর মাতা ফাতেমা বলেন, “সাইয়্যেদুনা
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)-এর বেলাদতের সময়
আমি দেখতে পাই (আমিনার) ঘর আলোকিত হয়ে গিয়েছিল এবং তারকারাজি এতো কাছে চলে
এসেছিল যে আমি মনে করেছিলাম সেগুলো বুঝি আমার ওপরই পড়ে যাবে।”
আল-এরবায ইবনে সারিয়্যা (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ
ফরমান: “আমি-ই হলাম আল্লাহতা’লার বান্দা ও আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর সীলমোহর;
ঠিক সে সময় হতে আমি তা-ই, যখন আদম (আ:)-এর কায়া মাটি ছিল। আমি এই বিষয়টি
তোমাদের কাছে ব্যাখ্যা করবো: আমি-ই আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম (আ:)-এর দোয়ার
উত্তর (ফসল); আর ঈসা (আ:)-এর প্রদত্ত শুভসংবাদ; আর আমার মায়ের দেখা
স্বপ্নের বিষয়বস্তু। পয়গম্বরবৃন্দের মায়েরা অহরহ-ই (এ ধরনের) স্বপ্ন দেখে
থাকেন।” মহানবী (দ:)-এর মা আমিনা (রা:) তাঁর বেলাদতের সময় এমন এক নূর
(জ্যোতি) দেখতে পান যার আলোকোচ্ছ্বটায় সিরিয়ার প্রাসাদগুলোও আলোকিত হয়।
হুযূর পূর নূর (দ:)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা:) তাঁর রচিত কবিতায় এই
বিষয়টি-ই উল্লেখ করেন এভাবে -
”(হে নবী) আপনার বেলাদত হয়েছিল যবে
ভুবন ও দিগন্ত আলোকিত হয়েছিল আপনারই নূরের বৈভবে
সেই নূরের আলোয় ও ন্যায়ের পথেই চলেছি আমরা সবে।”
ইবনে সাআদ (রহ:) বর্ণনা করেন যে আমিনা (রা:)-এর গর্ভে যখন মহানবী (দ:)-এর
বেলাদত হয়, তখন নবজাতকের শরীরে যে প্রসবোত্তর মল থাকে তা তাঁর মধ্যে ছিল
না।
সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও জর্দান (শাম-দেশ)-এর প্রাসাদগুলো আলোকিত হওয়ার
যে কথা (বর্ণনায়) এসেছে, সে সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে মহানবী (দ:)-এর
নবুওয়্যতের নূর হতে ওই সমস্ত রাজ্য আশীর্বাদধন্য হয়েছে; কেননা, ওগুলো তাঁরই
নবুওয়্যতের এলাকাধীন। এ কথা বলা হয়েছে, “ওহে কুরাইশ গোত্র, রেসালাত এখন আর
বনী ইসরাঈল বংশের আয়ত্তে নেই। আল্লাহর কসম, মহানবী (দ:) তোমাদেরকে এমন
প্রভাব বিস্তারের দিকে পরিচালনা করবেন, যা পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত
আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হবে।”
মহানবী (দ:)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনকালীন অলৌকিক ঘটনাবলীর কিছু কিছু
ইমাম এয়াকূব ইবনে সুফিয়ান নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্রে নিজ ‘ফাতহুল
বারী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন যে পারস্যরাজ কিসরা (খসরু)-এর
প্রাসাদ ওই সময় কেঁপে উঠেছিল এবং সেটির চৌদ্দটি ঝুল-বারান্দা ভেঙ্গে
পড়েছিল; তাইবেরিয়াস হৃদের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল; পারস্যের আগুন নিভে গিয়েছিল
(যা অসংখ্য বর্ণনামতে এক হাজার বছর যাবত অবিরাম জ্বলেছিল); আর আসমানে
প্রহরী ও ধুমকেতুর সংখ্যা বৃদ্ধি দ্বারা নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল, যার
মাধ্যমে শয়তানের দলের আড়ি পাতার বদমাইশিকে প্রতিরোধ করা হয়েছিল।
হযরত ইবনে উমর (রা:) ও অন্যান্যদের বর্ণনানুযায়ী, হুযূর পূর নূর (দ:)-এর
বেলাদত খতনা অবস্থায় হয় এবং তাঁর নাড়িও ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গিয়েছিল। হযরত
আনাস (রা:) উদ্ধৃত করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান:
“আমার মহান প্রভু কর্তৃক আমার প্রতি মঞ্জুরিকৃত উচ্চমর্যাদার একটি হলো,
আমার বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) খতনা অবস্থায় হয়েছে এবং কেউই আমার গোপন অঙ্গ
দেখেনি।”
রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেলাদতের বছর সম্পর্কে (ঐতিহাসিকদের) বিভিন্ন মত
রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত হচ্ছে তিনি ’হস্তীর বছর’ ধরণীতে আগমন করেন। সেটি
ছিল আবরাহা বাদশাহ’র হস্তী বাহিনীর ঘটনার পঞ্চাশ দিন পরে পবিত্র রবিউল
আউয়াল মাসের বারো তারিখের ভোরে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “সাইয়্যেদুনা
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)-এর বেলাদত সোমবার
হয়; রেসালাতের দায়িত্বও সোমবার তাঁর প্রতি ন্যস্ত হয়; মক্কা মোয়াযযমা থেকে
মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত-ও করেন সোমবার; মদীনায় আগমনও করেন সোমবার; আর কালো
পাথর বহনও করেন সোমবার। উপরন্তু, মক্কা বিজয় ও সূরা আল-মায়েদা অবতীর্ণ হবার
উভয় দিন-ই ছিল সোমবার।”
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস্ (রহ:) বর্ণনা করেন, “সিরিয়াবাসীদের এক
পুরোহিত বসবাস করতেন মারর্ আল-যাহরান এলাকায়, যাঁর নাম ছিল ইয়াসা। তিনি
সবসময় বলতেন, ‘মক্কায় এক নবজাতক শিশুর আবির্ভাবের সময় হয়ে এসেছে, যাঁর কাছে
আরব জাতি সমর্পিত হবে; আর অনারব জাতিগোষ্ঠীও যাঁর কর্তৃত্বাধীন হবে। এটি-ই
তাঁর (নবুওয়্যতের) জমানা।’ কোনো নবজাতকের জন্মের খবর পেলেই ওই পুরোহিত তার
খোঁজখবর নিতেন। সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া
সাল্লাম)-এর বেলাদত (ধরণীতে শুভাগমন) দিবসে আবদুল মোত্তালিব ঘর থেকে বেরিয়ে
পুরোহিত ইয়াসা’র সাথে দেখা করতে যান। তিনিও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে
বলেন, ‘আপনাকে যে নবজাতকের ব্যাপারে বলেছিলাম, আপনি যেন তাঁর আশীর্বাদধন্য
পিতামহ হোন। আমি বলেছিলাম, তাঁর বেলাদত হবে সোমবার, নবুওয়্যত পাবেন সোমবার,
বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্তিও হবে সোমবার।’ আবদুল মোত্তালিব
জবাবে বলেন, ‘এই রাতে, ভোরে আমার (ঘরে) এক নবজাতক আবির্ভূত হয়েছেন।’
পুরোহিত জিজ্ঞেস করেন, ‘তাঁর নাম কী রেখেছেন?’ তিনি উত্তর দেন,
‘(সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)।’
ইয়াসা বলেন, ‘এই নবজাতক আপনার আত্মীয়ের (বংশের) মধ্যে আবির্ভূত হবেন বলেই
আমি আশা করেছিলাম। আমার কাছে এর তিনটি আলামত ছিল: তাঁর তারকা (রাশি) গতকাল
উদিত হয়; তাঁর বেলাদত হয় আজ; এবং তাঁর নাম (সাইয়্যেদুনা) মুহাম্মদ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)’।” সৌর বছরের সেই দিনটি ছিল
২০শে এপ্রিল এবং বর্ণিত আছে যে তাঁর বেলাদত হয়েছিল রাতে।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) বর্ণনা করেন, “মহানবী (দ:)-এর বেলাদত যে রাতে
হয়েছিল, ঠিক ওই সময় একজন ইহুদী বণিক মক্কা মোয়াযযমায় অবস্থান করছিলেন। তিনি
জিজ্ঞেস করেন, ‘ওহে কুরাইশ গোত্র! আজ কি আপনাদের কোনো নবজাতকের আবির্ভাব
হয়েছে?’ তাঁরা উত্তর দেন, ‘আমরা জানি না।’ তিনি তখন তাঁদেরকে বলেন, ‘আজ
রাতে সর্বশেষ উম্মতের পয়গম্বরের বেলাদত হবে। তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে ঘোড়ার
(ঘাড়ে) কেশের মতো কিছু কেশসম্বলিত একটি চিহ্ন থাকবে।’ কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ওই
ইহুদীকে সাথে নিয়ে আমিনা (রা:)-এর কাছে যান এবং তাঁর পুত্রকে দেখা যাবে কি
না তা তাঁর কাছে জানতে চান। তিনি তাঁদের সামনে নিজ নবজাতক পুত্রকে নিয়ে
আসেন এবং তাঁরা তাঁর পৃষ্ঠদেশ হতে কাপড় সরালে সেই চিহ্নটি দৃশ্যমান হয়। এতে
ওই ইহুদী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন,
‘আপনার জন্যে আফসোস! আপনার আবার কী হলো?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আল্লাহর কসম!
বনী ইসরাঈল বংশ হতে নবুওয়্যত অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে’।”
আল-হাকীম (নিশাপুরী) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) মক্কা মোকাররমা’র
মোহাম্মদ বিন ইউসূফের ঘরে আবির্ভূত হন। তাঁর দুধ-মায়ের নাম সোয়াইবিয়া, যিনি
ছিলেন আবূ লাহাবের বাঁদি এবং যাঁকে হুযূর পাক (দ:)-এর বেলাদতের খোশ-খবরী
নিয়ে আসার জন্যে তাঁর মনিব (আবূ লাহাব) মুক্ত করে দিয়েছিল। আবূ লাহাবের
মৃত্যুর পরে তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি এখন কেমন আছো?’ সে
জবাব দেয়, ‘আমি দোযখে (নরকে) আছি। তবে প্রতি সোমবার আমাকে রেহাই দেয়া হয়;
সেদিন আমি আমার এই আঙ্গুলগুলো হতে পানি পান করতে পারি।’ এ কথা বলার সময় সে
তার দুটো আঙ্গুলের ডগা দেখায়। সে আরও বলে, ‘এই মো’জেযা (অলৌকিকত্ব) এ কারণে
যে, মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের সুসংবাদ নিয়ে আসার জন্যে আমি আমার দাসী
সোয়াইবিয়াকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম।’
ইবনে আল-জাযেরী বলেন, “অবিশ্বাসী আবূ লাহাব, যাকে আল-কুরআনে ভর্ৎসনা
(লা’নত) করা হয়েছে, তাকে যদি মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের খুশি উদযাপনের কারণে
পুরস্কৃত করা হয়, তাহলে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর উম্মতের মধ্যে সেসব
মুসলমানের কী শান হবে, যাঁরা তাঁর বেলাদতে খুশি উদযাপন করেন এবং তাঁর প্রতি
ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ সর্বাত্মক উদ্যোগ নেন? আমার জীবনের কসম, মহা
করুণাশীল আল্লাহতা’লার তরফ থেকে তাঁদের পুরস্কার হলো আশীর্বাদধন্য বেহেশতে
প্রবেশাধিকার, যেখানে (তাঁদের জন্যে) অপেক্ষারত মহান প্রভুর অশেষ রহমত,
বরকত ও নেয়ামত।”
ইসলামপন্থী সর্বসাধারণ সবসময়-ই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমনের
(মীলাদুন্নবীর) মাস (রবিউল আউয়াল)-কে ভোজন-আপ্যায়ন, সর্বপ্রকারের
দান-সদকাহ, খুশি উদযাপন, বেশি বেশি নেক আমল এবং সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্রাম)-এর বেলাদতের বৃত্তান্ত সযত্নে
পাঠ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকেন। এরই প্রতিদানস্বরূপ
আল্লাহতা’লা-ও ঈমানদারদেরকে এই পবিত্র মাসের অফুরন্ত নেয়ামত দ্বারা
পরিপূর্ণ করে দেন। মওলিদ নামে পরিচিত মহানবী (দ:)-এর পবিত্র বেলাদত-দিবসের
একটি প্রমাণিত বা প্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এটি সারা বছরের জন্যে
(খোদায়ী) হেফাযত বা সুরক্ষা বয়ে আনে এবং সেই সাথে সকল নেক মকসূদ পূরণেরও
শুভবার্তা নিয়ে আসে। রাসূলে পাক (দ:)-এর মওলিদের আশীর্বাদধন্য মাসের
রাতগুলোকে যাঁরা উদযাপন করেন, তাঁদের প্রতি আল্লাহতা’লা যেন তাঁর খাস্ রহমত
নাযেল করেন, (আমীন)!
অত্যাশ্চর্যজনক ঘটনাবহুল বাল্যকাল
সাইয়্যেদা হালিমা (রা:) বলেন, “আমি বনূ সা’আদ ইবনে বকর গোত্রের আরও কয়েকজন
(শিশুদেরকে বুকের দুধ খাওয়ানোর) ধাত্রীসহ নবজাতক শিশুদের খোঁজে মক্কা
মোকাররমায় এসেছিলাম। ধাত্রী (পেশার) জন্যে সম্ভাব্য নবজাতক পাওয়ার বেলায়
সেই বছরটি খারাপ যাচ্ছিল। আমি ও আমার বাচ্চা একটি গাধীর পিঠে চড়ে মক্কায়
আসি; আর আমার স্বামী এমন একটি বয়স্ক উটনীকে টেনে আনেন যার এক ফোঁটা দুধও
ছিল না। যাত্রা চলাকালে রাতে আমরা তিনজন ঘুমোতে পারিনি এবং আমার বাচ্চাকে
খাওয়ানোর মতো কোনো বুকের দুধও আমি পাইনি।
“আমরা যখন মক্কা শরীফে এসে পৌঁছি, তখন আমাদের দলের প্রত্যেক মহিলাকে মহানবী
(দ:)-এর ধাত্রী হওয়ার জন্যে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তাঁকে বাবা
ইন্তেকালপ্রাপ্ত এয়াতীম জানার পর প্রত্যেকেই ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
আক্ষরিকভাবে আমার বান্ধবীদের কেউই কোনো নবজাতক ছাড়া মক্কা মোয়াযযমা ত্যাগ
করেননি, কিন্তু তারা সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি
ওয়া সাল্লাম)-কে গ্রহণ করতে রাজি হননি। আমি এমতাবস্থায় কোনো নবজাতক শিশু না
পেয়ে আমার স্বামীকে বলি যে, কোনো শিশু ছাড়া ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের
দলে আমি-ই একমাত্র ব্যক্তি হওয়ার ব্যাপারটি আমি পছন্দ করি না। আর তাই আমি
ওই নবজাতক শিশুকে নিতে চাই।
“নবজাতক শিশুকে নেয়ার সময় তাঁর পরণে ছিল দুধের চেয়েও সাদা একটি পশমের জামা।
মেশকের সুগন্ধ তাঁর গা থেকে ছড়াচ্ছিল। চিৎ হয়ে গভীর ঘুমে অচেতন অবস্থায়
তিনি শুয়েছিলেন একখানা সবুজ রংয়ের রেশমী বস্ত্রের ওপর। তাঁর সৌন্দর্য ও
মাধুর্য দর্শনে বিমোহিত হয়ে ঘুম না ভাঙ্গানোর বেলায় আমি যত্নশীল হই। সযত্নে
কাছে গিয়ে তাঁর বুকের ওপর আমার হাত রাখলে পরে তিনি হেসে চোখ মেলে তাকান।
তাঁর নয়নযুগল হতে এমন এক জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়, যা সারা আসমান আলোকিত করে;
আর ওই সময় আমি (এই নয়নাভিরাম দৃশ্য) তাকিয়ে দেখছিলাম। তাঁর দু’চোখের মাঝে
আমি চুম্বন করি এবং আমার ডানদিকের বুকের দুধ তাঁকে পান করাই, যা তাঁকে
পরিতৃপ্ত করে। অতঃপর বাঁ দিকের বুকের দুধ পান করাতে চাইলে তিনি তা ফিরিয়ে
দেন। যতোদিন তিনি আমার বুকের দুধ পান করেছিলেন, এভাবেই করেছিলেন। তিনি
পরিতৃপ্ত হলে আমি আমার পুত্রকে বাঁ দিকের বুকের দুধ পান করাতাম। তাঁকে আমার
তাঁবুতে আনার পরপরই আমার দু’বুকে দুধ এসে গিয়েছিল। আল্লাহতা’লার মহিমায়
সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণ
তৃপ্তিসহ দুধ পান করেন, যেমনটি করেছিল তাঁর ভাই-ও। আমার স্বামী আমাদের
জন্যে তাঁর সেই উটনীর দুধ আনতে যেয়ে দেখতে পান সেটির স্তন-ও দুধে পরিপূর্ণ!
তিনি উটনীর দুধ দোহন করেন এবং আমরা তা তৃপ্তি সহকারে পান করি। আমাদের
জীবনে সেটি ছিল এক বিস্ময়কর রাত! আমার স্বামী পরে মন্তব্য করেন, ‘ওহে
হালিমা! মনে হচ্ছে তুমি এক পুণ্যাত্মাকে বেছে নিয়েছ। আমরা প্রথম রাতটি
আশীর্বাদ ও (ঐশী) দানের মাঝে কাটিয়েছি; আর তাঁকে (মহানবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামকে) বেছে নেয়ার পর থেকে আল্লাহতা’লার এই দান
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
“রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মাকে বিদায় জানিয়ে আমি তাঁকে (মহানবীকে) আমার হাতে
নিয়ে নিজস্ব গাধীর পিঠে চড়ে বসি। আমার গাধী অন্যান্য সকল সঙ্গির সওয়ারি
জন্তুদের পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যায়, যা তাঁরা অবাক হয়ে দেখতে থাকেন। বনূ
সা’অাদ গোত্রের বসত এলাকা, যা (আরবের) বিরাণ ভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাতে
পৌঁছুলে পরে আমরা দেখতে পাই যে আমাদের ভেড়ীগুলোও দুধে পরিপূর্ণ। আমরা দুধ
দোহন করে প্রচুর দুধ পান করি; সেটি এমন-ই এক সময় হয়েছিল, যখন কোনো ওলানেই
এক ফোঁটা দুধ-ও পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্যান্যরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি আরম্ভ
করেন, ‘আবূ সোয়াইবের কন্যার গবাদিপশু যেখানে চরে, সেই চারণভূমিতে পশুর পাল
চরাও।’ তবুও তাদের ভেড়ার পাল অভুক্ত ফিরতো, আর আমার পশুর পাল স্তনভর্তি
দুধসহ ফিরতো।”
রাসূলে পাক (দ:)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা:) বলেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)!
আপনার নবুওয়্যতের একটি নিদর্শনের আমি সাক্ষী হওয়ার দরুন আপনার ধর্মগ্রহণ
করেছিলাম। আমি প্রত্যক্ষ করি যে আপনি (শিশু থাকতে) চাঁদের সাথে মহব্বতের
সাথে কথা বলেছিলেন এবং আপনার আঙ্গুল তার দিকে নির্দেশ করেছিলেন। আপনি
যেদিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন, আকাশের সেদিকেই চাঁদ ধাবিত হয়েছিল।” হুযূর
পূর নূর (দ:) জবাব দেন, “আমি চাঁদের সাথে কথা বলছিলাম, আর চাঁদ-ও আমার
সাথে আলাপ করছিল, যার দরুন আমার কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটিকে আরশের
নিচে সেজদা করার আওয়াজ-ও আমি শুনতে পেয়েছিলাম।”
’ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে মহানবী (দ:) ধরাধামে শুভাগমনের সাথে
সাথেই কথা বলেন। ইবনে সাব’ উল্লেখ করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দোলনায়
ফেরেশতাবৃন্দ দোল দেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন যে হযরত হালিমা (রা:) সবসময় বলতেন যে
মহানবী (দ:)-কে প্রথমবার যখন তিনি মাই ছাড়ান (মানে শক্ত খাবারে অভ্যস্ত হতে
তা খেতে দেন), তখন তিনি উচ্চারণ করেন, “আল্লাহতা’লা শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে
সর্বশ্রেষ্ঠ; আর সমস্ত প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য; সূচনা থেকে অন্ত পর্যন্ত
তাঁরই পবিত্র মহিমা” (আল্লাহু আকবর কবীরা; ওয়াল্ হামদু লিল্লাহি কাসীরা; ওয়া সোবহানাল্লাহি বুকরাতান্ ওয়া আসীলা)। তিনি বড় হলে পরে বাইরে যেতেন এবং অন্যান্য শিশুদের খেলতে দেখলে তাদের এড়িয়ে চলতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন যে নবী করীম (দ:)-এর (পিতামাতার দ্বারা
পালিত তাঁর) বোন আল-শায়মা’আ (রা:) প্রত্যক্ষ করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর
বাল্যকালেই একটি মেঘ মহানবী (দ:)-কে সবসময় ছায়া দান করতো। তিনি পথ চল্লে
সেটিও তাঁর সাথে চলতো, তিনি থামলে সেটিও থেমে যেতো। তিনি অন্য কোনো ছেলের
মতো করে বড় হননি। হযরত হালিমা (রা:) বলেন, “আমি তাঁকে মাই ছাড়ানোর পর তাঁর
মায়ের কাছে নিয়ে যাই, যদিও আমরা তাঁকে কাছে রাখার ইচ্ছা পোষণ করছিলাম তাঁর
মাঝে সমস্ত আশীর্বাদ দর্শন করে। আমরা তাঁর মায়ের কাছে অনুরোধ জানাই তাঁকে
আমাদের কাছে থাকতে দেয়ার জন্যে, যতোক্ষণ না তিনি আরও শক্তিশালী হন। কেননা,
আমরা মক্কার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠার ব্যাপারে
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। আমরা বারংবার অনুরোধ করতে থাকি, যার ফলশ্রুতিতে
তিনি রাজি হন মহানবী (দ:)-কে আমাদের কাছে ফেরত পাঠাতে।”
প্রারম্ভিক শৈশবকালীন মো’জেযা (অলৌকিকত্ব)
[হালিমা (রা:) আরও বর্ণনা করেন] “আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে সাথে
করে ফেরত নিয়ে আসার দুই বা তিন মাস পরে আমরা আমাদের বাড়ির পেছনে নিজস্ব
কিছু গবাদি পশুর যত্ন নেয়ার সময় তাঁর দুধ-ভাই (হালিমার ছেলে)
ছুটে আসে এই বলে চিৎকার করতে করতে - ‘আমার কুরাইশ-গোত্রীয় ভাইয়ের কাছে সাদা
পোশাক-পরিহিত দু’জন মানুষ আসেন। তাঁরা তাঁকে শুইয়ে তাঁর বক্ষবিদীর্ণ
করেন।’ ছেলের বাবা ও আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই। মহানবী (দ:) তখন দাঁড়ানো এবং
তাঁর চেহারার রং বদলে গিয়েছে। তাঁর (পালক) বাবা তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এবং
জিজ্ঞেস করেন, ‘ওহে পুত্র! কী হয়েছে আপনার?’ সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দেন, ‘সাদা পোশাক পরা দুই
ব্যক্তি আমার কাছে আসেন। তাঁরা আমাকে শুইয়ে আমার বক্ষবিদীর্ণ করেন। অতঃপর
তাঁরা (শরীরের) ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে ফেলে দেন এবং বক্ষ যেমনটি ছিল
ঠিক তেমনটি জোড়া লাগিয়ে দেন।’ আমরা তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসি এবং তাঁর (পালক)
পিতা বলেন, ‘ওহে হালিমা! আমি আশংকা করি আমাদের এই ছেলের কিছু একটা হয়েছে।
আরও খারাপ কিছু হওয়ার আগে চলো তাঁকে তাঁর পরিবারের কাছে ফেরত দিয়ে আসি!’
“আমরা রাসূল (দ:)-কে মক্কায় তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করেন,
‘তোমরা তাঁকে নেয়ার জন্যে এতো আগ্রহ প্রকাশের পরে কী কারণে আবার ফেরত
এনেছো?’ আমরা তাঁকে জানাই যে মহানবী (দ:)-এর খারাপ কিছু হতে পারে ভেবে আমরা
শংকিত (তাই নিয়ে এসেছি)। আমিনা (রা:) বলেন, ‘তা হতে পারে না; তোমরা সত্য
কথাটি বলো যে আসলে কী হয়েছে।’ তিনি তাঁর অবস্থানে অনড় থাকার দরুন আমরা আসল
ঘটনা খুলে বলি। এমতাবস্থায় তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কি ভয় পেয়েছো যে
শয়তান তাঁর ক্ষতি করবে? না, তা কখনোই হতে পারে না। আল্লাহর কসম, শয়তান
কোনোক্রমেই তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমার এই ছেলে মহা সম্মানের
অধিকারী কেউ হবেন। তোমরা এক্ষণে তাঁকে (আমার কাছে) রেখে যেতে পারো’!”
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ
ফরমান: “আমি বনী সা’আদ ইবনে বকর গোত্রে (দুধ-মায়ের) লালন-পালনে থাকাকালীন
একদিন আমার সমবয়সী ছোট ছেলেদের সাথে খেলছিলাম। এমনি সময়ে হঠাৎ তিনজন
ব্যক্তি আবির্ভূত হন। তাঁদের কাছে ছিল বরফভর্তি সোনালী রংয়ের একখানা
ধোয়াধুয়ি করার পাত্র। তাঁরা আমাকে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা করেন, আর
আমার বন্ধুরা সবাই বসতীর দিকে দৌড়ে ফেরত যান। ওই তিনজনের মধ্যে একজন আমাকে
আলতোভাবে মাটিতে শুইয়ে আমার বুক হতে তলপেটের হাড় পর্যন্ত বিদীর্ণ করেন। আমি
তা দেখতে সক্ষম হই এবং আমার এতে কোনো ব্যথা-ই অনুভূত হয়নি। তিনি আমার
নাড়িভুঁড়ি বের করে বরফ দ্বারা সেটি ভালভাবে কাচেন এবং আবার যথাস্থানে
স্থাপন করেন। দ্বিতীয়জন দাঁড়িয়ে তাঁর সাথীকে সরে যেতে বলেন। অতঃপর তিনি
তাঁর হাত ঢুকিয়ে আমার হৃদযন্ত্র বের করে আনেন, যা আমি দেখতে পাই। তিনি তা
কেটে ওর ভেতর থেকে একটি কালো বস্তু বের করে ছুড়ে ফেলে দেন এবং তাঁর দুই হাত
ডানে ও বামে নাড়তে থাকেন, যেন হাতে কিছু একটা গ্রহণ করছিলেন। অকস্মাৎ তাঁর
হাতে চোখ-ধাঁধানো আলোর একখানি আংটি দেখা যায়। তিনি আমার হৃদযন্ত্রের ওপর
তা দ্বারা ছাপ বসিয়ে দেন, যার দরুন সেটিও আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এটি-ই
নবুওয়্যত ও জ্ঞান-প্রজ্ঞার নূর (জ্যোতি)। অতঃপর তিনি আমার হৃদযন্ত্র
যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করেন এবং আমি সেই আংটির শীতল স্পর্শ দীর্ঘ সময় যাবত
পাই। তৃতীয়জন এবার তাঁর সহযোগীকে সরে দাঁড়াতে বলেন। তিনি তাঁর হাত আমার
বিদীর্ণ বক্ষের ওপর বুলিয়ে দিলে আল্লাহর মর্জিতে তা মুহূর্তে জোড়া লেগে যায়
(অর্থাৎ, সেরে ওঠে)। এরপর তিনি সযত্নে আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য
করেন এবং প্রথমজনকে বলেন, ‘তাঁর জাতির দশজনের সাথে তাঁকে মাপুন।’ আমি তাদের
চেয়ে ওজনে ভারী প্রমাণিত হই। অতঃপর তিনি আবার বলেন, ‘তাঁর জাতির এক’শ জনের
সাথে তাঁকে পরিমাপ করুন।’ আমি তাদের চেয়েও ভারী হই। এবার তিনি বলেন,
‘তাঁকে তাঁর সমগ্র জাতির সাথে মাপলেও তিনি ভারী হবেন।’ তাঁরা সবাই আমাকে
জড়িয়ে ধরেন, কপালে চুমো খান এবং বলেন, ‘ওহে হাবীব (দ:)! আপনার জন্যে যে
মঙ্গল ও কল্যাণ অপেক্ষা করছে তা জেনে আপনি খুশি-ই হবেন’।” এই হাদীসে পরিমাপ
করার বিষয়টি হলো নৈতিকতা। অতএব, মহানবী (দ:) সবাইকে নৈতিকতা ও সদগুণাবলীতে
ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর ’সীনা চাক’ (বক্ষ বিদারণ) জিবরাইল আমীন (আ:) কর্তৃক
হেরা গুহায় ওহী বহন করে নিয়ে আসার সময় আরেকবার হয়েছিল; এছাড়া মে’রাজের
রাতে ঊর্ধ্বগমনের সময়ও আরেকবার বক্ষবিদারণ হয়েছিল তাঁর। আবূ নুয়াইম নিজ
‘আদ্ দালাইল’ পুস্তকে বর্ণনা করেন যে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বিশ বছর বয়সে
আরও একবার ’সীনা চাক’ হয়েছিল। তাঁর শৈশবে এটি হওয়ার এবং কালো বস্তু
অপসারণের হেকমত বা রহস্য ছিল তাঁকে সমস্ত ছেলেমানুষি বৈশিষ্ট্য হতে মুক্ত
করে প্রাপ্তবয়স্কদের (গুরুগম্ভীর) চিন্তা ও মননে বিভূষিত করা। তাঁর বেড়ে
ওঠা তাই নিখূুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। তাঁর দু’কাঁধের মাঝামাঝি স্থানে মোহরে
নবুওয়্যতের সীলমোহর দেয়া হয়, যা থেকে মেশকের সুগন্ধ বের হতো এবং যা দেখতে
একখানা তিতিরজাতীয় পাখির ডিমের মতো ছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) ছয় বছর
বয়সে উপনীত হলে তাঁর মা আমিনা (রা:) ও উম্মে আয়মান (রা:) তাঁকে এয়াসরিবে
(মদীনায়) অবস্থিত ’দারুল তাবে’আ’-তে তাঁরই বনূ আদী’ ইবনে আল-নাজ্জার
গোত্রভুক্ত মামাদের বাড়িতে মাসব্যাপী এক সফরে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে ওই
জায়গায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তিনি স্মরণ করেন। কোনো একটি নির্দিষ্ট বাড়ির
দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “এখানেই আমি ও আমার মা থেকেছিলাম। বনূ আদী’ ইবনে
আল-নাজ্জার গোত্রের মালিকানাধীন হাউজ বা জলাধারে আমি সাঁতার শিখেছিলাম।
একদল ইহুদী আমাকে দেখতে ঘনঘন এই স্থানে আসতো।” উম্মে আয়মান (রা:) বলেন,
“আমি ইহুদীদের একজনকে বলতে শুনেছি যে সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম হলেন এই জাতির পয়গম্বর; আর এটি-ই হলো তাঁর
হিজরতের স্থান। ইহুদীরা যা বলাবলি করেছিল, তার সবই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (দ:) ও তাঁর মা মক্কা মোয়াযযমায় ফিরতি যাত্রা আরম্ভ
করেন। কিন্তু এয়াসরিবের অদূরে আল-আবূআ’ নামের জায়গায় পৌঁছুলে মা আমিনা
(রা:) ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আল-যুহরী (রা:) হযরত আসমা’ বিনতে রাহম (রা:)
হতে, তিনি তাঁর মা হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “আমি মহানবী (দ:)-এর মা
আমিনা (রা:)-এর শেষ অসুখের (মৃত্যুব্যাধির) সময় উপস্থিত ছিলাম। ওই সময়
মহানবী (দ:) ছিলেন মাত্র পাঁচ বছরের এক শিশু। তিনি যখন মায়ের শিয়রে বসা,
তখন আমিনা (রা:) কিছু কবিতার ছত্র পড়ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি হুযূর পূর নূর
(দ:)-এর মোবারক চেহারার দিকে তাকিয়ে বলেন:‘(পৃথিবীতে) সকল প্রাণি-ই
মৃত্যুবরণ করবে; যাবতীয় নতুন বস্তু-ও পুরোনোয় পরিণত হবে; আর প্রতিটি
প্রাচুর্য-ও কমে যাবে; আমি মৃত্যুপথযাত্রী হলেও স্মৃতি আমার চিরসাথী হবে;
আমি রেখে যাচ্ছি অফুরন্ত কল্যাণ এবং জন্ম দিয়েছি পুতঃপবিত্র সত্তাকে এই
ভবে।’ এ কথা বলে তিনি ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর তিরোধানে জ্বিনদের কাঁন্নার আওয়াজ শুনতে সক্ষম হই।”
বর্ণিত আছে যে হযরত আমিনা (রা:) তাঁর ইন্তেকালের পরে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর
রেসালাতের প্রতি শাহাদাত তথা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আত্ তাবারানী (রহ:) হযরত
আয়েশা (রা:) হতে নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) আল-হাজূন
নামের স্থানে পৌঁছুলে তিনি অন্তরে অত্যন্ত বেদনাক্লিষ্ট হন। আল্লাহতা’লার
যতোক্ষণ ইচ্ছা, ততোক্ষণ তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। ওখান থেকে ফেরার পর
তিনি খুশি হন এবং বলেন, “আমি আমার মহাপরাক্রমশালী ও মহান প্রভুর
(খোদাতা’লার) দরবারে আরয করেছিলাম আমার মাকে তাঁর হায়াত (জীবন) ফিরিয়ে
দিতে। তিনি তা মঞ্জুর করেন এবং তারপর আবার মাকে ফেরত নিয়ে যান (পরলোকে)।”
আস্ সুহায়লী ও আল-খাতীন উভয়ই বর্ণনা করেন হযরত আয়েশা (রা:)-এর কথা, যিনি
বলেন যে আল্লাহ পাক হুযূর পূর নূর (দ:)-এর পিতামাতা দু’জনকেই পুনরায় জীবিত
করেন এবং তাঁরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামের
রেসালাতের প্রতি শাহাদাত বা সাক্ষ্য প্রদান করেন।
আল-কুরতুবী তাঁর ‘আত্ তাযকেরা’ গ্রন্থে বলেন, “সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও সদগুণাবলী
তাঁর সারা (যাহেরী/প্রকাশ্য) জিন্দেগী জুড়ে প্রকাশমান ছিল। তাঁর পিতামাতাকে
আবার জীবিত করে তাঁর প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব কিছু নয়।
ইসলামী বিধানে বা যুক্তিতে এমন কিছু নেই যা এর বিরোধিতা করে।” পবিত্র
কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে যে বনী ইসরাঈল বংশের এক ব্যক্তি খুন হওয়ার পর তাকে
আবার জীবিত করে খুনী কে ছিল তা জানানো হয়। অধিকন্তু, আমাদের পয়গম্বর ঈসা
(আ:) [যীশু খৃষ্ট] মৃতকে জীবিত করতেন। অনুরূপভাবে, আল্লাহতা’লা আমাদের
মহানবী (দ:)-এর দ্বারাও কিছু সংখ্যক মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেন। তাহলে
রাসূল-এ-করীম (দ:) কর্তৃক তাঁর পিতামাতাকে পুনরায় জীবিত করে তাঁর
নবুওয়্যতের প্রতি সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টি কেন অসম্ভব হবে, যেখানে এটি
তাঁরই শান-শওকত ও মহিমা প্রকাশ করছে?
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর মতে, সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া
আলেহি ওয়া সাল্লামের সকল পূর্বপুরুষ-ই মুসলমান। এটি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর
বাণী থেকেও প্রমাণিত। তিনি (দ:) বলেন, “আমাকে পুতঃপবিত্র পুরুষদের ঔরস থেকে
পুতঃপবিত্র নারীদের গর্ভে স্থানান্তর করা হয়।” আর যেহেতু আল্লাহ পাক
বলেছেন, “নিশ্চয় অবিশ্বাসীরা নাজাস তথা অপবিত্র”, তাই আমরা (এ আয়াতের
আলোকে) দেখতে পাই যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামের
পূর্বপুরুষদের কেউই অবিশ্বাসী ছিলেন না।
হাফেয শামস আদ্ দীন আদ্ দামেশকী (রহ:) এই বিষয়ে কী সুন্দর লিখেছেন:
“আল্লাহ পাক তাঁর নবী (দ:)-এর প্রতি নিজ আশীর্বাদ করেছেন বর্ষণ
এছাড়াও তিনি তাঁর প্রতি ছিলেন সর্বাধিক দয়াবান
তিনি তাঁর মাতা এবং পিতাকেও ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁদের জীবন
যাতে তাঁরা করতে পারেন তাঁর নবুওয়্যতের সাক্ষ্যদান
নিশ্চয় তা ছিল সূক্ষ্ম করুণার এক নিদর্শন
অতএব, এসব অলৌকিকত্বে করো বিশ্বাস স্থাপন
কেননা, আল্লাহতা’লা এগুলোর সংঘটনকারী হিসেবে সামর্থ্যবান
যদিও বা এতে তাঁর সৃষ্টিকুলের শক্তি-সামর্থ্য ম্লান।”
সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামের মায়ের
ইন্তেকালের পরে উম্মে আয়মান (রা:) তাঁর সেবাযত্নের দায়িত্ব নেন। মহানবী
(দ:) তাঁর সম্পর্কে বলতেন, “আমার মায়ের পরে উম্মে আয়মান হলেন আমার
(দ্বিতীয়া) মা।” রাসূলুল্লাহ (দ:) আট বছর বয়সে উপনীত হলে তাঁর দাদা ও
অভিভাবক আবদুল মোত্তালিব ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল এক’শ দশ বছর (অপর
বর্ণনায় এক’শ চল্লিশ বছর)। ইন্তেকালের সময় তাঁরই অনুরোধে মহানবী (দ:)-এর
চাচা আবূ তালেব তাঁর অভিভাবক হন। কেননা, তিনি ছিলেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর
পিতা আবদুল্লাহ’র আপন ভাই।
ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন জালহামা ইবনে উরফাতা হতে; সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমান: “আমি এক খরার সময়
মক্কায় আবির্ভূত হই। কুরাইশ গোত্রের কয়েকজন আবূ তালেবের কাছে এসে আরয করেন,
‘হে আবূ তালেব, এই উপত্যকা অনুর্বর এবং সকল পরিবার আর্তপীড়িত। চলুন, আমরা
বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করি।’ আবূ তালেব (ঘর থেকে) বেরিয়ে আসেন, আর তাঁর
সাথে ছিলেন এক বাচ্চা ছেলে, যাঁকে দেখতে লাগছিল মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা
সূর্যের মতো। তাঁর আশপাশে ঘিরে ছিল অন্যান্য শিশুর দল। আবূ তালেব তাঁকে
কা’বাগৃহের দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। আকাশে
ওই সময় মেঘের কোনো লেশচিহ্ন মাত্র ছিল না। কিন্তু যেমনি ওই বালক তাঁর হাত
দুটো ওপরে তোলেন, অমনি সবদিক থেকে মেঘ আসা আরম্ভ করে এবং বৃষ্টিও নামে -
প্রথমে অল্প, শেষে অঝোর ধারায়। ফলে উপত্যকা এলাকা উর্বর হয়ে ওঠে, আর মক্কা ও
বাইরের মরুভুমি অঞ্চলও শস্যশ্যামলতা ফিরে পায়। এই মো’জেযা (অলৌকিক ঘটনা)
সম্পর্কে আবূ তালেব (পদ্যাকারে) লেখেন:
‘জ্যোতির্ময় চেহারার সেই পবিত্র সত্তার সকাশে
যাঁর খাতিরে বারি বর্ষে
তিনি-ই এয়াতীমবর্গের আশ্রয়স্থল সবশেষে
আর বিধবাদের ভরসার উপলক্ষ নিঃশেষে’।”
*সমাপ্ত*
[সৌজন্যে: আস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা]