পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০১৭

প্রসংগঃ সা'মার মাহ্ ফিল

হাল আমলে কিছু তরীকতপন্থী আছেন, বিশেষ করে চিশতীয়া নিজামিয়া শাখায়, তারা বুঝেনই না, সা'মার মজলিশ (ধর্মীয় সংগীত) কি? কেন সামা তথা ধর্মীয় সংগীত-সুফী সাধকদের কাছে এতো আদরণীয়? এত প্রিয়? 

অত্যন্ত দুঃখ হয়, সেই সমস্ত তরীকতপন্থীদের জন্য, যারা খাজায়ে খাজেগানগণের এই বিশেষ মাহফিলের নামে যে অনুষ্ঠান সর্বস্ব পালন করেন, তা মোটেও তাঁদের পীরানে পীরগণদের সিলসিলা মোতাবেক নয়। তাঁদের পীরানেপীরদের মাহ্ ফিলে কোন প্রকার বে-আদবের স্খান ছিল না। তাছাড়া, যারা সা'মা সংগীত শ্রবণের উপযুক্ত নয়, তাদেরকে সেই মাহফিলে বসতে দেয়াও উচিত নয়। কিন্তু তাঁদের বর্ণিত সেই নিয়ম-নীতি অনুসরণতো  করেই না বরং আরো আধুনিকতার নামে যে নীতি তারা অনুসরণ করেন,সেটাও প্রযোজ্য নয়। তাদের উচিত, তাদের পীরানে পীরগণ যে নিয়ম নীতি অনুসরণ করেছেন, সে মোতাবেক সা'মার মজলিশ পরিচালনা করা। যদি সেটা অনুসরণ না করে সা'মার মজলিশ পরিচালনা করা হয়, তাহলে সেটা তাঁদের পীরানে পীরদের অবমাননা করা হয়। আর যে মুরিদ, তা করে, দয়াল মুর্শিদই ভালো জানেন, তিনি মুরিদ হবার উপযুক্ত কি-না?

কেন বললাম? 

বললাম এই কারণে যে, সা'মার মজলিশ হচ্ছে-রুহানী আত্মার খোরাক। অনেক আশেকগণ আছেন, যারা সা'মা শ্রবণ করে নিজেকে নিজের কাছে হারিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ তিনি তার ভেতর থাকেন না। মুর্শিদের খেয়ালে বরযোগে তাদের হাল এত উচ্চ পর্যায়ে চলে যায় যে, যা বর্ণনাতীত। এটা যাঁদের হয়েছে, কেবল তারাই তা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হন। সেই সময় অনেকেই নর্দন-কৃর্দন করেন। সেই নর্দন কুর্দন দেখে যারা এটা বুঝে না, তারা তাদেরকে অনেক অবমাননাকর উক্তি করে থাকেন। এমনও দেখা গেছে, তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সেইরুপ নর্দন-কুর্দন করে থাকেন। যা রীতিমতো বেয়াদবী। মাওলানা রুমি বলেন...

আস খুদা যুয়েম তৈফিকে আদব
বেয়াদব মাহরুম গাস্ত আজ লুতফে ফাজলে রব্ব

অর্থঃ আল্লাহর কাছে আদব করার তৌফিক প্রার্থনা কর কেননা বেয়াদব আল্লাহর নেয়ামত থেকে মাহরুম হয়ে যায়।

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী-শেষ পর্ব


(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

তিনি চিন্তিত মুখে পায়চারি করা শুরু করলেন। আর ভাবলেন, এর মধ্যে কি এর উত্তরটা পাওয়া যাবে......তিনি ঘড়ির দিকে
তাকালেন। দেখলেন, মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে....এত অল্প সময়ে এ বিষয়টা বের করে পড়া যাবে না..তাছাড়া গতানুগতিকভাবে তিনি যেভাবে ক্লাস নেন, আজ তার পুরো বিপরীত কাজটি করলেন। তিনি মনে মনে লজ্জিত হলেন। ভাবলেন-কাজটি ছেলেমানুষীর মতো  হয়ে গেল না....যার ডায়েরী তাকেই ফিরিয়ে দেয়াই উত্তম। তিনি তাই করলেন। তিনি নিষাদকে ডাকলেনঃ

-নিষাদ...

-জ্বি স্যার...

-এ দিকে আয়...

নিষাদ ভয়ে ভয়ে গুটি গুটি পায়ে মাথা নিচু করে মজিদ স্যারের কাছে গেলেন। ক্লাসের সকল ছাত্রের দৃষ্টি সে দিকে নিপতিত হলো। সবাই ভাবলোঃ স্যার বুঝি আজকে নিষাদকে ভয়াভয় কোন শাস্তি দিতে চলেছেন? দেখাই যাক্ না কি শাস্তি দেন? 
মজিদ স্যারের ভয়াবহ শাস্তির মধ্যে আছে দু' পায়ের নিচ দিয়ে অর্থাৎ দুই উরুর মাঝখান দিয়ে দুহাত দিয়ে দু কান ধরে ব্যাঙের মতো করে রাখা। তারপর ডাষ্টার দিয়ে ধুপধাপ করে কষে কয়েকটি বারি মারা। হাত দিয়ে ঠেকানোর কোন উপায়ই নেই।  আরেক ধরণের শাস্তি আছে। সেটা হলোঃ নিলডাউন করে রাখা। তারপর জালি বেত দিয়ে কষে দু'চারটা বারি মারা....

নিষাদকে যখন মজিদ স্যার ডেকে নিলেন, তখন থেকেই আমার বুকটা ধড়ফড় করছে...না জানি, স্যার ডায়েরীর মধ্যে কি পেয়েছেন?

কিন্তু মজিদ স্যার সকলকে অবাক করে দিয়ে নিষাদের কপালে একটি চুমো দিলেন। তারপর নিষাদের হাতে সেই ডায়েরীটা তুলে দিয়ে বললেনঃ 

-যতনে রাখিস্।সময়ের অভাবে পুরো ডায়েরীটা হয়তো পড়তে পারিনি। কিন্তু যতটুকু পড়েছি, তাতেই বুঝতে পারছি তোর বাবা, তোর জন্য একটা মহামুল্যবান জিনিস রেখে গেছেন। আমার ধারণা, তুই যদি তোর বাবার এই ডায়েরীটা পড়ে ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারিস, তাহলে নিঃসন্দেহে তুই একজন ভালো মানুষ হবি। আমি তোর জন্য এই দোয়া করি...


নিষাদ বাবাকে সে হারিয়েছে বহু আগেই। বাবা থাকতে তিনি প্রায়ই নিষাদের কপালে চুমু দিয়ে বলতেনঃ আমার লক্ষ্মী বাবা টা। তুমি অনেক বড়ো হও। বাবা চলে যাওয়ার পর কেউ তাকে এমন করে চুমেু দেয়নি। আজ মজিদ স্যারের চুমু খেয়ে নিষাদের তার বাবার কথা মনে পড়লো। বাবার কথা মনে পড়ায় তার চোখ দুটো জলে ভিজে গেল।
নিষাদ উপুড় হয়ে যখন মজিদ স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম  করছিল, ঠিক সে সময় মজিদ স্যারের পায়ের উপর গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা চোখের জল। স্যার টের পেয়েই নিষাদকে বুকের মাঝে টেনে নিলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেনঃ

-তুই অনেক বড়ো হ....

এ কথা বলেই মজিদ স্যার গট গট করে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন। আর ওমনি দপ্তরী হরিপদ দাস পিতলের প্লেটের মতো ঘন্টাটি পিটিয়ে আওয়াজ তুললেন... ঢং ঢং ঢং....

বাবার ডায়েরী-পঞ্চম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

সুফী দর্শনের কথা শুনে মজিদ স্যারের ভ্রুু কুঁচকে গেল। তার ইচ্ছে করছে সেটা জানার। আবার চিন্তা করছে-ঠিকমতোই তো নামায রোজই পালন করতে পারি না...তার উপর আবার সুফীদর্শন....মজিদ স্যার নিজের আনমনেই হাসলেন। 
ক্লাসের ছাত্ররা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না....এটাই কি সেই মজিদ স্যার.... যার ক্লাসে সব ছাত্ররা ভয়ে তটস্থ থাকতো....অার স্যারেরই বা আজ কি হলো...ডায়েরীটা পাওয়ার পর থেকেই স্যার কেমন যেন বদলে গেলেন...আজকের মজিদ স্যার যেন অচেনা কেউ....কখনো হাঁটছেন....কখনো হাসছেন....ব্যাপারটা কি? ছাত্ররাও স্যারের এই আচরণে কিছুটা বিব্রতবোধ করে হাসছে....

মজিদ স্যার ঘড়ি দেখলেন। এখনো পুরো পনেরো মিনিটের মতো বাকী আছে কাজেই ডায়েরীটা পড়া যেতে পারে...সে আবারো ডায়েরীটার মাঝখান থেকে দেখতে শুরু করলেন...সুফী দর্শন সর্ম্পকে কি লেখা আছে...খুঁজতে খুঁজতে একটা পাতাতে তার চোখ আটকে গেল...স্যার পড়া শুরু করলেনঃ

সুফীদর্শনঃ
---------
সুফীদর্শন কি? তা জানার আগে আমাদের জানতে হবে সুফী শব্দটির উৎস সমন্ধে। সেটা জানা হলে মোটামুটি সুফীদের সর্ম্পকে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সুফী শব্দের উৎপত্তি সমন্ধে অনেক মতানৈক্য প্রচলিত আছে। কেহ বলেনঃ সাফা ( পবিত্রতা ) শব্দ হতে সুফী শব্দের উৎপত্তি। অন্যদের ধারণা মতে, 'আসহাবুস-সাফা' হতে সুফীর উৎপত্তি। রাসুলুল্লাহর (সাঃ) জীবনাদর্শ ও কমপদ্ধতি অনুসরণ করে যে সকল ব্যক্তি নিজেদের চরিত্র গঠন করার মানসে তাঁর সান্নিধ্যে মসজিদ.ই.নবী-তে অবস্থান করতেন,  তাদেরকে বলা হতো আসহাবে সুফ্ফা বা আসহাবস-সাফা।

বুখারী শরীফের একটি হাদিস হতে জানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাহাবীগণকে ইহাদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করিতে উপদেশ দিয়েছেন। সুবিখ্যাত সাধক শয়খ আবুল কাসিম কুশাইরী (মৃত্যু ৯৮৮ খৃীষ্টাব্দ) এবং শয়খ শিহাবুদ্দিন সুহরাওয়ার্দীর (মৃত্যু ১২৩৪ খৃষ্টাব্দ) মতানুসারেঃ হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর পর হতে অর্থাৎ ৮২২ খৃষ্টাব্দ হতে সুফী শব্দের প্রচলন ঘটে।

এ বিষয়ে সকলেই একমত যে রাসুলল্লাহ (সাঃ) দ্বিবিধ অহীপ্রাপ্ত হন। প্রথমটি কোরআন শরীফে লিপিবদ্ধ। এটি সকলের জন্য বাধ্যকর ও ইলম.ই.সফিনা নামে খ্যাত। দ্বিতীয়টি, অতি গোপনীয় এবং মনোনীত সাহাবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটি ইলম.ই.সিনা নামে খ্যাত। কোরআন শরীফের কতক আয়াত মাহ্ কাম (স্পষ্ট), কতক /আয়াত মুতাশাবিহ (রুপক)। মাহকাম বুঝতে কোরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস, উসুল, ফিকাহ্ প্রভৃতি ইলম.ই. জাহির.ই যথেষ্ট।  এইটিই শরীয়াহ্ তথা শরীয়াত।
কিন্তু মুতাশাবিহা হলো মারিফত। মুতাশাবিহা বুঝতে রাসুলূল্লাহ (সাঃ) কিংবা তাঁর মনোনীত গুণসম্পন্ন কোন আত্মিক প্রভাবের প্রয়োজন। এই আত্মিক প্রভাব রাসুলল্লাহর (সাঃ) নিকট হতে পীরেরা পেয়েছেন।
কোরআন শরীফের কতিপয় আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, স্বয়ং রাসুলল্লাহর (সাঃ) মধ্যেই সুফীবাদের বীজ নিহিত ছিল। রাসুলল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ "আনা মদিনাতুল ইলম ওয়া আলীউন বাবুহা" - আমি জ্ঞানের শহর এবং সেই শহরের প্রবেশদ্বার অালী (আঃ)। রাসুলল্লাহ (সাঃ) এই জ্ঞান হযরত মাওলা আলী (অাঃ) কে শিক্ষা দেন। অনেকের ধারণা, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ও এই জ্ঞান লাভ করেছিলেন।

মজিদ স্যার কিছুটা বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হলো। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেনঃ কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদের মধ্যে যে হরফগুলো দেখতে পাই, যেমনঃ আলিম লাম মিম। এই হরফগুলোকে বলা হয় অায়াতে মুতাশাবিহ (রুপক) । বাংলা কোরআনে বঙ্গানুবাদের মধ্যে ফুটনোট করে নিচে লিখে দেয়া হয়েছেঃ  এর অর্থ একমাত্র আল্লাহপাক ই ভালো জানেন । তার মানে দাঁড়ালো যার মধ্যে ইলম.ই.সিনা আছে, সে এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে। কিন্তু এরুপ লোক কি দুনিয়াতে আছে? আর থাকলেও তারা মোল্লাদের ভয়ে প্রকাশ্যে বের হতে সাহস পাচ্ছেন না। কোন তথ্য প্রকাশ করতে পারছেন না। অার প্রকাশ করার পর দেখা যায়, তাদের লেখাগুলো অর্থাৎ বইগুলো বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। এর কারণ কি? তিনি শুনেছেন হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ আমি রসুল (সাঃ) পাকের নিকট হতে দুই পাত্র জ্ঞান লাভ করেছি। একটি তোমাদের মাঝে প্রকাশ করেছি আর অন্যটি যদি প্রকাশ করি তাহলে আমার খাদ্যনালী কর্তিত হবে। তার মানে, ইলম.ই. বাতেন সে যুগেও ছিল।

মজিদ স্যারের ভ্রুু কুঞ্চিত হলো। তিনি ভাবলেনঃ তার মানে পীর যারা, তারাই রাসুলের (সাঃ) পাকের সিনার জ্ঞান লাভ করেছেন বংশানুক্রমে। কিন্তু তাঁর বংশতো কারবালাতেই শহীদ হয়েছেন। সেখানেইতো সমাপ্তি ঘটেছে ইসলামের। তাহলে হাল আমলে যে ইসলাম দেখা যাচ্ছে, সেই ইসলামটিই বা কোথা থেকে এল?
(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী-পর্ব চতুর্থ



(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)
ডায়েরীটা পড়ার পর মজিদ স্যার বেশ দোটানায় পড়ে গেলেন। তিনি চিন্তা করে ভেবে পেলেন না, নিষাদের বাবা যে ডায়েরীটা লিখে রেখেছে, নিষাদকে দেয়ার জন্য। সেটা পড়ে তো নিষাদের ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে যাবে। কি করা যায়? এমন একটা বদ্ধ উম্মাদ তার ছেলের ভবিষ্যৎটা এভাবে নষ্ট করবে? এটা হতে দেয়া যায় না। তিনি ঠিক করলেন, ডায়েরীটা তিনি নিজের কাছে রেখে দেবেন। সেটা কি ঠিক হবে? কি করা যায়...না...কি...নিষাদের সাথে কথা বলবেন?
কি বলবেন নিষাদকে? তোমার বাবা কি পাগল ছিল? না কি বদ্ধ উম্মাদ ছিল? বাবা সম্পর্কে ছেলেকে কি এভাবে জিগ্যাসা করা শোভনীয় দেখায়?
নাহ্....ডায়েরীটা পড়াই ভুল হয়েছে। আবার তার মনটা বলছে...পড়েই দেখা যাক না...কি আছে তাতে....তিনি আবারো ভাবতে ভাবতে ডায়েরীটা খুলে পড়া শুরু করলেনঃ

প্রিয় নিষাদ,
বাবা, তুমি কেমন আছো?
তোমাকে না বলেছি, কখনো কোন চিন্তা করবে না। চিন্তার কি আছে? অামি নেই তো কি হয়েছে? তোমার মা নেই তো কি হয়েছে? জগতের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে। এটা বিধাতার নিয়ম।
কেন এই নিয়ম? তাইতো? তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে না? নিশ্চয়ই করছে।
শুন বাবা, মৃত্যুটা হলো একটা পরিণতি। এই পরিণতির কারণ-নতুন কিছু সৃষ্টি করা। অাল্লাহ পাক প্রতিটি বস্ত্তুকে নিত্যনতুনরুপে সৃষ্টি করে চলেছেন। আরেকটা কথা বাবা। তুমি যাকে অাল্লাহ বলে জানো, সেই অদৃশ্য আল্লাহ নিরাকার। নিরাকার অাল্লাহকে সকলেই মানে। কিন্তু সাকার আল্লাহকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। সাকার হলো একটা গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। মহান আল্লাহ পাক মোটেও সীমাবদ্ধ নন। তিনি অসীম। তিনি অনাদি অনন্ত। তাই মানুষ যখন নিজেকে আল্লাহ বলে প্রচার করে, তখন সাধারণ মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ কি? কারণ, তিনি কি রুপ, তা ঐসমস্ত লোকেরা জানে না। তারা মেনে নিতে চায় না। মহান আল্লাহ বলে যাকে জানে, সে মানুষের মতো কেউ হোক, তা তারা চায় না। কারণ, তাদের মনটা সেই মহান জাত পাককে দেখেনি। যদি দেখতো, তো তারাও হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) এর মতো বলে উঠতোঃ

অায় মেরে মাওলা তু ছবছে আলা,
তুহি হ্যায় আফজাল তুহি হ্যায় আহসান
অনাদি অনন্ত ছেফাত তোমহারি,
তুমহিছে পয়দা হ্যায় ছারে জাহান।
জমি জমামে মকি মোকামে হর এক জাগামে তোমারি জালুয়া
কুদরত কা তেরি নাহি কিনারা
ছবহি হ্যায় শাষদার ছবহি হ্যায় হয়রান।
অর্থঃ হে আমার প্রভু! তুমি সবকিছুর চেয়েও সুন্দর।
অনাদি হতে অনন্ত তোমারই সমস্ত প্রশংসা।
তুমি.ই এই বিশ্বজাহান সৃষ্টি করেছো।
প্রত্যেকটি স্খানেই তোমার প্রতাপ বিদ্যমান।
তোমার কুদরতের কোন কিনারা নেই।

শুন বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। ফরিদউদ্দিন আত্তার তাহার শেষ গ্রন্থ 'লিসানুল গায়িব' পুস্তকে বলেছেনঃ
আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অজুদ
হর যমাঁ খোদরা বা-নকশ ওয়া নমুদ;
জুমলা যাতে জাঁহানে মিরআতে উস্ত
হরচে বিনি মুসহাফে আয়াতে উস্ত;
"লাওহে-মাহফুয" আস্ত, দর মা'নী দিলাত
হরচে মি খাহী, শোদ যে উ হাসেলাত।
উনচে মাতলুবে-জাঁহা শোদ দর জাহান
হাম তুরী, ও বায জো আজ খোদ নেশান।।
অর্থাৎ তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি শরীরী-জগতে প্রতি মুহুর্তে নব নব রুপে প্রকাশিত হইতেছেন। বিশ্বের সকল অস্তিত্বই তাহার মুকুর। যাহা কিছু দেখিতেছ সমস্তই তাহার প্রকাশ-চিন্হ। প্রকৃতপক্ষে তোমার অন্তরই "লওহে মাহফুয"। যাহা কিছু চাও উহা হইতেই তাহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে। যিনি এই বিশ্বে সারা দুনিয়ার কাম্য, তুমিই তিনি। তোমার নিজের ভেতর তাহার সন্ধান কর।
মনে রেখো বাবা, সুফীরা আল্লাহ পাকের দীদারে থাকেন। তাঁদের কালামে অনেক রহস্যাবলী লুকিয়ে আছে। তাঁদের ধ্যান সাধনায় তারা তন্ময় থাকেন কেবল প্রভুর দীদার লাভের অাশায়। জগতে যত দর্শন আছে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দর্শন হচ্ছে সুফীদর্শন। প্রাচ্যে এর সমাদর দিনকে দিন বাড়ছে। আর আমাদের দেশে কমছে। কারণটা হলোঃ ধর্মীয় গোঁড়ামী। গোঁয়ার্তুমি করা। এরা কখনো দর্শন পড়েনি। দর্শন বোঝার চেষ্টাও করেনি। তাই, তুমি কখনো কোনো ঝগড়া বিবাদে যেও না। জোর করে কাউকে বোঝাতে যেও না। কথা বলবে মেপে মেপে...জন বুঝে.....কুতর্কে জড়িও না....কারণ হেদায়েত কেবল মাত্র আল্লাহ পাকের হাতে...তিনি যাকে হেদায়েত দেবেন, তিনিই হেদায়েত প্রাপ্ত হবেন। আজ এ পর্যন্তই ।
ভালো থেকো বাবা
ইতি
তোমার বাবা

লেখাটা পড়ে মজিদ স্যার ভ্রু কুঁচকালেন। সুফী দর্শন....সেটা আবার কি?
(চলবে)

বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী - তৃতীয় পর্ব


(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মজিদ স্যার একবার ভাবলেন-তিনি নিষাদকে ডাকবেন এবং জিগ্যেস করবেন, তার বাবা কোথায় মুরিদ হয়েছেন? আর কেনই বা তিনি নিষাদকে মুরিদ হতে বলেছেন?  আবার ভাবলেন, নাহ্ এটা করা ঠিক হবে না। কেননা, নিষাদ বুঝে ফেলবে। তার বাবার ডায়েরীটা আমি পড়েছি। আর পড়লেই বা কি? শিক্ষক হিসাবে আামার একটা দায়িত্ব আছে। ছেলেরা ক্লাসে কে,কি পড়ছে, তা দেখার। কাজেই সে ডায়রিটা পড়তেই পারে। এটাতে তিনি কোন দোষ দেখছেন না। তিনি আনমনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছেন। আর নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।  তিনি আড়চোখে নিষাদের দিকে তাকালেনঃ
দেখলেন, ছেলেটা ঠিক মতোই পড়া শোনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর নিষাদের পাশে বসা ছেলেটি ফিসফিস করে কি যেন বলছে? তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, তৃতীয় বেন্ঞ্চের কর্ণারে বসা ছেলেটি খাতা বের করে কি যেন লিখছে? তারপাশে বসা অন্য আরেকটি ছেলে সেটা দেখছে....একদম শেষের কর্ণারের দিকে একটি ছেলে বইয়ের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে...তিনি হুংকার দিয়ে বললেনঃ

-সবার পড়া হয়েছে?
 ছাত্ররা সমস্বরে বললোঃ

-জ্বী স্যার...

-ঠিক আছে। বই বন্ধ কর। এ্যাই ছেলে, তুমি দাঁড়াও...বলো আজকের পড়া বলো দেখি...হাটতে হাটতে তিনি সেই ছেলেটির কাছে গেলেন।

ঘুমিয়ে থাকার কারণে সে বুঝতেই পারছে না...কি পড়ানো হচ্ছিল...সে মজিদ স্যারের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো...সেটা দেখে মজিদ স্যার বেজায় রেগে গেলেন। তিনি ঠাস করে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন ছেলেটির গালে...চড়ের ভার সামলাতে না পেরে ছেলেটির গালটি লাল হয়ে গেল....এবং সে কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়লো। মজিদ স্যার, জিগ্যেস করলেনঃ

-কি নাম তোর?

-স্যার রাব্বি.....কাঁদো কাঁদো ভারী গলায় ছেলেটি তার নাম বললো। 

-নে ঠিক মতো পড়। বই বার কর। তারপর দেখে দেখে পড়া মুখস্ত হলে বলবি...এ্যাই তোরা এই চাপ্ট্যারটা ভালো ভাবে পড়বি। বুঝলি...এইটা খুব ইমপটেন্ট...পরীক্ষায় আসতে পারে..নে সবাই আবার পড়...
ছেলেরা সবাই বই বের করে পড়তে লাগলো....


পুরো ক্লাসে একটা গুণ গুণ ভাব উঠলো। ছেলেরা দুলে দুলে স্বর করে পড়তে লাগলো...মজিদ স্যার ঘড়ি দেখলেন। দুটা চব্বিশ...আরো বিশ মিনিট হাতে আছে। ক্লাস শেষ হতে। তিনি আবারো তার আসনে বসলেন এবং সেই ডায়েরীটা হাতে নিলেন। তারপর চিন্তা করলেন....পড়বেন কি-না? তিনি আবারো ডায়েরীতে হাত দিয়ে মাঝখান থেকে পৃষ্ঠা বের করলেন এবং পড়া শুরু করলেন...

বাবা নিষাদ,
তোমাকে কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ কথা বলবো। তুমি কথা কয়টি খুব মনোযোগ সহকারে বার বার অধ্যয়ন করিবে। বুঝিবার চেষ্টা করিবে, কেন তোমাকে এই গুরুত্ব পুর্ণ কথা কয়টি বললাম? শুনো সেই গুরুত্বপুর্ণ কথাঃ

"জগতে কোন কিছুই বিধাতা অযথা সৃষ্টি করেন নাই । সমস্ত সৃষ্টিই দুইটা ভাগে বিভক্ত। একটা হিজবুল্লাহ তথা আল্লাহ্ তায়ালার দল আর অন্যটি হলো হিজবুত শয়তান তথা শয়তানের দল। আল্লাহ পাক তাহার নিজের দলকে তিনি নিজেই হাদিরুপে হেদায়েতের দায়িত্ব নিয়াছেন। বলা হইয়াছেঃ লি কুল্লি কাওমিন হাদিন। প্রত্যোকটি সম্প্রদায়ে হাদিন তথা পথ প্রদর্শক প্রেরণ করা হইয়াছে। এছাড়া আরো বলা হইয়াছেঃ "মান হাদি আল্লাহু ফা হুয়াল মুহ্ তাদি ওমাইয়ুদ দলিল ফালান তাজিদালাহু ওয়ালিয়াম মুর্শিদা"। সুরা কাহাফে আল্লাহ পাক বলিতেছেনঃ আমি যাহাকে হেদায়েত দান করি সে.ই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। আর যাহাকে গোমরাহিতে রাখি, তাহার জন্য কোন অলীয়ে মুর্শিদ রাখি নাই। কাজেই, যে তোমার মুর্শিদ সেই তোমার রসুল এবং সে.ই আল্লাহ হয়। সেইটা কিভাবে হয়, সেইটা তোমাকে বুঝিতে হইবে। মনে রাখিবে - এই বিষয়টা নিয়া জগতে মারামারি, কাটাকাটি পর্যন্ত হইয়াছে। অনেককে মারিয়া ফেলা হইয়াছে....অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিতে হইয়াছে.... অর্থাৎ নানান বিপদের মধ্যে পতিত হইতে হইয়াছে। কাজেই, সাবধান থাকিবে। আর গাধার দলের সাথে তর্কে মাতিও না। তাহা হইলে তোমাকেও সেই দলের মধ্যে গণ্য করা হইবে।"

বাবা, নিষাদ তুমি ভালো থাকিও। আর দুঃচিন্তা করিও না....কেন না, আল্লাহ পাক বলিয়াছেনঃ ইল্লালল্লাহ মাস সাবেরীন। তিনি সবরকারীর সাথেই আছেন। যার সাথে আল্লাহ থাকেন, তার কি কোন ভয় বা দুঃচিন্তা থাকে? থাকে...না...থাকবেও....না...ভালো থাকো।

ইতি 
তোমার বাবা

বিঃদ্রঃ
তোমাকে সাহায্য করার জন্য জগত বিখ্যাত কিছু অলীআউলিয়াগণের মন্তব্য প্রদান করিলাম।
হজরত মুজাদ্দেদে আলফেসানি বলেছেন, পীরে তাস্ত আউয়াল মাবুদ তাস্ত অর্থাৎ ‘তোমার পীরই তোমার প্রথম মাবুদ।' (মাতলাউল উলুম ৮৬ পৃ)।
হজরত হাফিজ সিরাজিও এরকম কথাটিই বলেছেন। তবে ভাষাটি অন্যরূপ। হজরত হাফিজ সিরাজি বলেছেনঃ
আপন পীরের ধ্যানে নিরিখে-বরজখে, বছরের পর বছর নির্জনে ধ্যানসাধনা করার পর যখন আপন পীরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ফানা হয়ে গেলাম এবং কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না, তখনই দেখতে পেলামঃ আমার পীরও আমি, আমার মুরিদও আমি।
ফারসি ভাষায় বাক্যটি এই রকমঃ
‘চু খুদরা বিনগারাম দিদাম হামু নাস্ত জামালে খুদ জামালে ইয়ারে দিদাম।'
অন্যত্র হজরত হাফিজ সিরাজি, যাঁর নামাজে জানাজা সেই দিনের মোল্লারা পড়ে নি, সেই হাফিজ সিরাজি ফারসি ভাষায় বলছেন,
‘নামাজে মোলা মেহরাবে মিম্বার,
নামাজে আশেকা বারদারে দিদাম।' অর্থাৎ ‘মোল্লার নামাজ মেহরাব থেকে মিম্বারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর প্রেমিকেরা নামাজ পড়েন ঠাট্টা-তামাশার শূলের উপর দাঁড়িয়ে।' আরও উলেখ করা যায় যে, হজরত হাফিজ সিরাজি তাঁর রচিত বৃহৎ দিওয়ান-টির প্রথমেই উলেখ করেছেনঃ শুরু করলাম আপন পীর ও মুরশিদের নামে।

মজিদ স্যার বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেনঃ এটা কেমন কথা? মানুষ আল্লাহ হয় কিভাবে? নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক। এই লোকটার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ ছিল। মাথা থারাপ না থাকলে কিভাবে বলতে পারে - মানুষ নবী, মানুষই আল্লাহ....এ কথা ভাবাও তো পাপ...তিনি অসতাগফিরুল্লাহ মিন জালিক বলে বেশ কয়েকবার আউরালেন। আর আল্লাহ পাকের কাছে পানাহ চাইলেন...হে আল্লাহ, তুমি আমাকে হেদায়েত দান কর...ফেতনা ফ্যাসাদ থেকে বেচে থাকার তওফিক দান কর। আমিন।
(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী-দ্বিতীয় পর্ব

 (পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মজিদ স্যার বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ডায়েরীটার ভুমিকা অংশে দেখতে পেলেন সেখানে লেখা আছেঃ

' অামি আমার যাবতীয় জ্ঞান এবং উপলব্দি দিয়ে যা বুঝেছি, তা হলোঃ ঈশ্বরকে উপলব্দি করা। 
ঈশ্বর কি? এবং কেন তিনি এ বিশ্ব জাহান তৈরী করলেন? এর পেছনে কি উদ্দেশ্য আছে? তা জানা প্রতিটি মানবেরই মহান দায়িত্ব। কেননা, তাকে না জানলে এবং না বুঝলে কেন তিনি এই বিশ্ব জাহান তৈরী করেছেন, সেই মুল উদ্দেশ্য জানা সম্ভবপর নয়। তাই প্রতিটি মানবেরই প্রধান এবং প্রথম দায়িত্ব হলোঃ ঈশ্বরকে জানা এবং তার এই বিশ্ব জাহান সৃষ্টির মুল উদ্দেশ্য জেনে সেই অনুপাতে কর্ম করা। আমি এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমার পুত্রকে কিছু উপদেশনামা এবং করণীয় কর্তব্য সমুহ তুলে ধরার জন্যই এই ডায়েরীতে তা লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। যাতে আমি না থাকলেও তার যেন চলতে ফিরতে কোন প্রকার সংশয় উপস্থিত না হয়। সে যেন বিনা দ্বিধায় এই ধরণীর কর্ণ্টকময় পথ অতিক্রম করে যেতে পারে।'

মজিদ স্যার বুঝতে পারলেন না, এই এতটুকু শিশুর কাছে এই ডায়েরীতে যা লেখা আছে, তা সে কিভাবে উপলব্ধি করবে? ছেলেটি সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। এই ছেলের বুঝই কতোটুকুই হয়েছে? সে কিভাবে এই মহান ঈশ্বরকে উপলব্দি করবে? তিনি মনে মনে ভাবলেনঃ লোকটির কি মাথা খারাপ ছিল না-কি? মাথা খারাপ না হলে এই এতটুকু ছেলের হাতে কেউ এমন দার্শনিকভংগীতে লেখা ডায়েরীটা তুলে দিতে পারে না....আমার ধারণা, লোকটার মাথা খারাপ ছিল এবং অবশ্যই উদভ্রাণ্ত এবং পাগল প্রকৃতির কেউ ছিলেন। এ কথাটা মনে করে তিনি হাসলেন। তারপর তাকালেনঃ নিষাদের দিকে...দেখলেন, ছেলেটি মাথা নিচু করে পড়ছে। তিনি আর তাকে ডাকলেন না। তিনি আবারো সেই ডায়েরীটার পাতা উল্টালেন। দেখতে চাইলেন, ভেতরে কি লেখা আছে? পরের পাতা উল্টাতেই তার চোখে পড়লোঃ

প্রিয় নিষাদ,
বাবা, তুুমি কেমন আছো?
তোমার নিশ্চয়ই চিন্তা হচ্ছেঃ এই এতো বড় বিশ্বে তুমি কিভাবে চলবে? তোমার তো মা-বাবা কেউ নেই। কে তোমাকে লালন পালন করবে? কে তোমাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে? কে তোমাকে বাবার মতো শাসন করবে? আদর করবে? 
ভয় পেও না বাবা। জেনে রাখো, আমি এবং তোমার মা, তোমাকে জন্ম দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু তুমি এই ধরণীতে এসছো কেবল সেই পরম প্রভুর হুকুমে। সেই পরম প্রভুই তোমার প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা। তিনিই তোমার উত্তম অভিভাবক।
সার্বিকভাবে, আমরা তাঁকে চিনি না, জানি না, দেখি না, শুনি না অথচ তিনি আছেন। সেই উপলব্দিটা আমরা টের পাই যখন উপরের আসমানের দিকে তাকাই। আমরা যখন রাতের আকাশের দিকে তাকাই, তখন আমাদের মনে চিন্তা রেখাটা স্পষ্ট হয়। এই যে, মাথার উপর একটি অপরুপ আকাশ দিয়েছেন, নক্ষত্র খোচিত সুন্দর একটি চাঁদ দিয়েছেন, লালন-পালনের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস দিয়েছেন। প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন তারই মতোন করে সুন্দররুপে। তিনি নিশ্চয়ই সুন্দর। তাই, তাঁর সৃজিত প্রতিটি বস্তুই সুন্দর। শুধু্ উপলব্ধি করার মতো একটা সুন্দর হৃদয় পেলেই তুমি তাকে তোমার ভেতর আবিষ্কার করতে পারবে। কিভাবে? তাইতো ভাবছো? তাই না, বাবা....
শুন বাবা হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) তাঁর রচিত চিশতী উদ্যানে বলেছেনঃ

খোদার প্রেমে শরাব যদি করিতে চাহ পান ওহে মন
গড়িয়ে তোলো হৃদয়খানি, নহেতো হবে মিছে বিড়ম্বন।।
তনমন আপনা বিদায় কর ধরিয়া মুর্শিদের চরন
রাহাতে বসি থাকো সর্বদা যদি সে চাহ তার মিলন।।

তোমাকে একজন গুরুর কাছে যেতে হবে। যে তোমাকে এই শিক্ষাটা দেবেন। সেই শিক্ষানুযায়ী তুমি পথ চলিবে। তোমার ভেতর লূকিয়ে থাকা খান্নাসকে বের করে তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, তোমার সেই চিরাচরিত মহান সৃষ্টিকর্তাকে। সেই মহান সৃষ্টিকর্তা তোমার ভেতরই আছে। সেটা কোথায় লুকিয়ে আছে, তা তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। এই জন্যই বলা হয়েছেঃ 'রাহাতে বসি থাক সর্বদা, যদি সে চাহ তার মিলন' । তোমার মনে সেই অাশাটা পুষিয়ে রাখার জন্যই সর্বদা কথাটির উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে তুমি সবসময় তারই স্বরণে থাকো। শুন বাবা, তিনি আরো বলেছেনঃ

কাঁহা ছে আনা, কাঁহা ছে জানা, নাই নিশানা, নাই ঠিকানা
সে কিভাবে আসে, কিভাবে যায়.....তা তুমি নিজেই উপলব্দি করিতে পারবে...তখন তুমি আর তুমি থাকবে না...তোমার ভেতর থাকবে অন্য তুমি....এই অন্য তুমিটা টের পাবে তোমার ভেতর যে লাবডুব শব্দটা হচ্ছে....সেটার মাধ্যমে.....ইমানুয়েল কান্ট-এর ভাষায়ঃ
দুটি জিনিস আমার ভেতর ভয় ধরিয়ে দেয়। একটা হলো মাথার উপর খোলা অাকাশ অার অন্যটা হলোঃ আমার ভেতর যে কথা কয়.....
বাবা, আজ এ পর্যন্তই। যাবার আগে আবারো বলছি, তোমার প্রথম কাজ কি? তোমার প্রথম কাজ হলোঃ একজন গুরু তালাশ করা। পরিশেষে তোমার মঙ্গল কামনায়-

ইতি
তোমার বাবা


পুরো লেখাটা পড়ে মজিদ স্যারের ভ্রুু কুচকে গেল....তিনি মনে মনে ভাবলেনঃ এতো দেখছি মহান পুরুষ বানানোর দীক্ষা দেয়া হচ্ছে....তিনি আবারো নিষাদের দিকে তাকালেন...ছেলেরা কি পড়ছে না পড়ছে....তিনি তা বেমালুম ভুলে গেলেন...তিনি একবার ডায়েরীটার দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার নিষাদের দিকে তাকাচ্ছেন....
(চলবে)