পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

স্বরলিপি-স্বর্বেসত্ত্বার প্রকাশরুপঃ শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

-খান্নাস মানে কি? জানস?

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যাসা করলেন। আমি বললামঃ

-জানি না।

-খান্নাস মানে অইলো যে কুমন্ত্রণা দেয়? কেমতে দেয়? দেখবি খেয়াল কইর‌্যা-তুই যদি কোন একটা বিষয়ের দিকে গভীর মনোযোগ দেস, তখন তর মনোযোগ নষ্ট করার জন্য হেইড্যা আরেকদিকে লইয়্যা যাইব। ধর, তুই একটা মাইয়্যার দিকে তাকালি। তারপর হেই মাইয়্যার দিকে তাকানোর পর ঐ মাইয়্যাডার ছবি তর মনে কামনার ভাব জাগাইলো। তোরে কে যেন কইবো-দ্যাখছস কি সুন্দর একটা খাসা.....এই যে তোরে একটা খারাপ কাজের দিকে নিয়্যা যাইত্যাছে......এইডাই অইলো খান্নাসের কাজ। 
হোন, মানুষের মইধ্যে ছয়ডা খারাপ জিনিস আছে। হেইগুলিরে কয় রিপু। হেইগুলি অইলোঃ কাম,ক্রোধ,লোভ,মোহ,মদ, মাৎসর্য্য। এই ছয়ডারে কোন কোন গানে কইছে চোরা...ছয় চোরা...এইগুলিরে দুর করার চেষ্টা করবি। বুঝলি....

-এই গুলো দুর করলে কি হবে?

-এইগুল্যা দুর অইলে তোর মনডা পবিত্র অইয়্যা যাইবো গা। এইডারে কয় তাজকিয়ায়ে নফস। তুই পাক পবিত্র অইয়্যা হের (সৃষ্টিকর্তার) কাছে থিক্ক্যা আইছোস। আবার হের কাছেই ফিরর‌্যা যাইতে অইবো পাক পবিত্র অইয়্যা। যতক্ষুণ তুই তোরে পবিত্র না কইর‌্যা দুইন্ন্যা থিক্ক্যা বিদায় না নিবি...ততবার তোর পুনঃজন্ম  অইবো। খালি বার বার এই দুইন্ন্যার মইধ্যেই আওয়া যাওয়্যার মইধ্যেই থাকবি। খালি আবি আর যাবি...যত আবি তত তোর দুঃখ বারবো।

-আচ্ছা ঠিক আছে। সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্ত্তু আপনে যে কথাগুলো বলছেন, সেটা কি কোরআনে আছে?

-থাকবো না ক্যা..তুই কি সুরা ফজর পরস নাই...ইয়্যা অাইয়্যাুহাল নাফসুল মুতমাইন্ন্যা...ইরজিইলা রাব্বিকি রাদিয়াতুমমারজিয়্যাতাম। ফা ইদখুলি ফি ইবাদি ওয়াদখুলি জান্নাতি। হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।

-না। অামি সত্য কথাটাই বললাম। 

-হুম। তুই কি জানিস, কোরআন কি?

-কোরআন অাল্লাহর বাণী। কোরআন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপর অাল্লাহ পাক হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর মাধ্যমে নাযিল করেছেন।

-যেইখানে আল্লাহ পাক বলতাছেঃ ওয়া ফি আনফুসিকুম আফালা তুবছিরুন। নাহনু আকরাবু ফি ইলাহি হাবলিল ওয়ারিদ। আমি তোমার সাথেই আছি অতঃপর তোমরা কি দেখতে পাও না? আমরা তোমার শাহ রগের নিকটেই আছি....আর তুই কস আল্লাহর বাণী আননের লিগ্যা হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর দরকার অইছে? ক্যা, হেয় কি কতা কইতে পারে না?...মাঝ খান থিক্ক্যা জিব্রাইলরে আনলি.....তুই কি জানস বাণী কি? বাণী মানি অইলো কতা। কতা কওনের লিগ্যা মুখ লাগে। মুখের লগে স্বরনালী লাগে। আইচ্ছা তুই ক স্বরবর্ণ কি? নাহ্ তর কওনের দরকার নাই। স্বর বর্ণ অইলো যেই বর্ণ উচ্চারণের লিগ্যা স্বরযন্ত্র লাগে। স্বর যন্ত্র কারে কয়, জানস? স্বরযন্ত্র অইলো - মুখ,দাঁত,তালু, জিহ্বা, আলজিহ্বা ইত্যাদি মিল্ল্যা অয় স্বরযন্ত্র। হেই স্বরযন্ত্র উচ্চারণের স্থানের কারণে বিভিন্ন নাম অইছে। যেমুন সরে অ, সরে আ হ্রঅ ই, দীর্ঘ হ্রঅই.........এইগুলি কই থিক্ক্যা আহে...ক দেহি....এই গুলা আহে অন্তরের অন্তঃস্থল থিক্ক্যা...হেই হানেই হেয় বইয়্যা কতা কয়..ধ্যানে বইলেই তুই দেকতে পারবি....কইথিক্ক্যা কতার উৎপত্তি অয়...কেডা কতা কয়...চাইরট্যা পবিত্র শক্তি জাগাইতে পারলেই কোরআন নাজিল অয়...হেই চাইরডা পবিত্র শক্তি অইলোঃ আলমে লাহুত, আলমে জবরুত, অালমে হা-হুত, আলমে নাসুত। সবগুলির মইধ্যেই চারজন ফেরেস্তা থাকে..হেই ফেরেস্তা অইলো....

-হালার পো...ফাইজলামির আর জায়গা পাও না...এতক্ষণ তর বকবকানি শুনছি। তুই আমারে স্বরবর্ণ ব্যান্ঞ্জন বর্ণ শিখাস? আমি কি লেখা পড়া করি নাই? নাকি না শিখেই চাকরি করছি...তোর মতন পাগল ছাগলের সাথে বসাটাই আমার ভুল হইছে...কেন যে তোর কাছে বসলাম...যা ব্যাটা...তুই কি বেশি জ্ঞানী অইয়্যা গেছস...
আমি কথাগুলো বলে ঐ ব্যাটার কাছ উঠে দাঁড়ালাম।

-কি রে জাহিদ...তুই কার সাথে কথা বলছিস...আর এই কলা, রুটি, পানি নিয়ে এই অন্ধকারে তুই কি করছিস...

আমি পেছনে তাকাতেই দেখি সাদেক আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখে। সাদেক আমার রুমমেট। সাদেককে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও মনে সাহসের সঞ্চয় হলো। আমি সাদেকের দিকে তাকিয়ে বললামঃ

-এই হালার পাগল ছাগল আমারে কি সব আজে বাজে কথা বলছে...পবিত্র কোরআনের বাণীর অবমাননা করছে...কি সব বকবকানি..যত্তসব ছাগল পাগলের দল....গাধা কোনখানের...

-কই? আমিতো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না..কেউ তো সেখানে নাই। তুই তো একা একা বির বির করছিস। তোর কথা শুনে আমি দেখতে চাইলাম....তুই কার সাথে কথা বলছিস...

-এই যে....এই যে এইখানেই....
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই। পানির বোতলটা সেখানেই পড়ে আছে। রুটি, কলাগুলো সেখানেই পড়ে আছে। তাহলে আমি কার সাথে কথা বললাম....কে আমাকে বললোঃ আমার খুব খিদে লেগেছে..আমাকে রুটি কলা কিনে দে....আমি প্রায়ই জ্ঞান হারাতে বসেছিলাম...ঠিক সেই মুহুর্তে সাদেক আমাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ

-চল...বুঝেছি। আর দাঁড়াস না...তাড়াতাড়ি কর। চল্ মেছে যাই....

যেতে যেতে সাদেক বললো-শোন, বছর প্রায় চার/পাচ হবে। এই এলাকায় একটা পাগল গোছের লোক থাকতো। সে কি সব তরীকত ফরিকত করতো। আর লোকজনের দেখা পেলেই নানান সব কথা বলতো। পাগল মানুষ। কেউ তার কথা আমলে নিতো না। লোকজনের কাছে চেয়ে চিন্তে এটা ওটা খেতো। লোকজনও তাকে খাওয়াতো। কোন একটা কারণে লোকজন তাকে চোর ভেবে পিটিয়ে আধ মরা করে ফেলে। তার হাত পা ভেঙ্গে যায়। চলতে পারে না। কিছুদিন সেই লোকটা মারা যায়। তারপর শুরু হয় অন্য কাহিনী। নির্জনে কাউকে একা পেলেই সে দেখা দেয় এবং কিছু খায়নি বলে এটা ওটা অানায়। তারপর একসময় দেখা যায়...যে লোকটার সাথে কথা বার্তা বলছিল, সেই লোকটা সেখানে নাই....এই হলো এই পাগলের কাহিনী। তুই মনে হয় তাকেই দেখছিলি...

সাদেকের কথা শুনে আমি কেমন যেন ঘাবড়ে গেলাম। রুমে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেলাম। তারপর বাতি নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়লো। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্ত্তু ঘুম আসছে না। মনে হলোঃ আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। লোকটি আমার কাছে খাবার চাইলো। আনলাম। সে আমার সামনেই খেল। তারপর সে পবিত্র কোরআন শরীফের তরজমা করে শোনালো...কথা বললো। কথার শব্দ মালা কোথা থেকে উৎপত্তি হয়, সেটা বললো। কে কথা বলে.....সেটাও বললো......আমিতো সব কথাই নিজ কানেই শুনেছি। কিন্ত্তু লোকটি গেল কোথায়......কিভাবে গেল.......রাত প্রায় পৌণে চারটা বাজছে। আমার পাশে কেউ নেই। সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ...তাদের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে...আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর চোখ বুঁজে সেই কথা চিন্তা করছিলাম। কোন শব্দ নেই...সুশান নীরবতা...আমি চোখ বুঁজতেই শুনতে পেলাম আমার হৃদস্পন্দন লাব..ডুব...লাব...ডুব....লাব...ডুব .......কে বলছে....কে শব্দ করছে....তাহলে কি সে.ই এই শব্দ করছে.......

সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬

স্বরলিপি-সর্বেসত্ত্বার প্রকাশরুপঃ প্রথম পর্ব

আমি যেদিকে থাকি, সেদিকটা হচ্ছে মীরপুর ১নং গোলচত্ত্বরের পিছনের দিকটায়। অর্থাৎ কলওয়ালাপাড়া মসজিদের গলি। সেই গলিটা থেকে কিছুদুর আগালেই পড়ে লন্ডন হারবার। তার ঠিক পেছনটায় একটা টিনশেডের একটা মেছ আছে। সেই মেছে। গলিটার মাথায় বেশ কিছু ল্যাম্পপোষ্ট আছে। কিন্ত্তু সেই ল্যাম্পপোষ্টের অধিকাংশ ল্যাম্পই ফিউজ। তাই গলিটা অন্ধকারে ঢেকে থাকে। মাঝে মাঝেই ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। তাই আমি ভয়ে ভয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছি। যেহেতু আজ দেরী হয়ে গেছে...তাই দ্রুতই হেঁটে যাচ্ছি। ঠিক সেই সময় একটা ডাক শুনতে পেলামঃ

-এই খোকা, এই দিকে আয়...

আমি চার ধারে তাকালাম। কাকে ডাকছে? কে ডাকছে? তাছাড়া আমাকে তো খোকা বলার কোন কারণ নেই। আমি আবারো তাকালাম। নাহ্ কাউকেই তো দেখছি না....তাহলে কে ডাকছে এই খোকা বলে...আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমার মতো করে। যখন আমি হাঁটছি...ঠিক তখনই আবার সেই ডাকটা শুনতে পেলাম...এই খোকা এইদিকে আয়তো বাবা....

অামি আবারো পিছন দিকে তাকালাম। ভালো করে খুঁজে দেখার জন্য একটু পেছনের দিকেও আগালাম। ঠিক তখনই দেখতে পেলাম-একটা লোক জীর্ণ শীর্ণ কংকালসার দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লোকটিই আমার দিকে ইশারা করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকছে...এই খোকা বলে...কিন্ত্তু আমাকে ডাকার কারণ কি? আমিতো খোকা নই...তাহলে আমাকে ডাকার কারণ কি? আর ডাকলেই কি? আমি কেন যা'ব? এই রকম সাত-পাঁচ ভাবছি আর ঠাঁয় দাড়িয়ে আছি।
 লোকটাকে দেখলাম কিছুটা স্মীত হাস্যবদনে আমার দিকে তাকিয়ে আবারো ইশারা করে ডাকলো। এবার আর সাত-পাচ না ভেবেই তার কাছে গেলাম এবং জিগ্যাসা করলামঃ

-আপনি কি আমাকে ডাকছেন?

-হ বাজান।
 লোকটা কথাটা বলতে বলতে মনে হলো হাঁপাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মনে হয় পড়ে যাবে।  আমি তাকে ধরে বসিয়ে দিলাম। সে বসে বললঃ

-বড়ো খিদা লাগছে...আমারে একটা কলা আর একটা পাউরুটি কিন্ন্যা দিবি?

-এত রাতে?  কোথা থেকে কলা রুটি কিনবো?
অামি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় পৌণে একটা বাজে। এত রাতে কি দোকান পাট খোলা থাকবে?

-থাকবো? 

-কি থাকবো?

-দোকান পাট খোলা থাকবো। 

-আপনে জানলেন কিভাবে? আমি বেশ অবাক হয়েই তাকে জিগ্যাসা করলাম।

-অামি কেমতে জানলাম, হেইডা তর জাননের দরকার নাই। বাজান,তুই মেন রাস্তার ঐপারে যা। যেই রাস্তাটা শাহ্ আলী বাবার মাজারের দিকে গেছে। ঐ জায়গায় গেলে দেখবি দোকান-পাট খোলা আছে।যা, বাবা । আমার বড্ড খিদা লাগছে...


লোকটির কাতর কন্ঠ আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিল। অামি না করতে পারছি না। আমার লোকটাকে এভাবে ক্ষুধার্ত দেখে তাকে ছেড়ে আসতেও পারছি না। ভাবলাম তাকে কিছু টাকা দিয়ে অামি বিদেয় হই। কিন্ত্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, লোকটি যদি হাঁটতেই পারতো, তাহলে সেতো বহু আগেই সেইদিকটায় চলে যেতো। অামি চিন্তা করতে করতে হাঁটছি আর মনে মনে বলছি কথাগুলো। আবার ভাবছি আমার মনের কথা লোকটা কিভাবে জানতে পারলো? তাহলে লোকটা কি মাইন্ড রিডার? অর্থাৎ মানুষের মনের কথা রিড করতে পারে? দেখাই যাক না...যা হয় হবে...আমি জোড় পায়ে হেঁটে মুল রাস্তাটা পার হয়ে ও পাড়ে গেলাম। দেখলাম সত্যি সত্যিই দোকান পাট খোলা আছে। আমি একটা দোকান থেকে এক বোতল পানি, একটা রুটি ও দুটা কলা কিনে আবার হাঁটা দিলাম লোকটার উদ্দেশ্যে। 
মেইন রাস্তা পাড় হয়ে পৌছালাম লোকটার কাছে। তার হাতে দিলাম কিনে আনা জিনিসগুলো। দেখলাম সে বেশ পরিতৃপ্ত। খেতে খেতে আমাকে বললোঃ

-তুই খাবি না?

-নাহ্ । আপনি খান।

-বাবা তোরে একটা কথা বলি। অামি কারো কাছ থেকে কোন কিছু নেই না...যারে পছন্দ হয়, তার কাছে থিক্ক্যা চাইয়্যা খাই। তোরে দেইখ্যা আমার খুব পছন্দ হইছে। তাই তর থিক্ক্যা চাইয়্যা খাইলাম। সব পাগল সমান না। আবার সব পাগলই তার পাগল না...

-তার মানে আপনে আমাকে পছন্দ করেছেন। কিন্ত্তু কেন? 

-তোর ভিতর একটা জিগ্যাসু মন আছে। হেইডা খালি জানতে চায়। বুঝছে চায়। শিখতে চায়। তুই তারে শিখা। দেখবি হেই শিক্ষা এক সুময় তোরেই শিক্ষা দিব। 

-আমাকে শেখাবে মানে?

 -মানে অইলো তর মনটারে তুই যুদি এক জায়গায় কেন্দ্রীভুত করতে পারস, তাইলে কি অয়? একটা বিন্দু অয়। হেইডা অইলো সেন্টার। তারে হেইহানে বহাইয়্যা দে। তার পর হোন হেয় কি কয়?

 -কি সব আজে বাজে কথা বলছেন? আপনার কথার আগা মাথাতো কিছুই বুঝতে পারছি না...

অামার একথা শুনে দেখলাম লোকটি হাসছে। তারপর খাওয়া শেষ করে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেড়টা বাজে। এখন বাসায় যাওয়া যাক। আমি যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, ওম্মনি সে বললোঃ

 -বস। তোরে কি কইছি..হেইডা তো বুঝবার পারস নাই...তাই না...

-জ্বি।

-তাইলে শোন। তর মন অইলো চৈতন্য বা চেতন সত্ত্বা।  হেয় সব সময় উথাল পাথাল থাকে। কারণ কি? জানস?

-না?

-কারণ অইলো মায়া। এই মায়ারে কয় খান্নাস মানি কুমন্ত্রণাদাতা।  যে কুমন্ত্রণা দেয়। কেমতে দেয়? জানস?

-না?

-কেন্ ? তুই সুরা নাস পড়স নাই? হেই হানেইতো লেখা আছে মিন সাররিল ও্য়াসু বিসুফিছুদুরহিন নাস। মিনাল জিন্নাতিওয়ান নাস। হেই ছুদুর মোকামেই থাকে খান্নাস।
 (চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬

সোনার মানুষঃ মনা পাগলার ভাবনা


সোলেমান ভান্ডারী একজন সাদাসিদে মানুষ। প্রাণোচ্ছল এবং প্রাণবন্ত মানুষ। সব সময় তার মুখে হাসি লেগেই থাকে। পেশায় একজন স্বর্ণকার। তার একটি দোকান আছে। নাম-সাদিয়া জুয়েলার্স। কাষ্টমার আসলেই হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানায়। আজ তিনি একটি কাজের অর্ডার পেয়েছেন। সেটা হলোঃ একটা পুরোনো বালাকে ভেঙ্গে নতুন করে ডিজাইন করা। সোলেমান এখন সেটাই করছেন। তার পাশে বসে আছে মনা পাগলা। মনাকে সোলেমান খুব ভালোভাবেই চেনে। সে প্রায়ই সোলেমানের দোকানে বসে খোশ গল্পে মেতে থাকে। তার সাথে বসে চা খায়। আজো সে বসে চা খাচ্ছে আর সোলেমানের কীর্তিকলাপ দেখছে। দেখলোঃ-

সোলেমান প্রথমে চুড়িটি ভেঙ্গে কেটে টুকরো টুকরো করে একটা বাটিতে রাখলো। তারপর সেটাতে কিছুটা সোহাগা মেশালো। এরপর সেই বাটিতে এসিড ঢাললো। পরিমাণ মতো এসিড ঢেলে কয়লায় আগুন ধরিয়ে চুঙি দিয়ে ফুঁ দিয়ে কয়লাগুলোকে জ্বালানোর চেষ্টা করলো। যখন কয়লাগুলো আগুনের তাপে লাল টকটকে হলো, তখন সেই বাটিটা আগুনের উপর বসিয়ে দিল।

এসিড আগুনের তাপে ফুটতে শুরু করেছে। কেমন হাল্কা নীল বর্ণ ধারণ করে হাল্কা হলুদ রংয়ের ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। সেই ধোঁয়ায় একটা ঝাঁঝাঁলো গন্ধ কেমন যেন চোখে মুখে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে । মনা একটু নড়ে চড়ে বসলো। সেটা দেখে সোলেমান হাসি হাসি মুখে বললঃ

-দাদা স্বর্ণ পাকা করতাছি…

-বাপরে যেই গন্ধ...আচ্ছা দাদা, এসিডে কি স্বর্ণ সব গইল্যা যাইব গা...

-না দাদা...স্বর্ণের মধ্যে যে খাইদ আছে, হেইডা এই এসিডে খাইয়্যা শেষ কইর‌্যা দিব। তারপর যেইডা থাকবো হেইডা অইলো খাঁটি সোনা। এইডাতে কোন খাইদ থাকে না। এক্কেবারে পাকা সোনা। হেই সোনারে কোন এসিডে পোড়াইলেও আর খাইদ পাইবো না...

সোলেমানের কথা শুনে মনা কি যেন ভাবলো। সে যেন বুঝতে পারছে অন্য কিছু। উদাস ভঙ্গীতে সে চিন্তায় মগ্ন হলো। কিন্ত্তু সে কি চিন্তা করছে...তাকে চিন্তিত দেখে সোলেমান জিগ্যাসা করলোঃ

-কি অইলো দাদা...এক্কেবারে চুপ অইয়্যা গেলেন গ্যা..

-ভাবতাছি?

-কি ভাবতাছেন?

সোলেমানের কথা শুনে মনা বলে উঠলোঃ

-মাবুদগো তুমি আমারে এই স্বর্ণের মতোন খাঁটি কইর‌্যা এই দুইন্ন্যা থিক্কা নিও।

-হটাৎ কি এমুন অইলো, দাদা?

-ভাইরে, এই মাটির মইদ্যেই যখন আমাগো গোর অইব, তহন এই এসিডের মতোন কইর‌্যাই আমাগো পরীক্ষা কইর‌্যা দেকবো...আমরা কত্তদুর খাঁটি.....যুদি খাঁটি অই..তাইলে আর নতুন কইর‌্যা কোন কিছু বানাইবো না...হেমনেই রাইখ্যা দিব। আর যুদি খাঁটি না অই, তাইলে এই মাটির থিক্ক্যাই আবার নতুন কইর‌্যা বানাইয়্যা আবার দুনিয়্যাইতে পাডাইবো....ক্যা তুমি শুন নাই হাদিছে আছেঃ ইন্নাললাহা হারামা আলাল আরদে আরশাদুল আম্বিয়া...নিশ্চয়ই আমি হারাম করিয়া দিয়াছি মাটির জন্য আম্বিয়াদের দেহকে...অর্থাৎ মাটির সাধ্য নাই তাঁর প্রিয় বান্দাদের দেহরে নষ্ট করে। তাছাড়া কোরআন শরীফের সুরা বাকারার ১৫৪ নং আয়াতে আছেঃ
যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, তোমরা তা বুঝতে পারো না [ ﻭَﻻ ﺗَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﻟِﻤَﻦْ ﻳُﻘْﺘَﻞُ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺃَﻣْﻮَﺍﺕٌ ﺑَﻞْ ﺃَﺣْﻴَﺎﺀٌ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻻ ﺗَﺸْﻌُﺮُﻭﻥَ আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না বরং তারা জীবিত কিন্ত্তু তোমরা তা অনুভব করতে পার না। সুরা আল-বাকারাহ আয়াত নং-১৫৪]
তাছাড়া সুরা আলে ইমরানের ১৬৯নং আয়াতে বর্ণিত আছেঃ যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত; তারা আল্লাহর কাছ থেকে রিজিক পাচ্ছে [ ﻭَﻻ ﺗَﺤْﺴَﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻗُﺘِﻠُﻮﺍ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺃَﻣْﻮَﺍﺗًﺎ ﺑَﻞْ ﺃَﺣْﻴَﺎﺀٌ ﻋِﻨْﺪَ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻳُﺮْﺯَﻗُﻮﻥَ আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত, তাদেরকে রিয্ক দেয়া হয়। আলে‘ইমরান, ৩/১৬৯]

মনার কথা শুনে সোলেমানের মনে প্রশ্ন জাগেঃ

১. রিজিক কে খায়..জীবিতরা না মৃতরা?
২. মৃতরা কিভাবে রিজিক খায়…সেইটাই রহস্য রয়ে গেল সোলেমানের কাছে

[সংক্ষেপিত]

বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬

চক্রঃ মৃত্তিকার অন্যরুপের সৃষ্টি - মনা পাগলার অনুভব

মনা আজ পাল পাড়ায় ক্ষীরমোহন পালের বাড়িতে আসছে। তার উদ্দেশ্য কি, তা ক্ষীরমোহন ধরতে পারছে না। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, ক্ষীরমোহন চরকা ঘুরিয়ে কিভাবে মাটির পুতলা বানাচ্ছে ? সে বেশ ভাবুক ভঙ্গীতে বসে ক্ষীরমোহন পালের হাতের কারুকার্য পর্যবেক্ষণ করছে। ক্ষীরমোহন পাল তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনার দিকে তাকিয়ে জানতে চাচ্ছেঃ

-ওমন তাকাইয়্যা তাকাইয়্যা কি দেখতাছো মনা বাবু?

-দেকতাছি তোমার কীর্তি........

-হেইডা দেইক্যা তুমি কি করবা? তুমি কি বানাইতে পারবা?

-পারুম না দেইক্যাইতো তোমার কীর্তিকর্ম দেইক্যা সৃষ্টিকর্তারে বুঝবার চেষ্টা করতাছি...হেয় কেমুন কইর‌্যা মানুষ পুতুল বানায়...এই মাটি দিয়া.....একেকটা একক রকম...কি সোন্দর বার্নিশ করা....আবার ভিতরে কি সোন্দর বাত্তি জ্বালাইয়্যা রাকছে....দেকছোনি....

ক্ষীরমোহন এবার বুঝতে পারলোঃ কেন মনা এমন করে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ? সে সেটা বুঝতে পেরে বললোঃ

-ভাইরে....ভগবানের লীলা বোঝা ভার....আমাগো কি সাধ্য আছে এই মাটির পুতলা দেইখ্যা তারে বুঝবার পারি....হেয় তো কর্ম অনুসারে চরকা ঘুরাইয়্যা এই মাটি দিয়াই সবকিছু বানাইতাছে....হগ্গলতেরে এই মাটি দিয়াই সৃষ্টি করতাছে...অবিরাম অনবরত... মইর‌্যা গেলে এই মাটির মধ্যেই হান্দাইয়্যা থুইতাছে....পইচ্যা গইল্যা হেইডাই আবার অন্যরুপে অন্য কোন ক্ষীরমোহনের হাতে পইর‌্যা এই মাটির পুতল্যা অইয়্যা আবার দুইন্যাইতে আইতাছে....আগুনে পুড়ুক আর পানিতে পরুক...যেইভাবেই মরুক না কেন্......

মনা ক্ষীরমোহন পালের কথা শুনে বললোঃ

-কিন্ত্তু আমি ভাবতাছি অন্য কতা। সৃষ্টিকর্তা যে চরকা বানাইছে....হেই চরকায় পইর‌্যা কত জনম জানি ঘুরতাছি....আইজক্যা মনা পাগলা....কাইল মরণের পর কি অমু...কোন্ ক্ষীরমোহনের হাতে পইর‌্যা কোন্ পুতল্যা অমু....মাটির পুতলা না-কি মাটির কুত্তা বিলাই...নাকি মাটির হাত্তি ঘোড়া...কি যে অমু কইতে পারতাছি না...যুদি জানতে পারতাম....আহা...রে....

" সুব.ই.আজল ইয়ে মুঝছে কাঁহা জিব্রাইল নে
জো আকাল কা গুলাম হো...ও দিল না কার কবুল "।
-আল্লামা ইকবাল।

একটি প্রশ্ন, মাকড়শা এবং মনা পাগলার উত্তরঃ অনুভবতার এক নতুন দিগন্ত

মনার মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল বহুদিন থেকেই। কিন্ত্তু উত্তরটা জানা ছিল না। আজ মশাং বাজারে জুনাব আলীর দোকানে চা খেতে এসে সে উত্তরটা পেয়ে গেল। উত্তরটা পেতেই সে অতি উচ্ছ্বাসে নৃত্য আরম্ভ করলো। তার পাগলা নাচ দেখে আশে পাশের সমস্ত লোকজনের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। মনা সেটা থোড়াই কেয়ার করে। সে সেদিকে না তাকিয়ে নিজের মতো করেই নৃত্য করতে লাগল। আর গাইতে আরম্ভ করলোঃ

কতো কি সহিব নাথ, আমিতো আমারও নই
কেমনে চরণে র'ব আমিতো আমার নই।।

মনার গান থামতেই রজব আলী বয়াতী তার একতারাটা নিয়ে মনার হাতে সঁপে দিল। মনা সেটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলো। আর তারটাতে হাল্কা টোকা মেরে টুংটাং শব্দ করতে লাগলো। সে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে যন্ত্রটার দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উপর দিকে মাথা তুলে বললোঃ

উপহার দিব কি গো কি আছে আমার নাথ
তোমারইতো দেওয়া সবি কোথা কি পা'ব সই।
রজব আলী বয়াতি মনাকে প্রশ্ন করলোঃ
-মনা ভাই, তোমার এতো খুশির কারণ কি?

শুনে মনা বললোঃ

-আমার একটা প্রশ্নের উত্তর জানার প্রয়োজন ছিল। কিন্ত্তু সেটা পাচ্ছিলাম না। আজ এই মেলায় এসে সেই প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম একটা মাকড়াশার কাছ থেকে।
-মাকড়শার কাছ থেকে? মাকড়শার কথা শুনে রজব আলী আশ্চর্য্য হয়ে গেল।

সেটা দেখে মনা বললোঃ

-দ্যাখেন, একজন কুম্ভকার যখন কোন কিছু তৈরী করে, সেটার জন্য কিছু উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। যেমন মাটি, পানি, আগুন, বাতাস, আকাশ ইত্যাদি। আমার মনে প্রশ্নের উদয় হলোঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন যে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, সেই সৃষ্টির উপাদান তিনি কোথায় পেলেন?

বাহ্যিক দৃষ্টিতে আপনি যদি দেখেন, দেখবেন সমস্ত উপাদানগুলিই এই মহাবিশ্বে ছড়ানো ছিটানো ছিল। একজন কুমারের কথা চিন্তা করেন। দেখবেন, কুমার যে জিনিসটি তৈরী করতে চান, সেটা তার মাথায় একটা উপাদান হিসেবে কেন্দ্রীভুত ছিল। সেই কেন্দ্রীভুত চিন্তারেখাকে বাস্তবায়ন করার জন্য তার যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন ছিল, সেগুলি সংগ্রহ করে তারপর সে তার কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে বস্ত্তুটি সৃষ্টি করেন। যেমনঃ মাটির হাঁড়ি কুড়ি, ফুলদানি, ব্যাংক, মুর্তি ইত্যাদি।
আবার বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করেন। হাঁড়ি কুড়ি, ফূলদানি, ব্যাংক, মুর্তি ইত্যাদি ঐ মাটির মধ্যেই নিহিত ছিল। কুমারের হাত ধরেই তারা বাস্তবতার রুপ নিল। তার মানে, ঐ হাঁড়িকুঁড়ির জন্য একজন সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন ছিল। আর সেটা হলোঃ কুমার।

-কি বলেন ভাই?

-আমি ঠিকই বলছি। কেবল চিন্তা-ভাবনাটা আপনার। আপনি কি আমার চিন্তা-চেতনা ধরতে পারছেন কি-না? সেটা হলো বড়ো কথা....

-তাইলে এইবার কন, আল্লাহয় এই দুনিয়্যা সৃষ্টি করার উপাদান কৈ পাইলো?

-এই বিষয়টা উপলব্দি করার জন্য আপনাকে তাকাতে হবে একটা মাকড়শার দিকে। দেখবেন, মাকড়শা যে জাল বুনে, সেই জাল বুনার জন্য যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন পড়ে, সেটা তার নিজের ভেতরই ছিল। সেটা কি? সেটা হলো তার লালা। অর্থাৎ তার মুখনিঃসৃত রসাবলী। সেটা দিয়েই সে জালটা তৈরী করে। ঠিক তদ্রুপ, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এই জগত সৃষ্টির জন্য যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন ছিল, সবই তার মধ্যে নিহিত আছে। সেই জন্য সে কারো মুখাপেক্ষী নয়। তাইতো বলা হয়েছেঃ

তোমারইতো দেওয়া সবই কোথায় কি পা'ব সই।

-কন কি ভাই?

-শুধু তাই নয়। কোরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ আল্লাহু কুল্লিশাইইন মুহিত। অাল্লাহ যিনি প্রতিটি বস্ত্তুর মধ্যেই নিহিত আছেন তথা দ্রবীভুত অবস্থায় আছেন। তাহলে সমগ্র জগতের প্রতিটি বস্ত্তুই আল্লাহসত্তাময়। আল্লাহ ব্যতীত কিছুই নেই। লা মউজুদা ইল্লাল্লাহ....

মনার কথা শুনে রজব আলী বয়াতি মনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাই দেখে মনা বললোঃ
বুঝাইলে বুঝতে পার নতুবা বুঝিবে কই....

রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

সেলফিঃ অন্যদৃষ্টি-দৃষ্টিরভিন্নতা

মিতু বেশ কায়দা করে নাক-মুখ কুঁচকে একটি ছবি তুললো। তারপর সে ছবি দেখলো। নাহ! ছবিটি তার মনের মতো হয়নি। সে বেশ কায়দা করে আরেকটা ছবি তুললো। তারপর সেই ছবিটি সে তার ফেসবুকে আপলোড করে পোষ্টে লিখলোঃ
"বন্ধুরা বাদাম খাচ্ছি। দ্যাখোতো কেমন দেখাচ্ছে আমাকে..."
মিতুর সেই আপলোড করা সেই ছবিটি দেখে তার বন্ধুরা কেউ লাইক দিল। কেউ বা কমেন্টস করলো। কেউ বা শেয়ার করলো।
মিতুর সেই ছবিটি শাহেদ দেখতে পেল। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই ছবিটির দিকে। ছবিটি দেখে শাহেদের ভাবুক মন কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। সে মনে মনে বললোঃ আচ্ছা এই যে ছবিটি আমি দেখছি...এটা কি তারই ছবি...যে মনের ভেতর বসত করছে? যাকে জানার জন্য প্রতিটি ধর্ম গ্রন্থেই তাগিদ দেয়া হয়েছে…..বলা হয়েছে আত্মানং বিধি। কিংবা সক্রেটিসের সেই মহান উক্তিঃ know thyself. কিংবা মশহুদ হাদিস শরীফের বর্ণনাঃ “মান আরাফা নাফসাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু”। যে নিজেকে জেনেছে সে তার প্রভুকে জেনেছে?
আত্মা তো পন্ঞ্চ ভৌতিক উপাদান ক্ষিতি, অব, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এর সংমিশ্রণে তৈরী পোষাক বিশেষ। সেই পোষাকের ভেতর যে অংগ-প্রতঙ্গগুলো রয়েছে, সেগুলোকে ঢেকে রাখার একটা পর্দা বিশেষ। কিন্ত্তু যিনি এই অংগ-প্রতঙ্গগুলো পরিচালনা করছেন, তিনি কি সেই, যাকে আমি দেখছি…..না-কি তার ছায়া বিশেষ…সর্বস্ব তুমি কাহারো ছায়া…

রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৬

তৈলাক্ত বাঁশের নতুন অংকঃ সফলতাই উন্নয়নের মুলমন্ত্র

আজিজ মাষ্টার প্রাইমারী স্কুলের পিটি শিক্ষক। সেই আজিজ মাষ্টার আজকে একটা মজার খেলা খেলছে। সে পিটি ক্লাসের ছেলেপুলেদের দিকে তাকিয়ে বলছেনঃ
-আচ্ছা তোরা কি তৈলাক্ত বাঁশের অংকটা করেছিলি....
ছেলেরা সমস্বরে হ্যাঁ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কিন্ত্তু আজিজ মাষ্টরের সন্দেহ হল। সে আবারো বললোঃ
-যারা যারা অংকটা করেছিস, তারা হাত তোল....
দেখা গেল উপস্থিত সংখ্যার আধিক্যটাই বেশি। সেটা দেখে সে বেশ খুশি হলো। সে সমস্ত ছেলেদেরকে দুটি ভাগে ভাগ করলো। তারপর যারা করেছে, তাদের একদিকে আর যারা করেনি, তাদের অন্য দিকে রাখলেন। এরপর তিনি স্কুলের মাঠে একটি আট-দশ ফুট লম্বা বাঁশে ভালো করে তেল মালিশ করলেন। তারপর সেই বাঁশের মাথায় একটা সাইনবোর্ড ঝুঁলিয়ে দিলেন। সেখানে লেখাঃ "বর্তমান সময়ে উন্নয়নের চাবিকাঠি। সাফল্যের মুলমন্ত্র "।
তিনি অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে সেই তেলমাখা বাঁশটি মাঠের মধ্যে পুঁতে রাখলেন। এরপর যে সমস্ত ছেলেরা অংকটা করেছে-তাদের ডাকলেন। তারপর বললেনঃ

-এই বাঁশের মাথায় যে সাইনবোর্ডটি দেখছিস, যে আগে এই সাইনবোর্ডটি এনে আমার কাছে দিবি, তার জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার।

-কি পুরস্কার, স্যার? ছেলেরা জানতে চাইলো।

-আরে আগে তো সাইনবোর্ডটি আন। তারপর পুরস্কার। আচ্ছা, সবাই জামা খুলে ফেল্। যখন আমি বাঁশিতে ফুঁ দেব, তোরা শুরু করে দিবি। ঠিক আছে...যা সবাই যা।

ছেলেরা উন্নয়নের চাবিকাঠি ধরার জন্য এবং পুরস্কার পাওয়ার জন্য ইতি মধ্যেই লম্ফ জম্ফ শুরু করে দিয়েছে। অনেককেই দেখা গেল বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আজিজ স্যারের দিকে। সেটা দেখে স্যারও মহা খুশি। তিনি আর দেরী করলেন না...রেড়ি ওয়ান...টু...থ্রি বলে বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। আর অম্মনিতেই শুরু হলে গেল নাচন কুর্দন। একজন উঠতে চায়তো আরেকজন ঠেলে ধরে...সবারই দৃষ্টি ঐ সাইনবোর্ডটির দিকে। অন্য কোন দিকে তাদের মন নেই....ধ্যান নেই....তাদের লক্ষ্য একটাই উন্নয়নের চাবি। আর সাথে পুরস্কার।

আজিজ স্যার লক্ষ্য করলেনঃ ছেলেরা ইতিমধ্যেই মারামারি শুরু করে দিয়েছে। কেউ তাকিয়ে দেখছে...স্যার কিছু বলেন কি-না? কিন্ত্তু যখন দেখলো স্যার তেমন কিছুই বলছে না...তখন তারাও বুঝলো....এখন স্যার কি বলবে না। কারণ তিনিতো তাদেরকেই বলেছেন যেভাবে পারিস ঐ সাইনবোর্ড লেখা কাগজটি স্যারের হাতে দিতে। কাজেই যারা এ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো...স্যারের মৌন সম্মতি আছে, তখনই তারা দ্বিগুণ উৎসাহে মারামারি করছে।
আজিজ স্যার চেয়ারে বসে ছেলেদের মারামারি দেখছেন আর হাসছেন। তার সাথে যোগ দিয়েছে সেই ছেলেপুলেরা যারা অংকটা করেনি। তারাও স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে...

তারা দেখছেঃ সারভাইভার ফর দ্যা ফিটেস্ট.....ওয়েলিং ব্যামবো...ক্লাইবিং দ্যা চিন্ডেন।

শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৬

বিউটিকুইন নিউ অপেরা হাউসঃ মনার অনুভব

শীতের আমেজ আসতে শুরু করেছে কেবল। এরই মধ্যে মধ্যরাতে শিশিরের ফোটা আর কুয়াশায় ঘেরা চাদর প্রকৃতি ফেলতে শুরু করেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে য়াত্রাগান, পালাগানের শিল্পীদের তোড়জোড়। শীতের রাত দীর্ঘ হয় বলে এ সময়টাতেই বেশি চলে এই পালা উৎসব। বিউটিকুন নিউ অপেরা হাউস ঠিক সে রকমভাবেই নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছে। তাদের সামনে একটি অনুষ্ঠান করার কথা আছে। সেই অনুষ্ঠানে যাবার আগে যাত্রাগানের রিহার্সেল চলছে.....

মনা সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য একটি কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সে দেখছে-যাত্রাদলের লোকজন কি ভাবে সাজছে। কেউ গায়ে রাজা-বাদশার পোষাক পড়ে নিজেকে রাজা ভেবে বলছেঃ সেনাপতি....সেনাপতি ..এই কে আছিস..এক্ষুণি মন্ত্রীকে খবর দাও....কেউ হয়তো সেনাপতি সেজে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে যাবার প্রস্ততি নিচ্ছে...একটি লোহার তলোয়ার নিয়ে আপনা আপনি নাচাচ্ছে...কেউ বা বাইজি সেজে নাচছে...তবলা বাদক তবলায় টোকা দিচ্ছে...আর বলছে...তা...ধিন ধিন..ধিন না..তুন না...তা তিন..তিন না...সেই শব্দ শুনে বাইজী হাল্কা তালে নাচছে....

পাশে বসা নাট্য পরিচালক পান্ডুলিপি নিয়ে হাল্কা শব্দে উচ্চারণ করছে আর সেই কথা শুনে শুনে অভিনেতা অভিনেত্রীরা সংলাপ বলছে। ভুল হলেই সে ক্ষেপে যাচ্ছে আর সংলাপ ভালো করে শুনতে বলছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রের বাইরে কাউকে কোন কথা বলতে শুনছে না....

মনা মুগ্ধ হয়ে দেখছে....সবকিছু। এরমধ্যে সে দেখলো সফেদ দাঁড়িওয়ালা সাদা পায়জামা-পান্ঞ্জাবী গায়ে দিয়ে একটি লোক হাতে একতারা নিয়ে গান গাইতে গাইতে বলছে....ওরে বেভুল...তুই...

যাত্রাদলের মালিক রহিম সাহেব মনার পাশেই বসা ছিল। মনাকে দেখে রহিম সাহেব জিগ্যেস করলোঃ

-ভাইজান কেমুন বুঝতাছেন? ব্যবসা করতে পারমু তো....

মনা রহিম সাহেবের সেই কথার কোন উত্তর দিল না। সে ভাবতে শুরু করলো তার নিজের মতো করে।

এই মহা বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহ তায়ালা রব রুপে সকলেরই মাঝে বিরাজিত। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেনঃ সুন্দরতম আকৃতিতে। জমিনের বুকে সে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিচিত। সেই রবই তার মাঝে বিরাাজিত। তিনি যা বলছেন, আমরা কি তা শুনতে পাচ্ছি...যেমনটা এই যাত্রাপালার নাট্যপরিচালক হাল্কা শব্দে উচ্চারণ করছেন? যখন ভুল করেছন...তখন বিবেক এসে যেমন গান করে জানান দেয়, ঠিক তদ্রুপ আমরাও ভুল করলে আমাদের বিবেক এসে কি জানান দেয়? যদি দেয়, তাহলে সেই ভুল আমরা সংশোধন করছি না কেন ....না-কি না করাটাও আমাদের নাট্যচরিত্রেরই অংশ...

মনা যেন দেখতে পেল বিউটিকুইন নিউ অপেরা হাউসের মালিকের মতো তারই মালিক যিনি সমগ্র জগতের পরিচালক, তিনিও তার অপেরা হা্উসকে প্রতি নিয়তই সাজাচ্ছেন নিত্য নতুন রুপে। তার কথা কেউ শুনতে পায়...কেউ পায় না..কেউ তার নাট্য পরিচালককে দেখতে পায়, কেউ পায় না...সবই যেন সেই চিত্রনাট্য সাজানোর মতো করেই সাজানো....ভালো-মন্দ মিলিয়েই এই বিউটিকুন নিউ অপেরা হাউস।

"জিন্দেগী আপনি যব ইস শাকাল ছে গুজরি গালিব
হাম ভি ক্যা ইয়াদ করেগি কি খোদা রাখতে থি।"

-মীর্জা গালিব

ডিজিটাল ফকিরঃ মনে বুঝিলাম তাহারা অন্য জাতের মানুষ

অাধুনিক যুগে অতি আধুনিক ফকির হচ্ছে ডিজিটাল ফকির। ভাবছেন ডিজিটাল ফকির কি জিনিস? যারা আমার মতো ল্যাপটপ কাঁধে নিয়ে অফিসে অফিসে ওয়েবসাইটের কাজের জন্য ঘুরে বেড়ায়, তারাই হচ্ছে আধুনিক কালের ডিজিটাল ফকির। কেন বললাম এই কথাটা? তাহলে শুনুনঃ-
নতুন বাজার ভাটারা থানা থেকে দশ টাকা রিক্সাভাড়া। আমিনউদ্দিন মার্কেটের সামনেই একটা নাম করা অফিসে কাজের সন্ধান পাই। আমারই এক বন্ধু মাসুম ভাইয়ের মাধ্যমে। মাসুম ভাই আমাকে ফোন দেয়। তো অামি সেই ফোন পেয়ে ঝোলাটা (ল্যাটপট) কাঁধে নিয়ে দে ছুট। অফিসে ঢূকতেই মাথা ঘুরে গেল। এত্ত বড়ো অফিস..বাপরে বাপ....না জানি কতো টাকার কাজ দেয়...আমিতো মনে মনে মহা খুশি....যাক্ শেষ বেলায় একটা কাজ পেলে খারাপ কি? তাছাড়া পকেটও খালি। কি করি...হেনতেন ভাবতে থাকি..আর মনে মনে ভাবতে থাকি...কাজটাতো সিম্পল। দু একদিনের মধ্যেই করে ফেলা যাবে। কিন্ত্তু কতো নিবো..এই যখন ভাবছি তখন সে আমাকে একটা হোটেলে নিয়ে যায়....গ্রিল মুরগী আর রুটি। সাথে কোকাকোলা...খাচ্ছি আর ভাবছি...লোকটাতো ভালোই...বিনা মুল্যে এত ভালো খাবার পেলাম। পঁচিশ চেয়ে লাভ নেই। বিশের মধ্যেই করে দিব। এটাই ঠিক করে রাখলাম। সেই খাবার টেবিলেই খাবার খেতে খেতে তার ওয়েবসাইটের ব্যাপারে কথা হলো। ওয়ার্ডপ্রেস দিয়েই কাজটা করে দেব। তাকে আামার অফারের কথাটা বললাম। সে সাথে সাথে লাফ দিয়ে ওঠে বললোঃ বি....শ হাজার টা....কা। আরে ভাই কালকে আরেক জন অাসছিল..সেতো বলেছে....দশ হাজার টাকা....তার কথা শুনে এবার আমার লাফ দেবার পালা...এটাতো বেশ জটিল কাজ । আমরা অনেকদিন ধরে এই কাজের সাথে জড়িত আছি বলেই কাজটা সহজ মনে হচ্ছে....প্রথম প্রখম এরকম একটি সাইট তৈরী করতে কম করে হলেও দশ-বারো দিন লেগে যাবে। সেই কাজটাই করতে চাইছে....মাত্র দশ হাজার টাকায়....ঠিক আছে...বিশ না দিলেন পনেরো হাজার দিতেই হবে। আমি কোক খেতে খেতে বললাম।
ভদ্রলোক পকেট থেকে সাথে সাথে চেক বই বের করে সই করে সাইনঅাপ মানি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকার চেক দিল। অামি তো মনে মনে মহা খুশি....একেবারে খুশিতে বাগ বাগ....ফাঁকা পকেটে চাকা লাগতে শুরু করেছে...
বাড়িতে ফোন করলাম..তুমি চিন্তা করো না..অামি কালকেই তোমাকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে পাঠিয়ে দেব। এখন কাজ করতে দাও....আমার গিন্নিতো খুশিতে আটখানা...কালকেই টাকা পাবে....আর আমি রাত জেগে জেগে কাজ করে সেই চেকটা নিয়ে পরদিন সকালে ব্যাংকে গেলাম।
ব্যাংকে দেখলাম এক সুন্দরী উর্ব্বশী কর্মকর্তা। তার কাছে চেকটা দিলাম। সে চেকটি নিয়ে কমপিউটারে টিপে টাপে মুখে অদ্ভুত হাসি নিয়ে বেশ কোমল গলায় বললোঃ ভাইয়্যা একাউন্টে টাকা নেই। ব্ল্যাপ দিয়েছে আপনাকে......চেকটা হাতে নিয়ে আমি ফোন করলাম সেই সুদর্শন অতিথিকে। যিনি আমাকে আপ্যায়ন করে দ্রুত ফেনী হতে ঢাকায় এনে কাজটা দিয়েছেন। দেখলাম, সে ফোন তুলছে না....মাথা ঘুরে গেল..খবর নিয়ে জানতে পারলাম...সে নেই....বাহিরে চলে গেছে......তার কাজটা অনলাইনে এখনো অাছে...কেবল নেই আমার পারিশ্রমিকের টাকা.....মনে মনে বুঝিলাম ইহারা অন্য জাতের মানুষ।...সেই অন্যজাতের লোকটার দেশের বাড়ীর নামটা নাই বা বললাম...পাঠকরা অনুমান করে নিয়েন। এই অন্য জাতের লোকদের কারণেই আমার স্বপ্ন বার বার ভংগ হয়.....হৃদয় হয় খন্ড বিখন্ড.....

Neither visible naked eye or microscopic vision 
but internal vision that my heart bleeds.......

গল্প নয়..সত্য....

অণু গল্পঃ মনা পাগলার তত্ত্বনির্যাস

অাধ্যাত্মিক দর্শন এবং সুফীবাদ কি? সুফী কারা? প্রশ্নটা জানতে চাওয়া হয়েছিল মনার কাছে।
প্রশ্নটা শুনে মনা কিছু বললো না। শুধু একটা সাদা কাফনের কাপড় আর হাতে একটা কলার থোড় (কলার মোচা) নিয়ে আসলো। তারপর সেটাকে বিছালো। সেই কাফনের কাপড়ের বাম পাশটাতে কলার মোচাটা রেখে বললোঃ

-জ্ঞান থাকলে এই বার বুঝে নে....

-কি করলেন...কিছুইতো বুঝবার পারতাছি না....

নিজ দর্পণ ও দর্শনঃ অনুভবের নতুন দিগন্ত

মনা আমাকে ডেকে বললোঃ
-কি রে কি করছিস?
-তেমন কিছু না। বসে আছি।
-একটা গল্প শুনবি।
-বলো। তার আগে বলো তুমি কেন আমাকে গল্প শুনাতে চাইছো?
-গল্পটির মধ্যে একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। দেখি তুই ধরতে পারিস কি-না?
-ঠিক আছে। বল....
মনা তার গল্প বলা শুরু করলোঃ শোন তাহলে-
এক বনে ভেতর মনের সুখে বাস করতো পশু-পাখিরা। তাদের মধ্যে কোন মনমালিন্য ছিল না। ছিল না কোন বিভেদ। বনের রাজা সিংহ মশাই তাই আরামেই দিন গুজরান করছিল। তার মন্ত্রী মশাই বাঘ মামা নাকে তেল দিয়ে অঘোরে ঘুমাতো। কিন্ত্তু বিপদে ছিল পন্ডিত মশাই শিয়াল মামার । রাজার আদেশ ছিল প্রজাদের খোঁজ খবর নেবার। সে দুর দুরান্তে প্রত্যন্ত অন্ঞ্চলে ঘুরে ফিরে প্রজাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরে খবরাখবর নিত। কে কেমন আছে?
একদিন সেই শিয়াল গেল দুরের কোন এক গ্রামে। মাথার উপর তখন প্রচন্ড রোদের তাপ। উত্তাপে শিয়াল বেশ কাহিল হয়ে পড়লো। আশে পাশে কারো কাছে যে আশ্রয় নেবে সেই উপায়ও নেই। কি করা...বেচারা কষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছ তলায় আশ্রয় নিল। সেই সময় সে চিন্তা করলো ক্ষাণিকক্ষণ বিশ্রাম নিলে মন্দ হতো না। কিন্ত্তু তার আগে পেট পুরে পানি খাওয়া দরকার। কোথায় পানি পাওয়া যায়...কিছু দুর হাঁটার পর সে একটা পুকুর দেখতে পেল। পরিস্কার স্বচ্ছ পানি। সে আজলা ভরে পানি পান করলো। হটাৎ সে দেখতে পেল সেই পানিতে তারই মতো দেখতে অবিকল আরেকটি শিয়াল। আরে..এটা আবার কে...প্রথমে সে ঘাবড়ে গেল। তারপর সে আবারো উঁকি দিল সেই পুকুরে। দেখলো-তারই মতো দেখতে...অবিকল সে-ই যেন। নিজেকে নিজে দেখতে পেয়ে শেয়ালের মনে আনন্দ আর ধরে না..সে নাচতে নাচতে গাইতে শুরু করে দিলঃ-
আমি দেখেছি আমারে, গভীর কালো পদ্মজলে
আমার আমিকে খুঁজে ফিরে পেয়েছি আজ সদ্যমুলে।
গান গাইতে গাইতে সে যাচ্ছে আর নাচছে। শেয়াল পন্ডিত বলে কথা। আশে পাশের বনের সমস্ত পশু-পাখি শেয়ালের গান শুনে হতভম্ভ হয়ে গেল..তারা বুঝতে পারলো না...তার সেই গীত নৃত্যের মর্ম কথা।
এদিকে সেই কথা বনের রাজা সিংহ মশাইয়ের কানেও গেল। সে মন্ত্রীকে আদেশ করলোঃ যাও...এক্ষুণি ঐ ব্যাটাকে ধরে নিয়ে এস। যথা আজ্ঞা বলে মন্ত্রী মহাদয় বেরিয়ে পড়লো। তারপর সে শিয়াল ব্যাটাকে ধরে নিয়ে আসা হলো রাজ সভায়। সিংহ মশাই শেয়ালের কাছে জানতে চাইলো-মুল বিষয়টি কি?
শেয়াল সবিস্তারে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। শুনে সিংহ মশাইও সেটা দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলো। সাথে অনেকেই গেল।
সত্যিইতো...সিংহ তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে নিজেকে দেখা যায়...বাঘও বাদ গেল না..একে একে সকলেই নিজেকে দেখার আগ্রহ নিয়ে যখন দেখা শুরু করলো-ঠিক তখনই পুকুরটির পাড় ভেঙ্গে হুড়মুড় করে সবাই পানিতে পড়ে গেল। তারপর কে কার আগে উঠবে, সে প্রতিযোগীতায় মত্ত হয়ে সকলেই ডুবে মরলো।
দুরে দাঁড়িয়ে শেয়াল তখন বললোঃ
"যখন আমি আমাকে দেখলাম - একা দেখলাম। যখন সকলকেই দেখলাম - আমরা হলাম। তাও ঠিক ছিল। কিন্ত্তু সকলই যখন সকলকে দেখতে চাইলো তখনই সর্বনাশ হলো।"
এখন বল। এই গল্পটি থেকে তুই কি শিখলি?
-গল্পতো গল্পই। এর থেকে শেখার কি আছে?
-আছে রে বোকা। সব গল্পই কেবল গল্প নয়। গল্পের ভেতরও রহস্যময়তা লুকিয়ে থাকে। তুই যদি ভালো করে লক্ষ্য করিস, তাহলে দেখবি ধর্মগ্রন্থগুলিও বিভিন্ন নবী-রসুলদের কেচ্ছা-কাহিনীর বর্ণনা আছে। আবার যদি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ দেখিস,তো সেখানেও পাবি গল্প। যেমনঃ গীতায় অর্জুনের সাথে শ্রীকৃষ্ণের কথোপকথন। আবার রামায়ণে সীতার কাহিনী বর্ণিত আছে। প্রতিটি ধর্মগ্রণ্থেই গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। এছাড়া মসনবী শরীফেও গল্প আছে।
-তাই না-কি?
-হ্যাঁ ঠিক তাই। তুই পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি ভালো করে পড়ে দেখিস। তাহলেই আমার কথার সত্যতা পাবি। এখন বল্ এই গল্প থেকে তুই কি শিখলি?
-শিখলাম এটাই যে, মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামিন রব রুপে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই নিহিত আছেন সুপ্তাবস্থায়। এই রবকে দেখার জন্য নির্জন সাধনা একান্ত প্রয়োজন। যখন সাধনায় সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়, তখন রব জাগ্রত হয়ে তার সম্মুখে জাহির হয়। সেটাকে তখন হুর বলে। এই হুর দর্শন তথা আমাকে আমি দর্শন করার সমতুল্য। যেমন শিয়াল মহাশয় একা পানি খেতে যেয়ে নিজেকে দেখেছে। এইটাই তার দর্শন। সে তার ভেতর যে আমি রুপী রব আছে, সেটা অনুভব করতে পেরেছে। একে একে সবাই তা অনুভব করতে পেরেছে। কিন্ত্তু সকলেই সেই রবের দর্শন পায়নি। কাজেই নির্জন সাধনা ব্যতীত রবের দর্শন সম্ভবপর নয়।
-শিয়াল কি বলেছিল? শিয়াল বলেছিলঃ যখন আমি আমাকে দেখলাম - একা দেখলাম। তার মানে সে নিঃস্ব। নিজেই নিজের মধ্যে বন্ধী ছিল। যখন সকলকেই দেখলাম - আমরা হলাম। অর্থাৎ যখন সকলেই একসাথে দেখলো তখন তারা তাদের মধ্যে নিজেেদরকে দেখে আমরা হয়েছে। যেমনঃ সিংহ দেখেছে আমি, বাঘ দেখেছে আমি, হরিণ দেখেছে আমি। এই আমি-এর সমষ্ঠিই হচ্ছে আমরা। অর্থাৎ আমরা-আমি, তুমি, সে। আনা-লতিফা-মুনজিল। এরুপে প্রকাশ। প্রথমে হযরত আদম (আঃ)। এরপর হযরত হাওয়া (আঃ)। তারপর তাদের মাধ্যমে জগতের প্রকাশ। আমরা আসলাম। বুঝা গেছে কিছু?

আমি আর কিছু বললাম না। কেবল তাকিয়ে দেখলাম মনার দিকে.....কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে মনাকে।

ময়না ও মনা পাগলার কথোপকথনঃ অনুভবের এক নতুন দিগন্ত

মনা একটি ময়না পাখি কিনে এনেছে। মনা শুনেছে ময়নার ভোকালকড নাকি মানুষের কাছাকাছি। তাকে শিক্ষা দিলে সে সবকিছু বলতে পারে। তাই মনার খেয়াল হলো সে তার কেনা ময়নাটিকে কথা শেখাবে। কিন্ত্তু কি শিখাবে? অনেক ভেবেচিন্তে সে ঠিক করলো তার যা ইচ্ছা তাই সে শেখাবে। তার আগে তাকে তার নিজের ভাষা শেখাবে। যাতে সে সব কিছুই বলতে পারে।
মনার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সে ময়নাটিকে কথা বলাতে সমর্থ্য হলো। একদিন মনা তার প্রিয় ময়নাটিকে জিগ্যেস করলোঃ
-আচ্ছা তুই যখন জঙ্গলে ছিলি তখন কি ভালো ছিলি না-কি এখন ভালো আছিস?
উত্তরে ময়নাটি বললোঃ
-আমি যখন জঙ্গলে ছিলাম তখন স্বাধীন ছিলাম। উন্মুক্ত আকাশে দিগন্ত জোড়া ডানা মেলে উড়তে পারতাম। দিক বিদিগ ছুটে বেড়াতে পারতাম। আমার স্বজাতীয়দের সাথে কথা ভাব-ভালোবাসা বিনিময় করতে পারতাম। কতো সুখে ছিলাম আমি। তুমি আমাকে ঐ মুক্ত অবস্থা হতে ধরে এনে এই খাঁচায় বন্দী করেছো। এখন আমি না পারছি ঐ নির্মল আকাশে উড়তে, না পারছি আমার স্বজাতীয়দের সাথে মেলা মেশা করতে? তুমিই আমার সর্বনাশ করেছো?
-কিভাবে আমি তোর সর্বনাশ করলাম?
-তুমি আমাকে তোমার ভাষা শিখিয়ে তোমার মতো করে গড়ে তুলেছো। তোমার ভাষায় আমি আমার স্বজাতীয়দের সাথে ভাব-ভালোবাসা বিনিময় করতে পারবো না। তারা আমার কথা বুঝবে না...যেহেতু তুমি তোমার মতো করেই আমাকে বির্নিমাণ করেছো।
-তাহলে তুই আমার ভাষা কেন শিখলি?
-তুমি শিখিয়েছো তাই। আমিতো প্রথমে শিখতেই চাইনি। তুমি আমাকে বন্ধী করে জোর করে শিখিয়েছো। না শিখতে চাইলে তুমি আমাকে মারতে...আহার বন্ধ করে দিতে...আমি অনাহারে থেকে শিখেছি....এ থেকে আমার মুক্তি নেই। আমাকে মুক্ত হতে হলে অবশ্যই তোমার আনুগত্য করতে হবে। তাই তোমার আনুগত্য স্বীকার করে আমি তোমার মতো করে নিজেকে বির্নিমাণ করার কাজে মনোযোগী হলাম।
এখন দ্যাখ, আমি কতো সুখে আছি। প্রতিদিন কতো মানুষ আসে আমাকে দেখবার জন্য। যারাই আসে তারাই অবাক হয়। ভাবে,..বন্যপাখি কি ভাবে তাদের ভাষায় ভাব বিনিময় করে? তারা জানে না, আমার গুরু ইনসানে কামিল।
ময়নার মুখে কথাগুলো শোনার পর মনা একটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলোঃ-
আন্তা ফাওক্কী,আন্তা তাহতী, আন্তা আমামী, আন্তা খালফী, আন্তা ফি ওয়া আনা মা'আল জিহাতি ফিহা আয়নামাতুয়াল্লু ফা ছাম্মা ওয়াজহুল্লা।"
উঠাও আবরণ দাও দরশন, তোমার আমার রবে না চিনন
তুমি আসিলে রব না আমি, তোমার আমার হবেগো দেখা।।
[ কালামে পাক হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী(রহঃ)]

মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৬

মৃত্তিকা মায়াঃ মনার অনুভব


মনা একমুঠো মাটি নিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করছে। তার হাতে কিছু সিমের বীজ। আর কিছু খেজুরের বীজ। বীজগুলো নিয়েও সে নাড়াচাড়া করছে। উল্টে পাল্টে দেখছে। কিন্ত্তু কিছু বলছে না। মাটিগুলো একটি জায়গায় গর্ত করে তার থেকে উঠানো হয়েছে। গর্তটির মধ্যে সে বীজগুলো পুঁতে ফেলল। তারপর পানি ঢাললো। দুর থেকে অনেকেই মনার এ কীর্তিকলাপ দেখছে। কিত্তু কেউ কিছু বলছে না। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে মনার কার্যটাই দেখছে। অার তা দেখে মনা মিটি মিটি হাসছে। কারণ কি?

এবার মনা হাসতে হাসতে উঠে এল। তারপর সোজা চলে এল মোবারক মামার চায়ের দোকানের সামনে। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে মনা মোবারকের দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-মোবারক ভাই, ফাস কেলাস একটা চা বানাইয়্যা দেনতো খাই।

-তাতো দিমু। তয় মামা এখখান কতা জিগাই।

-কি জিগাইব্যা তা আমি জানি। ঠিক আছে তারপরও তুমি কও...কি কতা...

-মামা, আপনেরে দেকলাম পরথত মাডি উডাইলেন। তারপর হেই মাডিডি চিপরাইলেন। ধুলা বানাইয়্যা হালাইলেন। আবার মাডিডি থুইয়্যা বীজগুলি লইয়্যা দাপাদাপি করলেন। গর্তের মইদ্যে হেডিরে হালাইয়্যা মাডি দিয়্যা পানি দিলেন। ঘটনাডা কি মামা?

-জানতাম তুমি জিগাইব্যা...আগে চা দেও। চা খাই আর একটা বিড়িও দিও। খাইতে খাইতে কই....

মোবারক মনার জন্য সুন্দর করে একটা চা বানালো এবং একটি সিগারেটও দিল। মনা উদাস ভংগিতে কি যেন ভাবতে ভাবতে চা খাচ্ছে আর সিগারেটে একটা করে টান দিচ্ছে। কিন্ত্তু কিছু বলছে না...চুপ থাকতে দেখে মোবারক আবারো মনাকে ইয়াদ করাইয়্যা দিল...চা সিগারেট শেষ করে মনা এবার তার মতো করে বলতে শুরু করলোঃ

-শুন মিয়া....পরথম মাডি উডাইয়্যা দেকবার চাইলাম - এই মাটি দিয়া আমাগো সৃষ্টি করছে। এই মাটিতেই আমাগো আবারো শোয়ানো অইবো। আবার এই মাডি থিক্ক্যাই আমাগো উডাইবো [মিনহা খালাকনাকুম....তারাতান উখরা]। আমি তার লাইগ্যা মাডিডারে ভাল কইর‌্যা দেকবার চাইলাম। কেমতে উডাইবো? সবতো এই মাডিই খাইয়্যা হালাইবো। তহন আড্ডি গুড্ডি ছাড়াতো কিছুই থাকবো না..একসময় হেইডাও থাকবো না.....তাইলে কেমতে কি? পরক্ষণেই মনে পড়লো আল্লাহয় কইছেঃ ওয়াল্লাহু আনবাতাকুম মিনাল আরদে নাবাতান-সুম্মা ইউয়িদুকুম ফিহা ওয়া ইউখরেজুকুম ইখরাজান। [ বরং অাল্লাহ তোমাদিগকে উদভুত করিয়াছেন ভুমি হইতে। উদ্ভিদের ন্যায়। অতঃপর তিনি উহাতে তোমাদিগকে ফিরাইয়্যা লইবেন এবং তিনি তোমাদিগকে সেখান হইতেই বাহির করিবেন-এক নুতন জাত হিসেবে।] হেইডা মনে অওনের পরথিকক্যা....হাসলাম...

-হ দেকলামতো আপনে খালি হাসতেছন। দোকানের বেবাকতেই দেকছে। আমারে খালি জিগায় মোবারক, মনায় খেজুর বিচি দেইখ্যা ওমনে হাসতাছে ক্যা....বিচির মইধ্যে কি দেকছে...

-ভাইরে বিচির মইধ্যে কি দেকছি হেই কতা সমাজের কাছে ভাইঙ্গ্যা চুইর‌্যা কওন যাইবো না...বিচির রহস্য বড়োই বিচিত্রময়...বিচিত্রময় এই মাডিও। একই মাডি থিক্ক্যা একেক রকমের গাছ অয়। মরিচের বিচ হালাইলে মরিচ অয়..হেইডা ঝাল..আওউক লাগায়। রস মিষ্টি। খেজুর লাগায়...রস মিষ্টি...কতো কি লাগায়...কত কি অয়...এইডারেই কয় কুদরত। এই কুদরতি খেলা খেলতে গিয়া ধরা দিল এই মাডির শরিলটাতে। এই শইল্যের মইধ্যেই হেয় অাছেরে বোকা...এই মাডিডায়ই মায়া লাগাইছে। মাডিরে ভালো বাসতে শিক। উচা উচা কতা কইয়্যা আর ফালাইয়্যা লাব নাই। হগ্গলরেই এই মাডির মধ্যে হান্দাইতে অইবো। সময় থাকতে মাডির মতো অইয়্যা যাগা....মায়া করতে শিক...দরদ দিয়া যত্নআত্তি কইর‌্যা যারে পালতাছস....হেয় একদিন উড়াল দিবই দিব...যুদি হেরে ধইর‌্যা রাখতে না পারস..তার কোন ঠিকানাও পাবি না,, কোন নিশানাও পাবি না.....কাঁহাছে আনা কাঁহাছে জানা...না নিশানা নাই ঠিকানা [কালামে হযরক থাজা শাহ্ পীর চিশতী (রঃ)]....। ধরতে পারলে আর মরণ নাইরে পাগলা.....কবরে হাশরে মাওলা থাকবোরে তোর সংগ যাই....দিন থাকিতে পন্থ ধরা চাই....[কালামে হযরত থাজা শাহ্ পীর চিশতী (রঃ)]।

মনা তার বুকের বাম পাশটায় হাত রেখে বললোঃ

" হৃদয়ও বনে অতি গোপনে একারও বাঁশি শুনেছি প্রাণে...মরমে মরি চাহি নেহারি...সন্ধানে আমার পাইবে দেখা" [কালামে হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ)]। গভীর রাইতে বইস্যা বইস্যা এই মাটির শইল্যের মধ্যে কান পাইত্তা হুনবি...হেয় কি কয়...হেরে সময় থাকতেই চিনন লাগেরে পাগলা....দিবসও ফুরাইয়্যা গেলে মতি গতির ঠিক নাই....দিন থাকিতে পন্থ ধরা চাই...রে অবোধ ভাই....যহন তারে চিনবি তহন কবি..উঠাও আবরণ দাও দরশন তোমারও আমার রবে না চিনন...তুমি আসিলে রব না আমি...তোমারও আমার হবে গো দেখ্যা..[কালামে হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ)]।

মনা উঠে যেতে যেতে বললো-যত্ন কর....এই মাডিটারে য্ত্ন কর....যতনে রতন মিলে...

মনার কথা শুনে উপস্থিত সকলেরই মুখ হা হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বললো না। কেবল মোবারকের চোখের দেখা দিল....একফোঁটা বারিবিন্দু...যা সৃষ্টি হয় মহা সিন্ধু থেকে...এর উৎসও কেউ জানে না...ছোট্র এই দেহের মধ্যে কি অমুল্য ধনই না তিনি রেখেছেন...

বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১৬

বিভ্রান্ত ও পথহারা এক পথিক

----------------------------
বিভ্রান্ত ও পথহারা এক পথিক
-----------------------------
এলোমেলো পথ চলায় আমার আনন্দ। এ আনন্দের স্বরুপ উপলব্দি করার জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে কোন অচেনা পথে হাঁটা। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়লে কোন ছায়া সুনীবিড় বৃক্ষ তলের কোন একটি টং দোকানে বসে পড়া। আর সে যদি সাথে থাকে ঝির ঝির পাতলা বাতাস, তাহলে চোখ দুটো একটু মুদে থাকুন। স্রষ্টাকে স্বরণ করুন। কেননা, এ বাতাসের জন্য আপনাকে কোন ট্যাক্স দিতে হবে না। কোন সুইচ অন করা লাগবে না। বিনা মুল্যে পেয়ে যাবেন প্রাণকে শীতল করা পরশবুলি। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো-সেখানে আপনি পাবেন একদল জ্ঞানীমানুষ। যারা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে থাকে। তেমনি একজন জ্ঞানী মানুষ পেলাম। নাম বশির মিয়া। হাড় জিরজিরে কংকালসার শরীর। কাঁধে একটি লাল গামছা। লুঙ্গিপড়া। সে বসে আছে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে। একটি পা মাটিতে অন্য পা বেঞ্চিতে রাখা। সে বেশ আয়েশের ভঙ্গিতে বসেই আলাপ চারিতা করছে। আলাপের বিষয়বস্ত্তু ঠিক মতো ধরতে পারছি না। যেহেতু প্রথম থেকেই ছিলাম না, তাই মাঝখান থেকে শুনতে হচ্ছে। সে বলছেঃ অাল্লাহ পাক কুরআন পাক যখন সর্ব প্রথম নাযিল করলেন তখন নবী মস্তফা (সাঃ) তা পড়তে পারলো না। হযরত জিব্রাইল আঃ জিগ্যাসা করলেনঃ পড়....সে বললোঃ আমি পড়তে পারি না। এরপর জিব্রাইল তারে যখন ধইর‌্যা ছিনায় চাপ দেয় তখন সে পড়তে পারে। সে তখন পড়ে একরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক্...তাইলে দেখা যাইতাছে হযরত রসুলে পাকের ওস্তাদ হইতাছে জিব্রাইল আঃ। কি বলেন আপনারা? জিব্রাইল যদি তারে ছিনায় চাপ না দিতো তাইলে কি নবী পড়তে পারতো? পারতো না....
বশির মিয়ার কথা শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেল। আমি তাকে বললামঃ বশির ভাই, এদিকে আসেন। আমি পকেট থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেটটা বের করে তাকে ইংরেজিতে লেথা Make by British American Tobacco Bangladesh লেখাটা পড়তে দিলাম। বললাম পড়েন। সে বললোঃ ভাই অামিতো ইংরাজি পড়তে পারি না। ও ...তাই...এদিকে আসেন। সে আসতেই তাকে ধরে জোরে চাপ দেই। সে ওরে বাবারে মইর‌্যা যাইতাছি গা...ছারেন...ছারেন...ও ভাই ছারেন বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। তারপর বললামঃ পড়েন...কি পড়মু ভাই...এই যে এই লেখাটা....কেমতে পড়মু....কেন্ আপনি না বললেন জিব্রাইল ফেরেস্তা নবীকে ধরে চাপ দিল আর নবী পড়া শুরু করে দিল...আরে ভাই আপনে কি জিব্রাইল ফেরেস্তা......কি বলা যায়...

যেখানে দেখিবে ছাই কুড়াইয়া দেখ তাই

সদরঘাটের রাস্তা-ঘাট সর্ম্পকে যাদের কিঞ্চিৎ ধারণা আছে, তারা বোধ করি দেখে থাকবেন সারি সারি বইয়ের দোকান। তার মাঝে আছে পশরা সাজিয়ে কম দামে বই বিক্রি করার কিছু দোকানী। " যারা দেইখ্যা নেন দশ টাকা বাইছ্যা নেন দশ টাকা " দামের কিছু বই বিক্রি করে থাকে। তেমনি একটি বইয়ের পশরার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি কি কি বই বিক্রি করে। বইগুলো উলট পালট করে দেখতে থাকলাম। দেখলাম আছেঃ বেহেস্তের শান্তি দোযখের অাযাব, নেকী বদীর হিসাব-নিকাশ, দশ লক্ষ নেকীর দোয়া-কালাম, স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন, ওয়াজে ইসলাম, সাওয়াল-জওয়াব ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে দৃষ্টি নিবন্ধিত হলো একটি বইয়ের উপর। উপরের মলাটটা হাওয়া হয়ে গেছে। হাল্কা-পাতলা চটি ধরণের বই। পিনআপ করা। বইটির মাঝখানে লেখাঃ মকতুবাদে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) ও আসরারে হাকিকী। অনুবাদ-জিয়াউল আলম মোহাম্মদ ই্‌উসুফ খাঁ।
হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ মঈনউদ্দিন চিশতী (রহ) তাঁর প্রিয়তমযোগ্য শিষ্য হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহঃ) এর উদ্দেশ্যে লিখিত পত্রাবলী। বইটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলামঃ
-------------------------------------
বইটির ভুমিকা নামক অধ্যায়ে হাদিয়া নামক স্থানে লিখিত আছেঃ
যে মহান আউলিয়াকুল চুড়ামণির অপুর্ব আধ্যাত্মিক তত্ত্বের সুখ্যাতি বিভক্তি পুর্ব সমগ্র ভারতবর্ষে, উপজাতীয় সীমান্ত অন্ঞ্চলে, আফগানিস্তান ইরানে এবং আরব জগতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল যাহার দারাজ দাস্ত মোবারকে হিন্দু মুসলমান, খ্রীষ্টান ইহুদী পারসিক জৈন এবং বৌদ্ধ মারাঠী ইত্যাদি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে জামে মারেফাত পান করিয়া রাহে নাজাতের সন্ধান পাইয়াছে-যাহার খেদমত পাকে হায়দারাবাদের নিজাম বাহাদুর রামপুর ভুপাল এবং আলীগড়েরর নবাব নাজিমগণ ছের বাছজুদ থাকিতেন-যাহার নির্দেশ মোতাবেক ও তত্ত্বাবধানে জামানা দারাজ পর্যন্ত আজমীর শরীফের পবিত্র উরছ শরীফ সুসস্পন্ন হইত- যাহার শানে পবিত্র মক্কা মোয়াজ্জেমা নিবাসী ছৈয়দ হাবিব উলুবি উদাত্ত কন্ঠে গাহিয়াছেন-
ভাই কি দেকতাছেন? নিলে নেন, না নিলে রাইখ্যা দেন। খাড়াইয়্যা খাড়াইয়্যা খামাখা কেচ্যাল কইরেন না...দোকানীর কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সাথে সাথে দশটি টাকা দিয়ে বইটি কিনে নিলাম।
এমন একটি অমুল্য ধন যে দশটি টাকার বিনিময়ে পেয়ে যাবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি। হয়তো গরীব নেওয়াজের অশেষ রহমত ও নেগাহ পাকের করমে ভাগ্যগুণে পেয়ে গেছি। যদিও দশটি টাকা এই পার্থিব জীবনে অতি নগণ্য কিন্ত্তু যে বস্ত্তুটি ক্রয় করেছি তার মুল্য হয়তো অপার্থিব জীবনে অমৃত সুধার ন্যায় শরাবান তাহুরা...

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

যাদুকর ও মনার ভোঁ দৌড়

মীরপুর ১নং শাহ্ আলী (রহঃ) মাজার গেটের কাছে বেশ একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। চারদিক থেকে গোল হয়ে সেই জটলা একটা সময়পর বেশ বড়ো সড়ো আকার ধারণ করলো। মনা পাগলা বেশ আগ্রহ নিয়ে সেই জটলার মধ্যে ছেলেমানুষের মতো বসে বসে দেখছে। কি দেখছে? দেখছে একজন যাদুকর তার যাদু দেখাচ্ছে। যাদুকরের বেশভুষা আহমরি কিছু নয়। দেখতেও খুব একটা সুশ্রী বলা যাচ্ছে না। কিন্ত্তু তার কথা-বার্তার ধরণ এবং যাদু দেখে হাজারো মানুষকে আকৃষ্ট করছে। সেই যাদুকর একটা ডিম বল হাতে নিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছে আর বলছেঃ

-বাই আমার আতে এইড্যা কি দেখতাচ্ছেন? একটা ডিম বল। তাই না ? কি বাই ? কতা কন্ন্যা ক্যা ?

জনসমুদ্র হতে অনেকেই চিৎকার করে বলছেঃ

-হ এইডা একটা ডিম বল। 

যাদুকর বললোঃ

প্রয়োজন হইলে আপনেরা হাতে নিয়া দেখতে পারেন। তারপর যাদুকর সেই বলটা নিয়ে জনগণকে হাতে নিয়ে দেখাচ্ছে। মনাও বাদ গেল না। সে বলটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে বললোঃ

-হাচাইতো একটা প্যালাষ্টিকের বল। ডিমের লাহান দেহা যাইতাছে।

যাদুকর মনার হাত থেকে বলটা নিয়ে বললোঃ 

-এইবার দেকবেন আসল খেলা।

এই বলে সে বলটাকে তালু বন্ধি করলো। তারপর সে তুড়ি বাজাতেই বলটা গায়েব হয়ে গেল। তার হাতের মধ্যেই যে বলটি ছিল, তা মুহুর্তের মধ্যেই হারিয়ে গেল। সকলেই অবাক হয়ে সেই যাদুকরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সেই যাদুকর বললোঃ

-দেকছেন মুহুর্তের মইদ্যেই বলডা গায়েব হইয়্যা গেল। এহন এই বলটা কই পাই? দেহেন কি করি? বলটাতো আননের দরকার...এই বলে সেই একটি অপরিচিত ছেলেকে বললোঃ

-বাবা হা করতো? ছেলেটা হা করতেই যাদুকর বললোঃ 

-আয়তো...
অায়তো বলার সাথে সাথে বলটা ছেলেটির মুখের মধ্যে চলে এল। সে বলটা সবাইকে দেখিয়ে বললোঃ

-দেকছেন? ডিম মনে কইর‌্যা পুলাডা খাইয়্যা হালাইছিল। আরে বাবা আমার জিনিস তুমি খাইয়্যা হালাইব্যা আর আমি সালাম যাদুকর চাইয়্যা চাইয়্যা দেকমু, হেইড্যা অইবো না....

এবার সে ঐ ছেলেটাকে ডেকে তার কাছে নিয়ে এল। তারপর মুখ খুলতে বললো। ছেলেটা মুখ খুলতেই যাদুকর মুখের ভেতর বলটি ঠেসে ধরে বললোঃ যা গা...বলটা যাদুকরের হাতও নেই ছেলেটির মুখেও নেই। সকলেই মুগ্ধ হয়ে যাদুকরের সেই অভাবনীয় যাদু দেখছে। কারো মুখের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। সকলেই অবাক বিষ্ময়ের সাথে যাদুকরের যাদুর প্রশংসা করছে। এরপর যাদুকর ছেলেটিকে বসতে বললো। ছেলেটা বসলো। যাদুকর ছেলেটির পিঠের উপর দুইটা থাপ্পর মেরে বললোঃ বাইর অ। কথা বলা শেষ হতেই দেখা গেল বলটি ছেলেটির পশ্চাৎদেশ হতে বের হয়ে এল। এই দৃশ্য দেখে সকলেই হাসিতে ফেটে পড়লো। লজ্জা পেয়ে ছেলেটি দিল ভোঁ দৌড়।

যাদুটি দেখে মনা মনে মনে ভাবছে - এই বিশ্ব বিধাতা তাহলে যাদুকরের মতোই কুন-ফা ইয়া কুন বলে এই জগত সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "বাদী‘উস্ সামা-ওয়া-তি অল র্আদ্ব অইযা-ক্বাদ্বোয়ায় আম্মান ফা ইন্নামা- ইয়াক্বুলু লাহু কুন্ ফাইয়া-কুন [بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ]।"  অর্থঃ তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়। দারুণতো....সে বেশ উৎসাহ বোধ করছে....ঠিক সেই মুহুর্তে

যাদুকর মনা পাগলার দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-বাজান আপনে একটু এইদিকে আহেনতো?

মনা তখনো হাসছে। সে হাসতে হাসতে সামনের দিকে গেল। তারপর যাদুকর সকলের উদ্দেশ্যে বললোঃ 

-এতক্ষণতো আপনেরা দেকলেন বলের খেলা। এইবার দেকবেন আশেক-মাশুকের খেলা। প্রেমের খেলা। মায়া মোহাব্বতের খেলা। দেহেন আমার আতে দুইডা পুতুল। একটা বেডা। আর একটা মাইয়্যা। এই পুতুল দুইডা একজন আরেক জনরে ছাড়া থাকতে পারে না। দেহেন কেমুন মোহাব্বত! আর আজ কাইল আমাগো মইধ্যে মোহাব্বত নাই বললেই চলে। বাজান আপনে একটু এই দিকটায় আহেন। এ কথা বলে সে মনাকে টেনে একটু দুরে দাঁড় করিয়ে রাখলো। তারপর একটা পুতুল মনার হাতে দিয়ে বললোঃ 

-বাই এই পুতুলটা এইহানে রাখেন। তারপর এই বাডি দিয়্যা চাইপ্প্যা ধইর‌্যা রাকবেন। খবরদার উডাইবেন না। যহন আমি উডাইতে কমু তহন উডাইবেন। তারপর দেখবেন খেলা। 
এ কথা বলেই যাদুকর তার হাতের পুতুলটি নিয়ে আরেকটি জায়গায় রাখলো। তারপর বাটি দিয়ে চেপে ধরে বললোঃ

-এ্যাই মজনু আয়তো বাবা.....

একথা বলার সাথে সাথে মনাকে বাটিটি উঠাতে বললো। সকলেই অবাক হয়ে দেখলো পুতুলটি সেখানে নাই। সকলেই অবাক হয়ে গেল। যাদুকর তার হাতের বাটি উঠাতেই দেখতে পেল সেই বাটির মধ্যে ছেলে পুতুলটি চলে আসছে। এটা দেখে সকলেই হাত তালি দিতে লাগলো। তারপর সে সেই খেলারই পুণারবৃত্তি করার কথা বলে মনার হাতে মেয়ে পুতুলটি দিয়ে পুর্বের মতোই চেপে ধরে রাখতে বললো। তার পর যাদুকর তার হাতের ছেলে পুতুলটি পুর্বের মতো করেই বললোঃ এ্যাই তরা যা গা। মনাকে বাটি উঠাতে বললো। মনা বাটি উঠালো। যাদুকরও তার বাটি উঠালো। দেখলো কোথাও পুতুল দুটি নেই। 

এটা দেখে তো মনার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কেমনে, কি ভাবে হলো?
আশেক মাশুকের টানে থাকতে পারে না। আশেককে ডাকলে অবশ্যই মাশুক হাজির হবার কথা [উচ্চারণঃ"فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ অর্থঃ "অতএব তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব, তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী হইও না।"]। কিন্ত্তু আমরা যে বলি আমরা নবীর আশেক। আমরা আল্লাহর আশেক। তাহলেতো নবীর আসার কথা। যে নবীর আশেক, সে যদি ডাকে তাহলে তো অবশ্যই নবী আসবে। আবার যে আল্লাহর আশেক, সে যদি ডাকে তাহলেতো আল্লাহপাকেরও আসার কথা।

একটা সামান্য যাদুকর যদি এটা করে দেখাতে পারে, তাহলে যারা সত্যিকারের আশেক, তারা যদি তার মাশুককে ডাকে, তাহলে তার মাশুক আসবে না কেন? যদি না-ই আসে, তাহলে সে কিরুপ আশেক? অামরা বলি আমরা সবাই পীরের আশেক। তাহলে তার পীর যদি তাকে ডাকে আর সে যদি না যায়, তাহলে সে কিরুপ আশেক? ইশকের আগুনে যদি অন্তরই না পুড়লো, তাহলে সেই অন্তর দিয়ে হাজারো ডাকলে মাওলার দিদার পাওয়া সম্ভব নয়। মাওলার দিদার পেতে হলে তার কথা সঠিক ভাবে পালন করতে হবে। তিনি যা বলেছেন, তাই অক্ষরে অক্ষরে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে হবে। আশেকের মাশুক হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আশেকের মাশুকের খেলা বড়ো সাংঘাতিক খেলা। 

মনার মনে পড়লো তার গুরু তাকে ডেকে ছিল। সে যেতে পারেনি। তার কাছে যাবার মতো টাকা ছিল না। কারো কাছ থেকে যে টাকা নেবে তারও উপায় নেই। তাহলে সে কি আশেক নয়...সে কি সত্যিই আশেক নয়....

মনার বুক ফেটে কান্না আসছে। সে ভীড় ঠেলে বাহিরে বের হয়ে এল। তারপর ইয়া মুর্শিদ বলে একটা ভোঁ দৌড় দিল।

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬

বৃষ্টি নিয়ে ভাবনাঃমনা পাগলার চিন্তা

মনার আজ মন ভালো নেই। সে মন মরা হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে বাহিরের আবহাওয়ার সাথে তার মনের একটা সর্ম্পক তৈরী হয়ে গেছে। এই শ্রাবণ মাসের বারিধারায় স্নাত হওয়া একটা সময় তার সিজোনাল বাথ থাকলেও তা এখন পাল্টে গ্যাছে। তার এই ধরণ সরণ সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নয়। কিন্ত্তু তাকে যারা চেনে,তারা তার এই ধরণ-সরণ সম্পর্কে জানে। তাদেরই একজন হচ্ছেন জামিল ভাই। সেই জামিল ভাই এসে মনার কাঁধে হাত রেখে বললঃ
- কেমন আছেন?
- যেমন দেখছেন?
- দেখছি তো ভালোই আছেন।
- তাহলে ভালোই আছি।
- মন খারাপ কেন?
- ভাবচ্ছি।
- কি ভাবছেন?
- বৃষ্টির কথা...
- বৃষ্টির কথা ! জামিল ভাই কথাটা শুনে অনেকটা ভুত দেখার মতো করে চমকে উঠে বললেনঃ
- মেয়েটা কোথায় থাকে?
-আরে মিয়া, কিয়ের মাইয়্যা...আমি কইতাছি বাইরে যে বিষ্টি অইতাছে,হেইডার কথা..
জামিল ভাই দেখলেন মনা তার আসল রুপে ফিরে গেছে। তাই সে বেশ প্রফুল্ল বোধ করছেন। একটা স্বস্তি পাচ্ছেন। যাক্ শেষ পর্যন্ত মনাকে তার আসলরুপে পাওয়া গেল। তাহলে তার ভাবনার বিষয়টা জানা যেতে পারে....জামিল ভাই আস্তে করে মনাকে বললেনঃ বৃষ্টি সম্পর্কে কি ভাবছেন? সেটা কি বলা যাবে?
মনা দেখলো জামিল কেমন যেন মায়াবি গলায় কথাগুলো বলছে। মনার একটু দয়া হলো। সে ও আস্তে আস্তে করে জামিলকে বললোঃ

- তুমি যদি একটা পাত্রে পানি রেখে জ্বাল দিতে থাকো সেটা বাস্প হয়ে উড়ে যায়। সেটা জমে কখনোই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না..তাহলে...কি পরিমাণ পানি বাষ্প হলে সেটা জমে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে....মাঝে ....মাঝে শিলাবৃষ্টিও হয়? সুর্যকে কে নির্দেশ দিল পর্যাপ্ত পরিমাণ তাপ দিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করতে? না-কি মাটির বুক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে সিক্ত করণের জন্য পানি প্রয়োজন? মাটি কি কান্না করছিল পানির জন্য? যদি কান্না করেই থাকে, তাহলে সেই কান্না আমরা শুনতে পাই না কেন? অার যদি কান্না না করেই থাকে, তাহলে সে কার কাছে পানির জন্য আর্জি প্রার্থনা করছিল?
দ্যাখো,মহান রব মাটির ডাক শুনে বৃষ্টির পানি দিয়ে তাকে সিক্ত করেছেন। যেন শক্ত মাটিগুলো রসালো হয়। রসের জন্য প্রয়োজন পানি। বিধাতা সেই পানি দিয়ে জমিনকে সিক্ত করছেন। কারণ জমিন থেকে যে ফসল উৎপন্ন হবে তা তার বান্দারা আহার করবে। সেই আহার থেকে খাদ্যরস দেহবীজে পরিণত হবে। তারপর নতুন কিছু শিশু দুনিয়াতে আগমণ করবে। কেউ কেউ নির্গমণও হবে। তারপরও কথা থেকে যায়..

- কি কথা?

- যে শিশুটি ভুমিষ্ট হবে সে হবে লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি অাহসানে তাকবীম। সেই শিশুটিকে তিনি বিভিন্ন ধাপে ধাপে সৃষ্টি করেছেন। যেমন সুরা নুহ আয়াত নং ১৪। বলছেনঃ ওয়াকাদ খালাকা কুম আতওয়ারা.....তিনি (আল্লাহ) গঠন করিয়াছেন তোমাদিগকে উন্নতির নানা মাত্রায় (পর্যায়ক্রমে-বিভিন্ন ধাপে ধাপে)। সেই ধাপগুলো কি কি? একটু চিন্তা করে দেখ। এক সময় তোমার কোন অস্তিত্বই ছিল না। তুমি ছিলে নিরাকার। এরপর তোমার আকার দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে। কখন? যখন তুমি নুৎফারুপে ছিলে। সেই নুৎফার উৎপত্তি এই মাটি। ফা ইন্না খালাকনাকুম মিন তুরাবেন [সুরা হজ্জ আয়াত-২২]। তোমাকে গঠন করিয়াছি মাটি হইতে। কিরুপে? ওয়াল্লাহু আনবাতাকুম মিনাল আরদে নাবাতান-সুম্মা ইউয়িদুকুম ফিহা ওয়া ইউখরেজুকুম ইখরাজান [সুরা নুহ আয়াত নং-১৭-১৮]। বরং আল্লাহ তোমাদিগকে উদ্ভুত কয়িাছেন ভুমি হইতে-উদ্ভিদের ন্যায়। অতঃপর তিনি উহাতে তোমাদিগকে ফিরাইয়া লইবেন এবং তিনি তোমাদিগকে সেখান হইতে বাহির করিবেন-এক (নতুন) জাত হিসাবে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কি জানো? ইনসান সৃষ্টির বিভিন্ন ধাপটি। যেমন সুরা মোমিনুন আয়াত নং-১৪তে বলা হয়েছেঃ 
সুম্মা খালাকনান নুৎফাতা আলাকাতান মুদগাতান। অতঃপর অামরা সেই শুক্রবিন্দুকে দৃঢভাবে আটকাইয়া রাখি(জরায়ুতে)। ফা খালাকনাল মুদগাতা এজামান। পরে সেই দৃঢ়ভাবে আটকাইয়া রাখা বস্তুটাকে পরিণত করি চিবানো গোশতের পিন্ডরুপে। ফা কাসাওনাল এজামান লাহমান। এবং সেই চিবানো গোশতের পিন্ডকে রুপ দেই হাড়-হাড্ডিতে এবং সেই হাড্ডির উপরে দেই আবরণ-অক্ষত গোশতের দ্বারা।ছুম্মা আনশানা-হু খালক্কান আ-খার। অতঃপর তাকে অন্য একটি সৃষ্টি বানিয়ে দাঁড় করিয়েছি। ফাতাবা-রাকাল লাহু আহসানুল খালিকিন। সুতরাং তোমার সৃষ্টিকর্তা সুন্দরতম বরকতময়। 
দ্যাখো আল্লাহপাক কেবল মানব সৃষ্টির ব্যাপারেই কেবল বলেছেন ফাতাবা-রাকাল লাহু আহসানুল খালিকীন। আর অন্য সবার ক্ষেত্রে রাব্বুল আলামিন। খালিক তিনিই যিনি উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করতে পারেন। এ কথাটা কেবল আল্লাহ পাকের ক্ষেত্রেই খাটে। অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা, এই বিশ্ব ভুমন্ডল কেবল মাত্র মহান জাত পাক আল্লাহ পাকের। কাজেই তার উপাদান দিয়েই তুমি সৃষ্টি করছো। এজন্য তুমি হচ্চো সানে মানে দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা। যা কেবল ইনসানের ক্ষেত্রেই খাটে। এটা মাজেজি। হাকিকি নয়। পুর্ণ হাকিকি হচ্ছে মহান জাত পাক সুবহান ওয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম। তিনিই হচ্ছেন খালিক। তিনি ব্যতীত আর কেউ এ নামের যোগ্য নন।

মনার কথা শুনে জামিল ভাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ভাবতেই পারেননি বৃষ্টি নিয়ে কেউ এভাবে ভাবতে পারে? মনে মনে তিনি মনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা অবনত করলেন।

বুধবার, ২২ জুন, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মচিৎকার এবং বাস্তবতা-পর্ব সাত

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মানুষের বাক শক্তি অইতাছে কালাম তথা বাইক্য। এই বাক শক্তির গুণেই শব্দময় জগতের সৃষ্টি অইছে। কলুল্লাহার বাণী হুননের লাইগ্যা কান পাতন লাগে। তাইলেই হুনতে পারবি তার কতা বার্তা। হেয় অইলো বোবাজাতের মতো। নীরব ভাষায় হেয় কতা কয়। হের কতা হুননের লিগ্যাইতো মানুষজন ঘর বাড়ী ছাইড়্যা জংগলের মইধ্যে আশ্রয় লইছে। নীরব সাধন করছে। তার পর হের লগে কতা-বার্তা কইছে। নবী পাক হেরা গুহায় ধ্যান না করলে কি হের কতা হুনতে পারতো? নবী পাক আল্লাহ পাকের সাথে কতা কইছে। হের লগে দেহা সাক্ষাত করছে। মুছা নবীওতো মাঝে মাঝে তুর পাহাড়ে যাইয়্যা আল্লাহ পাকের লগে কতা বার্তা কইছে।

-মুছা নবীর কতা বার্তার কতাতো মোল্লাগো মুকে হুনছি। কিন্ত্তু একটা বিষয় মাতার মইধ্যে ঢুকতাছে না। হেইডা অইলোঃ মুছা নবী যহন আল্লাহর লগে দেহা করতে গেল, তহন তো ফেরেস্তা জিব্রাইল (আঃ) এর কতা হুনি না। ফেরেস্তা জিব্রাইল কি খালি মহানবী (সাঃ) এর লগেই সাক্ষাত দিয়া কইলোঃ ইকরা বিসমি রাব্বিকাললাজি খালাক। আর অন্যান্য নবীগো লগে দেহা সাক্ষাৎ করে নাই?

-এইডা তো জানি না। মনা বললো।

-বাই তাইলে তাওরাত যে আল্লাহর বাণী মানে আল্লাহর কতা। বাণী মানেতো কতা। তাই না? তো হেই তাওরাত কার মাধ্যমে নাজিল অইলো? কে আনলো এই বাণী? কোরআনের বাণীতো আনছে হযরত জিব্রাইল (আঃ)। তাইলে তাওরাতও কি হযরত জিব্রাইল (আঃ) আনছে?

-কি কমুরে হারুইন্যা, তুইতো দেহি জ্ঞানীগো মতো কতা বার্তা শুরু কইর‌্যা দিচ্ছস। তর লগেতো বেশিক্ষণ বহন যাইবো না...তুইতো দেহি প্যাঁচে ফালাইয়্যা দিবি...তারপর উল্টা পাল্টা বইল্যা আমারে মানুষের আতে মাইর খাওয়াইবি...

-না বাই। হেইডা পারুম না। এই অঞ্চলে বেবাকতে আপনেরে চিনে। তাছাড়া মনের মইধ্যে প্রশ্নডা গুর গুর করছিল। হেরলিগ্যা কইয়্যা হালাইছি। বাই...ভুল অইলে মাফ কইর‌্যা দিয়েন।

-বেডা হোন। হগলতে সব কতা জানে না। দেহা গেছে কেউ জানে বেশি কেউ জানে কম। আবার যে যেইডা জানে অন্যজন হেইডা জানে না। এর লিগ্যাই কইছে জ্ঞানীরা সর্বদাই একসাথে থাকতে পছন্দ করে। তারা কারো লগে বিবাদ করে না। তারা পরস্পর ভাই ভাই। 

-হের লাইগ্যাইতো আপনে আমার বাই। আপনেরে আমি বেশি পছন্দ করি। আপনেরে পাইলে কাম-কাইজ হালাইয়্যা থুইয়্যা আপনের কাছে ছুইট্র্যা আহি।

-হেইড্যা আমি জানি। তয় তোর মইধ্যে জাননের আগ্রহডা বেশি দেইক্ক্যাই তোরে জানাই। নাইলে দেহস না অন্যডির লগে বেশি প্যাঁচাল পারি না। 

-জানিতো বাই। আপনে আমারে পছন্দ করেন। আমার আমারে দেকতে সইর‌্যা যাইতে চান।

-এই যে তুই একটা ফালতু কতা কইলি। তোরে দেকলে পলাই যের লিগ্যা হেইডা অইলো তুই কামের কতা থুইয়্যা আকামের কতা বেশি কস। আর প্যাঁচাস বেশি। কইতাছিলাম কি আর তুই হেই কতা থুইয়্যা একটা প্যাঁচ লাগাইয়্যা দিলি...

-বাই মনের মইদ্যে যে গাই মারে কি করমু কন? কতার মইদ্যে আইলে কি বাদ দেওন যায়?

-না বাদ দেওন যায় না। তয় আগে গুরুত্বপুর্ণ কতাগুলি হুইন্যা লওন উচিত। নাইলে পরে ভুইল্যা যাইতে পারি..

-আইচ্ছা বাদ দেন। আমরা আমাগো কতায় ফিইর‌্যা যাই।

মনা আবার শুরু করলো তার পুর্বের কথা। কিন্ত্তু সে কতা বলে আগের মতো আর ভাব পাচ্ছে না। কারণটা কি? কারণটা আর কিছুই নয়। কারণটা হলোঃ হারুন তাকে যে প্রশ্নগুলো করেছিল সেগুলো মনার মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করছে। সে না পারছে আগের কথায় ফিরে যেতে না পারছে তার কথা চালিয়ে নিতে। কিন্ত্তু মনার মন না বসলেও সে আবার বলা শুরু করলোঃ
(চলবে)

রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মচিৎকার এবং বাস্তবতা-পর্ব ছয়

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মনার কথা শুনে হারুন একটু নড়ে চড়ে বসলো। তারপর মনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলোঃ

-এই যে আপনে কইলেন সুরা ওয়াকেয়ার ৫৮ নং আয়াতে আফারায়াইতুম মা-তুমনুন অর্থঃ ভেবেছ কি তোমাদের বীর্যপাত সম্বন্ধে । হের পর ৫৯নং আয়াতে আআনতুম তাখলুকনাহ আম নাহনুল খা-লিকুন। অর্থঃ তা থেকে তোমরা সৃষ্টি কর, না আমি সৃষ্টি করি? এইডার কথার মানিডা ঠিক বুঝবার পারলাম না...আমাগো কইলো বীর্যপাত সমন্ধে চিন্তা করতে তারপর কইলো তুমরা সৃষ্টি কর না আমি?

-আরে তুমি যে বীর্যপাত করবা, কার উপর করবা? আগে হেইডা ভাবো? তুমি যদি চিন্তা কর আমি মাইয়্যাডারে ভালোবাসি। হেই ভালোবাসার নাম কইর‌্যা তার স্বতীত্ব হরণ করবা? যেই চিন্তা কইর‌্যা বীজটা ঢালবা, হেই বীজটা ঠিক হেয় হেইরকম কইর‌্যাই তৈয়ারী কইর‌্যা পাডাইবো।  নজরুলের কবিতায় পড়ো নাই...শ্রেফ পশুর ক্ষুদা লইয়্যা হেথা মিলে নর-নারী যতো, সেই কামনার সন্তান মোরা তবুও গর্ব কতো? পশুর ভাব লইয়্যা যুদি বীজ ঢালো তাইলে হেই বীজের যে ফসল অইবো হেইডা অইবো পশুর মতোন। যদিও দেকতে মানুষের মতন। হুন যেই নিয়ামত আল্লায় তুমারে দিছে, হেই নিয়ামতের পাই পাই হিসাব হেয় নিব। তুমি কি ভাবছো, তোমারে এম্মনি এম্মনিই ছাইড়্যা দিব?

আরে বাউল ফকির সাধুগো মুকে হুন না. হেরা কি কয়? হেরা হয়-খবরদার, স্বত্ত্বা খন্ডিত করবা না। স্বত্ত্বা খন্ডিত অইলে তুমি বিপদে পড়বা। হেরা কি করে? হেরা যে কয় স্বত্ত্বা খন্ডিত করবা না....যদি স্বত্ত্বা খন্ডিত না অয় তাইলে হেগো ঘরে পুলা-মাইয়্যা আইলো কেমতে? আবার দেহো অন্যদিকে সুফী-সাধকরা বছরের পর বছর নির্জন সাধনা কইর‌্যা কামেল অওনের পর বিয়া সাদী কইর‌্যা হেগো স্বত্ত্বা খন্ডিত কইর‌্যা মুল খনি থিক্ক্যা জগত বাসীর লিগ্যা যেই সন্তান দিয়া গেছে...হেরাও কালজয়ী পুরুষ অইয়্যা গেছে.....কারণ কি? কারণ আর কিছু না.....বীজের খবর লওন....একটা মানুষের বীজের মইধ্যে  কি থাকে? আগে হেইডা জানো মিয়া?

-কেমতে জানমু?

-কেমতে জানমু মানে? তোমার কি বীজ নাই?

-আছে তো? থাকলে হেইডারে কেমতে জানমু? তাইলে তো বীজ বাহির করন লাগবো....এ কথা বলে হারুন একটু লজ্জা পেয়ে হেসে উঠলো। সেই হাসির সাথে তাল মিলিয়ে মনাও হেসে উঠলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললোঃ

-এই মানবদেহডা আল্লাহ পাকের লীলাভুমি। আল্লাহ অইলো যেই উপাদান দিয়া তুমি তৈরী অইছো। যেমুন আরবা আনাছের বা খামছা আনাছের। আব, আতশ, বাত, খাক, নুর। এই পঞ্চ উপাদানে তুমি সৃষ্ট। এইগুলারে কয় পাক পান্ঞ্জাতন। তোমার বীজও হেই পাক পান্ঞ্জাতন দিয়া সৃষ্টি অইছে। হেই বীজের মইধ্যে আছে উনিশটি উপাদান। সেগুলি অইলোঃ ১। হাইউন, ২। আলিমুন, ৩। কুদিরুন, ৪। মুরিদুন, ৫। সামিউন, ৬। বসিরুন, ৭। কলিমুন, ৮। দম,৯। কদম, ১০। অহম,১১।.ফহম,১২। আক্কেল, ১৩। এলেম, ১৪। হেলেম, ১৫। আগুন, ১৬। পানি,১৭। মাটি,১৮। বাতাস এবং ১৯। নুর। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর মইধ্যেও উনিশটি অক্ষর আছে। কিন্ত্তু মুল অক্ষর আছে ১০টি। আর এই ১০টি অক্ষরই মোট ১৯ বার ব্যবহার করছে। যেমুন-১। আলিফ-ব্যবহার অইছে = ৩ বার, ২। মীম-ব্যবহার অইছে = ৩ বার, ৩। বড় হে-ব্যবহার অইছে = ২ বার, ৪। রা ব্যবহার অইছে = ২বার, ৫। লাম-ব্যবহার অইছে = ৪বার, ৬। নুন-ব্যবহার অইছে = ১বার, ৭। ছোট হে-ব্যবহার অইছে = ১বার ৮। বা-ব্যবহার অইছে = ১বার, ৯। সীন-ব্যবহার অইছে = ১বার ১০। ইয়া-ব্যবহার অইছে = ১বার। এই দশ অক্ষর অইতাছে বিসমিল্লাহর প্রাণ বা বীজ অক্ষর। ইলমে তাছাউফের ভাষায় এই বিসমিল্লাহরে কয় নুরে মুহাম্মদ। এই নুরে মুহাম্মদী থিক্ক্যাই ১। কালেব ২। রুহ ৩। ছের ৪।খফি ৫। আগফা ৬। নফস ৭। আব ৮। আতশ  ৯। বাদ এবং ১০। খাকের সৃষ্টি।
প্রথমে তুমি আছিলা তোমার বাবার মাথার মইধ্যে। খায়েশের কারণে তোমার মায়ের গর্ভে তোমারে পাডাইয়্যা দিছে। আর তুমি বন্দী অইয়্যা আইছো এই পৃথিবীতে। হের লাইগ্যাইতো শাহ্ পীর কয়ঃ পাঠিয়ে দিয়েছ তাইতো এসেছি, আমি কি কিছুই জানি? যে পাডাইছে হেরে কিন্ত্তু তুমি দেকতে পারবা না। হেয় আড়ালে থাইক্ক্যাই তোমারে পাডায়ইয়্যা দিছে। হেরে কয় খালেক। মানি সৃষ্টি কর্তা। তুমি তোমার বাবারে সৃষ্টিকর্তা কইতে পারো। কিন্ত্তু কোরআন কইতাছেঃ তুমি সৃষ্টি কর, না আমি? এই অামি হচ্ছে দৃষ্টির অগোচরে থাকা মহা অামি। হেয় রব রুপে সবার মইধ্যেই মুহিত অবস্থায় থাহে। বুঝবার পারছো মিয়া?
আবার দ্যাহো, এই বীজ যহন মাতৃজঠরে যায়, তহন হেরে লালন পালনের লিগা মায়ের বুকের মইধ্যে দুদ আহে। হেই দুদের মইধ্যেই আছে ৫+৭ = ১২ ডা উপাদান। ডাইনধারে ৫ টা। আর বাম ধারে ৭টা। ডাইন ধারের ৫টার নাম অইলো গিয়া ১। নুরী ২। জহুরী ৩। যব্বুরী ৪। সত্তুরি ৫। বে-খুদী। এই পাঁচটা উপাদান দিয়া তৈয়ার অয়ঃ ১। আগুন ২। পানি ৩। মাটি ৪। বাতাস ৫। আকাশ। আর বাম ধারের ৭টার নাম অইলোঃ ১। শনি ২। রবি-সুর্য ৩। সোম-চন্দ্র ৪। মঙ্গল ৫। বুধ-ক্ষুদ্র ৬। বৃহস্পতি-বৃহৎ ৭। শুক্র-বীর্য। এই সাতটি দিয়া যেইগুলা তৈয়ার অয় হেইগুলি অইলোঃ ১। হাইউন-জীবিত শক্তি ২। আলিমুন-জ্ঞান ৩। কুদিরুন শক্তি-কর্মশক্তি ৪। মুরিদুন-যৌনশক্তি ৫। সামিউন-শ্রবণশক্তি ৬। বসিরুন-দর্শন শক্তি ৭। কালিমুন-বাক শক্তি। এই পাঁচ আর সাত মিল্ল্যা অইলো বারোডা রস ভান্ডার যারে কয় কলেমা বা বাক্য। সৃষ্টির মইধ্যে এই কলেমাই সবথিক্ক্যা উত্তম। হেরলিগ্যা এইডারে কয় মুসসফী কলেমা। এই বারোডা থিক্ক্যা আবার আরো বারোডা জিনিসের পয়দা অইছে। হেইগুলা অইলোঃ১.ওয়াজেবুল অযুদ ২। অহেদাল অযুদ ৩। আরেফেল অযুদ ৪। মোমতেনল অযুদ ৫। মোমকেনাল অযুদ ৬। জীবিত শক্তি ৭। জ্ঞান শক্তি ৮। কর্ম শক্তি ৯। শ্রবণ শক্তি ১০। যৌন শক্তি ১১। দর্শন শক্তি ১২। বাক শক্তি।
(চলবে)