পৃষ্ঠাসমূহ

হাফিজ সিরাজী













হাফিজ সিরাজীর কালাম

কেউ যদি আমার সাথে বসে,
আর আমরা আমাদের সেই প্রিয়তমকে নিয়ে আলাপ করি
যদি আমি তার অন্তরে স্বস্তি বয়ে আনতে না পারি.
যদি আমি তাকে আগের চেয়ে ভালো অনুভব করাতে না পারি
তাকে নিয়ে এবং এই পৃথিবীকে নিয়ে,
তাহলে হাফিজ,
দ্রুত ছুটে যাও মসজিদে আর সিজদাবনত হও --
কেননা তুমি এইমাত্র
আমার জানা একমাত্র পাপটি করেছ।

‍‍~ পারস্যের কবি হাফিজ

হাফিজের কবিতা সরাই শরাব সাকি : তৃষিতের ঠোঁট

উৎসর্গ : মনিরুদ্দীন ইউসুফ

তাঁর শাহনামা অনুবাদ সমুখে শ্রদ্ধায়  সবিনয় নিবেদন
তবে এই! এ জীবন এক সরাইখানা। এখানে বইছে শরাব, মাটির সোরাহি থেকে তো নয়, বইছে বেহেশতেরই সালসাবিল নহর থেকে নির্মল, ভরে তুলছে এই মর্ত্যরে পেয়ালা। সেই পেয়ালার দিকেই তবে তুলে ধরা আমাদের তৃষিত ঠোঁট। মাতাল- মাতাল হয়ে যাওয়া! আর তবেই পাবো উদ্ধার! স্বর্গীয় ডানা পাবো মাটি ছেড়ে আকাশে উড়বার। অপিচ এ উড্ডয়ন সকল সৌন্দর্য আর আত্মার আরামের দিব্য উৎস সকাশে পৌঁছে যাবার জন্যেই বটে। যখন এই অবকাশটি আমাদের জন্যে আসে তখন আমরা লীন হয়ে যাই অভূত এক সৌন্দর্যে, একাত্ম হয়ে উঠি আত্মার সঙ্গে- ফারসিতে যাকে বলি খুদি, যা থেকে খোদা শব্দটিরও উদ্ভব। বাংলা মুলুকে আমাদের পিতামহ প্রপিতামহদের যত ঊর্ধ্বে যাই খোদা শব্দটি ছিল তাঁদের কাছে আল্লাহর সমনাম, কিন্তু হায়, সাম্প্রতিক মৌলবাদীদের তথাকথিত শুদ্ধতার ধমকে শব্দটি এখন দণ্ডিত ও নির্বাসিত; খেদ শুধু এ কারণেই নয়, পরন্তু হাফিজের জন্যেই যে তাঁর শরাব-সাকি-পেয়ালার স্বর্গীয় প্রতীকতাও এখন এ বাংলাদেশে পেয়েছে করুণ ছিন্নতা।

হাফিজের সাধনা ছিল,তৃষিতের জন্যে অমৃত সন্ধান- পার্থিব সরাইখানায় সাকির হাতে সেই শরাব- এবং আজও তা এই সামান্য সাধারণ আমাদেরও চাওয়া। এ তৃষ্ণা চিরকালের, শতাব্দী পেরিয়ে যায় তৃষ্ণা ও সন্ধান তবু চলেই চলেছে। তাই হাফিজ হয়ে ওঠেন এমত অনিবার্য যে জীবদ্দশাতেই তিনি লোকসাধারণের প্রতিদিনের উচ্চারণে উঠে আসেন; জীবন যাপনের প্রতি বাঁকে, অভিজ্ঞতার অভিঘাতে, ফারসিভাষীদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন নিত্য উদ্ধৃতিযোগ্য, যেমনটি বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ। তাঁর খ্যাতি পারস্য ছাড়িয়ে তাবরিজ কি বাগদাদ, সমরখন্দ, এমনকি বাংলা মুলুকেও পৌঁছে যায়; তাঁর এক গজলেই আমরা সংকেত পাই, হাফিজ বলছেন- ইরানের শর্করাখ- এই যে যাত্রা করছে বাঙালার দিকে,সে দেশের কত শত তোতাপাখি একে তুলে নেবে তাদের চঞ্চুতে, স্বাদ নেবে আনন্দে।

আজ থেকে সাতশ’ বছর আগে ইরানের শিরাজ নগরে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি, নাম রাখা হয়েছিল খাজা শামসুদ্দীন মুহম্মদ, কবিনাম নিয়েছিলেন- হাফিজ; সম্পূর্ণ কোরান তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল বলেই এই নামটি তিনি বেছে নেন, প্রতিটি রচনার শেষ পদে তিনি স্বাক্ষর রেখে যান এ নামে, আর এ নামেই জগৎ তাঁকে জানে; শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে তাঁকে জেনেছিলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ- বালক বেলায় তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে দক্ষিণের বারান্দার সান্ধ্য অন্ধকারে সুরসহ নির্ভুল ফারসি আবৃত্তি শুনে।

পরিণত বয়সে ইরানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাফিজের সমাধি পাশে যান, বিবরণে তিনি লেখেন -

এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল,এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার অনেক রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমি তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ,কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে-মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।
হাফিজকে আর জেনেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সদ্য কৈশোর পেরুনো কালেই এবং পরে অনুবাদ করেছেন হাফিজকে; নজরুল লিখছেন,

হাফিজকে আমরা কাব্যপিপাসুর দল কবি বলেই সম্মান করি, কবিরূপেই দেখি। তিনি হয়ত বা
সুফি-দরবেশও ছিলেন।…তবু তাঁর কবিতা শুধু কবিতাই। তাঁর দর্শন আর ওমর খাইয়ামের দর্শন
প্রায় এক। এঁরা সকলেই আনন্দ-বিলাসী। ভোগের আনন্দকেই এঁরা জীবনের চরম আনন্দ বলে স্বীকার করেছেন।…তবে, এও মিথ্যা নয় যে, মদিরাকে এঁরা জীবনে না হোক কাব্যে প্রেমের আনন্দের প্রতীকরূপেই গ্রহণ করেছিলেন। শারাব বলতে এঁরা বোঝেন- ঈশ্বরের, ভূমার প্রেম, যা মদিরার মতোই মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। সাকি অর্থাৎ যিনি সেই শারাব পান করান। যিনি
সেই ঐশ্বরিক প্রেমের দিশারী, দেয়াসিনী। পানশালা- সেই ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা-নিকেতন।

সুফি মতবাদের শেকড়ে রয়েছে যে প্রেম ধারণা, দেহজ প্রায়, তার আত্মভূত চিত্রটিই হচ্ছে মিলন- শরীরী এক যুগলের, প্রেমিক-প্রেমিকারই যেনবা। নজরুল তাঁর রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ বইটি উৎসর্গ করেন তাঁর অকালমৃত পুত্র বুলবুলের উদ্দেশ্যে, মর্মস্পর্শী ভাষায় তিনি পাঠ লেখেন,

বাবা বুলবুল! তোমার মৃত্যু-শিয়রে ব‘সে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ
আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি- আমার কাননের বুলবুলি- উড়ে গেছ!
আমরাও দেখতে পাবো, মৃত্যুর এমত সন্নিধানে হাফিজ কীভাবে হয়ে ওঠেন জীবনের পাঠদাতা এক কবি। নজরুলেরই অনুবাদে আমরা পড়ে উঠব -
পরান ভরে পিয়ো শারাব, জীবন যাহা চিরকালের।
মৃত্যু-জরা ভরা জগৎ, ফিরে কেহ আসবে না ফের।
ফুলের বাহার, গোলাব-কপোল, গেলাস-সাথী মস্ত ইয়ার,
এক লহমার খুশির তুফান, এই ত জীবন!- ভাবনা কিসের?

একদিন যখন হৃদযন্ত্রের বৈকল্য কারণে মৃত্যুর কার্নিশে আমি, অপেক্ষা করছি শল্য চিকিৎসার তারিখের জন্যে, অনিশ্চিত এমত কালে লন্ডনের এক তীব্রশীত সন্ধ্যায় হাফিজকে প্রথম আবিষ্কার করি এ. জে. আরবেরির ইংরেজি অনুবাদে, পুরোনো এক বইয়ের দোকানে, পাঠ করে উঠি রাতভোর অবধি, মৃত্যু সম্পর্কে আমার যাবত ভাবনা যায় মিলিয়ে, হয়ত রবীন্দ্রনাথেই এটি হতে পারতো, কিন্তু সমূহ সেই সন্ধ্যায় হাফিজই মুমূর্ষু আমার সমুখে মেলে ধরলেন জীবনের মানচিত্রটি। বিশেষ করে হাফিজের সেই গজল যেখানে তিনি নিরুদ্দিষ্ট ইউসুফের কথা বলছেন, আর ধ্রুবপদের মতো বারবার বলছেন- চোখের পানি ফেলো না ফের, আমার চোখ ভেসে যায় জীবনের আশ্বাস ফিরে  পাওয়া অশ্রুতে। পারিবারিক পরম্পরায় হযরত শাহ সৈয়দ আলী মাহমুদের আধ্যাত্মিকতা আমার রক্তে, সেই আমি  হাফিজের রচনায় আদমের পাপশূন্য স্বর্গের রূপ প্রত্যক্ষ করে উঠি; আবার, দ্বিতীয় পাঠে, মহাজন পদাবলী ধাবনে রক্তমাংসঋদ্ধ যে প্রেমের সাক্ষাত বাঙালি আমি পাই, সেটিও তাঁর কবিতায় আবিষ্কার করে উঠি- আতুর প্রেমিকের মতো বলে উঠি, অমরত্ব যদি আদৌ প্রাপনীয় তবে তা রাধারই আধারে।

ফারসি পেরিয়ে ইংরেজি ভাষ্য উজিয়ে বাংলায় হাফিজকে যে তারপর একদিন এনে উঠি, সেটি এমন প্রেরণা থেকে যে হাফিজের রচনা যেন বাংলা কবিতাই হয়ে ওঠে। অনুবাদের প্রথম শর্তই হচ্ছে, এক ভাষা থেকে অপর ভাষাতেও যেন সেটি কবিতাই হয়। তবে, কলম হাতে এই যে হাফিজকে নিয়েছি, অনুবাদ নয়, বরং রূপান্তর এবং আরো বিশেষ অর্থে বিম্বিত কবিতাই আমি রচনা করতে চেয়েছি। হাফিজের খ- কবিতার সংকলন দিওয়ান-ই-হাফিজ-এর মোট চারশ’ ছিয়াশিটি গজলের একাধিক ইংরেজি অনুবাদ আমি বছরের পর বছর পাঠ করেছি, দূরযাত্রায় সঙ্গে রেখেছি, প্রবাসের নিঃসঙ্গ কামরায় এর পাতা উলটেছি এবং মাঝে মাঝেই আমার ভাষায় হাফিজের উচ্চারণটি ধরে রাখবার খেলায় মেতেছি; এই নিমজ্জনের সম্প্রসারণেই এখন হাফিজের সাতান্নটি পদ এখানে বাংলায় উপস্থিত করা গেলো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর একাধিক গজল থেকে পঙক্তি নিয়ে নতুন একটি কবিতা দাঁড় করিয়েছি; কিন্তু গজলের প্রথাসিদ্ধ যে-রূপ ও অন্তমিল বিন্যাসের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তা অনুসরণ করিনি, বরং প্রতিটি রচনার মনোভঙ্গী বুঝে এর ছন্দ-মিল-স্তবকের শরীরী কাঠামো বাংলায় গড়বার চেষ্টা করেছি। আমার এই রচনা-স্বাধীনতা নিশ্চয়ই শিরাজ নগরের সেই বুলবুল কবির অনুমোদন পাবে, নয়তো যদি ভাগ্যে হয় তবে তাঁর সমাধিতে গিয়ে একদিন নতজানু হবো, হয়ত তখন তাঁর ‘হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেতে’ ফুটে উঠবে অমর এ কবির মার্জনা।

১লা নভেম্বর ২০১৩
সৈয়দ শামসুল হক
[তথ্যসুত্রঃ মাসিক উত্তরাধিকার]


কেনান থেকে আসবে ফিরে- কোরো না শোক ইউসুফের।
নিরুদ্দেশের মাত্র ক‘দিন! চোখের পানি ফেলো না ফের।
কেঁদো না আর। কাঁদবে কেন? দুঃখশোকের খরাতেই
গোলাপকুঁড়ি উঠবে ফুটে সুগন্ধ তার ছড়াতেই।
বুকে তোমার গোপন ব্যথা, বিষণ্ণতায় মলিন মুখ-
আবার হয়ে উঠবে আলো, আসবে ফিরে মিলন সুখ,
শান্ত হবে দগ্ধ হৃদয়।
চোখের পানি ফেলো না ফের।
চোখের পানি ফেলো না ফের- ফিরবে ফুলের ফাগুন মাস,
আবার তুমি দেখতে পাবে বিরান মাঠে সবুজ ঘাস।
তারায় ভরে যাবে আকাশ তোমার কালো রাত্রিতে।
পাতায় ঢাকা ছায়ায় তুমি বসবে ফের শান্তিতে।
কালের এই কক্ষপথ মূর্খ তুমি জানলে না!
ভালোবাসার সত্য তুমি তোমার বোধে আনলে না।
কাঁদছো তাই? কেঁদো না আর।
চোখের পানি ফেলো না ফের।
এ হৃদয়ের চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হবার পূর্বে তো
দিনের পরে আসবে দিন, কালের চাকা ঘুরবে তো।
একদিন তো হবেই হবে ভাগ্যতারা প্রসন্ন-
উঠবে হেসে আজকে যারা সন্তাপিত বিষণ্ণ।
তীর্থে যারা বেরিয়েছিল পৌঁছে যাবে তীর্থে ঠিক।
পারবে কি আর মন্দকাল ডুবিয়ে দিতে দিগি¦দিক?
মরুর বুকে ফুটবে ফুল!
চোখের পানি ফেলো না ফের।
নশ্বরতার মত্ত নদী ভাঙছে ঢেউ চারধারে-
জীবন নামে কুটির কাঁপে থরথরিয়ে তার পাড়ে।
ভয় পেয়ো না, মত্ত পাগল বন্যা যতই অন্তরে-
নূহ নবীর জাহাজ ঠিকই পৌঁছে যাবে বন্দরে।
যদিও পথ দীর্ঘ আর যাত্রা ভীষণ ভয়াকুল
তবুও আছে যাত্রা শেষে পথের শেষে সেই সে কুল-
যেখানে ভার নামাবে তুমি।
চোখের পানি ফেলো না ফের।
শত্রুদলের বিরুদ্ধতা তাড়িয়ে ফেরে রাত্রিদিন।
ভালোবাসাও নিরুদ্দেশে- হৃদয় বড়ো সঙ্গীহীন।
চোখের পানি দেখেন তিনি, রচনা যাঁর এ সংসার;
তাঁর কাছে তো অজানা নয়- চোখের পানি ফেলো না আর।
অন্ধকারে বন্দী তুমি, নিঃস্ব তুমি বোধ করো-
হাফিজ, তুমি এবার ওঠো, দীনের দেনা শোধ করো।
চিরকালীন বার্তা পড়ো!
চোখের পানি ফেলো না ফের ॥


যেদিন বন্ধু ছিল এই বুকে সেই দিনটিকে ভুলো না।
অতীতের কথা ভোলা নয় ভালো, কখনোই তুমি ভুলো না।
পান করেছিলে নশ্বরতার পেয়ালাটি নিজ হাতে,
ভরে উঠেছিল মুখগহ্বর লবণের তেতো স্বাদে।
কিন্তু যে তুমি কোনো একদিন মধু পান করেছিলে-
মনে রেখো সেটি, কী সুখে সেদিন গান গেয়ে উঠেছিলে।
সে কি ভোলা যায়, ভুলো না!
ভুলো না প্রাণের সেই প্রিয়দের, বিদায় নিয়েছে যারা-
যদিও ভোলাই ভালো হতো খুব। মিথ্যাভাষিণী তারা!
কবরের মাটি এখন তাদের আভরণ হয়ে আছে-
হৃদয়ের চারু অনুভূতিগুলো অবশেষে ধূলি মাঝে।
মন থেকে যদি তোমাকে এখন বিদায় করেছে তারা,
তবু বেদনায় এখনো যে তুমি হওনি আত্মহারা-
সে কি ভোলা যায়, ভুলো না!

ক্লান্ত যদিও!- এখনো তো আমি ফিরে চাই বন্ধন,
একদা যাদের প্রেমেই হৃদয় পেয়েছে উত্তরণ।
একদা তারাই ছিঁড়েছে আমার বন্দীদশার শৃঙ্খল,
এখন যদিও ঝরছে আমার উষ্ণ অশ্রুজল-
এখনো তো আমি দুই চোখে সেই উদ্যান রেখে চলি।
গোলাপ যেখানে- সেখানেই যেতে হাঁটা এ অন্ধ গলি।
সে কি ভোলা যায়, ভুলো না!

আমার হৃদয়ে দুঃখের ঘরে আজ দেখো বসবাস-
সেখানে সবাই নিশ্চুপ পড়ে, পড়ে না দীর্ঘশ্বাস।
ভুলো না তাদের একদিন যারা ভুলে গিয়েছিল আমাকে-
হাফিজ, তাদের সব ইতিকথা বিস্মৃত বৈরাগে।
বিষণ্ণতার  দুয়ারে তাহলে এঁটে রাখো দেখি অর্গল-
তারপরও দেখো অমৃতের ধারা ঝরছে অনর্গল।
সে কি ভোলা যায়, ভুলো না!


মৃগনাভির গন্ধে মাতাল ভোরের হাওয়া ছুটবে।
বুড়োর হাড়ে লাগলে হাওয়া- যুবক হয়ে উঠবে!
বইবে ফের ফাল্গুনের সোরাহিতে সুরার ঢল,
গাছের ডালে ফুটবে ফের মন ভোলানো ফুলের দল।
খুলবে তারা পাঁপড়ি তো নয়- সরাইখানার দরজাটাই!
থাকবে কেন ঘরের কোণে? ডাকছে শোনো, চলো না যাই।
নেশার টানে আবার কত ইয়ার এসে জুটবে!
অনেকদিনের দুঃখশোকের চাবুক দেখো থামবে।
বিচ্ছেদের পরেই আসে মিলন- এটি জানবে।
সেই যে পাখি হাহাকারের, কণ্ঠে ফিরে পাবেই গান।
গোলাপফুলের লাল তাঁবুতে আসবে ফিরে মেহমান।
মসজিদে কি কাল কাটাবে? সরাই ডাকে দুর্নিবার।
মোল্লা বসে ওয়াজ করুন! শুনবে তুমি কতই আর!
আয়ু যতই দীর্ঘ হোক, হ্রস্ব বলেই জানবে!
মূর্খ রে মন! বর্তমানের মজায় যদি না মাতিস,
আসছে কাল আগামীতে হবি কি আর খুশ্নবিশ!
এখন যেটি সেটাই সেটি- এর চেয়ে কী সত্য আর?
শাবান মাসে নামিয়ে রাখ্ পুরোনো সব শোকের ভার।
আবার হাতে নে ‘পেয়ালা, পান করে হ’ টালমাটাল-
ফজর থেকে মাগরিবের হিসেবটা হোক বে-সামাল।
উঠলে চাঁদ রমজানের তখন না হয় রোজা রাখিস!
ওই যে দেখি গোলাপবনে ফুটছে ফুল রক্তলাল-
লজ্জাবতী পাঁপড়ি খোলে, সংকোচে কি কাটবে কাল?
বনের পথে পায়ের ভীরু শব্দ শুনি সেই যে তার-
বসন্তকাল কেটে গেলেই থাকবে না সে এখানে আর।
চারণ-কবি নীরব কেন? গান ধরো হে স্বাগতমে-
মন মাতানো সুরের দোলা, খুশি হবে না তার কমে।
যা হয় হবে আজকে হবে, পরের কথা আগামীকাল!
হাফিজ, শোনো সংগীতের সুরলহরী উদ্যানে।
অন্ধকারে কী লাভ থেকে? আলোয় এসো এইখানে।
যদিও পথ বারেবারেই অন্ধকারে ঘুরে যায়-
তবুও যেন তোমার বাণী সপ্তস্বরের স্পর্শ পায় ॥


চলে গেছে প্রাণবন্ধু পলকে, ফেলে গেছে তার ছাপ,
রেখে গেছে চোখে অশ্রু আমার এবং মনস্তাপ।
বুকে পড়ে ছিল- হঠাৎ উধাও আমাকে একাকী করে-
যেন প্রদীপের শিখাটি মিলাল বিষম ঝড়ের তোড়ে।
একদিন আমি রেখেছি যে-ঠোঁট পেয়ালায় অনুরাগে,
সেই পেয়ালায় জহর ছিল যে বুঝিনি তো আমি আগে।
বিচ্ছেদ ছিল ললাট লিখন-
বহি এই অভিশাপ!
সে ছিল শিকারী আর আমি তার অসহায় এক লক্ষ্য।
তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, বিদীর্ণ এই বক্ষ।
পড়ে আছি আজ রক্তসাগরে। সে কোথায়, কোনখানে?
যেন রাত শেষে বণিক ঘোড়ায়- গন্তব্যের পানে।
ঘোড়াটিকে আমি বন্ধনে পেতে যতœ করেছি কত-
লাগাম ছিঁড়ে সে ছুটে যায়, আমি এমনই ভাগ্যাহত।
হঠাৎ আকাশে ঢেকে দেয় মেঘ
চাঁদের শুক্লপক্ষ!
এ হৃদয় নয় এত বড়ো সয় এতটা বেদনাভার।
অশ্রু তো নয়, রক্তই ঝরে চোখে আজ অনিবার।
চেয়ে দ্যাখো এই মরুভূমে ক্ষীণ একটি নহর ওই-
রক্তই তার প্রবাহে এখন- নির্মল পানি কই?
মূর্খ সে বটে, জানে না প্রেমের উচ্চারণে কী ফোটে-
‘তোমাতেই প্রাণ’- তবুও বিদায় ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে।
এই ছিল এই নেই যে আবার-
এই তো সারাৎসার!

ভোর হয়ে আসে, আকাশে ফজর ফুটে উঠবার আগে
গোলাপ বাগানে যখন কুঁড়ির ফুটবার সাড়া জাগে
তখন হাফিজ তোমার বাগানে
উড়ে আসে বুলবুল-
বসে না সে ডালে, বলে যায় শুধু-
ভালোবাসাটাই ভুল ॥


ঝরেছে অনেক রক্ত যদিও বুলবুল তবু তার
বলার কথাটি বলতেই আজ প্রান্তর হলো পার।
বৃক্ষের ডালে বসল সে পাখি, বলল- শোনো গোলাপ,
মন থেকে তুমি আজ একেবারে মুছে ফ্যালো সব পাপ।
মানুষের মনে নন্দিত তুমি বর্ণে ও সৌরভে,
তুমি ফুটলেই হতাশের মনে আশা ফেরে, বলি তবে,
কেন কাঁটা ধরো? রক্ত ঝরাও?
থামো দেখি এইবার!

আমিও আমার নির্বাসনের শোক করবো না আর।
সেই মুখখানি মনে পড়ে যায়, দেখি যদি একবার
ভুলে যাই সব, আলোর মিছিলে যেন আমি ভেসে যাই-
যেন সে রক্তগোলাপের লাল ধমনীতে মেশে নাই।
নামাজীরা জানে বেহেশতে হুরী- মনে আশা খুব, শোবে!
আমার স্বর্গ পানশালাতেই- কখন সূর্য ডোবে!
কখন সময় হবে পেয়ালার!
হুরী তার পাশে কোন ছার!

অশ্রুর চেয়ে পেয়ালায় সুরা বহানো অনেক ভালো।
মিছে কোলাহল! করো সংগীত! যত পারো সুরা ঢালো!
সরে থাকে যারা- মরে থাকে তারা, তুমি নিশ্চয় জানো।
করুণাময়ের কৃপাতেই তুমি বুকে আজও শ্বাস টানো।
অনেকের কাছে বেঁচে থাকা মানে যত পারো লুটে নাও!
আমার বাজারে এসে দেখে নিয়ো রক্তের কত ভাও!
ভালোবেসে আমি রক্ত বহাই-
কান্নাও কত ভালো!

হাফিজ, কেন যে অবিরাম তুমি দুঃখেরই গান করো!
কেন যে হৃদয়ে এতখানি প্রেম ছোট্ট হৃদয়ে ধরো!
হয়ত তোমার কাছেই সত্য-
দুঃখের পথে পাওয়া,
তাই মিলনের আশায় বিরহ
আজীবন সহে যাওয়া ॥


আরো একবার হৃদয় আমার
ভেঙে গেছে বিচ্ছেদে,
যাবার যে গেছে, পড়ে আছি আমি
দ্যাখো তার নির্বেদে।
জানতো কী জাদু! করেছে কী দশা!
এমনই সে কৌশলী।
সাধুকেও ধরে নিয়ে গেছে তার
সরাইখানার গলি!

হৃদয়হীনের শোকে অশ্রুর
বর্ণ গোধূলি লাল-
আর কারো নয় বিশ্বে আমারই
শুধু এ পোড়া কপাল।
কোনো ভোরবেলা লায়লির আলো
চিরে দিয়েছিল রাত-
আলো নয় যেন মজনুর বুকে
ছিল তা বজ্রাঘাত।

ঢালো সুরা ঢালো পেয়ালায় সাকী,
মাতাল না হলে পারি-
দেখে নিতে তার চেহারা তো নয়
খাপ খোলা তরবারি!
হাফিজ, তুমি তো অনেক দেখেছ-
আরো কী দেখতে বাকি?
এই হৃদয়ের সবটাই ফাঁকা
আর সবটাই ফাঁকি ॥


কাজল চোখের জন্যে এই প্রেম থেকে মুক্তি নেই।
ভালো করে জেনে গেছি এতদিনে ভাগ্যলেখা এই।

বিরুদ্ধবাদীর স্বরে কানে তালা লেগে গেছে আজ-
ফজরে মিনারে আর পৌঁছুবে না আমার আওয়াজ।

হাশরের মাঠে আমি দাঁড়াবার আগেই কী পাপী-
কী তবে জীবন আর কী তবে সাধন- তাই ভাবি!

খোদার দোহাই লাগে, ক্ষমা করো তুমি বিচারক।
ওস্তাদের বিপরীতে আমি এক আনাড়ি বাদক।

সাকী যে পেয়ালা আনে, শান্তি সেই লাল মদিরায়।
এতেই যা কিছু আজ, যদি এতে সব ডুবে যায়।

কেবল একটি সাধ, ভালো যেন বেসে যেতে পারি-
কিছুতে না ভুলি যেন তার প্রেম, আলিঙ্গন তারই।

হাফিজ, প্রার্থনা করো, সব ভুলে যাবার পরেও-
স্মরণে থাকুক চোট আর পানি এ দুটি চোখেও ॥


গতকাল রাতে হাফিজ হঠাৎ মাতালের আড্ডায়,
নির্জনবাসে ছিল কতকাল সঙ্গীবিহীন একা।
ছিল সেই প্রেম আর সেই তার প্রেমিকের ভাবনায়,
সরাইখানায় যদি আজ আসে, যদি পাওয়া যায় দেখা!

স্বপ্নে হঠাৎ এসেছিল তার যৌবন ম্মৃতি ফিরে,
এখন মাথায় পাকা চুল আর ভাষা পলাতক ঠোঁটে।
এখনো তো এই অমাবস্যার ঘন রাতটিকে চিরে
জ্বলে বিদ্যুৎ, এখনো হৃদয় উন্মাদ হয়ে ওঠে।

মাত্রই গতকালের কথা সে ভেঙে ফেলে পানপাত্র,
আর সেই সাথে সুরার সোরাহি হয় তার হাতে চূর্ণ।
কা-টা দ্যাখো, গলায় সুরার এক ফোঁটা যাওয়া মাত্র,
পুরাতন প্রেমে হৃদয়টি তার কীভাবে হঠাৎ পূর্ণ।

আরো দ্যাখো এই গোলাপের বনে বুলবুল ডেকে উঠলো।
তুমি কে এখানে? এই উদ্যানে তুমি তো আগন্তুক।
এই যে আবার মোমবাতি ঘিরে প্রজাপতি এসে জুটল-
তুমিও পুড়বে। তবে বুঝি এই পোড়াতেই যত সুখ।

কান্না থামেনি তোমার, হাফিজ, বৃষ্টির মতো ঝরছে।
বৃষ্টির ফোঁটা ঝিনুকের বুকে পড়লেই হয় মুক্তো।
কাউকে এমন পাবে যে তোমার জন্যে মাতম করছে?
এই বন্ধন দশা থেকে তুমি কবে আর হবে মুক্ত?

হাফিজ, তাহলে নতজানু হও, নত হও প্রণিপাতে-
তবে যদি পাও বিরাম তোমার, আরাম শেষের শয্যায়।
তবে যদি আসে বিরতি তোমার এমন অশ্রুপাতে,
তবে যদি ফের ফিরে পাও তাকে আবার তোমার কবজায় ॥


হাওয়া কী মধুর, আর আকাশটা নীল যতদূর-
এসেছে বসন্ত ফিরে, কিন্তু আমি পকেটে ফতুর।
মেলায় গাওনা হচ্ছে, অধোমুখ রয়েছি লজ্জায়-
খালি হাতে গীতবাদ্য গরীবের বুঝি শোভা পায়!

নিজেকে তো বেচবো না, জগতেও দয়াশীল নাই;
ছেঁড়া এ জামাটি রেখে দেখি যদি পেয়ালাটি পাই।
চলো তবে খোলা ওই দরজাটি সরাইখানার।
আছে সুরা, আছে সাকি আর আছে আঙুর আনার।

হাফিজ, হয়ত আজো দয়াশীল আছে কেউ দেশে-
তোমার অশ্রুর নুনে যদি তার মধুটুকু মেশে ॥

১০
ওরে তুই পাখি পুবালি হাওয়ার মেলে দে এবার ডানা-
তোকেই পাঠাবো যেখানে আমার ভালোবাসবার ঠিকানা।
পায় কি রে শোভা পড়ে থাকা তোর বেদনার বাসাটিতে?
তোকে মর্মের বিতানে তাই তো চাইছি পাঠিয়ে দিতে।

উড়ি যাবি তুই, দূর নয় দূর, কাছেও নিকটে নয়!
উড্ডীন তোকে করছি আমি যে- পৌঁছে দিতে এ হৃদয়।
হৃদয়ের ভাষা! সকাল সন্ধ্যা জপে সেই এক নাম-
তারই উদ্দেশে হাওয়ায় হাওয়ায় তোকে আমি পাঠালাম।

খাজনা যে তার হৃদয় আমার!- বহুদিন বাকি পড়ে!-
নিয়ে যা রে পাখি উড়ে যা রে তুই পুবালি হাওয়ার ভোরে।
সুরা দাও, সাকি, গতকাল রাতে বলেছে সে সমাচার-
‘বেদনা যে সহে, পাঠাবোই তাকে নিরাময় আমি তার।’

দেখার ওপারে থাকো তবু জানি তুমি কী বাস্তব!
তাই প্রার্থনা তোমার জন্যে, করি তোমারই তো স্তব।
তুমি সুন্দর, বিধাতার তুমি নিজ হাতে নির্মিত।
পাঠিয়ে দিচ্ছি দর্পণ-মন- যদি হও বিম্বিত!

আমার এ প্রেম নিয়ে যদি গান চারণ কবিরা গায়-
পাখিটিকে তাই বলছি যেন সে সুরগুলো নিয়ে যায়।
হাফিজ, তুমি তো অন্তর থেকে উড়িয়ে দিয়েছো পাখি-
এবার শুনুক দুনিয়া সে গান, সুরাও ঢালুক সাকি ॥

১১
শরাবের এত গুণ- এতটাই করেছে মাতাল!
কেমন এ কা- বলো?- সব কিছু কী টালমাটাল।
ঢালে কে শরাব আর বলো দেখি এ কোন্ আস্তানা?
গান যে গাইছে কবি, তার মধ্যে তোমাকেই টানা!

তুমিও কি দিয়েছো চুমুক, তুমি হয়ে গেছো চুর?
গানের প্রতিটি কথা তোমারও কি লাগছে মধুর?
গোলাপ ফুটেছে দ্যাখো, মধুময় আজ মউচাক।
বাগান কী অপরূপ! যে পারে সে এসে দেখে যাক।

দেখে যাক এখানেই সেই রাণী বিলকিসের রূপ-
যার জন্যে আজও পোড়ে সোলেমান বাদশার ধূপ।
হৃদয়, গোলাপ হও, ফুটে ওঠো রক্তলাল হয়ে।
এই তো সময়- তুমি কেন বসে?- কাল যায় বয়ে!

সাকি যে শরাব নিয়ে ফিরে এলো ওই যে আবার-
এখনো কিছুটা কাজ বাকি আছে এ অমৃত সুধার!
হাফিজ, তুমিই জানো- ভালো জানো প্রেমের ধরন-
শরাবে জীবন ফেরে- আর সেই শরাবে মরণ!

১২
বললাম- তুমিই আমার কষ্ট! বলল সে, কষ্ট শেষ হবে।
বললাম, ওঠো তুমি চাঁদ! বলল সে, রাত হলে- তবে!

বললাম, ভালো যারা বাসে তারা হৃদয়ের সততাকে বোঝে।
বলল সে, চাঁদের বুকেই তবু মানুষেরা কলংকটি খোঁজে!

বললাম, তবু আমি চাঁদটিকে হৃদয়ের অন্ধকারে চাই।
বলল সে, পারি যদি চোরের নিঃশব্দ পায়ে তবে এসে যাই।

বললাম, তোমার চুলের গন্ধে সব পথ আজ একাকার।
বলল সে, এ কেমন কথা আমি পথেরই তো নিশানা তোমার।

বললাম, তোমার রতেœর জ্যোতি, ওতেই তো অন্ধ এই চোখ।
বলল সে, প্রেমের চাওয়া তো এই- প্রেমিকেরা ক্রীতদাস হোক।

বললাম, তাহলে কি মুক্তি নেই আমার এ বন্ধন দশার?
বলল সে, যখন সময় হবে! ধৈর্য ধরো! মিনতি আমার।

বললাম, পলে পলে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কবে আর তবে?
বলল সে, হাফিজ, নীরব থাকো! দুঃখ আর চিরস্থায়ী কবে?

১৩
কেউ কি বলেনি?- ওহে, ভালোমন্দ জানতে চেয়ো না,
অচেনা থেকেই যাও, কারো গল্প শুনতে যেয়ো না।
যদিও তোমার মন এতই কোমল আর এতটাই কাঁদে,
তবু তুমি কারো জন্যে কখনোই কাতর হয়ো না।

কেন যে বেদনা এত, প্রদীপের কাছে তুমি জিজ্ঞাসাটি রেখো-
ভোরের হাওয়ার কাছে জবাবটা জানতে যেয়ো না।
প্রেমের নিদান লেখা নেই কোনো চিকিৎসা শাস্ত্রেই-
অতএব কী ওষুধ কখনোই জানতে চেয়ো না।

মহাবীর সিকান্দার- তার যুদ্ধ ইতিহাস আমরা পড়িনি-
হৃদয়েরই যুদ্ধ যদি অন্য কিছু জানতে চেয়ো না।
হাফিজ, এসেছে দ্যাখো গোলাপের দিন, তাই বলি-
সুবাসে মাতাল হও, পূর্বাপর মোটেই ভেবো না ॥

১৪
সে চুরি করেছে মন, মুখ তার লুকিয়ে রেখেছে।
তাহলে এ খেলা হবে কার সাথে? দোহাই বলো না!
ভোর হয়, হৃদয়ের রক্ত ঝরে বিজন বেলায়।
অথচ সে করুণারই বলে আমি করেছি কল্পনা।

সে যদি নিয়েছে তার অপরূপ মুখখানি ফিরে-
গোলাপের মতো কেন রক্তলাল হয়ে উঠবো না?
আমাকে মোমের মতো পুড়িয়েছে তার প্রেম- তাই
পেয়ালাও কেঁদে ওঠে, সংগীতেও শোকের মূর্চ্ছনা।

ভোরের হাওয়া কি মিঠে, ওগো হাওয়া তোমাকে মিনতি-
জুড়াও এ অঙ্গ তুমি, এনে দাও সন্তাপে সান্ত¦না।
শত্রুর অধিক তার আচরণ দেখেছো, হাফিজ,
কেবল ভ্রকুটি মাত্র- বিদ্ধতীরে দুঃসহ যাতনা ॥

১৫
রাতের ইয়ার দোস্ত তুমি একটু মনে কোরো,
ভুলে যেয়ো না সরাইখানায় রাত-
মাতাল তুমি তবুও মনে পড়েছিল যে তাকে-
কেননা গান গাইছিল স্যাঙাত।

এমনটাই তো হবার কথা যখন পেয়ালায়
ঢালছে শরাব সাকি গোলাপ গাল!
দেখেই তাকে মনে পড়ে যায় আছে সে একজন-
যার জন্যে গোলাপ এত লাল।

তোমার হাত যখন খোঁজে ক্ষীণ সে কটি তার-
মনে তোমার জড়িয়ে ধরার সাধ-
তখন ওঠে মাতাল হাওয়া    স্মৃতির কন্দরে,
একদিন তো হয়নি বরবাদ।

এক পলকের দুঃখ ওসব,   মুহূর্তেরই শোক!
ভালোবাসায় অমন হয়ে থাকে।
আর এটিও জানবে তুমি    এই যে মহাকাল-
নিত্য ঘোরে চোরাপথের বাঁকে।

এমন মনে হচ্ছে যদি যাত্রাপথে তুমি
পথ হারালে অন্ধকার রাতে-
স্মরণ কোরো এমন সওয়ার অনেক ছিল যারা
আটকে গেছে ঘোড়ার চাবুকটাতে।

দিচ্ছি দোহাই তোমরা যারা অসীম করুণায়
পৌঁছে গেছো জ্যোতির্ময়ের মাঠ,
একবারটি তাকিয়ে দেখো    এই হাফিজের মুখ-
এবং সরাইখানার চৌকাঠ ॥


১৬
তার কারণেই চোখের পানি, মুছিয়ে ফের সে-ই দেবে-
জীবন যদি সে নিয়েছে, জীবন ফিরে সে-ই দেবে।
বলছে যারা যা পেয়েছ- এর থেকেও তো ভালো আছে,
আমার ভালোবাসায় কিন্তু এ-ও আছে আর ও-ও আছে।

শুনলে মনে হতেই পারে এ সব কথা রহস্যের।
একবারটি বলার পরে বলব আমি দ্যাখো না ফের!
নিয়েছে যদি শূন্য করে, হাত ভরিয়ে সে-ই দেবে।

ইহকাল আর পরকালের ভরসা তো সেই একজনাই।
খুলেই বলি ঢেকেই বলি- বলার কিন্তু বিরাম নাই।
এ দুনিয়ার ধরনটিকে ভরসা করাই বাতুলতা-
তাকে পেলেই সবটা পাওয়া- কে চায় তবে অমরতা!

পেয়ালা দাও পূর্ণ করে, মিনতি রাখো ও সাকি।
মাতাল হলে প্রাণে আমার কি আর কারো ভয় রাখি!
হাফিজ, তুমি ভালোবাসার, ভালোবাসাটি সে-ই দেবে ॥

১৭
সরাইখানায় টানছি মাল, মাতাল আমি টালমাটাল-
ভালোবাসার সাত কা-!- তবুও কী যে পোড়া কপাল!
ওই যে তার ভুরুর টান, ওতেই ফোটে তিরষ্কার
এক্কেবারে শুরুর থেকে- রক্ত ঝরে বুকে আমার।
গোলাপ তুমি ফুটলে ভোরে,
তুমিও দেখি রক্তলাল!

আচ্ছা খুব! শরাবে, সাকি, ভেজাল তুমি দিও না হে।
মাতাল যদি, আরো মাতাল হতে আমার প্রাণ চাহে।
শরাব যদি রঙিন লাল, তাকিয়ে দেখো এ হৃদয়-
সেটাও তারই রক্তলাল সিলমোহরের ছাপটা বয়।
হাফিজ, তুমি নীরব থেকো,
আজকে এবং চিরটা কাল ॥

১৮
এই দরজায় আমরা আসিনি খেতাব খেলাত আশাতে।
আশ্রয় পেতে এসেছি আমরা সময়ের ঝঞ্ঝাতে!

আমরা যাত্রী ভালোবাসবার সীমান্ত সব পেরিয়ে-
এই জীবনের একটি সড়কও আমরা যাইনি এড়িয়ে।

তোমার বাগানে আমরা দেখেছি ফোটে কত ফুল ভোরে-
আমরা এমন- হৃদয়কে রাখি সূর্যমুখীটি করে।

কই তুমি কই! আলো দাও আলো! দয়া করো একবার।
নুন দরিয়ায় ডুবে আছি দ্যাখো, করো তুমি উদ্ধার।

হাফিজ, তোমার দরবেশি ওই আলখাল্লাটি ছাড়ো।
ঢুকে পড়ো দেখি সরাইখানায়, পেয়ালাও আছে তোমারও ॥

১৯
কোথায় পালিয়ে গেলে? কই তুমি? বনের হরিণ!
তোমাকে নিবিড় করে জানতাম আমি একদিন।
ছিলাম তোমার বন্ধু, ছিলে তুমি প্রাণের অধিক।
আজ দ্যাখো দুজনেই পথহারা নিঃসঙ্গ পথিক।

এখন যে যার মতো হেঁটে যাচ্ছি- বড়ো দুঃসময়!
প্রতিটি পথের বাঁকে হামা দিয়ে আছে আজ ভয়।
হাফিজ, তোমাকে ডাকে- দেখা দাও, কাছে  এসো তুমি,
একা তো পারি না আর! চলো খুঁজি শ্যামশষ্প ভূমি-

যেখানে বিচ্ছেদ নেই, পুষ্প চাষ যেইখানে হয়-
হোক তা রক্তের রঙে, তবুও তো গোলাপ নিশ্চয় ॥

২০
অপার সাগরের মতো এ ভালোবাসা-
এখানে নেই কুল কিনারা।
বিলিয়ে দেয়া যায় যদি এ নিজেকেই,
তবেই আশা আছে হয়ত।
তুমি যে এসে গেলে এতটা পথ হেঁটে,
অনেক যদি থাকে গল্প-
সে সব পড়ে থাক, শরাব এনো তুমি,
শাস্ত্র কথা আর নয়ত।

বৈদ্য বহু আছে, তাদের কাছে তুমি
বলো না অসুখের বিবরণ।
বরং হৃদয়ের মোহর দিয়ে তুমি
সওদা করে নাও, সুফি!
দিও না দোষ তুমি মন্দ কপালের,
দরজা থাকে যদি বন্ধ।
স্বচ্ছ আয়নায় মুখটি দেখে নাও,
মাথায় পরে নাও টুপি।

পেয়ালা হাতে সাকি! সরাইখানা ডাকে!
মাতাল হও তুমি শরাবে।
কোদাল হাতে নিয়ে যেমন লুব্ধেরা
গুপ্তধন করে সন্ধান-
তুমিও তাই করো! তাকিয়ে দেখো তুমি
চোখের পানি পড়ে হাফিজের।
হৃদয় গলবে না? মিনতি রাখবে না?
কঠিন করে আর রেখো না প্রাণ ॥

২১
তুলেছি যেই পেয়ালা ঠোঁটে বিশুদ্ধ এই শরাবটির-
অমনি শুরু হলো আবার বুলবুলি ওই পাখিটির।
গাইছে গান বুলবুলিটি, বলতে কী চায় ভাবছো কি?
ব্যাখ্যা পেতে পণ্ডিতদের     কাছেই তুমি যাচ্ছো কি?
তাদের কাছে খবর নেই!     জানতে যদি ইচ্ছাটি-
পাখির কাছেই জানতে পাবে গানের তার ব্যাখ্যাটি।
শরাব! তুমি হারামখোর!     ফতোয়া দেন মৌলভি!
হাফিজ, তুমি টসকাবে না! শুনবে না ওই বাৎ কভি!
ওরা তো সেই ধুর্ত জোলা, সুতোয় বোনে জায়নামাজ-
কিন্তু বলেসোনায় বোনা!-    একেই বলে ধোঁকাবাজ!
হাফিজ, এসো, পেয়ালা নাও, মাতাল হও শীগগির।
শরাব সে তো পান করারই- কক্ষনো নয় বিক্রির!

২২
রূপবতী, যদি তুমি দাঁড়াও সমুখে,
গলায় জড়িয়ে যদি দাও ওই হাত,
তোমার গোলাপী গাল, ভালোবাসা বুকে,
এ কবি তখনই বাঁচে, বলে বাজি মাৎ-
তুচ্ছ ওই বোখারার সোনার ভান্ডার!
সমরখন্দের মণি? চাই না আমার!

তরল চুনির মতো সুরা ঢালো, সাকি!
নিরাশ হৃদয় ধরে রেখো না হে আর!
গোঁড়া ওই মোল্লাদের কথায় কী থাকি!
এমন নহর আর এই বাগিচার
মতো আর পাবে না হে রওশনাবাদে!
সে যদি সমুখে তবে পাত্র নাও হাতে।

যখন এমন কেউ এসে যায় কাছে-
যখন চোখের তীরে বিদ্ধ করে তারা,
যখন উন্মুখ মন ভালোবাসা যাচে,
মুহূর্তেই আমি হয়ে যাই সর্বহারা!
তাতার দস্যুর হাতে যেমন পথিক-
দ্যাখো আমি সর্বস্বান্ত তারও যে অধিক!

এই যে হৃদয় পোড়ে প্রেমের আগুনে-
চোখের এই যে অশ্রু- সাধ্য আছে তার
শর্করার স্বাদ আনে জীবনের নুনে?
ওই যে গোলাপী গাল, লাল আভা তার
পারে কি রাঙিয়ে দিতে দুনিয়ার ছবি?
তাহলে কিসের কাব্য? কোন্ ছার কবি!

কপালে যা আছে হবে! তুমি গান গাও,
বাগানে যে ফোটে ফুল তার কথা বলো,
শরাবের কথা যেন একটু না থামাও-
যতই তোমার চোখ হোক ছলোছলো।
যদিও এ সবই স্বপ্ন, মেঘে ঢাকা চাঁদ-
আশা না রাখলে হবে সবই বরবাদ!

রূপের এমনই জাদু, সেই ইউসুফ-
কী হলো দশাটি তার জুলেখাকে দেখে!
মুহূর্তেই মেশে তার রূপ ও অরূপ-
তৃষ্ণা জাগে- ইতিহাস এ কথাই লেখে।
এমন দেখিনি আর, শুনবো না আর-
অরূপ সন্ধানে রূপ! এমনই আমার!

রূপবতী তুমি অতি, আমার মিনতি,
আমাকেও দয়া করো, আমি প্রার্থনায়-
একবার যদি পাই তোমার সম্মতি
তবেই উঠবে চাঁদ এ অমাবস্যায়।
শরাব ঢালছে সাকি পেয়ালায় ওই-
এসো মাতি, এ সুধায় মাতাল তো হই!

কঠিন জবাব দিলে! তুমি কী নির্দয়!
এতটা বিরাগ! আমি তবু তোমাকেই
দিয়েছি সর্বস্বসহ দুর্বহ হৃদয়।
তুমি ছাড়া প্রার্থনার আর কিছু নেই।
যে ঠোঁটে এতটা মধু, তাতে কেন নুন?
এত যে শীতল চাঁদ- জ্যোৎস্নায় আগুন!

হাফিজ, কাতর তুমি রূপের সাক্ষাতে-
না হয় বিরূপ! আর তুমি কী উৎসুক!
মণি ও মুক্তার মতো শব্দরাজি হাতে
যদি পারো গাও গীত, ভাষা তো ফুটুক!
অন্তত তোমার কাব্য সে ভালোবেসেছে-
জেনে রেখো- যথালাভ! ওঠো তাই নেচে!

২৩
এই তো হয়েছে ভোর, আলোর নহর
ভাসিয়ে তুলছে আজ শিরাজ নগর।
পাখিরা গাইছে গান প্রণয় বিধুর-
বাগানে ফুলের কানে পশে তার সুর।

ওদের মতোই আমি বুকে ব্যথা নিয়ে
হেঁটে যাচ্ছি বাগানের দিকে পথ নিয়ে।
তাপিত হৃদয় নিয়ে এই হেঁটে যাওয়া।
যদিবা শীতল করে ভোরের এ হাওয়া।

গোলাপ রয়েছে ফুটে ওই থরে থরে-
ভোরের প্রথম আলো বুকে তারা ধরে।
করুণ একটি তারা ভোরবেলাকার-
এখনো রয়েছে ছুঁয়ে আকাশের পাড়।

পাখি ওই বুলবুল গ্রীবা তুলে ধরে।
ফোটে গান হৃদয়ের- শুনি তার স্বরে।
আমার মতোই তারও বিরাম তো নাই-
বাগানে যে গায় গান বুকে প্রেম তাই।

ফুলের পাঁপড়ি খোলে, অশ্রু তার চোখে-
জানি না শিশির নাকি হৃদয়ের শোকে।
তাকিয়ে দেখে সে ওই গোলাপের দিকে-
ক্ষত বলে মনে হয় লাল রঙটিকে।

পদ্ম যে উঠেছে ফুটে- দল যেন তার
তুলে ধরে আছে ভয়াবহ তিরষ্কার।
ওদিকে অনামা ফুল যত আছে সব
যেন ফুল নয় তারা আসলে গুজব।

কিছু ফুল ফুটে আছে, করছে দেয়ালা-
মাতালের হাতে যেন পানের পেয়ালা।
শিশির শরাব হয়ে ঝরেছিল রাতে-
আরো বুঝি বাকি আছে! ঢালো পেয়ালাতে!

সাকির মতোই কিছু ফুল দেখা যায়-
যেন হাতে সোরাহিটি সরাইখানায়!
কাৎ করে ঢেলে যাচ্ছে তাদের জন্যেই-
যাদের হৃদয় পোড়ে প্রেম আগুনেই।

হাফিজ, বাগানে যদি, শিক্ষা নাও তবে-
ফুলের কাছেই আজ পাঠ নিতে হবে।
সময় ফুরিয়ে যায়, যা কিছু এখনি!
এসেছোই যদি- নাও তোমার পত্তনি ॥

২৪
গতকাল শুনি আলোআঁধারির সরাইখানার হাঁক-
পাপ হলে হবে!   পান করো তুমি! পেয়ালাটি হাতে থাক!

এই তো সমূহ শুভ সংবাদ! ওঠো দেখি একবার!
জানবে তোমার    পথের শেষেই নদী বহে করুণার!

এ জীবনে পাপ!    কত কী যে পাপ! তালিকাটি সীমাহীন!
তার চেয়ে দেখো অসীম ক্ষমার আসনে তিনি আসীন।

অতএব চলো সরাইখানায়, ঝেড়ে ফেলো সব দ্বিধা।
দেখবে সেখানে    শরাব রঙিন বালিকারা সুস্মিতা।

হাফিজ, তাহলে   কাজ নেই গুনে কতটা করেছো পাপ।
সরাইখানায় পেয়ালাটি নাও- গোস্তাকি করো মাফ ॥

২৫
এই পেয়ালা নিলাম হাতে-
সব রেখে দিলাম তফাতে।
মন যদি শরাবে রঙিণ-
পূর্বাপর মুহূর্তে বিলীন।
ওই মাছ নদীর পানির-
অপেক্ষায় আছে বড়শির।
অতএব হাফিজ এখন-
শরাবেই খোঁজে নিমজ্জন ॥

২৬
দেবদারু দেখো তার মাথাটি আকাশে।
যাত্রীদের বিদায়ের মুহূর্তটি আসে।
একবার বোসো দেখি গাছের ছায়ায়-
পেতে রাখো চোখ দুটি তার অপেক্ষায়।
এই যে বসন্ত আর ফুল থরে থরে-
এই যে নহর বয় কুলকুল করে-
বুঝি কেঁদে যায় তার বিদায় স্মরণে,
তাই বুঝি এত ফুল ফুটেছে এ বনে।
ভুলি নাই ভুলি নাই ভালোবাসি যাকে-
আমার ক্রন্দন নাও- বলি কবিতাকে।
আমার চোখের পানি শ্রাবণ ধারায়-
নহরে নহরে দীর্ঘশ্বাস মিশে যায়।
নতুন নহর যাবে এ নহর থেকে-
হাফিজ, এ থেকে যদি কিছুমাত্র শেখে!

২৭
কারো হাতে তুমি শরাবের ওই পেয়ালাটি তুলে দেবে না।
এই যে গোলাপ, ডাঁটা থেকে তার হাতটিও তুলে নেবে না।
হাফিজ, এ বড়ো কঠিন দুনিয়া! দুরাচার দ্যাখো নিয়তির!
তার সাথে যদি পাল্লা দেবে তো, হও ধীর, হও স্থির।

কলমের মুখে আনো অক্ষর, লেখো হৃদয়ের রক্তে-
মুখটি ফিরিয়ে থাকুক সে বসে নির্দয় তার তখ্তে।
মুক্তি তোমার গজলের গানে, গজলেই পাবে তাকে-
শিল্পই শেষ অবধি বাঁচায়- শিল্পে যে মন রাখে ॥

২৮
এই যে তোমার পল্লবে ঘুম যেন আধফোটা গোলাপের
এই যে সোনালি বেণীর বন্যা- বেহেশতি সালসাবিলের,
মিছে নয় সেটি! মিছে নয়!
এই যে ঠোঁটের ওপরে এখনো এক ফোঁটা ওই দুধ,
এই যে শুকিয়ে গেলেই তা বিষ!- কান্ড কী অদ্ভুত!
মিছে নয় সেটি, মিছে নয়!
এই যে গজল ছিলো এতটাই ভাষাহীন এই ঠোঁটে,
এই যে এখন দেখো অক্ষর গোলাপের মতো ফোটে-
মিছে নয় সেটি, মিছে নয়!
এই যে হাফিজ, বেদনায় তুমি আজ পড়ে আছো ঘাসে-
এই যে এখনো আশা হয় যদি একবার ভালোবাসে-
মিছে নয় সেটি, মিছে নয়!
এই যে রাতের হাওয়া উঠে আসে তার পল্লীটি থেকে-
এই যে কোরক গোলাপের দ্যাখো দীর্ঘ এ রাত জেগে-
মিছে নয় সেটি, মিছে নয়!
এই যে হাফিজ, মরমেই মরে!- অথচ বইছে শ্বাস!
এই যে রাতের শেষ প্রহরেও শুকতারাটির উদ্ভাস-
মিছে নয় সেটি, মিছে নয়!

২৯
তবে কি কবরে যাবে নষ্ট এ জীবন?
পুণ্যে যদি সাধুবাদ- তারও আশা কই?
বড়ো দীর্ঘ পথে আজও আমার ভ্রমণ।
এর শুরু কিংবা শেষ- অবগত নই।

মাতাল এই যে আমি শরাবে দৈনিক-
তবুও আমাকে পুণ্যবান বলা যায়?
হাদিসটি হুজুরেরা হাতে তুলে নিক-
কিন্তু কই? বিশারদবৃন্দ বা কোথায়?

সাধুর আস্তানা ছেড়ে দিয়েছি তো কবে-
খুলেও ফেলেছি আমি দরবেশের বেশ।
যাবো যে সরাইখানা- যেতেই তো হবে!-
কে আমাকে বলে দেবে পথের উদ্দেশ?

মিলনের দিনগুলো মনে পড়ে যায়-
মধুর স্বপ্নের ঘোরে আজও দুই চোখ।
কিন্তু সেই মুখখানি মিলালো কোথায়?
তবে আর আশা কই হবো যে অশোক!

পথের ধুলাটি তার সন্তাপে চন্দন-
কতকাল নত আমি গলিপথে তার-
কোথায় বা যাবো আর- এ বড়ো বন্ধন-
যেদিকেই যাই- পথ জুড়ে সে আমার।

হাফিজ, তুমি তো আছো সঠিক পথেই-
কেউ যেন ভুল পথে নেয় না তোমাকে।
আছো যদি থাকো তবে ধীরতা ধরেই-
ঘুমিয়ো না! চোখে যদি ঘুম এসে থাকে!

৩০
ওঠো! তুলে ধরো পেয়ালা তোমার!
ভরে নাও লাল শরাবে!
কানায় কানায় ভরে নাও তুমি,
উপচালে উপচাবে!
পেয়ালা তো নয়- মাথার খুলিটি!
একদিন হবে কংকাল!
আজরাইলের পেয়ালা যেদিন
ওই হাতে এসে যাবে।

সেদিন যেতে তো হবেই তোমাকে-
আজ তুমি ভুলে থাকো।
আজ পেয়ালায় এ ঠোঁট তোমার
চুমুকে চুমুকে রাখো।
এসো উৎসাহে, পাখি গান গাহে,
বহে যায় শুভকাল-
রাত হলো ভোর- থাকবে কি বসে?-
ভোরের আলোটি মাখো।

ওহে দেবদারু! তোমার সবুজে
আমাকে সবুজ করো।
কী হবে আখেরে? তার জন্যে কি
ভয়ে হবো থরোথরো?
মাটি থেকে এসে মাটিতেই আমি
ফিরে যাবো সেটা জানি।
তাই বলে তাকে আজ সাধবো না!-
এ কথা কেমনতর?

এত সাধনেও পাইনি যে তাকে,
ভিজে ওঠে দুই চোখ।
অশ্রু বহাই, ধুয়ে যাক ধুলো,
এভাবেই তবে হোক
শুদ্ধ শরীর শুদ্ধ হৃদয়-
এ যে করুণার পানি!
গোসল করো তো! সহনীয় হবে
প্রণয়ের দুর্ভোগ।

হাফিজ, জানো তো, যদি তার দিকে
দৃষ্টি রাখতে হয়-
তবে নির্মল অশ্রু ধোয়ানো
চোখেই তা নিশ্চয়!
সাপের মতো যে চুলে তার তুমি
হয়েছিলে দংশিত-
তারই তো চুমোর ছোঁয়ায় তোমার
এসে যাবে নিরাময়।

বইছে বাতাস তার দিক থেকে!
সুবাস এনেছে ওই তার!
হাফিজ, তোমার দরকার নেই
দরবেশি আলখাল্লার।
ছুঁড়ে ফেলে দাও, মজনুর বেশে
হও তুমি সজ্জিত-
কখন সে আসে- যদি আসে তাই
বিছাও গোলাপে পথ তার ॥

৩১
ফাল্গুন এসেছে ফিরে, ফুলে ভরে গিয়েছে বাগান-
মাটির গভীর থেকে এরা সব পেয়েছে উত্থান।
তাহলে ধুলায় তুমি পড়ে আছো কেন হে হাফিজ?

শ্রাবণ মেঘের মতো বৃষ্টি তুমি ঝরাও চোখের।
ভেজাও কবরটিকে- কারাগার!- এই হৃদয়ের!
তুমিও উত্থান পাবে- অংকুরের জন্ম দেবে বীজ ॥

৩২
নহরের তীরে বাগানে এসেছি, ফুলে ফুলে ভরা ডাল-
দেখেই হৃদয়ে ঠেলে ওঠে গান সেই তার উদ্দেশে-
সরাইখানার সাকি যার গাল গোলাপের চেয়ে লাল,
তাকেই আমার বন্ধু করেছি এতটাই ভালোবেসে।

ভাগ্যই মানো এবার তাহলে! দেখা পেয়েছিলে তার!
আকাশে তারার ভীড় জমে ওঠে- দীপ্তিতে আঁকে মুখ
সেই তার যাকে ইচ্ছায় পেতে তুচ্ছ এ সংসার-
এবার তাহলে বেঁচে ওঠো তুমি- বেঁচে থাকাতেই সুখ।

যারা ভালোবেসে গিয়েছে শুধুই পায়নি তো ভালোবাসা-
আজীবন যারা বয়েছে শুধুই দুর্বিষহ এ ভার,
আজ তারা যেন ঠিকানাটি পায়, খুঁজে পেয়ে যায় বাসা-
এই যে হতাশা শুকনো সে ডাল- আগুনেই পোড়াবার।

আত্মা আমার যেন দুলহিন, কখন নওশা আসে-
তার পথ চেয়ে চোখ অপলক, কান নেই নহবতে-
মনিরত্নের পরেছে সে মালা, ভরে আছে উচ্ছ্বাসে-
বুঝি সে এখনি এসে যাবে ওই পুষ্প বিছানো পথে।

মনে করো সেই রাতগুলো তুমি কী ভালো কাটিয়েছিলে-
বন্ধুজনের সঙ্গটি ছিল মনোরম- মনে পড়ে?
আলো হয়ে ওঠে হৃদয়ের কালো ওই চাঁদ দেখা দিলে।
নহরের ধারে বাগানও তখন নিশ্চয় চোখে পড়ে।

যেন উজ্জ্বল সাকির ও চোখ শরাবের মতো উচ্ছ্বল-
কানায় কানায় ভরে আছে, কিছু উপচেও পড়ে যাচ্ছে-
দেখেই মাতাল হয়ে পড়ি আমি, হয়ে যাই টলমল।
চলে যদি যায়, সেই বেদনাও কত মিঠে হয়ে থাকছে।

হাফিজ, তোমার পরোয়া ছিল না জীবনের কোনো কালে-
অতএব এসো, তুমি আর আমি সরাইখানায় যাই।
না হয় ওখানে দস্যুরা বসে ছদ্মবেশের আড়ালে-
লুট হয়ে যাবে, তবুও জানবে- সম্পদ ছিল তাই!

৩৩
কই সে আহ্বান? আমি শুনি কই! তাহলে তো উঠে দাঁড়াতাম
এই ধূলি থেকে আর স্বাগতমে হাত দুটি বাড়িয়ে দিতাম।
আমি সেই পাখি যার ডানায় আকাশ ছুঁয়ে দেখবার সাধ,
তীব্র সাধ মুক্ত সে হবেই হবে ফাঁকি দিয়ে দুনিয়ার ফাঁদ।

তুমি যদি মধুকণ্ঠে দাও ডাক, ডেকে নাও তোমার সেবায়-
এই যে বিষণ্ণ দিন, এই যে বিচ্ছেদে দিন দীর্ঘ বহে যায়-
এই জ্বালা যন্ত্রণার পাশ ছিন্ন করে আমি দাঁড়াতাম উঠে
প্রাচীন বীরের মতো, অস্ত্র নয়- কতিপয় পঙক্তি করপুটে।

প্রভু তুমি করুণার! শান্তির অপার বারি বরিষ ধরায়!
যেন সে ধারায়, প্রভু, দীন এই কবরের মাটি ভিজে যায়।
রাত্রিদিন এই যে পাগল হাওয়া আর এই মহা ধূলি ঝড়-
থেমে যাক তোমারই বর্ষণে, প্রভু। তুমি ছাড়া কে আছে নির্ভর!

যখন ঢালবে তুমি অমৃতের ধারা, তুমি বাজাবে সেতার-
যখন সে সুর এসে ছুঁয়ে যাবে ভাঁজে ভাঁজে কাফনে আমার-
তখন আমিও প্রাণ ফিরে পাবো, নৃত্য করে উঠব সে সুরে।
হাতখানি ধরো তার, শিঞ্জনেরও ধ্বনি রেখো পায়ের নূপুরে।

জগতে সবাই জানে- তোমাতেই সমাপন, আরম্ভ তুমিও।
হাফিজ, ওঠো তো জেগে! নেচে ওঠো! পরে তুমি কবরে ঘুমিও ॥

৩৪
মাথার চুল আলুথালু, ঘামতে ঘামতে নাজেহাল!
পেয়ালা হাতে গজল গায়, শরাবে আজ সে মাতাল।

মনের মধ্যে ফূর্তি খুব, কিন্তু ঠোঁটে হায় হায়!
মনে পড়ছে রাত দুপুরে এসেছিল সে গতকাল।

কানের কাছে মুখটি রেখে বলছিল সে বিষাদে-
জেগে থাকার কথাটি যার তার কিনা এ ঘুমের হাল!

এমনতর ঘুমটা যদি শরাব টানার কারণেই-
যে দিয়েছে শরাব তাকে বলবে তুমি- কী দজ্জাল!

পেয়ালা হেসে উঠল তখন, বলল আমার দোষটা কী!
হাফিজ, প্রেমে এই তো হয়! হয়নি তোমার গোস্তাকি!

৩৫
বাতাস বহে যাও, পারো তো যাও তার
কুটির দিয়ে তুমি বহে যাও।
ফেরার পথে যদি পারো তো একবার
খবর তুমি তার এনে দাও।

গোলাপ ফুটেছো যে তোমার ইচ্ছাতে,
সুবাসে দাও তুমি খবর তার।
ভোরের পাখিটির কথাও মনে রেখো,
তারও যে এটা খুব দরকার।

হে চাঁদ ছিলে তুমি যখন প্রথমায়
তখনই তোমাকে যে বন্ধু পাই-
এখন যদি ষোলোকলায় তুমি তবে-
ঢেকেই রেখো না এ রোশনাই।

চুনির মতো লাল ওই যে দেখি ঠোঁট-
উৎস ওখানেই শর্করার।
দাও গো সেই স্বাদ টিয়ার মুখে তুমি,
আমি তো পাখি সেই অপেক্ষার।

এই যে ইহকাল জানি সে দুদিনের,
দেবার আছে তার সামান্যই-
এ কথা লুকোবার মতো যে তুমি নও-
ভোলার মতো লোক আমরা নই।

কালের স্মৃতিপটে থাকবে যদি আশা,
স্মরণে রেখো তবে সেই বচন-
কাব্য ভালোবাসে এমন সুজনেরা
বিলিয়ে দিতে সোনা নয় কৃপণ।

মিলিয়ে যাবে ধূলি, দুঃখ দূরে যাবে,
সুদিন দেখো ফিরে আসবেই।
হাফিজ, তাই বলে অশ্রু থামিও না-
সুখেও চোখ ভিজে উঠবেই ॥


৩৬
এই আলখাল্লা আজ বন্ধক রেখেছি আমি সরাইখানায়-
ভালো হয় শরাবেই যদি এই কবিতার খাতা ডুবে যায়!

আজ আমি ফিরে ফিরে নষ্ট এই জীবনের দিকে দৃষ্টি করি-
এর চেয়ে শরাবেই ভালো ছিল! মাতাল বেহুঁশ গড়াগড়ি!

জামা যার দরবেশের জাগতিক বোধবুদ্ধি তার জন্যে নয়।
অতএব অশ্রু আনো, শরাবের সোরাহিও ফেলে রাখা নয়।

সে যদি মাতাল তবে, পঞ্চমুখে রটাবো না দোষঘাট তার।
বলতেই হয় যদি- গজলেই বলে যাবো- সঙ্গতে সেতার।

এতটা বিরূপ যদি বেহেশতের বাগিচায় ওই যিনি বসে-
তবে আছে সাকি আর সরাইখানাটি- তুমি মাল টানো কষে।

কিন্তু হে হাফিজ তুমি চেয়ে দ্যাখো শাদা চুল কালের হাওয়ায়!
এখন যৌবনে যারা সরাইখানায় যাওয়া তাদেরই মানায় ॥

৩৭
সারারাত জেগে তোমার দীর্ঘ চুলের গেয়েছি গান।
ভোর হয়ে আসে তবুও আকাশে তারারা কী উজ্জ্বল-
ঠিক তার নিচে দুনিয়া যে পড়ে- কতটাই ম্রিয়মাণ-
দিন হতে থাকে ঢুলুঢুলু চোখে, জাগছে নিঁদমহল।
পারস্য দেশে শিরাজ নগর- এখানে তন্দ্রাহারা
একটি যে তারা! অস্ত যাবে না- তোমার চোখের তারা!
এখানেই রাতে আমরা গেয়েছি তোমার চুলের গান।

আমাদের বুক বিদ্ধ তোমার নিপুণ চোখের তীরে।
ক্ষতবিক্ষত তবু ফিরে ফিরে হতে চাই বিক্ষত-
তুমি তুলে ধরো ধনুক তোমার, এসো মজলিশে ফিরে,
কতকাল থেকে তুমি হও নাই নিশানায় উদ্যত।
হঠাৎ হাওয়ায় শুনে উঠি সেই পরিচিত আহ্বান-
বুক পেতে ধরো!- আশা নিরাশায় দুলে ওঠে এই প্রাণ।
প্রিয় মৃত্যুটি আসবে আবার তোমার চোখের তীরে।

থেকে যেতো প্রেম অজানা!- তোমার জন্ম হতো না যদি!
জানাই হতো না যার এত রূপ, খুনিও সে হতে পারে!
দীর্ঘ চুলের দেখেছি যে ঢল, বঙ্কিম তার গতি-
ভাঁজে ভাঁজে তার ফুঁসে ওঠে ফণা, বুঝিবা ছোবল মারে!
তাই দরবেশি পোশাক পরেছি মিশেছি তাদের দলে-
যেন নীল হয়ে যায় না শরীর তোমার বিষের ছোবলে!
থেকে যেতো প্রেম এত অজানাই জন্ম নিতে না যদি!

ওই বুক থেকে সরাও আঁচল, দয়া করো, দাও ঠাঁই-
জীবন মরণ এক হয়ে যায় তোমারই তো সাক্ষাতে-
ওই বুকে যেন মাথা রেখে আমি হৃদয় ধ্বনিটি পাই-
যেন এ তাপিত হৃদয়ের ধ্বনি মিশে যায় তার সাথে!
নইলে কবরে চলে যেতে হবে শেষ শান্তির খোঁজে।
এই চাওয়াটির অর্থ কে বোঝে, সেও যদি নাই বোঝে।
হাফিজ, তবুও তাকেই বলছ- দয়া করো! দাও ঠাঁই ॥

৩৮
কাল সারারাত সরাইখানায়, কাটে নাই মাতলামো,
সাতসকালেই চলেছি আবার সরাইখানার দিকে।
আবার যে চলে পা দুটি আমার! বলছি না তাকে- থামো!
মাতাল আমার চোখে পড়ছে না ঘুম ঘুম পৃথিবীকে।

এখনো রবাব বেজেই চলেছে, চলছে গজল পাঠ,
ওহে নিজেকেই    তাড়া দাও তুমি, তীর্থ যে ডাকে ওই-
ওখানে এখনো ভাঙেনি আসর, এখনো জমজমাট।
কেন একা যাবে? কিছু বন্ধুকে ডেকে নেবে নিশ্চয়ই।

একদিন তুমি সরাইখানায়    পেয়েছিলে দেখা তার।
কতনা কাব্য করেছিল তুমি তাকে জয় করে নিতে।
সে বলেছে বড়ো   উপহাস করে- ‘কোমরের এই হার-
এখানে তোমার    হাত রাখলে যে!   পারবে পাল্লা দিতে?

হাতটি সরাও,  পারো যদি যাও- অন্য কোথাও যাও-
যদি পাও খুঁজে কেন্দ্রে কে আছে, আছে অন্তিমে কে-
তবে তুমি ওহে   যাও তার কাছে, সেখানে গজল গাও।’
উঠে এলে তুমি-   তবুও তো আশা!- যদি নেয় পিছু ডেকে।

আসে নাই ডাক!   ঝড়ের সাগরে  তখন জাহাজে উঠি-
জাহাজ তো নয়-  শরাব সোরাহি!    ওতেই যে ভাসমান!
কান্ডটা দেখে সাকি ও সাথীরা হেসে হয় কুটিকুটি!
হোক তারা হোক! গায়ে মাখবো না    উপহাস অপমান।

বরং গজলে আমি বারবার   বলে যাবো এই কথা-
নেহাৎ মাটির  দেহটি তোমার তারই এত গৌরব?
হাফিজ শরাবে মতি রেখো তুমি ঠোঁট রেখো সর্বদা।
পেয়ালাই সব, পেয়ালা ভরসা, এই তো হে বাস্তব!

৩৯
ফিরে এসো! আহত এ হৃদয়ে আমার-
যেন ফুলে ভরে ওঠে শুকোনো বাগান,
যেন পাট খুলে যায় বন্ধ দরোজার-
কবরের লাশ যেন ফিরে পায় প্রাণ।
রাখো হাত, খুলে যাক পল্লব আমার
যেন চোখ দেখে ওঠে সৌন্দর্য তোমার।
ফিরে এসো! ফিরে এসো জীবনে আবার!

প্রাণের সংগীতে তুমি ফেরাও উল্লাস।
স্বাধীনতা এনে দাও পরাজিত দেশে।
তুমি তো নামলেই মাঠে দুশমনেরা লাশ!
আমিও দাঁড়াব উঠে বিজয়ীর বেশে।
এই দ্যাখো আয়নাটি তুলে ধরেছি যে,
এখানে তোমারই মুখ- অপরূপ কী যে!
খুন হয়ে যাই আমি রূপের কিরিচে।

নিশীথ যেন সে এক গর্ভবতী নারী-
প্রতিটি তারাকে আমি করেছি জিজ্ঞাসা-
কীসের সে জন্ম দেবে জানতে কি পারি?
চাঁদ? নাকি লোকে যাকে বলে ভালোবাসা?
জবাব মেলে না তার, তারা ঢলে পড়ে।
তখনো হাফিজ শোনে নিজের ভেতরে-
ফিরে এসো!- অবিরাম প্রহরে প্রহরে ॥

৪০
গিয়েছিল সরাইখানায় গতসন্ধ্যায় হাফিজ-
প্রেমের দুর্বার টানে দুনিয়া যে করেছে খারিজ।
হঠাৎ আবার তার যৌবনের ফিরেছিল সাধ,
যদিও বুড়িয়ে গেছে তবু হয়ে ওঠে সে উন্মাদ।
একদা যে ভেঙেছিল পানপাত্র ছুঁড়ে ফেলেছিল-
একটি চুমুকে তার সবই কিন্তু ফিরে এসেছিল।
হৃদয় যে করেছিল চুরি তার স্মৃতি ফিরে আসে।
ওই তো দাঁড়িয়ে আছে, একবার কাছে যদি আসে।
গোলাপের মতো লাল রক্ত ঝরে বুলবুলের ঠোঁটে-
রাতের মোমের আলো- তারই  দিকে পতঙ্গেরা ছোটে।
হাফিজ- ক্রন্দন তার থামে নাই মুহূর্তের তরে-
অশ্রুর ফোঁটায় মুক্তো জন্ম নেয় শুক্তির ভেতরে।
তাই সে গিয়েছে কাল বন্ধুদের মাতাল দঙ্গলে!
পতঙ্গ উড়েছে খুব- পুড়ে গেছে মোমের অনলে ॥

৪১
হৃদয় ভাগ্যই মানো, ফিরে এলো ভোরের হাওয়াটি-
বিলকিসের দেশ থেকে গানও নিয়ে এসেছে পাখিটি।

গাও পাখি, গাও তুমি, কেননা এ প্রভাতবেলায়
সোলেমানী গোলাপের গন্ধ ভেসে আসছে হাওয়ায়।

বাগানে এই যে ফুল- শরাবেরও ঘ্রাণ প্রতি ফুলে!-
আমাকে ফেরায় প্রেমে পুরাতন ইতিহাস তুলে।

যে বোঝে সে বোঝে আমি পড়ে নিচ্ছি ফুলের ভাষণ-
আসা তার- আর ফিরে যাওয়া তার- এর কী কারণ।

পরমকরুণাময় ঈশ্বরের অসীম কৃপায়-
বুঝে যাই কী করে পাষাণ মনে দয়া এসে যায়।

উৎসুক তাকাই ফিরে সড়কের দিকে, পল গণি,
কান পেতে রাখি তার কারাভার পেতে ঘন্টাধ্বনি।

যদিও হাফিজ সেই কবে থেকে বন্ধ দরজায়-
দ্যাখো কী অসীম ধৈর্য ধরে আছে!- যদি খুলে যায়!

৪২
মসজিদে মসজিদে যারা ওয়াজের তুফান ছোটায়-
পালনে তো একান্তে তারাই দেখি ভিন্ন হয়ে যায়।
এই যে সমস্যা! এটি মোল্লাদের কাছে পেশ করো-
নিজের তওবা নাই, বলবেন তবু ওহে অনুতাপ করো!

হয়তো তাঁদেরই নাই আখেরাতে হাশরে বিশ্বাস-
তাই কি আনেন তাঁরা দুনিয়াবি বিচারে সন্ত্রাস!
আমি তাই সরাইখানার সব হুজুরের পায়ে
পড়ে আছি- বাদশার খেলাত ফেলে আলখাল্লা গায়ে।

হাতে তসবি টিপে যাও হৃদয়ের এ বালাখানায়-
মনে রেখো, আদমকে গড়া হয় নিতান্ত কাদায়।
আর এই সরাইখানাটি সেও মাটিতেই গড়া-
অতএব এখানেই পাবে পাঠ, হতে থাক পড়া!

হাফিজ, তোমার আজ গজলের রচনা চলবে-
দেখবে তোমারই লেখা ফেরেশতারা মুখস্ত বলবে!

৪৩
ওই যে গান গাইছে ওরা রবাব সহযোগে-
বলছে, আনো, শরাব ঢালো,  যা বলে বলুক লোকে।
বলছে আরো- মনে যা আছে মনেই রেখে দাও-
কীসের পাপ! ভাববে কেন? পেয়ালা তুলে নাও।

তামাশা এই ভালোবাসাই    কাঠগড়াতে যায়!
বৃদ্ধেরা হয় তিরষ্কৃত, দন্ড তরুণ পায়।
আমাদের তো ছলাকলায় বাইরে রাখা হয়-
ভেতরটাতে ষড়যন্ত্রই চলছে নিশ্চয়।

মোল্লারা সব উচ্চস্বরে ওয়াজ করে যায়-
পথ দেখানো মাল্লা তো নয়! পথ থেকে সরায়।
বাঁকা ভুরুর  দৃষ্টি বানেই বদলে যাবে সব-
এই গরীবের ডেরায় ঝরে পড়বেই বৈভব।

এক দল তো ছেড়েই দিলো আল্লার হাতে সব।
আরেক দলে চেষ্টা চলে- চেষ্টায় সম্ভব।
মোদ্দা কথা- লেগেই থাকো হাল ছেড়ো না আর-
একদিন তো পাবেই পাবে তোমার পুরষ্কার।

শরাব আনো, শরাব ঢালো, হাফিজ এবং শেখ-
মাতাল হলেই উঠবে জমে প্রাণের অভিষেক ॥

৪৪
শরাব যদি নহর তবে
ভাসিয়ে দাও জাহাজটা-
বৃদ্ধ আর তরুণদের
থামাতে বলো আওয়াজটা।
ও সাকি আজ শরাব ঢেলে
জাহাজটাকে ভরিয়ে দাও।
এমন ভালো কাজের পরে
আমার সাধুবাদটা নাও।
ভুল করে তো ভুলেই ছিলাম
সরাইখানার রাস্তাটা-
এবার তুমি ফিরিয়ে নাও,
দেখিয়ে দাও পারঘাটা।

মধ্যরাতে চাঁদ সরিয়ে
সূর্যটাকে আনতে চাও?
দ্রাক্ষাবনের ওই কন্যার
ঘোমটাখানা সরিয়ে দাও।
যখন হবো আমিও লাশ
কবর তুমি দিও না গো!
সরাইখানায় আনবে টেনে,
বলবে এইখানেই থাকো।
হাফিজ তুমি পৌঁছে যাবে
যখন সুতোর শেষ মাথায়-
তখন তুমি দুঃখ শেষের
গজল লিখো শেষ পাতায় ॥

৪৫
গতকাল রাতে
মহাজন এক বলে যান কানে কানে-
তোমার কাছে তো
লুকোনো যাবে না সরাই-বুড়ো যা জানে।
আরো বলে যান,
জটিলতা ছাড়ো, এ তোমার পথ নয়।
জানবে তারাই
মুশকিলে পড়ে যারা সহজিয়া নয়।

এই কথা বলে
তুলে দেন তিনি পেয়ালা আমার হাতে-
সঙ্গীতে শুনি-
পান করো পান!- তারা ঝলমল রাতে।
আরো কী বলেন?-
বাপু, শোনো ওহে, দুনিয়ার হাল দেখে
ঘাবড়ে যেয়ো না,
অমূল্য এই উপদেশ যাই রেখে।

হৃদপিন্ডের
রক্ত যে লাল, সেই লাল আনো ঠোঁটে-
হেসে ওঠো তুমি,
রবাবে তোমার তীব্রতা নয় মোটে।
ভালোবাসবার
মহলে তোমার থাকে যেন নীরবতা-
খোলা রেখো চোখ,
পেতে রেখো কান, শুনে যেয়ো তার কথা।

কারণ এখানে
ইন্দ্রিয়গুলো গুটিয়ে আনতে হয়,
তারপর শুধু
দেখার দুচোখ আর কান হতে হয়!
বরাভয় পেয়ে
হাফিজের হাতে আবার ওঠে শরাব-
ফরমান জারি
মন্ত্রী করুন, পাবেই সে পাবে মাফ!

৪৬
যদিও বুড়িয়ে গেছি,
যদিও এখন ক্ষীন নাড়ি আর বিকল হৃদয়-
তথাপি তরুণ আমি
যখনি স্মরণপটে হয় তার মুখের উদয়।
আমার যা ছিল চাওয়া
সবই সে তো হাত ভরে দিয়েছিল, মনে পড়ে যায়।
তরুণ গোলাপ শোনো,
সেই তারই জন্যে আমি বুলবুল তোমার ছায়ায়।
প্রথমে ছিল না জ্ঞান
কালের নাগরদোলা, কত তার উত্থান পতন-
দুঃখের মক্তবে তুমি
দিলে পাঠ, ক্রমে হলো পরিষ্কার কারণ ও করণ।
এই যে বয়স বাড়ে,
তাই বুঝি আমি বুড়ো হয়ে যাই কালের নিয়মে?
জীবন যেমন সেও
আমাকে এড়িয়ে যায় বলেই তো বুড়ো ক্রমে ক্রমে।
সিংহাসনে সে আসীন,
তার দিকে যে পথ গিয়েছে বেঁকে- আমি যাত্রী তার,
যদিও বুড়িয়ে গেছি,
তবু দ্যাখো অনেক পেয়েছি বন্ধু পান পেয়ালার।
তোমার চোখের তীর
যেদিন বিধেঁছে বুকে, হাফিজ তো সেই দিন থেকে
অপেক্ষাই করে আছে
কতকাল পরে আর কবে আর কাছে নেবে ডেকে ॥

৪৭
তুমি যে একবার দৃষ্টিপাত করো
অমনি বেড়ে যায় বেদনা-
আমি যে একবার দৃষ্টিপাত করি
অমনি বেড়ে যায় কামনা।
প্রশ্ন করো নাই কেমন আছি আমি,
জানিনা ইচ্ছাটি কী তোমার।
তুমি কী উদাসীন- আনো না নিরাময়।
বেদনা বোঝো না এ আমার?

এই কি চাও তুমি ধুলায় ফেলে রেখে
চলেই যাবে দূর সুদূরে?
যাবে তো যাও তুমি, ধুলোই হবো আমি,
বাতাসে যাবো আমি উড়ে।
বাড়িয়ে দেবো হাত টানবো দুই হাতে,
তোমার জামাটার আস্তিন।
ধুলোর পথে তুমি, আমিও ধুলোতেই-
তাহলে ধুলোতেই প্রদক্ষিণ!

কষ্ট কতটাই শ্বাসে ও প্রশ্বাসে-
সহজ করবে না নিঃশ্বাস?
করেছ যদি খুন, তাহলে ধমকাও-
কবরে শুয়ে থাকো তুমি লাশ!
রাতে যে আমি ওই চুলের কুট্টিমে
তোমারই পেয়ে যাই সন্ধান-
তাইতো প্রথমার চাঁদের পেয়ালায়
শরাব হাতে নিয়ে করছি পান।

মাতাল হয়ে যাই, তোমাকে টানি বুকে,
শরীরে ঘন চুল জড়িয়ে যায়।
তোমার ঠোঁটে রাখি তৃষিত দুই ঠোঁট-
জীবন কোরবানি হয়ে যায়।
মিনতি হাফিজের- সদয় হও তুমি,
শত্রুদের বলো- যাও তফাৎ।
তোমার উষ্ণতা পেলেই কথা নেই-
শংকা দূরে যাবে তৎক্ষনাৎ ॥

৪৮
চুলটা খোলা রেখো না তুমি পাছে ওতেই আটকে যাই!
ঢং ছাড়ো তো! ওতে আমার সমূহ সর্বনাশটাই!

লালিমা রেখো গালে তোমার, গোলাপ যেন না ভোলায়!
চিবুক রাখো উন্নত ওই দেবদারুটির উচ্চতায়!

রটিয়ে তুমি দিয়ো না রূপ, চাই না হতে ঈর্ষিত,
নই ফরহাদ, চাই না হতে বিরাগ যদি শিঁরির তো!

বিষিয়ে যাবে রক্ত আমার শরাব যদি আর কাউকে দাও-
যেয়ো না দূরে, যাও যদি তো শুনবে না এই কান্নাটাও।

মোমের মতো জ্বলবে যদি পুড়ব তবে এক আমি-
সবার সাথে পেয়ালা তুলে কোরো না প্রেম কম দামী!

সঙ্গ ছাড়ো আর সকলের, নইলে আমার রইবে কে?
সবার শোক দেখতে গেলে অশ্রু আমার দেখবে কে?

দয়ার তুমি দয়াটা করো, এগিয়ে এসো উদ্ধারে।
দুঃখ আমার দূর করতে রাজার উজির কি পারে?

তোমার ফাঁদে বন্দি মানেই মুক্তি আমার আসলেই!
হাফিজ জানে, তুমিই তুমি! নইলে দ্যাখো সেও তো নেই!

৪৯
পা থাকতেও তার সড়কে পা ফেলছ না।
খেলাধুলার সবই আছে, কিন্তু খেলছ না।

হাতে তোমার শিকারী বাজ কাজে লাগাচ্ছো না।
টানছো শরাব সারাটা রাত সোয়াদ পাচ্ছো না।

অনুরাগের আস্তিনটা সুগন্ধি ভরপুর-
একটি ফোঁটা তার জন্যে তো করছ না উপুড়।

এই যে দেহে তার কারণেই রক্ত এত লাল-
কিন্তু এতে করছো না তার গাল দুটিকে লাল।

হাফিজ, ভালোবাসছ বাসো, উপদেশ তো শোনো-
হাত গুটিয়ে রাখায় কিন্তু লাভ হয় না কোনো ॥

৫০
আবার ফিরে হবেই ভোর, গন্ধবহ ছুটবে।
আবার দেখো জগৎ বুড়ি যুবতী হয়ে উঠবে।
পেয়ালা হবে বসন্তের শরাবে ফের ভরপুর।
আকাশ ভরা ব্যাথার তারা দেখছি চোখে যদ্দুর-
আবার তারা জুঁই হবে তো! বাগানে ফের ফুটবে।
বলছি আমি, হতেই হবে,
আবার হবে, হবেই ফের!

দীর্ঘ এই ক্রন্দনের দিনটা কেটে যাবেই তো।
বিচ্ছেদের পরে আবার মিলন ফিরে পাবেই তো।
দুঃখ পাখি পৌঁছে যাবে আবার সেই উদ্যানে-
হায় হায় যে করছিলো, আর করবে না সে তার গানে।
সরাই ফিরে ডাকবে, এসো- হাফিজ ফিরে যাবেই তো।
বলছি আমি, যেতেই হবে,
আবার যাবো, যাবোই ফের!

হায় রে বোকা, এমন সুখে আজকে যদি না মাতিস-
কালকে দিনের জন্যে যদি সবটা ফেলে তুই রাখিস-
তবেই বুঝি মিলিয়ে যাবে এই শাবানে দুঃখ তোর?
আসছে ওই রমজানেরই দিবসব্যাপী উপোস তোর!
তার চেয়ে তুই পেয়ালা তুলে তৃষিত তোর ঠোঁট রাখিস।
বলছি আমি, রাখতে হবে,
রাখবি তুই ঠোঁটটি ফের।

ওই যে দ্যাখ, গোলাপ ফোটে, টকটকে কী পাঁপড়ি লাল-
যেন প্রিয়ার মুখটি রাঙা, শরমে তার রঙিণ গাল।
ফুল বিছানো সড়ক দিয়ে আসল যদি সে আবার-
দুঃখটাকে বক্ষে পুষে করবি কি তুই দিন কাবার?
ফুরিয়ে যায় সময় দ্রুত, এক্ষুনি তুই হ’ মাতাল।
বলছি আমি, হতেই হবে,
মাতাল হবি হাফিজ ফের।

আসুক তবে গানের দল, আনুক তারা বীন্ রবাব।
আবার ফিরে সরাইখানায় নহর কেটে দিক শরাব।
হাফিজ ফিরে উঠে দাঁড়ায়, অন্ধকারের পাড় ঠেলে-
ঘনিয়ে যায় সেই যেখানে চুম্বনের ঠোঁট মেলে।
নিষেধকারী যারাই আছে তাদের দিয়ে দাও জবাব।
হাফিজ বলে, দিতেই হবে,
বিদায় করে দাও তাদের ॥

৫১
মগরিবে নামাজে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দুচোখ আমার ভেসে গেলো অশ্রুতে,
বলতেই পারলাম না কাহিনীটা যে বলতে চেয়েছিলাম।
মনে পড়ে গেলো দেশের কথা, বন্ধুদের কথা, চোখে এলো এত পানি,
নির্বাসিতের জামাটা আমি শরীর থেকে খুলে ফেললাম।

সে আমার আপনভূমি, স্বজন আমার যেখানে, শত্রুদেশ তো নয়!
তুমি দয়াবান, বন্ধুদের কাছেই তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও।
তোমরা যারা তীর্থপথে এখন, দোহাই আমাকে ফেলে যেয়ো না,
যাত্রাশেষের সরাইতে তোমরা আমাকেও নিয়ে যাও।

আমার মনের মধ্যে যে কী হচ্ছে- জানে কেবল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ হাওয়া,
কার এমন দায় পড়েছে আমার কাহিনীটা জেনে নিতে।
এই যে নির্বাসন আর এই যে ধুলি, হাওয়াকেই এত করে বলছি-
আমার জন্ম শহর শিরাজের ধুলি উড়িয়ে এখানে এনে দিতে।

চোখ থেকে তো পড়েই চলেছে পানি, ভিজে যাচ্ছে সড়কের ধুলি,
প্রেমিকার বাড়ি থেকে এখন আমি পড়ে আছি অনেক সুদূরে।
হঠাৎ একটা গানের কলি ভেসে এলো, তাকিয়ে দেখি- আরে!
এ যে এক গানের পরী! হাফিজেরই গজল গাইছে এত করুণ সুরে!

৫২
আমি সেই মুখখানির জন্যে পাগল, আমি সেই চুলের ঢলে ভেসে যাই,
ভুলতে পারি না চোখের সেই ভাষা, মদের স্বাদ সে কী!
ভালোবাসলেই এ রকম হয়, এত কষ্ট, এতটাই যে পুড়ে যাওয়া!
আমি মোমের মতো জ্বলছি, আমাকে আগুনের ভয়টা দেখাবে কী?

স্বর্গাদপি গরিয়সী আমার দেশ, তবে পর্যটনে রয়েছি আপাতত,
আর পথেই কিনা পড়ে গেলাম প্রেমে, কা- হচ্ছে এই!
কপাল যদি ভালো থাকে, মায়া কাটিয়ে ফিরবই একদিন দেশে,
স্মৃতিকেও ব্যবহার করতে পারবো আমার সেবাদাস হিসেবেই।

শিরাজ! আমার শহর! সেখানে লাল ঠোঁট আর সুন্দরীদেরই হাট।
কিন্তু আমি পকেটে ফতুর, সওদা করার নেই কোনো মওকাই
এই নিয়ে বড়ো আপশোসে আছি। এদিকে সবারই চোখ লাল!
আমি কিন্তু মাতাল না হয়েই নেশার ঘোরে পড়তে চাই।

তুমি বললে- এ জীবনের রহস্যটা বোঝো? যদি বোঝো তো বলো।
বললাম- আগে দু’একপাত্র মাল টানি, তারপরে তো উত্তর!
হায় রে হাফিজ, বিয়ের সেই বরের মতো দশা দেখছি তোমার!
আয়না আনতে ভুলেই গেছো! কনের মুখ দেখবে কী! দুত্তোর!

৫৩
দীর্ঘ এই যাত্রায় যে বেরিয়ে পড়েছি, হৃদয়, একবার ভাবো তো
পথের সঙ্গী সৌভাগ্যের চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
আর, এটিও তুমি ভেবে দেখো, শিরাজের বাগানে যে বইছে বাতাস,
তার থেকে বিশ্বস্ত দূত আর কেউ কি হতে পারে?

কথাটা হচ্ছে তুমি যাকে ভালোবাসো তার বাড়ি থেকে নয়,
আসল বেরিয়ে পড়াটা হচ্ছে আত্মিক সত্যের সন্ধানে,
এতেই স্থির থেকো তুমি, আর মনে রেখো তোমার চেনা শহরটিকে,
সেখানে যারা- তাদের আসল বাসাটি তো তোমারই প্রাণে।

পথের ওপর হঠাৎ যদি দস্যুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমার দুঃখ,
জন্মভূমির ওই বন্ধুরাই তো দেবে তোমাকে সান্ত¦না।
বসে পড়ো সরাইখানায়, শ্রান্ত তোমার হাতে তুলে নাও পেয়ালা,
পান করো! আর এতেই যে উদ্ধার, সে কি তুমি জানো না!

আর তো কিছুর দরকার নেই। এবার সহজ করে তোলো সব-
হাতের পেয়ালা- মনের সেই মানুষ- আর কি চাই তোমার!
হাফিজ, তুমি শুদ্ধাচারী এবং জ্ঞানী, তাই তুমিই তো এটা বুঝবে
এখানেই পুণ্য আর এখানেই পাপ- এই হচ্ছে সংসার ॥

৫৪
নিবিড় আশ্রয়, পেয়ালায় টলটলে শরাব, সহৃদয় একদল বন্ধু-
যদি তোমার হতো, হাফিজ! বরপুত্র বলতাম তোমাকে।
এই যে দুনিয়া সংসার- আসলেই তো কিছুর মধ্যে কিছু না!
কতবার এটাই তো দেখেছ, আর কী দেখার তবে বাকি থাকে?

বাকি আছে বৈকি! জানতাম না এত কষ্ট ভালোবাসায় আছে,
আর এ থেকে উদ্ধার দিতে পারে ভালোবাসার মানুষটিই তো!
তাহলে তারই কাছে ফিরে যাওয়াটাই তো সবচেয়ে ভালো,
নইলে পথে বেরিয়ে হতে হবে দস্যুর হাতেই লুণ্ঠিত।

তাহলে ভুলে যাও চুনির ঝলক আর পেয়ালায় শরাবের উচ্ছলতা,
এ সবই ক্ষনিকের, মায়ার বিভ্রম মাত্র- এটা বুঝে নাও।
আসল কথা, মনের মধ্যে সেই তাকে নিত্য ধরে রাখা নিজের করে।
এবার তুমি পথে এসে দাঁড়াও দেখি, পা চালাও।

তোমার অশ্রুর রঙটা কী বিষণœ লাল, কিন্তু অবাক হবার কিছু নেই-
এটিও তার কাছেই পাওয়া, আছে তোমার আঙটির পাথরে।
শুনেই সে হেসে বলল- তোমার প্রতিভার কাছে বিক্রি হয়ে গেলাম।
হাফিজ ভাবছে, সে আমাকে কতটাই না বোকা মনে করে!

৫৫
তাহলে বাধাটা কোথায়? জন্মভূমির দিকে কেন আমি রওনা হবো না?
কেন বন্ধুর গলিতে পৌঁছুবার পর তার ধুলি হয়ে থাকবো না?
বাড়ি থেকে বিজন এই বিদেশে এতকাল এত কষ্ট সইবার পর
কেন নিজের শহরে ফিরে নিজেই নিজের যুবরাজ হয়ে বসব না?

আমি ফিরব, আবার বসে যাবো প্রিয় সেই চত্বরে সবার সঙ্গে,
ভাগ করে নেবো সকলের সুখ দুঃখ যখন যেটা আসে।
জীবনের কথা তো আগে থেকে কিছু বলা যায় না, শুধু এই যে
যখন মৃত্যু আসবে, যেন শীতল সেই তার ছায়াতলেই আসে।

কত বেদনা কত ব্যর্থতা, আমার যে দুঃখতাপ মনে মনেই থাক।
ভালোবেসেছি আর ভালোবেসে যে হাল ছাড়িনি, অহংকারটা এই।
হাফিজকে থাকতে দাও নিজের মনে, তার আশা আছে একদিন
স্বর্গ সে পাবেই, আর সেই স্বর্গ আর কোথাও নয়- তোমাতেই ॥

৫৬
একদিন দেশে ফিরে যাবো এই নির্বাসন থেকে,
যদি যাই অভিজ্ঞান নিয়ে যাবো পূর্বাপর দেখে।
এই দীর্ঘ পথ যদি নিরাপদে পাড়ি দেয়া যায়
আবার উঠবো গিয়ে পুরোনো সে সরাইখানায়।
এক হাতে পেয়ালাটি, অন্য হাতে রবাবটি ধরে
পথের বর্ণনা আমি করে যাবো বন্ধুর আসরে।
প্রেমের যন্ত্রণা যারা একদিন সহেছিল তারা
বুঝে যাবে আমিও তাদের মতো আরেক বেচারা।
তারাই জানবে আমি পড়ে আছি এখনো পথেই-
পথ বড়ো দীর্ঘ পথ- এ চলার আজও শেষ নেই।
দৃষ্টির সমুখে শুধু সেই তার ভুরুর কলাপ
নামাজী যেমন তার সেজদায় দেখে মেহরাব।
পড়ে আছো প্রণত হাফিজ তুমি, বহে যায় সুরা!
আসরে সত্বর এসো, অপেক্ষায় রয়েছে বন্ধুরা ॥

৫৭
উঠবে তুমি খুঁজবে তুমি আবার সেই দরজা
আবার সেই জমজমাটি আসর ডাক দিচ্ছে
এবার হবে তামাম শোধ     যেন এ শেষ রোজা
মগরিবে আজ মিটবে হাফিজ তোমার সকল ইচ্ছে

যাত্রাপথে ছিল না মোটে রসদ এক রত্তি
এবার এসো সরাইখানায় ঢালছে শরাব সাকি
পেয়ালা নাও তৃষ্ণা মিটে যাবেই এবার সত্যি
উঠবে হেসে আবার তুমি প্রেমের বৈরাগী