পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সাঁইয়ের এনাটমি ও মনা পাগলার অদ্ভুত হাসি - পর্ব এক

মনা একটি ছবি দেখছে আর হাসছে। তার হাসি দেখে আশে পাশে পথচলা পথিকেরা বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্ত্তু সেদিকে তার মোটেও ভ্রুুক্ষেপ নেই। সে হাঁটছে তার নিজের মতো করে। হেলে দুলে। কিন্ত্তু যারা মনাকে চেনে তারাও তার এ আচরণের কারণটা ধরতে পারছে না। তারা দেখলোঃ মনার হাতে একটি ছবি। সে ছবিটি বার বার দেখছে আর খিলখিল করে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্ত্তু কাউকে সেই ছবিটি দেখাচ্ছে না। রহস্যটা কি?

মনার এমন আচরণে ভবা মনাকে জিগ্যেস করলোঃ

-কি রে মনা, তোর আজইগো কি অইছে? অত হাসতাচ্ছ কেরে?

-আর কইস না। একখান ছবি পাইছি। হেই ছবি দেইক্কা খালি হাসি আহে।

-কিয়ের ছবি? দেহি..

-তোরে দেহান যাইবো না। দেকলে তুই ও হাসবি...

-কস কি...তাইলেতো দেহন লাগে...দেহানা দোস্ত

-দেখবি? দ্যাখ...

ছবিটা দেখে মনা ও ভবা দুই জনেই হাসিতে গড়াগড়ি খা্চ্ছে। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে আর ইশারা করে হাসছে।

সাধারণ লোকজন এ হাসির রহস্য ধরতে পারছে না। আর কিছু বুঝতেও পারছে না। কিন্ত্তু তারাও মনা-ভবার কীর্তিকলাপ দেখে তাদের সাথে হাসিতে যোগ দিয়েছে। তারাও এখন মনা-ভবাদের সাথে হাসছে। কিন্ত্তু কি এমন ঘটনা ঘটেছে যে তাদের হাসি থামতেই চাইছে না। বিষয়টা ভাবিয়ে তুললো রশিদ সরকারকে। তিনি মনাকে একটি কষে ধমক দিলেন। তারপর মনার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন ছবিটি। ছবিটি তেমন কিছুই না। বায়োলজির একটি হিউম্যান এ্যামব্রায়োর ছবি। যেটাকে স্পার্ম বলা হয়। অর্থাৎ শুক্রাণুর একটি ব্যবচ্ছেদ করা ছবি। ছবিটিতে হিউম্যান স্পার্ম এর চিত্র দিয়ে এর কয়টি অংশ তা দেখানো হয়েছে। সেই ছবিটি মনা দেখছে আর হাসছে। অন্য দিকে ভবাও সেটা দেখে হাসছে। কিন্ত্তু এতে হাসির কি আছে, তা রশিদ সরকার বুুুুঝতে পারছেন না। তিনি হাসির রহস্যভেদ জানতে মনাকে জিগ্যেস করলেনঃ

-এটা দেখে হাসির কি আছে?

-কন কি সরকার সাব? এইডা দেইক্ক্যা হাসমু না? হুনেন সরকার সাব, আমাগো মতো অনেক পাগল আছে যারা এইডাকে কয় সৃষ্টিকর্তা। এইডা নাকি আমাগো সৃষ্টি করছে। এইডা যুদি আমাগো সৃষ্টিকর্তা অয়, তাহলে হেই সৃষ্টিকর্তারে কে বানাইছে? হেইডারে বানাইছি আমরাই। আমরা যা খাই (রিজিক যথাঃ ভাত, মাছ, মাংশ, ডিম, দুধ ইত্যাদি ) হেইডার মুল যে সৃষ্টিরস হেইডা থিক্কাইয়্যা অয় এই মুলবীজ। যেইডারে কয় দেহবীজ। এই দেহবীজ থিক্ক্যাই মানুষের জন্ম হয়। পশু-পাখির জন্ম অয়। তথা জীবের জন্ম। আপনে যুদি খাওয়ন দাওয়ন বন্ধ কইর‌্যা দেন, তাইলে এই বীজ অইবো না। যুদি অয় তয় হেইডার শক্তি থাকবো না। হেইডা হাতর পাইর‌্যা কেমতে ওর মায়ের রেহেমে যাইবো? কন...

- তাতো সত্য। কিন্ত্তু কোরআনে তো বর্ণিত আছেঃ

১. "ওয়া লাকাদ খালাকনাল ইনসানা মিন সালাসালেম মিন হামায়েম মাসনুন [সুরা হিজর আয়াতঃ ২৬]। আমরা মানুষকে গঠন করিয়াছি কর্দম হইতে, নক্সাকাটা নরোম মাটি হইতে।
২. ওয়া লাকাদ খালাকনাল ইনসানা মিন সুলালাতেম মিন তীন [সুরা মুমেনুন আয়াতঃ১২]। অর্থঃ আমরা গঠন করিয়াছি মানুষকে কাদামাটির বিশুদ্ধ সারভাগ হইতে।
৩. ফাইন্না খালাকনাকুম মিন তুরাবেন [সুরা হজ্জ আয়াতঃ৫] অর্থঃ আমরা তোমাদিগকে গঠন করিয়াছি (বা সৌষ্ঠবদান করিয়াছি) মাটি হইতে।

(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-শেষ পর্ব

(পন্ঞ্চম পর্বের পর হতে)
কথায় আছে না " যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয় "। মনার সাথে যখন কথোকথনে ব্যস্ত ছিলাম ঠিক সেই মুহুর্তে কলিংবেলের আওয়াজ পেলাম। দরোজা খুলে দেখলামঃ আজহার এসেছে। আমাকে দেখে বললোঃ

-কি রে তুই এতো তাড়াতাড়ি কোথ্থথেকে এলি? তোর না আজ একটা ইন্টারভিউ দেয়ার কথা। গেছিলি সেখানে...
কথা বলতে বলতে রুমের ভেতর প্রবেশ করেই আজহার মনা পাগলাকে দেখে চমকে উঠলো। বললোঃ

-এই আপদ কোথ্থ থেকে নিয়ে আসলি? .....তোকে না বলেছি যেনতেন লোক নিয়ে আমার রুমে আসবি না?

-দোস্ত শোন্...

-আরে রাখ তোর শোনাশুনি। এইসব পাগল ছাগল নিয়ে তুই কোন্ সাহসে আমার রুমে আসলি? তুই কি জানিস না..আমার এই রুমে কতো দামি দামি পোষাক আষাক আছে...কত কোম্পানীর গুরুত্বপুর্ণ ফাইল পত্র আছে? তারপরও তু্‌ই কোন্ সাহসে আনলি...

-দোস্ত শোন মনা পাগলা আর দশটা পাগলের মতো চোর ছেচ্চর না..সে নিতান্তই ভালো একটা মানুষ

-ওহ...এর মধ্যে নামও জেনে গেছিস? ও কি তোর বাপ লাগে...কথা নেই বার্তা নেই পাগল ছাগল একটারে ধরে নিয়ে আসবি..

-দোস্ত একটু শান্ত হ। আমার কথাটা শোন। তারপর তোর যা বলার বলিস..

আমি আজহারকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। সেটা শোনার পর আজহার তাকে এক্ষুণি বিদেয় করে দেয়ার জন্য বলে গেল। আর বলে গেল - আমি যেন ফিরে এসে ঐ পাগল ছাগলরে না দেখি..যদি কোন কিছু চুরি হয় তার জন্য তুই দায়ী থাকবি...আমি গেলাম..দরজা লাগা...

ঘটনার আকর্ষিকতায় মনা বেশ হতচকিত হয়ে পড়লো। সে বেশ শংকিত হয়ে পড়লো। কি করবে বুঝতে পারছে না। চলে যাবে না থাকবে....মনার দোটানা ভাব দেখে আমি মনাকে বললামঃ

-আপনি শংকিত হবেন না..ও একটু এরকমই..এসব একদমই পছন্দ করে না...

-নারে বাবা আর থাকার উপায় নাই। আমারে যাইতে হইব। 
মনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে
বাবারে আমাগো কোন জায়গাতে শান্তি নাই। মসজিদে গেলে মোল্লাগো লগে ঝগড়া লাগে...মাজারে গেলে শিন্নি খাইতে যাইয়্যা মারামারি করন লাগে...মন্দিরে গেলে পুরোহিতরা ঘেড়ি ধইরা বাইর কইর‌া দেয়। রাইতে ঘুমাইতে গেলে ঘুমের জায়গা লইয়্যা পারাপারি করন লাগে...যেন আমরা একটা বোঝা হইয়্যা গেছি। অনেকটা ফুটবলের লাহান। যে যহন পায় লাথ্থি মারে...আমাগো সমস্যার শেষ নাই...

কথা বলতে বলতে মনার গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।চোখের কোণে জলের ধারা কেমন যেন চকচক করে উঠে...নিজেকে সামলে নিয়ে মনা আবার বলা শুরু করে...

বাবারে..তোমার এইহানে আহনের পর বড়ো ভালো লাগছিল। জানি থাকতে পারুম না...আমরা কোন জায়গাতেই থাকতে পারি না...খাইয়্যা না খাইয়্যা অনাহারে অর্ধাহারে কতো দিন যে থাকন লাগে হেইডার কোন হিসাব নিকাষ নাই। আমাগো অপরাধটা কি? আমরা কি মানুষ ঠকাইয়্যা খাই? বরংণ্ঞ্চ মানুষই আমাগো ঠকাইয়্যা খায়। পাগলের ব্যাস ধইররা আমাগো ঠকায় আরেক পাগলরা। ওগো তামশা দেইখ্যা মানুষজন কামেল ভাইব্যা ভুলডা করে। এই বেরামের কোন চিকিৎসা নাই...

-আসলে আমি কি যে বলি...আজহার মানুষটা খুব ভালো। আমার কে আছে বলেন? আমারতো আপনার মতোই অবস্থা। আমারওতো থাকার জায়গা নেই। ও দয়া করে থাকতে দিয়েছে বলেইতো আছি। আজকের ঘটনার পর কি হয় বলা যায় না...তারপরও বলি...ও আসলে খুবই ভালো একজন মানুষ।

-বাবারে আমাগো ভালো মন্দ বুঝাইয়্যা লাভ নাই। মানুষের দরবারে পাগলদের মর্যাদা নাই। কিন্ত্তু মহান জাত পাক সুবহানের কাছে তার পাগলের মুল্য অনেক। ইচ্ছে করলেই কেউ পাগল হ্তই পারে না। কেউ তারে এ পথে নামাইয়্যা পাগল বানায়। যে বানায় সেই জানে সেই পাগলের মুল্য। তুমি মুল্য বিনিময়ে সত্যিকারের পাগল বানাইতে পারবা না। যতক্ষণ না সৃষ্টিকর্তা চাইবেন। যাইরে বাজান...ভালো থাকিস আর তোরে যা বলেছি মানলে মানিস, না মানলে না মানিস। জানতে চাইছস তাই বললাম।

এরপর সে তার পোটলা পুটলি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে গেল। আমি তার সাথে যেতে চাইলাম। সে বরণ করলো। অগত্যা কি আর করা...দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। 

রুমে এসে দেখি সেখানে এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে। হয়তো মনা মনের ভুলে সেটা ফেলে গেছে...কিন্ত্তু কি লেখা আছে সেই কাগজে? আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে লেখাঃ

"এমন অনেক উসকো খুসকো চুল ও ধুলা মলীন বিশিষ্ট ওলি আছে, যাদেরকে মানুষের দরজা থেকে বিতাড়ন করা হয়। অথচ তারা যদি আল্লাহর কাছে কিছু দাবী করে বসে, তাহলে আল্লাহ তাদের সেই দাবী অবশ্যই পুরণ করেন।(মুসলিম শরীফ)

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-পর্ব পন্ঞ্চম

(চতুর্থ পর্বের পর হতে)

আমি মনা পাগলার ঘুম ভাংগার অপেক্ষায় রইলাম। এক সময় তার ঘুম ভেংগে গেল। আর আমি বসে থাকতে থাকতে আমার ঘুম চলে এল। ঢুলুঢুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ খুলেই বললোঃ

-কি রে বসে আছিস?

-হ্যাঁ... কি করবো?

-তোর হাতে ওটা কি?

-বই।

-বই! কিসের বই? 

-দর্শন শাস্ত্রের একটা বই।

- ওহ...কিতাব...

কিতাবতো ভাই মানুষ নয়
নিত্য নতুন কথা কয়
ভবের ভাবুক হইয়া কেন কিতাব দেখ না।।
[সুত্রঃ হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) কর্তৃক প্রনীত চিশতী উদ্যান হতে সংগৃীত]

ভবের ভাবুক হইয়া কিতাব দেখ। ঐসব দর্শন ফর্শন পড়ে কিছুই পাবি না। যা পাবি তা হলো তোতা পাখি। অর্থাৎ মুখস্ত বিদ্যা দিয়া জগতে খ্যাতি কামাতে পারবি। সবাই তোকে জ্ঞানী বলে সম্মান করবে...ভাববে তুই অনেক জানলেওয়ালা হয়ে গেছিস। তোকে সবাই বেশ সমাদার টমাদর করবে। তোকে একটা গল্প বলি শোনঃ

একদিন এক দরবেশ বনের ধার দিয়ে কোন দুর দেশে যাচ্ছিলেন। সেই বনের পাখিরা সবাই বল্লাহ বল্লাহ বলে বেশ গুণ-গান করছিল। দরবেশ বল্লাহ বল্লাহ ডাকটি শুনতে পেয়ে পাখিটির উদ্দেশ্যে বললেনঃ তোমরা যে বল্লাহ বল্লাহ বলে ডাকছো..সেটা বল্লাহ বল্লাহ হবে না। সেটা হবে আল্লাহ। তোমরা আল্লাহ আল্লাহ বলে তারই গুণগান করো। পাখিরা সেই ডাক ভুলে দরবেশের দেয়া বল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহ আল্লাহ বলে ডাকতে লাগলো। সেই ডাক শুনে দরবেশ বেশ পরিতৃপ্ত হলেন। ভাবলেন বেশ ভালো একটি কার্য তার দ্বারা সমাধা হয়ে গেছে। তারা যেখানেই ডাকুক যেখানেই থাকুন তার ছোয়াব অবশ্যই তিনি পাবেন। পথিমধ্যে তিনি বেশ ক্লান্ত হয়ে একটা গাছ তলায় আশ্রয় নিলেন। এবং কিছুদিন এখানে এবাদত বন্দেগী করে কাটাবেন বলে মনোস্থির করলেন। তিনি সেই গাছতলাতেই ধ্যানমগ্ন রইলেন। একদিকে সেই পাখিটার মুখে বল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহ ডাক শুনে অন্যান্য স্বজাতীয় পাখিরা ঘাবড়ে গেল। বললোঃ তুই এই আল্লাহ কোথ্থথেকে এনেছিস? পাখিটি বললোঃ এক দরবেশের কাছ থেকে এনেছি। তারা বেশ অবাক হলো। কিছুদিন পর সেই দরবেশ দেখতে পেলেন যে, সমেত পাখিরা গাছের ডালে মাথা ঠুকছে। তিনি জিগ্যেস করলেন, তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা এমন করছো কেন? পাখিরা বললোঃ তুমি আমাদের কি নাম শেখালে? আমরা তো সব ভুলে গেছি। আগে যা বলে প্রাণখুলে ডাকতাম, তাওতো ভুলে গেছি? যখন আমরা তাকে আমাদের ভাষায় ডাকতাম তখন আমাদের রব আমাদের কথা শুনতেন। এখন তিনি আমাদের কথা শুনছেন না। তাই আমরা পেরেশান হয়ে মাথা ঠুকছি। দরবেশ বললেনঃ তোমরা প্রথমে বল্লাহ বল্লাহ বলে ডাকতে। আমি তোমাদের বল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহ ডাকতে বলেছি। এমন সময় এলহাম এলোঃ হে দরবেশ! এই পক্ষীকুল যতবার আমাকে "বল্লাহ " নামে ডেকেছে , প্রতিবারই আমি তাদের সুমধুর ডাক শুনেছি আর আমি সাড়া দিয়েছি  কারণ তারা আমাকে মন থেকে ডেকেছে ! আমি সবার মনের খবর জানি ! কাজেই তারা আমাকে "আল্লাহ" বা "বল্লাহ" যে নামেই ডাকে আমি তাদের ডাক শুনি ! "আমাকে ডাকতে চাইলে প্রাণ খুলে ডাকতে হবে ! সেটাই বড় কথা !"
দরবেশ নিজের ভুল বুজতে পেরে আল্লাহর দরবারে লজ্জিত হলেন এবং ক্ষমা চাইলেন আর পাখিদের বললেনঃ"তোমরা প্রভুকে যেভাবে ডেকে শান্তি লাভ কর , সেভাবেই ডাক " !!

-আপনি যে গল্প শোনালেন, সেটাতো আপনিই আমার অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে চাইছেন।

-না রে বোকা...দর্শন মনকে ভাবিয়ে তোলে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তোলে..কোন সমাধান দিতে পারে না...যেটা কোন সমাধান দিতে পারে না...সেটা কিভাবে তোকে কুলে তরী ভেড়াবে?

-কুলে তরী ভেড়াবার জন্যইতো দর্শন উপযুক্ত বিষয়। সমস্ত দার্শনিকগণ তো তাদের বাস্তব উপলব্দ জ্ঞান আরোহন করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। অামরা তো সেইটাই পড়ে জানতে চেষ্টা করছি।

-শোন দর্শন প্রত্যেকটি মানুষের মনের ভেতরই আছে। মনের ভেতর যে দর্শন লুকিয়ে আছে তাকে জানার চেষ্টা করাটাইতো সবচেয়ে বড়ো দর্শন। তাছাড়া দার্শনিকগণের মনে যে প্রশ্নের তথা ভাবের উদয় হয়েছে, তা কোথা থেকে উদয় হয়েছে? এই মন থেকেইতো উদয় হয়েছে। মনের বাইরে থেকে নয়। বস্ত্তু দেখে জ্ঞান লাভ করাটাই সত্য জ্ঞান। এই সত্য জ্ঞান তোর ভেতরেই আছে। 

মনার কথা শুনে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। সে আবার কোন্ দর্শনের কথা বলছে? আমার দর্শন আমার ভেতরই লুকিয়ে আছে? তো কোথায় সেটা? সেটা তো জানতে হবে। কিভাবে মনাকে প্রশ্ন করি? 

মনা বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে। তার বসার ভংগীটা সাধু সন্ন্যাসীদের মতো। পায়ের ভাঁজে পা রেখে বেশ আয়েশ করেই বসেছে। বাবা লোকনাথের ছবিতে দেখেছি এইভাবে বসতে।  আমি তাকে প্রশ্ন করলামঃ 

-এই যে বললেনঃ সত্য জ্ঞানের কথা..যা আমার ভেতরই লুকিয়ে আছে? সেটা কোথায় লুকিয়ে আছে?

-সেটা লুকিয়ে আছে তোর হৃদয়ের মাঝে। মনের মাঝে। তাকে পাবার জন্য সাধনা করতে হয়। সবকিছু বাদ দিয়ে তুই সাধনার পথে এগিয়ে চল। তুই কেন সাধনা করবি? না, পরমপুরুষ চাইছেন, তাই সাধনা করবি। এই যে পরমপুরুষের ইচ্ছা- এই ইচ্ছারপুর্তির জন্যেই সাধনা করবি। আর সেই সাধনা করবার সময় দেখবি যে পরমপুরুষ হয়ে যাচ্ছে তোর মনের বিষয় আর তুই হয়ে যাচ্ছিস তাঁর বিষয়ী। মানুষ হয়ে যায় কর্তা (Subject) আর পরমপুরুষ হয়ে যান কর্ম (object) । যদিও পরমপুরুষ চরম সত্তা (Supreme Subjectivity), সব কিছুর নিয়ন্ত্রী সত্তা, সব কিছুর পরিচালক সত্তা।

পরমপুরুষ হলেন সব কিছুর বিষয়ী আর মানুষ হ’ল তাঁর বিষয়। এমনিতে মানুষ পরমপুরুষকে মনের বিষয় বানাতে পারে না। এই জন্যে যখন তুই তাঁর জপ বা ধ্যান করবি, তখন মনে এই ভাবটা রাখবি যে তুই তাঁর বিষয় আর পরমপুরুষ তোর বিষয়ী। অর্থাৎ ধ্যানে তুই পরমপুরুষকে দেখছিস না, পরমপুরুষ তোকে দেখছেন। ভাবনাটা এমনই হওয়া উচিত- অতীতেও আমার উপর পরমপুরুষের নজর ছিল, আজও রয়েছে, আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আমি কোন অবস্থাতেই একলা নই, নিঃসঙ্গ নই। যতক্ষণ এটা আমার মনে থাকবে যে পরমপুরুষ আমায় দেখছেন, ততক্ষণ বিশ্বের কোন শক্তিই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেবল এতটুকুই নয়, আব্রহ্মস্তম্ব ব্রহ্ম অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা থেকে শুরু করে একটা ঘাসের পাতা পর্যন্ত সব কিছুই তোর সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কেন না, পরম পুরুষের বিধানই এই যে জীব পরস্পর মিলেমিশে এই পৃথিবীতে বাস করুক; কেউ যেন কারুর উপর অবিচার বা অত্যাচার না করে; আর যাকে যতটা শক্তি দেওয়া হয়েছে সে যেন ততটা শক্তির সদ্ব্যবহার করে।

এখন, পরমপুরুষের কাছ থেকে যতটা শক্তি পেয়েছিস, আর সেই সঙ্গে আর যা’ যা’ পেয়েছিস, সব কিছুকে পুরোপুরি কাজে লাগা। তারপর যখন তোর শক্তি-বুদ্ধি-সিদ্ধি কোন কিছুই থাকবে না, তখন পরমপুরুষ তোর প্রয়োজন বুঝে তোকে সব কিছুই দেবেন। এই জন্যে মানুষের পরমপুরুষের কাছে ‘এটা দাও’, ‘ওটা দাও’ বলে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আর সেই সঙ্গে এই কথাটা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে মানুষ অবশ্যই কখনো একলা নয়। তাই মানুষের কখনো ভীত বা শঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। ‘আমার কী হবে গো’, ‘আমার কী হবে গো’, – এ ধরণের চিন্তা একেবারেই বাজে চিন্তা। যা হবে পরমপুরুষ দেখবেন ও প্রয়োজনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। যেমন ছোট্ট শিশু নিজের সম্বন্ধে একেবারেই ভাবে না, যা’ ভাববার তা’ সেই শিশুর মা-বাবা ভাববেন ঠিক তেমনই তোর নিজের ব্যাপারে তুই কোন কিছুই ভাবিস না। তোর সম্বন্ধে পরমপুরুষকে ভাবতে দে। তুই শুধু নির্ভয়ে , নিঃশঙ্ক চিত্তে ও সানন্দে নিজের কর্ত্তব্য করে যা। দেখবি , পরমপুরুষ তাঁর স্নেহের পুত্র-কন্যাদের জন্যে যা কিছু করবার অবশ্যই করবেন।

কারুর মনে কোন প্রকার হীনমন্যতা থাকা উচিত নয়। তুই কারো চেয়ে ছোট নস, কারো চেয়ে হীনও নস। আর একটা কথাঃ পিতার কাছে তার পুত্র-কন্যারা সমান আদরের, সমান স্নেহের। কন্যা পুত্রের চেয়ে বা পুত্র কন্যার চেয়ে কোন অংশে হীন নয়। উভয়েই সমান। কেউ যদি কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তো বুঝতে হবে, সে পরমপুরুষের বিরুদ্ধাচরণ করছে, তাতে তার নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনছে।
(চলবে)

মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-পর্ব চতুর্থ

(তৃতীয় পর্বের পর হতে)

দেখতে দেখতে আমরা মীরপুরের ঝুট পট্রিতে এসে পড়লাম। ঝুটপট্রিতে সাধারণতঃ গার্মেন্টেসের ঝুটের ব্যবসা হয়। সাধারণ ব্যবসায়ীরা গার্মেন্ট হতে ঝুট কিনে এনে এখানে বেছে বুছে শার্ট-প্যান্ট, মেয়েদের বিভিন্ন ধরণের আইটেম বিক্রি করে। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে পাইকারী কিনে বিভিন্ন স্থানে খুচরা বিক্রি করে। আমার বন্ধু আজহার এই ঝুটের ব্যবসা করে। তারই আশ্রয়ে রুমের কোণে বিছানা পেতে আমি থাকি। ভাড়া বলতে নাম মাত্র। আমার তেমন কেউ ঢাকায় পরিচিত নেই। তাছাড়া আর কোন আশ্রয় আমার নেই। আমি মনাকে নিয়ে সেই রুমের মধ্যে গেলাম। মনাকে আমার বিছানায় বসতে দিলাম। ভাগ্যিস আজহার এই সময় থাকে না। থাকলে হয়তো নানান র্কীতি করতো। কেন এনেছি? কি হয় আমার? যদি কোন চুরি হয়? কিংবা কে জানে হয়তো ভন্ড প্রতারক। ভান ধরে পড়ে থাকে...ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্নে জর্জরিত করতো। ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে। যাই হোক..মনাকে আমি আমার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। মনা সেখানে আরাম করে শুইয়ে রইলো। 

মনাকে শুইয়ে রেখে আমি ফ্যানটা ছাড়লাম। মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে। কেন যেন এই লোকটার প্রতি আমার মায়া পড়ে গেছে। লোকটাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তার মধ্যে একটা দার্শনিক মন কাজ করছে। এই মন কেবল মনাকেই বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। কেন করে? সেইটা একটা প্রশ্ন। আমি মনার দিকে তাকালাম। তার চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা মায়া আছে...

অামি বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ম্যাচের কাঠিটা ছুড়ে ফেলতে যা'ব ঠিক তক্ষুণি মনে হলো মনার কথা।...পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ..আমি কাঠিটা হাতের কাছেই রাখলাম। আর সিগারেটের ছাই ফালাবার জন্য এসট্রেটা ব্যবহার করলাম...সিগারেট টানছি আর ভাবছি মনার কথা....বলেছিল

এই যে তুই আমাকে দেখছিস...বাস্তবিকই কি তুই আমাকে দেখছিস...না-কি অন্য কাউকে দেখছিস? তোর ভেতর যে আছে সে আমার ভেতরও আছে। তাহলে কে কাকে দেখছে....যে চোখ দিয়ে তুই আমাকে দেখছিস...দৃষ্টিটা তোকে বিভ্রান্ত করে বলেই তুই তার স্বরুপটা ধরতে পারছিস না...যেমন ধর আমরা একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলে কি করি? সালাম দেই...বলি আসসালামুআলাইকুম...উত্তরে সে বলে ওয়ালাইকুম আস সালাম...কে কাকে দেখলো...কাকে দেখে কে কার প্রতি সালাম দিল ও প্রতিউত্তর দিল? রহিম সাহেব করিম সাহেবকে দেখে সালাম দিল। করিম সাহেব জবাবে রহিম সাহেবের প্রতিও সালাম দিল...বিষয়টা আপেক্ষিক...দুটি বস্ত্তুর মধ্যে একই বিষয় ক্রিয়া করছে...দুই জনের ভেতরেই লাবডুব করে বাজছে। প্রশ্নটা হলোঃ দৃষ্টির কারণে ভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে..দৃষ্টিটা তাকে তার বাহ্যিক দিকটা দেখাচ্ছে। ফলে ভেতরটা অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে..মানে হলো দৃষ্টিটা প্রতারিত করছে...তাই নয় কি? বুঝি না...

আবারো সিগারেটে টান দিয়ে মনার দিকে তাকালাম। কি নিশ্চিত মনে ঘুমাচ্ছে...হয়তো এমন আরাম করে কখনো ঘুমিয়েছে কি-না সন্দেহ আছে? বিষয়টা এমন না যে আমার বিছানা ফুলশষ্যা। তেলচিটচিটে বালিশ আর দুটি কাথা কম্বল দিয়ে একটু উচু করে পাতা। তোষকের পরিবর্তে দেয়া আর কি? আমিতো ঘুমাই ঠেকায় পড়ে...ম্যাছে থাকতে হলে এরচেয়েও ভালো ভাবে থাকা যায়। কিন্ত্তু আমার সেই সাধ্য নেই। ইনকামের অবস্থা খুবই করুণ। দুটা টিউশনি করি...যা পাই তা দিয়েই চলে যায় কোন মতে...

আমি সিগারেটটা শেষ করে অবশিষ্টাংশ বাইরে ছুড়ে ফেললাম..আবারো মনে হলো মনার সেই পুরোনো কথা...আমি দেখলাম মনা কেমন যেন করে উঠলো...তাকিয়ে দেখলাম সে ঘুরে আবারো শুয়ে পড়লো। আমি তার পাশেই হেলান দিয়ে একটি বই বের করলাম। বই মেলা থেকে কিনেছি। নামঃ ইবনুল আরাবী ও মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী।বইটা পড়া শুরু করলামঃ 

'ওয়াহাদাতুল ওজুদ' শব্দের অর্থ ধর্মীয় দর্শনের ভাষায় সত্তার ঐক্য, ঐক্যনীতি, অদ্বৈতবাদ বা সর্বেশ্বরবাদ। তাঁর 'ওয়াহাদাতুল ওজুদ' মতবাদ অনুসারে সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তাসমুহের মুল সত্তা একটি। এই সত্তা ধর্মীয় ভাষায় আল্লাহ। আল্লাহ একমাত্র পরম সত্তা। তিনি বিশ্ব মাঝে ব্যাপ্ত আছেন। এই বিশ্ব জগৎ আল্লাহ সত্তাময়, আল্লাহর নাম ও গুণের প্রকাশ, আল্লাহ ও বিশ্বজগত অভিন্ন। 

ওয়াহাদাতুল ওজুদ মতবাদকে সাধারণভাবে সর্বেশ্বরবাদ বলা হয়। কারণ, এর মধ্যে আল্লাহ ও বিশ্বে যেন কোন ভেদ নাই। সমগ্র বিশ্বজগতই যেন আল্লাহ এবং আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগত। তার মতে আল্লাহ বিশ্বজগতে ্ এবং বিশ্বজগত আল্লাহয় অবস্থিত, সমগ্র বিশ্বজগত আল্লাহ কিন্ত্তু সমগ্র আল্লাহ বিশ্বজগৎ নয়। তার মতবাদ যে দৃষ্টিভংগী হতে গড়ে উঠেছে তা স্পিনোজীয় দৃষ্টিভংগী হতে অনেকাংশে ভিন্ন ধরণের।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম...মনা যে কথা বলেছিল-তা ইবনুল আরাবীর সর্বেশ্বরবাদকেই পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে। তার মানে কি? আমিতো বইটাতে পড়ে পেলাম...মনা পেল কিভাবে? সে কিভাবে জানলো...মনার প্রতি আমার কৌতুহল বেড়ে গেল...আমি তাকালাম মনার দিকে...সে তখনো ঘুমাচ্ছে...আমি তার ঘুম ভাংগার অপেক্ষায় রইলাম...

(চলবে)

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-পর্ব তৃতীয়

(দ্বিতীয় পর্বের পর হতে)

-সেই কখন থেকেইতো বলছেন তারপর শুরু হইলো আসল ঘটনা। আসল ঘটনাটাতো কিছুই বলছেন না?

-আরে অতো অধৈর্য্য হইস না...বলছি তো। শোন..

জুতা জোড়া যখন বাইরে ছুইড়্যা মারলাম তখন সেইটা লাগলো অন্য আরেকজন মুসল্লির গায়। সে তখন বেশ রেগে গিয়েছে। কোন দিকপাশ না চেয়ে সে আমাকে একটা ঘুসি দিল। সেই ঘুষিরটা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে অামি পরে যাই পাশে বসে থাকা অন্য আরেকজন মুসল্লির উপর। শুরু হলো হুড়োহুড়ি। মারামরি। কোলাহলে কোন্দলে শান্ত স্নিগ্ধ মসজিদটা হয়ে উঠলো অশান্ত। কথা কাটা কাটি, ধাক্কা ধাক্কি। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য মুসল্লিরা ঘাড় ধরে আমাকে মসজিদ থেকে বের করে দিল। তাদের ধারণা, দোষটা নাকি আমার। আমি যদি জুতাটা সামনে রাখতাম, তাহলে নাকি এই ঘটনা ঘটতো না। কিন্ত্তু আমি জুতা সামনে রাখবো কেন? 

-আহা জুতা জোড়া সামনে থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো? রাখলেই তো পারতেন? এতটুকু সহনশীলতা দেখালে তো আপনাকে এত কিল ঘুসি থাপ্পর খেতে হতো না.... 

-ভাইরে মসজিদ হইতাছে সেজদার জায়গা। মসজিদ এর মুল হইল সজিদ তথা সেজদা। সেজদা অর্থ আত্মসমর্পণ। সেজদা কারে দেয় জানস? জানস না। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্যেই সেজদা দেওন লাগে। কেন লাগে? কারণ তুই, আমি আমরা সবাই তারই সৃষ্টি রাজ্যে বাস করি। তার রাজ্যে বাস করে তারই দেয়া রিজিক আমরা খাই। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যেই সেজদা দিতে হয়। আর সেই সেজদা দেওনের সময়, যদি সামনে জুতা থাকে, তাহলে মনের মধ্যে শিরিকের সৃষ্টি হয়। মনটা হইয়া যায় দো'মনা। সেই মন নিয়া সেজদা দিলে মোনাফিকির সৃষ্টি হয়।

-কি বলছেন আবল তাবল...তাহলেতো সব মুসল্লীরাই...

-ভাই, শোন..রাগ করিস না। একটু ভেবে দেখ....বোখারী শরীফের একটি হাদিসে আছেঃ "তুমি এমন ভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তুমি তাকে দেখতে পাও। আর যদি তা না পারো...তাহলে মনে মনে চিন্তা কর..আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।" এমন হাদিসতো আমরা প্রায়ই ইমাম সাহেবদের মুখে শুনি। সেইটাই যদি ধরি, তাহলে দেখ্...ইমাম সাহেব যখন সুরা ফাতেহা পাঠ করে বলে..."ইয়া ক্যা'না বুদু ওয়া ইয়া ক্যা'নাস্তাইন...আমরা তোমরই ইবাদত করি এবং তোমার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি..সেই সময় যদি জুতাটা সামনে থাকে..তাহলে সেই সময় তুই কাকে দেখছিস, কার কাছে সাহায্য চাচ্ছিস...মুখে বলছিস স্রষ্টার কথা আর অন্তরে চিন্তা করছিস তোর জুতার কথা...দেখছিস জুতাটা..ঠিক আছে না-কি কেউ নিয়ে গেছে...এইটা কি মুনাফেকী না...এইটাকে তুই কি বলবি?

তারপর ধর...মসজিদকে অনেকেই বলে আল্লাহর ঘর। সেইটা মস্তবড়ো ভুল। অাল্লাহর ঘর হলো বাইতুল্লাহ...মসজিদ হলো ইবাদত বন্দেগীর স্থান। যেখানে বসে ইবাদত বন্দেগী করা হয়। যারা ইবাদত বন্দেগী করে, তাদের বলা হয় মুসল্লি। শব্দগত অর্থ যদি ধরিস তাহলে দেখ... মসজিদ মুল সজিদ তথা সেজদা। ইবাদত যার মুল আবদ অর্থ দাস। বন্দেগী অর্থ বন্দনা করা তথা প্রশংসা কীর্তন করা। গুণ-গান করা। মুসল্লী হলো শান্তিকামী। যে কোন ব্যক্তি যদি স্রষ্টার সর্বশক্তিমান অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কিংবা অনুধাবণ করে তারই গুণ-গান করার জন্য যে স্থানটিতে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে তার মাথাটা স্রষ্টার প্রতি অবদমন করে, সেটাই হয় সেজদা। যে স্থানটিতে করা হয় সেটাকে বলা হয় মসজিদ। সেটাকে তো পাক পবিত্র হওয়া বান্ঞ্চনীয়। নয় কি? 

তোরা তো কথায় কথায় বলিস...পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক। তাই না?

-হ্যাঁ বলি। এটাতো হাদিসেই আছে...

-মানিস?

-কেন মানবো না? একশো বার মানি...

-তোরা মানিস ঘোড়ার ডিম। মানলে দেশের এই অবস্থা হয়? প্রতিটি রাস্তা-ঘাট ময়লা আবর্জনায় পরিপুর্ণ। ময়লা দুঃগন্ধযুক্ত। পরিবেশ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। নাকে রোমাল চেপে হাঁটতে হয়। অথচ দ্যাখ, কি আশ্চর্য্যের বিষয়...বাংলাদেশ একটা মুসলিম রাষ্ট্র। সেই মুসলিম রাষ্ট্রটা যদি এই হাদীসটাই মানতো..তাহলে প্রতিটি রাস্তা ঘাট ঝকঝকে তকতকে থাকার কথা...হাদিসটার কথা ধরলে ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায়...বিপরীত দিকে তাকা, যাদের কে বলিস ইহুদী নাসারা তাদের দেশে যেয়ে দেখ...রাস্তা-ঘাট কতো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন...হাদিসটা তোরা বলিস মানে ওরা...প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রেই এই একই অবস্থা...

কথাটা শুনে মনাকে কি বলবো? আমি নিজেইতো পরিস্কার রাখি না আমার রুমটা। বিছানা পত্র। বালিস...সবকিছুই এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো থাকে। কলা খাই তো খোসাগুলো ড্রেনের ভেতর ফেলে দেই কিংবা এখানে সেখানে। বাজার করে নিয়ে আসলে পলিথিনটা ছুঁড়ে ফেলে দেই..জানালা দিয়ে রাস্তার ধারে...সিগারেট খেলে ছাইপাশতো যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি। তার মানে আমার ঈমান দুর্বল ঈমানের লক্ষণ..কি বলবো বুঝতে পারছি না...

আমি মনার দিকে তাকালাম..দেখলাম সে থুতনিতে হাত দিয়ে ক্ষতস্থানটা বুলাচ্ছে। কথা বলতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে...। আমি আর কোন কথা তাকে জিগ্যাসা করলাম না...শুধু রিক্সাওয়ালাকে বললাম...এ্যাই ডান দিকে যাও...

আমার দিকে তাকিয়ে মনা বললোঃ

-আমার দুঃখ কি জানিস?

-এখন কোন কথা না। পরে বাড়ীতে যেয়ে শুনবো...প্লীজ...

(চলবে)

শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-দ্বিতীয় পর্ব

(প্রথম পর্বের পর হতে)

মনা রিক্সাটির একপাশে হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করলোঃ

-তুই তো জানিস আমি তেমন নামায টামাজ পড়ি না। মাঝে মাঝে মনটা টানলে হয়তো মসজিদে যাই। তাও কদাচিৎ। তো সেদিন আমি গেছি মীরপুর মাজারে। মাজারের পাশেই একটা নির্জন জায়গায় বসে আছি। সেই সময় মাজার কমিটির লোকজন সবাইকে জুম্মার নামাজে আসার জন্য দারোয়ানকে বলে দিল। দারোয়ান সবাইকে বলছিল যথারীতি। আমিও শুনলাম সেই কথাঃ ওই সবাই আউসক্যা জুম্মার নামাজ পড়বি। নাইলে কইলাম খবর আছে? সেই কথা শুনে আমার মনটা চাইলো মসজিদে যাই। নামায পড়ি। কিন্ত্তু আমার যে বেশ ভুষা তাতে নামায হয় কিনা সন্দেহ আছে? কিন্ত্তু কি করবো? মাজার কমিটির হুকুম। না মানলেতো থাকতে দিবে না। অগ্যতা গেলাম।

যেই অযুখানায় গেছি অযু করতে অম্মনিই একজন বললোঃ আইগ্যা হোছে না, মুইত্যা লয় পানি। হালারপো আইছে নামাজ পড়তে? ঐ ব্যাটা তুই কি জানস না, জুম্মার দিনে নামায পড়তে আসলে অজু গোসল লাগে? ভালো জামা কাপড় পইড়্যা আহন লাগে...এই ছালার জামা পইড়্যা কি নামায অয়?

লোকটির কথা শুনে কিছু বলতে চাইছিলাম। কিন্ত্তু পরক্ষণেই গুরুর আদেশ পেয়ে কিছু বললাম না। গুরু নিষেধ করলো তর্ক করার জন্য। 

-গুরু নিষেধ করলো মানে? আপনার গুরু কি সেই সময় উপস্থিত ছিল?

-ছিল মানে? সেতো সবসময়ই উপস্থিত থাকে। তাকে যারা চিনে তারা তার উপস্থিতি সর্বত্রই টের পায়। তো শোন এরপর কি হলো-

মনা তার কথা আবার বলা শুরু করলোঃ

তাদের কথা শুনে আমি চুপ চাপ অযু করছিলাম... কোন কথা বলছিলাম না..

আমাকে অজু করতে দেখে অনেকেই বেশ উৎসাহ বোধ করছিল। কেউ হয়তো ঠাট্রা বিদ্রুপ করছিল...কেউ টিটকারি মারছিল। কেউ বা কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। আমি অযু করা শেষ করে মসজিদের ভেতরে গেছি। আর তারপরই শুরু হলো আসল ঘটনা...

কথা থামিয়ে একপর্যায়ে মনাকে দেখলাম সে তার গালের পাশটাতে হাত দিয়ে ব্যথাটা জানান দিচ্ছে।  ক্ষতস্থানটিতে হাত বুলাতে লাগলো। মনে হলো তার ব্যথা যেন এখনো পুরোপুরি যায়নি। মনে হচ্ছে কথা বলতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। তাকে আমি আর জোড় করলাম না। সে আবারও বলা শুরু করছে-

ইমাম সাহেব কাবলাল জুম্মা আদায় করার জন্য মুসল্লিদের আহব্বান জানালেন। অামি নামায পড়ার জন্য যেখানে দাঁড়িয়েছি সেখানে দেখলাম একজন মুসল্লি তার জুতাজোড়া সামনে রেখে দিল। আমি সেটা নিয়ে দুরে সরিয়ে রাখলাম। আর তখনোই বেঁধে গেল গোলযোগ। সে তার জুতাজোড়া আবারো সামনে এনে রাখলো। আমি সরিয়ে রাখলাম। তারপর সে চেঁচিয়ে বলতে লাগলোঃ

-ওই ব্যাটা কি হইছে? হ্যাঁ...খালি বার বার জুতাগুলি সরায় রাখস?

-ভাই সেজদা দেওনের সময় মাথায় জুতাটা লাগবো? তাই সরিয়ে রাখলাম

-সাইট দিয়া রাখ..

-ভাই আপনার পাশ দিয়া রাখেন..

-কেন্ এই পাশে রাখলে সমস্যা কি?

-সমস্যা আছে। আপনার জুতা আপনার পাশ দিয়ে রাখেন। আমি এখানে রাখতে দিব না..

-জুতা এইখানেই থাকবো..দরকার হইলে...

আমার জেদ চেপে যাওয়ায় আমি জুতা জোড়া নিয়ে দুরে ফেলে দেই। তারপরই শুরু হয় আসল ঘটনা....

(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ - প্রথম পর্ব

তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি রাগ করিও না। একটু বুঝে চলার চেষ্টা করো। কারণ, এই যে আমাকে দেখছো? তুমি কি সত্যিই আমাকে দেখছো? না-কি অন্য কাউকে দেখছো? একটু ভেবে উত্তর দেবার চেষ্টা করবে। আর আমার হাল দেখে তুমি বিচলিত হইও না। কারণ তুমি একা নও। এই জগতে কেউ একা নয়। কেউ একা থাকে না। থাকার চেষ্টা করলেও পারে না। একটা সময় দেখবে-তুমি হয়তো কোন একটা কারণে সম্পুর্ণ একা হয়ে গেছো। কারো কাছ থেকে সাহায্য সহযোগীতা পাচ্ছো না। কেউ তোমার দুঃখ বোঝার চেষ্টা করছে না। ভাবছো, তুমি একা হয়ে গেছো? নিঃস্ব, অসহায়, এবং সম্বলহীন একজন হয়ে গেছো? না...না...তুমি কখনোই একা নও। তোমার গুরু তোমার পাশেই রয়ে গেছে। তুমি টেরই পাওনি। যিনি তোমাকে দয়া করে বাচিয়ে রাখছেন, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন একটা কারণ রয়ে গেছে যা তুমি জানো না। তার যা ইচ্ছে হয়, তা তিনি করতেই পারেন। তার ইচ্ছের বিপরীতে তুমি চলার চেষ্টা করো না। পারবে না....কারণ তার দয়ার বারিধারা তোমার উপর পতিত হয়েছে....

আমি মনা পাগলার কথা শুনে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, তার চেহারা। মুখের একটা অংশে কালো শিটকে দাগ পড়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে হয়তো। এখনো ক্ষাণিকটা রক্ত শুকিয়ে দাগটা স্পর্শ করে তুলেছে। হাতের দিকে তাকাতেই শিউরে উঠলাম। বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে অনেক বড়ো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে অনর্গল রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তা দেখে আমি সান্তনার স্বরে বললামঃ

-আপনাকে তো এখনই ডাক্তার দেখানো উচিত। রক্তটা বন্ধ না হলে তো আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন। তাছাড়া আপনাকে এটিএস দিতে হবে। নয়তো ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে?


আমার কথা শুনে তিনি তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বললেনঃ

-যিনি আমাকে জীবন দান করেছেন, তিনি চাননি যে অামি চলে যাই? যদি চাইতেন, তাহলে সেইখানেই আমাকে শেষ করে দিতে পারতেন। যেহেতু তিনি চাননি, তাই তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন। মহান গুরু, তার কৃপা ধন্য এ দাস কেবল তারই আজ্ঞাবহ...সে সেভাবেই কাজ করতে চাইছে....

আমি তার কথা শেষ হতে না দিয়েই হড় হড় করে টেনে নিয়ে গেলাম ধারের কাছের কোনো একটা ডিসপেন্সারীতে। সেখানে গিয়ে তার হাতটা ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ করে দিল। আর তাকে একটি এটিএস ইনজেকশন দিয়ে দিল। রক্ত পড়ায় সে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে।  টাকা পরিশোধ করে আমরা বের হয়ে এলাম। দেখলাম মনার হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তাকে কিছু খাওয়ানো দরকার। একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে দুটি চিকেন বার্গার আর কোল্ড ড্রিংস এর অর্ডার দিলাম। দোকানী আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার অবাক হবার কারণ নিশ্চয়ই মনা। ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। আর আমি ঢুকেছি একটা পাগলকে নিয়ে। অবাক হবারই কথা।

মনা আর আমি খাওয়া শেষ করে রাস্তায় বের হয়ে এলাম। ভাবলাম, কোথায় যাওয়া যায়? তার বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্ত্তু তাকে কোথায় নিয়ে রাখবো? আমার নিজেরইতো থাকার জায়গা নেই। এই অবস্থায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে? শেষে সিধান্ত নিলাম। নাহ্ মেসেই ফিরে যাব। আমি একটা রিক্সাভাড়া করলাম। তারপর দুজন উঠলাম সেই। রিক্সায়। আমি রিক্সায় উঠেই মনার কাছে জানতে চাইলাম-কি হয়েছে?

আমার কথা শুনে মনা বললঃ

-তেমন কিছুই হয়নি। 

-তেমন কিছু না হলে আপনার এই অবস্থা হয়? 

-ধুর পাগল! গুরু সহায় ছিল বলেইতো তোকে গুরু আমার কাছে পাঠিয়েছে..

-ঐসব কথা রাখেন। সত্য করে বলেনতো, কি হয়েছিল?

-বললাম না? তেমন কিছুই হয়নি।

-আবারো শুরু করেছেন?

এবার একটু রাগত স্বরে বলায় মনা বললো তাহলে শোন
(চলবে)

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা-শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

করিম সাহেব রিক্সাতে উঠতেই রিক্সাওয়ালা টানা শুরু করে দিল। টুনটুন করে কয়েকবার বেল বাজিয়ে কাদের যেন সর্তক করলো। ভাংগা চোরা রাস্তাতে রিক্সার ঝাঁকুনির মাত্রা বেড়ে গেল। করিম সাহেব জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন একটা কোণে। শীতের দাপটে তিনি রীতিমতো ঠক ঠক করে কাঁপছেন। রিক্সার হুট ধরবেন কখন? ঝাকুনিতে তিনি প্রায়ই পড়েই যাচ্ছিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ধমকের সুরে রিক্সাওয়ালাকে বললেনঃ

-আরে একটু আস্তে চালা না বাপ? বুড়া মানুষ। এই রাইত বিরাইতে যদি রাস্তার মধ্যে পড়ি তাইলে কি উপায় আছে?

-চাচা মিয়া। একটু শক্ত হইয়া বসেন। রিক্সাটা মাটির রাস্তা ছাইড়্যা মেইন রাস্তায় উটলে আর কোন ঝামেলা থাকবো না। টাইন্ন্যা চইল্যা যামু গা। মেলা রাইত হইছে।

-হেইড়া নাইলে বুঝলাম। তাই বইল্যা কি এত জোরে টানা লাগে...বেশি জোর খাটাইলে তো কাহিল হইয়্যা যাইব্যা মিয়া..বোঝো না ক্যা...

-আরে আপনে চুপ কইর‌্যা বহেনতো....খালি পেচ্যাল পাড়তাছে...

করিম সাহেব অগত্যা চুপ করে চাদর মুড়ি দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে শক্তভাবে বসে রইলেন। দুপাশে তখন ঘন কুয়াশা। সবে মাত্র কামারগাঁও বাজারে আসছে। দোকান পাট সব বন্ধ। রাস্তায় অবশ্য লাইট জ্বলছে। কিন্ত্তু সে আলো ম্লান দেখাচ্ছে। সবকিছু ছাপিয়ে কুয়াশা তার চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। রিক্সার নিচে হ্যারিকেনের আলোয় মুল রাস্তাটা কেমন যেন দেখাচ্ছে।রিক্সাটা হেলে দুলে চলছে। বলেছিল টানের চোটে সে মান্দ্রা চলে যাবে। কিন্ত্তু শীতের দাপটে সেও কেমন কাবু হয়ে গেছে। করিম সাহেব আকাশের পানে তাকালেন। দেখলেন...আকাশটা বেশ পরিস্কার। চাদটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্ত্তু তারপরও কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে...

যে বিধাতা এত সুন্দর করে তার প্রকৃতিকে সাজাতে পারে সে নিশ্চয়ই আরো সুন্দর। কেন নয়। তিনিতো বলেছেনঃ মানুষকে তিনি তার অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে মাঝে মাঝে যে কিছু কুৎসিত মানব দেখা যায়, সেই অবয়বও কি তিনিই সৃষ্টি করেছেন। যদি ধরে নেয়া হয়, তিনিই সৃষ্টি করেছেন। অন্য কেউ নয়। কারণ লা মউজুদা ইল্লাল্লাহ...অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কিছুই নেই। সবই আল্লাহময়। তাহলে তো নানান সমস্যায় পড়তে হয়। নানা প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দেয় মনের মধ্যে। মনের যে কেন্দ্র বিন্দু, সেই কেন্দ্র বিন্দুতে কে অবস্থান করে? কে প্রশ্ন করতে শেখায়? কে ভাবিয়ে তোলে? এই যে নীরবতা..এই যে নিশ্চুপ প্রকৃতি...হাজার হাজার বছর পুর্বে যে সমস্ত আল্লাহর অলিগণ নীরবে ধ্যান সাধনা করতেন কিংবা রেয়াজত পালন করতেন...কিভাবে কিসের টানে তারা তাদের পৈতৃক ভিটে মাটি ছেড়ে কেবল মাত্র ধ্যান করেই বছর বছর পার করে দিয়েছেন? কি দেখেছেন ধ্যান সাধনায়? আর এই ধ্যান করার পদ্ধতিটাই বা কে শেখালো? কোথ্থ থেকে এর উৎপত্তি? কে কাকে শেখাচ্ছে? সবইতো তিনি। তিনিময় ছাড়াতো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনের মাঝে তিনি। গানের মাঝে তিনি...প্রাণের মাঝে তিনি...তিনিই তো সবকিছু...সবই তিনি। জগত বড়ো বিচিত্রময়। 

করিম সাহেবের মনে পড়লো তিনি চিশতী উদ্যান নামক হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) এর গজলে পড়েছিলেনঃ

উপহার দিব কিগো, কি আছে আমারও নাথ...
তোমারইতো দেওয়া সবই, কোথায় কি পাব সই?
যাহা কিছু সব তুমি, তুমি বিনে আমি নই।।

প্রিয় মানুষটিকে কোন কিছু উপহার দিতে হলে তাকে তার পছন্দমত জিনিসই দিতে হয়। জগতের নিয়মে তাই হয়ে আসছে। যার যেরুপ পছন্দ, সে তার প্রিয়সীকে সেটাই উপহার হিসেবে দিতে চায়। কিন্ত্তু কোন্ জিনিসটি তার নাথ তথা প্রভুকে উপহার দেবেন? সমস্ত কিছুইতো তারই দেয়া। তার দেয়া জিনিস থেকে কিভাবে তাকেই উপহার দেয়া যায়? তিনি সর্বত্রই তাকেই উপলব্ধি করছেন। সমস্ত কিছুতেই তারই সরব উপস্থিতি। এমন কি তার নিজের জীবন পর্যন্ত। সবই তার দেওয়া। কাজেই তাকে নতুন করে দেওয়ার কিছুই নেই। কারণ তিনি সামাদ। আহাদ নন। আহাদ হচ্ছি আমি। আমি সবর্দাই তোমার মুখাপেক্ষী। তাই তুমি সামাদ। তুমি আমি মিলেই হয় নাহনু। আমরা। আমি,তুমি এবং সে। আমি-পুং লিঙ্গ/স্ত্রী লিঙ্গ। তুমি-স্ত্রী লিঙ্গ/পুংলিঙ্গ। দুটির মিলনে উৎপত্তি তৃতীয় শক্তি - সে। আমি,তুমি এবং সে। একটি পরিবারেরই অংশ। সমগ্রই বিশ্বটাই আল্লাহর পরিবার। তাই তিনিই মালিক। তিনিই খালিক। তিনিই হুব্বুন। এই প্রেম হৃদয়ের গভীরে বসবাসরত কোন অজানা উৎস থেকে আসা এক অচিন পাখি। যাকে পরিপুর্ণরুপে দর্শন করাটাই সালাতুল মেরাজ। মেরাজ তখনই হয় যখন মুল সত্ত্বাটি তার স্বরুপে হাজির হন। তথা দর্শন দেন। তাইতো তারা সেই প্রেমেরই কারণে ঘর বাড়ি ছেড়ে সংসার ধর্ম পালন না করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর তারা পার করে দিতে পেরেছিলেন কেবল স্বরুপ দর্শনেই। "প্রেমিক সুজন এহেনও রতন, হারে কি কখন পাইলে দেখা" -এই স্বরুপের কোন ধ্বংস নেই। লয় নেই। প্রলয় নেই। তাই তারা মরেও অমর। তারা মিশে যান সেই চিরন্তন সত্ত্বার সাথে। যার সম্পর্কে বলা হয়েছে বলা হয়েছেঃ " ইয়া আইয়্যুতুহান নাফছুল মুতমাঈন্নাহ। তোরজেয় ইলা রব্বেকি।রাদিয়াতাম মারজীয়া।ফাদখুলিফি ইবাদি ওয়াদখুলি জান্নাতি। (সুরা আল ফজর ২৭-৩০)। অর্থঃ ওহে প্রশান্ত চিত্ত নফস।তুমি তোমার রবের দিকে ফিরে এসো সন্ত্তুষ্ট ও মর্জী চিত্তে। আমার দাসদের দাসত্ব করো আর জান্নাতে প্রবেশ করো। 

করিম সাহেব আবারো তাকালেন সেই প্রকৃতির দিকে। রিক্সাটা তখন বালাশুর চৌরাস্তার মোড়ে বাঁক দিতে যাচ্ছে। দু পাশের খালি জায়গায় দেখলেন.....কুয়াশা বিস্তৃতি ছাড়িয়েছে...রিক্সাটা যেই মান্দ্রার দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে..তখনই দেখলেন কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে উঠলো। রিক্সাটা তখন চলতে শুরু করেছে...আর করিম সাহেব সেই মহাপ্রভুর অপরুপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করে মনে মনে হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ)-এর একটি কবিতা আবৃত্তি করছেনঃ

আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অযুদ
হর যমাঁ খোদরা বা-নকশ ওয়া নমুদ;
জুমলা যাতে জাঁহানে মিরআতে উস্ত
হরচে বিনি মুসহাফে আয়াতে উস্ত;
"লাওহে-মাহফুয" আস্ত, দর মা'নী দিলাত
হরচে মি খাহী, শোদ যে উ হাসেলাত।
উনচে মাতলুবে-জাঁহা শোদ দর জাহান
হাম তুয়ী, ও বাঘ জো আজ খোদ নেশান।

অর্থঃ " তিনিই সেই আল্লাহ! যিনি শরীরী-জগতে প্রতি মুহুর্তে নব নব রুপে প্রকাশিত হইতেছেন। বিশ্বের সকল অস্তিত্বই তাহার মুকুর। যাহা কিছু দেখিতেছ, সমস্তই তাহার প্রকাশ চিন্হ। প্রকৃত পক্ষে তোমার অন্তরই "লওহে-মাহফুয"। যাহা কিছু চাও, উহা হইতেই তাহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে। যিনি এই বিশ্বে সারা দুনিয়ার কাম্য, তুমিই তিনি, কেনই বা এদিক সেদিক ঘুরে সময় নষ্ট করছ, তুমি তোমার নিজের ভিতর তাহার সন্ধান কর।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁসমুরগীর ছানাপোনা-পর্ব এগারো

(দশম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব হরিদাসের কথা শুনে বললোঃ

-দাদা তুমিতো বললে এই জ্ঞান লাভ করতে হলে সদ্ গুরুর কাছে যেতে হবে। তারপর তার থেকে এই পরমতত্ত্ব জ্ঞান লাভ করতে হয়। তার মানে তুমি গুরু ধরেছো।

-অবশ্যই ধরেছি। না ধরলে এই তত্ত্ব কথা জানলাম কিভাবে?

-এইসব তত্ত্বকথাতো এখন বই থেকে পাওয়া যায়। যে কেউ বই পুস্তক পাঠ করে এই বিদ্যা অর্জন করতে পারে। তাই না?

-হ্যাঁ তা পারে। কিন্ত্তু উপলব্দি করার ক্ষমতা থাকবে না। অর্থাৎ সে বুঝতে পারবে না এই দেহজগতে কোথায় কিরুপ লীলা খেলা চলে? যেমন ধরো শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের কথা। একটি গাছে দুটি পাখি- একটি জীবাত্মা অন্যটি পরমাত্মা (শ্রীকৃষ্ণ) মুণ্ডক উপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আত্মা ও পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল খাচ্ছে অন্য পাখিটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। এই দুটি পাখি গুণগতভাবে যদিও এক, তবুও তাদের একজন সেই জড়-জাগতিক গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ, আর অন্য জন একান্ত সুহৃদের মতো তার কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বাক্ষীরূপ পাখি আর অর্জুন হচ্ছেন ফল আহারে রত পাখি। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্য জন হচ্ছেন ভৃত্য। জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে তার এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই এক গাছ থেকে আর এক গাছে অর্থাৎ এক দেহ থেকে আর এক দেহে সে ঘুরে বেড়ায়। এই জড় দেহরূপ বৃক্ষে জীবাত্মা কঠোর সংগ্রাম করছে। কিন্ত্তু যে মুহূর্তে সে অন্য পাখিটিকে পরম গুরুরূপে গ্রহণ করতে সম্মত হয় যেভাবে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ লাভের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ অধীন পাখিটি সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হয়। 

মুণ্ডক উপনিষদে (৩/১/২) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৪/৭) প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে –
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ ।।

“দুটি পাখি একই গাছে বসে আছে, কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত সে গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্ত্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখিটির দিকে ফিরে তাকায় তবে তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত শোকের অবসান হয়। কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।” 

অর্জুন তাঁর নিত্যকালের বন্ধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে ভগবদগীতার তত্ত্ব জানতে পেরেছেন। এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করার ফলে তিনি ভগবানের পরম মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হন।

এখন দাদা আপনি বলেন-যারা বই পুস্তক পাঠ করবে, তারা কিভাবে সেই পরমতাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করবে? জ্ঞানের উৎপত্তিতো ধ্যানযোগে লাভ হয়। ধ্যান না করলে জ্ঞান হয় না। বিদ্যা পড়লে বিদ্বান হওয়া যায়। কিন্ত্তু জ্ঞানী হওয়া যায় না। যেমন ধরুনঃ যে লোক অক্ষর চেনে না, সে যেমন তার ভাষায় কথা বলছে কিন্ত্তু লিখতে দিলে পারছে না। তার মানে সে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন নয়। তাই সে নিরক্ষর। আর যে জানে, তাকে বলা হয় বিদ্বান। তথা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি কিন্ত্তু জ্ঞানী নন। কারণ জ্ঞানীগণ যে জ্ঞান লাভ করেছেন, তা যখন লিপিবদ্ধ করা হয় তখনই তা হয় কিতাব তথা পুস্তক বা বই। মুল পুস্তক কিন্ত্তু সেই জ্ঞানীর অন্তঃকরণে। যেখান থেকে সে জ্ঞান লাভ করেছিল। সে যখন তা ভাষায় বর্ণনা করলো তা শব্দরুপে আমাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করলো। আমরা শুনতে পারলাম। শব্দ উচ্চারণ না করলে কিভাবে তা ধ্বনি হয়? ধ্বনিতো তখনই হয় যখন উচ্চারণ করা হয়। আর উচ্চারিত হয় স্বরতন্ত্র তথা স্বরযন্ত্র হতে।

করিম সাহেব কিছুই বললেন না। তিনি চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন কেমন সুনশান নীরবতা। শীতের কুয়াশায় চারিদিকে ঢেকে আছে। সেই কুয়াশা শিশিরের রুপ ধারণ করে টিনের চালার উপর টুপ টুপ করে পড়ছে। বাড়ীর পাশে দেবদারু গাছটি কেমন ঝিম মেরে বসে আছে। একটুও কাঁপুনি নেই। অথচ তিনি শীতের কথা চিন্তা করে এখনোই ঠক ঠক করে কাঁপছেন। তাকে যেতে হবে মান্দ্রা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন। তিনি তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন।
বললেনঃ

-হরি দা আজ উঠি। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ী ফিরতে হবে।

-সে কি? প্রসাদ খাবেন না?

-না দাদা। আজ নয় অন্য আরেক দিন। এক্ষুনি যেতে হবে। নয়তো রিক্সা পাবো না...এখন পাই কি-না সন্দেহ আছে। তাছাড়া আজকে বেশ শীত পড়েছে। সাথে কুয়াশাও।

তিনি আর দেরী করলেন না। হড় হড় করে হেটে চলে এলেন মুল রাস্তার ধারে। একটা রিক্সা পাওয়ায় তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

 (চলবে)

রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা এ হাঁসমুরগীর ছানাপোনা-দশম পর্ব

(নবম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব হরিপদের  কথা শুনে বেশ ভাবিত হলেন। তিনি মনযোগ সহকারে হরিপদের কথা শুনছেন। আর হরিপদ তার কথা বলেই যাচ্ছেঃ

গুণগতভাবে পরমাত্মা তাঁর পরমাণুসদৃশ অংশ জীবাত্মার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। জড় দেহের যেমন পরিবর্তন হয়, আত্মার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। তাই আত্মাকে বলা হয় কূটস্থ, অর্থাৎ কোন কালে, কোন অবস্থায় তার কোন পরিবর্তন হয় না। জড় দেহে ছয় রকমের পরিবর্তন দেখা যায়। মাতৃগর্ভে তার জন্ম হয়, তার বৃদ্ধি হয়, কিছুকালের জন্য স্থায়ী হয়, তা কিছু ফল প্রসব করে, ক্রমে ক্রমে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অবশেষে তার বিনাশ হয়। আত্মার কিন্ত্তু এই রকম কোন পরিবর্তনই হয় না। আত্মার কখনও জন্ম হয় নাযেহেতু সে জড় দেহ ধারণ করে, তাই সেই দেহটির জন্ম হয়। যার জন্ম হয়, তার মৃত্যু অবধারিত। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। তেমনই আবার, যার জন্ম হয় না, তার কখনই মৃত্যু হতে পারে না। আত্মার কখনও জন্ম হয় না, তাই তার মৃত্যুও হয় না আর সেই জন্য তার অতীত, বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সে নিত্য, শাশ্বত পুরাতন, অর্থাৎ কবে যে তার উদ্ভব হয়েছিল তার কোনও ইতিহাস নেই। আমরা দেহ-চেতনার দ্বারা প্রভাবিততাই আমরা আত্মার জন্ম-ইতিহাস খুঁজে থাকি। কিন্ত্তু যা নিত্য, শাশ্বত, তার তো কোনও শুরু থাকতে পারে না। দেহের মতো আত্মা কখনও জরাগ্রস্ত হয় না। তাই, বৃদ্ধ অবস্থাতেও মানুষ তার অন্তরে শৈশব অথবা যৌবনের উদ্যমতা অনুভব করে। দেহের পরিবর্তন কখনই আত্মাকে প্রভাবিত করে না। জড় দেহের মাধ্যমে যেমন সন্তান-সন্ততি উৎপন্ন হয়, আত্মা কখনও তেমনভাবে অন্য কোনও আত্মা উৎপাদন করে না। দেহজাত সন্তান-সন্ততিরা প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন আত্মা। স্ত্রী-পুরুষের দেহের মিলনের ফলে আত্মা নতুন দেহ প্রাপ্ত হয় বলে সেই আত্মাকে কোন বিশেষ স্ত্রী-পুরুষের সন্তান বলে মনে হয়। আত্মার উপস্থিতির ফলে দেহের বৃদ্ধি হয় কিন্ত্তু আত্মার কখনও বৃদ্ধি বা কোন রকম পরিবর্তন হয় না। এভাবেই আমার উপলব্ধি করতে পারিদেহে যে ছয় রকমের পরিবর্তন হয়, আত্মা তার দ্বারা প্রভাবিত হয় না

কঠ উপনিষদেও (//১৮) গীতার এই শ্লোকের মতো একটি শ্লোক আছে-
জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।
এই শ্লোকটির সঙ্গে ভগবদগীতার শ্লোকটির পার্থক্য কেবল এখানেবিপশ্চিৎশব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞানী অথবা জ্ঞানের সহিত।

আত্মা পূর্ণ জ্ঞানময়, অথবা সে সর্বদাই পূর্ণচেতন। তাই, চেতনাই হচ্ছে আত্মার লক্ষণ। এমন কি আত্মাকে হৃদয়ের মধ্যে দেখা না গেলেও চেতনার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। অনেক সময় মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবার ফলে অথবা অন্য কোন কারণে সূর্যকে দেখা যায় নাকিন্ত্তু সূর্যের আলো সর্বদাই সেখানে রয়েছে এবং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এখন দিনের বেলা। ভোরের আকাশে যখনই একটু আলোর আভাস দেখতে পাওয়া যায়, তখনই আমরা বুঝতে পারি, আকাশে সূর্যের উদয় হচ্ছে। ঠিক তেমনই, মানুষই হোক বা পশুই হোক, কীট-পতঙ্গই হোক বা উদ্ভিদই হোক, একটুখানি চেতনার বিকাশ দেখতে পেলেই আমরা তাদের মধ্যে আত্মার উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। আত্মার সচেতনতা পরমাত্মার সচেতনতার মধ্যে অবশ্য অনেক পার্থক্য রয়েছে, কারণ পরমাত্মা হচ্ছেন সর্বজ্ঞ। তিনি সর্ব অবস্থায় ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে অবগত। স্বতন্ত্র জীবের চেতনা বিস্মৃতিপ্রবণ, সে যখন তার সচ্চিদানন্দময় স্বরূপের কথা ভুলে যায়, তখন সে শ্রীকৃষ্ণের পরম উপদেশ থেকে শিক্ষা আলোক প্রাপ্ত হয়। কিন্ত্তু শ্রীকৃষ্ণ বিস্মরণশীল জীবের মতো নন। যদি তাই হত, কৃষ্ণের ভগবদগীতার উপদেশাবলি অর্থহীন হয়ে পড়ত।
 
আত্মা দুই রকমের- অণু আত্মা পরমাত্মা বা বিভু-আত্মা
কঠ উপনিষদে(//২০) তার বর্ণনা করে বলা হয়েছে-
অণেরণীয়ান্মহতো মহীয়ান আত্মাস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াম
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুঃ প্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ ।।

পরমাত্মা জীবাত্মা উভয়েই বৃক্ষসদৃশ জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত। যিনি সব রকমের জড় বাসনা সব রকমের শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনি কেবল ভগবানের কৃপার ফলে আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমাত্মারও উৎস আর অর্জুন হচ্ছেন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে আত্মবিস্মৃত জীবাত্মা; তাই তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অথবা তাঁর সুযোগ্য প্রতিনিধি সদগুরুর কাছ থেকে এই পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হয়

(চলবে)