পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮

হাইবারনেশনঃ

কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে যখন পুর্ণিমার চাঁদটি ঠিক মধ্য গগণে, তখন অনেকেই শীতের উষ্ণতা উপভোগ করার জন্য কম্বল অথবা লেপের ভেতর মুড়ি দিয়ে উষ্ণতা অনুভবে ব্যস্ত। কেউ বা আদিম উষ্ণতা অনুভবে নিমগ্ন। 

কিন্তু সেই পরম উষ্ণতার স্নিগ্ধতা ভংগ করে যারা ছুটে এসেছিলেন বারাহিগুণী দরবার শরীফে পবিত্র ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদযাপন করার জন্য, তারা অবশ্য পেয়েছেন এমন এক হৃদয়ের উষ্ণতা, যা পার্থিব এবং অপার্খিব আনন্দঘন এক পরম আবেশের সৃষ্টি করেছিল। এমন এক আবেশ, যা কখনো কদাচ পাওয়া যায়। 

ঠিক এমনই এক আবেশের পরশ পাওয়া গেল যখন পবিত্র গিলাফ শরীফ চড়ানো হয়েছিল বাদ মাগরিব...সেই সময়টাতে। যেন নববধুর সাজে সাজানো হচ্ছিল পবিত্র রওজা শরীফ। যেন কারো সাথে পবিত্র বন্ধন আবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি সাজছেন এক নববধুর সাজে। মোহনীয় সেই সাজের স্বার্থকতা পাওয়া গেল যখন মাঝ রাতের কুয়াশাস্নাত রাতের চাঁদটি মধ্যগগণে স্থিত। কি মনোরোম এবং মায়াবি পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ যোগ্য নয়। বিষয়টি উপলদ্ধি করার জন্য হৃদয়ের বোধগম্যতাও যেন জরুরী হয়ে পড়ে....শিশির স্নাত সেই রাতটি যেন প্রকৃতি নিজেই তৈরী করেছিল রহমত রুপে..

দয়াল নবীর অশেষ রহমত এবং মুর্শিদের কৃপায় এক ফাল্গু ধারা সৃষ্টি করেছিল, যখন পরিবেশন করা হয়েছিলঃ "সবচে আলা হামারা নাবী।" কিংবা বড্ড জলি মেরি ইয়া মুহাম্ম দ.... কিংবা "ইয়া নবী রোজে আজলছে মাই তেরা দিওয়ানা হো...নানান শানে মানে ভরপুর সব কাওয়ালী। 

মধুময় সেই কাওয়ালদের পরিবেশনায় যখন উপস্থিত আশেকানে চিশতগণ নিমগ্ন..জজবার তালে নৃত্যরত, ঠিক তখনই পাওয়া গেল মুর্শিদের এক নির্দেশনা। পরিবেশন করা হলো আরো কিছু নাতে রছুল (সাঃ) এবং খাজায়ে খাজেগানের শান-মান সমৃদ্ধ কাওয়ালী। বাদ ফজর আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে সেই পবিত্র রজনীর স্বার্থকতা।

আফসোস..যারা হাইবার নেশনে ব্যস্ত, তারা কিভাবে বুঝবে সেই মহামহিম রজনীর তাৎপর্য? তাদের অন্তঃকরণে কিভাবে ঝিলিক দেবে...রহমতের দরিয়ায় প্রবাহমান ফাল্গু ধারা.......

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮

মুর্শিদের দৃষ্টি

মুর্শিদের দৃষ্টি কী রকম? হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে: النظر شفاء (আননাজ্রু শিফাউন্) অর্থাৎ, দৃষ্টিতে আরোগ্য হয়। এর অর্থ শুভ দৃষ্টি। মুর্শিদকে দেখলে মৃত অন্তর সজীব হয় বা রোগাক্রান্ত অন্তর আরাম বোধ করে এবং চিন্তিত হৃদয়ের চিন্তা দূর হয়। মুর্শিদের আসল এবং প্রকৃত রূপ যে দেখে, সে মরে না। যেমন আজরাঈল (আঃ)-এর আসল রূপ যে দেখে, সে বাঁচে না। তবে এ দেখা কয়েক প্রকার হতে পারে, যেমন বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখা এবং অন্তর্দৃষ্টিতে বা ধ্যানে দেখা। বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য সামনা-সামনি হওয়া প্রয়োজন। ধ্যানে দেখার ব্যাপারে কাছে বা দূরে, অতি দূরেও কোনো পার্থক্য নেই। কারণ এটা মুর্শিদের বৈশিষ্ট্য। তবে যার ধ্যানশক্তি উন্মোচিত হয়েছে, তাঁর জন্য মুর্শিদের রূপের ধ্যান একটা বিরাট নিয়ামত। এর ন্যূনতম উপকারিতা হল এই যে, এ ধ্যানে আপন মুর্শিদের সাহচর্যের উপকারিতা পাওয়া যায়। হযরত শাহ্ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস (রঃ) বলেন, واذا غاب الشيخ عنه يخيل صورته فتفيد صورته ما تفيد صحبته (অ-ইজা গা-বাশশাইখু আন-হু ইয়াখিল্লু ছোরাতাহু ফাতাফিদু ছুরাতা-হু মা তাফিদু ছুহবাতা-হু) অর্থাৎ, মুর্শিদের অবর্তমানে মুর্শিদের রূপের ধ্যান মুরিদকে তাঁর সাহচর্যের উপকারিতা প্রদান করতে পারে। উল্লেখ্য, মুর্শিদের আসল রূপ আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত। নবী করীম (সাঃ) বলেন, من رأني فقد رأي الحق (মান রা-আনি ফাকাদ্ রা-আল হাক্কা) অর্থাৎ, যে আমাকে দেখেছে, বস্তুত সে আল্লাহকে দেখেছে। সুতরাং যে আল্লাহকে দেখেছে, সে আলমে লাহুত বা ঐশী জগতের অধিকারী হয়েছে। আর আলম-এ লাহুতে মৃত্যুর প্রবেশাধিকার নেই। কারণ মৃত্যু রূহ্-কে আলম-এ নাসুত বা বস্তুজগৎ থেকে আলমে মেছাল তথা অনুরূপ জগৎ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এর উপরে তার প্রবেশাধিকার নেই। অতএব যে নশ্বর জগৎ অতিক্রম করে অমর জগতে প্রবেশ করেছে, তার আর মরণ নেই, বরং সে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে যায়। এ জন্য আল্লাহর অলীগণ ছাড়া অন্যরা এ বিষয়টা বোঝে না। না বুঝে ভালো কথা, কিন্তু বিপদ এই যে, তারা এর ঘোর বিরোধী। অথচ এরাই তাদের পুস্তক-পুস্তিকায় লিখে যে, সাধক যখন স্বীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তি করার মানসে ধ্যানে বসেন, তখন তিনি অনুভব করেন যে, একটি কামানের গোলা তার বক্ষভেদ করে চলে গেছে। ফলে তার বক্ষে যেন একটা সুড়ঙ্গ হয়ে গেছে। অতঃপর সাধক অনুভব করেন যে, ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গটি বড় হতে হতে গোটা দেহটি সুরঙ্গের সাথে বিলীন হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সুড়ঙ্গটা সমস্ত দেহে ছড়িয়ে গেছে। ফলে গোটা দেহটা সুড়ঙ্গের সাথে বিলীন হয়ে গেছে। এটার নামই ফানা বা আত্মবিলুপ্তি। এটা সাধকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
এখানে স্মরণীয় যে, মুর্শিদের রূপ আল্লাহর গুণাবলিতে পরিপূর্ণ। যার ধ্যানের মাধ্যমে শত সহস্র সংকেত ও গোপন রহস্য সম্পর্কে আলোক লাভ হয়। তাদের মতে, মুর্শিদের ধ্যান করা র্শিক ও হারাম। তাহলে ধ্যানে কামান, গোলা তথা লোহা কল্পনা করা কী করে পুণ্যের কাজ হয়? তদুপরি অনেক অমূলক চিন্তার মাধ্যমে নিজেকে বিব্রত করা হয়। যেমন: ধ্যানে লোহা দ্বারা কামান ও গুলি তৈরি করা, তাতে বারুদ সংযুক্ত করা এবং আগুনের শক্তিতে গুলি সতেজ হওয়া। অতঃপর সে গুলি বক্ষে বিদ্ধ হওয়া আবার তা থেকে সুড়ঙ্গ সৃষ্টি হওয়া, ধীরে ধীরে সে সুড়ঙ্গ বড় হতে থাকা এবং পরিশেষে তাতে কাল্পনিকভাবে বিলীন হওয়া। অর্থাৎ মিথ্যামিথ্যিভাবে কল্পনায় ফানা বা বিলীন হওয়া।

মাওলানা রুমীর বাণী,
“খেয়ালাতে না-দানে খেলোয়াত নাশিন,
বাহাম বরকুনাদ্ আকেবাত্ কুফরওয়াদিন।”
তিনি আরও বলেন,
“কারে পাকান-রা-কিয়াস্ আজ খোদ্ মগির,
গারচে মান্দ বাশাদ দরনাবেশ্তান সেরও সীর।”
মোটকথা, এটাও তো ফানা নয়, বরং ফানার ওপর একটা অনুমানের বোঝা চাপানো। বলুন তো, ফানার সময় খেয়াল ও কল্পনাকে ফানা করতে হয় কি না? যদি ফানা করতেই হয়, তাহলে কলেমার আঘাতে কেন ফানা করা হচ্ছে না? লোহার শিবলিঙ্গের দ্বারা কী করে ফানা হবে? এটাতো ফানা নয়; বরং ফানা হওয়ার পথে বাধা। কারণ ফানায় স্বীয় দেহ ও ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে হয়। যাতে উহাতে আর কখনো কোনো প্রকার ইন্দ্রিয়ানুভূতি সৃষ্টি না হয় এবং ইহজাগতিকতায় জড়িয়ে না যায়। ধ্যানে যে সুড়ঙ্গের কল্পনা করতে হয়, সেটা তো ইহজগৎ এবং এ স্থানেই। সুড়ঙ্গের মধ্যে যে স্থান অনুমিত হয়, তা আপন দেহের চেয়ে অনেক কঠিন। তার বিলোপ সাধনের জন্য কী ধরনের কামান প্রয়োজন? স্মরণীয় যে, আল্লাহর তাওহীদের ভিতর কোনো প্রকার অসত্যের প্রবেশাধিকার নেই। সেক্ষেত্রে এতসব অবাঞ্চিত কল্পনা কী করে বৈধ হতে পারে? এবং এর দ্বারা কী করে তাওহীদ অর্জিত হতে পারে? অতএব তাওহীদের ক্ষেত্রে যাদের এরূপ চিন্তাভাবনা হতে পারে, উপবিষয়সমূহে অনুরূপ আচরণ করতে তারা কি কখনো ছাড়বে? মুর্শিদের ধ্যানের যদি কোনো উপকারিতা ও প্রভাব না থাকে, তাহলে লোহার কি প্রভাব থাকতে পারে? লোহার কল্পনা কেন করতে হবে? মানসিক উপকারিতার জন্য, না আত্মিক উপকারিতার জন্য? অভ্যন্তরীণ উপকারিতার জন্য, না বাহ্যিক উপকারিতার জন্য, না মানবিক উপকারিতার জন্য? তাতে মৌল রশ্মি, না রূপক রশ্মি কোন্টা আছে যে, তার ধ্যান বা কল্পনা করতে হবে? অথচ যে মুর্শিদের ভিতর উক্ত সমস্ত গুণাবলি বিদ্যমান, তিনি দূরে থাকুন অথবা কাছে থাকুন, তাঁর বাহ্য রূপ কল্পনা করা হোক বা আসল রূপ, সর্বাবস্থায় যার দ্বারা প্রভাবিত বা উপকৃত হওয়া যায়, তাঁর ধ্যান করা যাবে না কেন? মুর্শিদের যদি ধ্যান করা না যায়, তাহলে মুর্শিদ দ্বারা লাভ কী? কামানের কল্পনার সময় শয়তান যদি কামানের রূপ ধারণ করে, তাহলে কী হবে? এক গোলার আঘাতে সমস্ত ধ্বংস করে দেবে। কারণ শয়তান সব রূপ ধারণ করতে পারে, কিন্তু রাসূল (সাঃ) এবং রাসূলের রূপে বিলীন ব্যক্তির রূপ ধারণ করতে পারে না। কারণ রাসূল (সাঃ) এর রূপে বিলীন ব্যক্তির রূপ রাসূলেরই অনুরূপ এবং তিনিই পরিপূর্ণ মানুষ। তাঁর রূপও শয়তান ধারণ করতে পারে না। তাই হাদিস শরীফে আছে: يفر الشيطان من ظل عمر (ইয়া ফিররুশ শায়তানু মিন জিল্লি ওমর) অর্থাৎ, হযরত ওমর (রাঃ)-এর ছায়া দেখলে শয়তান পালায়। সুতরাং মুর্শিদ না থাকলে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা নেই। الرفيق شم الطريق (আর রাফিকো ছুম্মাত্ তারিকো) অর্থাৎ, প্রথমে মুর্শিদ পরে সাধনা ও সিদ্ধি।

“চো খালিল আ-মদ খেয়াল ইয়ারে মান
ছোরতাস বুৎ মা’না আও বুৎ শেকান।”

যে ব্যক্তি মুর্শিদের ভিতরের রহস্য সম্পর্কে অবহিত নয়, সে মুর্শিদ সম্পর্কে কী জানবে? শুধু মুর্শিদের নাম লেখা এবং তাঁর পরিচয়নামা সঙ্গে রাখায় কী উপকার? তাঁর ত্বরিকার নাম জপলেই তা হাসিল হবে না। আর অযথা বার বার নাম জপ করায় নাম বিলুপ্ত হয় মাত্র। এতে আরও কিছু আছে। কিন্তু মুর্শিদের মধ্যে যে মানবিক ফায়েজ বা উপকারিতা পাওয়া যায় তাতে দয়াময়ের মহান দান অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই মুর্শিদে বিলীন হওয়া বেলায়েতের প্রথম সোপান বা সিঁড়ি। মুর্শিদের মধ্যে মানবিক ফায়েজ না থাকলে মুর্শিদের কোনো প্রয়োজনই হত না। সুতরাং এ ফায়েজ বা প্রচুর কল্যাণ অর্জন করতে হলে ভক্তি, ভালোবাসা ও ধ্যান প্রয়োজন। ভালোবাসাহীন ভক্তি বা বিশ্বাসে তেজ নেই এবং স্মরণ ও ধ্যানহীন ভক্তি ভালোবাসা বিস্মৃতিরই নামান্তর। এ তিনটির সমন্বয় হলেই উদ্দেশ সিদ্ধ হয় এবং লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে ভক্তি যত বেশি হবে, ধ্যান ও অনুভব শক্তি তত বাড়বে। তবে যিনি অন্তর্দৃষ্টিবান, তাঁর ধ্যান হবে কাশ্ফ্ পদ্ধতিতে। আর যিনি অনুভূতিশীল বা অনুরূপ তাকে নিজের তরফ থেকে ধ্যান করতে হবে। তবে উভয় অবস্থাই ভালো। মুর্শিদের ধ্যান অর্থ এই যে, মুরিদ যখন আপন মুর্শিদের ফায়েজ প্রাপ্ত হতে থাকবে এবং বুঝতে পারবে, মুর্শিদের ফায়েজ অর্থ কি? তখন সাবধানী সাধক যখনই মুর্শিদকে স্মরণ করবে, তখনই সে আরও অধিক পরিমাণে ফায়েজ লাভ করবে। তার যিকিরের ক্ষমতা বাড়বে, তার অবস্থার উন্নতি হতে থাকবে এবং সে তা উপলব্ধি করতে পারবে। যার এ অবস্থা লাভ হয়নি, সে ধ্যান এবং মুর্শিদের ফায়েজের অর্থ কখনো বুঝবে না। এ কারণেই ধ্যানের ব্যাপারে এদের আপত্তি বা বিরোধিতা।

ধ্যান বিরোধিরা ফায়েজ বা মুর্শিদের মহা দান এবং তাসাউফের অর্থ জিজ্ঞেস করে। বস্তুত তারা জানে যে, ফায়েজের আভিধানিক অর্থ পুরস্কার এবং সংবাদ প্রকাশিত হওয়া। আর তাসাউফ অর্থ কল্পনা বা ধ্যান। কিন্তু এরা এর মর্মার্থ বোঝে না। এ পর্যায়ে অনেক সাধকেরও ধ্যান সাধনায় দ্বিধা ও সংশয় রয়েছে। তারা মুর্শিদের ধ্যানে মুর্শিদের প্রকৃত রূপের ধ্যানও কল্পনা করতে পারছে না। তা হলেও মুর্শিদের ফায়েজ থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় না। এ বিষয়ে সাধকদের কোনো প্রকার সংশয় থাকা উচিত নয়। কারণ যখন মুর্শিদের ফায়েজ লাভ হয় অর্থাৎ নিজের অবস্থাদি দ্বারা বুঝতে পারে যে, এ ফায়েজ মুর্শিদের তরফ থেকে প্রেরিত, তখন যদি মুর্শিদের ধ্যান না করা হয়, তাহলে সে ফায়েজ স্থায়ী হয় না। এটাও এক প্রকার ধ্যান। কেননা ধ্যান-ধারণা অনেক প্রকার। যেমন: আবেগের ধ্যান, কাশ্ফের ধ্যান এবং বিশ্বাস ও ভক্তির ধ্যান। কাশ্ফের ধ্যানে দেখতে হবে কাশ্ফের দৃষ্টি দিয়ে। আর আবেগের ধ্যানে দেখতে হবে আবেগের দৃষ্টি দিয়ে এবং ভক্তির ধ্যানে দেখতে হবে ভক্তির দৃষ্টি দিয়ে। এটাও ভালো; বরং এক হিসেবে মৌলিক। কারণ ভক্তির জোরে কাশ্ফ ও ধ্যান ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। ভক্তিমূলক ধ্যানশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য এটাই যথেষ্ট। কারণ যার কাশ্ফ এবং ধ্যানশক্তি আছে কিন্তু ভক্তি বা বিশ্বাস নেই, সে ব্যক্তি মৃত। কিন্তু যার কাশ্ফ এবং ধ্যান নেই, ভক্তি বা বিশ্বাস আছে, সে ব্যক্তি অকপট দ্বিধাহীন। কোনো কোনো সাধক বা শিষ্যের মধ্যে দ্বিধা এবং হতাশা সৃষ্টি হয়। তারা মুর্শিদ সম্পর্কে অন্যায়ভাবে খারাপ ধারণা করে যে, মুর্শিদ বড় নিষ্ঠুর, হয়ত আমাদেরকে কিছুই দেবেন না। এটা খুবই খারাপ এবং বঞ্চিত হবার লক্ষণ। 

মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর ভাষায়,
“আগার হোব্বে খোরদে লাহো সাকুক দারাদ্ দরিঁয়ে রাহ্
কদম মানদান হীচ সূদ্মান্দ নিস্ত।”

অর্থাৎ, “এ পথে দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য কোনো কল্যাণ নেই।” এ ধরনের শিষ্যদের অবিলম্বে তওবা করা কর্তব্য। কারণ মুর্শিদের কৃপা লাভ করা উচিত, অসন্তুষ্টি নয়। এ ধরনের হতভাগ্য শিষ্য ব্যক্তিগতভাবেই অপদার্থ। তবুও মুর্শিদ তাকে সুনজরেই দেখেন এবং আশীর্বাদ করেন। বস্তুত সে শিষ্য কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই পাচ্ছে। সে যদি তওবা করে, তবে কুলক্ষণ কেটে যাবে।
কোনো কোনো সময়ে শিষ্যদের মধ্যে আবেগ প্রবণতা এবং অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, প্রেমের কারণেই এটা হয়। কারণ প্রেমিক বিচ্ছেদে স্থির থাকতে পারে না। 

কবির ভাষায়,
“হাফতে দরিয়া গর বানুশম তর নাকুনাম কামরা
শরবত দিদার বায়াদ্ তেশনায়ে দিদার রা”।

অর্থাৎ, “সাত সাগরের পানি পান করেও তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা মিটে না।” নবী অলীদের এ রকম অবস্থা হয়। এটা ভালো। তবে আল্লাহর সত্তা অসীম বিধায় এ পর্যায়ে নিজেকে সংযত করা উচিত। তা না হলে দেওয়ানা বা মজ্জুব হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু দেওয়ানা এবং মজ্জুবদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ কুতুব ও আবদাল এবং উত্তম ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্য থেকেই আবির্ভূত হন।
( মাতলাউ’ল ঊ’লূম )
»হযরত আহম্মদ আলী ওরফে বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রঃ)

শুক্রবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৮

আজব দরবার হ্যায় দরবারে খাজা

আরশে মোয়াল্লায় একটা মালা ঝুলছিল। তাতে লেখা ছিলঃ 
"লান্ নাতুল্লাহে আলা ইবলিশাছাহ্"। অর্থাৎ ইবলিছের উপর আল্লাহ্ তায়া'র অভিশাপৎ বর্ষিত হোক। 

হযরত আজাজিল (আঃ) আল্লাহ্ পাকের কাছে আরজ করলেনঃ "হে মহান প্রভু! এই ইবলিছটা কে? যার উপর তোমার অভিশাপৎ বর্ষিত হোক" বলে লিখে রেখেছো? 
মহান প্রভু বললেনঃ সময় হলেই তুমি তা দেখতে পাবে। হযরত আজাজিল (আঃ) আরো একবার জোরে শোরে বললেনঃ "লান্ নাতুল্লাহে আলা ইবলিশ ছাহ্"।

কিছুদিন পর যখন মহান প্রভু হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করে তাকে সিজদাহ্ করার জন্য আদেশ দিলেন, তখন হযরত আযাযিল (আঃ) সিজদাহ করা থেকে বিরত রইলেন।  মহান প্রভু দয়াময় আল্লাহ পাক তাকে জিগ্যাসা করলেনঃ 

"তুমি কেন আদম (আঃ) কে সিজদাহ করলে না? কিসে তোমাকে বিরত রাখলো?"
হযরত আযাযিল (আঃ) উত্তর করলেনঃ "সে মাটির তৈরী আর আমি আগুনের।" 
মহান প্রভু তাকে বললেনঃ "দুর হ! হে ইবলিশ।"
এ কথা বলার সাথে সাথেই হযরত আযাযিলের গলায় আরশে মোয়াল্লায় ঝুলে থাকা সেই লান্নতের মালাটি খসে পড়লো। এবং ইবলিশের গলায় তা ঝুলে রইলো। এই মালাটি কেয়ামত দিবস পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। 

ঠিক তদ্রুপ, বারাহিগুনি দরবার শরীফের মুল ফটকে লেখা আছেঃ " দরবারে খাজা"। বারাহিগুণী দরবার শরীফ।
অর্থাৎ এই দরবারটি খাজার দরবার। অর্থাৎ মহান মুর্শিদ কেবলাহ্ হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) এর দরবার নয়। এই দরবারটি হযরত খাজা সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীব নওয়াজ (রাজিঃ) এর দরবার। 

এই দরবারে যারা  জিয়ারত করেন এবং এখানে এসে বাইয়াত গ্রহণ করে ধন্য হন, তারাও সেই লেখাটি পড়ে থাকবেন। এবং পবিত্র ওরোছ শরীফে বর্ণিল ব্যানারে সজ্জিত  অনেক ব্যানারের ফাঁকে একটা বা দুটো ব্যানারে লেখা থাকেঃ

"আজব দরবার হ্যায় দরবারে খাজা
আজব সরকার হ্যায় সরকারে খাজা।।"

সেটিতেও আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে বৈ কি?  কিন্তু যেটি দৃষ্টি গোচর হয়নি সেটি হলো এর ইতিহাস। অর্থাৎ এর পেছনে বর্ণিত মুল বা প্রকৃত সত্যটি।

উল্লেখ্য যে, এই দরবার শরীফ অন্যান্য আট-দশটা দরবারের মতো নয়। এখানে আদব-কায়েদার বরখেলাফ হলেই মহান অলী-আউলিয়া, সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীব নওয়াজ (রাজিঃ) এর হুকুম মোতাবেক তার উপর এমন এক বিপদাপদ কিংবা বালা-মুছিবাত আসবেই, যা তাকে দুনিয়া এবং আখিরাতের কল্যাণকামিতা থেকে দুরে রাখবে। কারণ, মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (রহাঃ) এর ভাষায়ঃ

"আয় খোদা জুইয়াম তাওফীকে আদব,
 বে আদব মাহরুম গাশত আয ফজলে রব। 

অর্থঃ হে খোদা তুমি দয়া করে, আমাকে আদব ভিক্ষা দাও। কেননা বে-আদব আল্লাহর রহমত হইতে বঞ্চিত থাকে। 

জালাল উদ্দিন রুমী আরো বলেনঃ
বে-আদব বা তা খোদরা দাশতে বদ বালকে আতেশ দারহামা আফাক যাক। 

অর্থঃ বে-আদব শুধু নিজেকেই ক্ষতি করে না বরং সে পৃথিবীতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।


মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৮

লায়লী - মজনুঃ ইশকে এলাহির প্রেম সম্পর্কীয় বয়ান


ওহে দরবেশগণ! একবার মজনু শুনিলো লায়লী গরীবদিগকে খাদ্যদ্রব্য দান করিতেছে। মজনুও একটি কাঠের পাত্র লইয়া অন্যান্যদের সাথে লাইনে দাঁড়াইল। সকলকেই কিছু কিছু দিয়া বিদায় করিল কিন্তু মজনুকে কিছুই দিল না। অধিকন্তু তাহাকে দেখিয়া লায়লী গৃহাভ্যন্তরে চলিয়া গেল। ইহা দেখিয়া মজনু মনের উল্লাসে নাচিতে আরম্ভ করিল।

লোকে তাহাকে ধিক্কার দিয়া বলিল - আরে নাচার মতো কি হইল? অন্যান্যকে তো কিছু কিছু দিল। আর তোমাকে দেওয়া তো দুরের কথা। তোমার চেহারা দেখিয়াই তো বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেল।

মজনু বলিল - তোমরা ঠিকই বলিয়াছ। আমাকে কিছুই দেয় নাই। কিন্তু ইহাতো সত্য যে আমার প্রেমাষ্পদ আমাকে স্বচক্ষে দেখিয়াছে। ইহার চেয়ে আনন্দের বিষয় আমার আর কি হইতে পারে?

অতঃপর তিনি অশ্রু সজল নয়নে বলিলেন - ওহে দরবেশগণ! যে প্রেম সাগরে নিমজ্জিত সে-ই এ কথার মর্মার্থ উপলব্দি করিতে পারিবে। যে প্রেমের দাবী করে; তাহার কর্তব্য আজীবন প্রেমাষ্পদের দরজায় আঘাত হানা। ক্রমাগত আঘাতের ফলে একদিন না একদিন দ্বার উন্মুক্ত হইবেই আর সে তাহার আকাঙ্খিত বস্তু লাভ করিবেই।

কাযি হামিদ উদ্দীন নাগুরী (রহঃ) তাঁহার গ্রন্থের একস্থানে লিখিয়াছেন - "কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিবেন - মজনুকে হাযির কর। তাহাকে হাজির করা হইলে বলিবেন - যে সমস্ত লোক পৃথিবীতে আমার প্রেমের দাবী করিতো তাহাদিগকে মজনুর সন্মুখে উপস্থিদ কর।"

সকলকে উপস্থিত করা হইলে আল্লাহতা'য়া এরশাদ করিবেন - "যদি প্রেমের দাবী কর তবে মজনুর ন্যায় কর। যতদিন সে জীবিত ছিল লায়লী ব্যতীত অন্য কিছুতে তাহার ধ্যান ছিল না। মৃত্যুর সময় সে লায়লীকে স্বরণ করিয়াই মরিয়াছে। আজ হাশরের মাঠেও তাহার মুখে সেই একই কথা - লায়লী।"

অতঃপর বলিলেন - আশেকদের জন্য ইহাই কষ্টি পাথর। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বন্ধুত্বের দাবী করে তাহার কর্তব্য সেই দাবীতে দৃঢ় থাকা। দিনের পর দিন বন্ধুদ্বের প্রেমের বাধন মজবুত হওয়া ব্যতীত যেন ঢিলা না হয়।

ওহে দরবেশগণ! নেজামী গানজুরী (রহঃ) অতি উচ্চ পর্যায়ের একজন খোদা প্রেমিক ছিলেন। আধ্যাত্মিক প্রেম সমন্ধে তিনি বহু মুল্যবান তথ্য লিখিয়া গিয়াছেন। একবার আমি তাহার মজলিশে উপস্থিত হইলাম। সেখানে আরো বহু দরবেশ উপস্থিত ছিলেন। মজলিশে সা'মা(ভক্তিমুলক গান) হইতেছিল। কাওয়াল যে গান গাহিতেছিল - উহার দুইটি লাইন এখনো আমার স্মরণে রহিয়াছে। উহার অর্থ এই যে "প্রকৃত প্রেম কখনো হ্রাস পায় না আর প্রকৃত প্রেমিকও পদঙ্খলন করে না। যেই প্রেম যর্থার্থ নয় উহাতো যুবকদের কাম প্রবৃত্তির উপকরণ মাত্র।"

তথ্যাবলীঃ
--------
গ্রন্ধসুত্রঃ ইসরারুল আউলিয়া (আউলিয়া রহস্য)। পৃষ্ঠাঃ ১১-১৩ দ্রষ্টব্য।
মুল গ্রন্থঃ হযরত খাজা শায়খ ফরীদ (রাঃ)।
অনুবাদঃ আবদুল জলীল।
ফেরদৌস পাবলিকেশনস, ৪১ নর্থব্রুকহল রোড, ঢাকা।
ইমেজ সংগ্রহঃ ইন্টারনেট।

খাজা চিশতীর বাণীঃ হযরত খাজা ফরিদউদ্দিন গন্ঞ্জে শক্কর (রহঃ)

 খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (রাঃ) এক স্থানে লিখিয়াছেন - "বন্ধুর রহস্যের উদাহরণ এক সৌন্দর্য্যময়ী নারীর ন্যায়। প্রেমিকের জ্বলন্ত অন্তর ব্যতীত যাহার আর কোথাও শান্তি পাওয়ার জায়গা নাই।"

হযরত ইয়াহ্ ইয়া মাআয রাযী (রাঃ)-কে লোকে জিগ্যাসা করিলঃ - "হযরত! আপনার পবিত্র মুখে আমরা কখনও হাসি দেখি নাই। ইহার কারণ কি?"

তিনি উত্তর করিলেনঃ -" দিবা রাত্রের এমন কোন একটি মুহুর্ত খালি যায় না যখন আমার অন্তঃকরণে আল্লাহর রহস্যের জ্যোতি অবতীর্ণ না হয়। যাহার অন্তঃকরণ বন্ধুর রহস্যের ভান্ডার তাহার আবার বাহ্যিক হাসির কি প্রয়োজন? শুধু ঐ একটি দিনই হাসিব যখন বন্ধুর পক্ষ হইতে তাহার নিকট যাওয়ার আমন্ত্রণ আসিবে।

আমীরুল মোমেনীন হযরত ওমর (রাঃ) - কে লোকে জিগ্যাসা করিলেন - "আপনি আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব করিয়া কি দেখিয়াছেন?"
তিনি উত্তর করিলেনঃ একদিন আমি উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় আমার হাতে প্রেমের আয়না দেওয়া হইলো। সেই আয়নায় আমি এমন একটি আকৃতি দেখিলাম - যাহা দেখার সাথে সাথে চঞ্চল হইয়া উঠিলাম। অতঃপর আমি তওবাহ এসতেগফার এবং কান্নাকাটি করিয়া বলিলামঃ - "আল্লাহ! তুমি আমাকে এই নিয়ামত দান কর।" এরশাদ হইলোঃ "তোমাকে দান করিলাম। কিন্তু ইহা কাহার নিকট প্রকাশ করিও না। তাহা হইলে অন্য প্রকার রহস্য অবগত হওয়ার উপযুক্ত থাকিবে।"

অতঃপর শায়খুল ইসলাম একটি কবিতা পাঠ করিলেন। উহার অর্থ এই -
"তোমার প্রেম আমাকে বন্দী ও বিষ্ময়াপন্ন করিয়া রাখিয়াছে,
বিজনবনে হয়রান পেরেশান করিয়া করিয়া রাখিয়াছে।
এই সমস্ত আপদ বিপদে জড়িত থাকা স্বত্ত্বেও - হে বন্ধু! দেখিয়া রাখ!
তোমার রহস্যাবলী কেমন ভাবে অন্তরের মণি কোঠায় গোপন করিয়া রাখিয়াছি।"

তথ্যাবলীঃ
--------
গ্রন্ধসুত্রঃ ইসরারুল আউলিয়া (আউলিয়া রহস্য)। পৃষ্ঠাঃ ১৫ দ্রষ্টব্য।
মুল গ্রন্থঃ হযরত খাজা শায়খ ফরীদ (রাঃ)।
অনুবাদঃ আবদুল জলীল।
ফেরদৌস পাবলিকেশনস, ৪১ নর্থব্রুকহল রোড, ঢাকা।

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

মোরাকাবা বা ধ্যান সাধনা

ধ্যানের দ্বারা প্রেমাগুণ প্রজ্জ্বলিত হয়। যে ধ্যান করে না সে প্রেম থেকে বঞ্চিত। আল্লাহ বলেনঃ "যারা আমাকে পাওয়ার সাধনা করে আমি তাকে তাদেরকে সেই পথ প্রদর্শন করি" - [সূরা আনকাবুত—৬৯]।

এবার আসি মূল আলোচনায়। এ আলোচনা অতি দীর্ঘ। অবশ্যই আত্মার জ্ঞান অন্বেষণকারীগণ ধৈর্য নিয়ে পড়বেন এবং তা থেকে আলোর সন্ধান পাবেন। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কারণ সবকিছু সত্যের ফলশ্রুতি তে প্রকাশিত।

মুর্শিদকে দেখলে মৃত অন্তর সজীব হয় বা রোগাক্রান্ত অন্তর আরাম বোধ করে এবং চিন্তিত হৃদয়ের চিন্তা দূর হয়। মুর্শিদের আসল এবং প্রকৃত রূপ যে দেখে, সে মরে না। যেমনঃ আযরাঈলের ( আঃ) আসল রূপ যে দেখে, সে বাঁচে না। তবে এ দেখা কয়েক প্রকার হতে পারে। যেমন- বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখা এবং অন্তর দৃষ্টিতে বা ধ্যানে দেখা।

বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য সামনা-সামনি হওয়া প্রয়োজন। ধ্যানে দেখার ব্যাপরে কাছে বা দূরে, অতি দূরেও কোন পার্থক্য নেই। কারণ এটা মুর্শিদের বৈশিষ্ট্য। তবে যার ধ্যানশক্তি উম্মোাচিত হয়েছে, তাঁর জন্য মুর্শিদের রূপের ধ্যান একটা বিরাট নিয়ামত। এর ন্যূনতম উপকারিতা হলো এই যে, এ ধ্যানে আপন মুর্শিদের সাহচর্যের উপকারিতা পাওয়া যায়। অর্থাৎ মুর্শিদের অবর্তমানে মুর্শিদের রূপের ধ্যান মুরিদকে তাঁর সাহচর্যের উপকারিতা প্রদান করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, মুর্শিদের আসলরূপ আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত। নবী করীম (সঃ) বলেনঃ "যে আমাকে দেখেছে, বস্তুতঃ সে আল্লাহকে দেখেছে"। সুতরাং যে আল্লাহকে দেখেছে, সে আলমে লাহুত বা ঐশী জগতের অধিকারী হয়েছে। আর আলম-এ লাহুতে মৃত্যুর প্রবেশাধিকার নেই। অতএব, যে নশ্বর জগৎ অতিক্রম করে অমর জগতে প্রবেশ করেছে, তার আর মরণ নেই। বরং সে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে যায়। এ জন্য আল্লাহর অলিগণ ছাড়া অন্যরা এ বিষয় বুঝে না। না বুঝে ভাল কথা, কিন্তু বিপদ এই যে, তারা মুর্শিদ সাধনার ঘোর বিরোধী।

এখানে স্মরণীয় যে, মুর্শিদের রূপ আল্লাহর গুণাবলীতে পরিপূর্ণ। যার ধ্যানের মাধ্যমে শত সহস্র্র সংকেত ও গোপন রহস্য সম্পর্কে আলোক লাভ হয়। যেখানে আল্লাহর অলিগন আল্লাহর জাত সত্তা গুনে গুনাম্বিত, রূপ রসে স্বভাবে একাকর। আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান, ফানা ফিল্লায় উপনীত। তাই হাদিসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দার হাত, পা, চোখ মূখ সমস্ত ইন্দ্রীয়তে পরিনত হয়, যা দ্বারা সে কার্য সম্পাদন করে, মূলত তা আল্লাহই করেন। আর এই মুর্শিদের ধ্যান সাধানা মুলতঃ আল্লাহর সাধনা। তা না হলে আল্লাহর ধ্যান কি উপায় কোন রূপে করবে বল? অনেকের মতে মুর্শিদের ধ্যান করা শিরক হারাম। তবে তারা বলুক আল্লাহর ধ্যান কি ভাবে করতে হয়? মোট কথা এদের ঈমান একিন সম্মান্ধে কোন ধারনাই নেই। আল্লাহর এবাদত তো পরের কথা।
যা হোক, চুড়ান্ত সত্য হল এই যে, মোরাকাবাতে মুর্শিদের চেহারা ধ্যান করলে উপকার হয়। কারণ, মুরিদ যখন ধ্যানে আপন মুর্শিদের চেহারার মুখোমুখি হয়, তখন তার ভিতর বিশ্বাস, প্রেম, এবং ধ্যান শক্তি—এ তিনটি মনাকর্যক ও মহৎগুন সৃষ্টি হয়। এ তিনটি গুন একই সঙ্গে যখন মুর্শিদের নূরী অন্তর এবং প্রেমের দৃঢ়তার রাজ্যের আওতায় প্রবেশ করে এবং এর প্রতিক্রিয়া মুরীদের অন্তরে এক প্রকার চুম্বক ও আকর্ষণ জন্মলাভ করে এবং প্রতিক্রিয়া মুরীদের আত্মার মধ্য দিয়ে তার সমগ্র দেহে ত্বরাঙ্গিত হয়। তখন আত্মাসহ মুরীদের সারা দেহ তা দ্বারা আলোকোদ্ভাসিত হয়। তাতে দিশারীরূপ ধ্যানের চাবির বদৌলতে মহামূল্যবান সম্পদ মুর্শিদের ইচ্ছার ভান্ডার খুলে যায় এবং মুর্শিদের ভিতর যে অনন্ত সম্পদ নিহিত রয়েছে, মুরীদ তা থেকে অংশ পেতে শুরু করে।

আতরের সুবাস দূর থেকেই পাওয়া যায় এবং অনুভবও করা যায়। অনুরূপভাবে বারুদ ও দিয়াশলাইর মধ্যে সুপ্ত আগুনের মতো মুর্শিদের ভিতরও নেয়ামতসমূহ মজুদ রয়েছে। এ কারণে যথাযোগ্য মুর্শিদের সত্তাও বারুদেরই মতো তেজোদীপ্ত। এর সাথে প্রেমাগুন যুক্ত হলে তা আতশবাজির ন্যায় স্বীয় শক্তিতেই অন্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে এবং পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে। ধ্যানের দ্বারা প্রেমাগুণ প্রজ্জালিত হয়। যে ধ্যান করে না, সে প্রেম থেকে বঞ্চিত। প্রেমাগ্নি যখন মাশুকের বারুদগ্নির সাথে মিলিত হয়, তখনই প্রেমিক আতশবাজির আনন্দ অনুভাব করে। আতশ বাজির সময় যেমন রং বেরং এর ঝাড় ফুল এবং আলো বিচ্ছুরিত হয়, তেমনই মুর্শিদের ধনাগারেও নানারূপ ইস্কে এলাহীর নূর প্রজ্জ্বলিত হয়। এটা মুর্শিদের রূহের প্রভাব এবং বৈশিষ্ট্য।

কোর’আনে আল্লাহর নামের সাথে সাথে যে সব অনুকম্পার কথা বর্ণিত হয়েছে, ঠিক সে রকম মুর্শিদের সত্তাও আল্লাহর সে সব মহত্ব, পূর্ণতা এবং মহব্বত দ্বারা পরিপূর্ণ। অতএব, মুর্শিদের সত্তার ধ্যান ও চর্চ্চা করা হলে পবিত্র সূক্ষ্ম রূহের সূক্ষ্ম প্রভাব মুরীদের রূহ বা আত্মাকে প্রভাবিত করতে থাকে। যেমনই প্রেম আন্দোলিত হয় মাশুকের স্মরণে। এভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন হয়, তার আত্মা প্রেমাগুনে দগ্ধ হয় এবং এর ফলে মাশুকের নূরী রং তার মধ্যে চমকাতে থাকে। আশিক ও মাশুকের মধ্যে এরূপ একাত্মতার সম্পর্ক অবশ্যই বর্তমান রয়েছে। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক ভাব থাকতেই পারে না। এটা করো কাছেই গোপন নেই যে, মূলের বিরোধী হয়ে মূলে পৌঁছা যায় না। প্রত্যেক বস্তুই স্ব স্ব মূলের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং মূলের দিকেই আকৃষ্ট।

ইশককে এলাহীর উৎস স্বয়ং আল্লাহ ও পরমসত্তা। বিধায় ইশক্ বা প্রেম উক্ত সত্তারই গুণ ও ফল। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ভক্ত তাঁর থেকে তিনি যে শক্তি, সামর্থ, জ্ঞান-গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হন, তা সবই তাঁর সেই প্রেমাস্পদ আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। মাশুক স্বত্তার আকর্ষণ গুণেই এরূপ হয়। যে ব্যক্তি ‘শরাফতে হক্ক’ প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি অতি সৌভাগ্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যের অধিকারী। এ ‘শরাফতে হক্ক’ এর প্রভাবে যার অন্তর আলোকিত হয়, তাঁর জ্ঞান গরিমা, গুণাবলী ও স্বত্তা সবই নূরময় রূপ ধারণ করে। ফলে তাঁর দেহও নূরময় হয়। এটাই মাশুকের প্রেমের মর্ম ও রূপায়ণ। অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা ও বৈশিষ্ট্যবলী তাঁর প্রেমিকের সত্তায় রূপান্তরিত হয়। এ কারণেই তাঁকে ‘ফানা ফিল্লাহ’ অথবা ‘ বাকা বিল্লাহ’ বলা হয়। অর্থাৎ তাঁর দেহ-মন মাশুকের সাথে লীন হয়ে স্থিতিপ্রাপ্ত হয়ে যায়।
লেথক - সেখ আসাদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী