(পুর্ব প্রকাশের পর)
দ্যাখ কিতাব বা কেতাব বলতে
আমরা কি বুঝি? বুঝি পুস্তক বা বই কিংবা পাঠযোগ্য কোন বিষয়। সেই অর্থে কিতাব বলতে
মানব দেহকেও বুঝায়। মানব দেহও পাঠযোগ্য বিষয়। দেহপাঠে মুল গুরু হচ্ছে যার যার
মুর্শিদ। যে এই কিতাবের ভেদরহস্য জানে। যে উরুজ-নুযুল সর্ম্পকে ওয়াকিবহাল। কোথা
থেকে আয়াত নুযুল হয় তা দেখাবার বিষয়। কোরআনে সুরা কদরে বলা হয়েছেঃ "ইন্না
আনযালনা হু ফি লাইলাতুল কাদরি।" ইন্না -> অবশ্যই, আনযালনা
->নুযুল-অবতরণ হয় হু->তিনিত্ব ফি->আছে, মধ্যে, ভেতরে, লাইল->রাত্রি,
কদর->শক্তিশালী। তাহলে অবশ্যই হু নাযিল হয় শক্তিশালী রাত্রিতে। এই হু বা
তিনিত্বকে দেখার বিষয়। জানার বিষয়। তিনি কি বলছেন তা শোনার বিষয়
হৃদয়ও বনে অতি গোপনে একার
বাঁশি শুনেছি প্রাণে।
মরমে মরি চাহি নেহারি প্রাণ
বধুয়া নাহিক হেথা।।
শুনতে হয় কান পেতে সে কি
বলছে? কে কথা বলে? গুরু। পরম গুরু। তিনিই একটি আকার নিয়ে অন্তরের মণিকোঠায় বসে
আছেন। তিনিই সব কিছু পরিচালনা করছেন। তিনিই সর্বেসর্বা। তিনিই আহাদ। আবার তিনিই
সামাদ। তাকে দেখলে তুই চমকে উঠবি।
চমকি উঠি রুপেরই ছটায় থমকে
উঠি হেরিয়ে বাকায়
জাগিয়ে দেখি নাহিক হেথায়
কোথায় গিয়ে লুকালে সখা।
আরেকটি বিষয় শোন। আল্লাহ সর্ব
বিষয়ে মুহিত তথা দ্রবীভুত অবস্থায় বিরাজমান। তার অস্তিত্ব সমগ্র বিশ্বময়।
দেও দানব মানব-জ্বীন খোদা
বিনা সবি হীন।
খোদার খোদা যিনি আছেন কেমন
চিন্তা করে ধ্যান ধরলে হয়ে যাবি দেওয়ানা।
আমি মনার কথা মন দিয়ে শুনছি। সে কি বলতে চাইছে। সে যেটা বলছে সেটা দর্শনের ভাষায় বলা হয়-সর্বেশ্বরবাদ বা
প্যাথেইজম। ওয়াহদাতুল অযুদ।সমগ্র বিশ্বটাই আল্লাহর দেহ। তিনি ছাড়া আর কোন কিছুরই
অস্তিত্ব নাই। সর্বত্রই তার সরব উপস্থিতি। ছান্দোগ্য উপনিষদে এর একটি চমৎকার
বর্ণনা আছে। শ্বেতকেতু নামে উদ্দালক আরুণির এক পুত্র ছিলেন। একবার আরুণি তাঁর
পুত্রকে বললেন,‘শ্বেতকেতু, তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করো। আমাদের
বংশে বেদ অধ্যয়ন না করে শুধু নামে মাত্র ব্রাহ্মণ হয়েছেন এমন কেউ নেই। (ছান্দোগ্য-৬/১/১) ।। বারো বছর বয়সে শ্বেতকেতু গুরুগৃহে গেলেন। চব্বিশ বছর
বয়স পর্যন্ত সেখানে থেকে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করে গম্ভীরচিত্ত, অবিনয়ী ও পাণ্ডিত্যের
অহংকারে পূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, ‘শ্বেতকেতু, তুমি দেখছি
গম্ভীর, পাণ্ডিত্যাভিমানী ও অবিনীতস্বভাব হয়ে ফিরে এসেছো। কিন্তু তুমি কি সেই
উপদেশের কথা গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলে–। (ছান্দোগ্য-৬/১/২) ।। – যে উপদেশের
সাহায্যে অশ্রুতবিষয় শোনা যায়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয়
জানা যায়।’ (শ্বেতকেতু জিজ্ঞাসা করলেন) ‘ভগবন্, কী সেই উপদেশ?’ (ছান্দোগ্য-৬/১/৩) ।। হে সোম্য, যেমন একখণ্ড মাটিকে জানলেই মাটির তৈরি সব
জিনিসকে জানা যায়। জিনিসগুলি নামে আলাদা বা নামের বিকার, কেবলমাত্র মাটিই সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/১/৪) ।। হে সোম্য, একতাল সোনাকে জানলে যেমন সোনার তৈরি সব
জিনিসকেই জানা যায়। সোনার অলঙ্কারগুলি কেবল নামের বিকার, কতগুলি শব্দ মাত্র। সোনাই
একমাত্র সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/১/৫)।। (শ্বেতকেতু বললেন)– ‘আমার পূজনীয়
আচার্যগণ নিশ্চয়ই এ সত্য জানতেন না। যদি জানতেন তবে বললেন না কেন? অতএব ভগবন্,
আপনি আমাকে তা বলুন।’ পিতা বললেন, ‘সোম্য, তাই হোক।’(ছান্দোগ্য-৬/১/৭) ।।
হে সোম্য, এই দৃশ্যমান জগৎ
প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় সৎরূপে বিদ্যমান ছিলো। এই বিষয়ে কেউ কেউ বলেন,‘এই জগৎ
প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় অসৎরূপে বিদ্যমান ছিলো’অর্থাৎ তখন কোন কিছুরই
অস্তিত্ব ছিলো না। সেই অসৎ থেকেই সৎ হয়েছে। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।। পিতা বললেন,
‘কিন্তু সোম্য, তা কী করে হতে পারে? অসৎ (অর্থাৎ শূন্য) থেকে কী করে সৎ (অস্তিত্ব) উৎপন্ন হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে, হে সোম্য, এই জগৎ প্রকাশিত হওয়ার আগে এক ও অদ্বিতীয়
সৎরূপেই বর্তমান ছিলো।’ (ছান্দোগ্য-৬/২/২)।। সেই সৎ-বস্তু সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি
বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ তারপর তেজ অর্থাৎ অগ্নি সৃষ্টি হলো। সেই তেজও
সঙ্কল্প করলেন,‘আমি বহু হবো,উৎকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ সেই তেজ থেকে জল উৎপন্ন
হলো। তাই যখনই মানুষ শোক করে বা ঘর্মাক্ত হয়, তখনই তেজ থেকে জল উৎপন্ন হয়। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)।। সেই জল সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে
উৎপন্ন হবো।’ সেই জল থেকে অন্ন (পৃথিবী) সৃষ্টি হলো। এইজন্য যেখানে যখন বৃষ্টি
পড়ে, সেখানেই প্রভূত অন্ন উৎপন্ন হয়। এই অন্নই পৃথিবী। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।।
এই জগতে যত ভূত আছে, বিষয়
আছে, জীবন আছে, সবই এই ত্রিবিৎকরণ বা তিনের (তেজ, জল, অন্ন) মধ্যে। যেমন– অণ্ডজ (ডিম থেকে জাত), জীবজ (জীব বা পিতামাতার থেকে জাত)এবং উদ্ভিজ্জ (উদ্ভিদ থেকে
জাত)। এই তিনের বাইরে কিছু নেই। (ছান্দোগ্য-৬/৩/১)।। পূর্বোক্ত সেই
সৎবস্তুস্বরূপ দেবতা আবার সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি এই তিন দেবতার (অর্থাৎ তেজ, জল ও
অন্ন বা পৃথিবীর) মধ্যে আত্মরূপে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে নামে রূপে প্রকাশ করি না
কেন?’ (ছান্দোগ্য-৬/৩/২)।। ‘উক্ত তিন দেবতার প্রত্যেককে আগে ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ
(তিন তিন ভাগে বিভক্ত) করে দিই। প্রত্যেকের মধ্যেই প্রত্যেকের কিছু কিছু অংশ
ঢুকিয়ে দিই।’ এই ভেবে তিনি এঁদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে নানা নামে-রূপে
প্রকাশ করলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৩/৩)।।
স্থূল অগ্নির যে লাল বা
রক্তবর্ণ তা সূক্ষ্ম অগ্নির রূপ, যা সাদা বা শুক্লবর্ণ তা সূক্ষ্ম জলের রূপ, আর যা
কালো বা কৃষ্ণবর্ণ তা সূক্ষ্ম অন্ন বা পৃথিবীর রূপ। এইভাবে অগ্নির অগ্নিত্ব দূর
হলো। কারণ সব পরিবর্তন বা বিকারই শব্দাত্মক, নামমাত্র (অর্থাৎ অগ্নি একটি নাম
মাত্র। এর দ্বারা একটি বিশেষ অবস্থাকে বোঝাচ্ছে)। এই তিনটি বর্ণই (অর্থাৎ তিনটি
সূক্ষ্ম মহাভূতই) কেবলমাত্র সত্য।(ছান্দোগ্য-৬/৪/১)।। একথা জেনেই
প্রাচীনকালে আদর্শ গৃহী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেছিলেন– ‘আজ থেকে কোন ব্যক্তি
আমাদের এমন কিছু বলতে পারবেন না যা আমরা শুনিনি, চিন্তা করিনি বা আমাদের জানা
নেই।’ কারণ লোহিতাদি এই তিন রূপের কথা তাঁরা জেনেছিলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৫)।। তাঁরা জেনেছিলেন যে, যা কিছু লাল বলে মনে হয় তা তেজের (অগ্নির) রূপ, যা কিছু সাদা
বলে মনে হয় তা জলের রূপ, এবং যা কিছু কালো বলে মনে হয় তা অন্ন বা পৃথিবীর রূপ। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৬)।। অন্য যা কিছু অজানা ছিলো, তাও যে এই তিন দেবতারই
(অর্থাৎ তেজ, জল ও অন্ন বা পৃথিবীর) সমষ্টি বা সংযোগ তা তাঁরা বুঝেছিলেন । হে সোম্য
জেনে নাও, এই তিন দেবতা কিভাবে ত্রিবৃৎ হয়ে শরীর, মন, প্রাণ, বাক্য উৎপন্ন করছে। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৭)।।
আমরা যে অন্ন বা খাবার খাই তা
শরীরের ভিতরে গিয়ে তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ মলে, মধ্যম অংশ মাংসে এবং
সূক্ষ্মতম অংশ মনে পরিণত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/১)।। আমরা যে জল পান করি তা
তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ মূত্রে, মধ্যম অংশ রক্তে এবং সূক্ষ্মতম অংশ
প্রাণে রূপান্তরিত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/২)।। (ঘি, মাখন প্রভৃতি
শক্তি-উৎপাদনকারী) তেজস্কর পদার্থ খেলে তা তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ
অস্থি, মধ্যম অংশ মজ্জা এবং সূক্ষ্মতম অংশ বাক্-এ পরিণত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/৩)।। ‘অতএব, হে সোম্য, মন অন্নের দ্বারা পুষ্ট হয় এবং প্রাণ
জলের দ্বারা। আর বাক্ পরিপুষ্টি লাভ করে তেজের দ্বারা।’ (শ্বেতকেতু বললেন)– ‘আপনি
আমাকে আবার বুঝিয়ে বলুন।’ পিতা বললেন, ‘হে সোম্য, তাই হোক।’ (ছান্দোগ্য-৬/৫/৪)।।
হে সোম্য, মানুষের ষোলটি কলা
বা অংশ আছে। তুমি পনেরো দিন কিছু আহার কোরো না। তবে যত ইচ্ছে জল পান কোরো। কারণ
প্রাণ জলের ওপর নির্ভরশীল। জল পান করলে প্রাণ বিয়োগ হয় না। (ছান্দোগ্য-৬/৭/১)।। শ্বেতকেতু পনের দিন কিছু খেলেন না। তারপর পিতার নিকট
উপস্থিত হতেই পিতা বললেন,‘সোম্য, তুমি তো সব বেদই অধ্যয়ন করেছো। আমাকে ঋক, যজুঃ,
সাম বেদ থেকে কিছু মন্ত্র শোনাও তো।’ শ্বেতকেতু বললেন,‘ওসব আমার কিছুই মনে পড়ছে
না।’(ছান্দোগ্য-৬/৭/২)।। পিতা আরুণি শ্বেতকেতুকে বললেন,‘হে সোম্য, যদি
বিশাল প্রজ্বলিত অগ্নির থেকে জোনাকি পোকার মতো ছোট একখণ্ড অঙ্গারমাত্র অবশিষ্ট
থাকে তবে তার দ্বারা তার চেয়ে বড় কোন বস্তু দগ্ধ করা যায় না। তেমনি তোমার ষোল কলার
এক কলা মাত্র অবিশিষ্ট আছে। তার দ্বারা বেদসমূহ বুঝতে পারছো না। ভয় নেই। তুমি
নিত্য অন্নভোজন শুরু করো। আহার করো, পরে আমার কথা বুঝতে পারবে।
(ছান্দোগ্য-৬/৭/৩)।।শ্বেতকেতু এবার নিয়মিত অন্নাহার করে একদিন পিতার কাছে
এলেন। পিতা তাঁকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন,সে সবই তিনি অনায়াসে বুঝতে ও বলতে
পারলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৪)।। পিতা তাঁকে বললেন,‘হে সোম্য, প্রায় নিভে যাওয়া
বিশাল অগ্নিকুণ্ডের সেই জোনাকি পোকার মতো ছোট অঙ্গারটিকে যদি খড়কুটো দিয়ে আবার দাউ
দাউ বাড়িয়ে তোলা যায় তবে তার দ্বারা আগের চেয়েও বেশি পরিমাণ বস্তু দগ্ধ করা যায়।’
(ছান্দোগ্য-৬/৭/৫)।।‘ তেমনি হে সোম্য, তোমার ষোলটি কলার এক কলা মাত্র
অবশিষ্ট ছিলো। সেই কলাটি অন্নের দ্বারা বর্ধিত হয়ে প্রজ্বলিত হয়েছে। এখন তার
দ্বারাই তুমি বেদ বুঝতে পারছো, সহজে বলে যেতে পারছো। অতএব হে সোম্য, এখন বুঝতে
পারছো কেন আমি বলেছি মন অন্নময়, প্রাণ জলময় এবং বাক্ তেজোময় !’ তখন শ্বেতকেতু পিতা
আরুণির উপদেশ বুঝতে পারলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৬)।।
(চলবে)