পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে-চতুর্থ পর্ব



(পুর্ব প্রকাশের পর) 
 
দ্যাখ কিতাব বা কেতাব বলতে আমরা কি বুঝি? বুঝি পুস্তক বা বই কিংবা পাঠযোগ্য কোন বিষয়। সেই অর্থে কিতাব বলতে মানব দেহকেও বুঝায়। মানব দেহও পাঠযোগ্য বিষয়। দেহপাঠে মুল গুরু হচ্ছে যার যার মুর্শিদ। যে এই কিতাবের ভেদরহস্য জানে। যে উরুজ-নুযুল সর্ম্পকে ওয়াকিবহাল। কোথা থেকে আয়াত নুযুল হয় তা দেখাবার বিষয়। কোরআনে সুরা কদরে বলা হয়েছেঃ "ইন্না আনযালনা হু ফি লাইলাতুল কাদরি।" ইন্না -> অবশ্যই, আনযালনা ->নুযুল-অবতরণ হয় হু->তিনিত্ব ফি->আছে, মধ্যে, ভেতরে, লাইল->রাত্রি, কদর->শক্তিশালী। তাহলে অবশ্যই হু নাযিল হয় শক্তিশালী রাত্রিতে। এই হু বা তিনিত্বকে দেখার বিষয়। জানার বিষয়। তিনি কি বলছেন তা শোনার বিষয়

হৃদয়ও বনে অতি গোপনে একার বাঁশি শুনেছি প্রাণে।
মরমে মরি চাহি নেহারি প্রাণ বধুয়া নাহিক হেথা।।




শুনতে হয় কান পেতে সে কি বলছে? কে কথা বলে? গুরু। পরম গুরু। তিনিই একটি আকার নিয়ে অন্তরের মণিকোঠায় বসে আছেন। তিনিই সব কিছু পরিচালনা করছেন। তিনিই সর্বেসর্বা। তিনিই আহাদ। আবার তিনিই সামাদ। তাকে দেখলে তুই চমকে উঠবি।

চমকি উঠি রুপেরই ছটায় থমকে উঠি হেরিয়ে বাকায়
জাগিয়ে দেখি নাহিক হেথায় কোথায় গিয়ে লুকালে সখা।

আরেকটি বিষয় শোন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে মুহিত তথা দ্রবীভুত অবস্থায় বিরাজমান। তার অস্তিত্ব সমগ্র বিশ্বময়।

দেও দানব মানব-জ্বীন খোদা বিনা সবি হীন।
খোদার খোদা যিনি আছেন কেমন চিন্তা করে ধ্যান ধরলে হয়ে যাবি দেওয়ানা।

আমি মনার কথা মন দিয়ে শুনছি। সে কি বলতে চাইছে। সে যেটা বলছে সেটা দর্শনের ভাষায় বলা হয়-সর্বেশ্বরবাদ বা প্যাথেইজম। ওয়াহদাতুল অযুদ।সমগ্র বিশ্বটাই আল্লাহর দেহ। তিনি ছাড়া আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব নাই। সর্বত্রই তার সরব উপস্থিতি। ছান্দোগ্য উপনিষদে এর একটি চমৎকার বর্ণনা আছে। শ্বেতকেতু নামে উদ্দালক আরুণির এক পুত্র ছিলেন। একবার আরুণি তাঁর পুত্রকে বললেন,‘শ্বেতকেতু, তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করো। আমাদের বংশে বেদ অধ্যয়ন না করে শুধু নামে মাত্র ব্রাহ্মণ হয়েছেন এমন কেউ নেই। (ছান্দোগ্য-৬/১/১) ।। বারো বছর বয়সে শ্বেতকেতু গুরুগৃহে গেলেন। চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে থেকে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করে গম্ভীরচিত্ত, অবিনয়ী ও পাণ্ডিত্যের অহংকারে পূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, ‘শ্বেতকেতু, তুমি দেখছি গম্ভীর, পাণ্ডিত্যাভিমানী ও অবিনীতস্বভাব হয়ে ফিরে এসেছো। কিন্তু তুমি কি সেই উপদেশের কথা গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলে–। (ছান্দোগ্য-৬/১/২) ।। – যে উপদেশের সাহায্যে অশ্রুতবিষয় শোনা যায়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়।’ (শ্বেতকেতু জিজ্ঞাসা করলেন) ‘ভগবন্, কী সেই উপদেশ?’ (ছান্দোগ্য-৬/১/৩) ।। হে সোম্য, যেমন একখণ্ড মাটিকে জানলেই মাটির তৈরি সব জিনিসকে জানা যায়। জিনিসগুলি নামে আলাদা বা নামের বিকার, কেবলমাত্র মাটিই সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/১/৪) ।। হে সোম্য, একতাল সোনাকে জানলে যেমন সোনার তৈরি সব জিনিসকেই জানা যায়। সোনার অলঙ্কারগুলি কেবল নামের বিকার, কতগুলি শব্দ মাত্র। সোনাই একমাত্র সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/১/৫)।। (শ্বেতকেতু বললেন)– ‘আমার পূজনীয় আচার্যগণ নিশ্চয়ই এ সত্য জানতেন না। যদি জানতেন তবে বললেন না কেন? অতএব ভগবন্, আপনি আমাকে তা বলুন।’ পিতা বললেন, ‘সোম্য, তাই হোক।’(ছান্দোগ্য-৬/১/৭) ।।

হে সোম্য, এই দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় সৎরূপে বিদ্যমান ছিলো। এই বিষয়ে কেউ কেউ বলেন,‘এই জগৎ প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় অসৎরূপে বিদ্যমান ছিলো’অর্থাৎ তখন কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিলো না। সেই অসৎ থেকেই সৎ হয়েছে। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।। পিতা বললেন, ‘কিন্তু সোম্য, তা কী করে হতে পারে? অসৎ (অর্থাৎ শূন্য) থেকে কী করে সৎ (অস্তিত্ব) উৎপন্ন হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে, হে সোম্য, এই জগৎ প্রকাশিত হওয়ার আগে এক ও অদ্বিতীয় সৎরূপেই বর্তমান ছিলো।’ (ছান্দোগ্য-৬/২/২)।। সেই সৎ-বস্তু সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ তারপর তেজ অর্থাৎ অগ্নি সৃষ্টি হলো। সেই তেজও সঙ্কল্প করলেন,‘আমি বহু হবো,উৎকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ সেই তেজ থেকে জল উৎপন্ন হলো। তাই যখনই মানুষ শোক করে বা ঘর্মাক্ত হয়, তখনই তেজ থেকে জল উৎপন্ন হয়। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)।। সেই জল সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ সেই জল থেকে অন্ন (পৃথিবী) সৃষ্টি হলো। এইজন্য যেখানে যখন বৃষ্টি পড়ে, সেখানেই প্রভূত অন্ন উৎপন্ন হয়। এই অন্নই পৃথিবী। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।।

এই জগতে যত ভূত আছে, বিষয় আছে, জীবন আছে, সবই এই ত্রিবিৎকরণ বা তিনের (তেজ, জল, অন্ন) মধ্যে। যেমন– অণ্ডজ (ডিম থেকে জাত), জীবজ (জীব বা পিতামাতার থেকে জাত)এবং উদ্ভিজ্জ (উদ্ভিদ থেকে জাত)। এই তিনের বাইরে কিছু নেই। (ছান্দোগ্য-৬/৩/১)।। পূর্বোক্ত সেই সৎবস্তুস্বরূপ দেবতা আবার সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি এই তিন দেবতার (অর্থাৎ তেজ, জল ও অন্ন বা পৃথিবীর) মধ্যে আত্মরূপে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে নামে রূপে প্রকাশ করি না কেন?’ (ছান্দোগ্য-৬/৩/২)।। ‘উক্ত তিন দেবতার প্রত্যেককে আগে ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ (তিন তিন ভাগে বিভক্ত) করে দিই। প্রত্যেকের মধ্যেই প্রত্যেকের কিছু কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিই।’ এই ভেবে তিনি এঁদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে নানা নামে-রূপে প্রকাশ করলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৩/৩)।।

স্থূল অগ্নির যে লাল বা রক্তবর্ণ তা সূক্ষ্ম অগ্নির রূপ, যা সাদা বা শুক্লবর্ণ তা সূক্ষ্ম জলের রূপ, আর যা কালো বা কৃষ্ণবর্ণ তা সূক্ষ্ম অন্ন বা পৃথিবীর রূপ। এইভাবে অগ্নির অগ্নিত্ব দূর হলো। কারণ সব পরিবর্তন বা বিকারই শব্দাত্মক, নামমাত্র (অর্থাৎ অগ্নি একটি নাম মাত্র। এর দ্বারা একটি বিশেষ অবস্থাকে বোঝাচ্ছে)। এই তিনটি বর্ণই (অর্থাৎ তিনটি সূক্ষ্ম মহাভূতই) কেবলমাত্র সত্য।(ছান্দোগ্য-৬/৪/১)।। একথা জেনেই প্রাচীনকালে আদর্শ গৃহী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেছিলেন– ‘আজ থেকে কোন ব্যক্তি আমাদের এমন কিছু বলতে পারবেন না যা আমরা শুনিনি, চিন্তা করিনি বা আমাদের জানা নেই।’ কারণ লোহিতাদি এই তিন রূপের কথা তাঁরা জেনেছিলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৫)।। তাঁরা জেনেছিলেন যে, যা কিছু লাল বলে মনে হয় তা তেজের (অগ্নির) রূপ, যা কিছু সাদা বলে মনে হয় তা জলের রূপ, এবং যা কিছু কালো বলে মনে হয় তা অন্ন বা পৃথিবীর রূপ। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৬)।। অন্য যা কিছু অজানা ছিলো, তাও যে এই তিন দেবতারই (অর্থাৎ তেজ, জল ও অন্ন বা পৃথিবীর) সমষ্টি বা সংযোগ তা তাঁরা বুঝেছিলেন । হে সোম্য জেনে নাও, এই তিন দেবতা কিভাবে ত্রিবৃৎ হয়ে শরীর, মন, প্রাণ, বাক্য উৎপন্ন করছে। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৭)।।

আমরা যে অন্ন বা খাবার খাই তা শরীরের ভিতরে গিয়ে তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ মলে, মধ্যম অংশ মাংসে এবং সূক্ষ্মতম অংশ মনে পরিণত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/১)।। আমরা যে জল পান করি তা তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ মূত্রে, মধ্যম অংশ রক্তে এবং সূক্ষ্মতম অংশ প্রাণে রূপান্তরিত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/২)।। (ঘি, মাখন প্রভৃতি শক্তি-উৎপাদনকারী) তেজস্কর পদার্থ খেলে তা তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ অস্থি, মধ্যম অংশ মজ্জা এবং সূক্ষ্মতম অংশ বাক্-এ পরিণত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/৩)।। ‘অতএব, হে সোম্য, মন অন্নের দ্বারা পুষ্ট হয় এবং প্রাণ জলের দ্বারা। আর বাক্ পরিপুষ্টি লাভ করে তেজের দ্বারা।’ (শ্বেতকেতু বললেন)– ‘আপনি আমাকে আবার বুঝিয়ে বলুন।’ পিতা বললেন, ‘হে সোম্য, তাই হোক।’ (ছান্দোগ্য-৬/৫/৪)।।

হে সোম্য, মানুষের ষোলটি কলা বা অংশ আছে। তুমি পনেরো দিন কিছু আহার কোরো না। তবে যত ইচ্ছে জল পান কোরো। কারণ প্রাণ জলের ওপর নির্ভরশীল। জল পান করলে প্রাণ বিয়োগ হয় না। (ছান্দোগ্য-৬/৭/১)।। শ্বেতকেতু পনের দিন কিছু খেলেন না। তারপর পিতার নিকট উপস্থিত হতেই পিতা বললেন,‘সোম্য, তুমি তো সব বেদই অধ্যয়ন করেছো। আমাকে ঋক, যজুঃ, সাম বেদ থেকে কিছু মন্ত্র শোনাও তো।’ শ্বেতকেতু বললেন,‘ওসব আমার কিছুই মনে পড়ছে না।’(ছান্দোগ্য-৬/৭/২)।। পিতা আরুণি শ্বেতকেতুকে বললেন,‘হে সোম্য, যদি বিশাল প্রজ্বলিত অগ্নির থেকে জোনাকি পোকার মতো ছোট একখণ্ড অঙ্গারমাত্র অবশিষ্ট থাকে তবে তার দ্বারা তার চেয়ে বড় কোন বস্তু দগ্ধ করা যায় না। তেমনি তোমার ষোল কলার এক কলা মাত্র অবিশিষ্ট আছে। তার দ্বারা বেদসমূহ বুঝতে পারছো না। ভয় নেই। তুমি নিত্য অন্নভোজন শুরু করো। আহার করো, পরে আমার কথা বুঝতে পারবে। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৩)।।শ্বেতকেতু এবার নিয়মিত অন্নাহার করে একদিন পিতার কাছে এলেন। পিতা তাঁকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন,সে সবই তিনি অনায়াসে বুঝতে ও বলতে পারলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৪)।। পিতা তাঁকে বললেন,‘হে সোম্য, প্রায় নিভে যাওয়া বিশাল অগ্নিকুণ্ডের সেই জোনাকি পোকার মতো ছোট অঙ্গারটিকে যদি খড়কুটো দিয়ে আবার দাউ দাউ বাড়িয়ে তোলা যায় তবে তার দ্বারা আগের চেয়েও বেশি পরিমাণ বস্তু দগ্ধ করা যায়।’ (ছান্দোগ্য-৬/৭/৫)।।‘ তেমনি হে সোম্য, তোমার ষোলটি কলার এক কলা মাত্র অবশিষ্ট ছিলো। সেই কলাটি অন্নের দ্বারা বর্ধিত হয়ে প্রজ্বলিত হয়েছে। এখন তার দ্বারাই তুমি বেদ বুঝতে পারছো, সহজে বলে যেতে পারছো। অতএব হে সোম্য, এখন বুঝতে পারছো কেন আমি বলেছি মন অন্নময়, প্রাণ জলময় এবং বাক্ তেজোময় !’ তখন শ্বেতকেতু পিতা আরুণির উপদেশ বুঝতে পারলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৬)।। 
(চলবে)     

শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে - তৃতীয় পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

আমি পীর ইয়েমেনী যা গোলাপ শাহ্ র মাজার নামে পরিচিত সেইখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম-আমি যাকে খুঁজছি সে সেখানেও নেই।  আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেখানে দু'চারজন আমার উৎসুক দৃষ্টি দেখে জানতে চাইলো-কোন মানত আছে কি-না? কিংবা কোন মিলাদ শরীফ দেব কি-না? আমি তাদের কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে এসে চিন্তা করতে লাগলাম কি করা যায়? কোথায় যাওয়া যায়? মনটা উসখুস করছে মনার জন্য। মনা যে কি জাদু করেছে আমায় কে জানে?

আমি রাস্তার একপাশে একটা টং দোকানে গিয়ে চা চাইলাম। দোকানী আমাকে চা দিল। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে দেখি চায়ের বদলে কেবল গরম পানিতে কৌটার দুধ গুলিয়ে দিয়েছে। চা-টাও স্বাদ হয়নি। বিস্বাদযুক্ত চা বিষবৎ লাগলো। আমি দোকানীর কাছ থেকে একটি সিগারেট নিয়ে তার পাওনা মিটিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম-যেখানে কোয়ানটিটি ভালো সেখানে কোয়ালিটি খারাপ হয়। আর যেখানে কোয়ালিটি ভালো সেখানে কোয়ানটিটি কম থাকে। কথাটা সত্য মনে হলো। যাক আমার কোয়ালিটি বা কোয়ানটিটি কোনটিই দরকার নেই। আমার দরকার মনা পাগলাকে। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম মীরপুর মাজারের দিকে যাই। সেখানে হয়তো থাকতে পারে। আমি মীরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে যেতে যেতে ভাবলাম মনার কথা।

মনা আমাকে বলেছিলঃ তুই কি মীর্যা গালিবের কথা শুনেছিস?

-হ্যা শুনেছি বৈকি। তার কিছু শায়েরও মুখস্ত ছিল। এখনো আছে দু'চারটা।

-তাহলে শোনা দেখি একটা ?

আমি মনার দিকে তাকিয়ে মীর্যা গালিবের একটি শায়ের বলার চেষ্টা করলামঃ

হার এক বাতপে ক্যাঁহেতে হো তুম কে তু ক্যাঁয়া হে
তুমহি কহো কে ইয়ে আন্দাজ গুফতেগু ক্যায়া হে।।
রগো মে দৌড়তে ফিরনে কে হাম নেহি কায়িল
যব আঁখোহিছে না টাপকা তো ফির লহু ক্যা হ্যায়।।

তা শুনে মনা বললোঃ

-তুই কি এর অর্থ ধরতে পেরেছিস? বুঝিস কিছু?

-না। সে ভাবে হয়তো বুঝিনি। যেভাবে আপনি কিছু বুঝাতে চাইছেন?

মনা মুচকি একটা হাসি দিল। সেই হাসির মধ্যে হয়তো একটা মিনিং ছিল। আমি সেটা ধরতে পারিনি। আমি তার দিকে তাকিয়ে সেই হাসি দেখছিলাম। জানতে চাইলাম সেই হাসি রহস্য। কিন্ত্তু মনা সেই কথার কোন উত্তর দিল না। সে কেবল মৌন রইল। হটাৎ মনা সেই মৌনতা ভেংগে বলে উঠলোঃ

-নিজেকে বড়ো ভাবার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। নেই কোন বাহাদুরী। বড়ো বড়ো শায়ের আবৃত্তি করে যদি তার অর্থই ধরতে না পারিস,তাহলে তা মুখস্ত করে কি লাভ হলো? হয়তো কাউকে শুনালি। সে শুনে না বুঝে হয়তো ভাববে তুই বেশ বড়ো মাপের কেউ। অনেক জানিস তুই। তোকে সবাই জ্ঞানী ভেবে সম্মান করবে...যত্নআত্তি করবে...আর তা পেয়ে তুই আনন্দে গদ গদ করবি...তা-না রে? ঠিক বলছি কি না? বল...
আমি কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। আমি মনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।  আমার তাকানোর ধরণ দেখে মনা আবারো বলতে শুরু করলোঃ

কেতাবত ভাই মানুষ নয় নিত্য নতুন কথা কয়
ভাবের ভাবুক হইয়া কেন কেতাব দেখ না।।
মস্তফার রুপ দেখি আবু বকর গেল মজি
আবু জাহেল ঘৃনা করি পায় যাতনা।।
 (চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে-দ্বিতীয় পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

মনা পাগলা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললোঃ তুই কি জানিস কোন্ কথাটি বলার জন্য আল্লামা ইকবালকে একশত আলেম কাফের ফতুয়া দিয়েছিল?

-না। আমিতো সেই রকম কিছুই জানি না।

-শোন তাহলে। আল্লাহকে লক্ষ্য করে আল্লামা ইকবাল বলেছিলঃ "আল্লাহ তুমি দয়ালু নও।" একই ধরণের কথা বাট্রেন্ড রাসেলও বলেছিলঃ গড ইজ অলমাইটি টাইরেন্ট। ঈশ্বর হচ্ছেন জালিমের বাদশাহ। কিন্ত্তু মজার ব্যাপার কি জানিস? দুইজনের দৃষ্টি ভিন্ন। দুইজনের দর্শন ভিন্ন। এই উক্তি ঈশ্বর বা আল্লাহকে কে করতে পারে? সাধারণের দৃষ্টিতে অনেকেই বলবে-কাফিররা। অনেকেই বলবে মুরতাদরা। কিংবা যারা ধর্ম সর্ম্পকে অজ্ঞ তারাই একথা বলতে পারে। এই উক্তিটি যদি বিশ্লেষণ করতে হয়-তাহলে তাদের দর্শন তথা তাদের চিন্তা-ধারা সর্ম্পকে জানতে হবে আগে। কিংবা তাদের নিকট এর ব্যাখ্যা চাইতে হবে। কেন তারা এ ধরণের উক্তিটি করেছিল? কিন্ত্তু তাদেরকে কোন সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। 
মনার এ কথা শুনে হয়তো অনেকেই ভুল বুঝতে পারে। যেহেতু তারা মনা পাগলাকে চেনে না। তার সাথে কথা বলেনি। এমনকি তার দর্শনও জানে না। আমি এদিক থেকে লাকি বলতে পারি। অামি মনাকে চিনি। তার সাথে কথা হয়েছে। সে মাঝে মধ্যেই আমার সাথে কথা বলতো। আমিও তার সাথে কথা বলে মজা পেতাম। তাই তার সাথে দেখা করার আরেকবার স্বাদ হলো। 

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে হাইকোর্ট মাজারের মুল গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি তা খেয়ালই করিনি। মাজারের মুল গেটে সামনের দুধারে সারি করে অনেকেই খয়রাত করছে। কেউ বা বেশ ভুষায় পরিবর্তন এনে নিজেকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি তাদের মধ্যে মনাকে খুঁজলাম। নাহ! মনা সেখানে নেই। কোথায় থাকতে পারে মনা? হয়তো ভিতরেই থাকতে পারে। আমি মৃদু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মাজারের দিকে রওনা হলাম। সেখানেও সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফকির মিসকিনরা। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে মনাকে খোজার চেষ্টা করলাম। নাহ্! সেখানেও নেই।
আমি ওযুখানা হতে ওযু করে মাজারের ভেতর প্রবেশ করলাম। মাজারের মুল ফটকের সামনে লেখাঃ বাংলা ওলি। হযরত খাজা শরফু উদ্দিন চিশতী (রহঃ)।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই হযরত খাজা শরফ উদ্দিন চিশতী (রহঃ) ছিলেন সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর মেজ ছেলে। বিভিন্ন সুত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে সুনিশ্চিতভাবে জানা গেছে যে, ওলী--বাংলা হযরত খাজা শরফুদ্দিন চিশতী (রহঃ) সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীব উন নেওয়াজ হযরত খাজা মইনুদ্দিন হাসান চিশতী (রহঃ) এর ২য় পুত্র ছিলেন হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর ২য় স্ত্রী হযরত বিবি ইসমত - এর গর্ভে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর ঔরসে ৬২৮ হিজরী মোতাবেক ১২৩০ খৃষ্টাব্দে আজমীর শরীফে জন্মগ্রহণ করেন।তার ওফাত দিবস ৯৯৮ হিজরি।

বিগত ৭৫০ বৎসর ব্যাপী লিখিত বিভিন্ন মালফুজাত, তাজকিরাত, মাকতুবাদ বিশেষ করে হযরত খাজা গরীব উন নেওয়াজ মইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর দ্বিতীয় প্রধান খলিফা হযরত হামিদউদ্দিন সাভালী (রহঃ) কর্তৃক ১২৫০ খ্রীষ্টা্ব্দ রচিত "সুরুবাস সুদুর" - তথ্য প্রদত্ত হয়েছে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) রচিত "ফাতেয়াইদুল ফুয়াদ" এবং তার খলিফা হযরত নাসিরউদ্দিন চেরাগী রচিত "খায়রুল মন্ঞ্জিলপুস্তকের বর্ণনায় এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।ওলী--বাংলার পিতৃপ্রদত্ত প্রকৃত নাম ছিল খাজা হুসামউদ্দিন আবু সালেহ চিশতী (রহঃ) এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হযরত খাজা ফখরউদ্দিন আবুল খায়ের চিশতী (রহঃ) হযরত খাজা গরীব উন নেওয়াজ (রহঃ) এর ১ম স্ত্রী বিবি আমাতুল্লাহর গর্ভজাত একই মাতার গর্ভে তার একমাত্র ভগ্নী হযরত বিবি হাফেজা জামাল (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তার কনিষ্ঠভ্রাতা হযরত খাজা গিয়াস উদ্দিন আবু সাইয়েদ চিশতী (রহঃ) তার গর্ভধারিণী মাতা বিবি ইসমত এর গর্ভজাত ছিলেন। পিতৃকুলে এই ওলী মহান ওলী সাইয়েদ ছিলেন এবং বংশধারা পিতা হযরত খাজা গরীব উন নেওয়াজ (রহঃ) মাধ্যমে রাসুল কারীম (সাঃ) এর রক্তধারার সাথে সংমিশ্রিত ছিল।তিনি হযরত শাহ্ জালাল(রহঃ)-এর সাথে ই বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে আগমণ করেছিলেন। হযরত শাহ্ জালাল(রহঃ)সুলতানের সেনাবাহিনীর সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিনের বাহিনীর সাথে হুশামউদ্দিন শাহ্ জালাল (রহঃ) এর ৩৬০ জন ওলী দরবেশ হিজরী ৭০১ মোতাবেক ১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দে বিজয়ীর বেশে শ্রীহট্টে প্রবেশ করেন। অতঃপর শ্রীহট্ট বা সিলেট হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) এর সাথে তিনি বৎসর অবস্থান করেন তার সহবতে ফায়েজ বরকত লাভ করেন। এই সময় খাজা গরীব উন নাওয়াজ (রহঃ) এর পুত্র হিসাবে পরিচিতি প্রকাশ পেলে হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) তাঁর নাম রাখলেন শরফউদ্দিন যার আরবী অর্থ হচ্ছে-বদলানো বা পাল্টানো। সেই থেকে হযরত হুসাম উদ্দিন চিশতী (রহঃ) হযরত খাজা শরফউদ্দিন চিশতী (রহঃ) নামে পরিচিত হন। 
আমি মাজারে গিয়ে তাজিমী সিজদাহ করে ফাতেহা পাঠ করলাম। অতঃপর মোনাজাত করে মাজার হতে বের হয়ে এলাম। কিন্ত্তু কি করা যায়? মি যাকে খুজছি তাকেতো পা্ছি না। কোথায় গেলে পাওয়া যেতে পারে? চিন্তা করলাম হয়তো হযরত খাজা ইয়ামিন(রহঃ)ওনার ওখানেই থাকতে পারে। পীর ইয়ামিনীকে বলা গোলাপ শাহ। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। গোলাপ শাহ (রহঃ) এর মাজারের দিকে।পাগল ছাগলরাই মাজারকে তাদের প্রাণকেন্দ্র মনে করে। তারা দিনকে দিন মাজারেই পড়ে থাকে। মনা পাগলা সেই ধরণেরেই জাতের পাগল। কাজেই তাকে পেতে হলে বিভিন্ন মাজারে দরগাহতে হানা দিতে হবে। তাকে যে আমার ভীষণ দরকার 
(চলবে)

বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে - প্রথম পর্ব

মনা পাগলার সাথে কবে দেখা হয়েছিল সেই দিনক্ষণ মনে নেই। মনে আছে কেবল দেখা হবার স্মৃতিটুকু। সেই স্মৃতিটুকু হাতড়ে বেড়াবার কোন মানে হয় না। কিন্ত্তু মনের মাঝে খস খস করছে সেই স্মৃতিটুকু। বার বার ফিরে এসে কেবল মনের জানালায় উঁকি দিচ্ছে। তাইতো তার সাথে দেখা করার জন্য মনটা উতালা হয়ে আছে। সবাই তার প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য পাগল থাকে। আর আমি উতালা হয়ে আছি একটি পাগলের সাথে দেখা করার জন্য। মনা যে আমাকে কি যাদু করেছে কে জানে?

আমি আর দেরি করলাম না। ঘর হতে বের হয়ে এলাম। কিন্ত্তু মনাকে কোথায় খুঁজবো? কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? সে কোথায় থাকে তাতো জানি না। আমি হাঁটতে হাঁটতে হাইকোর্ট মাজারের দিকে গেলাম। মাজার হচ্ছে পাগলদের আস্তানা। বলা চলে সবধরণের পাগলদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় মাজারে। এখানে নানান জাতের মানুষ ঘুরে বেড়ায়। নানা ধান্দায় থাকে মানুষ সব। ভাল-মন্দ মিলিয়েই সেই মিলন মেলা হলো মাজার কেন্দ্রিক। যার মাজার সে কি জানে তাকে কেন্দ্র করে কতো জাত বেজাতের মানুষজন নানা ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়? মনার কাছে শুনেছি মাজার তারই হয় যার ভেতর অন্তরের মানুষ থাকে। সেই অন্তরের মানুষকে যারা জাগাতে পারে তারা মরেও অমর হয় এই ধরাতে। তারা নরাধম মানুষদের মাঝেই স্বশরীরে বিরাজ করে। কিভাবে সম্ভব কে জানে? মনাকে বলতেই সে বললঃ

করিলে স্বরণ হবে না মরণ
যদি সে থাকে মরু সাহারায়।।*

মনাকে জিগ্যেস করেছিলাম এ ব্যাপারে। আপনি বলেছেনঃ 

-"অলি আউলিয়ারা মরে না। তাঁরা  জীবিত। এর কি কোন দলিল কোরআনে আছে?" 

মনা হাসতে হাসতে জবাব দিল

-আছে মানে? পুরা কোরআনইতো সেই শিক্ষা দিবার জন্য নাজিল হয়েছে। মানবজাতি তা ভুলে বসে আছে। কোরআনের মুল শিক্ষা হলোঃ 

"অসতো মা সদগয়মঃ
তমস্য মা জ্যোতিগয়মঃ
মৃতং মা অমৃত গয়মঃ

অর্থঃ" হে দয়াময় প্রভু! তুমি আমাকে অসৎ হতে সত্যের দিকে নিয়ে যাও। অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে আলোর দিকে ধাবিত করো। মৃত থেকে অমৃতের দিকে নিয়ে যাও।

-কিন্ত্তু এটাতো কোরআনের কোন আয়াত নয়। আমি চাচ্ছি কোরআন কি বলে সেটা জানতে? 

আমার কথা শুনে মনা বিরক্ত হয়ে বলেছিলঃ

-আরে গাধা শোন। সুরা বাকারার ১৫৪নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ[وَلَا تَقُولُوا لِمَن يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِن لَّا تَشْعُرُونَ [٢:١٥٤] "ওয়ালাতাকুলু লিমাইয়াখতালু ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াতু বাল আহ্‌হিয়া। ওয়ালাকিল্লা তাশউরুন।" অর্থাৎ আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত। কিন্ত্তু তোমরা তা বুঝ না। সুরা আলে-ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ [وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ [٣:١٦٩] "ওয়ালা-তাসাবান্নাল্লাযিনা কুতিলু ফি সাবিলিল্লা-হি আমওয়া-তা বাল আহ্ইয়াউন ইন্দা রাব্বিহিম ইউরযাকুন।" অর্থঃ আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।" সুরা ইউনুসের ৬২-৬৪নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ[أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [١٠:٦٢] আলা ইন্না অলিআউলিয়াহে লা খাওফুন আলাইহিম। অর্থঃ মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ[١٠:٦٣] আল্লাযিনা আমানু ওয়া কা-নু ইয়াত্তাকুন। অর্থঃ যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করতে রয়েছে। لَهُمُ الْبُشْرَىٰ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ۚ لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [١٠:٦٤] লাহুমুল বুশরা-ফিল হায়া-তিত দুননিয়া ওয়াফিল আ-খিরাতি; লা -তাবদিলা লিকালিমাতিল লা-হি;যা-লিকাহুওয়াল ফাওযুল আযিম। অর্থঃ তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।

-আল্লাহর রাস্তা কোন্ টা? মনা আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল। 

-আমার জানা নেই। আপনিই বলুন। কোন্ টি আল্লাহর রাস্তা।

-মনা হেসে জবাব দিয়েছিলঃ যে রাস্তায় গেলে আল্লাহকে পাওয়া যায় সেই রাস্তাটাই হচ্ছে আল্লাহর রাস্তা। যখন কেউ সেই রাস্তার দিকে হাঁটা শুরু করে তখন সে পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হয়। হওয়াটাইতো স্বাভাবিক। যার জীবনে উত্থান-পতন নেই তার জীবনের মানে কোথায়? মনে উদয়-বিলয় না ঘটলে সেটা কিসের মন? তুই কি আল্লামা ইকবালের নাম শুনেছিস? যাকে একশো মুফতি কাফের ফতুয়া দিয়েছিল?

-হ্যাঁ শুনেছি। কিন্ত্তু বিশেষ কিছু তার সম্পর্কে জানি না।

-শোন্ আল্লামা ইকবাল তার এক শিকোয়ায় বলেছিলঃ

"তেরে যমিরপর যবতক না হো নুযুলে কিতাব
শেরা কে শাহে রাজি না সাহেবে কাশশাফ।"

যতক্ষণ তোমার অন্তরে কেতাব নাজিল না হয় ততক্ষণ পযর্ন্ত বিখ্যাত তফসীরকার আল্লামা রাজিই হোন আর আল্লামা যামাকশারীই হোন কেউ এর মর্মগ্রন্থি খুলতে পারবে না। অন্য এক জবাবে আল্লামা ইকবাল বলেছিলঃ "কি হ্যাকছে ফেরেস্তাউনে ইকবালকো গামরাজি আদমকো শিখাতাহে আদাবে খোদাবান্দি।" 
(চলবে)
[*সুত্রঃ হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী কর্তৃক রচিত চিশতী উদ্যান হতে সংকলিত]

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

সোনার মানুষ - শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

বিরতির পর রহমান সাহেব সলোমানের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

-আমার কথা বুঝতে আপনার কোন কষ্ট হচ্ছে না-তো?

সলোমান হাসি মাখা মুখ নিয়ে বললোঃ

-না তেমুন কষ্ট হয় না। তয় আপনে যে কোরানের আয়াত দিয়া বুঝাইতাছেন হেইডা আমার জানা নাই।

-সমস্যা নাই। আপনি কোরআন হতে দেখে নিয়েন। তো যা বলছিলাম
রহমান সাহেব আবারো শুরু করলেন

দ্যাখেন আল্লাহ পাক সৃষ্টির বিকাশ ঘটিয়েছেন নুরে মুহম্মদী দ্বারা। এই নুরে মুহম্মদীর মধ্যে রুহ প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। সাধনা দ্বারা নুরে মুহম্মদীর মধ্যে তার জাগরণ ঘটাতে হয়। রুহ যখন সাধক নফসের মধ্যে জাগ্রত হয় তখন তা স্বমুর্তিতে রুপ ধারণ করে সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। এই রুহকে দেখার মানেই হলো আত্মদর্শন লাভ করা। তথা মান আরাফা রাব্বাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু। তার মানে নিজেকে নিজে দেখা। নিজেকে নিজে চেনা। এর কোন ধ্বংস বা বিনাশ নেই। এটি অপরিবর্তিত তথা স্বয়ং সম্পুর্ণরুপ ।
সুরা মরিয়মের ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ "ফাততাখাজাত ( সুতরাং তিনি [মরিয়ম] গ্রহণ করিলেন) মিন দুনিহিম (তাহাদের হইতে) হিজাবান (পর্দা) ফা আরসালনা (সুতরাং আমরা [আল্লাহ] পাঠাইলাম) ইলাইহা (তাহার দিকে) রুহানা (আমাদের [আল্লাহর]রুহ) ফাতামাসসালা (সুতরাং উহা প্রকাশিত হইল) লাহা (তাহার জন) বাশারান (বাশার[মানুষ]) সাউইইয়ান (পরিপুর্ণ)। অর্থাৎ এই আয়াতে বলা হলোঃ সুতরাং তিনি(মরিয়ম) পর্দা গ্রহণ করিলেন তাহাদের হইতে, সুতরাং আমরা (আল্লাহ) পাঠাইলাম তাহার দিকে আমাদের (আল্লাহ) রুহ। সুতরাং উহা প্রকাশিত হইল তাহার জন্য পরিপুর্ণ বাশার(মানুষ)। 
এছাড়া সুরা আননাহল আয়াত নং ১০২ তে বলা হয়েছেঃ কুল(বলুন) নাজজালাহু (তিনিই নাজিল করেন) রুহুল কুদুসি (রুহুল কুদ্দুস) মির(হইতে) রাববিকা (তোমার রব) বিল হাককি(সত্যসহ) লিইউসাববিতাল(প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য) আললাজিনা(যাহারা) আমানু(ইমান আনিয়াছে) ওয়া(এবং) হুদাও(হেদায়েত) ওয়া(এবং) বুশরা(সুসংবাদ)লিল(জন্য) মুসলিমিনা(মুসলমা[আত্মসমর্পণকারী]দের)। অর্থঃ তিনিই নাজেল করেন রুহুল কুদ্দুস তোমার রব হইতে সত্যসহ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য যাহারা ইমান আনিয়াছে এবং হেদায়েত এবং সুসংবাদ মুসলমানদের[আত্মসমর্পণকারী]জন্য। এই আয়াতে প্রথমেই বলা হয়েছে রুহুল কুদ্দুস তিনিই নাজেল করেন তোমার রব হইতে। 
খেয়াল করুন, এখানে 'মিররাব্বিকুম' তথা তোমাদের রব হইতে বলা হয় নি বরং নিছক তোমার রব হইতে রুহুল কু্দ্দুস নাজেল করা হয়। তারপরেই বলা হয়েছেঃ সত্যসহ এবং তারপরে বলা হয়েছেঃ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য নাজেল করা হয়? উত্তরটি হলো যারা ইমান এনেছে এবং হেদায়েত এবং যারা মুসলমান (আত্মসমর্পণকারী) তাদের জন্য । এই বিষয়টি একটি বিরাট সুসংবাদ। এই রুহুল কুদ্দুস যারা মুসলমান এবং ইমান ও হেদায়েত লাভ করেছেন তাদের জন্য বিরাট একটি সুসংবাদ।

তাহলে সোলেমান ভাই এইবার আমরা পুর্বের কথায় ফিরে যাই।

খাঁটি স্বর্ণের কথা বলছিলাম। সেই খাঁটি স্বর্ণ হলো এই রুহুল কুদ্দুস যা একটি পরিপুর্ণ বাশার রুপ ধারণ করে। এইটিকেই বলা হয় সোনার মানুষ। মনের মানুষ। মানুষ রতন।  তো সেই স্বর্ণটির মধ্যে খাদ তথা দুনিয়াবী চিন্তা-ধারা কামনা-বাসনার লোভ মোহ মায়া ইত্যাদি মেশানো হয়, তখন তা আর তার স্বরুপটি ধরে রাখতে না পেরে আত্মার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলে। যখন মৃত্যু নামক বিষয়টি তথা সোহাগা মেশানো হয় এবং এসিডে পোড়ানো হয় তথা মাটিতে বা কবরে শোয়ানো হয় তখনই তার এসিড টেষ্ট হয়। সে যদি খাঁটি হয় তাহলে তার দেহ কখনো মাটি ধ্বংস করতে পারে না। কারণ " ইন্নাল্লাহা হারামা আলাল আরদে আরশাদুল আম্বিয়া "।

- তো সলেমান ভাই কি বুঝলেন?

সলেমান রহমান ভাইয়ের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেল। সে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো-জীবনে কতো স্বর্ণ গলিয়ে অলংকার তৈরী করেছি। অলংকার ভেংগে স্বর্ণ বের করেছি। কিন্ত্তু কখনো এভাবে চিন্তা করিনি। মৃত্যু নামক এই বিষয়টিকে কেউ এড়িয়ে যেয়ে পারে না। সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কিন্ত্তু তারপরও আমরা অচেতন। কতো পাপ করেছি....চিন্তা করতে করতে সলেমানের দুচোখ জলে ভিজে এল।

রহমান ভাই লক্ষ্য করলেন-সলেমানের চোখ দুটো ছলছল করছে। তিনি কিছু বললেন না। তিনি কেবল চিন্তা করতে লাগলেন - আরো কিছু বলার ছিল। কিন্ত্তু সলেমানের কথা চিন্তা করে তা বাদ দিলেন। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক প্রমাণতো আল্লাহ পাক নিজেই দু'চারটা করে নজির দেখান। যে লোকটির কথা বলা হলো - তার নজিরতো পুরো গ্রামের মানুষ দেখেছে। তারাই বিচার বিবেচনা করুক। চিন্তা ভাবনা করুক। কোন্ টা সত্য কোন্ টা মিথ্যা...

শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

সোনার মানুষ-দশম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

সুফী সাহেব চলে যেতেই রহমান ভাই সোলেমানের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

-ভাই আপনি কি করেন?

-আমি একজন স্বর্ণকার। সোলেমান বললো।

-তাহলে তো ভালোই হলো। আপনাকে তাহলে স্বর্ণ দিয়েই বুঝাই। পৃথিবীর মধ্যে যতগুলো ধাতু আছে তার মধ্যে স্বর্ণ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং একটি মুল্যবান ধাতু। তো এই ধাতু দিয়ে যখন কোন অলংকার তৈরী করা হয় তখন তার সাথে খাদ মিশানো হয়। তারপর অলংকার তৈরী করা হয়। নিখাদ ধাতু দিয়ে অলংকার তৈরী হয় না। তাইতো?

-জি।

-কোন তৈরী করা অলংকার যখন ভেংগে চুরে আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয় তখন প্রথমে কি করেন? স্বর্ণটিকে সোহাগা দিয়ে একটি মাটির পাত্রে রাখেন। তারপর সেই পাত্রটিকে আগুন দিয়ে জ্বাল দেয়া হয়। একসময় স্বর্ণটি গলে একটি খন্ডে পরিণত হয়। তখনও কিন্ত্তু স্বর্ণটি খাটি বা নিখাদ নয়। তাইতো?

-জ্বি।

-এরপর সেই স্বর্ণটিকে একোয়া রিজিয়া বা এসিডে চুবিয়ে রাখা হয়। কেন? স্বর্ণের মধ্যে যে খাদ আছে তা এসিড ধ্বংস করে ফেলে। ফলে একপর্যায়ে সেই স্বর্ণটি হয়ে যায় নিখাদ স্বর্ণ। এরমধ্যে আর কোন খাদ থাকে না। আর এসিডেরও কোন ক্ষমতা থাকে না সেটিকে ধ্বংস করার। তাইতো?

-জ্বি।

এবার আসি আমাদের আলোচনায়। পৃথিবীর মধ্যে যতপ্রকার জীব আছে তার মধ্যে মানব হচ্ছে আল্লাহর বহিঃপ্রকাশের সবোর্ত্তম মাধ্যম। সুরা তীন আয়াত নং-৪ এ বলা হয়েছেঃ "লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানে তাকবীম" অর্থঃ
আমরা মানুষকে গঠন করিয়াছি সর্বোত্তম সাংগঠনিক পরিকল্পনা অনুসারে। আল্লাহ পাক এই মানবের মধ্যে নিজের একটি অংশ খুবই সুক্ষ্ম আকারে দিয়ে দিয়েছেন। সেটি হলো রুহ। যা এই নশ্বর পৃথিবীতে সৃষ্ট নয়। সমগ্র জগতই স্বয়ং আল্লাহপাকের সৃষ্ট হলেও তার মুল অংশ যা চিৎপরমাণু নামে পরিচিত, যাকে বলা হয় রুহ, তার অবস্থান হচ্ছে প্রাণে। প্রাণ ব্যতীত কোন প্রাণী নেই। এই প্রাণের স্পন্দন অনুভুত হয় হৃদপিন্ডে। যাকে বলা হয় কলব। এই কলবের মধ্যে ছুদুর নামক একটি মোকামের উল্লেখ আছে। যা থেকে ওয়াস ওয়াসা অর্থাৎ কুমন্ত্রণা বা খারাপ কাজের আদেশ দেয়া হয়। সুরা নাসে বলা হয়েছেঃ মিন শারিল্লিল ওয়াস ওয়াসিল খান্নাস। আবার অন্যত্র বলা হয়েছেঃ ইন্নামাল নাফসুল আম্মারা বিসসুয়ে। নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা খারাপ আদেশ কলনেওয়ালা। তার মানে যে আত্মা কলুষিত সে আত্মাকে বলা হয় নাফসুল আম্মারা। নাফস হচ্ছে দেহ। নফসকে আম্মারা, লাউয়ামা এবং মুৎমায়িন্না এই তিনভাগে ভাগ করা যায় এবং এই নফস পন্ঞ্চভুতে তৈরী। এই নফস বা দেহ সংগঠনের তিনটি স্তর আছে। বহিঃস্তর বা দেহের বাহ্যিক অবয়ব। মধ্যঃস্তর বা সুক্ষ্ম দেহ অর্থাৎ প্রানময় শরীর। অন্তঃস্তর বা সুক্ষাতিসুক্ষ স্তর বা সুক্ষ্মদেহ বা জ্যোতিদেহ। এই জ্যোতিদেহই হচ্ছে রুহ। যা খালি চোখে দেখা যায় না। রুহ সর্ম্পকে জানতে চাওয়া হলে নবীপাক (সাঃ) মারফত আল্লাহ পাক বলেছেন পবিত্র কুরআনের ভাষ্যমতেঃ “কুল্লির রুহ মিনআমরি রাব্বি”। অর্থাৎ রুহ হচ্ছে আল্লাহ পাকের হুকুম। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ ওয়া নাফাখতু ফিহে মেররুহি”। এর কোন ধ্বংস বা বিনাশ নাই। যেহেতু সে দেহে অবস্থান করে সেহেতু পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা জানি পদার্থের তিনটি গুণাবলী যথাঃ ওজন, অবস্থান, আকার এবং অায়তন আছে। বাতাসের আকার ব্যতীত অন্যান্য গুণাবলী থাকার কারণে তা একটি পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত। যেমন খালি বেলুনে বাতাস ভর্তি করে ওজন নিলে ঐ বেলুনে বাতাসের কত ওজন তা পরিমাপ করা যায়। বিজ্ঞানীরা এই পদার্থ সর্ম্পকে ব্যাপক গবেষণা করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, পদার্থ বিনষ্ট কিংবা সৃষ্টি হতে পারে না তবে একরুপ হতে অন্য রুপে রুপান্তর হতে পারে। বস্ত্তুর অবিনাশিতাবাদ সুত্রে বলা হয়েছেঃ Matter can not be destroyed, can not be created but can shaped from one to another. একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝে নেয়া যাক। আমরা জানি পানি একটি তরল পদার্থ। পানিকে উত্তপ্ত করলে তা বাষ্পে পরিণত হয়। পানির এই অবস্থা হচ্ছে বায়বীয় অবস্থা। একইভাবে তরল পানিকে কম তাপমাত্রায় রাখলে তা বরফ হয়ে যায়। বরফ হচ্ছে কঠিন পদার্থ। একই পানির তিনটি অবস্থা থাকায় কোনটার বিনাশ সম্ভব হচ্ছে না বরং একটি থেকে অন্যটির অহরহ রুপান্তর হচ্ছে।এ পর্যায়ে রহমান সাহেব একটু বিরতি দিলেন।
(চলবে)