পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁসমুরগীর ছানাপোনা-নবম পর্ব

(অষ্টম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেবকে দেখে হরিপদদা কীর্তন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করলেন। তিনি করিম সাহেবকে বললেনঃ

-নমস্কার দাদা....ভালো আছেন?

-নমস্কার। তুমি ভালো আছো? হরিপদ

-আছি গুরুর দয়ায় ভালোই। ...আপনি আসায় খুব ভালো লাগছে করিমদা.

-আমারো ভালো লাগছে......তাছাড়া তোমার সাথে অনেকদিন প্রাণভরে কোন কথা হয় না। আজকে যখন তোমাকে পেয়েছি, তাহলে প্রাণখুলে কথা বলা যাবে....কি বলো হরিপদ..

-দাদা, কি যে বলেন?.... আপনি একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ....আর আমি একজন সাধারণ মানুষ.....আমার সাথে কি কথা বলবেন আর আমিই বা আপনার সাথে কি কথা কমু..

-আরে এটা কোন বিষয়ই না। তুমি বেশ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষ। তোমাদের ধর্মে বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় ধর্মতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে গীতা এবং উপনিষদও পড়ি। সেখানে পেয়েছি অনেক দামী দামী এবং অসাধারণ ভাষা...

-দাদা....প্রতিটি ধর্মই একই কথা বলে। মুল বিষয়টাতে কোন ধর্মেই বিভেদ নেই। বিভেদ কেবল মনে। যেমন ধরেন..ধর্ম। মুল শব্দ ধৃ হতে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ যা ধারণ করে আছে। কি ধারণ করে আছে? বস্তুর গুণাবলী। যেমন ধরেন। আগুন। এর ধর্ম দাহন করা। পৃথিবীর যেই স্থানেই যান, অগ্নি দহন করবেই। ধর্ম মানুষকে সহনশীন হতে শেখায়। কোন ধর্মই বিভেদের বীজ বোপন করে না।

-তুমি ঠিকই বলেছো হরিপদ । ধারণদঃ ধর্ম। ধর্মঃ মুলহি ভগবান সর্বোবেদ ময়ঃ হরি। ধর্মের মুল হচ্ছে ভগবান হরি। হরি অর্থ যিনি হরণ করেন। কি হরণ করেন? হরণ করেন পাপবোধ। মনের মধ্যে যে পাপ তথা ভ্রান্তি লুকিয়ে আছে, তা দুর করাই হরণ করা। কে করেন? ভগবান। ভগবান=ভব+বান-ভব মানে হচ্ছে দুনিয়া। আর বান মানে হচ্ছে আসত্তি। অর্থাৎ দুনিয়ার প্রতি আসত্তিবোধ থেকে যিনি মুক্ত, তিনিই ভগবান। অর্থাৎ ভব সাগরকে যিনি পাড়ি দিতে পেরেছেন, তিনিই ভগবান।

-দাদা, আপনি কি ভগবানকে দর্শন করেছেন?

-নাহ্...। তার স্বরুপ উপস্থিতি ধরতে পারছি কিন্ত্তু তাকে পরিপুর্ণভাবে দেখা হয়নি।

-আপনার কথা শুনে হাসি পেল দাদা।

-কেন? কেন..

-দাদা, আপনিতো শিক্ষিত মানুষ। অনেক লেখা পড়া করেছেন। শুনেছি কোরআনে আছেঃ আল্লাহু কুল্লে শাইইন মুহিত। আল্লাহ সর্ব বস্তুর মধ্যে মুহিত অবস্থায় আছেন। তার মানে অাপনাদের আল্লাহ আমাদের ভগবান তথা হরি এই পদবাচ্য। আপনারা ডাকেন আল্লাহ বলে। আর আমরা ডাকি ভগবান হরি বলে। এই হরি আছেন প্রতিটি মানবের হৃদমন্দিরে। তাকে আত্মা বলেও অনেকে মনে করেন। মুলতঃ আত্মার মুল হচ্ছে পরমাত্মা। এই পরমাত্মা সারা দেহজুড়ে বিস্তৃত।

যে-কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, সমগ্র দেহ জুড়ে কি বিস্তৃত হয়ে আছেসেটি হচ্ছে চেতনা প্রত্যেকেই তার দেহের সুখ বেদনা সম্বন্ধে সচেতন চেতনার এই বিস্তার প্রত্যেকের তার নিজের দেহেই সীমাবদ্ধ কিন্ত্তু একজনের দেহের অনুভূতি অন্য আর কেউ অনুভব করতে পারে না এর থেকে বোঝা যায়, এক-একটি দেহ হচ্ছে এক-একটি স্বতন্ত্র আত্মার মূর্তরূপ এবং স্বতন্ত্র চেতনার মাধ্যমে আত্মার উপস্থিতির লক্ষণ অনুভুত হয় এই আত্মার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্ত্র ভাগের একভাগের সমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (/) প্রতিপন্ন করা হয়েছে-
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ বিজ্ঞেয়ঃ চানন্ত্যায় কল্পতে।।
অর্থঃ “কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করে তাকে আবার শতভাগে ভাগ করলে তার যে আয়তন হয়, আত্মার আয়তনও ততখানি। 

সেই রকম অনুরূপ একটি শ্লোকে বলা হয়েছে
কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশসদৃশাত্মকঃ।
জীবঃ সূক্ষ্মস্বরুপোহয়ং সংখ্যাতীতী হি চিৎকণঃ।।

অর্থঃ “অসংখ্য যে চিৎকণা রয়েছে, তার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্র ভাগের এক ভাগের সমান।” 

সুতরাং এর থেকে আমরা বুঝতে পারি জীবাত্মা হচ্ছে এক-একটি চিৎকণা, যার আয়তন পরমাণুর থেকেও অনেক ছোট এবং এই জীবাত্মা বা চিৎকণা সংখ্যাতীত। এই অতি সুক্ষ্ম চিৎকণাগুলি জড় দেহের চেতনার মূল তত্ত্ব। কোন ওষুধের প্রভাব যেমন দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, এই চিৎ-স্ফুলিঙ্গের প্রভাবও তেমনই সারা দেহ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। আত্মার এই প্রবাহ চেতনারূপে সমগ্র দেহে অনুভূত হয় এবং সেটিই হচ্ছে আত্মার উপস্থিতির প্রমাণ। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে, জড় দেহে যখন চেতনা থাকে না, তখন তা মৃত দেহে পরিণত হয় এবং কোন রকম জড় প্রচেষ্টার দ্বারাই আর সেই দেহে চেতনা ফিরিয়ে আনা যায় না। এর থেকে বোঝা যায়, চেতনার উদ্ভব জড় পদার্থের সংমিশ্রণের ফলে হয় না, তা হয় আত্মার থেকে। চেতনা হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক প্রকাশ। আত্মার পারমাণবিক পরিমাপ সম্বন্ধে মূণ্ডক উপনিষদে (//) বলা হয়েছে-
এষোহণুরাত্মা চেতসা বেদিতব্যো যস্মিন্প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।
প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং যস্মিন্বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ আত্মা।।
 
অর্থঃ- “আত্মা পরমাণুসদৃশ এবং শুদ্ধ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তাকে অনুভব করা যায়। পরমাণুসদৃশ এই আত্মা পঞ্চবিধ বায়ুতে (প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান উদান) ভাসমান থেকে হৃদয়ে অবস্থান করে এবং জীবাত্মার সমগ্র দেহে তার প্রভাব বিস্তার করে। আত্মা যখন এই পঞ্চবিধ জড় বায়ুর কলুষিত প্রভাব থেকে পবিত্র হয়, তখন তার অপ্রাকৃত গুণাবলীর প্রকাশ হয়।

(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা-অষ্টম পর্ব

(সপ্তম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব ভেবে পেলেন না-সেটা সত্যি কি-না? একবার মনে হচ্ছে সত্যি আরেকবার মনে হচ্ছে মিথ্যা। সত্য-মিথ্যার দোলা চালে পথ চলতে লাগলেন তিনি । আর দু'পাশ দিয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য অবলোকন করছেন।

শীতের আমেজ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। সদ্য প্রসুত শিশুর মতো সুর্যটা কেবল হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। দুর থেকে যে সুর্যটা এতদীপ্তিময় মনে হচ্ছে সেই সুর্য্যের হাসিটা কেমন যেন ম্লান লাগছে করিম সাহেবের কাছে। নদীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা মেঠো পথে হাঁটতে ভালোই লাগছে। মাঝে মাঝে শীতের ঝাপটা গায়ে লাগছে। আবার সুর্য্যের হাসি তা বিলীন করে দিচ্ছে। ভাগ্যকুল বাজারটা অতি প্রাচীন। পদ্মার পাশ দিয়ে বসা অন্যান্য হাট-বাজারের মতোই এ বাজারটা। পার্থক্য কেবল এ বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ীরাই সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাছাড়া এ বাজারটা ধরতে গেলে এ অন্ঞ্চলের অধিবাসীদের প্রাণ। তাদের দেহের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে এ বাজারটি। করিম সাহেব গায়ের চাদরটা জুতসইভাবে পেঁচিয়ে বাজারের ব্যাগটি নিয়ে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন। তাকে দেখে লক্ষণদা বললেনঃ

-নমস্কার কর্তা...বাজারে যাইতাছেন না-কি?

-হ। তুমি কই যাইতাছো?

-অামি একটু বালাশুর যামু। ঐ হরিপদ দাদারে খবর দিতে...

-হরিপদ দাদারে হটাৎ দরকার পড়লো? কোন অনুষ্ঠান আছে নি?

-জ্বে দাদা। আমাগো লক্ষ্মীপুজা আছে। আর একটা কীর্তনের আসরও আছে।

-তা বেশ। যাও..দেহি সময় পাইলে আমিও যামুনে...

-তাইলে তো ভালোই অয়....

হাঁটতে হাঁটতে করিম সাহেব বাজারের কাছাকাছি চলে এলেন। আর তাকে শেষ বার নমস্কার জানিয়ে লক্ষণও একটা রিক্সা নিয়ে বালাশুরের দিকে চলে গেল। হরিপদ বেশ জ্ঞানী লোক। তত্ত্ববেশ বোঝেন। তাছাড়া তার গলা বেশ। কীর্তন তিনি ভালোই গান। আর করিম সাহেবও কীর্তন বেশ পছন্দ করেন। করিম সাহেব বেশ পুলকিত হলেন। মনের মধ্যে একটা কেমন যেন অজানা ভালোলাগার অনুভুতি কাজ করলো। তিনি আর দেরী করলেন না। তাড়াতাড়ি বাজার করে বাড়ীতে ফিরে এলেন।

বাড়িতে এসে তিনি হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পুকুর পাড়ে গেলেন। পুকুর পাড়ের ধারে দেখলেন-হাসগুলো ছানাপোনা সহ পানিতে সাঁতার কাটছে। মাঝে মাঝে পুকুরের মধ্যে ডুব দিচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। একটু দুরে দেখলেন-পুরুষ হাঁসটি ওপারে নোংরা কাদামাটি খ্যাত খ্যাত শব্দ করে ঘাটছে। তার পাশেই আরেকটি হাঁসের বাচ্চা সেটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। করিম সাহেব বেশ মজা পেলেন। দৃশ্যটি তিনি আনমনে অবলোকন করছেন। কোন দিকেই তার খেয়ালই নেই। তিনি যে একটি আর্টিকেল লিখতে বসছিলেন, তা বেমালুম ভুলে গেলেন। তার মন পড়ে রইলো ঐ হাঁসগুলোর দিকে।

রহিমা মাছ কেটে তা ধুতে গেলেন পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড়ে যেয়ে সে দেখলো করিম সাহেব খালি গায়ে তেল মেখে বসে আছে। গোসল করার নাম গন্ধও নেই। কেমন যেন আনমনা হয়ে হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। রহিমা জানে, এ লোকটি যেন কেমন। কোন দিকেই তার খেয়ালই নেই। কি ভাবছে কে জানে? 

-কি গো, কি ভাবতাছো?

-দ্যাখতাছি। হাঁসগুলির তামশা...

-এইডা দেহনের কি অইলো? আমিতো রোজই দেহি।

-তোমার দেহা আর আমার দেহার মইদ্যে বিস্তর ফারাক। দ্যাহো হাঁসগুলি সারাদিন ময়লা কেদ্যার মইধ্যে কেমুন ঘাডাঘাডি করতাছে। পানিতে ডুবাইতাছে। অথচ সন্ধ্যায় যহন খোয়ারে ঢোকে তখন ওগো গায়ে একটুও ময়লা লাইগ্যা থাকে না। তুমি যদি ময়লাতেও থাকো আর মাওলা পাকের নাম লইয়্যা সাঁতার কাটো এই ভবনদীর পাড়ে তাইলে এই হাঁসের মতোই তোমার জীবন হইবো। মানে হইলোঃ তুমি হইবা হাঁস।

-হাঁস ???

করিম সাহেব কথা বাড়ালেন না। তিনি তাড়াতাড়ি গোসল করে ওঠে এলেন। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের দিকে রওনা হলেন লক্ষণদার বাড়ীতে। লক্ষণদের বাড়ী কামারগাঁও। এখন রওনা হলে  সন্ধ্যা নাগাদ পৌছে যাবেন। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে হরিপদদা ধুপ ধুপনা জ্বালিয়ে বাড়ীর বারান্দায় একটা মাদুর পেতে বসে কীর্তন গেয়ে চলেছেন।

যার মুখে ভাই হরি কথা নাই তার কাছে তুমি যেও
যারে দেখে তুমি ভুলে যাবে হরি তার পানে তুমি চেও না।।

করিম সাহেব কিছু না বলে সেই অনুষ্ঠানে বসে পড়লেন। তিনিও হাত জোড় করে চোখ বুঁজে মাথা দোলাতে লাগলেন। সনাতন ধর্মালম্বীগণের ন্যায়। দেখলে বোঝার উপায় নেই..তিনি সেই করিম সাহেব যিনি ভাগ্যকুল কলেজের দর্শনের প্রাক্তন শিক্ষক। বয়সের ভারে ন্যুজ্জ করিম সাহেব বেশ উপভোগ করছেন সেই কীর্তন।
(চলবে)

বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম মাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা-পর্ব সাত

(ষষ্ঠ পর্বের পর হতে)

বিষয়টি কেমন যেন ঠেকলো করিম সাহেবের কাছে। সব কিছুই আল্লাহময়? নিজেকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না করিম সাহেব। চা টা শেষ করে তিনি আবারো নিজের লেখার প্রতি মনোযোগ দিলেন। বার বার পড়লেন। তারপর তিনি বেশ গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

দর্শন বেশ গভীরের বিষয়। হুট করে কেউ সেটা বুঝতে পারে না। প্রতিটি বিষয়ের মধ্যেই দর্শন লুকিয়ে আছে। সেই দর্শন উপলব্ধি করার জন্য চাই মনের গভীরতম সত্তা অর্থাৎ চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ মানুষ  দর্শন বুঝতে পারে না। কারণ তাদের চিন্তা-চেতনার স্মূক্ষ্মতম স্তরটি রুদ্ধ হয়ে আছে। সেই চিন্তা চেতনার রুদ্ধদ্বারটি উন্মুক্ত না হলে উন্নত চিন্তা বা উচ্চতম চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না। সেই চেতনাটি জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন ধ্যান। ধ্যান ব্যতীত জ্ঞান সম্ভবপর নয়। তাই যারা এই জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছেন, তারা ধ্যানের মাধ্যমেই পেয়েছেন।

সকালের নরোম রোদ এখন আস্তে আস্তে তার দীপ্তি ছড়াতে শুরু করেছে। করিম সাহেব তার চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দিয়ে বাহিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আর ঠিক সেই সময় রহিমা এসে হাজির। হাতে বাজারের ব্যাগ। করিম সাহেব বেশ বুঝতে পারলেন-তাকে বাজারে যেতে হবে। তিনি ঠিক এই বিষয়টি অপছন্দ করেন। বাজারে জিনিস পত্র দামাদামি করে কিনতে তার ভালো লাগে না। দোকানীরা কোন জিনিসই সঠিক দামে বিক্রি করে না। ব্যবসা করবিতো ভালো কথা কিন্ত্তু লাভের নামে গলাকাটা কাটবি কেন?

-এই নেও। বাজার নেই।

-তাতো বুঝতেই পারছি।

-ভালো। আজকে একটু ভালো মন্দ বাজার করো।

-কেন?

-কেন আবার? আজ তোমার ছোট মেয়ের জন্মদিন। ওর জন্মদিনতো আর ঘটা করে পালন করতে পারবো না..

একথা বলেই রহিমার বুক হতে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। সে দেখেছে আশে পাশে প্রতিবেশিদের বাড়ীতে কতো ঘটা করে ছেলে-মেয়ের জন্মদিন পালন করে। আর আমার মেয়ের কপালে জুটেছে একটা হা-ভাতে বাবা। যে বাবা কেবল বড়ো বড়ো কথা বলতে পারে..কিন্ত্তু টাকা-পয়সা কামাতে পারে না।

করিম সাহেব রহিমার দীর্ঘশ্বাসের অর্থ বোঝেন। কিন্ত্তু তার কিছু করার নেই। কারণ তিনি হাতে পায়ে বন্ধী। তিনি নিজে অনেক চেষ্টা করেও কোন কিছুতেই এগুতে পারছেন না। তাই তিনি অবসর পেলেই বই পড়েন। তাছাড়া এ বয়সে কাজ করার মতো শক্তি সামর্থ্য তার নেই। তিনি বাজারের ব্যাগটি হাতে নিলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লেন।

পথে যেতে যেতে ভাবলেন-আল্লাহর তাহলে রুপ হচ্ছে দুটি। একটি আহাদ আল্লাহ আরেকটি সামাদ আল্লাহ। সর্বসত্তাময় মহান আল্লাহ পাক তার সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টারুপ ধরেছেন-খালিক তথা সৃষ্টিকর্তা রুপে। আর রবরুপে ধরেছেন পালনকর্তা। তাহলে যে আমাকে আলো-বাতাস দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেটা কি স্রষ্টার রবরুপের বহিঃপ্রকাশ? 
(চলবে)

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা - ষষ্ঠপর্ব

(পন্ঞ্চম পর্বের পর)

করিম সাহেব যে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন, তাহলোঃ কোরআনুল করিমের যে ব্যাখ্যা ডাঃ জাহাঙ্গীর আল সুরেশ্বর সাহেব দিয়েছেন, সেটাতো তার নিজের বক্তব্য। তিনি যা বুঝেছেন, সেটাই তিনি নিজের ভাষায় ব্যাক্ত করেছেন। মুল বিষয়টি কি আসলেই তাই? পশু বৃত্তিক কার্য্যাবলী পরিত্যাগ করার জন্য প্রতিটি ধর্মই কমবেশি জোর দিয়েছে। তেমনি জোর দিয়েছে "মনুষ্যত্ব গুণগুলো অর্জনের" অর্থাৎ সৎপথে পরিচালিত হবার। তাহলে কি পশুবৃত্তিক নফসকে দমন করার জন্য যে জেহাদের কথা বলা হয়েছে সেটাই কি সত্য ? কিন্ত্তু যে নফস - এর কথা বলা হচ্ছে তার আগে কি আমাদের জানা উচিত নয় কি? নফস কি? করিম সাহেব কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। এবং কাগজের মাঝখানটায় লিখলেনঃ

নফস (Nafs) কি?

নফস অর্থ প্রাণ। আবার অনেকেই একে আত্মা বলে থাকেন। আত্মা হচ্ছে কতোগুলো উপাদানের দ্বারা সৃষ্ট। সেই উপাদানগুলো কি? সেই উপাদানগুলো হচ্ছে-মাটি,পানি,আগুন,বাতাস এবং আকাশ। এই পঞ্চউপাদানকে অনেকে পন্ঞ্চভুত বলে থাকেন। সংস্কৃতভাষায় এদেরকে বলা হয়-ক্ষিতি,অব,তেজ,মরুৎ এবং ব্যোম। আরবী ভাষায় এদেরকে বলা হয় খামছা আনাছের। খাক(মাটি),বাত(বাতাস),আব(পানি),আতশ(আগুন) এবং ইথার(আকাশ)।

প্রশ্ন হলোঃ এই পন্ঞ্চ উপাদান কিভাবে সৃষ্টি হলো? কে সৃষ্টি করলো এ পন্ঞ্চ উপাদান? আর কোরআন শরীফে কি এ ব্যাপারে কোন কিছু উল্লেখ আছে?

আসমান এবং জমিনে যা কিছু আছে সবকিছুই আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। যদি তাই হয়,তাহলে ধরে নিতে হয়, উক্ত উপাদান সমুহও আল্লাহ পাকের সত্তার অধীন। যেমনঃ একটি মাকড়শার কথা ধরা যাক। খাদ্য তৈরী করার জন্য মাকড়শা  যে জাল তৈরী করে, সেই জাল তৈরী করার জন্য উপকরণ সে পেল কোথায়? সে উপাদানসমুহ তার নিজের মধ্যেই ছিল। সে তার লালা দিয়ে সেই জাল তৈরী করে। সেই জালের মধ্যে কোন কীট পতঙ্গ আটকে গেলে আর ছুটতে পারে না। এক সময় সেই আটকে পড়া কীট পতঙ্গটি অনাহারে মারা গেলে মাকড়শা সেটা গলদঃকরণ করে নিজের জীবন বাঁচিয়ে রাখে। মজার তথ্য হলোঃ স্ত্রী মাকড়শা যে বাচ্চা জন্মদান করে, সেই বাচ্চাগুলো মায়ের দেহ আহার করে নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখে। আল্লাহ পাক যখন ছিলেন তখন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। সেই এক আল্লাহ পাক হতেই সমস্ত কিছুর সৃষ্টি। অর্থাৎ সমস্ত কিছুই আল্লাহ পাকের অস্তিত্বের সাথে সায়ুজ্যপুর্ণ। কারণ আল্লাহ পাক নিজেই বলেছেনঃ-

"কুলহু আল্লাহু আহাদ। অর্থঃ বল তিনিই আল্লাহ-আহাদ
আল্লাহু সামাদ।অর্থঃ আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত সামাদ (অর্থাৎ নিরপেক্ষ, স্বনির্ভর, স্বাধীন, মুক্ত, মুখাপেক্ষীহীন)
লাম ইয়ালিদ ওয়ালামউলাদ। অর্থঃ তিনি জন্ম দেন না এবং তাকে জন্ম দেওয়া হয় না।
ওয়ালাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ। অর্থঃ এবং আহাদের কিছুই (বা কেহই) তাহার (অর্থাৎ সামাদের) সমগোত্রীয়/সমতুল্য নয়।

এখানে আল্লাহ পাক আহাদ এবং আল্লাহ সামাদ। যার অর্থ হচ্ছেঃ আল্লাহর প্রকাশের রুপ দুইটি। আহাদরুপ এবং সামাদ রুপ। সামাদ সত্তা পুরুষ, আহাদ সত্তা প্রকৃতি বা নারী। জড় জগত, জীব জগত, মনুষ্য জগতে এবং মনুষ্য জগতের মধ্যকার জাহান্নাম ও জান্নাত জগত সকলই আহাদ জগতের অন্তর্ভুক্ত। আহাদের অন্তর্ভুক্ত সত্ত্বাসমুহ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। শব্দটি মুলতঃ বহু বচন। সুতরাং আহাদ শব্দটিকে এক না বলে একক বলা হয়েছে। পরষ্পর নির্ভরশীলতায় আহাদের সবাই একধর্মী। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজন অচল।

তার মানে যে উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করা হয় তার সব উপাদানই আল্লাহ সত্তাময়। মুল কথাটি হলোঃ আকাশ আল্লাহর সত্তা, বাতাস আল্লাহর সত্ত্বা, আগুন আল্লাহর সত্ত্বা, পানি আল্লাহর সত্ত্বা এমনকি মাটিও আল্লাহর সত্ত্বা। তার মানে হলোঃ পুরো বিষয়টি হচ্ছেঃ ওয়াহদাতুল ওযুদ। অর্থাৎ সর্বেশ্বরবাদ।
(চলবে)

বুধবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানা পোনা - পন্ঞ্চম পর্ব


(চতুর্থ পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব ভেবে পেলেন না - যে মা মুরগীটা তার পঙ্গু বাচ্চাটিকে আগলে রাখছে, সেই মা মুরগীটা কেন তার সেই বাচ্চাটির নিকট হতে তেলাপোকাটি ছিনিয়ে নিল? অতঃপর ভক্ষণ করলো? তাহলে কি ধরে নেবো মা মুরগীটার হৃদয়ে মায়া-মমতা বলে কিছু নেই? তা কি করে হয়? সেটা হলে তো সে তার পঙ্গু বাচ্চাটিকে আগলে রাখতো না। তাহলে কি তার ভেতর লোভ কাজ করছিল? কিন্ত্তু পরক্ষণেই করিম সাহেব বুঝতে পারলেন সেই রহস্যটি। তিনি দেখলেন - তার অন্যান্য ছানাগুলো মাকে খেতে দেখে তারাও দৌড়ে আসছে। খাবারটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। এবং মা মুরগীটা খাদ্যটা নিয়ে দুরে সরে যাচ্ছে। এই অসম লড়াইয়ে হয়তো পঙ্গু বাচ্চাটি পারতো না। খাদ্যটা নিয়ে মা মুরগীটা দুরে সরে যাওয়ায় তার সেই পঙ্গু বাচ্চাটি সম্পুর্ণ নিরাপদ রইল এবং তার অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের থেকেও বেঁচে গেল। করিম সাহেব বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেন। যাক্ মা মুরগীটার মাথায় বুদ্ধি আছে। তা না হলে সেই পঙ্গু বাচ্চাটির খাদ্য নিয়ে তার অন্যান্য সঙ্গী-সাথীরা কাড়াকাড়ি করলে সে হয়তো আরো বেশি আহত হতো। সেই পরিণাম থেকে মা মুরগীটা তাকে বাঁচালো।

করিম সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে আবারো তার লেখার দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করলেন। তিনি কি লিখতে চাইছিলেন, সেটাই ভুলে গেছেন। তিনি তাকিয়ে দেখছেন তার পুর্বের লেখাটি। লেখাটি শেষ করেছিলেন -

প্রশ্ন উঠছে-যারা শহীদ হয়েছে তাদেরকে মৃত বলা নিষেধ। কেবল তারাই জীবিত।আর বাকী যারা মারা যাবে তারা সবাই মৃত। তিনি কোরআনুল করিমের সেই আয়াতটি আবার পড়া শুরু করলেন এবং বেশ ভালোভাবেই বিচার বিশ্লেষণ করা শুরু করলেন। তিনি দেখলেন সেই আয়াতটিতে লেখা আছেঃ" ওয়া (এবং) লা (না) তাকুলু (তোমরা বলিও) লিমাই (যাহারা) ইউকতালু (নিহত হয়, হত্যা করা হয়,কতল করা হয়) ফি (মধ্যে) সাবিল (পথে,রাস্তায়) লিল্লাহে(আল্লাহর) আমওয়াতুন (তাহারা মৃত,তাহারা মরিয়া গিয়াছে) বাল (বরং) আহইয়াউন (তাহারা জীবিত) ওয়ালাকিন (কিন্ত্তু,যদিও) লা (না) তাসউরুন (তোমরা অনুভব কর, তোমরা বোঝো, তোমরা জানো, তোমরা খবর রাখো)।" অর্থঃ "এবং তোমরা বলিও না, যাহারা নিহত হয় আল্লাহর পথের মধ্যে তাহারা মৃত। বরং তাহারা জীবিত, কিন্ত্তু তোমরা জানো না।[সুরা বাকারা আয়াত নং-১৫৪]

বিষয়টি বেশ অদ্ভুত লাগলো করিম সাহেবের কাছে। কারণ, আল্লাহ পাক নিজেই বলছেন, যে বিষয়টি তোমরা বুঝবে না। অর্থাৎ যে লোকটি মারা গেল যাকে সবাই দেখলো এবং যার জানাজা পড়া হলো এমন কি সবাই মিলে তাকে দাফন পর্যন্ত করা হলো, তাকে সবাই মৃত হিসেবে জানলেও আল্লাহ পাক বলছেন যে, সে জীবিত । কিন্ত্তু কিভাবে জীবিত? সে সর্ম্পকে আল্লাহ পাক নিজেই বলছেন যে, তোমরা বুঝবে না। শর্ত হলোঃ- যারা আল্লাহর রাহে মৃত। বিষয়টি বেশ রহস্যজনক মনে হলো করিম সাহেবের কাছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন এর একটি বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কিন্ত্তু সে ব্যাখ্যা কিভাবে দেবে? কে দেবে সেই ব্যাখ্যা?

তিনি কোরআন শরীফের তফসীরের শরাপন্ন হলেন। তিনি তফসীরে কোরআনুল করিম ডাঃ জাহাঙ্গীর আল সুরেশ্বর কর্তৃক রচিত এর প্রথম খন্ডটি হাতে নিলেন। অতঃপর সুরা বাকারার ১৫৪নং আয়াতের ব্যাখ্যা জানার জন্য উক্ত পুস্তকের ৭৪ নং পৃষ্ঠায় দেখতে পেলেন, সেখানে লেখা আছে - প্রথমেই বলা হয়েছে 'এবং' শব্দটি যুক্ত করে যে, যাহারা আল্লাহর পথের মধ্যে তথা "ফি" তথা "ইলা" নয় তথা "দিকে" নয়- নিহত হয়েছেন, তথা কতল হয়েছেন, তাদেরকে মৃত বলতে তথা 'মরে গেছে' বলতে একদম মানা করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ধর্মযুদ্ধটিকে 'জেহাদ' বলা হয়, আসলে এই জেহাদটিকে ছোট জেহাদ বলা হয়েছে। তাবুকের যুদ্ধে জয়লাভ করার পর মহানবীর (সাঃ) কাছে আসার পর মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন যে, তোমরা ছোট জেহাদে জয়লাভ করেছ, এবার তোমরা বড় জেহাদের দিকে ধাবিত হও। প্রশ্ন উঠেছিল, বড় জেহাদ বলতে কি বোঝানো হয়েছে? মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন, আপন নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটাই হলো আসল জেহাদ তথা জেহাদে আকবর তথা বড় জেহাদ। কোরআন যতই রুপকতার আশ্রয় নিক না কেন, মুল কথাটি বলাই কোরআনের এক মাত্র উদ্দেশ্য। মুল হতে বিচ্যুত হয়ে কোন কথাই কোরআনে বলা হয় নাই। সুতরাং আপন নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করাটাই মুল উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন হলো, নফস তো পবিত্র, তাহলে নফসের বিরুদ্ধে কেমন করে এবং কেন জেহাদ করতে যাব? প্রতিটি নফসের সঙ্গে শয়তানকে খান্নাসরুপে একান্ত পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে। এই খান্নাসটিকে নফস হতে তাড়িয়ে দেবার জন্য ধ্যান সাধনাটিকেই জেহাদ বলা হয়েছে। ধর্মযুদ্ধের জেহাদটি এখানে গৌণ এবং আপন নফসের মধ্যে অবস্থিত খান্নাসরুপী শয়তানটির বিরুদ্ধে জেহাদ করাটি হলো মুখ্য। এই গৌণ এবং মুখ্য উভয় বিষয়টিকে একত্র করে অতুলনীয় সুন্দর করে কোরআনে যে বাক্যটি গঠন করা হয়েছে ইহা কোন মানুষের পক্ষ সম্ভব নয়।
(চলবে)

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানা পোনা - চতুর্থ পর্ব

(পূর্ব প্রকাশের পর হতে)

করিম সাহেবের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তিনি কি করবেন-ঠিক ভেবে পেলেন না। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো রহিমা বেশ খুশিই হবে। কিন্ত্তু খুশি হওয়ার পরিবর্তে রহিমা যে রুপ দেখালো, তাতে মনে হলো সে যেন রহিমার আসল রুপটি দেখতে পেয়েছেন। তিনি শুনেছেন-রাগের সময় মানুষের আসল চেহারা বের হয়ে আসে।  যেমনঃ কোন এক ব্যক্তি যদি অপর কোন ব্যক্তির আচরণে ত্যতবিরক্ত হয়ে তাকে কুত্তার বাচ্চা বা শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেয়, আশে পাশের লোকজন সেই লোকটিকে তার আকারেই দেখছে। কিন্ত্তু যে লোকটি যাকে গালি দিচ্ছে, সে ঐ ব্যক্তিকে কুকুরের বাচ্চা বা শুকরের বাচ্চা রুপে দেখছে বলেই তাকে উক্তরুপ সম্বোধন করছে। কিংবা হতে পারে সে লোকটি এমন কোন আচরণ করেছে যে তার আচার আচরণ কুকুর কিংবা শুকোরের বাচ্চা সদৃশ্য বলে অনুমিত হয়েছে বলেই সে এরুপ গালি দিয়েছে। 

করিম সাহেব সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্ত্তু তার অবচেতন মন কিছুতেই কথা শুনছে না। তিনি কিছুক্ষণ মৌন রইলেন। তারপর চোখ বুঁজে দীর্ঘভাবে বেশ কয়েকবার শ্বাস নিলেন। আবার ছাড়লেন। এভাবে বেশ কয়েকবার করার পর দেখলেন যে তার রাগ নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেছে। মনটাও বেশ বদলে গেছে। তিনি আবারো পড়ার দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলেন। যেই বইটা হাতে নিতে যাবেন দেখেন টেবিলের উপর চা এবং মুড়ি ভাজা রাখা। তিনি একমুঠো মুড়ি হাতে নিয়ে মুখে পুরে চিবাতে লাগলেন আর ফাঁকে ফাঁকে বইয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেন। পড়া শুরু করলেনঃ

দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম "শীষ নবীর জ্ঞান - এখানে আল্লাহর সন্দর্শন বা প্রত্যক্ষণ সর্ম্পকে বলা হয়েছে । প্রত্যক্ষণ দুই প্রকার। সত্তা সারের প্রত্যক্ষণ ও নামের প্রত্যক্ষণ। সত্তাসারের প্রত্যক্ষণ হলোঃ আল্লাহর জ্যোতিঃ বা আলোকের প্রত্যক্ষণ এবং সাধকের প্রত্যক্ষণের শক্তি ও ক্ষমতা অনুসারে তাঁর নিজের আকারের মাধ্যমে আল্লাহ-রুপ-দর্পণে সম্ভব হয়। দর্পণের প্রতি লক্ষ্য করলে দর্পণ অদৃশ্য হয় এবং সেখানে নিজের আকার প্রতিফলিত দেখা যায়। আপনি আপনাকে জানবেন এই হেতু আল্লাহ আপনার দর্পণ হন। এবং তাঁর গুণাবলী আপন জীবনে প্রকাশ করে আপনি তাঁর দর্পণ হন। আল্লাহর নাম অসংখ্য এবং তাঁর নামগুলো সত্তাসার ও তাঁর বিভিন্ন গুণ বা দিকের মধ্যে সর্ম্পক স্থাপন করে এবং আল্লাহর জ্ঞান লাভের সহায়ক হয়। বাহ্যিক জগতে এক একটি নাম এক একটি স্বতন্ত্র বস্ত্তুকে বুঝায় কিন্ত্তু ঐশী জগতে একই বস্তুকে নির্দেশ করে।

" যে ব্যক্তি নিজেকে জানে সে তার প্রভুকে জানে।" ঐশী জ্ঞানই আল্লাহর বাহ্যিক প্রকাশ সর্ম্পকে সামান্য জ্ঞান দান করতে পারে যা এই জগতে সম্ভব হয়। এই জগতে যদি এই জ্ঞান লাভ করতে না পারে তবে পরজগতে এই জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এখানে যে অন্ধ, পরজগতেও সে অন্ধ হবে সঠিক পথ থেকে সে বহু দুরে থাকবে।

মরমী সাধক বা অতীন্দ্রিয়বাদী সন্দর্শন করেন যে আল্লাহ এক। দৃশ্যমান জগতের সকল বস্ত্তুর অস্তিত্ব আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। এক আল্লাহ বহুরুপে প্রকাশিত হয় যে ব্যক্তি 'বহু' এর জ্ঞানলাভ করে সে 'এক' এর জ্ঞান লাভ করে। অদৃশ্য ও অতুলনীয় পরম সত্তা "বহু" আকারের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে। যদিও 'এক' ও 'বহু' - এর মধ্যে পার্থক্য আছে, তবুও স্রষ্টাই সৃষ্টি এবং সৃষ্টিই স্রষ্টা এবং 'সার্বিক সত্তাসার' হতে বহু 'বিশেষ সত্তাসারের' উৎপত্তি হওয়ার ফলে এমন মনে হয়, বাহ্যিক জগতের বহুর 'বহু' আকার এক পরম দর্পণে প্রতিফলিত হয়। অন্যভাবে বললে, বহু-রুপ দর্পণে এক আকারই প্রতিফলিত হয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে লক্ষ্য করার ফলে অনেক সময় আশ্চর্য হতে হয়, কিন্ত্তু যারা জ্ঞানবান বা 'সত্তাকে অনুধাবণ করতে সক্ষম', তারা আশ্চর্য হয় না।

শীষ নবীর জ্ঞানের অধ্যায়ে ইবনুল আরাবীর "ওয়াহ্ দাতুল ওযুদ" মতবাদ ও আল্লাহর জ্ঞানলাভের কথা বলা হয়েছে। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে প্রার্থনার অর্থ জ্ঞান লাভ করা এবং জ্ঞান লাভের অর্থই আল্লাহকে সন্দর্শন করা

করিম সাহেব হুম করে একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন। এর অর্থ হতে পারে সে বিষয়টি উপলব্দি করতে পারছেন। তিনি আবারো এক মুঠো মুড়ি মুখে পুড়লেন আর ধীরে ধীরে তা চিবাতে লাগলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি উঠোনের দিকে তাকালেন। দেখলেন, মা মুরগীটা একটু দুরে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাবার খাচ্ছে। আর তার পাশেই একটি ছানা খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটি তেলাপোকা মুখে নিয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্ত্তু পারছে না। তার খোঁড়া পায়ে জোর না থাকায় তারই অন্যান্য  ভাই-বেরাদাররা তেলাপোকাটা নেয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তা দেখে মা মুরগীটা ছো মেরে তেলাপোকাটা নিয়ে নিল। করিম সাহেব বেশ আশ্চার্য বোধ করলেন।
(চলবে)

শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ধারা ও হাঁস মুরগীর ছানাপোনা - তৃতীয় পর্ব

(দ্বিতীয় পর্বের পর হতে)

রহিমা রান্না ঘরে চলে যেতেই করিম সাহেব আবার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিলেন। তিনি আজকে সকালে যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন, তার একটা সমাধান আজকের মধ্যেই বের করতে হবে। তিনি চান আজকের মধ্যেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ফেলতে। তিনি তার ভাবনায় আবারো ডুবে গেলেন।

তিনি আবারো বইটি হাতে নিলেন এবং পড়া শুরু করে দিলেন। 

ইবনুল আরাবীর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠগ্রন্থ "ফুসুল-উল-হিকাম"। এই গ্রন্থখানি ২৭টি অধ্যায়ে লিখিত এবং প্রত্যোকটি অধ্যায় এক একজন নবীর নামের শিরোনামায় উল্লেখিত। এই গ্রন্থে সুফীবাদের বিভিন্ন বিষয় সর্ম্পকে আলোচনা করা হয়েছে। তার রচনার পদ্ধতি, ভাষা, উপমা ইত্যাদি অত্যন্ত জটিল,দুর্জ্ঞেয় ও দুর্বোধ্য হওয়ার ফলে অনেকে তাঁর অর্থ বুঝতে পারেননি এবং তাঁর মতো একজন মুক্তবুদ্ধি, গোঁড়ামিশুন্য, উদারমনা, প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের বাহ্যিক অর্থের সমালোচক ইবনে তাইমীয়া, আল-তাফতাযানী ও ইব্রাহিম আল বিকায় প্রমুখ চিন্তাবিদ "যিন্দিক" বা কাফের বলে আখ্যায়িত করেন। যারা তাঁর মতবাদ বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা তাঁকে "সিদ্দিক" বা বিশ্বাসী, "শায়খুল আকবর বা শ্রেষ্ঠ শায়খুল, 'হাকায়েক' বা সভ্যতার সমুদ্র বলে উল্লেখ করেছেন। জামালউদ্দিনের মতে, " তিনি জ্ঞানীকুলের শিরোমণি এবং আল্লাহ তাকে সব রকম জ্ঞান দান করেছেন।" তার ফুসুল-উল-হিকাম এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিম্নরুপঃ

প্রথম অধ্যায়ের নাম " আদমের জ্ঞান"। আদম বিশ্ব জগতে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ হিসেবে আদমের উচ্চ স্থানের কথা বলা হয়েছে। মানুষ সকল ঐশীগুণ সমন্বিত ক্ষুদ্র বিশ্ব এবং সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, সৃষ্টির প্রথম ও শেষ কারণ, আল্লাহর পুর্ণ-প্রকাশ, পুর্ণ-মানব, পুর্ণ-জ্ঞানের অধিকারী। ফেরেস্তাগণ আল্লাহর শক্তি, আল্লাহর নাম ও গুণে প্রকাশ, তাঁদের জ্ঞান ও গুণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশ্ব জগৎ আত্মসচেতন নয়। বাইরের দিক দিয়ে আলোচনা করলে বলতে হয় যে, এটা আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে অবস্থিত। দৈহিক বহুত্বের জন্য সত্তাকে বহু বলা যায় না। মানবতাও মুলতঃ এক। সবকিছুর মুলে এক।


তিনি আদমের জ্ঞান অধ্যায়টি কয়েকবার পড়লেন। কিন্ত্তু তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধিত রইল কেবল একটি বিষয়ের উপর। আর সেটা হলোঃ সবকিছুর মূলে এক। তার মানে কি? সমগ্র বিশ্ব তাঁরই মুকুর। তিনিই জ্ঞানের আধার। তিনিই সব। সব কিছুই তিনি। তাহলে আদম এবং হাওয়া বলে যে কথাটি আছে-সেখানে হাওয়া সৃষ্টির কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। হাওয়া কি আদমের মতোই কোন সৃষ্টবস্ত্তু? না-কি অন্য কোন উপায়ে হা্ওয়াকে সৃষ্ট করা হয়েছে? তাছাড়া আদমকে যখন সৃষ্টি করা হয় তখন ফেরেস্তারা তা দেখেছে। যখন আদম ছিল তখন হাওয়ার কোন অস্তিত্বই ছিল না। হাওয়া আসছে পরে। তার জাওজ হিসেবে। কোরআনেও সেটা উল্লেখ করা হয়েছে জাওজ বলে। তার মানে - আদমের ভিতরই কি হাওয়ার অস্তিত্ব ছিল? না-কি হাওয়া হটাৎই সৃষ্টি হয়েছে এবং মানবীয় রুপ ধারণ করে তার জাওজ হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে? তাছাড়া আদমের সৃষ্টির ব্যাপারে কোরআনে যেরুপ বর্ণনা করা হয়েছে-হাওয়াকে সৃষ্টির ব্যাপারে সেরুপ বর্ণনা অনুপস্থিত। কিন্ত্তু কেন? এর কারণ কি? তিনি ভেবে পেলেন না। কারণ, যখন আদম ছিল তখন হাওয়া ছিল না। আদমকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে সেভাবে যদি হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, তাহলে সেখানে আদমের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। আদমের দেখার কথা। আদম দেখলো-তার সম্মুখে একটা রমনীরুপে হাওয়াকে। তাহলে সে কিভাবে আদমের মতো সৃষ্ট পদার্থ হয়? তাহলে সে কি সৃষ্টির বাইরের কোন অস্তিত্বের কেউ? যে তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং সম্পূর্ণরুপে? তাহলে আদমের কাছে হাওয়া কি একটি রহস্যের নাম? যে রহস্যের ভেদ অজানা? কি ধরে নেব?

করিম সাহেবের মাথা ঘুরতে লাগলো। তিনি আবারো একটি সিগারেট ধরালেন। ঠিক সেই সময় রহিমা চায়ের কাপ নিয়ে হাজির। একটি প্লেটে করে মুড়ি ভেজে এনেছেন। তিনি চা এবং মুড়ি টেবিলের উপর রাখলেন। করিম সাহেব সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন-আচ্ছা তুমি কি হাওয়া সর্স্পকে কিছু জানো?

আচানক এ প্রশ্ন করায় রহিমা অপ্রস্তত হয়ে ঘাবড়ে গেল। সে কি বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। সে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-তুমি কি কিছু বললে?

-না, মানে আমি তোমাকে জিগ্যাসা করছিলাম তুমি কি হাওয়া সর্ম্পকে কিছু জানো কি-না?

-আমি কি তোমার মতো অত জ্ঞানী গুণী মানুষ যে জানবো? তোমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই সারাদিন বই পড়বে আর এটা ওটা লিখবে? আচ্ছা এইসব ছাই পাস দিয়ে কি হবে আমাদের? বলোতো? 

-তোমাকে জিগ্যাসা করাটা আমার উচিত হয়নি। তোমার মতো গন্ডমুর্খ হওয়ার চাইতে গাধা হওয়াও অনেক ভালো।

-তোমার সেটাই হওয়া উচিত। গাধা তো সারাদিনমান খেটে খুটে বেড়ায়। কাজ করে। তুমিতো কাজ কাম বাদ দিয়ে সারাদিন লেখালেখি নিয়ে থাকো। এই দিকে ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া, ঘর-সংসার কোন দিকেই তোমার মন নেই। তুমি কখনো সংসারের কোন খোজ খবরই রাখো না। থাকো তোমার লেখা লেখি নিয়ে। চা আর মুড়ি দিয়ে গেলাম। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। আমার তোমার মতো অত জেনে কাজ নেই।

করিম সাহেব ভুলেও ভাবতে পারেননি রহিমা তার খোদক্তি এভাবে করবে? তিনি বেশ অপ্রস্তুত এবং বিব্রত বোধ করলেন।
(চলবে)

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ধারা ও হাঁস-মুরগীদের ছানাপোনা-পর্ব দুই

(প্রথম পর্বের পর হতে)

করিম সাহেব বেশ চিন্তিত মুখে মলিন বদনে বসে আছেন। তার মুখ-মন্ডলে চিন্তা-রেখা সুস্পষ্ট। তা দেখে রহিমা করিম সাহেবকে বললেনঃ

-কি ব্যাপার? তোমাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে? কি হয়েছে?

-নাহ্ । তেমন কিছু না। আর যা হয়েছে তা তুমি ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।

রহিমা জানে তার স্বামী যখন কোন কিছু নিয়ে লেখা লেখি করে তখন তাকে চেনা যায় না। তিনি যেন অন্য কোন গ্রহের মানুষ হয়ে যান। কেমন যেন অচেনা মনে হয় লোকটাকে। অথচ তার স্বামী যখন তারই সাথে খাবার খায় এবং একই বিছানায় ঘুমায়, তখন তাকে চির চেনা লোকটির মতোই মনে হয়। কিন্ত্তু লেখার সময় তিনি লোকটির সাথে পুর্বের লোকটির কোন সায়ুজ্য খুঁজে পান না। তাছাড়া তাকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেশ রেগে যান। তাই রহিমা সবসময় দুরত্ব বজায় রেখে চলেন। রহিমা করিম সাহেবকে বললেনঃ

-তুমি কি চা খাবে? আদা দিয়ে লাল চা বানিয়ে আনি...খেলে বেশ ভালো লাগবে

করিম সাহেব তার কোন উত্তর না দিয়ে কেবল "হুম" বলে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন হাঁস-মুরগীদের দিকে। দেখলেন, সবাই কেমন গোগ্রাসে খাবারগুলো খাচ্ছে। হাঁসগুলো তার চেপ্ট্যা ঠোঁটদুটো খাদার মধ্যে ডুবিয়ে কেমন যেন একটি খ্যাত খ্যাত শব্দ করে কুড়োগুলো খাচ্ছে। আর মুরগীটা একটা একটা করে খুদগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। একবার মাথা উঠাচ্ছে আবার নামাচ্ছে। অনেকটা আমরা যেমন নামাযে দাঁড়াই, সেজদা দেয়ার পুর্বে যেমন রুকু হতে উঠে দাঁড়াই, ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। একবার মাথা উপরের দিকে উঠাচ্ছে পরক্ষণেই আবার মাটিতে থাকা খুদের মধ্যে ঠোকর দিচ্ছে। তাকে অনুসরণ করছে মুরগীর ছানাগুলো। তারাও মায়ের মতো করেই খাদ্য খাচ্ছে। করিম সাহেব কি মনে করে যেন সেই দিকটায় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রহিমাও সেদিকটা দেখার চেষ্টা করলো। সেও দেখলো-তার স্বামী উঠোনে থাকা হাঁস-মুরগীদের খাবারের দৃশ্য উপভোগ করছে। কিন্ত্তু সে ঠিক কি চিন্তা করছে, সেটা রহিমা ধরতে পারলো না। সে বেশ অবাকই হলো। রহিমা জিগ্যেস করলোঃ

-কি, কিছু বলছো না যে? চা বানিয়ে আনবো?

-আরে আনো না...দেখছো না একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছি..

-কি কাজ করছো?

-হাঁস মুরগীদের খাবার গ্রহণের দৃশ্যগুলো মনোযোগ সহকারে দেখছি।

-সেটা দেখার কি হলো? আমিতো রোজই দেখি..

-তুমি দ্যাখো কিন্ত্তু উপভোগ করো না...

-উপভোগ? সেটা আবার কি? 

-সেটা হলো দর্শন।

-দর্শন? 

-হ্যাঁ। দর্শন। 

করিম সাহেব একটি সিগারেট ধরিয়ে ফুঁস করে একরাশ ধোঁয়া বের করলেন। তারপর বললেনঃ

-দেখা এক জিনিস আর দর্শন আরেক জিনিস। স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে যে দেখা, সেটা হলো সাধারণ দর্শন তথা দেখা। সাদা মাটা। সেটা উপভোগ্য বিষয় নয়। কিন্ত্তু যখন সেই দৃষ্টির মধ্যে গভীর কোন তত্ত্ব খোঁজার চেষ্টা করা হয়, তখন সেখান হতে একটি উপভোগ্য বিষয় বের হয়ে আসে। সেটাই সেটার দর্শন। তথা মুল বিষয় বস্তু। তুমি দেখেছো সাধারণ দৃষ্টি নিয়ে। তাই তোমার কাছে বিষয়টি উপভোগ্য হয়নি। সেটা দর্শন নয়। কিন্ত্তু আমি সেই দৃষ্টি নিয়ে তাকাই নি। আমি সেই দৃশ্যের মধ্যে একটা উপভোগ্য বিষয় খুঁজতে চেষ্টা করেছি। তাই সেটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হয়েছে। সেটাই আমার দর্শন।

-খুলে বলো।

রহিমা বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো। সে প্রতিদিনতো একই কাজ করে আসছে। সে হাঁস-মুরগীদের যত্ন আত্তি করছে। তাদের খাবার দিচ্ছে। আবার যথারীতি সাঁঝে হাঁস-মুরগীদের খোয়ারে তোলে দোর লাগিয়ে দেয়। দোরটির মুখে একটি ইট দিয়ে রাখে, যাতে সেটা সরিয়ে কোন শিয়াল কিংবা খাটাশ মুরগী কিংবা হাঁস ধরে নিয়ে যেতে না পারে। এত কিছু করার পরও সে দর্শন করতে পারলো না-বিষয়টা তার কাছে বেশ রহস্যময় মনে হলো। রহিমা তাকিয়ে আছে তার স্বামীর দিকে।

করিম সাহেব সিগারেটে দম নিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বেশ কায়দা করে তার দর্শনের বিষয়টি খুলে বলার চেষ্টা করছেন। শোন তাহলেঃ

- আল্লাহ পাক সমগ্র সৃষ্টিজগতের আধার। তিনি স্রষ্টা হয়ে খালিকরুপে সমগ্র সৃষ্টিজগতের ভার নিয়েছেন। তিনি সেই সৃষ্ট বিষয়ের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞ। তাই তাদের রিজিক তিনি দান করেছেন অকৃপণভাবে। জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। সেই রিযিক গ্রহণ করে দেহবীজ উৎপন্ন করে সৃষ্টিধারা অব্যাহত রেখেছেন মুরীদুন ছেফাতের মাধ্যমে। দেহবীজ তৈরীর মুল উপকরণ হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য বিনে দেহবীজ উৎপন্নসম্ভবপর নয়। সেই খাদ্য যেটা জমিনের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মুরগীটার দিকে লক্ষ্য করো - দ্যাখো তাকিয়ে। সে কিভাবে সেগুলো একটা একটা করে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। আর বাচ্চাদের সেই খাবার গ্রহণের কৌশল শেখাচ্ছে। বাচ্চাগুলো মাকে অবলোকন করে অবলীলায় মায়ের ভংগীতেই খাবারগুলো খাচ্ছে। তার পাশেরই দ্যাখো মোরগটাও খাবার খাচ্ছে। সে খাবার গ্রহণের সময় তার ধারের কাছে কা্‌উকেই ভীড়তে দিচ্ছে না। সে জানে, তার জন্যই খাবারটা বেশি জরুরী। কেননা, তাকে প্রডাক্টিভিটি চালিয়ে রাখার জন্য খাদ্যটা বেশি জরুরী। আর মা মুরগীটা তার ছানাদের নিয়ে অন্যদিকটায় অবস্থান করে অবলীলায় খাদ্য খেয়ে যাচ্ছে। 

অপরদিকটায় দ্যাখো-হাঁসদের খাদ্যের ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই। তারা গোগ্রাসে কারো দিকে না তাকিয়ে কে কতো বেশি খাবার খেতে পারে, সেরকম এক ধরণের প্রতিযোগীতার সৃষ্টি করে চলেছে। মনে হচ্ছে, অন্য দিকে দৃষ্টি দিলে হয়তো পাশেরটা তার থেকে বেশি খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। কারো যেন কোন হুঁস নেই। পাতি হাঁসটি তার বাচ্চাদের দিকেও খেয়াল করছে না। বাচ্চাগুলো মরিয়া হয়ে খাবার গ্রহণের চেষ্টা করছে। সেও তার মা-বাবার মতোই একই কায়দায় খাবার খাচ্ছে। পার্থক্য হলোঃ মা মুরগীটা তার বাচ্চাদের প্রতি কর্তব্যপরায়ন এবং শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে বেশ আগ্রহশীল। আর মা হাসটি তার বাচ্চাদের ব্যাপারে গাফেল। সে সেদিকটায় মোটেও খেয়াল করছে না। না তার খানা খাদ্যে, না তার চলা-চলতিতে। ফলে তাদের যে খাদ্য ছিটকে পড়ছে তার দিকে তাদের খেয়ালই নেই। অথচ মুরগীটি প্রতিটি দানা একটা একটা করে খুটে খুটে খাচ্ছে। কি অদ্ভুদ! তাই, না?

রহিমা তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনেও সেই খেয়াল চাপলো। করিম সাহেব কি হাঁসদের মতোই গাফেল ? সে কি এই সংসারের দিকে এমন দৃষ্টি নিয়ে কখনো দেখেছে? কি করে এই সংসারটা চলে? কিভাবে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে হয়? কিভাবে তাদের জন্য সেই ভোর হতে রাত অবধি গাধার খাটুনি খাটতে হয়? তার চিন্তা-ভাবনা করার মতো ফুরসৎ কই? কিভাবে সে করিম সাহেবের মতো দর্শন খুঁজে বেড়াবে? রহিমার চোখে জল চলে আসছে সংসারের অভাব অনটনের মধ্যে থেকে তার স্বামীর দর্শন চিন্তা দেখে। যে ব্যক্তি সামান্য পশু-পাখিদের মধ্যে দর্শন চিন্তা করতে পারে, সে নিশ্চয়ই বড়ো কোন কিছু অবশ্যই চিন্তা করতে পারে। রহিমা স্বামীকে খুশি করার জন্য বললোঃ

-সত্যিই তো? সেইভাবে তো কখনো দেখিনি। চিন্তাও করতে পারিনি। 

এ কথা বলে রহিমা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। এখনো অনেক কাজ বাকী। ছেলে-মেয়েদের জন্য নাস্তা তৈরী করতে হবে। নিজেদের জন্যও খাবার তৈরী করতে হবে। তাকে তো কেউ হাঁস-মুরগীদের মতো খাবার তৈরী করে খেতে দেবে না। তার খাবার তার নিজেরই তৈরী করতে হবে।
(চলবে)