পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪

স্তব্ধ পৃথিবী

আজকের দিনটি কেমন যেন অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু ভিন্নভাবে শুরু হয়েছে আবীরের। শীতের দিন। পৌষ মাসের আজ ১৮ তারিখ। এসময় শীতের প্রকোপ থাকার কথা। কিন্ত্তু শীতের সেরকম আমেজ নেই। নেই কোন উচ্ছ্বলতা, নেই কোন প্রাণচাণ্ঞ্চল্যতা। কেমন যেন সবকিছু গুমোট মনে হচ্ছে। কেন এমন মনে হচ্ছে কে জানে? বিছানা ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছে করছে না। আবার শুয়ে থাকতেও ভাল লাগছে না। চিন্তা করে পাচ্ছিল না কি করবে আবীর।
বিছানার পাশেই সস্তা সিগারেটের প্যাকেট। ম্যাচটিও তার পাশেই আছে। একটি সিগারেট বের করে ধরালো। ফুঁস করে ধোঁয়া ছাড়ছে আর দেখার চেষ্টা করছে - ধোঁয়াগুলো কেমন যেন কুন্ডলী পাকিয়ে আস্তে আস্তে বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে। দেখে কেমন যেন উৎফুল্ল মনে হলো। সে আবারো বড় করে একটা টান দিয়ে বেশ আয়েশ করেই ধোঁয়া ছাড়লো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ধোঁয়ার দিকে। সেই আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো। তবে আগেরটির চেয়ে এবার একটু সময় বেশি নিল। অবাক করা ব্যাপার। কেন এমন হলো? আবীরকে ভাবনায় ফেলে দিল এই অতি সামান্য ঘটনাটি। সে ভেবেই পেল না কেন এমন হলো ?- আচ্ছা এই যে ধোঁয়া...
তার ভাবনায়  ছেদ পড়লো হটাৎ মোবাইলের জ্বলো-নিভু আলোয়। পাশেই থাকা তার মোবাইল সেটটি কেঁপে উঠলো। শ্বেতা ফোন করেছে। আজ তার সাথে বাইরে ঘুরতে যাবার কথা। শ্বেতার ফোন পেয়েই তার ভাবনাগুলো সব গুলিয়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে সে মোবাইলটা ওঠালো। কানের কাছে নিতেই সে শুনলে পেল শ্বেতার কন্ঠ।
-কি ব্যাপার? এতো দেরী করে ফোনটা ধরলে কেন?
-কই? তুমিতো ফোন দেয়ার সাথে সাথেই ধরলাম।
-তোমাকে বেশ কয়েকবার আমি কল দিয়েছি।
-তাই? বেশ অবাক হলো আবীর।
-কি কথা বলছো না কেন?
- না, মানে আমিতো তোমাকে বলেছি....
-আবীর, তোমার এই মিনমিনে স্বভাবটা আমার এক দম পছন্দ না। তোমাকে তো বলেছি আজকে আমরা অনেক দূরে যাব। এক সাথে হেঁটে বেড়াবো। দুপুরে কোথাও এক সাথে খাব.....
শ্বেতা তার স্বপ্নের কথা বাস্তবে রুপ দেয়ার চেষ্টায় বিভোর। আর আমি মেলাতে চেষ্টা করছি আমার পকেটের অবস্থা। মেছে থেকে থেকে স্বভাবটা কেমন যেন কাজের বুয়া টাইপের হয়ে গেছে। ঠান্ডা পানিতে কাপড় ধুয়ে সেটা আবার আয়রন করে পড়তে হয়্। রান্না বান্না করে খেতে হয়। সবচেয়ে বাজে হচ্ছে যেদিন মাছ কিনে আনি। মাছ কেটে ধুয়ে রান্না করে খা্ওয়া যে কি ঝামেলার সেই কষ্টের কথা কি শ্বেতা বুঝবে? কেন যে বেকারদের প্রিয় খাবার আলুভর্তা আর ডাল কিংবা ডিমভাজা সেটা বেকার না থাকলে আর মেছে না থাকলে বুঝানো যাবে না। মাস শেষ হবার আগেই ভাড়ার কথা বলে যায় বাড়ীওয়ালা,কুদ্দুস চাচা বারবার স্বরণ করে দেয় তার সিগারেটের বিলের কথা। মোবারক মামা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে মামা - আইজ কয় তারিক?
-কি ব্যাপার তুমি কোন কথা বলছো না কেন?
-এই যে তুমি বলছো আমি শুনছি।
-কি বলেছি বলোতো?
-বলেছো তুমি আর আমি আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াবো। দুপুরে একসাথে খাব..এইতো?
-ঠিক আছে। তুমি রেডি হয়ে মোবারকের দোকানের সামনে আসো। আমি বের হচ্ছি।
-আচ্ছা। লাইনটা কেটে দিল। আবীর আর কথা বাড়াতে চাইলো না।
 সে তৈরী হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি বাথ রুমে গিয়ে ঢুকলো। বালতিতে পানি ভরাই ছিল। হাত দিতেই শরীর হিম শীতল হয়ে গেল। পানি প্রচুর ঠান্ডা। গরম পানি মিলিয়ে যে গোসল করবে সেই সময়টুকুও নেই। আয়নায় দেখলো তার দাঁড়িগুলো কেমন যেন বড়ো বড়ো লাগছে। সেভ করতে হবে। আবার বাইরে এসে সেভিংক্রীম আর রেজরটা নিল। সেভ করতেই তার কেমন যেন অস্বস্থিবোধ হতে লাগলো। পেটের মধ্যে কেমন যেন ব্যথা করছে। সে আবার বাথ রুমে ঢুকলো। বাথ রুমে গিয়ে বসতেই সে দেখতে পেল আগের মতো আর চাপ অনুভব করছে না। সব কিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। কোনটা ছেড়ে কোনটা করবে ভেবেই পাচ্ছে না। আরো কিছুক্ষণ বসে রইলো। যদি কিছু হয়....
কিন্ত্তু কিছুই হচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে গেল। দেখা গেল আমি শ্বেতার সাথে হাঁটছি। হটাৎ উইথআউট নোটিশে আবার প্রকৃতি জানান দিচ্ছে -সকলে কিন্ত্তু কিছুই হয়নি। তোমার আজকে কিছু জমা দেয়ার ডেট। কিছুই জমা দাওনি। এখন জমা দাও... কি করবে তখন? শ্বেতাকে বলবে --প্লীজ ওয়েট ফর মি। আ'ম জাস্ট কামিং... চিন্তা করতেই তার হাসি পেয়ে গেল।
-ওই ব্যাটা, কি করস? হাগতে বইস্যা হাসতাস কেন? ওপাশ থেকে সোহেলের গলা শোনা গেল।
-দাঁড়া ব্যাটা। বাইর হইতাছি। হাগার পর গোসল করমু। তারপর তোর সিরিয়াল।
বাথ রুমে বসেই কথাগুলো জানান দিল আবীর। সে জানে দরজা খুলে কথা বলতে গেলেই সে ফুরুৎ করে ঢুকে যাবে। আর বের হবে এক ঘন্টা পর। ততক্ষণে তার অবস্থা শেষ।
-কস কি বে? আমিতো হালায় মইর‌্যা যামুগা...
কথা না বাড়িয়ে আবীর গোসল সেরে নিল। সে শুনে ছিল-শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে গেলে প্রথমে একটু ঠান্ডা লাগে বাট পানি ঢালা শুরু করলে পরে আর শীত বোধ হয় না। কথা ভুল প্রমাণ করে দিলে হড়হড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বের হলো আবীর। খালি গায়ে কেমন যেন চুপসে গেছে। তাকে ধাক্কা দিয়েই ভিতরে প্রবেশ করলো সোহেল। আর সাথে শুনতে পেল বিকট কিছু উদ্ভট শব্দ। আবীরের বেশ হাসি পেল।
-কি রে শালা। সব কিছু কি বোমা মাইর‌্যা উড়াইয়্যা দিবি না-কি?
ওপাশ থেকে কোন কথা শোনা গেল না। শুধু কিছু আওয়াজ শুনতে পেল। আবীর আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি রেড়ী হয়ে নিল। মোবাইলটা হাতে নিয়েই সে অবাক হয়ে গেল। বেশ কয়েকটা মিস কল। শ্বেতা তাকে কল করেছিল। তার মোবাইল যে ভাইব্রেশন দিয়ে রেখেছিল সেটার দিকে তার নজরই যায়নি। তার জন্যই সে রিংটোন শুনতে পায়নি। ওহ! সিট বলেই সে শ্বেতাকে কল দিল। যতবারই সে কল দিচ্ছে ততবারই সে শুনতে পাচ্ছে-এই মুহুর্তে আপনার......
শ্বেতা বোধ হয় রেগে মেগেই চলে গ্যাছে। তাড়াতাড়ি বের হয়েই সে মোবারক মামার চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালো। কিন্ত্তু শ্বেতাকে দেখা গেল না কোথা্ও। আবার কল দেয়ার চেষ্টা করলো। লাভ হলো না। সেই একই কথার পুণরাবৃত্তি শুনতে পেল। মোবারক মামাকে শ্বেতার কথা জিগ্যেস করতেই বললো-হ মামা। আইছিলোতো। অনেকখুন দাঁড়ায় থাইক্কা চইল্ল্যা গেছে। কথাটা শুনতেই তার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল।
-মামা একটা চা দেন।
মোবারক নামক লোকটার বয়স প্রায়ই ছেচল্লিশের মতো। মোটা সোটা। কিন্ত্তু বেশ মিশুক টাইপের। চা-টা বেশ কায়দা করে বানায়। তার চায়ের সুনামের জন্যই তার পরিচিতি। মোবারক মামার চায়ের দোকানের কথা বললেই ইয়ং জেনারেশনের সবাই একবাক্যে চেনে। তার স্বাদের চায়ের নাম ফান্টুস চা। ফেন্সি (ফেন্সিডিল) দিয়ে বানালো চা। প্রয়োজনমতো দুধ চিনি থাকে। খেলেই কেমন যেন একটা ফিলিংস আসে। প্রতি কাপ দশ টাকা। ইয়ংদের কাছে সে বেশ জনপ্রিয়।
-মামা এহন দিমু? মোবারক জানতে চাইলো।
-দেন।
চায়ে চুমুক দিতেই তার মনে রাজ্যের চিন্তা ভীড় করলো। কেন এমন হলো? নিজের বোকামির জন্যই তো শ্বেতার সাথে ঘুরতে যেতে পারলো না। ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সে জন্যেইতো মোবাইলে ভাইব্রেশন দিয়ে রেখেছিল। ঘুম তো তার ঠিকই ভেংগে ছিল। কেন যে এ কাজ করতে গিয়েছিল...
-কি রে তুই এইখানে? আর তোরে আমি খুঁইজ্যা মরতাছি।
সোহেলের গলা শুনে তার চিন্তায় ছেদ পড়লো।
-ক্যান? কি হয়েছে?
-তুই জানস না?
-কি জানমু ব্যাটা? কবি তো?
-আজ সকালে খোকন মারা গেছে। দুপুরে জানাজা। যাবি না?
-কি বললি? খোকন মারা গেছে?
আবীরের বিশ্বাস হতে চাইছে না। গত কালকেও সে তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে দেখে এসেছে। অনেক কথা হয়েছে ওর সাথে। একই সাথে লেখা পড়া করেছে। বড় লোকের একমাত্র ছেলে। অঢেল টাকা পয়সা। দিব্যি খায় আর আরামছে ঘুমায়। আমাদের মতো বুয়াটাইপের জীবন কাটাতে হয় না। মাঝে মাঝে হাতে টান পড়লে তাকে সাহায্য করতো। বেশ বোঝা পড়া ছিল দুজনের মধ্যে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছিল সপ্তাহাখানেক আগে। হটাৎ ওর মৃত্যূর খবর শুনে ঘাবরিয়ে যায়। চা-টা শেষ করেই বলে
-চল। ওদের বাড়ীতে যাই।
আবীর আর সোহেল খোকনদের বাড়ীতে যায়। বাড়ীর উঠানেই রাখা হয়েছে খোকনের লাশ। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। মসজিদ থেকে আনা খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। খাটের চার পাশে আগর বাতির ধোঁয়া উড়ছে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে মাদ্রাসার ছাত্রদের কোরান তেলাওয়াতের শব্দ। ...ফাবি আইয়্যি আলা...রাব্বি কুমা তুকাজ্জিবান...
খোকনের আম্মা যাকেই পাচ্ছে তাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ শুধু পাওয়া গেল মলির। মলি খুব ভালো বাসতো খোকনকে। কিন্ত্তু খোকন কোন দিনই মলিকে পাত্তা দিতে চাইতো না। কারণ সে জানতে পারছিলো সে বেশিদিন বাঁচবে না। আবীর ব্যাপারটা জানতো। কিন্ত্তু খোকন মানা করেছিল বলে মলিকে বলেনি।
চারদিকে একটি আবেগঘন পরিবেশ তৈরী হওয়ায় আবীরও যেন সেই পরিবেশের একজন হয়ে গেল। মসজিদের হুজুরকে খবর দেয়া হয়েছে। বাদ জোহর জানাজা হবে। মসজিদ থেকে জব্বার হুজুরকে ধরে আনা হয়েছে মুর্দাকে গোসল দেয়ার জন্য। জব্বার তার সাথের লোকজনকে গোসলের জায়গাটা দেখিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো গোসল দেয়ার জন্য। আবীর আস্তে আস্তে করে সেখান থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ একটা স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। দেখতে দেখতে নামাযের সময় হয়ে এল। নামায পড়ার জন্য সবাই মসজিদে ছুটলো। এদিকে মুর্দার গোসল শেষ করে শেষ বারের মতো সবাইকে দেখতে বলা হয়েছে। বাড়ীর সবাই একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জব্বার হুজুর বললো - আপনারা গন্ডগোল কইরেন না। সবাই সুন্দরভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে লাশ দেখেন। লাশ দেখা শেষ হলেই মসজিদে নিয়া যাইতে হইবো। নামাযের সময় হইয়া আইছে। আমি মসজিদে যাই। এদিকে জব্বার হুজুর চলে যেতেই মহিলারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সোহেল এসে আবীরকে বললো
-ধর। খাটের ঐ পাশটা ধর। আবীর খাটিয়ার একটি প্রান্ত ধরে মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
নামায শেষ করে মুসল্লিরা মুর্দার জন্য অপেক্ষা করছিল। ইমাম সাহেব আগেই মুসল্লিদের জানিয়ে রেখে ছিলেন নামাযের শেষে জানাযা আছে। জানাজার নামায ফরযে কেফা্‌ইয়া। আদায় করা জরুরী। তাই মুসল্লিরা কেউ যায়নি। সবাই ঠাঁই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। এরই মধ্যে লাশটি এনে সামনে রাখা হলো। ইমাম সাহেব বলতে লাগলেন-
আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন-"কুল্লু নাফসিন জায়কাতুল মউত।[সুরা আলে ইমরা-১৮৫]" প্রত্যেকটি জীবিত প্রাণীকে অবশ্যই মৃত্যূর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এর কোন ব্যত্যয় আল্লাহ পাক রাখেননি।
বারা বিন আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে জনৈক আনসারী সাহাবীর জানাযায় শরীক হওয়ার জন্যে বের হলাম। তখনও কবরের খনন কাজ শেষ হয়নি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন। আমরাও তাঁর চারপাশে বসে গেলাম। তাঁর হাতে ছিল একটি কাঠি। তা দিয়ে তিনি মাটিতে খুঁচাতে ছিলেন এবং একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর একবার যমিনের দিকে মাথা অবনত করছিলেন। তিনবার তিনি দৃষ্টি উঁচু করলেন এবং নীচু করলেন। অতঃপর বললেনঃ"তোমরা আল্লাহর কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাও। কথাটি তিনি দুবার অথবা তিনবার বললেন।অতঃপর তিনি এই দুআ করলেনঃ
)أَللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوْذُبِكَ مِنْ عَذاَبِ الْقَبْرِ(
অর্থঃ"হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই।"তারপর তিনি বললেনঃ মুমিন বান্দার নিকট যখন দুনিয়ার শেষ দিন এবং আখেরাতের প্রথম দিন উপস্থিত হয় তখন আকাশ থেকে উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট একদল ফেরেশতা উপস্থিত হন। তাদের সাথে থাকে জান্নাতের পোষাক এবং জান্নাতের সুঘ্রাণ। মুমিন ব্যক্তির চোখের দৃষ্টি যতদূর যায় তারা ততদূরে বসে থাকেন। এমন সময় মালাকুল মাউত উপস্থিত হন এবং তার মাথার পাশে বসে বলতে থাকেনঃ হে পবিত্র আত্মা! তুমি আপন প্রভুর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বের হয়ে আস। একথা শুনার পর মুমিন ব্যক্তির রূহ্‌ অতি সহজেই বের হয়ে আসে। যেমনভাবে কলসীর মুখ দিয়ে পানি বের হয়ে থাকে। রূহ বের হওয়ার সাথে সাথে ফেরশতাগণ তাঁকে জান্নাতী পোষাক পরিয়ে দেন এবং জান্নাতী সুঘ্রাণে তাকে সুরভিত করেন। তার দেহ থেকে এমন সুঘ্রাণ বের হতে থাকে যার চেয়ে উত্তম সুঘ্রাণ আর হতে পারেনা। তাকে নিয়ে ফেরেশতাগণ আকাশের দিকে উঠে যান। যেখান দিয়েই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানেই ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করেনঃ এটা কার পবিত্র আত্মা? উত্তরে অতি উত্তম নাম উচ্চারণ করে বলা হয় অমুকের পুত্র অমুকের। আকাশে পৌঁছে গিয়ে দরজা খুলতে বলা হলে তা খুলে দেয়া হয়। তাঁর সাথে প্রথম আকাশের ফেরেশতাগণ দ্বিতীয় আকাশ পর্যন্ত গমণ করেন। এভাবেই এক এক করে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যান। তখন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমার বান্দার নামটি ইল্লিয়ীনের তালিকায় লিপিবদ্ধ করে দাও। অতঃপর তাকে নিয়ে যমিনে ফিরে যাও। কেননা আমি তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। মাটির মধ্যেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং সেখান থেকেই তাকে পুনরায় জীবিত করব। তখন কবরে তার আত্মা ফেরত দেয়া হয়। ওখানে দুজন ফেরেশতা আগমণ করেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ তোমার প্রতিপালক কে? তিনি উত্তরে বলেনঃ আমার প্রতিপালক হচ্ছেন আল্লাহ। আবার জিজ্ঞেস করেনঃ দুনিয়াতে তোমার দ্বীন কি ছিল? তিনি উত্তর দেনঃ আমার দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। পুনরায় তাকে প্রশ্ন করেনঃ তোমাদের কাছে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল তিনি কে? জবাবে তিনি বলেনঃ তিনি হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। তখন আকাশ থেকে মহান আল্লাহ ঘোষণা করতে থাকেনঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে। তাঁর জন্যে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোষাক পরিয়ে দাও। আর তাঁর জন্যে জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও, যেন সে জান্নাতের বাতাস ও সুঘ্রাণ পেতে পারে। তার কবরটি দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেয়া হয়। একজন সুন্দর আকৃতি ও উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট লোক উত্তম পোষাক পরিহিত হয়ে এবং সুঘ্রাণে সুরভিত অবস্থায় তার কাছে আগমণ করেন এবং বলেনঃ তুমি খুশী হয়ে যাও। তোমার সাথে যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা আজ পূর্ণ করা হবে। মুমিন ব্যক্তি লোকটিকে জিজ্ঞেস করেনঃ আপনি কে? তিনি বলেন, আমি তোমার সৎ আমল। তখন মুমিন ব্যক্তি বলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি এখনই কিয়ামত সংঘটিত করুন। আমি আমার পরিবারের সাথে মিলিত হবো। তখন তাকে বলা হয় তুমি এখানে আরামে ও স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে থাক। তোমার কোন চিন্তা ও ভয় নেই।
ছোট খাট ওয়াজের মাঝেই শোনা যেতে লাগলো- ভাই লাইন সোজা করেন। ভাই একটু ডাইনে চাপেন। পেছনে যান...ইত্যাদি। জানাজার নামাজ শুরু হয়ে গেল। নামাজ শেষ করেই লাশ নিয়ে যাওয়া হলো আজিমপুর গোরস্থানে। আগেই কবর খোঁড়া ছিল। সেখানে গিয়ে দাফনের জন্য লাশটি যখন মাটিতে রাখা হবে জব্বার হুজুর বললেন-আপনারা হাতে মাটি নিয়ে বলেনঃ"মেনহা খালাকনা কুম--ফিহা নুয়ি দুকুম--মেনহা নোখরে জুকুম তারাতান উখরা" অর্থঃ"এই মাটি হতে তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই মাটিতেই তোমাকে শোয়ানো হলো। এই মাটি হতেই পুণরায় তোমাকে উঠানো হবে।" আবীর জব্বার হুজুরের কথা মতো মাটি নিয়ে সাথে সাথে বললো এবং মাটি কবরে ফেলতে লাগলো। ওর দেখাদেখি সোহেলও মাটি নিয়ে ফেলতে লাগলো। এই প্রথম বন্ধুটির জন্য তার প্রাণ কেঁদে উঠলো। কান্না এসে ভীড় করতে লাগলো তার মনের মাঝে। চোখের পানি যতটা সম্ভব আত্নগোপন করার চেষ্টা করলো। দাফন শেষ করে সবাই মোনাজাত ধরলো।
মোনাজাত শেষ করেই সবাই বাড়ীর পথ ধরলো।
রুমে ঢুকেই আবীর তার মোবাইলটিকে একটি আছাড় দিয়ে ভেংগে ফেললো। এই মোবাইলের জন্যই আজ তার শ্বেতার সাথে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আবার পরক্ষণেই মনে হলো-মোবাইলটিতো ভাইব্রেশনে ছিল। সেই তো সাইলেন্ট করে রেখেছিল। তাহলে মোবাইলটি ভেংগে ফেলার অর্থ কি? শ্বেতার সাথে ঘুরতে গেলেতো খোকনের জানাজায় যেতে পারতো না। মোবাইলটি ভাংগার আওয়াজ শুনে সোহেল দ্রুত এসে জিগ্যেস করলো
-কিরে কি সব পাগলামি শুরু করছিস?
-ধুর। কথা বলিস না। ভাললাগছে না।
-তোর কান্ড কারখানা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি যে করিস তুই?
সোহেল ভাবছে হয়তো খোকন মারা যাওয়ায় খুব শক পেয়েছে। তাই হয়তো এমন করছে। তাছাড়া তারও মন ভালো নেই। আর বিরক্ত করলো না। আবীরকে তার মতো ছেড়ে দিয়ে সে চলে গেল ওয়াস রুমে।
ফান্টুস চা খাওয়ায় এম্মনিতেই তার মাথা ঘুরছে। তার উপর আবার খোকনের মৃত্যূ.... সব মিলিয়ে আজকের দিনটি তার কাছে মনে হচ্ছে কবরের আযাব যেন তার উপর দিয়েই গিয়েছে। হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে।ঘুম আসছে দুচোখ ভেংগে। ঘুমের আবেশেই  আবীর খেয়াল করলো তার  মাথায় তখন ঢুকে গেছে হুজুরের কথা-বার্তা। জব্বার হুজুরের দোয়া করার আয়াতসমুহ। ঘুমের আবেশেই সে মনে মনে বলতে লাগলো-


মেনহা খালাকনা কুম--ফিহা নুয়ি দুকুম--মেনহা নোখরে জুকুম তারাতান উখরা”।

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

মোবাইলফোন ও আমরা













-হ্যালো দোস্ত, তুই কই?
-আরে আমিতো এখন মগবাজার।তুই কই?
-ধুর ব্যাডা।তরে কইলাম আমি আমার এহানে আয় আর তুই...
বাসে বসেছিলাম।পাশের সিটে বসা ইয়ং জেনারেশনের প্রতিনিধিত্বকারী একটি স্মার্ট (?) ছেলে। হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে তার বন্ধুর সাথে কথা বলছে। কথার ধরণ শুনেই বুঝা যাচ্ছে তার খুবই কাছের বন্ধু।অর্থাৎ বোসোম ফ্রেন্ড।বাস্তব জীবনে যে বিষয়টি এখন ওতোপ্রেতভাবে জড়িত, সেটি হচ্ছে মোবাইল ফোন। সুখে-দুঃখে সমানভাবে জড়িত এ বিশেষ জিনিসটি আমাদের জীবনে এখন অংগাংগীভাবে জড়িয়ে আছে। কখনো সুখের কখনো বা দুঃখের। সব সময়ের এ বস্ত্তুটি আমাদের শেখায় - সত্য মিথ্যার অনেক গল্প। কথার খৈ কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তা বলা নিতান্তই বাতুলতা। যেমন ধরুণ প্রেমিক প্রেমিকার কথা। কিংবা কোন প্রবাসীর স্ত্রীর কথা । অথবা মায়ের সাথে তার সন্তানের কথা। কথা যেমনই হোক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এ যন্ত্রটির তুলনা অপরিসীম।
-হ্যালো, কে বলছেন ভাই? হ্যালো...হ্যালো...
লোকটির হ্যালো হ্যালো শুনতে শুনতে বিরক্ত ধরে গেল। কি করবো? কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। একদিকে বাসের ইন্ঞ্জিনের শব্দ, তার উপর আবার মোবাইলের উৎপাত। সকালে এম্মনিতেই অনেক কষ্ট করে বাসে উঠতে পেরেছি। অফিসের সময় বাসে ওঠা কি যে কষ্টকর আর তার উপর যদি থাকে ভীড়, তাহলে মোবাইলের রিংটোনের আ্ওয়াজও হয়ে যায় বিষবৎ সমতুল্য। এমন একটি ব্যাপার নাও বলা যায় না। কারণ আমারো মোবাইল আছে। তাকে যদি না করি আর আমারটা যদি এসে যায় তাহলেতো মুস্কিল।বিরক্তি চেপে কথা না শুনতে চাইলেও কিছু কথা নিজের অজান্তেই শুনতে হচ্ছে। সিটের পাশে হাত দিয়ে বালিশ বানিয়ে মাথাটা নেয়ালাম। চোখ বুজে থাকার চেষ্টা করলাম যাতে একটু ঘুমাতে পারি। কারণ কাজের চাপে আর সকালে অফিসে যাবার চিন্তায় এম্মনিতেই ঘুম চলে যায়। জীবন যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই অর্ধেকটা জীবন চলে যায় ভেজাল দ্রব্যাদি আহার করে।  তার উপর খাবারে অনিয়ম। শ্বেতা কতে করে বলেছে-তুমি দুপুরের খাবারটা নিয়ে যেও।
শ্বেতাকে কি করে বুঝাই সকালের অফিস যাত্রাকালে একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বাসে ওঠা কতো যন্ত্রণা। তার উপর থাকে নানান ফাইলপত্র। এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম জানি না। ঘুম ভাংলো কন্টাকটরের ডাকে।
স্যার ভাড়া দেন। পকেট হাতড়িয়ে ভাড়া দিলাম। ভাড়া দেয়ার পরই আবার যথারীতি অলস বদনে শুয়ে পড়লাম। মাথায় কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছে। চোখ বুজে থাকলাম। আর এরই মধ্যে স্বপ্নে বিভোর হলাম। দেখলাম একটি বটগাছের বেদীর উপর একটা স্টেজ করা। সেই স্টেজে গান গাইছে...
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি
কোন্ মিস্ত্রি বানাইয়াছে....
-কি মিয়া কি ভাবতাছো?
-না। দেখছি।
-কি দেখতাছো?
পাগল কিছিমের একটা লোক আমার কাছে এসে জিগ্যেস করলো। আজকাল কি হয়েছে কে জানে। যত পাগল ছাগলের সাথে দেখা হয়। পাগলা পাগলা কথা বলে। মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝি না।
-মোবাইল দেকছো?  মোবাইল? লোকটি নিজের দেহটি দেখিয়ে বললো।
-এইডা হইলো আমার মোবাইল আর এইডা হইলো তোমার মোবাইল। লোকটি আমার দেহে হাত দিয়ে বললো।
-এই মোবাইলে কল দিলেই সাঁইজির সাথে কথা বলা যায়। শোনা যায় সাঁইজির বাণী।মাজে মাজে মেসেজ পাডায়। বুছছো মিয়া...সাঁইজির নাম্বার জানো? লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললো। অামি সম্মোহিত হয়ে বললাম
-না। না কথাটি বলার সাথে সাথে আমাকে পেয়ে বসলো কিছু অনাকাংখিত ঘটনা। আমি যেন দেখতে পেলাম আমি নিজেই একটি মোবাইল। লোকটি বললো
-কি ভাবতাছো মিয়া? ভালা কইরা তাকাও তোমার দেহডার দিকে। অথচ আর্শ্চায্য হলেও সত্য এ যন্ত্রটির সাথে আপন দেহের যোগাযোগের একটি অবিচ্ছেদ্য সর্ম্পক এবং মিল রয়েছে। লোকটি আবার বলতে শুরু করেছে
-তুমি যদি এডারে ভাংগ তাইলে কি দেকবা? একখান বেটারী,একখান ছিম,কেছিং....

লোকটি বলতে শুরু করেছে আর আমি তার সাথে মিলাতে শুরু করেছি একটি ব্যাটারী, একটি সীম, একটি কেসিং, মনিটর বা ডিসপ্লেবোর্ড, কি প্যাড, ক্যামেরা, রেডিও এফ এম এবং এমপি থ্রি বা ফোর। এছাড়া আছে মাদারবোর্ড আর আছে কিছু কারিগরী নৈপুণ্যেভরপুর ইলেকট্রনিক্স আইটেম।
-এই যে ব্যাটারি দেকতাছো এইডা হইলো তোমার জীবন শক্তি। আর কেছিং হইল তোমার দেহখানা। বাহ! বাহ! কি আজব খেলা তার। কতো রং বেরংয়ের কেছিংরে...ওই মিয়া এই যে চোখ দুইডা দেখতাছো এইডা অইলো গিয়া তুমার ক্যামেরা। আর এইডা অইলো গিয়া তুমার বোর্ড (মাদারবোর্ড দেখিয়ে )এইযে কতো বাহারি রংচঙ দিয়া আঁকিবুকি মারা।
এইডাই অইলো আসল। বোজপার পারছোনি মিয়া...
তোমারে বুঝাইবার তরে এই সকল পয়দা করে।
সকল রুপই তুচ্ছ জান তার রুপেরই ছামনা।
লোকটি গুণগুনিয়ে গান শুরু করে দিল। আমি অবাক হয়ে শুনছি লোকটির গানের কথা। কেমন যেন একটা মায়াবী কন্ঠ অামাকে টানছে।গান গাওয়া শেষ হতেই লোকটি বলে উঠলো
-তোমারে মিয়া গান শুনাইলাম। মোবাইলে গান বাজে না হেই গান। আহা রে কে বোঝে তার খেলা। লোকটি আবার বলা শুরু করলো
-এই মোবাইলে ঠিকমতো নাম্বার দিয়া ডায়াল করলেই তাঁর সাথে যোগাযোগ করা যায়। তাঁর কথা শোনা যায়।আর নাম্বার না জাইন্যা আনতাজে রিং ঘুরাইলে কি আর যোগ অইবো? তার নাম্বার জানো মিয়া...
-না। আমি কিভাবে জানবো?
একথা শুনতেই লোকটি অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। আরে মিয়া তার নম্বর জানো না তো আমার কাছে আইছো ক্যা? লোকটি আবার অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো।তার হাসির শব্দে হটাৎ আমার ঘুম ভেংগে গেল। চেয়ে দেখি আমার পাশে বসা সেই স্মার্ট ছেলেটি তার লাভারের সাথে কথা বলছে। আর মাঝে মাঝে হাসছে। সেই হাসির শব্দই আমার কানে আসছিল।তাহলে সেই লোকটি কোথায় গেল? যে আমাকে মোবাইলের দর্শন বুঝাচ্ছিল?
পকেট থেকে মোবাইলটি হাতড়িযে বের করলাম। ভালো ভাবে দেখতে লাগলাম। আর মেলাতে শুরু করলাম স্বপ্নে পাওয়া সেই দর্শনটি যেটি কিছুক্ষণ আগেই দেখেছিলাম। মুখে এক টুকরো হাসি এসে গেল। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।
বাসটি চলছে ধীর লয়ে। মুক্ত আকাশে কিছু পাখি উড়াউড়ি করছিল। মনে মনে জিগ্যাসা করলাম - হে বিধাতা তোমার নাম্বার কতো?