পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

দিবালোকের স্বপ্ন


চৈত্রের খরতাপে প্রচন্ড পানির পিপাসা পায় করিম শেখের তিনি আশে পাশে ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখলেন কোন নলকুপ বা পুকুর দেখা যায় কিনা? কিন্ত্তু তিনি যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন তাকে রাস্তা বলা ভুল হবে জমির আলের উপর দিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন দুধারে ধানের ক্ষেত তার মাঝ দিয়ে রাস্তা তিনি ভেবেছিলেন সেই রাস্তা দিয়ে আড়াআড়ি হেঁটে গেলে তাড়াতাড়ি বাড়ী পৌঁছতে পারবেন কিন্ত্তু তার সিধান্ত যে ভুল ছিল তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন পিপাসায় কাতর করিম শেখ দ্রুত পা চালালেন যাতে কোন ছায়াঘেরা পরিবেশে যেতে পারেন তিনি তার কাঁধের বোঝাটা টেনে ধরে এদিক ওদিক করে সরিয়ে রাখলেন হাতের দোতারাটা শক্ত করে ধরে দ্রুত পা পালালেন ঘেমে অস্থির করিম শেখ সামনের দিকে দেখতে পেলেন দুরে একটি একটি বাগানের মতো দেখা যাচ্ছে মনে মনে প্রশান্তির আশায় তিনি দ্রুতবেগে হাঁটা শুরু করলেন

হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে তিনি সেই গাছ-গাছালি ঘেরা বাগানে এসে উপস্থিত হলেন। ভর দুপুরে বাগানে কাউকেই তিনি দেখতে পেলেন না। তিনি তার ঝোলাটা রেখে বিশ্রামের আশায় আশ্রয় খুঁজতে লাগলেন। কাছেই দেখতে পেলেন একটি উঁচু গাছের মাচা। হয়তো কেউ মাচা পেতে রেখেছিল। তিনি আগ পাশ না ভেবে সেই মাচায় গিয়ে বসলেন। গায়ের জামাটা খুলে ফেললেন। ঘামে জর্জরিত জামাটি তিনি মেলে ধরলেন শুকানের আশায়। তারপর তিনি সেখান থেকে নেমে পানির খোঁজ করতে লাগলেন। অদুরেই দেখতে পেলেন পুকুর ঘাট। সরাসরি তিনি সেই পুকুরে নেমে পড়লেন। আজলা ভরে পান করলেন পানি। চোখে মুখে ভালোভাবে ছিটিয়ে দিলেন। পেট ভরে পানি খেলেন। তারপর তিনি সেখান থেকে উঠে এসে সেই মাচার দিকে গেলেন। সেখানে আয়েশের ভংগিতে বসে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। 

পুরো পরিবেশটি গাছ গাছালিতে ভরপুর। তিনি শুনতে পেলেন পাখিদের কিচির মিচির। নানান জাতের পাখির সমাবেশ যেন সেই বাগানটিকে ঘিরে রেখেছে। গা খালি থাকায় হাল্কা বাতাসের পরশ পেয়ে তিনি যেন স্বর্গীয় অনুভুতি পেলেন। দোতারাটা পাশে রেখে তিনি বিশ্রাম নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তা টেরই পেলেন না। সেই ঘুমের মধ্যেই তিনি তার সাঁইজিকে দেখতে পেলেন। তার সাঁইজি তাকে বলছেনঃ

-কি মিয়া? কেমন আছো?

-জ্বী বাবা ভালো আছি। আপনার দয়ায়। তিনি সাঁইজিকে প্রণাম করলেন

- তোর খুব কষ্ট হচ্ছে রে বাজান। গতকাল সারা রাত গান গেয়েছিস। এত দুরের পথ তুই হেঁটে আসছিস। তোকে দেখেতো আমার খুব মায়া হচ্ছেরে বাজান

-দয়াল আপনার দয়া পেলে এরচেয়েও কষ্ট করতে রাজি আছি

-আমি জানিরে ব্যাটা। তাইতো তোকে আলাদা করে রেখেছি। একান্ত আপন করে রেখেছি। তুই আমার কাছে এতটাই আপন যে তোকে বিপদে আপদে দেখলেই আমি তোর পাশে এসে দাঁড়াই

-দয়াল সেটাতো আপনার কৃপা। আপনাকে কাছে পেলে আমি সব দুঃখ ভুলে যাই

-কাল রাতে যে গানটা গেয়েছিস তার মানে কি তুই বুজছে পেরেছিস রে বাজান? খালি গান গাইলেই হয় না। গানের কথা সুর সবই ভাবে তৈরী হয়। সেই ভাব হৃদয়ে ধারণ করে সেটা বুঝতে হয়। তবেই না তোর মনের মানুষ জেগে উঠবে। তাকে জাগাতে দরকার হয় সাধনা। কঠোর থেকে কঠোর সাধনা করতে হতে হয়রে বোকা

-বাজান চেষ্টাতো করি। আপনি বলেছিলেন ব্রক্ষচর্য করতে। সেটাওতো করছি।

-বাজান ব্রক্ষচর্য বলতে কি বুঝায় তা আগে বুঝতে চেষ্টা করো। জোর খাঁটিয়ে ব্রক্ষচর্য রক্ষা হয় না। পরম ব্রক্ষ যে শক্তি তোমাকে দান করেছেন তার যথাযথ প্রয়োগই হচ্ছে ব্রক্ষচর্য। শোন বাজান-পুরুষ দেহে পিতৃশক্তি বীর্য আছে। রমনী দেহে মাতৃ শক্তি রজঃ আছে। পিতৃশক্তি মাতৃশক্তি সঙ্গে মিলন হয়ে পূর্ণ হতে চায়, আর মাতৃশক্তি পিতৃশক্তির সহিত মিলন হতে চায়। এই কারনে পুরুষ মেয়ের জন্য পাগল এবং মেয়ে পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। অতএব জোর করে অকর্ষনের হাত হতে রক্ষা পাবার কোন উপায় নেই। সদ্ গুরুর নিকট হতে বজ্রোলি সাধন শিক্ষা করে স্ত্রীর নিকট হতে ( স্বামী ) পুরুষকে সেই রজঃ শক্তি আহরণ করিয়া রজঃ বীর্যে মিলন ঘটাইতে পারলে আর আকুলি বিকুলি থাকে না। তখনই হয় পূর্ণ সাধনার সুযোগ। ব্রহ্মচর্যের প্রকৃত অর্থ ব্রহ্মে বিচরন করা। জোর করে শুধু বীর্য রক্ষন করলেও প্রকৃত ব্রহ্মচারী হওয়া যায় না

-বাজান এখন আমার কি করা উচিত?

-তোমার উচিত হচ্ছে তোমার সাধন সংগী লওয়া।  তারপর তোমারে যে মতে সাধন দিচ্ছি সেই মতে সাধন করা। আর তোমার ভেতর যে ভাব শক্তি আছে তা রক্ষা করা। ভাবের ভাবুক না হইলে এই ভব সংসারের ভাব বোঝা যায় না। শুন ভব রুপ সাগরকে যিনি পাড়ি দিয়েছেন অর্থাৎ ছেদ করতে পেরেছেন তিনিই ভগবান। ভব+বান। 

-বাজান অামিতো সেই ভাবেরই ভাবুক হয়ে এই জগৎসংসারে আমার ভাবের কথা প্রচার করতে চাই। আমার হাতে যেই যন্ত্রটা দিয়েছেন সেটা নিয়েইতো ভাব রচনা করি

-তোমার হাতে যেই যন্ত্রটা তুমি দেখছো সেটার অর্থই তো তুমি বুঝ নাই মিয়া। তোমার হাতে যে যন্ত্রটা আছে সেটাকে বলা হয় দোতারা। দো মানে দুই আর তারা মানে আলো বা দুরের আলোকিত বস্তু। কিন্ত্তু সেটার মধ্যে তার আছে তিনটা। উদারা মুদারা তারা। উদারা বাম দিকে মুদারা মাঝখানে আর তারা ডানদিকে। সেইখানে আছে সপ্ত সুর। সা রে গা মা পা ধা নি। এর অর্থ গোপন তত্ত্বে বর্ণিত আছে। জগৎ সংসার এই সপ্তসুরে বাঁধা। এই যন্ত্রটার দিকে ভাল করে খেয়াল করে দ্যাখো। নিচের দিকটা গোলাকার হয়ে উপরের দিকে সরু লম্বা নলের মতো হয়েছে। এর মানে কি? জান?

-বাজান আমারে না জানালে আমি জানবো কেমনে? আপনিইতো পতিত পাবন

-নিচের দিকটা হচ্ছে মায়ের জঠর। তার উপর দিকটা সরু নলের মতো। সেই নলের মধ্যে দিয়েই এই সপ্তসুরের আনা-জানা। সাঁই এই পথেই আনা জানা করে। কথা হয় ভাবের সনে। সেই ভাবের সাথে তাল মিলাতে পারলে সেই তালেই জগৎ মাতোয়ারা হয়

-সাঁইজি আপনিই আমার পতিত পাবন। আমারে সেই গানের মানে বইল্যা দেন

-কোনটার অর্থ জানতে চাসরে বোকা?

-নারীর ওই সিন্ধুমাঝে ভানুর এক কিরণ সাজে
তাহার মধ্যে প্রেমের বাঁচা রে।
মামুন বলে চল সখী গহীন জলে
শুদ্ধ প্রেম কেনাবেচা করি লো কিশোরী। - এটার মানে সাঁইজি

-তবে শোনরে বোকা।

এই নারী হল সাঁইজীর কাননের সেই কামিনী। যাকে দিয়ে সাঁইজী সৃষ্টি সম্ভব করে তুলেছেন। সৃষ্টির পর সেই নারীর সমুদ্রে ভানুর কিরণ (সূর্যের আলো) প্রতিফলিত হয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছে। সেই বিস্ময়কর সুন্দর নারীর সমুদ্রের ভিতর প্রেমের অধিষ্ঠান। তাইই তো হওয়ার কথা। নারীর তো প্রেমের আধার, উৎস। মামুন নদীয়া আরও বলছেন, সেই নারী-সমুদ্রের গহীন অতলে রয়েছে সত্য। শিব (শুভ অর্থে) এবং সুন্দর। যে সত্য উপলব্দির জন্য আমি ঘর ছেড়েছি, সংসার তুচ্ছ করেছি কিন্তু কি লাভ হল? কি শিক্ষা হল? কি দীক্ষা হল? পথের শেষে আমি কি পেলাম? সে প্রসঙ্গে মামুন নদীয়া বলছেন-মামুন নদীয়া বলে চল সখী গহীন জলে/শুদ্ধ প্রেম কেনাবেচা করি লো কিশোরী। এই শুদ্ধ প্রেমই তো জীবনের পরম পাথেয়। জীবনের মূল। আবার ফিরে যাই অস্টম শতকের তান্ত্রিক বৌদ্ধদের চর্যার সেই পদে- তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে/ বোধি কি লভ ভই প্রণ বি দেঁহে। ... স্বয়ং ঈশ্বর যে নারীর মাধ্যমে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই পরমতত্ত্ব লাভের উদ্দেশ্যে সেই নারীর ভজনা করা-মাতৃতান্ত্রিক বাংলার এইই পরম দীক্ষা। যে কারণে লালন বলেছেন, নারী হও। নারী ভজ। লালনের গুরু শ্রীচৈতন্যদেব বলেছেন, ‘আমার অন্তরে রাধা বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।দশম শতাব্দীর বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামের অতীশ দীপঙ্কর বলেছেন, জগতের সৃষ্টির মূলে রয়েছে বজ্র। বজ্র হল নারীরই এক অনিবার্য গুণ

- মিয়া হুইয়া হুইয়া কি কইতাছেন। যত্ত সব পাগল ছাগলের কারবার। ওডেন মিয়া। খালি গায়ে হুইয়্যা গেনার প্যাচাল পাড়তাছে। যান মিয়া

লোকটির আচরণে যথেষ্ট কষ্ট পেলেন করিম শেখ। কিন্ত্তু তিনি কি বলবেন? সাঁইজিতো বলেছেন আরো কঠোর সাধনা করতে হবে। লোক জনের গালাগালাজ শোনা অনেকাংশেই ব্যথিত করে। সেই ব্যথিত চিত্তে করিম শেখ তার জামা পড়ে নিলেন। হাতে দোতারাটা নিয়ে বোচকাটা কাঁধে উঠিয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ীর পথ ধরলেনঃ-
সমন দমন হবে যাতেরে, হরি বল বাহু তুলে।
হরি নাম কর সার ভব সিন্ধু হবে পার
রবিসূত দূত যারা পালাইবে ত্রাসেরে।।
শুনিয়া গোবিন্দ রব পালাবে পাষণ্ডি সব
সিংহ রব শুনে যেমন করি পলায় বনেরে।
ভাই বন্ধু পরিবার কেবা সঙ্গে যাবে কার
যারে বল আপন আপন সেতো আপন নয়রে।।
জীবে দেখি দুরাশয় কলি যুগে দয়াময়
দয়াময় নাম সুধা ঘরে ঘরে যাচের