পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৯ জুন, ২০১৮

ময়ুরের সৌন্দর্য্য এবং সত্য-উম্মোাচন

হেকায়াতঃ
একটি বনের মনোরম পরিবেশে একজোড়া ময়ুর-ময়ুরী বাস করতো। বনের গাছ-গাছালি এবং পাখ-পাখালিদের কল-কাকলিতে মুখরিত থাকতো বনটি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এলে বৃষ্টির কলতানে ময়ুর-ময়ুরীটি বৃষ্টির রিমিঝিমি তালে পেখম তুলে নাচতো। নাচের তালে তালে এবং বৃষ্টি পতনের ছন্দে ময়ুর-ময়ুরীটির হুঁশ জ্ঞান থাকতো না যে তাদের পেখম হতে পালক খসে পড়ছে। সেই পালক তুলে নেয়ার জন্য বনের অন্যান্য পাখিদের মাঝে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেত।
একদিন একটি তোতার হাতে পালক দেখে টিয়া জানতে চাইলোঃ
-তোমার হাতে ওটা কি?

-এটা ময়ুরের পালক। তোতা বললো।

-পালক? এটা দিয়ে কি করো?

-আমি এটা হাতে নিয়ে সেইদিনটির কথা চিন্তা করি, যেদিন তার অপার সৌন্দর্য্য দেখেছিলাম। যে সৌন্দর্য্য আমাকে বিমোহিত করেছিল...

বয়েতঃ
তেরি চেহেরা.ই.আনোয়ার এক দিব্যজ্যোতিঃ
হৃদয়ে চালিয়েছে প্রেমের ছুরি,হরণ করেছে এই অন্তর।
প্রেমের ধারা বইছে অবিরত ঝরেছে কিছু লহু
সর্বদাই করছে এক যিকর.আল্লাহু আল্লাহু আকবর।।
হুসনে এ জলওয়া চলছে অবিরত
আয়নামা তুয়াল্লু ফাছাম্মাা ওয়াজহুল্লায়..
দেখেও দেখে না কোন মু্ন্সি মোল্লায়।।
কিতনে আজিব বাত হ্যায় ইয়ে, কুল্লি শাইইন মুহিত
ম্যায় ভি নেহী জুদা..হই যদি তোমার প্রেমে শহীদ।।

তোতার মুখে ঐরুপ প্রশংসা শুনে টিয়ার সাধ হলো সে সেই বনে যাবে এবং ময়ুরের পেখম তোলার অপরুপ দৃশ্যটি অবলোকন করবে। যথারীতি সে এই কথা অন্যান্য পাখিদের জানালো। তারা টিয়ার মুখে প্রশংসা শুনে সেই সত্য দেখার জন্য বনের ভেতর প্রবেশ করলো এবং দেখতে পেল সত্য-সত্যই একজোড়া ময়ুর-ময়ুরী হাঁটাহাঁটি করছে। কিন্ত্তু তাদের কোন পেখম দেখতে পেল না। তাদের কেমন যেন শ্রীহীন দেখাচ্ছে। এছাড়া তারা পেল না টিয়ার মুখে শোনা বর্ণনার সাথে কোন মিল। তারা টিয়াকে যথারীতি তিরষ্কার করা শুরু করলো। তাদের তিরষ্কার শুনে টিয়াটিও দুঃখ পেল। সে ছুটে গেল তোতার কাছে। গিয়ে দেখলো তোতা তখনো সেই পালকটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে এবং মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে সেই দৃশ্যটি দেখার চেষ্টা করছে। সে তোতাকে বললোঃ
-মিথ্যুক। বন্ধ কর তোমার ঐ ধাপ্পাবাজি। তোমার কথা শুনে আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম একজোড়া বিবর্ণ ময়ুর-ময়ুরী হাঁটাহাঁটি করছে। আমার সাথে অন্যান্যরাও ছিল। তারাও তা দেখেছে।
নির্বিকার চিত্তে তোতাটি বললোঃ

-বন্ধু, মিথ্যা বলিনি। আমার সাথে অন্যান্যরাও দেখেছে। আমি যে সময় ঐস্থানে গিয়েছিলাম সে সময় বৃষ্টি হয়েছিল আর তুমি যে সময় গিয়েছিলে তখন কোন বৃষ্টি ছিল না। ময়ুরের সৌর্ন্দয্য দেখতে হলে চাই বৃষ্টি, চাই পরিবেশ। চাই দেখার জন্য দৃষ্টি শক্তি। চাই সেই শক্তি অন্তরে ধারণ করার ক্ষমতা...

তোমারতো তার কোনটাই হয়নি। তুমি গিয়েছো অসময়ে...তুমি কিভাবে আমার কথার সত্যতা যাচাই করবে...তুমিতো জানোই না কিভাবে সেই সৌন্দর্য্য ধারণ করতে হয়? তাহলে কি সত্য তুমি উম্মোাচিত করবে? যে সত্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে পালকটি এখনো আমার হাতে আছে?


উপদেশঃ

মহান প্রভুর দর্শন লাভ করতে হলে তার দৃষ্টি দিয়েই তাঁকে দেখতে হবে। তার জ্ঞান দিয়েই তাকে জানতে হবে। জ্ঞানের এই দৃষ্টি যদি সঠিক না হয়, তাহলে তাকেও জানা সম্ভব নয়। এই জন্যই বলা হয়েছেঃ ইবাদতের মাধ্যমে তিনি বান্দার হাত হয়ে যান। যা দ্বারা তিনি ধরেন। তিনি তার চোখ হয়ে যান যা দ্বারা তিনি দেখেন। পা হয়ে যান, যা দ্বারা তিনিই চলেন। মুলতঃ তিনিই তার হাত দিয়েই ধরেন। তার চোখ দিয়েই তিনি দেখেন। তার পা দিয়েই তিনি চলেন। যদিও সাধারণ্যের দৃষ্টি শক্তি এত তীক্ষ্ম নয় যে সে তার দৃষ্টি শক্তি দিয়ে বস্তুর গভীরতা ভেদ করে তাকে দেখতে পাবে। এইটাই হচ্ছে হিজাব। তাই
তার দয়া ব্যতীত কেউ তাকে দেখে না। জানে না।
সুতরাং মহান প্রভুর সান্নিধ্য পেতে হলে তারই মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা তারই নির্দেশিত পথে চললেই কেবল দেখা সম্ভব।
#স্বপন #চিশতী

সোমবার, ২৫ জুন, ২০১৮

বিবর্ণ ময়ুরের গল্প

















হোকায়েতঃ
-----------
এক বনে বাস করতো একটি ময়ুর। ময়ুরটি তার বন কাননে বেশ ভালোই ছিল। নাচতো পেখম তুলে। যখন ময়ুরটি পেখম তুলে নাচতো তখন চারদিকে তার রুপের আভা ছড়িয়ে পরতো। বৃষ্টির রিনিঝিনির তালে তালে সে যখন রুমঝুম রুমঝুম করে নাচতো তখন চারদিক থেকে পশু পাখিরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। 

একদিন ময়ুরটি একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো। রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির ফলে ময়ুরটির দেহ হতে পালকগুলো খসে খসে পড়ে যেতে লাগলো। ফলে এক সময় সে বিবর্ণ হয়ে পড়লো। তার এই বিবর্ণরুপ দেখে আশে পাশের সমস্ত পাখিরা এমন কি তার সমগোত্রীয় ময়ুররাও তাকে অবজ্ঞা করতে লাগলো। এটা দেখে সে বেশ বিষর্ম হলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে গভীর অনুতাপের সাথে স্র্রষ্টার দয়া কামনা করলো। 

দয়ার সাগর মহান স্র্রষ্টা তার প্রতি সদয় হলেন। দৈববাণী হলোঃ

"তুমি দুঃখিত হইও না। চিন্তিত হইও না। ধৈর্য্যধারণ কর। জেনে রাখো, ধৈর্য্যশীলদের সাথে স্র্রষ্টা অবস্থান করেন। তোমাকে  রোগ দিয়েছেন যিনি, সারিয়েও তুলবেনও তিনি।"

দৈববাণী শুনে ময়ুরটি বেশ আনন্দিত হলো। পরদিন সে যখন তার সেই বাগানে প্রবেশ করলো, তখন যথারীতি পাখিরা ঠাট্রা বিদ্রুপ করা শুরু করে দিল। 

কাক বললোঃ

-দ্যাখো দ্যাখো ঐ যে, একটা কুৎসিত ময়ুর আসছে। ওর গা থেকে দুর্গন্ধ আসছে..ছিঃ ছিঃ...আমি দেখতে কালো। আমি ময়লা আবর্জনা খাই। সেখানেই পড়ে থাকি অথচ আমার গা থেকে ওর মতো পঁচা দুর্গন্ধ আসে না...

তোতা বললোঃ

- যা বলেছো ভাই...এমন কুৎসিত প্রাণী আমি এই জগতে কোথাও দেখিনি..ওর চেয়ে আমার ঝুটিটাও সুন্দর।

টিয়া বললোঃ

-ভাই তোতা তা যা বলেছো। আমার এই রাঙা ঠোটটিও ওর চেয়ে সুন্দর।

তাদের এই কথপোকথনে অন্যান্য পাখিরাও হাসাহাসি করতে লাগলো। আর তার সমগোত্রীয় ময়ুররা সিধান্ত নিল তাকে তাদের সমাজ থেকে বের করে দেবে। তারা বললোঃ

-তোর মতো এমন কুৎসিত চেহেরার ময়ুর থাকলে আমাদেরও বদনাম হবে। তুই আমাদের সমাজ থেকে বের হয়ে যা..এক্ষুণি বিদায় হ..

তারা সবাই মিলে বিবর্ণ ঐ ময়ুরটিকে বের করে দিল। 

বিবর্ণ ঐ ময়ুরটি কাদতে কাঁদতে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু তার অন্তরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো সেই দৈববাণীটি। তার বিশ্বাস ছিল সে একদিন অবশ্যই সুস্থ হবে। তখন তারই শরীর থেকে নতুন পালক গজাবে। তা হবে আরো সুন্দর এবং ঝকঝকে পরিস্কার। যাবার আগে সে তাদের উদ্দেশ্যে বলে গেল, তোমরা ভুলে যেও না আমিও তোমদের সমগোত্রীয় ময়ুর পরিবারের সদস্য। আজ আমার দুর্দিনে তোমরা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছো, সামনে এমন দিনও আসতে পারে যা আমাকে পুর্বের চেয়ে আরো সুন্দর, আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে..

সে আশ্রয় নিল আরেকটি বনে। সেই বনের পরিচ্ছন্ন আবহওয়া তার শরীরের প্রতিটি অনুরনণে প্রবেশ করায় সে দ্রুত সুস্থ হতে লাগলো। এক সময় সে সম্পুর্ণ সুস্থ হলো এবং তারই শরীর থেকে নতুন পালক গজাতে শুরু করে দিল। প্রতিটি পালক বেশ ঝকঝকে। যা পুর্বের চেয়েও সুন্দর এবং মজবুত। একসময় সে পরিপুর্ণ  ময়ুররুপেই আর্বিভুত হলো। সেদিন বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিতে নাচতে লাগলো আর গাইতে লাগলোঃ

বয়েতঃ
-------
ইন্নালাহা মা সাবেরীণ বলে ছিলে যখন
তুমিই ছিলে মোর সাথে তখন।
হে দয়াময়,
তোমার এই গুণ গান মম ছুবহান আল্লাহ
জপি তোমার নাম পরতে পরতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।।

গানের সুর ছন্দে বনটি মুখরিত হয়ে উঠলো। দুর দুরান্ত হতে সেই গান শোনার জন্য পাখিরা ছুটে আসতে শুরু করে দিল। তাদের ছুটতে দেখে ময়ুররাও তাদের পিছু নিল। তারপর তারা যা দেখলো, তাতে তাদের চোখ বিষ্ফারিত হলো। তাদের অন্তর প্রকম্পিত হলো। তারা দেখলো, তাদের চেয়েও সুন্দর ঝকেঝকে পালকগুচ্ছ নিয়ে একটি ময়ুর পেখম তুলে গান গাইছে আর নাচছে। এটি আর কেউ নয়। সেই বিবর্ণ হওয়া ময়ুরটি।


 উপদেশঃ
---------
 
কখনো কারো খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো প্রকার কটুক্তি করা উচিত নয়। বরং সহানুভুতি নিয়ে এগিয়ে এসে তাকে সাহায্য করা উচিত। তাকে সাহস দিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করা উচিত। যাতে সে ভেংগে না পড়ে। 

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ওয়াল আছর। ইন্নাল ইনসানা লা ফি খুছরীন। কালের শপথ! নিশ্চ য়ই প্রতিটি ইনসান ক্ষতির মধ্যে। এই ক্ষতিগ্রস্থের মধ্যে কালের প্রবাহে অনেকেই পতিত হতে পারে। আপনি জানেন না..সামনে আপনার ভবিষ্যৎ কতটুকু উজ্জ্বল...কতটুকু অনুজ্জ্বল। কাজেই একথাটি সর্বদা স্বরণ রাখা উচিতঃ ইল্লাললাহা মা সাবেরীন। নিশ্চ য়ই আল্লাহ সবরকারীদের সাথেই আছেন।

শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮

মেরাজের রাতে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াস সাল্লাম কাকে দেখতে গিয়েছিলেন?



মেরাজ বিশ্বনবী হযরত রাসুল (সাঃ) এর জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক তাৎপর্যবহ ঘটনা। রজব মাসের ২৭ তারিখ সোমবার রাত্রের শেষাংশে আমাদের দয়াল রাসুল (সাঃ) মেরাজে গিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে কোন মুসলমানের মাঝেই কোন বিতর্ক নেই। সেই মেরাজের উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিলো আল্লাহ্রাব্বুল আলামীনের দিদার লাভ। কিছুদিন আগে অনলাইনে এক ব্যক্তির মন্তব্য চোখে পড়ল। তার বক্তব্য ছিল যে মেরাজে গিয়ে রাসুল (সাঃ) আল্লাহ্কে নয় বরং জিব্রাইল ফেরেস্তাকে দেখেছিলেন। লেখাটা পরে অবাক হলাম। এতকাল জেনে আসলাম যে রাসুল (সাঃ) মেরাজে গিয়ে আল্লাহ্কে দেখেছিলেন আর এখন শুনছি যে তিনি আল্লাহ্কে দেখেননি, জিব্রাইল্কে দেখেছিলেন। আমার বাসায় বাংলা অনুবাদসহ একটি কোরআন শরীফ আছে। সেখানেও দেখলাম যে অনুবাদকারী মেরাজ সঙ্ক্রান্ত ঐসব আয়াতের অনুবাদ করার সময় জিবরাঈল ফেরেশতাকে  ইঙ্গিত করেছেন। তারপর এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম এবং অবশেষে যা জানতে পারলাম তা হলো রাসুল (সাঃ) মেরাজে গিয়ে জিবরাঈল (আঃ) কে নয় বরং স্বয়ং আল্লাহ্রাব্বুল আলামীনকেই দেখেছিলেন।

মেরাজের কিছু বিবরণ আল-কোরানের সূরা আন নাজমের প্রথম অংশে বর্ণীত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো আল্লাহ্এই সুরায় মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সরাসরিআল্লাহ্‌”এবং রাসুল (সাঃ) এই নাম দুটো উল্লেখ করেননি। আর এটাকেই বিতর্ক তৈরির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা আন নাজমের কয়েক্তি আয়াত উল্লেখ করে বিষয়টি  বিস্তারিত বললে সবার বুঝতে সুবিধা হবে।

সূরা আন-নাজমের থেকে নং আয়াতের আভিধানিক অর্থ হলোঃতাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী সত্তা। সহজাত শক্তি সম্পন্ন সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেলো, ঊর্ধ্ব দিগন্তে।  কিন্তু অনুবাদকারী অনুবাদ করতে গিয়ে লিখেছেতাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা।কিন্তু আয়াতের কোথাও ফেরেশতা অথবা জিব্রাইল (আঃ)- এই শব্দটাই নাই।

সূরা আন নাজমের থেকে নং আয়াতের আভিধানিক অর্থ হলোঃ  অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম।এই আয়াতের কোথাও সরাসরি আল্লাহ্বা রাসুল (সাঃ) কথাটা উল্লেখ নাই। কিন্তু যারা অনুবাদ করেছেন তারা অনুবাদ করার সময়অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হোল”, এইসেএর যায়গায় ব্রাকেটে লিখেছে অথবা সরাসরি লিখেছে জিব্রাইল (আঃ) আরতারএর যায়গায় লিখেছে রাসুল (সাঃ) এর কথা। এখন এই আয়াতের প্রথম অংশে যখনসেএর যায়গায় জিব্রাইল (আঃ) এর নাম লিখা হয় তখন যারা সাধারন মানুষ এবং যাদের আরবী ব্যাকরন সম্পর্কে ধারণা নেই তারা কিন্তু এটাই ধরে নিবে যে এই আয়াতের আবিধানিক অর্থেই জিব্রাইল শব্দটি এসেছে।

আবার এই সুরার ১৩-১৪ নং আয়াতে বর্ণীত হয়েছে, “নিশ্চয় তিনি তাকে আরো একবার দেখেছিলেন, সিদরাতুল-মুন্তাহার (প্রান্তীয় কুলবৃক্ষের) নিকটে।  এই আয়াতেরও আভিধানিক অর্থে কোথাও সরাসরি আল্লাহ্বা রাসুল (সাঃ) কথাটা উল্লেখ নাই। কিন্তু যারা অনুবাদ করেছেন তারা অনুবাদ করার সময়তাকে আরো একবার দেখেছিলেন”- এইতাকেএর জায়গায় অথবা পাশে ব্রাকেটে লিখেছে জিব্রাইল (আঃ) আর এভাবেই মেরাজের ঘটনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিতর্কিত করা হয়েছে।
এবার তাহলে মূল আলোচনায় আসা যাক যে রাসুল (সাঃ) মেরাজে গিয়ে আসলে কাকে দেখেছিলেন?  আল্লাহ্রাব্বুল আলামীন নাকি জিবরাঈল (আঃ)?

সূরা আন নাজমের থেকে ১০ নং আয়াতের আভিধানিক অর্থ হলোঃ  তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী সত্তা। সহজাত শক্তি সম্পন্ন সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেলো, ঊর্ধ্ব দিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হোল, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন তিনি তার বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন।

এখন দেখা যাক যে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত হাসান আল বসরী (রাঃ) কি বলেছেন। বর্ণিত হাদিসটি তফসিরের কিতাবতফসীরে হাসান বসরীএর ৫ম খণ্ডে হযরত হাসান আল বসরী (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ বাণী ““তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী সত্তা।হযরত হাসান আল বসরী (রাঃ) বলেন, যিনি স্বরূপে দৃশ্যমান হয়ে ওহী করেছিলেন তিনি ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ্তায়ালা। আর শক্তি ক্ষমতা আল্লাহ্তালারই একটি গুণ। অতঃপর হযরত হাসান আল বসরী (রাঃ) তিনবার কসম করে বলেন, অবশ্যই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মহান প্রতিপালক আল্লাহ্কে দেখেছেন।

বর্ণিত হাদিসটি তফসীরের কিতাব তফসীরে দুররে মানসুর এর ১৫ নং খণ্ডে  হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, “যখন আমাকে আকাশে সায়ের করানো হচ্ছিলো,  তখন মহামান্বিত আল্লাহ্আমার নিকটবর্তী হলেন। আর সে সময় তিনি আমার এতই নিকটবর্তী হলেন যতখানি তীর ধনুকের নিকটবর্তী হয়। অতঃপর তিনি আরও নিকটে এলেন।
বর্ণিত হাদিসটি তফসীরের কিতাবতফসীরে তাবারীর২৭ খণ্ডে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ বাণী, “অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, বাণীর মর্ম হচ্ছে-মহান প্রতিপালক আল্লাহ্রাসুল (সাঃ) এর অতি নিকটবর্তী হলেন।

এখন প্রশ্ন হলো যে আল্লাহ্রাসুল (সাঃ) এর এত নিকটবর্তী হওয়ার পরেও কি তিনি আল্লাহ্কে দেখতে পেলেন না!!

সূরা আন নাজমের ১১ থেকে ১২ নং আয়াতের আভিধানিক অর্থ হলোঃযা সে দেখেছে তার অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি। সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সাথে বিতর্ক করবে?”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “যা সে দেখেছে তার অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি।” - এই বাণীর মর্ম হচ্ছে-হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার প্রতিপালক আল্লাহ্কে দেখেছেন। [তফসীরে তাবারীর ২৭ খণ্ড]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত রাবী (রাঃ) বলেন, “যা সে দেখেছে তার অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি।” - এই বাণীর মর্ম হচ্ছে-হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার প্রতিপালক আল্লাহ্কে অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখেছেন। [তফসীরে তাবারীর ২৭ খণ্ড]

বর্ণিত হাদিসটি তফসীরের কিতাবতফসীরে দুররে মানসুরএর  ২৭ খণ্ডে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন যে, আল্লাহ্ রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, “আমি আমার মহান প্রতিপালক আল্লাহ্কে অতি উত্তম সুরতে দেখেছি।

বর্ণিত হাদিসটি তফসীরের কিতাবতফসীরে মাঝহারীএর ৯ম খণ্ডে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে সম্মানিত করেছেন বন্ধুত্ত দান করে, হযরত মুসা (আঃ) কে সম্মানিত করেছেন তার সাথে কথা বলে। আর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে সম্মানিত করেছেন আপন দর্শন দিয়ে।

সূরা আন নাজমের ১৩ থেকে ১৪ নং আয়াতের আভিধানিক অর্থ হলোঃ,  নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল, সিদরাতুল মুন্তাহার (প্রান্তীয় কুলবৃক্ষের) নিকটে।

বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাবতাফসীরে তাবারীএর ২৭ খণ্ডের  হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ বাণী, “নিশ্চয় তিনি {রাসুল (সাঃ)} তাকে (আল্লাহ্কে)  আরো একবার দেখেছিলেন, সিদরাতুল-মুন্তাহার নিকটে।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এবার তিনি স্বীয় প্রতিপালক আল্লাহ্কে আত্মার চোখ (অন্তরচক্ষু) দিয়ে দেখেছেন। আর কথা শুনে এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ্কি বলেননি যে, “দৃষ্টিসমূহ তাকে পরিবেষ্টন করতে পারেনা, যদিও তিনি সকল দৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে আছেন। কথা শুনে হযরত ইকরামা (রাঃ) বল্লেন, দেখা আর পরিবেষ্টন করার অর্থ এক নয়। তুমি কি আকাশ দেখনা? লোকটি বলল, হ্যা, দেখি। তিনি বল্লেন, তুমি কি আকাশের অন্তর্নিহিত সবকিছু কি দেখ?

বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাবতাফসীরে দুররে মানসুরএর ২৭ খণ্ডের  তিরমিযীর সুত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ বাণী, “নিশ্চয় তিনি  তাকে  আরো একবার দেখেছিলেন, সিদরাতুল-মুন্তাহার নিকটে।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, অবশ্যই হযরত রাসুল (সাঃ) মহান মহামান্বিত আল্লাহ্কে দেখেছেন।

সূরা বনী ইসরাঈলের ১ম আয়াতে আল্লাহ্বলেন, “পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে (রাসুলকে) রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত। যার চারপাশকে আমি করেছিলাম বরকতময়,আর তা এজন্য যে, আমি তাকে দেখিয়েছি  আমার নিদর্শন বা চেহারা।  নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।

এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই আয়াতের এক যায়গায়আয়াতুনশব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যার আভিধানিক অর্থ নিদর্শন। যার কারনে অনেক অনুবাদেআমি তাকে দেখিয়েছি  আমার নিদর্শনকথাটি বলা হয়েছে। কিন্তু সুফী সাধকদের মতে এই নিদর্শন বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা মুলত আল্লাহ্ পবিত্র চেহারা মোবারক।

মহান আল্লাহ্পবিত্র কোরআনে তার চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়েওয়াজহুনশব্দ ব্যবহার করে ১১ টি আয়াত নাজিল করেছেন। আরবী  ওয়াজহুনশব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চেহারা। আবার আল্লাহ্‌ “আয়াতুনশব্দ ব্যবহার করে ৩টি আয়াত নাজিল করেছেন। আরবী অভিধান আল মুঞ্জিল আয়াতুনশব্দের সমার্থক হিসেবে বলা হয়েছে আলামাতুন (নিদর্শন), ছাখসুন  ইত্যাদি। আবার আল মুরাদিফ নামক অভিধানে  ছাখসুন  এর সমার্থক হিসেবে বলা হয়েছে শরীর, অবয়ব, চেহারা। সুতরাং আয়াতুনশব্দ দ্বারা যেমন নিদর্শনকে বোঝানো হয়েছে তেমনি কিছু জায়গায় এইআয়াতুনশব্দ দ্বারা আল্লাহ্ অবয়ব বা চেহারাও বোঝানো হয়েছে। আসলে কোরআনের কোন যায়গায় কোন শব্দের কি অর্থ ব্যবহৃত হবে তা সেই সুফীসাধক মহামানবগণই ভালো বলতে পারবেন যাদের সাথে আল্লাহ্ রাসুল (সাঃ) এর যোগাযোগ আছে। যেমন মেরাজ সম্পর্কিত সূরা বনী ইসরাঈলের ১ম আয়াতে আয়াতুন বলতে আল্লাহ্তার নিজ চেহারার কথাই উল্লেখ করেছেন।

সবচেয়ে বড় কথা মেরাজের ঘটনায় দেখা যায় যে জিবরাঈল (আঃ) সিরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত রাসুল (সাঃ) এর সাথে ছিলেন। তারপর বাঁকি পথ রাসুল (সাঃ) একাই পরিভ্রমণ করতে হয়েছে যেখানে জিবরাঈল (আঃ) এর যাবার অনুমতি ছিলোনা। তাহলে এই প্রশ্ন তোলাই যায় যে আল্লাহ্ আরশে গিয়ে রাসুল (সাঃ) আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে জিবরাঈল (আঃ) কে কিভাবে দেখেন যেখানে জিবরাঈল (আঃ) উপস্থিতই ছিলেন না। যেই জিবরাঈল (আঃ) সকাল বিকাল নিজেই রাসুল (সাঃ) এর কাছে আল্লাহ্ ওহী নিয়ে ছুটে আসতেন, সেই জিবরাঈলকে দেখার জন্য রাসুল (সাঃ) নিজেই ছুটে গেলেন সাত আসমানের উপর আর এই কারনেই এই রাত এত বরকতময় হলো। তা কি হয়?

আসলে একটা স্বার্থান্বেষী মহল  বেশ কিছুদিন যাবত কৌশলে ইসলামে নানা বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দিচ্ছে এবং নানা কৌশলে বিভিন্ন বিষয়কে বিতর্কিত করছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই অপপ্রচার যে রাসুল (সাঃ) মেরাজে গিয়ে জিব্রাইল (আঃ) কে দেখেছিলেন। ইতিপূর্বে ঈদ--মিলাদুন্নবী (সাঃ) কে বেদাত হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে,  লাইলাতুল বরাতকে বিতর্কিত করা হয়েছে। এবার লাইলাতুল মেরাজের পালা। আনুষ্ঠানিক ভাবে হাদীস সংকলন শুরু হয়েছিলো রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের প্রায় ১০০ বছর পরে। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল ইয়াজিদ পন্থি উমাইয়ারা, যারা ছিল রাসুল (সাঃ) রেখে যাওয়া মোহাম্মদী ইসলামের শত্রু। তাদের শাসন আমলেই যেহেতু আনুষ্ঠানিক ভাবে হাদিস সংকলন শুরু হয় তখন বেশ কিছু জাল হাদীস ঢুকে পরে। রাসুল (সাঃ) এর বানী অন্যান্য সম্মানিত সাহাবীদের বানীকে বাদ দিয়ে চক্রান্তকারীরা সেইসব জাল হাদিসকে পুজি করে এই বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।  তবে সন্তোষজনক বিষয় হলো যে মেরাজ নিয়ে এই বিতর্ক সমাজে এখনও খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি। অনলাইনে সেই ব্যক্তির সাথে কথা বলার আগে আমি নিজেও এই বিতর্কের বিষয়ে তেমন কিছুই জানতাম না। আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য হলো নতুন করে কেও যদি মেরাজ নিয়ে এই বিতর্কের সম্মুখিন হন তাহলে যেন কেও বিভ্রান্ত না হন। পরিশেষে একটি প্রশ্ন রেখে শেষ করি। তা হলো রাসুল (সাঃ) যেই মহান সত্তা আল্লাহ্রাব্বুল আলামীনকে নিজে দেখলেন তিনি তাহলে নিরাকার হন কিভাবে

লেখাটি লেখার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে "তফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী" প্রথম খণ্ড থেকে।
[ লেখকঃ তারেক ইমতিয়াজ। ]