পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ২৫

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

যেমনঃ পরশুরামের কথাই ধরা যাক । পরশুরাম দশ অবতারের এক অবতার । অবতার বলতে আমরা বুঝি - দেহ ধারন করে জগতে ঈশ্বরের আবির্ভাব । জৈবিক দেহ ধারণ করলেও প্রাণীকূলের কাছে তিনি নমস্য । এই নমস্য হবার জন্য এমন কতগুলি গুণ তাঁর মধ্যে প্রকটিত হয়, যেগুলি শ্রদ্ধাযোগ্য । যেমনঃ পিতা মাতাকে শ্রদ্ধা, সত্য ভাষণ, অহিংসা মনোভাব, জীবে প্রেম ইত্যাদি । কিন্তু পরশুরামের কাহিনী যদি বিচার করি, তাহলে তাঁর মধ্যে এমন কোন শ্রদ্ধা করার মত গুণই নেই । তিনি মাতৃ হত্যা করেছিলেন। হিংসার বশবর্তী হয়ে একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রীয় করেছিলেন । 

একটা মানুষ যে গুণে দৈব সত্ত্বা প্রাপ্ত হয়, সে গুণও তাঁর ছিল না। যেমনঃ বশিষ্ট । বশিষ্ট ঠিক পরশুরামের বিপরীত মেরুর মানুষ । শত পুত্র নিহত হলেও তিনি বিশ্ব মিত্রের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করেননি । এইজন্য তিনি ব্রাক্ষণ শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ আত্মবশ । বশিষ্ট শব্দের অর্থ হল আত্মবশ। সেই বশিষ্টের উদাহরণের পাশে হিংসায় উন্মুক্ত পরশুরাম কি করে অবতার অর্থাৎ ঈশ্বরের গুণাবলী নিয়ে অবতার হিসাবে চিহ্নিত হতে পারেন ? 

আসলে এই গল্পটির একটি রূপকার্থ আছে । রূপকার্থ এইরকম --------- মাতা মানে 'Energy জগত' । শুণ্যতার বুকে সুপ্ত এই Energy বা শক্তি স্বভাব গুণে ফুটে উঠে গোলাকার জগতের রূপ নেয়। এই জগতকে হনন করে অর্থাৎ জয় করে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়য় করে সেই শূন্যতে যিনি ধ্যান মার্গে ফিরে যেতে পারেন, তিনিই ঈশ্বররূপে গ্রাহ্য হন । পরশুরাম এই জগতকে জয় করেন নির্গুণ শুণ্যতায় তিনি স্থিত হতে পারতেন । সুতরাং তিনি ছিলেন ঈশ্বরতূল্য। জগত অর্থাৎ শক্তিজয়ী হিসাবে তিনি মাতৃঘাতী । কারণ শক্তিকে স্ত্রীলিঙ্গ বা মাতারূপে কল্পনা করা হয় ।

ক্ষত্রিয় হলেন তিনি যার মধ্য সত্বঃ রজঃ ও তম গুণের মধ্য রজঃ ও তম গুণের প্রাধান্য বেশি থাকে । কোন সাধক একুশ দিন সমাধিস্থ থাকলে এই রজঃ ও তম গুণের সম্পূর্ণ নাশ হয় । তখন তিনি ঈশ্বরের নির্ভেজাল সত্বঃ গুণের অধিকারী হন । পরশুরাম একুশ দিন সমাধিস্থ থেকে জড় দুই গুণ অর্থাৎ রজঃ ও তম কে জয় করতে পেরেছিলেন বলেই একুশবার ক্ষত্রিয় নিধনকারী রূপে বর্ণিত হয়েছেন । তিনি কুঠারধারী। এ কুঠার নরহত্যার প্রয়োজনে ব্যবহৃত কুঠার নয়। এ হলো জ্ঞান কুঠার । যার দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকারকে ছেদন করে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় । সেইজন্য অদ্যবধি শৈব সাধকরা কুঠার প্রতীক ধারণ করে থাকেন । গল্পের এই রূপকার্থ খুঁজে পেলে পরশুরামের অবতার তত্ত্বের যুক্তিযুক্তকতা প্রমাণিত হয় । কিন্তু এই রূপকার্থ ধরা না গেলে তা কুসংস্কার ও অজ্ঞানতার তূল্য হয় । 

চলবে...
 

বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ২৪

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

একজন মানুষের নিজের সারা জীবন সে যদি সুবিচারকের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করে, তাহলে জীবনে ঘটনা প্রবাহের অন্তরালে সে এমন অনেক অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে পারবে যা প্রকৃতপক্ষে কৌতূহলপ্রদ ও চমক সৃষ্টিকারী । অন্তত আমি মিঠু যদি আমার ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকাই তাহলে এমনতর চিন্তা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না । 

জীবনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে বাস্তববাদীর বিচারে যার কোন ব্যাখা চলে না, দেওয়াও সম্ভব নয় । সে সব ঘটনা কেমন করে কিভাবে ঘটলো পার্থিব বিচার বিশ্লেষণে অন্তত আমি নিজে তার কোন হদিস পাই না। এমনতর ঘটনার পেছনে নিয়তির কোন হাত আছে বলে ধরে নিই বা অনেকে মনে করেন এই নিয়তি কি? ''অদৃষ্ট''। সাধারণের ধারণা সব কিছু ঘটনার পেছনেই রয়েছে বিধাতা পুরুষের হাত বা অদৃষ্ট লিখন । অর্থাৎ জন্মকালে তিনি কার জীবনে কি ঘটবে তা লিখে দেন ------ সেই লেখা অনুযায়ীই মানুষের জীবন পরিচালিত হয় । কিন্তু এসব ধারণা অবশ্যই পৌরাণিক কাহিনী প্রসূত । 

পুরান, কোরআন, বেদ, গীতা এবং বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক সত্যকে সাধারণের পাঠযোগ্য করে তোলার জন্য গল্পের আকারে পরিবেশন করে, গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয় অবশ্য রূপকের মাধ্যমে একটি সত্যকে বর্ণনা করা । কিন্তু কালক্রমে এই রূপকার্থ লোকে বিস্মৃত হয়ে যায় । তখন রূপক নামক বহিরাবরণরূপী যে গল্প, তা-ই সত্য হয়ে দাড়ায় । রূপকার্থ বর্জিত হয়ে গল্পগুলি যখন অবিশ্বাস্য ননসেন্সে পরিণত হয় । এই জগতে আধ্যাত্ম সাহিত্যে এইভাবেই প্রতিগ্রন্থের মাধ্যমে কলঙ্ক পড়েছে । 

পুরানের ইংরেজী প্রতিশব্দ Mythology--- যার অর্থ দাঁড়ায় 'অবিশ্বাস্য' । তাই সব পুরান সত্যি সত্যিই অবিশ্বাস্য হয়েছে । সভ্যজাতি অধ্যাত্মতার ক্ষেত্রে জগতবাসীকে বর্বর বলে ভাবতে শিখেছে । এই জগতের সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও অধ্যাত্ম সত্য হারিয়ে গিয়ে কতকগুলি কুসংস্কারই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে এবং জন্ম জন্ম ধরে তারা সেই কুসংস্কার অনুসরণ করে তাকেই সত্য বলে আকড়ে ধরেছে । 

রক্ষণশীল মানসিকতার জন্য কিছুতেই এর বাইরে সে যেতে চায় না। এমনি করে একদিন মানুষে মানুষে ভেদাভেদের প্রশ্নটাও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে জগতবাসীর মনে । নইলে স্থির মস্তিষ্কে বিচার করলে পুরানের বহু গল্পই আপাত অর্থে গ্রাহ্য হতে পারে না । যেমন, পরশুরামের কথাই ধরা যাক । 

চলবে............

মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ২৩

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

এই জন্য খুব কম সাধকই দীর্ঘক্ষণ ব্রহ্ম সান্নিধ্যে বা সমাধিতে নির্বিকল্প অবস্থায় থাকতে পারেন। অধিকাংশ সাধকই ব্রহ্মা সান্নিধ্যে থাকেন ততটুক সময়ই যতক্ষণ একটি সরষের দানা মশের শিঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এই ব্যক্তি চেতনা অবলুপ্তি ভীতিকে লক্ষ্য করেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “ কেনরে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়, জয় অজানার জয়।” 

কিন্তু এইসব কি তিনি সচেতনভাবে লিখেছেন অথবা পূর্ব জন্মের সংস্কার বশে তন্ময় অবস্থাতে এসব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তা স্পষ্ট করে বলা খুবই দুষ্কর। কারণ সচেতনভাবে এ সম্পর্কে তার রচনা যেমন ‘ধর্ম’ নিবন্ধ সত্যি সত্যি অধ্যাত্ম জগতে বিচরণশীল ব্যাক্তিদের কাছে অত্যন্ত অপর্যাপ্ত ও দুর্বল বলে মনে হয়। ফলে ধারনা হয় যে, পূর্ব জন্মের সংস্কারই তার তন্ময় মুহূর্তে ফুটে উঠে তাকে এমন অতিন্দ্রিয় মরমিয়াভাবে রঞ্জিত করেছে। যোগীদের কাছে শোনা যায়, ষষ্ঠতলে এখনও রবীন্দ্রনাথ নিদ্রামগ্ন অবস্থায় সুক্ষ্মাদেহে বিরাজমান। 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শুন্যতাবোধের অতীত। কিন্তু শুন্যতায় সমাধিস্থ হয়ে ফিরে এলে পরম প্রশান্তি অনুভুত হয়। এজন্য কবি অজানার (বোধাতীতের) জয়গান করেছেন। বিজ্ঞান কিন্তু শুন্যতা বোধের অতীত হলেও IR RESPONSIVE নয়। কারন VACUUM এ FIELD তৈরি হলে তার চারপাশে শুন্যতায়ও আলোড়িত হয়। SPACE এ বৃহদায়তন OBJECT থাকলে তার চতুর্দিকে শুন্যতা বেকে যায়। শ্রী শ্রী চণ্ডীর এই শ্লোকটিও এই অর্থে অত্যন্ত কৌতুহল উদ্দীপক। এর বাক্যার্থ সহজ হলেও ভাবার্থ নিতান্ত কঠিন। এবং এই ভাবার্থ বোঝা না গেলে এসব পাঠ করা নিরর্থক। 

চণ্ডীতে শুম্ভ যখন পার্বতীকে রমনীরত্ন হিসাবে তাকে অথবা তার অনুজ নিশুম্ভকে পতিত্বের বরন করতে বলেছেন তখন পার্বতী বা দুর্গা তার জবাবে বলেছেনঃ “যো মাং জয়তি সংগ্রামে যো মে দর্পং ব্যপোহতি যো মে প্রতিবলো লোকে স মে ভর্তা ভবিষ্যতি।” অর্থাৎ আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, যিনি আমাকে সংগ্রামে পরাজিত করতে পারবেন, তাকেই আমি পতিত্বে বরণ করব। এ কথার বাহ্যিক অর্থ এই যে, শুম্ভ- নিশুম্ভ তাকে সংগ্রামে পরাজিত করতে পারলে তাদের একজনকে তিনি পতিত্ব বরন করবেন। এই কাহিনীকে যারা যথার্থ অর্থে বিশ্বাস করেন তারা মূর্খ। তাদের চণ্ডী পাঠের কোন মুল্য নাই। অধ্যাত্ম জগতেও অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এই ভাবার্থই হল সত্য।

চলবে.........

সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ২২

লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সেই বিন্দু থেকে অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু সদৃশ ফুলকি বেরিয়ে আসে। আসলে এই বিন্দু হল আত্মজগতের জ্যোতি সমুদ্রে শতদল পদ্মের মত। জ্যোতি সমুদ্রে চৈতন্য সত্তাকে ছড়িয়ে দিয়ে যে সাধক এই বিন্দু নির্গত পরমাণু কনাগুলি দেখতে পান তিনি অপার আনন্দে মুগ্ধ হন। এই বিন্দু জ্যোতি কণাই শতদল অনন্তদল পদ্মের মধু স্বরূপ। সেই অলৌকিক মধুর দৃশ্য দেখে বিহ্বল হওয়ার অর্থ হল- শতদল পদ্মের মধু পান করা।

রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গানের কলি " কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়, জয় অজানার জয়।" এও এক অদ্ভুত হেয়ালী ভরা গান। এ গান সম্পূর্ণ মরমিয়া, অদ্ভুত এক তন্ময় অবস্থা থেকে এ বোধ আসে অর্থাৎ TRANCE থেকে। দেহতত্ত্বে ষষ্ঠ চক্রের কথা বলেছি। এই ষষ্ঠ চক্র ভেদ করে সাধক যখন বিন্দুর জ্যোতির্মণ্ডল পার হন এবং চৈতন্যলোকের স্বচ্ছতা অতিক্রম করতে যান,তখন কেন্দ্রস্থিত শুন্যতা সমস্ত বোধ লুপ্ত করে দিয়ে অদ্ভুত এক নির্বিকল্প সমাধির মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে চায়। দেহতত্ত্বের এই পর্যায় পর্যন্ত সাধকের এক সছেতন প্রয়াস থাকে অর্থাৎ তাঁর সুক্ষ্মা অহংতত্ত্ব এই পর্যন্ত কাজ করে। কিন্তু এরপর শুন্যতার টানে তাঁর বিচারবোধ হারিয়ে যেতে চায় তখনই সুক্ষ্মা অহংবোধ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পাছে তাঁর ব্যাক্তি সত্ত্বা হারিয়ে যায় এই ভয়ে সে নিঃশেষে নিজেকে সেই মহাশূন্যের টানের কাছে ছেড়ে দিতে পারেনা আবার ব্যাক্তি চেতনার ভিতর ফিরে আসে। 

এই অবস্থাকে 'মোক্ষভীতি' নাম দেওয়া হয়েছে। এজন্যই ব্রহ্মন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে ব্রহ্মন হলেন 'মহদ্ভয়ম' অর্থাৎ ব্রহ্মন হলেন বিরাট ভয়ের কারণ। কিন্তু ব্রহ্মন কাউকে ভয় করেন না। ব্রহ্মন ভয় করবেন কি? তাঁর তো কোন বোধই নেই। তিনি সমস্ত কিছু আত্মস্থ করে নির্বিকল্প ও নির্গুণ হয় আছেন। বস্তুত নির্গুণ হয়ে আছেন ব্রহ্মন নয় পরব্রহ্মন, ব্রহ্মন হলেন গতিশীল-EXPANDING. বৃ = To Grow থেকে বৃহমান = স্ফীত হওয়া ব্রহ্মন। এই নির্গুণ অবস্থায় ব্যক্তিসত্ত্বার সমস্ত বোধকে ছেড়ে দেওয়া সত্যি সত্যি বহুজনের কাছেই ভয়ের হয়ে ওঠে।

 চলবে...............

মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন - পর্ব ২১

 (পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মানব জীবের জড় প্যাঁচ খুলে সে যখন অন্তরস্থ জ্যোতিতে প্রবেশ করে,বিশ্বও বিপরীত দিকে তার প্যাঁচগুলি খুলে তার অন্তরঃস্থ জ্যোতি প্রকাশ করে। সুক্ষ্মতম ব্যবধানের মধ্যে দিয়ে এক জ্যোতি অপর জ্যোতির সঙ্গে মিশে যায়। যেমনঃ কাঁচের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। ভগবত গীতার এই শ্লোকটির ভাবও যারা আত্মতত্ত্ব ও জগততত্ত্ব জানেন না, তাদের পক্ষে ভাষ্য পড়েও কোনদিন প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। সঙ্গে একটু বিজ্ঞান পরিচয় থাকাও প্রয়োজন। ভগবত গীতায় জগতের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এইভাবেঃ- 

“এই সংসার রূপ মায়াময় বৃক্ষের মুল (কারণ) উর্ধ্বে মায়াশক্তি বিশিষ্ট ব্রহ্মে হিরন্য গর্ভাদি শাখা নিম্ন দিক। কর্ম কাণ্ডরূপ বেদসমুহ ইহার কাণ্ড।” অর্থাৎ সংসার রূপ জগত বৃক্ষের মুল উর্ধ্বে। শাখা প্রশাখা,কাণ্ড ইত্যাদি নিচের দিকে। 

যোগদর্শনজাত গীতার এই জগত বর্ণনা যে কতটা সত্য অধুনা ASTRO PHYSICS ও তা অনুমোদন করেছে। কারণ ASTROPHYSICS এর ‘BIG BANG’ তত্ত্ব বা ‘STEADY STATE’ তত্ত্ব এ কথাই বলে যে, কোন কেন্দ্রস্থিত বস্তুকনা সমূহে শক্তির বিস্ফোরণের ফলেই গোলাকার জগতে সৃষ্টি। এই শক্তি ঘূর্ণায়মান হবার জন্য কিছুটা ‘ELLIPTICAL’ বা ‘OVAL’ মুলত গোলাকৃতি। যেখান থেকে জগত বিস্ফরিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সেটাই তার কেন্দ্র। ছবিটি দাঁড়ায় এরকমঃ



এই গোলাকার জগতের যেদিক থেকেই কেন্দ্রের অভিমুখে যাওয়া যাক না কেন, কেন্দ্রকে উর্ধ্বমুখী মনে হবে। সুতরাং জগত (সম্প্রসারনশীল গোলক) এর মুল উর্ধ্বে ও ডালপালা অর্থাৎ সুক্ষ্মাংশ থেকে স্থুল অংশ নিচের দিকে। 

বস্তুবিজ্ঞান, আত্মজ্ঞান এবং অন্তর্জগতের স্বরূপবোধ হলে তবেই এই শ্লোকটি ব্যাখ্যা করা সম্ভবঃ “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি?” গানটি বরং ভগবতগীতার উপরক্ত শ্লোকটি থেকেও দুরহ। কারণ দেহের অভ্যন্তরে কুল কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে উর্ধ্বপর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারলেও গানের অন্তঃর্নিহিত রহস্য কারও পক্ষে ভেদ করা সম্ভব নয়। দেহতত্ত্ব অংশে মুলাধারস্থ শক্তির উর্ধ্বগতির ফলে অন্তর্দৃষ্টিতে কিভাবে নানা রঙের খেলা দেখা যায়,  সেটা পুর্বেই ব্যক্ত করেছি। 

প্রকৃতপক্ষে অন্তরসত্ত্বা রীতিমত উজ্বল হয়ে ওঠে চেতনা কে ‘মনিপুর’চক্র অবধি ওঠালেই অনাহত চক্রের নীল আকাশে চেতনা উঠলে প্রায়শই মনে হয়, আকাশ যেন সহস্র চন্দ্র কিরণে উদ্ভাসিত। সেই স্নিগ্ধ জ্যোতি অন্তর আকাশের চন্দ্র কিরণ দেখিলে প্রাণে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করা যায়। 

গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় খোলা ছাদে দক্ষিণ সমুদ্রের ভেজা হাওয়া গায়ে লাগলে যেমন স্নিগ্ধ ও তৃপ্ত ভাব বোধ হয়, এই দর্শনজাত ভাব ও অনুভুতিও তেমনি। সাধক অন্তর আকাশে এই জ্যোৎস্নার লাবন্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তন্ত্রে এই জন্য এই আকাশকে বলা হয়েছেঃ  ‘কোটি চন্দ্র সুশীলতম’ অর্থাৎ কোটি চন্দ্র যেন এই আকাশকে সুশীতল করে রেখেছে। এই চন্দ্র কিরন ধৌত আকাশ দেখেই দেহতত্ত্ব কবি মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন- “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি।” ‘

আমরা ভেবে করবো কি?” কথার অর্থ হলঃ বিচার বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে এর কারণ ধরা পড়বার নয়। রবীন্দ্রনাথের “এই জ্যোতি সমুদ্রে মাঝে যে শতদল পদ্মরাজে তারই মধুপান করেছি ধন্য আমি তাই।” এর ব্যাখ্যাও কোন বাংলার অধ্যাপক করবেন? 

উপরে যে দেহতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছি তাতে কোথায় জ্যোতিসমুদ্র তার কথা বলেছি। আসল জ্যোতিসমুদ্র হল ‘বিন্দু’। কিন্তু এই জ্যোতিদর্শন আরম্ভ হয় ‘মনিপুর চক্র’ থেকেই। মনিপুর চক্র থেকে সহস্রারের মুল জ্যোতি পর্যায় পর্যন্ত ওঠাকালে জ্যোতির মধ্যভাগে সাধকরা “বিন্দুর” অস্তিত্ব দেখতে পান। 

চলবে............

সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগৎ দর্শনঃ পর্ব - ২০

''যে রত্ন প্রাণের শান্তি, তাতে কি আসে ক্লান্তি ? 
একবার বললে বাবা, নিভে যায় দোজখ হাবা ।" 

মুলাধারে এসে স্থির হয়ে যাওয়া এই শক্তিকে যদি সুহ্মা বায়ু দ্বারা উত্তপ্ত করা যায় তাহলে ব্যারোমিটারের রন্ধ্রপথে ঊর্ধ্বমুখী পারার মত এই শক্তি উল্টো গতিতে উৎপত্তি স্থান অর্থাৎ ব্রহ্মারন্ধ্রের দিকে ফিরে চলে। ব্রহ্মারন্ধ্রের শূন্যতার মধ্যে তাকে লুপ্ত করে নিতে পারলেই জগৎলীলা শেষ। জগৎ মানেই মায়ার বাঁধন,জন্ম-মৃত্যু এবং সুখ দুঃখের বৃত্তাকার খেলা। শূন্যে এই শক্তি লয়প্রাপ্ত হলেই জগত লীলারও শেষ অর্থাৎ মুক্তি । মুলত যে সব যোগী ব্রহ্মারন্ধ্রের এই শূন্য তাদের চেতনাকে নিয়ে যেতে পারেন- তাঁরা পরম এক প্রশান্তি বোধ করেন। এরপর জীবদেহে বেচে থাকলেও সুখ-দুঃখ কোনটাই তাদের উদ্বেলিত করতে পারে না। 

ব্রহ্মারন্ধ্রের শূন্যতাকে বলা হয় “পরমান্তন” বা “আন্তন”। সেখানে শক্তি লুপ্ত হওয়া মানে আত্মস্থ হওয়া । এই আত্মস্থ করাকেই বলে খেয়ে ফেলা। যিনি শক্তিকে এইভাবে আত্মস্থ করতে পারেন তিনি পরম প্রশান্তি প্রাপ্ত হন। কারন এই আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে “ শান্তো ইয়মাত্মা” অর্থাৎ এই আত্মা অত্যন্ত শান্ত, নিবিড় নিদ্রায় যে প্রশান্তি অনুভব করা যায় এই প্রশান্তি সেই রকম। চঞ্চলা শক্তিকে এইভাবে আত্মস্থ করা গেলেই তাকে খেয়ে ফেলা হয়। সাধকের মূল লক্ষ্য এই শক্তিকে আত্মস্থ করা। সুতরাং গভীরতর এক ভাববোধ থেকেই রামপ্রসাদ সেন এই গানটি রচনা করেছেন। 

মীরার- “ জ্যোতি যে জ্যোতি মিলাও”- এ দেহতত্ত্বের গভীরতর পর্যায়ের গান। মুলাধার শক্তিকে যখন বিন্দুর জ্যোতির্মণ্ডলে নিয়ে যাওয়া যায় তখন মানুষের চেতনাতে সঙ্গস্কারের স্থুল বন্ধন এতটাই সূক্ষ্ম হয়ে যায় যে, জ্যোতিপূর্ণ সুক্ষাতম কাঁচের মত হয়ে যায় তা। বিন্দু পর্যায়ে পৌঁছালে সেই সূক্ষ্ম জ্যোতির্ময় কাঁচস্বরূপ জীবাত্মার আত্মসত্তার বিশ্বের বিন্দুসত্তার জ্যোতি এসে মিশে যায়। ব্যবধান থাকে অথচ তাকে একাত্মা বলে বোধ হয়। তখন দ্বৈতে থেকে অদ্বৈত এক মিলনের বর্ণনাতীত আনন্দ উপলব্ধি হয়। যারা প্রেমিক সাধক তাঁরা এই আনন্দ ত্যাগ করে নির্বিকল্প প্রশান্তির মধ্যে সকল বোধ হারিয়ে ফেলতে চান না, সাধক বা সাধিকা তখন কেবল সেই ভাবমূখে থাকতে চান। এই জন্যই মীরা নিজে স্থুলসত্ত্বার বহু আবরণ খুলে ফেলে আত্মজ্যোতির মধ্যে বিশ্বজ্যোতির অনুপ্রবেশ উপলব্ধি করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেয়ে উঠেছিলেন- “জ্যোতি যে জ্যোতি মিলাও”। 

আত্ম ও বিশ্ব গঠনের দিক থেকে একই ধরনের। দুইই সুক্ষা থেকে স্থুলে এসেছে। দুইয়েরই সুক্ষা অংশ পরতে পরতে স্থুলতার আবরণে আবদ্ধ। কিন্তু দুইজনের অবস্থান ঘূর্ণনের দিক থেকে ঠিক বিপরীত মুখে, যেমন বিজ্ঞানে “ MATTER ও ANTI-MATTER”। MATTER এর চার্জ যদি POSITIVE হয় ANTI-MATTER এর চার্জ হয় NEGATIVE । MATTER যদি বায়ে ঘোরে ANTI-MATTER ঘোরে ডানে । জীবাত্মা ও বিশ্বের গতিও ঠিক সেইরকম । জীবাত্মা বা দিকে স্থুল আবরণের এক প্যাঁচ খুললে বিশ্বও ডান দিকে স্থুল আবরণের এক প্যাঁচ খুলে ফেলে । জীবাত্মা তার প্যাঁচ খুলে যখন আত্মস্থ জ্যোতিতে প্রবেশ করে বিশ্বও তখন তার প্যাঁচ খুলে নিজস্ব জ্যোতিতে প্রকাশ পেতে থাকে । তার উভয়ের শেষ প্যাঁচটুকু খুলে গেলে অন্তরস্থ দুই শূন্য এক হয়ে যায় । দ্বৈত অদ্বৈত হয়ে একাকার হয় । চিত্রটি নিম্নরুপঃ












 চলবে...............

শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৯

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে) 

“ এই সবই তো প্রহেলিকা,তবু মনে জোর আকাঙ্ক্ষা, 
সঙ্গে থাকো সর্বক্ষণ, তাই নমি অনুক্ষণ”। 

অন্তর্জগতের এই যে রহস্যময় ক্ষেত্র এটা শুধু রহস্যময় অনুভুতিই নয়, বাস্তব বিশ্লেষণী বুদ্ধিতেও এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এ নিয়ে আজকাল রীতিমত রিসার্চ হচ্ছে প্যারাসাইকোলজী ডিপার্টমেন্টে। প্যারাসাইকোলজী বা অধিমনোবিজ্ঞানে একটি জিনিস ধরা পড়েছে যে, বহিরিন্দ্রিয় বন্ধ করলে মানসিক কার্যকলাপের ক্ষমতা বেড়ে যায়। মণি তখন ইন্দ্রিয়ের কাজগুলির দায়িত্ব গ্রহন করতে পারে। শুধু পারে তা নয়,এমন সব অদ্ভুত কাজ সে করতে পারে, যাকে বলা যায় অতিন্দ্রিয় দর্শন। 

প্যারাসাইকোলজীর ভাষায় E.S.P অর্থাৎ ‘EXTRA SENSORY PERCEPTION’। প্যারাসাইকোলজীতে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে, বহিরিন্দ্রিয় বন্ধ হলে অতিন্দ্রিয় দর্শনের ক্ষমতা বেড়ে যায়। চর্মচক্ষে না দেখা গেলেও অনেক কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়। অদ্ভুত ধরনের এক টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা জন্মে যায় মনের। কিন্তু কিভাবে এই ক্ষমতা জন্মে, কিভাবে এই অতিন্দ্রিয় দর্শন হয়, সে বিষয়ে এরা তেমন ওয়াকিবহাল হতে পারেন না। বহিরিন্দ্রিয় বন্ধ করে চোখ বুজে মনের মধ্যে যে ছবি তারা দেখেন, সে ছবি কোথায় কিভাবে প্রতিফলিত হয়,এ নিয়ে তারা তেমন বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেননি। এই যোগ ধ্যানে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করে এর যথার্থ ব্যাখা দেওয়া যায়। 

এই অতিন্দ্রিয় দর্শন হয়ত দেহের ভিতরে যে স্বচ্ছ অবস্থা আছে সেই স্বচ্ছ দর্পণ থেকে হয়, যাকে লালন বাবা ‘আরশী নগর’ বলে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমী অধিমনোবিজ্ঞানে এই অতিন্দ্রিয় দর্শন সম্পর্কে সমীক্ষা করা হয় ‘টেলিপ্যাথির’ আকারে। যেমন একটি SOUND PROOF ঘরে কাউকে বসিয়ে দেওয়া হল- তাঁর চোখ এবং কান বন্ধ করে দেওয়া হল, পাশের ঘরে একজন কতগুলি ছবির উপর মনোনিবেশ করলেন। তিনি যে বিশেষ ছবিটির উপর মনোনিবেশ করলেন রুদ্ধকক্ষে চোখ কান বন্ধ অবস্থায় পরীক্ষার্থী ব্যক্তিটিকে দেখা গেল ঠিক সেই ছবিটির বর্ণনাই দিচ্ছেন। পরে যখন তাকে অনেকগুলি ছবি দেখানো হল তার মধ্যে থেকে ঠিক সেই ছবিটিই তিনি নির্ভুলভাবে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন। এধরনের দর্শনকে প্যারাসাইকোলজীতে ‘টেলিপ্যাথি’ বলে অর্থাৎ একজনের চিন্তা তরঙ্গ আরেকজনের মস্তিষ্কে আঘাত করে অনুরূপ ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। পশ্চিম জগত একে মনের একটি বিশেষ ক্ষমতা বলে ধরে নিয়েছে। মনের এই বিশেষ ক্ষমতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে। তবে বিষয়ের দর্শন যে সবসময় যথাযথ হয়,তা নয়। অনেক সময় প্রতীকের মধ্য দিয়ে পরীক্ষার্থী নিরীক্ষামূলক বিষয়টিকে দেখতে পান, বস্তুত অতিন্দ্রিয় দর্শন কখনও কখনও প্রতীকের মধ্যে দিয়ে সেকথা বলে। ঐশ্বরিক জগতের ভাষা এই প্রতীকময়তা দিয়েই তৈরি, যেকথা পরে বলব। 

এবার আমরা রামপ্রসাদ সেনের গানটির যথার্থ স্বরূপ ব্যাখ্যা করছি যা তথাকথিত পণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষে বিশ্লেষণ দ্বারা ধরা সম্পূর্ণ অসম্ভব। রামপ্রসাদ লিখেছেন ‘এবার কালী তমায় খাবো।” বাহ্য অর্থে এতো একটি রাক্ষুসে ক্ষুধার পর্যায়ে পড়ে। এ যেন আফ্রিকার নরখাদক কোন কবির লেখা গান। অন্তর্জগতে যার প্রবেশাধিকার নেই এমন পশ্চিমী বিদ্যায় শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে এই গানটি ‘NONSENSE VERSE’ এর চাইতেও Absurd প্রমানিত হতে পারে। কিন্তু দেহতত্ত্ব জ্ঞাত হবার পর এ গানের লাইনটির দিকে একটু যদি বিশ্লেষণী মানসিকতা নিয়ে তাকানো যায় তাহলে গভীরতর এক দর্শন এর মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করে। ‘মা কালী হলেন আদি শক্তি,যাকে বলে আদ্যাশক্তি PRIMAL ENERGY KINETIC IN NATURE’। শূন্যে সুপ্তাকারে স্থিত এই শক্তি স্বভাব গুনে নড়ে চড়ে ওঠা মাত্র সময় বা কালের (TIME)উদ্ভব হয়েছে। কালের জন্মদাত্রী বলেই তিনি ‘মা কালী’। এই শক্তিই গোলাকার ব্রহ্মাণ্ডরূপে জগত হয়েছেন। কিছুটা শক্তির ঘূর্ণনের ফলে ‘ELLIPTICAL’ কিংবা ‘OVAL’।মানুষের দেহের মধ্যে এই জগতের ক্ষুদ্র সংস্করণ কাজ করছে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে মুলাধার পর্যন্ত। চলবে............

শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন - পর্ব ১৮

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে) 

“বলছ সব অগণন, কালে কি তা হবে পুরন ?
 তাইতো তব শত ধন্য, তুমি যে গো বিশ্ব বরেণ্য”...... 

এই মস্তিষ্ক স্নায়ু হইল তৃতীয় নয়ন অর্থাৎ অন্তর চক্ষু। অসীম নীলিম আকাশই হইল নজরুলের গানের উৎস – যখন তিনি লিখেছেনঃ 

“ভাবিস তুই ক্ষুদ্র কলেবর, ইহাতেই অসীম নীলাম্বর।” 

যে পর্যায়ে নীলাভ অনন্তবিস্তার আকাশে এই সব রহস্যময় দর্শন হয় তাকেই দেহতত্ত্বে অনাহত চক্র ( দেহের যে স্তরে শক্তি পৌঁছালে মানুষের চেতনাতে সুখ-দুঃখ বোধ থাকে না অর্থাৎ মানুষ সুখ-দুঃখ দ্বারা আহত হয় না।) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আত্মমগ্নতা আরও তীব্র হলে জ্যোতির্ময় এক নীলাভ ব্যপ্তি চোখে পড়ে। এখানে নানা অলৌকিক দর্শন হয়। দেহতত্ত্বে এই পর্যায়কে বিশুদ্ধ চক্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রান্ত ভাগ থেকে কেন্দ্রের দিকে প্রত্যাবর্তন কালে এই রঙ গুলি চোখে পড়ে। কারন সৃষ্টির কেন্দ্রে বিস্ফোরণ হলে ক্রম পর্যায়ে যতই বিশ্ব জগৎ কম উষ্ণ হতে থাকে, ততই শক্তি তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সির তারতম্য হেতু রঙের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ASTROPHYSICS এ তাই বলা হয়েছে বিশ্বের আদি পর্যায়ে দেশ (SPACE) প্রচণ্ড ভাবে আলোকিত ছিল। 

আত্মমগ্নতা আরও তীব্রতর হলে এমন এক পর্যায়ে যাওয়া যায় সেখানে আকস্মাৎ বিস্ফোরণে নানা রঙের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হতে থাকে। দেহতত্ত্বে এই পর্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে আজ্ঞাচক্র। এই আজ্ঞাচক্রই হল দেবী জগতে অর্থাৎ সপ্ততলে প্রবেশের ছাড়পত্র। নিম্ন ষট চক্রের সকল রঙ ও স্বচ্ছতার এখানে তন্মাত্র অভিনয় হয়ে থাকে। স্বচ্ছ আয়নায় ফুটে থাকা প্রতিবিম্বের মত নানা রহস্যময় দর্শন এখানে হয়। বিন্দুমণ্ডলে কোন দর্শন হয় না কিন্তু আরও ঊর্ধ্বে উঠলে শাশ্বত স্বচ্ছস্তরে অর্থাৎ চৈতন্যমণ্ডলে সমস্ত বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডকেই ফুটে থাকতে দেখা যায়। মানুষ নিজেই ঈশ্বর তুল্য হয়। সে তখন বলতে চায় – “আমিই সেই”। অর্থাৎ আমার মধ্যেই সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড প্রতিবিম্ব হয়ে আছে। এই দর্পণ সদৃশ জগৎ যা মানুষের নিজের মধ্যেই আছে। 

সাধনার অভাবে মানুষ তা দেখতে পায় না। রামপ্রসাদের সেই গানের মত – “মানব জীবন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা”। কর্ষণের অর্থাৎ কৃষ্টি বা চর্চার অভাবে মানুষ নিজের অভ্যন্তরের সত্যকে জানতে পারে না। যা আছে নিজের মধ্যে লুকিয়ে, তাকে পাবার জন্য বাইরে ঘুরে বেড়ায়। ইদানিংকালে বিজ্ঞানীরা মহাকাশ অভিযান করেন। এত কাছে সত্য লুকিয়ে আছে যে, সে খবরটাই তারা রাখেন না। এ জন্যই লালন বাবা লিখেছেন – “ঘরের কাছে আরশি নগর, সেথায় এক ঘর পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”।

 চলবে....................................

বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৭

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে) 

“প্রভু যদি সবই দেখেন, অন্যায় তবে করি কখন ? 
প্রভু বার্তা বহেন যিনি, তিনিই তো মাথার মনি”। 

এবার এই দেহতত্ত্বের ভিত্তিতে মরমিয়া গানগুলি ব্যাখ্যা করা যাক। মরমিয়া শব্দের ইংরেজি হলঃ ‘MYSTIC’- গ্রীক শব্দ ‘MYEN’ অর্থাৎ রুদ্ধ করা। বহিঃ ইন্দ্রিয় রুদ্ধ করা থেকে ‘MYSTIC’- মরমিয়া। যিনি ইন্দ্রিয়াতীত মর্ম দ্বারা বোধ করেন - শব্দের উৎপত্তি । মর্ম দ্বারা বোধ করার সময় মানুষের চেতনার মাত্রা (DIMENSION) বৃদ্ধি পায়। ফলে Astrophysicist Carl Sagan এর মতে, INSIDE TURNS OUT বা মানুষ নিজের মধ্যে অনন্ত বিশ্ব দেখতে পায়। যে গানের ধাঁধা তুলে প্রকৃতপক্ষে বর্তমান গ্রন্থে সাধক তাঁর অন্তঃধ্যানে লালন বাবার গানটি ব্যাখ্যা করেছেনঃ “বাড়ির কাছে আরশী নগর, সেথায় এক ঘর পড়শি বসত করে,আমি একদিনো না দেখিলাম তারে।” 

উপরের গানটির যদি দেহতত্ত্ব না জেনে বাক্যর্থ করা যায় - তাহলে অর্থ দাঁড়ায় বাড়ির কাছে অর্থাৎ যে আচ্ছাদনের নিচে আমরা বাস করি তাঁর কাছে আরশি নগর অর্থাৎ আয়না বা দর্পণ নগর আছে। সেই নগর আমরা দেখতে পাইনি। এই বাক্যার্থের কোন মুল্যই নেই। কিন্তু দেহতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে এবং এ বিষয়ে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকলে আধ্যাত্ম জগতের এক বিরাট রহস্যময় ক্ষেত্র ধরা পড়ে যায়। এর ভাবার্থ এই রকমঃ ঘর হল মানুষের দেহ - যে দেহের মধ্যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা দুইই বাস করে। বাইরে থেকে দেখলে এই দেহ একটি স্থুল পদার্থের রূপরেখা মাত্র। কিন্তু চোখ বুঁজে নিজের মধ্যে মনোনিবেশ করলে দেখা যায়। এখানে নানা স্তরের বিস্তৃত পরিধির একটি স্বচ্ছ জগত। সেই স্বচ্ছতা স্বাধিষ্ঠান চক্র থেকেই ফুটতে আরম্ভ করে। কিন্তু নিচের দিকে সে বেশি রকম অস্বচ্ছ এবং উপরের দিকে ক্রমশঃ বেশি স্বচ্ছ। চৈতন্য মণ্ডলে সে স্বচ্ছতম। সেই স্বচ্ছতম একটি দর্পণের মত। যেখানে বহির্জগতের নানা দৃশ্য প্রতিবিম্বের মত ফুটে আছে। মুলাধারস্থ শক্তি দেহ পর্যায়ের যে স্তরে উঠে যে তরঙ্গ মণ্ডলে বিরাজ করে - সম পর্যায়ের তরঙ্গ মণ্ডলের সব ছবিই সেখানে প্রতিবিম্ব হয়। অর্থাৎ EQUAL WAVE LENGTH CASTS THE PICTURE OF EQUAL WAVE LENGTH অর্থাৎ টি.ভি তে যেরকমটি হয়ে থাকে সেরকম। 

স্বাধিষ্ঠান মণ্ডলের স্বচ্ছতায় যে ছবি ফুটে ওঠে তা অস্বচ্ছ। কারণ, এখানকার স্বচ্ছতা ধুলা জমা আয়নার মত। চৈতন্য শক্তি আরও উপরে উঠলে অর্থাৎ আত্ম মগ্নতা আরও বেশি গভীরে প্রবেশ করলে স্বচ্ছতার এক নতুন পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। মনিপুর চক্র এই স্বচ্ছতা হালকা মেঘে ঢাকা নিদাগের মধ্যাহ্ন গগনের মত। আত্মমগ্নতা আরও গভীর হলে নিজের দেহের মধ্যে নীলাভ স্বচ্ছ এক আকাশ চোখে পড়ে। অনন্ত পরিধি এই নীলিম আকাশে নানা দৃশ্য চোখে পড়ে। চোখ বুঁজেও এসব কিছু দেখা যায় অর্থাৎ মস্তিস্ক স্নায়ুতে তরঙ্গের সামঞ্জস্যহেতু অনুরূপ সব ছবি ফুটে ওঠে। দেহের ভিতরে বহির্বিশ্বের অনন্ত আকাশ দেখা যায়। কুলকুণ্ডুলিনীর ঊর্ধ্বগতি হেতু মানুষের ‘DIMENSION’ বৃদ্ধির ফলে ত্রিমাত্রিক মানুষ যদি চতুর্মাত্রিক বা অধিক মাত্রা লাভ করে তবে নিজে ভেতরকে বাইরে দেখবে। বিজ্ঞানে বলা হয়েছে “If a fourth dimensional creature existed in our three dimensional universe it could also turn us inside out. There are several ways in which we can be turned inside out, the least pleasant would result in our VISCERA and internal organs being on the out side and the entire COSMOS- Glowing Intergalactic gas, Galaxies, Planets everything on the inside” চলবে..................

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৬

(পুর্বপ্রকাশের পর হতে)

“আশা তো পাওনা থোওনা 
জাতে আসে বঞ্চনা কল্পনা।” 

শক্তি যখন আরও এগিয়ে যায় তখন দেহভার আর থাকেই না। দেহ শূন্যে ভাসমান হয়, জিহ্বা নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে- কুম্ভক হয়। পার্থিব জগত লুপ্ত হয়ে শুধু মাত্র স্বচ্ছ দর্পণতুল্য এক দেশ বিরাজ করে। সেই দর্পণে জগত ব্রহ্মাণ্ড প্রতিবিম্ব হিসাবে বিরাজ করে, ব্যক্তি সর্বদ্রষ্টা হন। ইচ্ছাশক্তি করায়ত্ত হয়। ইচ্ছামাত্র সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের ক্ষমতা জন্মে। শক্তি এই চিৎ পর্যায়ে পৌঁছাবার অনেক আগেই মানুষের মধ্যে আত্মিক শক্তি জন্মায়, যাকে ইংরাজি তে বলে ‘PSYCHIC POWER’ এই আত্মিক বলে বহু লোক রোগ নিরাময় ইত্যাদি করে থাকে। চিৎ পর্যায়ে স্থিত হলে মৃতকেও জীবন দান করা যায়,পঙ্গুকে গিরিলঙ্ঘন করানো যায় অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তি করায়ত্ত হয়। কারন এই চিৎ পর্যায়ে থেকেই শক্তি আত্মপ্রকাশ করে- এইজন্য শক্তির নাম ‘চিন্ময়ী’ ও বটে। এর উপর শক্তি যখন আরও এগোয় তখন ক্রমশ বোধশক্তিও লোপ পায় এবং একসময় সবকিছুই হারিয়ে যায়। কোনকিছুই বোধের মধ্যে থাকে না। এই হল শুন্যস্থিত শক্তির জগৎরূপ,গতিশীল রূপ ত্যাগ করে পুনরায় শূন্যে সুপ্ত হওয়া- যাকে বলা হয় ‘সমাধি’-‘মরার আগে মরো’। 

শক্তিকে বিপরীত মুখে ফিরিয়ে নিয়ে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায় বলে আচারকে ‘বাম (বিপরীত) আচার’ বা ‘বামাচার’ নাম দেওয়া হয়েছে। 

বিশ্বজগৎ তখন তার। জ্যোতির্ময় ধোঁওয়ার মত যে মেঘরূপ পাল্টে যে ছবি এঁকে তাঁর সঙ্গে কথা বলে।সেই মেঘই বা কি? আধ্যাত্ম পুরুষেরা বলেন, ইশ্বরের বিভূতি। সত্যিই কি তাই? এই জ্যোতির্ময় বিন্দুমণ্ডলের ঊর্ধ্বে যখন স্বচ্ছ কাঁচের মত জগত ভেসে ওঠে,সাধক সেখানে তখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করেন। আরও অবাক হন যখন নিবিড় নিদ্রার মত একটা গভীর প্রশান্তির মধ্যে কিছুক্ষণ হারিয়ে যান। ফিরে এসে দেহ মনকে মনে করেন স্নিগ্ধ, স্নিগ্ধ, স্নিগ্ধ। অপূর্ব এক ভালবাসায় তখন তাঁর সমগ্র চৈতন্যসত্ত্বা ভরে যায়। তখন সাধকের মনে হয়,’এই শেষ লাভটুকুই যথার্থ লাভ,আর সবই মিথ্যা’। 

সুখ,সম্পদ,নাম-যশ, ভোগ সবার চাইতে বড় হল প্রশান্তি। শোনা যায় ইশ্বর মানুষকে সবকিছু দিয়ে শুধু এই প্রশান্তিটুকু নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। নির্বিকার নীরবতায় সেখানে হয়ত ইশ্বরের কোলে বসে তাঁর সঙ্গে সেই প্রশান্তিটুকুই ভাগ করে নেন সাধক। 
(চলবে)

মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৫

“প্রভু হলো দয়ার ডিপু
 ডাকি তাই নূই্য়ে বপু।” 

শক্তিকে এখানে তুলতে পারলে নানা দৈবীভাবে দেহ অনুরণিত হতে থাকে। বিশুদ্ধ চক্র থেকে শক্তি যখন আরও ঊর্ধ্ব দিকে এগিয়ে চলে তখন ‘জ্যোতির্ময় নীল’ আরও সুক্ষ্মতর হতে আরম্ভ করে অর্থাৎ COLOR BECOMES MORE LUMINOUS NEAR THE CENTRE। এখানে নানা দিব্যদর্শন ও পার্থিব জগতের বিগত মহাত্মাদের অর্থাৎ উচ্চ কোটি সাধকদের বহু সুক্ষ্ম দেহ দর্শন হয়। এরপর শক্তি যখন ভ্রু মধ্যে আজ্ঞা চক্রে প্রবেশ করে তখন নানা রঙের বিস্ফোরণ হতে থাকে। মাঝে মাঝে এখানেও নানা দিব্যদর্শনও হতে থাকে। .
বিঃদ্রঃ- হুজুর পাক (সাঃ) এর অনুমতি ছাড়া এই আজ্ঞা চক্রে প্রবেশ করা সহজসাধ্য নহে।  কারণ এইখানের অবস্থান দরবারে রেসালত আর রেসালতের ইমাম অর্থাৎ সরদার হুজুর পাক (সাঃ)। 

আজ্ঞাচক্র অর্থাৎ অনুমতি চক্র পার হলে সপ্ততলে অর্থাৎ স্থায়ী দিব্য জগতে প্রবেশের অধিকার মেলে। এখানে পূর্বে বর্ণিত সকল রঙের তন্মাত্র অর্থাৎ ESSENCE পুনরায় সুক্ষ্মারুপে দেখা যায়। তারই মাঝে মাঝে দৈবী সত্ত্বার তন্মাত্র রূপ চোখে পড়তে থাকে। আজ্ঞাচক্র হল দিব্য জগতে প্রবেশের ছাড়পত্র স্বরূপ। সেইজন্য এর নাম ‘আজ্ঞা চক্র’, অর্থাৎ অনুমতিপত্র বা ছাড়পত্র বিশেষ।

অনুমতি পেলে মেরুদণ্ডের রন্ধ্রপথ তখন পরিষ্কার হয়ে যায়। মূলাধারের কুণ্ডস্তিত শক্তির ঊর্ধ্ব যাত্রা পথে তখন আর কোন বাধাই থাকে না। বিনা বাধায় শক্তি দ্রুত ঊর্ধ্বে উঠে সপ্ততলে চলে যায়। সপ্ততলে নানা বর্ণের ও নানা দৃশ্যের তন্মাত্র দর্শনের পর শক্তি প্রবেশ করে বিন্দুতে। তখন বিন্দু অদৃশ্য হয়। বিন্দুর (বস্তুত বিন্দু অদৃশ্য হয় না। সাধকের চেতনা বিন্দুস্থ হয়ে বিন্দুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর লক্ষ্য করতে পারে না। যেমন ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আমরা ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে পারি না।) পরিবর্তে শুধুমাত্র জ্যোতি দর্শন হতে থাকে। সপ্ততলে নানা বর্ণ মাঝে মাঝেই অনন্ত আকাশে কোটি চন্দ্র প্লাবিত জ্যোৎস্নার প্লাবনে মন প্রাণকে স্নিগ্ধ করে দেয়। বিন্দুতে ঢুকলে সুক্ষ্মা অহংবোধ ও দিব্যবোধ একাত্ম হয়ে অদ্ভুত এক পরিপূর্ণ আনন্দ দান করতে থাকে। যেন ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়েছি অথচ তাকে বোধ করে আনন্দও পাচ্ছি এইভাবে। বিন্দুর এই জ্যোতির্মণ্ডলে প্রবেশ করলে ব্যাক্তি মানুষের নিজের মধ্যেই দৈবী ক্ষমতা দেখা দেয়। বিন্দুর জগতে প্রবেশ করলে জ্যোতি ছাড়া সে তখন আর কিছুই দেখে না। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় চোখ বুঝলে সেই দিব্য জ্যোতি নানা রূপ অঙ্কন করে প্রতীকী ভাষায় কথা বলে। ঠিক যেন আকাশের মেঘ। আকাশের মেঘ যেমন এক এক সময় এক এক রূপ ধারণ করে – সেই জ্যোতিও নানাপ্রকার রূপ ধারণ করে ইঙ্গিতে কথা বলতে থাকে। জগতের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই যেন তার চৈতন্যসত্ত্বার ধৃত হয়ে আছে। ইচ্ছামাত্র প্রতীকী রূপে সে সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত দেয়। 

চলবে..................

সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৪

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)
"সবকে টানে আকর্ষণ তাকে 
টানে সে কোন জন ?
কারো হিসাব দিবা বর্ষে 
কারো আবার আলোক বর্ষে"। 

সৃষ্টি প্রথম দৃশ্যমান হয় স্থুল জগতে। কিন্তু সৃষ্টি একটি অন্ধ আবেগে আপন পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে অর্থাৎ যেখান থেকে সে এসেছে সেখানেই ফিরে যাবার পথে সে এগিয়ে চলেছে। এখন আর এটা ব্যাখ্যাতীত নয়। কারণ চেতনা Energy রূপে ফুটে উঠে বস্তু পুঞ্জে তাকে আচ্ছাদিত করে ভেতরে পূর্ণ চেতনাকে ধরে রাখে। এবং সেই চেতনাই গতি চরিত্র অনুযায়ী আবার উৎসের দিকে ফিরে যাবার মুখে Evolution রূপে নিজেকে প্রকাশ করে আত্মস্ত হয়। সুতরাং চেতনা সর্বত্রই রয়েছে। কোথাও স্থির হয়ে।  কোথাও বা চলমান রূপে। 

এই অন্ধ আবেগ বা গতিকেই বলে “Will” বা Elan Vital”। স্থুল থেকে ব্যাখ্যাতীত রহস্যে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে। একে অন্ধ আবেগ না বলে সচেতন আবেগও বলা যায়। কারণ এই আবেগ ধুম্র  কুন্ঞ্জ রুপে ধারণ করে ঘূর্ণাবর্তে তাঁর মধ্যে যে শূন্যতাকে ধরে রাখে, সেই শূন্যতা পূর্ণচেতনাময়। প্রমাণঃ সেই শূন্যস্থ বা সমাধিস্থ - সম (Equal) অধি - (Still Stage Beyond The Physical World)  = সমাধি। 

জীব ত্রিকালজ্ঞ হয় প্রান থেকে মনের। মন থেকে বুদ্ধির। চিত্তবৃত্তি ও অহঙ্কারের আবির্ভাব। এই বুদ্ধি দ্বারা মানুষ বুঝতে শিখেছে যে, শূন্যতা থেকে সৃষ্টি, শূন্যতাতেই আবার ফিরে যেতে হবে। শুধু তাই নয়। ব্যাবহারিক জীবনে বহু সাধু সন্ত এই শূন্যতাতে ফিরেও গেছেন। ফলে মনুষ্য দেহের বাইরে উৎকৃষ্টতর অন্য কোন দেহের প্রয়োজন নেই বলে ভিন্ন গ্রহেও যে সব জন্তু ও জীব দেখা যায় তারা ক্ষুদ্রাকার বা বৃহদাকার হলেও দ্বিহস্ত দ্বিপদ বিশিষ্টই। তার বাইরে নয়। বৃহদাকার জীব দেখা যায় সেই সব গ্রহের মধ্যে যার মধ্যাকর্ষণ শক্তি কম। যে সকল গ্রহে মধ্যাকর্ষণ শক্তি বেশি সেখানে জীব ক্ষুদ্রকায় কিন্তু বেশি তেজসম্পন্ন। 

অনাহত চক্রের স্বচ্ছ নীল আকাশেই যে প্রথম অলৌকিক দর্শন হয় তা নয়। তার আগেও মাঝে মাঝে নানা ধরনের অলৌকিক জ্ঞান হয়। তার মধ্যে কিছু কিছু হয়তো আপন মনের সংস্কারের প্রতিফলন। কিছু হয়তো বা সত্য যেমন ঘূর্ণ্যমান শিবলিঙ্গ বা বলয়যুক্ত শনিগ্রহ। শিবলিঙ্গ আর কিছুই নয়। বিন্দু - যাতে পুরুষ শূন্যতা ও প্রকৃতি একাত্ম হয়ে আছে। আনন্দ অর্থাৎ বিন্দুপর্যায়ে শূন্যের চতুর্দিকে এই বিন্দুরুপ আলো ঘূর্ণ্যয়মান হয় অর্থাৎ বিন্দু শূন্য বা পুরুষের চতুর্দিকে গৌরপট্রের মত বিরাজ করে। যোগীরা হয়তো এ দেখেই শিবলিঙ্গের কল্পনা করেছিলেন। অনাহত চক্র ছাড়িয়ে শক্তি উপরের দিকে যখন উঠতে থাকে তখন নীল রং ক্রমন উজ্জলতর ও সুক্ষাতর হতে আরম্ভ করে। অবশেষে বিশুদ্ধ চক্রে এসে পৌঁছালে তা নীল জ্যোতির আকার ধারণ করে। উৎসের নিকটবর্তী অঞ্চলে যে নীল রঙের গভীরতা, তা উপলব্ধি করা যায়। এই “জ্যোতির্ময় নীল” দিব্যজগতের খুব কাছাকাছি। এখানে নানা দিব্য মূর্তি দর্শন হয়। তবে তারা কেউ রক্ত মাংসের নন। হয় সাধকের মনের প্রক্ষেপন অথবা দৈবীসত্তা সুক্ষারুপ। মনে রাখতে হবে যে বিভিন্ন যে রূপ তা তরঙ্গের তারতম্য হেতু।

 চলবে.........

রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১৩

( পুর্বপ্রকাশের পর হতে )

“কক্ষ ঘোরে কার পরে
 বলছো না কিসের তরে?
তারা গ্রহ মরে ঘুরে,
কার আকর্ষণের জোরে?”

এরপর শক্তি যখন অনাহুত চক্রে গিয়ে স্থির হয় তখন শুধু নীল নীল আর নীল দেখায়। পরতে পরতে নীল সরে গিয়ে আরও সুক্ষ্ম জ্যোতির্ময় নীল দেখা দিতে থাকে। কেন্দ্রের যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, ততই আরও বেশি গাঢ় নীল রং হয়। সেই নীলের মধ্যে নানা ধরনের ছবি ফুটে উঠতে থাকে। যেমনঃ দূর দেশ, পর্বতশৃঙ্গ, সাগর, মরুভুমি, গ্রহান্তর-গ্রহান্তরের জীব, দেব-দেবীর জীবন্ত ছবি। দেশে (SPACE) জীবন্ত যেসব দেব-দেবী ও জীবের ছবি দেখা যায়, তার উৎপত্তি স্থান সম্ভবত- INTER STELLAR MEDIUM এ। কখনও কখনও ভিন্ন গ্রহে রক্ত মাংসের উন্নত জীব দেখা যায়- ASTROPHYSICS মনে করে যে, যখনই কোন নক্ষত্রের জন্ম হয় তখনই তার সাথে থাকে গ্রহের সমাবেশ। 

আমাদের সৌরজগতের কাছাকাছি এই ধরনের আটটি নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। BURNARD’S STAR এর দুইটি গ্রহ সঙ্গী আছে বলে মনে হয় - যাদের MASS আমাদের বৃহস্পতি গ্রহের 0.8 time বেশি রয়েছে। অনুমান করা হয় যে, আমাদের ছায়াপথে অন্তত বিশ বিলিয়নেরও বেশি নক্ষত্র রয়েছে। এদের প্রত্যেকটি নক্ষত্রেরই অন্তত এমন একটি করে গ্রহ আছে যেখানে উত্তাপের তীব্রতা খুব বেশি নয় বা শীতলতাও অতিরিক্ত নয়। আবহাওয়া অনেকটা আমাদের পৃথিবীর মতই। এখানেই ভিন্ন জগতের জীব দেখা যায়। তবে বৈজ্ঞানিকেরা গ্রহ জাতীয় ক্ষেত্রে তিন ধরনের সভ্যতা অনুমান করেছেন। 

প্রথম ধরনের গ্রহে - প্রাণীকুল পরিবেশকে পরিবর্তিত করতে পারলেও তারা নিজেদের গ্রহস্থ উপাদানসমুহ নিয়েই তৃপ্ত থাকে। দ্বিতীয় ধরনের সভ্যতায় - কেন্দ্রস্থ নক্ষত্রের সকল শক্তিই ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। তৃতীয় ধরনের সভ্যতায় - একদল নক্ষত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। তাদের কার্যকলাপ হয় ‘GALACTIC’ পর্যায়ে। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধরনের সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য। যাদের মধ্যে কারও কারও আকৃতি আমাদের পৃথিবীর পুজ্য দেব-দেবীদের মত। শুধু দেব-দেবীদের নয়, বড় বড় পণ্ডিত ও সাধকদের চেহারাও ধ্যানে আসতে থাকে যা দেখলে মনে হয় অনেক অনেক পরিচিত ছবি। বোধ হয় যোগীরা ধ্যানে এইসব দূরবর্তী গ্রহের জীব দেখেই দেব-দেবীর কল্পনা করেছিলেন। যে জন্য বলা হয়েছে, ‘যোগীনাম ধ্যান নিমির্তম’। এই ধ্যানলব্ধ মূর্তির সঙ্গে তত্ত্ব যুক্ত করে তাকে ভিন্নতর রূপ দেওয়া হয়েছে যেমন-‘মা-কালী’। 

শক্তির দুর্বোধ্য শিহরণ রূপে তার বর্ণ করা হয়েছে কালো।  অর্থাৎ যে আদি, যে শক্তির স্বরুপ ধারনার মধ্যে আনা যায় না। তাই সৃষ্টিকর্তারই রূপ। কৃষ্ণ বা কালো বর্ণ হলঃ দুর্বোধ্যতার প্রতীক। বিজ্ঞানেও দেখা যায় যে, ‘BIG BANG’ রূপ বিস্ফোরণের পর শক্তি পাঁচ লক্ষ বছর ধরে আলোহীন অন্ধকার রূপে এই জগত ব্যক্ত হয়ে ছিল। শক্তির এই আদি অবস্থা অর্থাৎ ‘PRIMORDIAL ENERGY’ রূপ মা-কালীর বর্ণ। তাই কালো। চুল শক্তির প্রতীক। তাই তার দীর্ঘ বিলম্বিত এলোকেশ। শ্বেত শিবের বুকের উপর তাকে দাঁড় করিয়ে এইটুকু বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, শূন্যের বুকে নিষ্কম্প আবেগ বা চিৎ বা চৈতন্য (শ্বেতবর্ণ) থেকে তার জন্ম। তার নাম ‘মা-কালী’ দেওয়া হয়েছে এই কারনে যে, ENERGY রূপে তিনি নড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কালের জন্ম হয়েছে।

কালের (TIME) জন্মদাত্রী হিসাবেই তিনি ‘মা-কালী’। তাঁকে চার হাত দান করা হয়েছে এই কারনেই যে, তাঁর দ্বারা মহৎ একটি তত্ত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে অর্থাৎ মহাশক্তি। যিনি জগতরূপে ফুটে আছেন। তিনিই তা পালন করছেন। তিনিই তা ধ্বংস করছেন। দক্ষিণ দুই করে ( ডান পাশের দুই হাতের তালু) বর ও অভয়। খড়গ ধৃত বাম করে (বাম হাত) ধ্বংস এবং মুণ্ডধৃত বাম করে (বাম হাত) সৃষ্টি। তিনি যে উলঙ্গ তার কারণ আদি পর্যায়ে শক্তি ‘গুণত্রয়’ দ্বারাও বেষ্টিতা ছিলেন না। গুণ বসন স্বরুপ। দেবী ‘পরাবিদ্যা’ বলেই গুণ দ্বারা আচ্ছন্না নন। গলার পঞ্চাশটি মুণ্ডমালা পঞ্চাশটি কোয়ান্টাম লীপের প্রতীক। 

হাতের মুণ্ড সৃষ্টির প্রতীক। দেবীর চার হাত ‘SYMMETRY BREAKING’ এর চারিটি শক্তিও হতে পারে। তাঁর গলায় পঞ্চাশটি ও হাতে একটি মুণ্ডু দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে একান্নটি তরঙ্গে শক্তি রূপে তিনি স্থুল জগতে আকৃতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর বিলম্বিত জিহ্বা ‘খেচরীমুদ্রা’র প্রতীক, অর্থাৎ তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করে তাতে সাম্য রক্ষা করেছেন।

সাধকের দেহ ভুমিত্যাগ করলে ‘খেচরীমুদ্রা’র সাহায্যে তিনি দেহের সাম্য বা BALANCE রক্ষা করেন। মুলতঃ শক্তির ঊর্ধ্বগতিতে মস্তিষ্ক তন্ত্রীর তরঙ্গ মাত্রার সঙ্গে সমপর্যায়ে তরঙ্গায়িত যত গ্রহ-গ্রহান্তর, জীব, সবই দেখা যায়। গঠন এবং আকৃতিতে তারা পার্থিব জগতের জীব থেকে ভিন্ন নয়। এমনকি উন্নত জীব। যাদের দেখে যোগীরা ধ্যানে দেব-দেবী কল্পনা করেছেন। তারাও মানুষেরই মত দ্বিহস্ত-দ্বিপদ যুক্ত। পৃথিবীতে তাদের রুপান্তর মানুষের ভাবাদর্শ যোগ হবার জন্য। না হলে জীব জগতের চূড়ান্ত আকৃতিগত পরিনতি দ্বিহস্ত-দ্বিপদের মধ্যেই রয়েছে। কারণ মনুষ্যাকৃতি এই দেহের মধ্যেই জীব জগত তার চূড়ান্ত সিদ্ধি অর্জন করেছে। সৃষ্টিতত্ত্বের মূলকথা - “যেখান থেকে উৎপত্তি সেখানেই পরিনতি।” এই বৃত্ত বা CYCLE শেষ হলেই সৃষ্টি উদ্দেশ্য চূড়ান্ত পরিনতি লাভ করে। সৃষ্টি যে পর্যায়ে জীব বা প্রানীজগত আত্মপ্রকাশ করেছে,তা স্থুল জড় পর্যায়।

 চলবে..................

বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব ১২

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

“বলছ যে সবাই ঘোরে
নিজ নিজ কক্ষপরে।”

সে যাক। তত্ত্ব কথা থাক। দেহ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে আমরা যে কতকগুলি মরমিয়া গানের ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিলাম, সে কথাতেই আসা যাক। 

দেহ তত্ত্বে ব্রক্ষ্ম রন্ধ্র থেকে শক্তির মূলাধার পর্যন্ত অবরোহনের কথা বলেছি। এবার আর এক পর্যায়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়। প্রানায়ামের ফলে মূলাধারস্থ শক্তি যখন ঊর্ধ্বগামী হয়, তখন ক্রম ঊর্ধ্ব পর্যায়ে শক্তি যে পর্যায়ে থাকে, অরোহ পর্যায়ে সেই সব ধাপের সূক্ষ্ম জগত সে অবলোকন করে। তবে এই অবলোকন যে সে চর্ম চক্ষুতে করে তা নয়। করে তৃতীয় নয়নে অর্থাৎ অন্তর চক্ষুতে। এই তৃতীয় নয়ন হল তার মস্তিষ্কের স্নায়ুমণ্ডলী – VISUAL NERVE এ। 

মূলাধারস্থ শক্তি এক এক ধাপ ঊর্ধ্ব দিকে উঠলে মেরুদণ্ড রূপ নালী বা তার (WIRE) বেয়ে মস্তিষ্ক স্নায়ুতে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। যদি অনুরূপ তরঙ্গের কোন জিনিসের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে যায়, তাহলে সেই পর্যায়ের ছবিগুলো তার রিসেপটিভ ব্রেনতরঙ্গে ধরা পড়ে টিভির পর্দার মত ছবির PROJECTION তৈরি করে। ফলে বাংলাদেশের কোন ঘরে বসে যে তরঙ্গ তার মস্তিষ্ক স্নায়ুগুলি রয়েছে অনুরূপ তরঙ্গের দূর আমেরিকার কোন শহর বা মানুষের চিত্র তার চোখে ধরা পড়তে পারে। অন্তত কেউ কেউ এই দূরশ্রুতি বা দর্শনকে সমান্তরাল তরঙ্গ বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। এখন দেখা যাক শক্তির অরোহ পর্যায় ব্রেন তরঙ্গে কি কি দৃশ্য একজন সাধকের বা তত্ত্ বজিজ্ঞাসু গবেষকের তৃতীয় নয়নে ধরা পড়ে। 

শক্তির আরোহ পর্যায়ে যখন সে মূলাধার চক্র নড়ে ওঠে তখন গবেষক বা সাধক অদ্ভুত এক রং দেখতে পান। সে রং সন্ধ্যার ছায়ায় ঢাকা লাল বর্ণের আকাশের মত অর্থাৎ ফ্যাকাশে লাল রঙের কিছুটা ঘন তরল অবস্থা। কেউ কেউ এই সময় একটি কালো হাতের আশীর্বাদ ভঙ্গির লাল করতল দেখতে পান। তান্ত্রিকরা একেই বলেন ‘মায়ের হাত’। যারা এই হাত দেখতে পান তাদের ঊর্ধ্বগতি ও অতিন্দ্রিয় দর্শন অনিবার্য। এছাড়া অকস্মাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মত তীব্র আলোকচ্ছটাও দেখতে পান কেউ কেউ। এ হল ঐশ্বরিক দীপ্তির ক্ষণিক প্রকাশ। তন্ত্রে এ ধরনের আলোকে বলা হয়েছে ‘কোটি সূর্য বিভাযিতম’। 

ব্রহ্মাণ্ডের আদি পর্যায়ে এই সুতীব্র আলো দেখা যায়। সে এত তীব্র আলো যে সাধক বা গবেষকের মনে হয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। হয়তো বা চোখ অন্ধ হয়ে যাবে (চিত্র- ১) । শক্তি যখন আর একটি ঊর্ধ্ব পর্যায়ে ওঠে তখন শক্তি স্বাধিষ্ঠান মণ্ডলে এলে তখন সেই ফ্যাকাশে লাভা তুল্য লাল রঙের মধ্যে আরেকটা লাল রঙের মধ্যে বৃত্তাকার একটি সবুজ বৃত্ত দেখা যায়। সেই সবুজ বৃত্ত ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে জলো ছায়া ছায়া এক জগতে প্রবেশ করে। দিনের বেলা পুকুরে ডুব দিয়ে চোখ মেলে তাকালে  যেমন সবুজ সবুজ ভাব দেখা যায় সেই রকম। পরে তা ধীরে ধীরে ছায়া ছায়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যাবেলা পুকুরে ডুব দিয়ে চোখ মেলে তাকালে যেমন দেখা যায়, সেই রকম হয় (চিত্র- ২) । 

মুলাধারস্থ শক্তি যখন আর এক ধাপ উপরে ওঠে অর্থাৎ মণিপুর চক্র আসে তখন সে তেজোময় ধূম্র  পুঞ্জ দেখতে পায়। সেই ধূম্র  পুঞ্জ দেখতে অনেকটা নিদাঘদগ্ধ মধ্যাহ্ন গগনের মত (চিত্র - ৩) ।  এরপর শক্তি যখন আরও ঊর্ধ্বে উঠতে আরম্ভ করে তখন সাদা মেঘের আকাশে যেন কোদলে মেঘের মউজ উঠে। এই মেঘকে বলা হয় ‘INTERSTELLAR DUST’ অর্থাৎ সাদা মেঘ থোকায় থোকায় কাটতে আরম্ভ করে এবং তার ফাঁকে ফাঁকে শরতের নীল আকাশের মত আকাশ উঁকি দেয়। ঠিক যেন ছানা কাটা দুধের ফাঁকে নীল পানি ফুটে ওঠার মত। যখনই অনাহুত চক্রের দিকে শক্তির অগ্রগতি পথের সাদা জ্যোতির্ময় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আবার নীল আকাশ উঁকি দেয় তখন সাধক নিজের সারা দেহমনে অদ্ভুত এক আনন্দের এক শিহরণ অনুভব করেন। কখনও কখনও যেন বহুদুরে আকাশ থেকে সেই নীল অংশ বেয়ে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে গম্ভীর এক আওয়াজ ধ্বনি ভেসে আসে – ‘আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু – অ-উ-ম, অ-উ-ম, অ-উ-ম’। অনেকটা যেন অদ্ভুতরকম রহস্যময় ধ্বনি (চিত্র- ৪) ।


 চলবে.........

মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন- পর্ব- ১১

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

“মৌলিকহীন তাই যা কষ্ট যোগ
 বিয়োগের অতি পুষ্ট।”

ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্রের উল্লেখিত সব প্রক্রিয়া তত্ত্বই যে নির্ভুল এবং বৈজ্ঞানিক তা নয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকারক। যেমনঃ এমন অনেক গুরু আছেন যারা ধ্যানকালে শিষ্যের মনচাঞ্চল্য দেখলে তার নিন্দা করেন। কিন্তু এত বড় ভ্রান্তি আর নেই। প্রকৃতপক্ষে মনচাঞ্চল্য এবং মনের নানা ধরনের চিন্তা আত্মতত্ত্ব জানার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক। ‘PARAPSYCHOLOGY’ পরীক্ষা করে দেখেছে যে, স্বপ্ন মানুষকে সুস্থ রাখার পক্ষের বড় সহায়। 

মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা এবং অপ্রাপ্তির বঞ্চনার সম্মুখীন হয়। সেগুলো তার মনের ভিতর জমে থেকে অশান্তি সৃষ্টি করে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলি যদি বেরুবার পথ না পায়, তাহলে মানুষের জীবনে নানা বিপত্তি ঘটতে পারে। সাধারণতঃ দেখা যায় তারা উন্মাদ হয়ে যায়। মানুষ প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখে বলে এই উন্মাদ হয়ে যাবার সম্ভাবনার হাত থেকে রক্ষা পায়। প্রতিটি মানুষ প্রতি রাতে কমপক্ষে চার বা ততোধিক স্বপ্ন দেখে। মনের মধ্যে চেপে থাকা এই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা স্বপ্নের আকারে তার মধ্য থেকে বেরিয়ে যায় । এই স্বপ্ন ‘NON R.E.M ও R.E.M’ জাতের। অর্থাৎ প্রথম রাতে মানুষ যে স্বপ্ন দেখে তাতে তার চোখের পাতা কম আন্দোলিত হয়। একে বলে ‘NON RAPID EYE MOVEMENT’। শেষের দিকে যে স্বপ্ন দেখেন, তাতে চোখের পাতা বেশি কাঁপে। যাকে বলে ‘R.E.M’ অর্থাৎ ‘RAPID EYE MOVEMENT’। তার এই স্বপ্ন দেখা ‘ E.E.G’ অর্থাৎ ‘ELECTRO ELECTROENCEPHALOGRAPH’ নামক যন্ত্রে ধরা পড়েছে। স্বপ্ন দেখে বলেই মানুষ নরমাল থাকে। যাদের স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায়, তারা ক্রমশই উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয়। একে বলে ‘APPROACHING SIGN OF INSANITY’ 

স্বপ্ন দেখলেও যে মানুষের ভিতরকার সকল অবরুদ্ধ বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাই দূর হয়ে যায় তা নয়। কিছু কিছু থেকে যায়। সেগুলোই সে যখন কোন কিছুতে একাগ্রচিত্ত হতে চায়, তখন নানা চিন্তার আকারে বাইরে আসতে থাকে। এইভাবে কিছুদিন চলার পরে দেখা যায় যে, তেমনভাবে বিশৃঙ্খল চিন্তা ভাবনা আর তার ভেতর থেকে বেরুচ্ছে না। ক্রমশই তার দেহ হালকা হতে থাকে। ক্রমশই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে সংযম দেখা দেয়। তার নানা দূরদর্শন ও দুরশ্রুতি হতে থাকে।

ব্রহ্মাণ্ডের নানা অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসও তার নজরে পড়ে। এর কারন তখন তার শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। শাসন করে যারা মনকে সংযমে রাখতে চায়। তারা আসলে মনের কতগুলি স্বাভাবিক ক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখে। মানুষের ভিতর নানা যে সুক্ষ্মাস্তর আছে, অবরুদ্ধ কামনা-বাসনাগুলি তখন তার উপর আবরণ সৃষ্টি করে তার দৃষ্টিকে ঢেকে দেয়। এবং তাদের পক্ষেই সহজে অতিন্দ্রিয় জগতে পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ‘ব্রহ্মচর্য’ মানে যে নিশ্পাত বীর্যধারণ তা নয়। ‘ব্রহ্মচর্য’ অর্থ হল সংযম, সাম্য, BALANCE । হিন্দুমতে, মানুষ তিন গুনের অধীন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ । এই তিন গুণের কোন গুন অতিরিক্ত প্রবল হলে সাম্য নষ্ট হয়। হিন্দুদের জীবনে আছে চারিটি আশ্রম – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। এর মধ্যে সংযম থাকলেই যথার্থ ব্রহ্মচর্য হয়। 

হিন্দুমতে আছে, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ অর্থাৎ সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে চলা, টাকা-পয়সা উপার্জন করা, ভোগ করা আবার সত্যজ্ঞান লাভ করে মোক্ষ লাভ করা। এই চারটি আদর্শের মধ্যে যিনি সাম্য রাখতে পারেন, তিনিই ‘ব্রহ্মচারী’। ব্রহ্মাচার্য যদি নিশ্পাত বীর্যধারণ হত তাহলে বিশিষ্ট শত পুত্রের জনক হয়েও ‘ব্রাহ্মণ’ শ্রেষ্ঠ হতেন না বা যাজ্ঞবল্ক্য দুই বিবাহ করেও ব্রহ্মাজ্ঞ পুরুষ হতে পারতেন না।

 চলবে..................

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন – পর্ব- ১০

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে) 

"মেরামতে তাই দক্ষ
অতি শ্রমিক তার অধিপতি।”

 যে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়াতে ঘুমন্ত মুলাধারস্থ শক্তি (ENERGY)বিকিরণ করে, সেই স্থুল শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়াকে সুক্ষ্ম করতে পারলে জ্যোতির্ময় বায়ুর শক্তি আরও বেড়ে যায়। শক্তিশালী বায়ু তখন মূলাধারে ১০ শতাংশ অপেক্ষাও অনেক বেশি শক্তিতে জাগরিত করতে পারে। বায়ুকে শক্তিশালী করার পদ্ধতির নাম ‘প্রাণায়াম’। ‘প্রান’ অর্থাৎ বায়ু, ‘আয়াম’ মানে নিয়ন্ত্রণ। যিনি শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন, তিনি বায়ুর শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেন। বায়ুর শক্তি বৃদ্ধি মানে বায়ুর স্থুলতা নাশ। বায়ুর স্থুলতা নাশ হবে বায়ু যত কম প্রবাহিত হবে তত। শ্বাস প্রশ্বাস যত কম বইবে ও কম বিলম্বিত হবে অর্থাৎ নাসারন্ধ্র থেকে নিচের দিকে যতই কম যাবে ততই তার শক্তি বৃদ্ধি পাবে। হোমিওপ্যাথি ওষুধের পটেন্সির মত যতই তার পরিমান কম,ততই তার সুক্ষ্মতা ও শক্তি বেশি। বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য নাক টিপে প্রানায়াম করার বিধান আছে। যাকে বলা হয় রেচক,পুরক ইত্যাদি। এসব কৃত্রিম পদ্ধতি। স্বাভাবিক পদ্ধতি হলঃ মনকে কোন বিষয়ে নিবদ্ধ করা। মন কোন বিষয়ে নিবিষ্ট চিত্ত হলে স্বাভাবিক ভাবেই বায়ুর ক্রিয়া কমে যাবে। পরিমানে শ্বাস ও প্রশ্বাস কমও বিলম্বিত হয়। যে কোন মানুষ সহজেই তার প্রমান পেতে পারেন – রুদ্ধশ্বাস কোন বইয়ের কাহিনী পড়ার আগে নাসারন্ধ্রে একবার হাত দিয়ে দেখুন। এবং তারপর বই পড়ার সময় নাসারন্ধ্রে হাত রেখে দেখুন। তাহলেই শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়ার পার্থক্য বুঝতে পারবেন। মন যত একাগ্র হবে বায়ু অর্থাৎ শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া ততই সুক্ষ্ম হবে আর শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া যতই কমবে তার শক্তিও ততই বাড়বে।

মূলাধারস্থিত শক্তি থেকে ১০ ভাগেরও বেশি এনার্জি বিচ্ছুরিত হলে উত্তাপে তা ব্যারোমিটারের পারার মত গলে যাবে। তখন সে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজবে। মেরুদণ্ডের রন্ধ্রপথ দিয়ে উপরে উঠতে চাইবে। মূলাধার এক ধরনের গর্ত বা CAVITY তে সুপ্ত থাকে। এই গর্তকে বলা হয় অনার্য ভাষাতে ‘কুণ্ড’। কুণ্ডস্থিত শক্তির এজন্য নাম হয়েছে ‘কুণ্ডলিনী’। 

মেরুদণ্ডের অভ্যন্তরস্থ রন্ধ্রপথে নানা স্থানে আবর্জনা জমে বন্ধ হয়ে থাকে। এই আবর্জনাগুলি হল কামনা, বাসনা, লোভ-লালসা, হিংসা- বিদ্বেষ, গীবত, অহঙ্কার, রাগ, সন্দেহ।  দেহের আবর্জনা আবেগ।  ছয়টি ক্ষেত্রে এই জঞ্জাল অত্যন্ত বেশি। এই ছয়টি ক্ষেত্রই ‘জট চক্র’ নামে পরিচিত। শক্তি উপরে ওঠার সময় প্রবল বেগে এই আবর্জনাগুলিকে সরিয়ে দিতে চায়। ফলে তার প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দেহ নড়ে ওঠে। এঁকে বলা হয় ‘দেহ কম্পন’। বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়োজনে মনঃসংযোগের ক্ষেত্রে এজন্য তিনটি পর্যায় আছে। যাকে বলে যোগঘর্ম, কম্পন ও ভুমি ত্যাগ। ভুমিত্যাগই হল আসনের শ্রেষ্ঠ পর্যায়। এই সময় মানুষের জিহ্বারও ক্রিয়া আরম্ভ হয়। কারণ জিহ্বার শেকড় রয়েছে মূলাধারে। শক্তির চাপে এই জিহ্বা তখন বিলম্বিত হয়। কখনও বড় হয়ে বাইরে আসে। কখনও ঘুরে অর্থাৎ উল্টে গিয়ে নাসারন্ধ্র অর্থাৎ নাক বন্ধ করে শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়াকে রুদ্ধ করে দেয়। তখন বায়ু গতিহীন হয়ে প্রবলতর হয়। মুলাধার থেকে অকল্পনীয় শক্তি সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। জিহ্বার এই বিলম্বিত ভাবই ‘খেচরীমুদ্রা’ নামে পরিচিত। শুন্যে ঝুলন্ত দেহের ভারসাম্য রাখে তখন এই জিহ্বা। এসব হল দেহতত্ত্বের ক্রিয়ার কথা। এর সঙ্গে যুক্ত আছে অসংখ্য শিরা-উপশিরাও। যাকে তন্ত্র শাস্ত্রে ‘ইড়া’, ‘পিঙ্গলা’, ‘সুষুম্না’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তন্ত্রবিদদের মতে, দেহের মধ্যে বাহাত্তর হাজার (৭২,০০০) বা ততোধিক শিরা উপশিরা আছে কিন্তু এসব জটিল তথ্যের খোঁজ না করেও শুধুমাত্র মনসংযোগ ক্রিয়া করতে পারলেই যে কোন ব্যক্তি যোগ সিদ্ধি অর্জন করতে পারেন। 

চলবে.........

রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শন – পর্ব-৯

(পুর্বপ্রকাশের পর হতে)


“শব্দ হয় পরিচালক সনাক্ত করে সর্বলোক,
শ্রমিক তার মানবজাতি খাটছে তাই দিবা-রাত্রি।"

দ্বিতীয় পর্বে আল্লাহর ফুঁৎকারের কথা বলা হয়েছে। যে জ্যোতির্ময় “ফুঁ” উনি মানব দেহে প্রবেশ করান সেটা মাথার তালু থেকে কুণ্ডলিনি গর্তে প্রবেশ করে,যখন মানুষ জন্ম গ্রহন করে পৃথিবীতে আসে তখন মানুষের মাথার মাঝখানে তুলার মতন তুলতুলে নরম থাকে। মাথার তালুর এই অবস্থানকে বলা হয় ব্রহ্মরন্দ্র।
ব্রহ্মরন্দ্রের শুন্যস্থিত সুপ্ত শক্তি ফুটে ওঠার আবেগ পাওয়া মাত্র তা “বোধ” অর্থাৎ “আছি” এই বোধ সৃষ্টি করেন। এই বোধই হল চিৎ বা চৈতন্য। শূন্যতা অবর্ণনীয়, কিন্তু চিৎ বর্ণনীয়। চিৎ এর অবস্থা স্বচ্ছ দর্পণের মতন অর্থাৎ আয়না মহল। আনন্দের অবস্থা জ্যোতিপূর্ণ, এই জ্যোতি ভ্রু মধ্যস্ত আজ্ঞাচক্র অবধি নেমে আসার সময়—সূক্ষ্ম বর্ণ রূপে স্তরে স্তরে নেমে আসে অর্থাৎ যথার্থ বর্ণের Essence বা তন্মাত্র অবস্থায় নেমে আসে, এইহল বীজের মধ্যে মহীরুহের তন্মাত্র অবস্থায় থাকার মতো। আজ্ঞাচক্রে এসে এই তন্মাত্র বর্ণ গুলি বিস্ফোরণের আকারে অসংখ্য বর্ণদ্যুতি বিকিরন করে, বিশুদ্ধচক্রে নেমে তা স্বচ্ছ নীল বর্ণ ধারণ করে। অনাহুত পর্যায় এলে আকাশের নীলিমার রং প্রাপ্ত হয়। মণিপুরে তা তেজোময় ধুম্রপুঞ্জের মতো হয়।

স্বাধিষ্টান সবুজ বর্ণ ধারণ করে। মূলাধারে লাল বর্ণ হয়। তাত্ত্বিক তন্ত্র শাস্ত্রের সঙ্গে এর হয়তো মিল হয় না কিন্তু যারা ক্রিয়াযোগে অভ্যস্ত তারা চৈতন্যধৃত অভিজ্ঞতায় উপরোক্ত বর্ণগুলিই প্রত্যক্ষ করেন। বর্ণের এই প্রত্যক্ষকরন অবরোহ পর্যায়ে হয় না। হয় আরোহ পর্যায়ে। এই পর্যায়ের স্বরূপ বুঝতে গেলে শক্তির স্বরূপও কিছুটা জানা দরকার।

শূন্যস্থিত শক্তি আবেগ জনিত কম্পনে বিস্ফোরিত হলে কেন্দ্র থেকে সম্প্রসারিত হয়ে দুরে সরে যেতে থাকে। এই সম্প্রসারণ অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে দুরে সরে যাওয়াকেই বলে অবরোহণ। মানুষের দেহে ব্রহ্মরন্ধ্ থেকে নামতে নামতে এই শক্তি মূলাধারে এসে স্থূলত্ব লাভ করে । যেমন বিশ্ব জগত একান্নতম পর্যায়ে কেন্দ্র থেকে দুরে সরে এসে বৃত্তের প্রান্তে স্থুলতা প্রাপ্ত হয়। শক্তি স্থুলতা প্রাপ্ত হয়ে মূলাধারে এসে ঘনীভূত হলে দেহ যন্ত্রের শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া প্রতিনিয়ত যেখানে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে যে তাপ উৎপন্ন করে সেই তাপে দেহ জীবিত থাকে। মূলাধারের অবস্থান মলদ্বার ও প্রসাবদারের মাঝখানে। শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া সেখানে এসে কিভাবে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে, যে কোন ব্যক্তি শ্বাসপ্রশ্বাস কালে গুহ্যদ্বারে হাত দিয়ে দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন যে, প্রতি শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া সেখানেও ওঠা-নামা হচ্ছে। এটা হল অতি স্থুল পর্যায়ের ওঠা-নামা। এতে দেহকে জীবিত রাখার জন্য মূলাধারের সুপ্ত শক্তিতে যতটুকু আঘাত করা প্রয়োজন ততটুকুই আঘাত করা হয়। ফলে মানুষের চেতনা স্থুল পর্যায়ে থাকে। এই স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস এক এক জন মানুষের ক্ষেত্রে এক এক মানের।

জগতে যারা মনীষী ব্যক্তি বলে পরিচিত তাদের এই শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়ার মুলাধারস্থ সুপ্ত শক্তিকে আঘাত হানার ক্ষমতা বেশি। সাধারন সুপ্ত শক্তির একশ ভাগের দশ ভাগ শক্তি এর ফলে জাগরিত হতেপারে, তার বেশি নয়। এই দশ ভাগ শক্তি যাদের জাগরিত হয় তারা জগতের আইনস্টাইন শ্রেণীয়ে চিন্তাবিদ হিসাবে বিশেষ মনীষী বলে গণ্য হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই শক্তি তিন,ছার,পাচ অথবা ছয় শতাংশ ভাগে জাগরিত হয়। কিন্তু যারা দেহতত্ত্বের কলা কৌশল জানেন এবং জ্যোতির্ময় বায়ুর স্বরুপ বোঝেন, তারা এই শক্তিকে আরও বেশি করে জাগরিত করে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন। কারণ Astrophysics এ দেখা গেছে যে, শক্তির ঊর্ধ্ব গতি হলে এর মাত্রা বেড়ে যায় এবং মাত্রা বেড়ে গেলে ভেতর বাইরে চলে আসে। অর্থাৎ INSIDE TURNS OUT । এরই ফলে নিজের ভেতরে অনন্ত বিশ্বকে দেখা যায়।
 
চলবে......

শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭

ধ্যানে দেহ জগত দর্শনঃ - পর্ব - ৮



(পুর্ব প্রকাশের পর হতে) 

পৃথিবী গ্রহ ক্ষুদ্র মেশিন প্রভু তার গোসা নশিন।
--------------------------------------------

এই অনুকে বিস্ফোরিত করলে জগত সৃষ্টির নিয়ম অনুসারেই ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ একটি অনুর মধ্যে ক্ষুদ্র বিশ্ব ফুটে ওঠে যাকে ইংরাজীতে বলা যায় ‘MINIATURE UNIVERSE’। একটি অনুর ভিতর যেমন জগত সৃষ্টিক্রিয়া এইভাবে ক্রিয়াশীল তেমনই প্রতিটি জীব ও মানুষের ভিতর এই ধরণের সৃষ্টি রহস্য কর্মরত। মানুষের দেহতত্ত্বের সেই খবর জানা গেলেই মানুষের সুক্ষ্ম দর্শন,অনুভুতি ও শ্রুতির প্রমান পাওয়া যাবে।


মানুষের দেহে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে মুলাধার পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিশ্ব জগতের সুক্ষ্মতম ও সুক্ষ্মতর থেকে স্থুল পর্যায়ের উপাদান রয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডের ছায়াপথগুলি যেমন ভাসমান অজুত কোটি নক্ষত্র দিয়ে তৈরি তেমনই মানুষের দেহও কোটি কোটি কোষ দিয়ে নির্মিত। যেমন জগতে যা বিদ্যমান তেমনই মানুষের দেহেও সমন্বয়,বৃদ্ধি ও ক্ষয় সবই আছে। দেহতত্ত্বে ব্রহ্মরন্ধ্রকে ধরা হয়েছে শুন্যতা স্বরূপ। তার পরের স্তরে রয়েছে বিস্ফোরণের আবেগজনিত অবস্থা। তারপর বিস্ফোরণজনিত জ্যোতি আলো এবং একেই বলা হয় সৎ+ চিৎ+আনন্দ বা বিন্দু। সৎ হল শুন্যতা। চিৎ হল বিস্ফোরণের আবেগজনিত বোধ এবং আনন্দ হল বিন্দু। এই বিন্দু বা বিস্ফোরণের জ্যোতির্ময় আলো থেকে স্তরে স্তরে বিস্ফোরণজনিত কম্পন বা VIBRATION নিচে নেমে এসেছে। বিশ্বসৃষ্টির মতই এই তরঙ্গ একান্নটি। মুলত তাকে সাতটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে - দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডস্থিত ছটি চক্র ও ব্রহ্মরন্ধ্রের নিকটস্থ সপ্ততল। সর্বোপরি রয়েছে চিত্ত ও সৎ। এক একটি চক্র ও সপ্ততলে রয়েছে সাতটি করে আরও সুক্ষ্মতর পর্যায় অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে ৪৯টি পর্যায়। সর্বোপরি দুই পর্যায় দিয়ে ৪৯+২=৫১ পর্যায়। ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে মুলাধার পর্যন্ত সৃষ্টিক্রিয়া একটি দেহকে কেন্দ্র করে যেভাবে নেমে আসছে তা নিম্নরূপঃ




চলবে...............