পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

স্বরলিপি-স্বর্বেসত্ত্বার প্রকাশরুপঃ শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

-খান্নাস মানে কি? জানস?

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যাসা করলেন। আমি বললামঃ

-জানি না।

-খান্নাস মানে অইলো যে কুমন্ত্রণা দেয়? কেমতে দেয়? দেখবি খেয়াল কইর‌্যা-তুই যদি কোন একটা বিষয়ের দিকে গভীর মনোযোগ দেস, তখন তর মনোযোগ নষ্ট করার জন্য হেইড্যা আরেকদিকে লইয়্যা যাইব। ধর, তুই একটা মাইয়্যার দিকে তাকালি। তারপর হেই মাইয়্যার দিকে তাকানোর পর ঐ মাইয়্যাডার ছবি তর মনে কামনার ভাব জাগাইলো। তোরে কে যেন কইবো-দ্যাখছস কি সুন্দর একটা খাসা.....এই যে তোরে একটা খারাপ কাজের দিকে নিয়্যা যাইত্যাছে......এইডাই অইলো খান্নাসের কাজ। 
হোন, মানুষের মইধ্যে ছয়ডা খারাপ জিনিস আছে। হেইগুলিরে কয় রিপু। হেইগুলি অইলোঃ কাম,ক্রোধ,লোভ,মোহ,মদ, মাৎসর্য্য। এই ছয়ডারে কোন কোন গানে কইছে চোরা...ছয় চোরা...এইগুলিরে দুর করার চেষ্টা করবি। বুঝলি....

-এই গুলো দুর করলে কি হবে?

-এইগুল্যা দুর অইলে তোর মনডা পবিত্র অইয়্যা যাইবো গা। এইডারে কয় তাজকিয়ায়ে নফস। তুই পাক পবিত্র অইয়্যা হের (সৃষ্টিকর্তার) কাছে থিক্ক্যা আইছোস। আবার হের কাছেই ফিরর‌্যা যাইতে অইবো পাক পবিত্র অইয়্যা। যতক্ষুণ তুই তোরে পবিত্র না কইর‌্যা দুইন্ন্যা থিক্ক্যা বিদায় না নিবি...ততবার তোর পুনঃজন্ম  অইবো। খালি বার বার এই দুইন্ন্যার মইধ্যেই আওয়া যাওয়্যার মইধ্যেই থাকবি। খালি আবি আর যাবি...যত আবি তত তোর দুঃখ বারবো।

-আচ্ছা ঠিক আছে। সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্ত্তু আপনে যে কথাগুলো বলছেন, সেটা কি কোরআনে আছে?

-থাকবো না ক্যা..তুই কি সুরা ফজর পরস নাই...ইয়্যা অাইয়্যাুহাল নাফসুল মুতমাইন্ন্যা...ইরজিইলা রাব্বিকি রাদিয়াতুমমারজিয়্যাতাম। ফা ইদখুলি ফি ইবাদি ওয়াদখুলি জান্নাতি। হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।

-না। অামি সত্য কথাটাই বললাম। 

-হুম। তুই কি জানিস, কোরআন কি?

-কোরআন অাল্লাহর বাণী। কোরআন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপর অাল্লাহ পাক হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর মাধ্যমে নাযিল করেছেন।

-যেইখানে আল্লাহ পাক বলতাছেঃ ওয়া ফি আনফুসিকুম আফালা তুবছিরুন। নাহনু আকরাবু ফি ইলাহি হাবলিল ওয়ারিদ। আমি তোমার সাথেই আছি অতঃপর তোমরা কি দেখতে পাও না? আমরা তোমার শাহ রগের নিকটেই আছি....আর তুই কস আল্লাহর বাণী আননের লিগ্যা হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর দরকার অইছে? ক্যা, হেয় কি কতা কইতে পারে না?...মাঝ খান থিক্ক্যা জিব্রাইলরে আনলি.....তুই কি জানস বাণী কি? বাণী মানি অইলো কতা। কতা কওনের লিগ্যা মুখ লাগে। মুখের লগে স্বরনালী লাগে। আইচ্ছা তুই ক স্বরবর্ণ কি? নাহ্ তর কওনের দরকার নাই। স্বর বর্ণ অইলো যেই বর্ণ উচ্চারণের লিগ্যা স্বরযন্ত্র লাগে। স্বর যন্ত্র কারে কয়, জানস? স্বরযন্ত্র অইলো - মুখ,দাঁত,তালু, জিহ্বা, আলজিহ্বা ইত্যাদি মিল্ল্যা অয় স্বরযন্ত্র। হেই স্বরযন্ত্র উচ্চারণের স্থানের কারণে বিভিন্ন নাম অইছে। যেমুন সরে অ, সরে আ হ্রঅ ই, দীর্ঘ হ্রঅই.........এইগুলি কই থিক্ক্যা আহে...ক দেহি....এই গুলা আহে অন্তরের অন্তঃস্থল থিক্ক্যা...হেই হানেই হেয় বইয়্যা কতা কয়..ধ্যানে বইলেই তুই দেকতে পারবি....কইথিক্ক্যা কতার উৎপত্তি অয়...কেডা কতা কয়...চাইরট্যা পবিত্র শক্তি জাগাইতে পারলেই কোরআন নাজিল অয়...হেই চাইরডা পবিত্র শক্তি অইলোঃ আলমে লাহুত, আলমে জবরুত, অালমে হা-হুত, আলমে নাসুত। সবগুলির মইধ্যেই চারজন ফেরেস্তা থাকে..হেই ফেরেস্তা অইলো....

-হালার পো...ফাইজলামির আর জায়গা পাও না...এতক্ষণ তর বকবকানি শুনছি। তুই আমারে স্বরবর্ণ ব্যান্ঞ্জন বর্ণ শিখাস? আমি কি লেখা পড়া করি নাই? নাকি না শিখেই চাকরি করছি...তোর মতন পাগল ছাগলের সাথে বসাটাই আমার ভুল হইছে...কেন যে তোর কাছে বসলাম...যা ব্যাটা...তুই কি বেশি জ্ঞানী অইয়্যা গেছস...
আমি কথাগুলো বলে ঐ ব্যাটার কাছ উঠে দাঁড়ালাম।

-কি রে জাহিদ...তুই কার সাথে কথা বলছিস...আর এই কলা, রুটি, পানি নিয়ে এই অন্ধকারে তুই কি করছিস...

আমি পেছনে তাকাতেই দেখি সাদেক আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখে। সাদেক আমার রুমমেট। সাদেককে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও মনে সাহসের সঞ্চয় হলো। আমি সাদেকের দিকে তাকিয়ে বললামঃ

-এই হালার পাগল ছাগল আমারে কি সব আজে বাজে কথা বলছে...পবিত্র কোরআনের বাণীর অবমাননা করছে...কি সব বকবকানি..যত্তসব ছাগল পাগলের দল....গাধা কোনখানের...

-কই? আমিতো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না..কেউ তো সেখানে নাই। তুই তো একা একা বির বির করছিস। তোর কথা শুনে আমি দেখতে চাইলাম....তুই কার সাথে কথা বলছিস...

-এই যে....এই যে এইখানেই....
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই। পানির বোতলটা সেখানেই পড়ে আছে। রুটি, কলাগুলো সেখানেই পড়ে আছে। তাহলে আমি কার সাথে কথা বললাম....কে আমাকে বললোঃ আমার খুব খিদে লেগেছে..আমাকে রুটি কলা কিনে দে....আমি প্রায়ই জ্ঞান হারাতে বসেছিলাম...ঠিক সেই মুহুর্তে সাদেক আমাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ

-চল...বুঝেছি। আর দাঁড়াস না...তাড়াতাড়ি কর। চল্ মেছে যাই....

যেতে যেতে সাদেক বললো-শোন, বছর প্রায় চার/পাচ হবে। এই এলাকায় একটা পাগল গোছের লোক থাকতো। সে কি সব তরীকত ফরিকত করতো। আর লোকজনের দেখা পেলেই নানান সব কথা বলতো। পাগল মানুষ। কেউ তার কথা আমলে নিতো না। লোকজনের কাছে চেয়ে চিন্তে এটা ওটা খেতো। লোকজনও তাকে খাওয়াতো। কোন একটা কারণে লোকজন তাকে চোর ভেবে পিটিয়ে আধ মরা করে ফেলে। তার হাত পা ভেঙ্গে যায়। চলতে পারে না। কিছুদিন সেই লোকটা মারা যায়। তারপর শুরু হয় অন্য কাহিনী। নির্জনে কাউকে একা পেলেই সে দেখা দেয় এবং কিছু খায়নি বলে এটা ওটা অানায়। তারপর একসময় দেখা যায়...যে লোকটার সাথে কথা বার্তা বলছিল, সেই লোকটা সেখানে নাই....এই হলো এই পাগলের কাহিনী। তুই মনে হয় তাকেই দেখছিলি...

সাদেকের কথা শুনে আমি কেমন যেন ঘাবড়ে গেলাম। রুমে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেলাম। তারপর বাতি নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়লো। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্ত্তু ঘুম আসছে না। মনে হলোঃ আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। লোকটি আমার কাছে খাবার চাইলো। আনলাম। সে আমার সামনেই খেল। তারপর সে পবিত্র কোরআন শরীফের তরজমা করে শোনালো...কথা বললো। কথার শব্দ মালা কোথা থেকে উৎপত্তি হয়, সেটা বললো। কে কথা বলে.....সেটাও বললো......আমিতো সব কথাই নিজ কানেই শুনেছি। কিন্ত্তু লোকটি গেল কোথায়......কিভাবে গেল.......রাত প্রায় পৌণে চারটা বাজছে। আমার পাশে কেউ নেই। সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ...তাদের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে...আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর চোখ বুঁজে সেই কথা চিন্তা করছিলাম। কোন শব্দ নেই...সুশান নীরবতা...আমি চোখ বুঁজতেই শুনতে পেলাম আমার হৃদস্পন্দন লাব..ডুব...লাব...ডুব....লাব...ডুব .......কে বলছে....কে শব্দ করছে....তাহলে কি সে.ই এই শব্দ করছে.......

সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬

স্বরলিপি-সর্বেসত্ত্বার প্রকাশরুপঃ প্রথম পর্ব

আমি যেদিকে থাকি, সেদিকটা হচ্ছে মীরপুর ১নং গোলচত্ত্বরের পিছনের দিকটায়। অর্থাৎ কলওয়ালাপাড়া মসজিদের গলি। সেই গলিটা থেকে কিছুদুর আগালেই পড়ে লন্ডন হারবার। তার ঠিক পেছনটায় একটা টিনশেডের একটা মেছ আছে। সেই মেছে। গলিটার মাথায় বেশ কিছু ল্যাম্পপোষ্ট আছে। কিন্ত্তু সেই ল্যাম্পপোষ্টের অধিকাংশ ল্যাম্পই ফিউজ। তাই গলিটা অন্ধকারে ঢেকে থাকে। মাঝে মাঝেই ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। তাই আমি ভয়ে ভয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছি। যেহেতু আজ দেরী হয়ে গেছে...তাই দ্রুতই হেঁটে যাচ্ছি। ঠিক সেই সময় একটা ডাক শুনতে পেলামঃ

-এই খোকা, এই দিকে আয়...

আমি চার ধারে তাকালাম। কাকে ডাকছে? কে ডাকছে? তাছাড়া আমাকে তো খোকা বলার কোন কারণ নেই। আমি আবারো তাকালাম। নাহ্ কাউকেই তো দেখছি না....তাহলে কে ডাকছে এই খোকা বলে...আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমার মতো করে। যখন আমি হাঁটছি...ঠিক তখনই আবার সেই ডাকটা শুনতে পেলাম...এই খোকা এইদিকে আয়তো বাবা....

অামি আবারো পিছন দিকে তাকালাম। ভালো করে খুঁজে দেখার জন্য একটু পেছনের দিকেও আগালাম। ঠিক তখনই দেখতে পেলাম-একটা লোক জীর্ণ শীর্ণ কংকালসার দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লোকটিই আমার দিকে ইশারা করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকছে...এই খোকা বলে...কিন্ত্তু আমাকে ডাকার কারণ কি? আমিতো খোকা নই...তাহলে আমাকে ডাকার কারণ কি? আর ডাকলেই কি? আমি কেন যা'ব? এই রকম সাত-পাঁচ ভাবছি আর ঠাঁয় দাড়িয়ে আছি।
 লোকটাকে দেখলাম কিছুটা স্মীত হাস্যবদনে আমার দিকে তাকিয়ে আবারো ইশারা করে ডাকলো। এবার আর সাত-পাচ না ভেবেই তার কাছে গেলাম এবং জিগ্যাসা করলামঃ

-আপনি কি আমাকে ডাকছেন?

-হ বাজান।
 লোকটা কথাটা বলতে বলতে মনে হলো হাঁপাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মনে হয় পড়ে যাবে।  আমি তাকে ধরে বসিয়ে দিলাম। সে বসে বললঃ

-বড়ো খিদা লাগছে...আমারে একটা কলা আর একটা পাউরুটি কিন্ন্যা দিবি?

-এত রাতে?  কোথা থেকে কলা রুটি কিনবো?
অামি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় পৌণে একটা বাজে। এত রাতে কি দোকান পাট খোলা থাকবে?

-থাকবো? 

-কি থাকবো?

-দোকান পাট খোলা থাকবো। 

-আপনে জানলেন কিভাবে? আমি বেশ অবাক হয়েই তাকে জিগ্যাসা করলাম।

-অামি কেমতে জানলাম, হেইডা তর জাননের দরকার নাই। বাজান,তুই মেন রাস্তার ঐপারে যা। যেই রাস্তাটা শাহ্ আলী বাবার মাজারের দিকে গেছে। ঐ জায়গায় গেলে দেখবি দোকান-পাট খোলা আছে।যা, বাবা । আমার বড্ড খিদা লাগছে...


লোকটির কাতর কন্ঠ আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিল। অামি না করতে পারছি না। আমার লোকটাকে এভাবে ক্ষুধার্ত দেখে তাকে ছেড়ে আসতেও পারছি না। ভাবলাম তাকে কিছু টাকা দিয়ে অামি বিদেয় হই। কিন্ত্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, লোকটি যদি হাঁটতেই পারতো, তাহলে সেতো বহু আগেই সেইদিকটায় চলে যেতো। অামি চিন্তা করতে করতে হাঁটছি আর মনে মনে বলছি কথাগুলো। আবার ভাবছি আমার মনের কথা লোকটা কিভাবে জানতে পারলো? তাহলে লোকটা কি মাইন্ড রিডার? অর্থাৎ মানুষের মনের কথা রিড করতে পারে? দেখাই যাক না...যা হয় হবে...আমি জোড় পায়ে হেঁটে মুল রাস্তাটা পার হয়ে ও পাড়ে গেলাম। দেখলাম সত্যি সত্যিই দোকান পাট খোলা আছে। আমি একটা দোকান থেকে এক বোতল পানি, একটা রুটি ও দুটা কলা কিনে আবার হাঁটা দিলাম লোকটার উদ্দেশ্যে। 
মেইন রাস্তা পাড় হয়ে পৌছালাম লোকটার কাছে। তার হাতে দিলাম কিনে আনা জিনিসগুলো। দেখলাম সে বেশ পরিতৃপ্ত। খেতে খেতে আমাকে বললোঃ

-তুই খাবি না?

-নাহ্ । আপনি খান।

-বাবা তোরে একটা কথা বলি। অামি কারো কাছ থেকে কোন কিছু নেই না...যারে পছন্দ হয়, তার কাছে থিক্ক্যা চাইয়্যা খাই। তোরে দেইখ্যা আমার খুব পছন্দ হইছে। তাই তর থিক্ক্যা চাইয়্যা খাইলাম। সব পাগল সমান না। আবার সব পাগলই তার পাগল না...

-তার মানে আপনে আমাকে পছন্দ করেছেন। কিন্ত্তু কেন? 

-তোর ভিতর একটা জিগ্যাসু মন আছে। হেইডা খালি জানতে চায়। বুঝছে চায়। শিখতে চায়। তুই তারে শিখা। দেখবি হেই শিক্ষা এক সুময় তোরেই শিক্ষা দিব। 

-আমাকে শেখাবে মানে?

 -মানে অইলো তর মনটারে তুই যুদি এক জায়গায় কেন্দ্রীভুত করতে পারস, তাইলে কি অয়? একটা বিন্দু অয়। হেইডা অইলো সেন্টার। তারে হেইহানে বহাইয়্যা দে। তার পর হোন হেয় কি কয়?

 -কি সব আজে বাজে কথা বলছেন? আপনার কথার আগা মাথাতো কিছুই বুঝতে পারছি না...

অামার একথা শুনে দেখলাম লোকটি হাসছে। তারপর খাওয়া শেষ করে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেড়টা বাজে। এখন বাসায় যাওয়া যাক। আমি যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, ওম্মনি সে বললোঃ

 -বস। তোরে কি কইছি..হেইডা তো বুঝবার পারস নাই...তাই না...

-জ্বি।

-তাইলে শোন। তর মন অইলো চৈতন্য বা চেতন সত্ত্বা।  হেয় সব সময় উথাল পাথাল থাকে। কারণ কি? জানস?

-না?

-কারণ অইলো মায়া। এই মায়ারে কয় খান্নাস মানি কুমন্ত্রণাদাতা।  যে কুমন্ত্রণা দেয়। কেমতে দেয়? জানস?

-না?

-কেন্ ? তুই সুরা নাস পড়স নাই? হেই হানেইতো লেখা আছে মিন সাররিল ও্য়াসু বিসুফিছুদুরহিন নাস। মিনাল জিন্নাতিওয়ান নাস। হেই ছুদুর মোকামেই থাকে খান্নাস।
 (চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬

সোনার মানুষঃ মনা পাগলার ভাবনা


সোলেমান ভান্ডারী একজন সাদাসিদে মানুষ। প্রাণোচ্ছল এবং প্রাণবন্ত মানুষ। সব সময় তার মুখে হাসি লেগেই থাকে। পেশায় একজন স্বর্ণকার। তার একটি দোকান আছে। নাম-সাদিয়া জুয়েলার্স। কাষ্টমার আসলেই হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানায়। আজ তিনি একটি কাজের অর্ডার পেয়েছেন। সেটা হলোঃ একটা পুরোনো বালাকে ভেঙ্গে নতুন করে ডিজাইন করা। সোলেমান এখন সেটাই করছেন। তার পাশে বসে আছে মনা পাগলা। মনাকে সোলেমান খুব ভালোভাবেই চেনে। সে প্রায়ই সোলেমানের দোকানে বসে খোশ গল্পে মেতে থাকে। তার সাথে বসে চা খায়। আজো সে বসে চা খাচ্ছে আর সোলেমানের কীর্তিকলাপ দেখছে। দেখলোঃ-

সোলেমান প্রথমে চুড়িটি ভেঙ্গে কেটে টুকরো টুকরো করে একটা বাটিতে রাখলো। তারপর সেটাতে কিছুটা সোহাগা মেশালো। এরপর সেই বাটিতে এসিড ঢাললো। পরিমাণ মতো এসিড ঢেলে কয়লায় আগুন ধরিয়ে চুঙি দিয়ে ফুঁ দিয়ে কয়লাগুলোকে জ্বালানোর চেষ্টা করলো। যখন কয়লাগুলো আগুনের তাপে লাল টকটকে হলো, তখন সেই বাটিটা আগুনের উপর বসিয়ে দিল।

এসিড আগুনের তাপে ফুটতে শুরু করেছে। কেমন হাল্কা নীল বর্ণ ধারণ করে হাল্কা হলুদ রংয়ের ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। সেই ধোঁয়ায় একটা ঝাঁঝাঁলো গন্ধ কেমন যেন চোখে মুখে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে । মনা একটু নড়ে চড়ে বসলো। সেটা দেখে সোলেমান হাসি হাসি মুখে বললঃ

-দাদা স্বর্ণ পাকা করতাছি…

-বাপরে যেই গন্ধ...আচ্ছা দাদা, এসিডে কি স্বর্ণ সব গইল্যা যাইব গা...

-না দাদা...স্বর্ণের মধ্যে যে খাইদ আছে, হেইডা এই এসিডে খাইয়্যা শেষ কইর‌্যা দিব। তারপর যেইডা থাকবো হেইডা অইলো খাঁটি সোনা। এইডাতে কোন খাইদ থাকে না। এক্কেবারে পাকা সোনা। হেই সোনারে কোন এসিডে পোড়াইলেও আর খাইদ পাইবো না...

সোলেমানের কথা শুনে মনা কি যেন ভাবলো। সে যেন বুঝতে পারছে অন্য কিছু। উদাস ভঙ্গীতে সে চিন্তায় মগ্ন হলো। কিন্ত্তু সে কি চিন্তা করছে...তাকে চিন্তিত দেখে সোলেমান জিগ্যাসা করলোঃ

-কি অইলো দাদা...এক্কেবারে চুপ অইয়্যা গেলেন গ্যা..

-ভাবতাছি?

-কি ভাবতাছেন?

সোলেমানের কথা শুনে মনা বলে উঠলোঃ

-মাবুদগো তুমি আমারে এই স্বর্ণের মতোন খাঁটি কইর‌্যা এই দুইন্ন্যা থিক্কা নিও।

-হটাৎ কি এমুন অইলো, দাদা?

-ভাইরে, এই মাটির মইদ্যেই যখন আমাগো গোর অইব, তহন এই এসিডের মতোন কইর‌্যাই আমাগো পরীক্ষা কইর‌্যা দেকবো...আমরা কত্তদুর খাঁটি.....যুদি খাঁটি অই..তাইলে আর নতুন কইর‌্যা কোন কিছু বানাইবো না...হেমনেই রাইখ্যা দিব। আর যুদি খাঁটি না অই, তাইলে এই মাটির থিক্ক্যাই আবার নতুন কইর‌্যা বানাইয়্যা আবার দুনিয়্যাইতে পাডাইবো....ক্যা তুমি শুন নাই হাদিছে আছেঃ ইন্নাললাহা হারামা আলাল আরদে আরশাদুল আম্বিয়া...নিশ্চয়ই আমি হারাম করিয়া দিয়াছি মাটির জন্য আম্বিয়াদের দেহকে...অর্থাৎ মাটির সাধ্য নাই তাঁর প্রিয় বান্দাদের দেহরে নষ্ট করে। তাছাড়া কোরআন শরীফের সুরা বাকারার ১৫৪ নং আয়াতে আছেঃ
যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, তোমরা তা বুঝতে পারো না [ ﻭَﻻ ﺗَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﻟِﻤَﻦْ ﻳُﻘْﺘَﻞُ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺃَﻣْﻮَﺍﺕٌ ﺑَﻞْ ﺃَﺣْﻴَﺎﺀٌ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻻ ﺗَﺸْﻌُﺮُﻭﻥَ আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না বরং তারা জীবিত কিন্ত্তু তোমরা তা অনুভব করতে পার না। সুরা আল-বাকারাহ আয়াত নং-১৫৪]
তাছাড়া সুরা আলে ইমরানের ১৬৯নং আয়াতে বর্ণিত আছেঃ যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত; তারা আল্লাহর কাছ থেকে রিজিক পাচ্ছে [ ﻭَﻻ ﺗَﺤْﺴَﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻗُﺘِﻠُﻮﺍ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺃَﻣْﻮَﺍﺗًﺎ ﺑَﻞْ ﺃَﺣْﻴَﺎﺀٌ ﻋِﻨْﺪَ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻳُﺮْﺯَﻗُﻮﻥَ আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত, তাদেরকে রিয্ক দেয়া হয়। আলে‘ইমরান, ৩/১৬৯]

মনার কথা শুনে সোলেমানের মনে প্রশ্ন জাগেঃ

১. রিজিক কে খায়..জীবিতরা না মৃতরা?
২. মৃতরা কিভাবে রিজিক খায়…সেইটাই রহস্য রয়ে গেল সোলেমানের কাছে

[সংক্ষেপিত]

বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬

চক্রঃ মৃত্তিকার অন্যরুপের সৃষ্টি - মনা পাগলার অনুভব

মনা আজ পাল পাড়ায় ক্ষীরমোহন পালের বাড়িতে আসছে। তার উদ্দেশ্য কি, তা ক্ষীরমোহন ধরতে পারছে না। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, ক্ষীরমোহন চরকা ঘুরিয়ে কিভাবে মাটির পুতলা বানাচ্ছে ? সে বেশ ভাবুক ভঙ্গীতে বসে ক্ষীরমোহন পালের হাতের কারুকার্য পর্যবেক্ষণ করছে। ক্ষীরমোহন পাল তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনার দিকে তাকিয়ে জানতে চাচ্ছেঃ

-ওমন তাকাইয়্যা তাকাইয়্যা কি দেখতাছো মনা বাবু?

-দেকতাছি তোমার কীর্তি........

-হেইডা দেইক্যা তুমি কি করবা? তুমি কি বানাইতে পারবা?

-পারুম না দেইক্যাইতো তোমার কীর্তিকর্ম দেইক্যা সৃষ্টিকর্তারে বুঝবার চেষ্টা করতাছি...হেয় কেমুন কইর‌্যা মানুষ পুতুল বানায়...এই মাটি দিয়া.....একেকটা একক রকম...কি সোন্দর বার্নিশ করা....আবার ভিতরে কি সোন্দর বাত্তি জ্বালাইয়্যা রাকছে....দেকছোনি....

ক্ষীরমোহন এবার বুঝতে পারলোঃ কেন মনা এমন করে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ? সে সেটা বুঝতে পেরে বললোঃ

-ভাইরে....ভগবানের লীলা বোঝা ভার....আমাগো কি সাধ্য আছে এই মাটির পুতলা দেইখ্যা তারে বুঝবার পারি....হেয় তো কর্ম অনুসারে চরকা ঘুরাইয়্যা এই মাটি দিয়াই সবকিছু বানাইতাছে....হগ্গলতেরে এই মাটি দিয়াই সৃষ্টি করতাছে...অবিরাম অনবরত... মইর‌্যা গেলে এই মাটির মধ্যেই হান্দাইয়্যা থুইতাছে....পইচ্যা গইল্যা হেইডাই আবার অন্যরুপে অন্য কোন ক্ষীরমোহনের হাতে পইর‌্যা এই মাটির পুতল্যা অইয়্যা আবার দুইন্যাইতে আইতাছে....আগুনে পুড়ুক আর পানিতে পরুক...যেইভাবেই মরুক না কেন্......

মনা ক্ষীরমোহন পালের কথা শুনে বললোঃ

-কিন্ত্তু আমি ভাবতাছি অন্য কতা। সৃষ্টিকর্তা যে চরকা বানাইছে....হেই চরকায় পইর‌্যা কত জনম জানি ঘুরতাছি....আইজক্যা মনা পাগলা....কাইল মরণের পর কি অমু...কোন্ ক্ষীরমোহনের হাতে পইর‌্যা কোন্ পুতল্যা অমু....মাটির পুতলা না-কি মাটির কুত্তা বিলাই...নাকি মাটির হাত্তি ঘোড়া...কি যে অমু কইতে পারতাছি না...যুদি জানতে পারতাম....আহা...রে....

" সুব.ই.আজল ইয়ে মুঝছে কাঁহা জিব্রাইল নে
জো আকাল কা গুলাম হো...ও দিল না কার কবুল "।
-আল্লামা ইকবাল।

একটি প্রশ্ন, মাকড়শা এবং মনা পাগলার উত্তরঃ অনুভবতার এক নতুন দিগন্ত

মনার মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল বহুদিন থেকেই। কিন্ত্তু উত্তরটা জানা ছিল না। আজ মশাং বাজারে জুনাব আলীর দোকানে চা খেতে এসে সে উত্তরটা পেয়ে গেল। উত্তরটা পেতেই সে অতি উচ্ছ্বাসে নৃত্য আরম্ভ করলো। তার পাগলা নাচ দেখে আশে পাশের সমস্ত লোকজনের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। মনা সেটা থোড়াই কেয়ার করে। সে সেদিকে না তাকিয়ে নিজের মতো করেই নৃত্য করতে লাগল। আর গাইতে আরম্ভ করলোঃ

কতো কি সহিব নাথ, আমিতো আমারও নই
কেমনে চরণে র'ব আমিতো আমার নই।।

মনার গান থামতেই রজব আলী বয়াতী তার একতারাটা নিয়ে মনার হাতে সঁপে দিল। মনা সেটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলো। আর তারটাতে হাল্কা টোকা মেরে টুংটাং শব্দ করতে লাগলো। সে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে যন্ত্রটার দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উপর দিকে মাথা তুলে বললোঃ

উপহার দিব কি গো কি আছে আমার নাথ
তোমারইতো দেওয়া সবি কোথা কি পা'ব সই।
রজব আলী বয়াতি মনাকে প্রশ্ন করলোঃ
-মনা ভাই, তোমার এতো খুশির কারণ কি?

শুনে মনা বললোঃ

-আমার একটা প্রশ্নের উত্তর জানার প্রয়োজন ছিল। কিন্ত্তু সেটা পাচ্ছিলাম না। আজ এই মেলায় এসে সেই প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম একটা মাকড়াশার কাছ থেকে।
-মাকড়শার কাছ থেকে? মাকড়শার কথা শুনে রজব আলী আশ্চর্য্য হয়ে গেল।

সেটা দেখে মনা বললোঃ

-দ্যাখেন, একজন কুম্ভকার যখন কোন কিছু তৈরী করে, সেটার জন্য কিছু উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। যেমন মাটি, পানি, আগুন, বাতাস, আকাশ ইত্যাদি। আমার মনে প্রশ্নের উদয় হলোঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন যে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, সেই সৃষ্টির উপাদান তিনি কোথায় পেলেন?

বাহ্যিক দৃষ্টিতে আপনি যদি দেখেন, দেখবেন সমস্ত উপাদানগুলিই এই মহাবিশ্বে ছড়ানো ছিটানো ছিল। একজন কুমারের কথা চিন্তা করেন। দেখবেন, কুমার যে জিনিসটি তৈরী করতে চান, সেটা তার মাথায় একটা উপাদান হিসেবে কেন্দ্রীভুত ছিল। সেই কেন্দ্রীভুত চিন্তারেখাকে বাস্তবায়ন করার জন্য তার যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন ছিল, সেগুলি সংগ্রহ করে তারপর সে তার কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে বস্ত্তুটি সৃষ্টি করেন। যেমনঃ মাটির হাঁড়ি কুড়ি, ফুলদানি, ব্যাংক, মুর্তি ইত্যাদি।
আবার বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করেন। হাঁড়ি কুড়ি, ফূলদানি, ব্যাংক, মুর্তি ইত্যাদি ঐ মাটির মধ্যেই নিহিত ছিল। কুমারের হাত ধরেই তারা বাস্তবতার রুপ নিল। তার মানে, ঐ হাঁড়িকুঁড়ির জন্য একজন সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন ছিল। আর সেটা হলোঃ কুমার।

-কি বলেন ভাই?

-আমি ঠিকই বলছি। কেবল চিন্তা-ভাবনাটা আপনার। আপনি কি আমার চিন্তা-চেতনা ধরতে পারছেন কি-না? সেটা হলো বড়ো কথা....

-তাইলে এইবার কন, আল্লাহয় এই দুনিয়্যা সৃষ্টি করার উপাদান কৈ পাইলো?

-এই বিষয়টা উপলব্দি করার জন্য আপনাকে তাকাতে হবে একটা মাকড়শার দিকে। দেখবেন, মাকড়শা যে জাল বুনে, সেই জাল বুনার জন্য যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন পড়ে, সেটা তার নিজের ভেতরই ছিল। সেটা কি? সেটা হলো তার লালা। অর্থাৎ তার মুখনিঃসৃত রসাবলী। সেটা দিয়েই সে জালটা তৈরী করে। ঠিক তদ্রুপ, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এই জগত সৃষ্টির জন্য যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন ছিল, সবই তার মধ্যে নিহিত আছে। সেই জন্য সে কারো মুখাপেক্ষী নয়। তাইতো বলা হয়েছেঃ

তোমারইতো দেওয়া সবই কোথায় কি পা'ব সই।

-কন কি ভাই?

-শুধু তাই নয়। কোরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ আল্লাহু কুল্লিশাইইন মুহিত। অাল্লাহ যিনি প্রতিটি বস্ত্তুর মধ্যেই নিহিত আছেন তথা দ্রবীভুত অবস্থায় আছেন। তাহলে সমগ্র জগতের প্রতিটি বস্ত্তুই আল্লাহসত্তাময়। আল্লাহ ব্যতীত কিছুই নেই। লা মউজুদা ইল্লাল্লাহ....

মনার কথা শুনে রজব আলী বয়াতি মনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাই দেখে মনা বললোঃ
বুঝাইলে বুঝতে পার নতুবা বুঝিবে কই....