পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-পর্ব ষষ্ঠ

(পন্ঞ্চম পর্বের পর)

আমি যে বইটি তুলে নিলাম সেটা ছিল সুলতানুল হিন্দ শাহেন শাহে আওলিয়া হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ (রহঃ) কর্তৃক লিখিত কিছু মকতুবাদ। যা তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয় মুরিদ এবং খলিফা হযরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহঃ)-কে উদ্দেশ্য করে। সেই মকতুবাদের প্রথমটি হচ্ছেঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
মেরে দেলী মোহেব্ব । মেরে কালবী দোস্ত। মেরে ভাই খাজা কুতুবউদ্দিন দেহলবী - আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দোজাহানের ছায়াদাত বখশেষ করুন।

বান্দা মিছকিন মঈনউদ্দিনের ছালাম জানিবা। পর সমাচার এই যে, আছরারে এলাহী (খোদাতত্ত্ব) সমন্ধে যাহা কিছু লিখিতেছি তাহা স্বীয় সত্যিকার মুরিদগণকে এবং সত্যপথের অনুসন্ধানকারীগণকে বেশ ভালভাবে বুঝাইয়া দিবা। তাহারা যেন ভুল পথে না যায়।

আজীজে মান ! যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে চিনিতে সক্ষম হইয়াছে সে ব্যক্তি কখনও কোন ছোওয়াল, খায়েশ বা আরজু করিবে না। যে ব্যক্তি এ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাকে জানিতে সক্ষম হয় নাই, সে ব্যক্তি ইহার ভেদ উপলব্দি করিতে পারিবে না। দ্বিতীয়তঃ হেরেছ ও হাওয়া সম্পুর্ণরুপে দুরীভুত কর। যে ব্যক্তি স্বীয় হেরেছ ও হাওয়াকে দুরীভুত করিতে সফলকাম হইয়াছে সে ব্যক্তি মন্ঞ্জিলে মকসুদে পৌছিঁয়াছে। এইরুপ ব্যক্তিগণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজিদে এরশাদ ফরমাইয়াছেন - "যে ব্যক্তি স্বীয় নফছকে যাবতীয় খাহেশাত হইতে নির্লিপ্ত করিয়াছে-সে তাহার স্থান বেহেস্তে করিয়া লইয়াছে "। যাহার দিলকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় তরফ হইতে বিমুখ করিয়াছেন তাহাকে খাহেশে শাহওয়াতের নর্দমায় চির নিমজ্জিত করিয়াছেন। ছুলতানুল আরেফিন খাজা বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে তিনি একদা রজনীতে স্বপ্নযোগে আল্লাহ তায়ালার দীদার লাভ করিয়াছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তখন জিগ্যাসা করিয়াছিলেন " আয় বায়েজীদ ! তুমি কি চাও ? বায়েজীদ তখন উত্তর করিয়াছিলেন, "যাহা তুমি চাও হে খোদা।" তখন আল্লাহ তায়ালা বায়েজীদের কথায় সন্ত্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, আচ্ছা বায়েজীদ ! যেরুপভাবে তুমি আমার হইয়া গিয়াছ, আমিও তদ্রুপ তোমার হইয়া গেলাম।
যদি তাছাওয়াফের মহাজ্ঞানে জ্ঞানী হইতে চাও, তবে যাবতীয় বাহ্যিক সুখ-সম্পদের আশা পরিত্যাগ কর। সেই মহাসম্পদশালী চিরশান্তি ও আরাম প্রদাতা পরমসৃষ্টিকর্তার মোহব্বত লাভ করিবার উদ্দেশ্যে একাগ্রচিত্ত হইয়া অবিশ্রান্ত কোশেশ কর। যদি তুমি ইহা প্রতিপালন করিতে সমর্থ হও, তবে জানিও যে, তুমি তাছাওয়াফ বিদ্যায় আলেম হইয়াছ (সংক্ষিপ্ত)।

আমি যখন গভীর মনোযোগ সহকারে আমার মনের বাড়ীতে মকতুবাদে খাজা পড়ছিলাম তখন হটাৎ একটা বিকট ধাক্কায় আমার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম - পুলিশের ভ্যানটি একটি কাভার্ড ভ্যানকে সাইট দিতে গিয়ে একেবারে ফুটপাতের সাথে লেগে একধরণের ঘ্যষ ঘ্যষ শব্দ করে হার্ডব্রেক কষলো। তারপর ভ্যান হতে নেমে কাভার্ডভ্যান চালকের লাইসেন্স চাইলো এবং সেই ড্রাইভারের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আবারো গাড়ী ছেড়ে দিল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম-কোথায় আসছি? দেখলাম হাইকোর্ট মাজারের কাছ দিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটির দিকে যাচ্ছে। গাড়িটি যখন যাচ্ছে তখন হাইকোর্ট মাজারের সদর গেইটটি দেখতে পেলাম।

আমার তখনই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেইটা হলো কিছুক্ষণ আগে যে সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীর নেওয়াজের মকতুবাদ পড়ছিলাম, সেই খাজা গরীব নেওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র যে, এ মাজারে শুয়ে আছে, সেটা কি সবাই জানে? তারা কি জানে - তার প্রকৃত নাম কি? কেন তাকে শরফ উদ্দিন চিশতী (রহঃ) বলা হয়? তিনি সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরীব উন নেওয়াজ (রহঃ) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হযরত ইসমত (রহঃ) -এর ঔরসে ৬২৮ হিজরী মোতাবেক ১২৩০ খ্রীস্টাব্দে আজমীরে জন্মগ্রহণ করেন। ওলী-এ-বাংলার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল হযরত খাজা হুশামউদ্দিন আবু সালেহ চিশতী (রহঃ) এবং তিনি হযরত খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) এর হস্তে মুরিদ হন। তিনি হযরত খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া হতে অশেষ ফয়েজ বরকত লাভ করেন এবং হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)-এর সাথে বঙ্গে আসেন। সেই সময় তিনি তাঁর প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছিলেন। পরবর্তীতে যখন তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়-তখন হযরত খাজা শাহ্ জালাল (রহঃ) তাকে "শরফ উদ্দিন" নামে ভুষিত করেন। যার আরবী অর্থ হয়- পাল্টানো বা বদলানো। তিনি হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)-এর সাথে দুই বছর অবস্থান করেন। পরবর্তীতে হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)-এর আদেশক্রমে তিনি বর্তমান হাইকোর্ট যা রমনা গ্রাম নামে পরিচিত ছিল, সেইখানে তার আস্তানা গাড়েন এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। এই মহান অলী যিনি ওলী-এ-বাংলা নামে পরিচিত ছিলেন তিনি হিজরী ৭৩৮ মোতাবেক ১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে ১১০ বৎসর বয়সে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে গমণ করেন (ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

আমি আবার চেষ্টা করলাম সেই মকতুবাদটি পড়ার জন্য। মনের বাড়ীতে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু পারলাম কোথায়? গাড়ীটি থামলো শাহবাগের মোড়ের দিকে পুলিশ ক্যাম্প-এর সামনে। আকাশ ততক্ষণে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। আমাকে নামানো হলো। সাত্তার নামক পুলিশটি আমাকে ইশারা দিল তাকে অনুসরণ করার জন্য। আমি তার পিছু নিলাম।
(চলবে)

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-পন্ঞ্চম পর্ব

তারিখঃ ১৭ই এপ্রিল, ২০১৪
বারঃ বৃহসপতিবার

আজকে আমাদের ক্লাসে জালাল স্যার পদার্থের ধর্ম পড়াচ্ছিলেন। স্যার বলছিলেন-পদার্থ কাকে বলে? পদার্থের ধর্ম কি? পদার্থ কতো প্রকার ও কি কি? স্যার পড়ানোর ফাঁকে লক্ষ্য করলেনঃ সাজিদ মাহিনের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে। কি বলছিল ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্ত্তু তাদের কথোপকথন স্যারের দৃষ্টি এড়ালো না। স্যার কঠিন দৃষ্টি নিয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেনঃ এ্যই ছোকরা, কি নাম?

-স্যার, সাজিদ।

-সাজিদ? আচ্ছা কি নিয়ে এত কথা বলছিলে?

-মাহিন জানতে চাইলো-ধর্ম কি?

-তা স্যাার আপনি কি বললেন? ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে স্যার সাজিদকে প্রশ্ন করলেন।

-স্যার আমি বলেছি ধর্ম হলো যা ধরণ করে আছে। অর্থাৎ একটা বস্তু যে গুণাবলী ধারণ করে আছে তাই তার ধর্ম।

-হুম। তাহলে ধর্ম নিরপেক্ষতা কি?

-স্যার ধর্ম নিরপেক্ষতা হলোঃ যে কোন পদার্থের গুণাবলী নষ্ট না করে কিংবা অন্যের গুণাবলীকে প্রষ্ফুটিত করার জন্য বা  ত্বরান্তিত করার জন্য সহায়তা করে।যেমনঃ শয়তান।

জালাল স্যার রাগে গজ গজ করতে করতে বললেনঃ বেয়াদব। এক্ষুণি ক্লাস থেকে বের হ।
তোমার সেই দিনের খেয়ালীপনায় সমস্ত ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা পিন পতন নীরবতা নেমে এসেছিল।সবার কাছে তুমি হাসির পাত্র বনে গেলে। কি লাভ হলো বলোতো? তোমাকে সেই দিন বের করে দেয়ায় আমার যে কি কষ্ট হচ্ছিল তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। কিন্ত্তু কেন তুমি এমন কাজটা করলে তা কিন্ত্তু কোনদিন বলোনি।

রাত তখন আনুমানিক তিনটা। শীতের রাতগুলো মেরাথন প্রকৃতির হয়। আমার আজকের রাতটি আরো বেশি মেরাথন মনে হচ্ছে। আকাশের চাঁদ তখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। মাঝে মাঝে গাড়িতে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে তা পেটানোর চটোপৎঘাত পাওয়া যাচ্ছে। শুনেছি শীতে মশাদের বেশি প্রডাক্টিভিটি থাকে না। শীতের প্রকোপের কারণে মশাদের বংশবৃদ্ধি হয় না। প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। কিন্ত্তু মানবের ক্ষেত্রে কোন বাঁধই মানে না। কি করবো বুঝতে পারছি না। আর আমাকে নিয়ে কি করতে চায়, তাও স্পষ্ট হয়নি। কোর্টে চালান দেবে না-কি থানা হাজতে ঢুকিয়ে দেবে তাও বুঝতে পারছি না। কি যে করি? 

তারিখঃ ১৯শে এপ্রিল, ২০১৪ইং
বারঃ শনিবার
আজকে তুমি একটা অদ্ভুত কথা বললে। আমি তোমাকে বলেছিলাম-তোমার পাগলামির রহস্য কি? তুমি বললেঃ মনা পাগলা। যখন প্রশ্ন করি মনা পাগলাটাকে, তখন বললে-মনা পাগলা হলো মনের ভেতর যে পাগলের বাস, সেই পাগলই হচ্ছে মনা পাগলা। প্রত্যাকটি মানুষের মনের মধ্যে আরেকটা মানুষ থাকে। সেটা হলোঃ মনের মানুষ। আর আমারটা হলোঃ পাগল। তাই আমার পাগলামির রহস্যজনক ব্যক্তির নামঃ মনা পাগলা। 
তুমি যে পাগল হয়ে যাচ্ছ-তা কি তুমি বুঝতে পারছো? তোমাকে একজন মনোবিজ্ঞানের ডাক্তার দেখানো উচিত। সেদিন দেখলাম তুমি ঝুম বৃষ্টিতে কোট-প্যান্ট টাই গলায় ঝুলিয়ে হাঁটু সমান পানিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছো। আবার হাতে একটি সিগারেট ধরাচ্ছ। ম্যাচটি ভিজে যাওয়ায় বার বার চেষ্টা করছো। কায়দা করে ধরিয়ে টানতে টানতে যাচ্ছো। আশে পাশের মানুষজন হা করে তাকিয়ে দেখছে। আমার কি যে খারাপ লাগছিল, তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। প্লিজ সাজিদ, বুঝতে চেষ্টা করো-জীবনটা অনেক দামী। এটাকে এভাবে হেয়ালিপনা করে নষ্ট করে দিও না।

তারিখঃ ২৩শে এপ্রিল, ২০১৪ইং
বারঃ বুধবার
আমি ঠিক তোমাকে বুঝে উঠতে পারছি না। কখনো মনে হয় তুমি যা কিছু করছো, তা ইচ্ছাকৃত। অথবা আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কোন্ টা যে ঠিক, সেটাও পরিস্কার নয়। তোমাকে নিয়ে যেদিন আমি আমাদের বাড়ীতে গেলাম-আমার আব্বা-আম্মাকে সালামতো দাওনি, উল্টা তুমি আব্বার সাথে ধর্ম নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়লে? তার সাথে দর্শন কপচানো শুরু করে দিলে? দর্শন যদি তোমাকে বুঝানো হয়, তাহলে তুমি জিরো পাবে। যে মেয়েটা তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে তার দর্শন না বুঝে তুমি কি দর্শন করতে চাইছো? তুমি কি জানো-প্রেম ছাড়া কোন ইবাদত কবুল হয় না। প্রেম সমস্ত ইবাদতের মুল। ইশকে মাজিজি না বুঝলে ইশকে হাকিকি কিভাবে বুঝবে? 
তোমাকে একটা উদাহরণ দেই। নারী -বা জননী - এক মহাশক্তির রূপ ! এর বিশেষ এক অঙ্গ - শক্তির ভান্ডার ! আর পুরুষ -- নিজে স্বয়ং মহান সত্যের স্বরূপ ! এদের বিশেষ অঙ্গে সেই স্বরূপ বিরাজমান !!এর অনাচার ব্যাভিচার - তৃতীয় - এক অশুভ শক্তির সৃষ্টি !! সদগুরুর নিকট বসে শিখতে হয়- এর যৌগিক পদ্ধতি ! এই যৌগিক পদ্ধতিতেই - মহাতৃপ্তি বা মহাশান্ত - প্রশান্ত !!রতি + মতি-- গতি -(2) নিম্নগতি ; উর্ধগতি = জ্যোতি (গুরুর কৃপায় উর্ধগতিতে)। যেখানে সুর কেটেছে পুনরায় সেইখানে সুর জোড়া লাগলে - তবেই তৃপ্ত আত্মা !! তোমার মনা পাগলা কি সেটা জানে? ভেবে দ্যাখো-
আজলে (আদিতে) একটি নূর (জ্যোতি) ভেঙে দুটি হল - এরা মিলবে বা মিলছে কখন ? না আধখানা ই আছে ? তাহলে উপাসনা কি অর্ধেক ? আবার এক ছাড়া দ্বিতীয় নাই !! এর রহস্য কি ? তোমার মনা পাগলা কি জানে? যদি জানে তাহলে উত্তর দিও।

পুলিশটাকে দেখলাম মনোযোগ সহকারে ডায়রীটা পড়ছে। কোন ব্যাঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহার করছে না। বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখলাম পড়ছে। কোন তারিখেরটা পড়ছে সেটা বুঝতে পারলাম না। কারণ সে আগের মতো শব্দ করে পড়ছে না। আমি চিন্তা করলাম বসে থেকে লাভ কি? তার চাইতে কোয়ান্টাম মেথড পদ্ধতিতে চলে যাই না কেন -আমার মনের বাড়ীতে। আমি কোয়ান্টাম পদ্ধতি অবলম্বন করে মনের বাড়ীতে চলে গেলাম। আমার মনের বাড়ীটি বেশ চমৎকার। বাড়িটির চর্তুপার্শ্বে দেবদারু আর শাল -সেগুণ গাছ পালা দিয়ে ঘেরা। সেই বাড়ীর সামনের সদর দরোজার পাশে দুটি ফুলের বাগান। ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলে পাওয়া যাবে দেয়ালে ঝুলছে বিখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি। পাশে দুটি আরাম কেদারা। পাশে সারি সারি বই। যেটা ইচ্ছা সেটা হাত বাড়িয়ে নেয়া যাবে। ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। ইচ্ছে করলে গানও ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। গান শুনতে শুনতে বই পড়া যাবে। আমি সেই আরাম কেদারায় আরাম করে বসলাম। বইগুলো হতে একটি বই হাতে নিলাম। বইটির নামঃ আসরারে হাকিকি-মকতুবাতে খাজা। আমি হাল্কা মিউজিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সংগীত শুনছি আর বইটি পড়ছি।
(চলবে)

শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-চতুর্থ পর্ব

(তৃতীয় পর্বের পর হতে)

সাত্তার নামক পুলিশটা আমাকে ধমক দিয়ে বললোঃ

-ওই কি দ্যাখস..এ্যায়ই...একদম চক্ষু দুইটা উঠালামু.....চুপ কইর‌্যা বইয়্যা থাক

-ভাই...আপনি এমন করছেন কেন? আমি কি করেছি? আমি কি চোর? না ডাকাত? আমি কি কারো বাড়িতে আগুন দিয়েছি ? না-কি কোন মিটিং মিছিলে বোমা মারছি? না হাইজ্যাক করেছি...

-তুই কিচ্ছু করস নাই। এতো রাইতে তোর আচরণ গতিবিধি সন্দেহ জনক হওয়ায় তোরে ধরছি। বেশি তেরি বেরি করবি, তো তোরে জংগি বানাইয়্যা কোর্টে চালান করইয়্যা দিমু

এরপর আর তর্ক করা চলে না। শুনেছি ৫৪ ধারায় নাকি আচার-আচরণ, গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তাকে ধরা যায়। কিন্ত্তু আমার আচার আচরণতো সন্দেহ জনক ছিল না। খামোখা আমাকে গাড়িতে উঠিয়েছে। ঢাকায় আমার তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। নেই কোন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। থাকলে না হয় মোবাইলে কল দিয়ে ধরিয়ে দিতাম। হায়! আমার কেউ নেই। হুমায়ুন আহমেদের "কোথাও কেউ নেই" নামক জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকের মুনার মতো আমি আবারো আমার সেই কোন পুরোনো স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্ত্তু পারলাম কই

তারিখঃ ২৬শে মার্চ, ২০১৪ইং
বারঃ বুধবার
আজ তুমি আমার সাথে বেশ খারাপ আচরণ করছো। আমি তোমার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করিনি। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি এমন করবে?........

তারিখঃ ২৮ শে মার্চ, ২০১৪ইং
বারঃ শুক্রবার
আজ বাবা আমাকে বকেছে। কাল রাতে যখন তোমার সাখে কথা বলছিলাম তখন বাবা নাকি সব শুনেছে। সকালে ঘুম হতে উঠতে দেরী হওয়ায় আম্মুর বকাঝকা শুনতে হয়েছে। আচ্ছা আজ শুক্রবার। বন্ধের দিন। একটু আরাম-আয়েশ করে কি ঘুমাতে পারবো না? আমি কি কচি খুকি? জানি না...


তারিখঃ ৩০ শে মার্চ, ২০১৪
বারঃ রবিবার
আজ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। ফোনের পর ফোন দিচ্ছি। তুমি আসছো..আসছি...এইতো পাঁচ মিনিট...আরে জ্যাম কি করবো... আসছিতো...বলে নানা টাল বাহানা করছো। কিন্ত্তু তুমি এখনো আসছো না কেন? তুমি কি জানো - রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কতো কষ্টের..কতো যন্ত্রণার...তুমি কি একটুও চেন্ঞ্জ হবে না? প্লিজ একটু নিজেকে চেন্ঞ্জ করো...অত্যন্ত আমার জন্য হলেও...

পুলিশের গাড়িটা একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। পাশের দুজন চোখ রগড়াতে রগড়াতে গাড়ি হতে নামলো। তারপর তারা আমার দিকে তাকালো। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। মাথা ব্যাথা নামক রোগটা পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় নাকি অন্যকোন অদৃশ্য কারণে উধাও হয়ে গেল। এখন যেটা ভর করেছে সেটা হলো মানসিক যন্ত্রণা।
(চলবে)

শ্বেতার ডায়রী-তৃতীয় পর্ব

(দ্বিতীয় পর্বের পর)
পুলিশের গাড়িটি নানা দোলাচালে হেলেদুলে চলছে। অনেকটা নৌকা দোলার মতো। ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি এম্মনিতেই এসে যায়।  তাইতো বলি পাশের পুলিশ দুটি কেন ঘুমাচ্ছে? 

আমি মনে মনে  আমার সুখ স্মৃতির কল্পনায় হারিয়ে গেলাম। সেবার আমি আর শ্বেতা দুজনে একটা নৌকা ভাড়া করলাম। কোথায় যা'ব জানি না। কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা টাইপের। আমি নৌকায় বসে আছি। আমার পাশে শ্বেতা। শ্বেতার পরণে ছিল লাল পারের সাদা শাড়ি। কপালে ছিল লাল রংঙের টিপ। হাতে ছিল শাঁখার চুড়ি। তাকে দেখতে কেন যেন হিন্দুয়ানি ঘড়ানার কোন গৃহস্থ বাড়ির বউয়ের মতো লাগছিল। নৌকার গলুইয়ে বসে শ্বেতা পানিতে হাত ডুবানের চেষ্টা করলো। একটু উপুড় হয়ে বসে পানি ধরছে আর তা আমার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে। যে স্থানটায় আমি আর শ্বেতা গিয়েছিলাম সেটা ছিল - আড়িয়াল বিল। বিলের চারদিকে কেবল পানি আর পানি। সেই পানিতে পদ্মফুল ফুটে আছে। লাল টকটকে পদ্মফুল। শ্বেতা হাত দিয়ে পদ্মফুল তোলার চেষ্টা করছে। কিন্ত্তু পারছে না। সে আবারও চেষ্টা করলো। একটা পদ্মফুল ধরে সেটাকে টান দিতেই ছিঁড়ে গেল। আরেকটা ধরার চেষ্টা করছে। কিন্ত্তু আচমকা নৌকাটা দুলে উঠায় শ্বেতা পড়ে যেতে চাইল। ঠিক তক্ষুণি আমি তাকে ধরে ফেললাম। সে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার তাকানোর ভংগিটা ছিল অসাধারণ। চোখের কোণে কাজল দেয়ায় চোখের পানিতে কাজলগুলো ধুয়ে নেমে আসতে চাইছে। শ্বেতা ভয় পেয়ে এমনভাবে জপটে ধরেছিল যে আমি সহজে ছুটতে পারছিলাম না। আমি সেই প্রথমই কোন মেয়ের শরীরের ঘ্রাণ পাই। কি মিষ্টি একটি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। চোখ মুদে আসে সেই ঘ্রাণ সুদীর্ঘভাবে টেনে নিতে চাইলে। আমি চোখ দুটো মুদে রইলাম আর মনে মনে আবৃত্তি করলামঃ

তুমি তো জানো না কিছু-না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে-
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে?
আমি ঝরে যাবো-তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেদিন পৃথিবীর পরে
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।

শ্বেতা তখনো কাঁদছে। এই ভয়ে যে যদি পানিতে পড়ে যেত। তাহলে কি হতো? সেতো সাঁতার জানে না। তাকে সান্তনা দিয়ে বললামঃ

-তুমিতো আমাকে বললেই পারতে। কেন বলোনি?

-এমন সুন্দর প্রকৃতি। এমন সুন্দর একটা দিন। আর তোমাকে বলতে হবে - প্লীজ আমাকে একটা পদ্মফুল ছিঁড়ে খোঁপায় পড়িয়ে দাও না?

-আহা, আমি বুঝবো কি করে?

-তোমাকে বুঝতে হবে কেন? তোমার ভেতর কি রোমান্টিক অনুভুতি নেই? 

-ছিল এবং এখনো আছে। আমি তোমাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম-তুমি কি করো? তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলেইতো তোমাকে ধরতে পেরেছি। না ধরলে কি সর্বনাশ হয়ে যেত। বলোতো?

-এখনোতো ধরে আছো। ছাড়ছো না কেন?

-ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। মনে হয় এভাবে ধরে রাখি সারাটা জীবন...

কতক্ষণ ধরে ছিলাম জানি না। সেই সুখ স্মৃতি ভংগ হলো সেই বেরসিক পুলিশটির ডাকে। দেখলাম এবার সে বেশ আগ্রহ নিয়েই পাশের পুলিশ দুটোকে জাগালো। তারপর বেশ আগ্রহ নিয়ে ডায়রী হতে শব্দ করে পড়া শুরু করে দিলঃ


তারিখঃ ১৪/০২/২০১৪
বারঃ শনিবার
আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আজকে আমি আর সাজিদ সারাদিন একসংগে কাটিয়েছি। একসংগে দুপুরের খাবার খেয়েছি। পড়ন্ত বিকেলের সুর্যালোক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সুর্যাস্ত দেখেছি। লাল রক্তিম সুর্যটা যেন সারাদিনমান ক্লান্ত থেকে বিশ্রাম নিতে চলে যেতে চাইছে। আর আমি চাইছি সাজিদের প্রেম। একটু আদর...কিন্ত্তু একটা হাদারাম কিচ্ছু বোঝে না। মেয়েরা কি সবকিছু বুঝিয়ে দেয়? ওর সরলতা আমাকে মুগ্ধ করে বলেই ওকে আমি এতোবেশি ভালোবাসি। আমার প্রাণের চাইতেও ওকে ভালোবাসি। ইশ্ যদি আরেকটু চালাক-চতুর হতো...ধুর কি সব ভাবছি...
সাজিদ সাজিদ সাজিদ.....আমি তোমাকে ভালোবাসি...ভালোবাসি....ভালোবাসি....

পুলিশটা আমার দিকে আবারো আড়চোখে তাকালো। আমিও তাকালাম। দেখলাম তার বুক পকেটের উপর লেখা - মোঃ আব্দুস সাত্তার। পাশের পুলিশ দুটো ওর সেই বিদঘুটে শব্দ উচ্চারণের প্রতি বিন্দু মাত্র আগ্রহ দেখালো না। আমি ঘুমন্ত পুলিশ দুটোর বুক পকেটের দিকে তাকালাম। একজনের নাম মস্তফা আরেক জনের নাম ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমি ভালো করে তাকিয়ে পড়তে চেষ্টা করলাম।  
(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-দ্বিতীয় পর্ব

(প্রথম পর্বের পর)
ডায়রীটা হাতে পাওয়ার পর পুলিশটা সেটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিল। কি লেখা আছে সেই ডায়রীতে। ডায়রীটা আহামরি কিছু নয়। দেখতেও খুব যে ভালো তাও নয়। কিন্ত্তু সেই ডায়রীতে জড়িয়ে আছে আমার আর শ্বেতার স্মৃতিবিজড়িতজড়িত বেশ কিছু দিনলিপি। আমার ভালোলাগা মন্দলাগা সমস্ত ঘটনাই শ্বেতা তুলে ধরেছিল। আমি জানতাম না। শ্বেতার ডায়রি লেখার অভ্যাস আছে। পুলিশটা ব্যাঙ্গাত্মক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলোঃ

তারিখঃ পহেলা জানুয়ারী ২০১৪
বারঃ বৃহসপতিবার

আজকে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি ও আমার বান্ধবীরা সবাই এক সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেই সময় আমার চোখ যায় দোতালার বারান্দায়। দেখি একটি সুদর্শন দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে বেশ ধীরে সুস্থে। কি বলছে কে জানে? তার বন্ধুরা বেশ আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছে। মিলা আমাকে আড়চোখে দেখছিল। আমি খেয়ালই করিনি। আমি কি দেখছি, তা দেখার জন্য সেও সেই দিকে তাকিয়ে রইল। দেখলো সেই সুদর্শনকে। মিলা আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বললোঃ
 
কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;
এ-ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে। 
-জীবনানন্দ দাশ

কবিতাটি আবৃত্তি করেই মিলা হাসতে হাসতে বললো-ওর নাম সাজিদ। আর ওর পাশে দাঁড়ানো ঐ যে ছেলেটিকে দেখছিস? ওর নাম মাহিন। সেই প্রথমই আমি তোমার নাম জানতে পারি। তখনো তোমাকে বলিনি যে - আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। যাকে লাভ এট ফাস্ট সাইট...

ঘটনাটা পড়ে পুলিশটা আমার দিকে আড়চোখে তাকালো। দেখলো আমি সুদর্শন কি-না? কিন্ত্তু আমি জানি আমি সুদর্শন নই। সিগারেটে পোড়া কালো দুটি ঠোট। লম্বাটে ধরণের মুখ। নাকটাও বেশ সুঁচালো। প্রশস্ত ললাট। কেশগুলো হাল্কা-পাতলা। রেশমের মতো। এ সবই শ্বেতার বর্ণনা। কাজেই শ্বেতার কাছে আমাকে ভালো লাগতে পারে। কিন্ত্তু নির্দয় ঐ পুলিশটার কাছে নয়। পুলিশটা আবারো পাতা উল্টিয়ে পড়া শুরু করেছেঃ

তারিখঃ ১৩/০১/২০১৪ইং
বারঃ সোমবার

আজকে ক্লাসে কুদ্দুস স্যার আমাদের হৈমন্তী পড়াচ্ছিল। স্যারের পড়ার ধরণ বেশ। স্মার্ট উচ্চারণ। কোন জড়তা নেই। গলার স্বর বেশ ভালো। এত সুন্দর করে কেউ পড়াতে পারে-আমার জানা ছিল না। আমরা মন্ত্র-মুগ্ধ হয়ে স্যারের পড়া শুনছিলাম। কিন্ত্তু দেখলাম সাজিদ লাষ্ট বেন্ঞ্চে মাথা নুয়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছিল ওর গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেই। কিন্ত্তু আমারতো সেই অধিকার নেই।

-কিরে পড়া বাদ দিয়ে খালি ঘুমাস না-কি? 

পুলিশটা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিগ্যাসা করছিল আর মিটি মিটি হাসছিল। দেখে আমার এমন রাগ লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি পুলিশের গাড়ির বেন্ঞ্চিতে কুঁজো হয়ে বসে আছি। সামনের দিকে ঝুঁকে বসে থাকায় হাত দুটো সামনের দিকে ছিল। আমার পাশেই আরো দু'জন পুলিশ আছে। দুজনই হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি মনে মনে বললামঃ এই সময় যদি কোন দুর্ধর্ষ খুনি কেউ আসে কিংবা কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এই দু,জন কিভাবে সামাল দেবে? ভাগ্যিস আমি দুর্ধর্ষ কেউ নই। তাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। আমি আবার তাকালাম সেই পুলিশটার দিকে। দেখলাম, সে ডায়রী পড়া বাদ দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। তারপর আবার পড়া শুরু করলোঃ

তারিখঃ ১৫/০১/২০১৪ ইং
বারঃ বুধবার

তোমার কিসের এতো অভিমান? কেন তুমি আমাকে এত কষ্ট দাও...বলোতো....

-কিরে... কি করছিলি...বলতো? খামাখা মেয়েটাকে কষ্ট দিছস...

আমার বিরক্তের সীমা রইল না। কি যে করবো? বুঝতে পারছি না...এই নাছোড়বান্দা পুলিশটাতো দেখি আমাকে জ্বালিয়ে মারবে...ডায়রীটার মাঝখান হতে একটা করে পেইজ বের করে আর ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় জোরে জোরে শব্দ করে পড়ে। সিগারেটে টান দেয় আর ফুঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে। কি যে করি...আমি আলগোছে আমার মাথার চুলগুলো দু'হাত দিয়ে ওঠানামা করছি...হটাৎ মনে হলো..আমার এই মুহুর্তে কোন সুখের স্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত। আমি চোখ বুঁজে মনে মনে হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমার স্মৃতির জানালায়। দেখি সেখান থেকে কোন সুখ স্মৃতি খুঁজে পাই কি-না?
(চলবে)

বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্বেতার ডায়রী-প্রথম পর্ব

মনটা বিশেষ ভালো নেই। শীতের আবহাওয়া জানান দিচ্ছে - দেহ মনে পরিবর্তন আনার জন্য। আমার দেহ ও মন সেই প্রকৃতির অংশ হিসেবে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মাথার কোণে কেমন যেন ভোঁতা ধরণের ব্যাথা হচ্ছে। শিরা উপশিরাগুলো ব্যাথার চোটে ফেটে যেতে চাইছে। আমি মাথার কোণে ঠিক সেই ব্যাথার স্থানে আমার বৃদ্ধা অঙ্গুলি দ্বারা চেপে ধরছি। কিন্ত্তু ব্যাথা কমার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ভাবলাম বাইরে গিয়ে এককাপ আদা চা খেলে হয়তো ব্যাথাটা কমতে পারে? রুম থেকে বের হলাম।

বাইরের আবহাওয়াটা দারুণ। হাল্কা শীতের আমেজ আর বাহারী রংয়ের পোষাকের আদলে বদলে গেছে মানুষজন। সবাই কেমন যেন স্মার্টভাবে চলাফেরা করছে। অামি যে রাস্তাটাতে দাঁড়িয়ে আছি তার পাশেই নিয়ন লাইটের আলো জ্বলছে। লাইটের হলদে আলোয় চলাফেরারত মানব-মানবীকে কেমন যেন বদলে যেতে দেখছি। মনে হচ্ছে অন্যজগতের কোন বাসিন্দা। হাল্কা কুয়াশায় ঢেকে আছে ঢাকার রাজপথ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। এতো রাতে চা পাবো কি-না কে জানে? যদিও ঢাকায় সাড়ে দশটা মানে সন্ধ্যা হওয়া। কিন্ত্তু শীতের কারণে অনেকেই বাড়ী তাড়াতাড়ি চলে যায়। অযথা কেউ দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে না। আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখি কোন চায়ের দোকান খোলা আছে কি-না? 

ভাগ্য ভালো বলতে হবে। মোবারক মামার চায়ের দোকানটা খোলা আছে। আমি যে স্থানে থাকি সেখানটায় ছেলে-বুড়ো সকলেই মোবারক মামাকে ভালোই চেনে। তার চায়ের আদর সর্বত্রই। চায়ের কারণেই লোকটি অত্র এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। সে তার দোকানে একটি সাইনবোর্ডও লাগিয়েছে। মোবারক টি স্টল। সেই টি স্টলটিতে বিভিন্ন ধরনের চায়ের লিষ্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। হেন চা নেই যা মোবারক মামা বানাতে পারে না। গোলমরিচের চা, আদা চা, লেবু চা, তুলসিপাতার চা, পদিনা পাতার চা..আর দুধ চাতো আছেই। সেই দুধের মধ্যেও ভাগ করেছে। গুড়া দুধের চা..গরুর দুধের চা...কনডেন্সমিল্ক এ চা..ইত্যাদি। সব সময় পান মুখে আছেই। কাষ্টমার দেখলেই মোবারক মামা তার স্বভাবসুলভ লাল দাঁত বের করে হেসে জিগ্যেস করে- মামা কি চা দিমু?

আমাকে দেখেই মোবারক মামা তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে জিগ্যাসা করলোঃ

-মামা, এই রাইতে?

-বাহির হইলাম আর কি? মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে..

-বহেন মামা...গরম গরম আদা চা কইর‌্যা দিতাছি..চুমুক দেওনের সাথে সাথেই দেখবেন ব্যাতা নাই হইয়্যা গেছে গা..টেরও পাইবেন না

কিন্ত্তু মোবারকের চায়ে চুমুক দেয়ার পরও ব্যাথা কমার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাথাটা কেমন যেন বাড়ছে..আবার কমছে...

-কি মামা? ব্যতা কমছে...কইলাম না আমার চা চুমুক দেওনের লগে লগে ব্যাতা বাপ বাপ কইর‌্যা পলাইয়্যা যাইবো গা...

-না মামা। ব্যাথা যায় নাই। ব্যাথা আছে...

-কন কি মামা...আমার চায়ে আপনের মাথা ব্যাথা কমতাছে না....
মোবারক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমার ব্যাথায় সে বেশ কাতর। অথচ আমি সেই কাতর যন্ত্রণাটা নিয়ে ঘুরছি। আমার যন্ত্রণা বুঝতে পেরে মোবারক মামা বললোঃ

-মামা আমার মনে হইতাছে আপনের এই ব্যাথাটা খুব খারাপ ধরণের ব্যাতা। একটা ডাক্তার দেহান।

-তা দেখাবো। তবে এই সময় ব্যাথা কমার জন্য ঔষধ আনার জন্য কোন ডিসপেন্সারী খোলা পাবো?

-কি যে কন না মামা? আরে আপনে ডাক্তারের দোকান খোলা না পাইলে সোজা মেডিকেলের সামনে ইর্মাজেন্সীতে চইল্যা যাইবেন গা। হেইহানে সারা রাইত ওষুধ বিক্রি অয়।

-কথাটা মন্দ বলো নি। কিন্ত্তু অত জরুরী না। সেইরকম মাথা ব্যাথা না..

আমি মোবারক মামার দোকান হতে একটা সিগারেট নিয়ে সেটা ধরিয়ে টানতে টানতে আবার হাঁটা শুরু করলাম। আশ্চর্য্য মাথার যন্ত্রণাটা কম মনে হচ্ছে। ভাবছি সারারাত রাস্তায় হেঁটে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? মাথার যন্ত্রণাটাও কমবে আবার নতুন একটা অভিজ্ঞতাও হবে..

অামি হাঁটছি আনমনে। অনেকটা টালমাটাল ভংগীতে। আমার হাঁটার ধরণে কি-না জানি না ..নাকি অন্য কোন কারণে টহলরত পুলিশ আমাকে দেখে ডাকলোঃ

-এই যে ভাই...এই দিকে আসেন?
হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছে। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম...আমাকে ডাকছে না-কি অন্য কাউকে ডাকছে..কাউকেই ডাকছে বলে মনে হলো না। অগ্যতা আমি নিজেই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে পুলিশের কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই সেই পুলিশটা খ্যাক খ্যাকে গলায় বললোঃ

-কই জান...কি করেন..আর এতো রাইতে এই শীতের মধ্যে রাস্তায় কি? চামড়া খোঁজতে বাইর হইছেন?

অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করায় আমি কোনটার উত্তর দেব ভাবছিলাম। আর সেই ভাবাটাই আমার কাল হলো। হেড়ে গলায় বেশ জোর দিয়ে পুলিশটা আমাকে বললোঃ

-কি রে ? তোরে কি জিগাইতাছি..কথা কানে যায় না? এই লাঠিটা দেখছস...এইডা তোর জায়গা দিয়া ভইর‌্যা দিলেই দেখবি ভর ভর কইর‌্যা কতা বাহির হইবো...

আমি কি বলবো? বেশ ভড়কে গেলাম। আমি আমতা আমতা করে বললামঃ

-মাথাটা ব্যাথা করছে। তাই ঔষধ কেনার জন্য বাহির হইছি...

-শীতের রাইতে তোর মাথা ব্যাথা করতাছে আর সেই ব্যাথার লিগা ওষুদ কিনতে বাইর হইছস? আমাগো ভোদাই পাইছস? সত্য কথা ক...ছিনতাই করতে বাইর হস নাইতো? নাকি গরম চামড়া খোঁজতে বাইর হইছস?

গরম চামড়া কি জিনিস, তা আমার বোধগম্য হলো না। সে গরম চামড়া দ্বারা কি ইশারা করতে চাইছে? আমি বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম...কথাটা নতুন শোনলাম...মানেটা কি? 

-উঠ। গাড়িতে ওঠ। 

এই কথা বলেই আমার কলার ধরে হড় হড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল। কলার ধরে ধাক্কা ধাক্কি করতে করতেই আমার কোমর হতে একটা ডায়রী মাটিতে পড়ে গেল। সেই ডায়রীটা হাতে নিয়ে পুলিশটা খুলে দেখলো, কি লেখা আছে সেই ডায়রীতে...কিন্ত্তু আমি অবাক হয়ে ভাবছি এই ডায়রীতো আমি সাথে আনিনি। তাহলে এই ডায়রীটা কোথ্থথেকে এলো...এটাতো আজ সকালে শ্বেতা আমাকে দিয়ে ছিল। শ্বেতা সেই ডায়রীতে আমাদের প্রেম-ভালোবাসার দিনলিপিগুলো  খুব গুছিয়ে লিখে রেখেছিল। 

(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে -শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

তব কাননে ধীর গমণে কুসুম কলি ফোটাও চরণে
বিহঙ্গ গণে ললিত তানে প্রেম আলাপন করিবে সদা।

তব কাকনে তব মানে তুমি বা তোমার। কাকনে মানে বাগান, গালিচা। ধীর অর্থ অর্থ আস্তে আস্তে। অর্থাৎ স্লেথগতি। মন্থর গতি। গমণে অর্থ যাওয়া। ধীর গমণে অর্থ-মন্হর গতিতে যাওয়া। কুসুম কলি - কুসুম মানে ফুল। কলি অর্থ কিশোরী। সদ্য প্রসুত নয় এমন। অর্থাৎ নব যৌবন প্রাপ্ত কোন কিশোরী। ফোটাও চরণে। চরণ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এখানে চরণ বলতে গুরুর পদতলে আশ্রয় লাভ করাকে বোঝানো হয়েছে। গুরু তার বিশ্ব বাগানে ধীরে ধীরে প্রেমিকগণকে আকৃষ্ট করার জন্য সদ্য যৌবনা প্রাপ্ত কিশোরীর মতো প্রেমিকগণকে তার চরণে সমর্পিত করেন। অর্থাৎ তার চরণে ঠাই দিয়ে থাকেন। চরণে ফোটা অর্থ গুরুর চরণ তলে আশ্রয় লাভ করা। 
বিহঙ্গ গণে  অর্থ বিহঙ্গ মানে পাখি। এখানে বিহঙ্গ  অর্থ হচ্ছে প্রাণরুপ পাখি। ললিত তানে  অর্থ সুমধুর কণ্ঠে ধ্বনি তোলা। প্রেম আলাপন করিবে সদা  মানে হলো সর্বদা গুরুর স্বরণে থাকা। গুরু তার প্রেমিককে অর্থাৎ আশেককে সর্বদাই তারই চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গুরুর শরণ নিলে তাদের মধ্যে কথোপকথন হয় ধীরগতিতে। তাই প্রেমিক সেই আলাপন শোনার জন্য সর্বদা জাগ্রত থাকার চেষ্টা করেন। গুরুর সংযোগ হলে তাদের মধ্যে কথোপকথনকেই প্রেম আলাপন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

উদিত শশী কিরণরাশি দুরিবে ভাতি মেঘের কালা
তুমি যেখানে নাহি সেখানে সর্বস্ব তুমি কাহার ছায়া।

উদিত শশী  মানে উদিত অর্থ উরুয হওয়া। উর্ধ্বগামী হওয়া। প্রস্ফুটিত হওয়া। আলোকিত হওয়া। শশী মানে চাঁদ। যার অন্য অর্থ হয় চন্দ্র তথা মণি। যাকে হাকিকাতে নুরে মুহাম্মদী বলা হয়। নুরে মুহম্মদীর উদয় হওয়াকেই উদিত শশী বলা হয়েছে। সাধকের সাথে যখন সাধনার স্তরে গমণ করেন তখন তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য যে ধর্মরাশি উদয় হয় তম্মধ্যে নারীমোহ হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা। চন্দ্রকে জাগ্রত করতে হলে এ মোহ মায়া ত্যাগ করে তাকে সঞ্চয় করার মানসিকতা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। নয়তো মণি কখনো উর্ধ্বগামী হয় না। এজন্যই বলা হয় - আগে বিন্দু সাধন পরে পতন। এই বিন্দু যখন সাধনার  দ্বারা  স্বচ্ছ হয়ে যায় তখন সেই বিন্দুতেই সৃষ্টি হয় গুরুর পুত্র। জগত পিতার জগত পুত্র। তিনিই হন  নুরের মানুষ।  কিরণ রাশি  মানে হলো কিরণ মানে আলো। কিরণ রাশি মানে আলোকিত। দুরিবে ভাতি অর্থ দুর হয়ে যাবে সমস্ত কলুষতা, কালিমা। মেঘের কালা  মানে এখানে উপমা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে আকাশ অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে যখন মেঘমালা পুঞ্জিভুত হয় তখন সমস্ত কিছু অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আবার যখন মেঘ সরে যায় তখন সমস্ত আকাশ স্বর্ণোজ্জ্বল আলোকে ঝলমল করতে থাকে।

মনা পাগলা যেভাবে গজলটির ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে তাতে আমার কাছে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আমি যেন সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমি তম্ময় হয়ে শুনতে থাকলাম মনার সেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। শুরুতে যেটাকে শ্রেফ একটা গান বলে মনে হয়েছিল তা আর এখন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) তাঁর ধ্যান জ্ঞান তার সাধনার ফসল রেখে গেছেন তার ভক্তবৃন্দের কাছে। চিশতী উদ্যান নামক পুস্তকটি কেবল একটা গজলের পুস্তকই না। এটা জ্ঞানীদের কাছে রেখে যাওয়া একটা সমুদ্র বিশেষ। যারা এর গভীরে প্রবেশ করে হাবুডুবু খাচ্ছেন কেবল তারাই তার জ্ঞানের গভীরতা পরিমাপ করতে পারবেন। হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতীকে বুঝতে হলে তার সহজ মাধ্যম হচ্ছে তার রচিত পুস্তক তথা কেতাবটি। এটিই তার নিবেদিত প্রাণ যা তাকে অমর করে রেখেছে। শত শত আশেক গণের হৃদমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে।

আমার দিকে তাকিয়ে মনা বললোঃ

-কিরে কি ভাবচ্ছিস?

-নাহ্ তেমন কিছু না। ভাবছিলাম আপনি যার গজলটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছিলেন সেই মহা প্রাণের কথা।

-আরে পাগল, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না। ভাব উদ্ধার বলতে পারিস।

-ভাব উদ্ধার বলতে তো তিনি যে ভাব নিয়ে বিরাজিত ছিলেন সেই ভাব নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই ভাব নিজের মধ্যে বিরাজ না করলে সেটাকে কিভাবে আপনি তাঁর ভাব উদ্ধার করবেন? তাছাড়া আপনি যে ভাব নিজের মধ্যে নিয়ে তাঁর রচিত গজলের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটাতো তার ভাব নাও হতে পারে?

আমার কথা শুনে মনা যেন কেমন থ মেরে গেল। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার মর্মভেদ করলো। আমিও মনার দিকে তাকিয়ে আছি। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানি না। নীরবতা ভংগ করে মনা বললোঃ

পড় পড় আলেম ফাযেল হোয়া
কাদি আপনে আপ নু পড়হেয়ায়ে নই।

জা জা ওয়ার্দা মন্দর মসীতা
কাদি মন আপনে ভিচ ওয়ারিয়ায়ি নই।

আইওয়ায়েঁ রুয শয়তান নাল লাড়দাঁ
কারদী নফস আপনে নাল লাড়িয়ায়ে নই।

বুল্লে শাহ আসমানী উড়দিয়া ফারদা
যায়রা ঘর ব্যায়ঠা ওহনুঁ ফারিয়ায়ে নই।

[হযরত খাজা বুল্লে শাহ-এর কালাম] 

পড়ে পড়ে আলেম হয়েছো। ফাজেল হয়েছো। তুমি তোমাকে পড়ো নাই। প্রতিদিন মন্দির মসজিদে যাও। তোমার মন মন্দিরে যাও নাই। প্রতিদিন শয়তানের সাথে লড়াই করো। কখনো নিজের নফসের সাথে লড়াই করো নাই। তোর কথা শুনে আমার কেন যেন বুল্লে শাহর এই কালামের কথা মনে পড়লো। তাই বললাম। তবে তোর চিন্তা ভাবনার উন্নতি হয়েছে জেনে ভালো লাগলো। তুই বই পুস্তক পাঠ করে বিদ্বান হতে পারবি। বড়ো বড়ো ডিগ্রী নিতে পারবি। কিন্ত্তু তাকে তুই কখনো কিতাবে পুস্তকে পাবি না। তাকে পেতে হলে তোকে অবশ্যই তোর মন মন্দিরে ঢুকতে হবে। কেন শুনিস নি-

কেনো খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি কংকালে
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
বন্ধু, বলিনি ঝুট।
এই খানে এসে লুটায়ে পড়ে সকল রাজ মুকুট।

নজরুলের বাণী আর বুল্লে শাহর বাণী অভিন্ন বাণী। তৌহিদ সাগরে যারা ডুবারু তাদের মধ্যে দুই নেই। তুই সেই সাগরে ডুব দে। ডুব দিয়ে তুলে নিয়ে আয় মণি মুক্তা। নজরুলের মতো করে-

থাকবো নাকো বদ্ধঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে

কিংবা ধর রবীন্দ্রনাথের কথা। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি।

অামি যখন তন্ময় হয়ে মনা পাগলার কথা শুনছি, ঠিক তক্ষুণি টের পেলাম-আমার বাঁ দিকটা হটাৎ ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বেত দিয়ে আঘাত করছে। ব্যাথার সেই স্থানটিতে হাত বুলাতে বুলাতে শুনতে পেলাম কে যেন চিৎকার দিয়ে বলছেঃ

-ঐ ব্যাটা কতক্ষণ ধইর‌্যা দেখতাছি বক্কর বক্কর করতাচ্ছস। ব্যাপারটা কি? মাল খাইছোস? ডোসটা কি কড়া হইয়্যা গেছে? ওস্তাদ হালায় মনে হয় গাঞ্জা খাইছে। মাতাটা উডাইতে পারতে আছে না। দিমুনি হালার হোগা দিয়া লাডিডা ঢুকাইয়্যা...

আমি তাকিয়ে দেখি কোথায় কি? আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়া মুছুয়া টাইপের একটা দাড়োয়ান। হাতে লাঠি। লাঠি দিয়ে আমাকে খোঁচা দিচ্ছে। আর খিস্তি খেউড় করছে। তাহলে যার সাথে এতক্ষণ কথা বললাম সেটা কে ছিল? সেটা কি আমার মনের ভুল? নাকি পাগলের প্রলাপ। আমার দিকে তাকিয়ে যে দাড়োয়ানটি তার ওস্তাদকে ডাকছিলো সেই লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললোঃ

-দেকতো তো ভদ্দ লোকের পোলা মনে অয়। ওয় পোলা, কবে থিক্ক্যা এই লাইনে আইছস? আ্যায়...নাম কি তর..

-ওস্তাদ অত কতা দিয়্যা কাম কি? হোগার মইধ্যে দুইড্ড্যা বারি দিয়া ছাইর‌্যা দেই...হালারপো ডলতে ডলতে বাইত যাইবো গা নে...

কথা বলা শেষ হতে না হতেই আমার পেছনে বেত দিয়ে দুইটা বারি দিল। ব্যাথার চোটে মুখ লাল হয়ে উঠলো। সেই ব্যাথা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাঁটতে শুরু করেছি..আর কানে বাজছে...  

জা জা ওয়ার্দা মন্দর মসীতা
অর্থঃপ্রতিদিন তুমি মন্দির মসজিদে যাও 

কাদি মন আপনে ভিচ ওয়ারিয়ায়ি নই 
অর্থঃকিন্ত্তু তুমি তোমার মন মন্দিরে যাও নাই। 

আইওয়ায়েঁ রুয শয়তান নাল লাড়দাঁ 
অর্থঃ প্রতিদিন তুমি শয়তানের সাথে লড়াই করো

কারদী নফস আপনে নাল লাড়িয়ায়ে নই
অর্থঃকখনো তুমি তোমার নফসের সাথে লড়াই করো নাই


বিঃদ্রঃ মনা পাগলা বস্তুজগতের কেউ নয়। এটি অবচেতন মনের কল্পনা। পুরো গল্পটিই কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে মিল অনেকটা কাকতালীয়। তাই দয়া করে কেউ এর মধ্যে দর্শন খোঁজার চেষ্টা করবেন না। দর্শন যার যার বিশ্বাস ভক্তির ব্যাপার। জোড় করে কিংবা প্ররোচিত করে ধর্ম দর্শন পরিচালিত হয় না। কারণ মনের ঐকান্তিক চেতনার ফসল হলো ধর্ম বিশ্বাসের মুল ভিত্তি।

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে - দশম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

আমি ভেবে পেলাম না। আমার চিন্তা-চেতনাগুলো কেমন যেন অনুভুতি শুন্য হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার ক্ষেত্রগুলো কেমন যেন সংকুচিত হয়ে আসছে। কি করি আর কি ভাবি, কোন কিছুই ঠিক করতে পারছি না।তাই ঝিম মেরে রইলাম। আমার অবস্থা দেখে বোধ করি মনা কেমন যেন ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর সে বললোঃ

-শোন বোকা। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি ধুলি-কণা এমন কি মহাজগতের সমগ্র কিছুই তার মহান সত্তার অস্তিত্ব। তোর দেহের প্রতিটি লোমকুপ, অণুচক্রিকা, লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা এমন কি মুলবস্ত্তু সবই কিছুই যেমন তোর অংশ-তদ্রুপ এই মহা জাগতিক প্রতিটি বস্তু কণা তারই অংশ। কাজেই তুই যে শেরেক করার কথা বললি, কোন্ অংশ দিয়ে কোনটি দিয়ে তার সাথে শেরেক তথা অংশীদার করবি? 

-যদি মহাবিশ্বের সবকিছুই তার অংশ হয়ে থাকে তাহলে তো আমিও স্বয়ং আল্লাহ পাক জাত সুবহানের উপাদানে তৈরী।

-অবশ্যই। এই যে তুই এখানে বসে আলো বাতাস নিচ্ছিস, কে দিচ্ছে? কোথা হতে কেমন করে তা তুই পাচ্ছিস? তোকে যদি তোর মহান প্রভু দয়া না করতো তাহলেতো তুই মৃত। তোর কোন অস্তিত্বই থাকতো না। তোর ভেতর তুই আছিস বলেইতো তুই বেঁচে আছিস।

-তাকে কি দেখা যায়? 

-কেন যাবে না? দেখার জন্য তো চোখ থাকা চাই। দৃষ্টির বাইরে দৃষ্টি সম্পুর্ণ ভিন্ন। দৃষ্টি মতিভ্রমের সৃষ্টি করে। কিন্ত্তু প্রকৃত দৃষ্টি তোকে কখনো বিভ্রান্ত করতে পারবে না। তুই আমার চোখের দিকে তাকা। কি দেখছিস? কাকে দেখছিস?

অামি মনার চোখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের দৃষ্টির মধ্যে আমার প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম আমি তার চোখের পুত্ততিতে যেভাবে আমি বসে আছি হুবহু সেইভাবেই আমাকে দেখলাম। আমি তাকে বললামঃ

-আমি আমাকে দেখছি। আমি আবার পাল্টা প্রশ্ন করলামঃ আপনি কাকে দেখছেন?

-আমি তোকে দেখছি। আমি তোর চোখের দৃষ্টির মধ্যে আমাকে দেখছি।

-এর মানে কি?

-খুবই সোজা। তুই আমাকে দেখছিস আমি তোকে দেখছি। তার মানে আমি ও তুমি। এই দুটোই সত্য। মুলে এক। পরম সত্ত্বাও এক। দুই দেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি। দুই হচ্ছে জোড়া সংখ্যা যা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আবার বলা শুরু করলোঃ

-আমি ও তুমি হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা । যুগলবন্দী। আশেক - মাশুক। আশেক সব সময় তার মাশুকের দেখার জন্য পাগল প্রাণ থাকে। চায় মিলন ঘটাতে। মিলনের সফলতা আসে সৃষ্টির সুভাষিত উদ্ভাষিত আলোক ধারায়। স্রষ্টা কি নারী না পুরুষ? সেটা জানাও জরুরী। তোর স্রষ্টা যদি নারী হয় তাহলে তোকে হতে হবে পুরুষ। আর তোর স্রষ্টা যদি পুরুষ হয় তোকে হতে হবে নারী। এই নারী-পুরুষ জাগতিক কোন নারী-পুরুষ নয়। এই নারী-পুরুষ হচ্ছে সত্ত্বাগত ভাবধারা। যা নুরে মুহাম্মদীর মধ্যে সুপ্তাবস্থায় নিহিত থাকে। এই নুরে মুহাম্মদীর প্রাণ হচ্ছে স্বয়ং রবরুপে তার দয়া। তাই তিনি রব্বুল আলামিন। সমস্ত জগতের প্রতিপালক। যিনি প্রতিপালন করেন তিনি কি? তিনি হচ্ছেন উত্তম অভিভাবক। তার চেয়ে উত্তম কোন অভিভাবক জগতে তুই আর পাবি না। তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা। তিনি যখন সেই জগত হতে এ জগতে আসেন তখন তার সম্মানে সকলে অবনত হয়ে যায়। যেটা কোরআনে বলা হয়েছেঃ "যখন আমি আদমকে স্বয়ং সম্পুর্ণ করবো তখন তোমরা তার সম্মানে সেজদায় অবনত হয়ে যেও।" তিনিই কেবল পারেন সেই অচেনা অজানা জগতের সাথে তোকে পরিচয় করিয়ে দিতে। এছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। তার দয়া ছাড়া কিছুই হয় না। হবে না। সম্ভব নয়। 

-ঠিক বুঝলাম না।

-বোঝার কথা ও না। জাগতিক বিষয় চিন্তা কর। তোর প্রেমিকাকে দেখার জন্য তুই কি করিস? তাকে দেখার একটা প্রচেষ্টা সবসময় থাকে তাকে দেখার। কেন? দেখলে তোর প্রাণটা একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। তাই না? এখানে তুই হচ্ছিস প্রেমিক। তথা আশেক। এই আশেক তার মাশুকের দীদার লাভ করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে। ঠিক তদ্রুপ তোকেও সেই আশেক-মাশুকের খেলা খেলতে হবে। জগতে অনেক নামী দামী আধ্যাত্মিক সাধকগণ স্রষ্টাকে দেখেছেন তার মাশুক রুপে।
যেমনঃ

হে সুজনী গুলবদনি চন্দ্রাননী নয়নও বাঁকা
মুক্তাকেশী প্রাণ পিয়াসী চন্দ্র শশী চরণও ছায়া।।
তব কাননে ধীর গমণে কুসুম কলি ফোটাও চরণে 
বিহঙ্গ গগনে ললিত তানে প্রেম আলাপন করিবে সদা।।
উদিত শশী কিরণ রাশি দুরিবে ভাতি মেঘের কালা
তুমি যেখানে নাহি সেখানে সর্বস্ব তুমি কাহার ছায়া।।
উঠাও আবরণ দাও দরশন তোমার ও আমার রবে না চিনন
তুমি আসিলে রবো না আমি তোমার আমার হবে গো দেখা।। 
খন্ঞ্জন গমন মৃগয়ালোচন ও রুপ রাশি লুকিবে কোথা
প্রেমিকও সুজন এহেন ও রতন হারে কি কখন পাইলে দেখা।।
সর্বত্র তুমি কোথা লুকিবে আমাতে তোমার খোজ মিলিবে
তেরা শাহাপীর হবে না অস্থির তোমার আমার হবে গো দেখা।।
(হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী কর্তৃক রচিত চিশতী উদ্যান হতে সংগৃহীত)

এখানে দ্যাখ, হে সুজনী অর্থ সুন্দর জন। স্ত্রী লিংগে প্রকাশিত ভাবধারা। গুলবদনি। গুল অর্থ ফুল আর বদনি অর্থ বদন মানে দেহ। তার মানে গুল বদনী বলতে ফুলের মতো দেহ যার। তার নয়ন চোখ বাঁকা। এখানে বাঁকা অর্থ বেকা-তেরা নয়। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা ট্যাগ্রা বলি সেরুপ কিছু নয়। এখানে বাকা অর্থ চিরস্থায়ী। মুক্তাকেশী অর্থ যার কেশ অর্থাৎ চুল মুক্তার মতো উদ্ভাষিত। প্রাণ পিয়াসী।  প্রাণ অর্থ চলৎ শক্তি। পিয়াসী। তথা আকষর্ণীয়। পিয়াস বলতে অামরা বুঝি তেষ্টা পাওয়া। তদ্রুপ প্রাণ পিয়াসী বলতে বুঝানো হয়েছেঃ যাকে দেখলে প্রাণের আকুলতা মিটে যায়। চন্দ্র শশী চরণও ছায়া। চন্দ্র-শশী বলতে বুঝানো হয়েছে-মণিকে। যা মহাদান স্রষ্টার পক্ষ থেকে। তার চরণের খেদমতে নিবেদিত প্রাণের আকুলতা নিয়ে পড়ে থাকাই স্বার্থকতা।
(চলবে)

বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে-নবম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)

-ভালো লাগবে কি করে? তোকে তো ভাবে পেয়ে বসেছে রে। এই ভাবতো ভালো না। এই ভাব দুনিয়া হতে পুরোপুরি মুক্তি দেয় না। একবার মনে হয় দুনিয়াটা মায়াজাল..মিথ্যা একটা অবভাষিক কিছু..আবার পরক্ষণেই মনে হয়.. না দুনিয়াই মজা..দুনিয়া অনেক কিছু। না দুনিয়া, না আখিরাত..মনের মধ্যে এ দোটানা ভাব পেয়ে বসে। তখনই কিছু ভালো লাগে না...

-কিন্ত্তু আমিতো সেটা চাই নি। আমি চাই আগে জেনে বুঝে তারপর এগুতে...আমার জানার ইচ্ছা প্রবল

-জেনে বুঝে যে আগাতে চাস...কি জেনে আগাবি...কিতাব পড়ে..নজরুলের কথা শুনিসনি..নজরুল কি বলেছে..

-কি বলেছে?

-কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি কংকালে
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
সেই কিতাব পড়, যা জানলে বুঝলে তুই নিজেকে পাঠ করতে পারবি। জানতে পারবি স্রষ্টার রহস্য। সৃষ্টির রহস্য।

-কিন্ত্তু সেই কিতাব কিভাবে পাঠ করতে হয় সেটাতো জানি না..

-আগে তোকে সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। যে তোকে নিজেকে পাঠ করতে শেখাবে...

-কিন্ত্তু তাকে পাবো কোথায়...

-হৃদয় বনে অতি গোপনে একার বাঁশি শুনেছি প্রাণে
মরমে মরি চাহি নেহারি  প্রাণ বঁধুয়া নাহিক হেথা।।
[হযরত খাজা শাহ পীর চিশতী-চিশতী উদ্যান] 
তোর হৃদয় মাঝে যে ডাক আসে তার কথা নীরবে নিশীথে একাকী বসে শোন...সে কি বলে...

-তার মানে আপনি ধ্যানের কথা বলছেন?

- তা না হলে আর কিসের কথা বলবো রে...মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যে হেরা গুহায় ধ্যান করেছিলেন তাতো তুই শুনেছিস তাই না? কিভাবে ধ্যান করতে হয় তা কি জানিস?

-নাতো?

-তাহলে তো তুই কিছুই জানিস না। তোকে যে কিভাবে ধ্যান শোখাবো? শোন...

হারিয়ে আপন করিবে ধ্যান মিলিবে আপন সোনারই বরন
অনন্ত জীবন পাইবে আপন মরন কখন হবে না তোমায়।
চাহিয়ে থাকো রুপেরই পানে মিশিয়ে যাও তাহারাই ধ্যানে
স্মরিবে তাহার তাহারই জ্ঞানে আপনা আপন হারিয়ে হেথায়।
[হযরত খাজা  শাহ্ পীর চিশতী-চিশতী উদ্যান] 

কি বুঝলি? তোকে ধ্যান করতে হলে তোর নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ তোর মধ্যে যে চেতনা আছে সেই চেতনাকে স্পর্শ করতে হবে। যখন তুই তাকে স্পর্শ করতে যাবি তখন দেখবি তোকে নানা রকম প্রলোভন দেখাবে..নানা প্রকার ভয় ভীতি দেখাবে...

-কে দেখাবে?

-তাগুত তথা শয়তান। কোরআন আর কিছুই নয়। মহা নবী হেরা গুহায় ধ্যানমগ্নঅবস্থায় যে বাণী লাভ করেছিলেন তা ছিল তার অন্তরের ভেতর থাকা মহান স্রষ্টার ডাক। স্র্রষ্টা তোর ভেতর সুপ্তাবস্থায় ঢাকা পড়ে আছে। এই ঢাকা পড়া অবস্থাটা হলো কুফুরি অবস্থা। কুফর অর্থ ঢেকে রাখা। সালাত ব্যাতীত তথা ধ্যান ব্যতীত সেই কালিমা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। আর ধ্যান করতে হলে গুরুর দয়া নিয়েই করতে হয়। নয়তো তাগুত তথা শয়তান বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করে। মন-মস্তিষ্কে সপ্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বার দ্বারা শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি নানারুপ প্রলোভনের সৃষ্টি করে। একেই বলা হয় মুর্তি। এই মুর্তি মন-মস্তিষ্কে যখন গেঁথে যায় তখন স্র্রষ্টা ঢাকা পড়ে যায় তথা কুফুরির মধ্যে থাকে। এই জন্যই বলা হয়েছেঃ লা তাকরাবুসসালাতা ওয়া আনতুম শুকারা। অন্য স্থানে বলা হয়েছেঃ লা সালাতা ইল্লাবিল হুজুরী কল্বব। আর কোরআনে বলা হয়েছেঃ "ইয়া আয়ুহাল লাজিনা আমানুত্তা কুল্লাহা ইয়াবতাগুত ইলাহিল ওলিসাতা ওয়া জাহিদু ফি সাবিলিল্লাহি লা আল্লাকুম তুফলিহুন।" এখানে আমানু বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা এই সালাত করে একটা ওসিলা নিয়ে। ওসিলা ব্যতীত সালাত আদায় করতে গেলেই বিপদে পড়তে হয়। হবে। এই ওসিলাই হলো কামেল মুর্শিদ। তাকে সাথে নেয়ার অর্থ হলো তুই শরিক করলি। অর্থাৎ মুশরিক হলি।

-শেরেক করাতো মহাপাপ। আল্লাহ পাকতো বলেছেন তিনি সবকিছু ক্ষমা করতে পারেন। কিন্ত্তু যারা শরিক করবে তাদের তিনি কোন মতেই ক্ষমা করবেন না। শেরেক করা অমার্জনীয় অপরাধ।

-তুইতো দেখি বেশ জানিস। আচ্ছা বলতো শেরেক ছাড়া কোন মানুষ আছে? আছে কোন সৃষ্টি? 

মনার কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এম্মনিতেই আজকে একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছি। তাতেই মাথাটা বন বন করে ঘুরছে। তারপর মনার বকবকানি। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। এখন আবার আরেকটা কথা বলছেঃ শেরেক ছাড়া কোন মানুষ আছে কি-না? 

আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম-শেরেক বা শিরক অর্থ অংশীদার। কিসের অংশীদার। অংশ বলতে আমরা বুঝি ভাগ করা। জমি জমা ভাগ করতে গেলে এই অংশীদারের ব্যাপারটা আসে। কেন আসে? পিতার অংশ এবং মায়ের অংশ থেকে সৃষ্টি আমি। তার মানে আমার ভেতর এক অংশ পিতার এবং আরেক অংশ মায়ের। এখানেওতো শেরেক আছে।মনে হয় মনা এই শেরেকের কথা বলে নাই। না-কি বলেছে? জিগ্যেস কিছু করবো? না-কি আরেকটু চিন্তা করবো? যেহেতু সে বলেছে " শেরেক ছাড়া কোন মানুষ আছে কি-না "?
(চলবে)

রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনাপর্ব পাগলার খোঁজে-অষ্টম

(পুর্ব প্রকাশের পর)
মনার দেখা না পেয়ে মনটা হতাশায় পরিপুর্ণ হয়ে গেল। দুঃখভারাক্রান্ত মনে একটা টং দোকানে বসে পড়লাম। দোকানীকে বললামঃ

-একটা চা দেন, মামা।

-চা কি মামা দুধ চিনি বাড়াইয়্যা দিমু?

-বাড়াইয়্যা দিবেন মানে কি?

-মানে কিছু না। দুধ চাতে অনেকেই দুধ চিনি বাড়াইয়্যা খায়তো। হেরলাইগ্যাই জিগাইলাম।

তার কথাটা আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হল। তার মানে সে আমার অবস্থা দেখে মনে করেছে আমি ফেন্সি খেয়েছি। নয়তো গাজায় টান দিয়েছি। যারা নেশা করে তারা হয়তো সেটা পছন্দ করে। আমার কাছে মনে হলো দোকানীর কাছে যারা আসে তারা সবাই খোরে আদম। আমারও মন চাইলো বিষয়টা অনুসন্ধান করে দেখার। এম্মিতেই মনার দেখা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। তার উপর দোকানী যেভাবে সন্দেহ করছে তাতেতো দেখি খাওয়াই উচিত। আমার কৌতুহলী মনটা নেশা করার জন্য ব্যস্ত একটা ভাব দেখালো। আমি মামাকে জিগ্যাসা করলাম

-মামা ব্যবস্থা কিছু আছে না-কি?

-কোনটা মামা?

-এই ধরেন সস্তা ধরণের কোন কিছু?

-আছে মামা। এই নেন। 

দোকানী আমাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে টং দোকানের পেছনের দিকটা দেখিয়ে বললো

-ঐ দিকটায় যান। কেউ বিরক্ত করবো না। আর পুলিশও আসবো না। যান মামা।

আমি সিগারেটটা নিয়ে ধরালাম। ধরিয়ে দেখি বিকট গন্ধ। বুঝলাম। সস্তা বলতে সে গাঁজাকে বুঝিয়েছে। আর দামী বললে সে হয়তো ফেন্সি ধরিয়ে দিতো। যাই হোক। সেখানে গিয়ে দেখি ছেলে বুড়ো সবাই দিব্যি গাঁজা টানছে। আমার টানার ধরণ দেখে তারা বুঝলো যে আমি আনকোড়া। অর্থাৎ নতুন। বুড়োরা দেখি কলকিতে ধরিয়ে জোড়ছে টানছে। যে পরিমাণ ধোয়া বের হচ্ছে আর উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে তাতেতো যারা খায় না তারাও নেশাগ্রন্থ হয়ে যাবে। সিগারেটটা শেষ করার পর টের পেলাম আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। আর মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। মুহুর্তের মধ্যেই চেনা পরিবেশটা হটাৎ কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছি আশে পাশের মানুষগুলো যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কথা বলার ধরণগুলো পাল্টে যাচ্ছে। কেমন যেন কথাগুলো জড়তায় আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি হটাৎ উঠে দাঁড়ালাম। মাথাটা ঘুরছে। দোকানীকে বললামঃ

-মামা পানি দাও।

-মামা পানি না খাইয়্যা একটা গরম চা দুধ-চিনি বাড়াইয়্যা বানাইয়্যা দেই খাইয়্যা দেহেন। হের পর কথা কইয়েন। দেহেন কেমুন লাগে?

-দে...ন..খা..ই

দোকানী আমাকে দুধ চিনি বাড়িয়ে একটা চা দিল। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়ে ফেললাম। কিন্ত্তু বেশ লাগছে। যেদিকে লোকজন কথা বলছে সেদিকটায় খেয়াল করলে বেশ স্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে। আবার অন্য দিকটায় তাকালে কেমন যেন অপরিচিত লাগছে। 
আমি দোকানীর পাওনা মিটিয়ে সেখান হতে বের হয়ে নিরিবিলি একটা স্থান দেখে বসে পড়লাম। যেদিকটায় সচরাচর কেউ আসে না। সেটা হলো মাজারের পেছন দিকটায় যে পুকুর ঘাটটা আছে সেখানে। পাশেই শান বাধানো বেদী। আমি একটার উপর হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। গাছের গুড়িতে মাথা ঠেকিয়ে পা দুটো জড়ো সড়ো করে চোখ বুঝে ঝিম মেরে বসে রইলাম। নীরব নিঃস্তব্ধ। চারদিকে সুনশান নীরবতা। মাঝে মাঝে মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। চোখ বুঁজে থাকতে বেশ লাগছে। জায়গাটা এতোটাই নীরব যে নিজের কানে শুনছি নিজের ভেতরের তর্জন-গর্জন। বুকের ভেতরের ধুকধুকানি। ঠিক তক্ষুণি মনাকে দেখতে পেলাম। মনা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আর হাসছে। আর বলছেঃ

-কিরে তুই এখানেও চলে এলি?

-কি করবো? কিছুইতো ভালো লাগে না।
 (চলবে)

শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে-সপ্তম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)
আমার দাঁড়িয়ে থাকাটা প্রিন্স বাজারের দারোয়ানের খুব বেশি পছন্দ হয়নি। একজন পাগলের জন্য আরেকটি পাগল হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পথিকের মতো বিশ্রাম নিবে প্রিন্স বাজারের সামনে তা-কি হয়? কখনো না। দারোয়ান বেশ ভারিক্কি গলায় বললোঃ

-এখানে দাঁড়াইছেন কেন্?

-কেন ভাই? কোন সমস্যা?

-অবশ্যই সমস্য। আপনে এইখানে শুধু শুধু দাঁড়াইয়্যা থাকবেন? এইটা কেমুন কথা? যান এইখান থিক্কা।

অপমানজনিত কথা। কিন্ত্তু কি করবো? সেখান থেকে চলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কাছাকাছি আসতে আসতে একটা অজনিত আশংকা পেয়ে বসলো। কি জানি কি হয়? যদি তার দেখা পাই, সে কি আমাকে দেখে অবাক হবে? না-কি সে তার স্বভাবসুলভ আচরণ করবে? আর যদি না-পাই তাহলে কোথায় খুঁজবো তাকে? তাকে যে আমার দরকার। আমি মীরপুর মাজারের কাছাকাছি চলে এলাম। এসেই পড়লাম বিপাকে। কোন্ দরজা দিয়ে যাবো? বড়ো গেইট দিয়ে নাকি বাজারের সামনে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা দিয়ে প্রবেশ করবো? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভাবলাম যা থাকে কপালে সামনের দরজা দিয়েই প্রবেশ করবো। 

আমি সামনের রাস্তা ধরে এগুতে থাকলাম। আর আশে পাশে চোখ বোলাতে লাগলাম। দেখি তার দেখা পাওয়া যায় কি-না? মাজারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু কিছু লোক এমন আচরণ করে যে, সে সত্যিকারের কোন বড়ো কোন ফকির। যে কোন সমস্যার সমাধান সে করে দিতে পারে। তাদের ভিক্ষার পদ্ধতি এমন যে সাধারণ মানুষ তো ধোঁকায় পড়বেই এমন কি অনেক শিক্ষিত লোকও বোকা বনে যেতে পারে। তাদের কারণেই অনেক অনেক সত্যিকারের পাগলরা ঢাকা পড়ে যায়। তাদের কারণেই মাজারের বদনাম হয়। হয় অলিদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্রদ্ধভাব। এই মনোভাবের কারণেই সাধারণ মানুষ এমন কি অনেক শিক্ষিত মানুষও অলিদের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে ওঠে। ব্যবসা করার ফন্দি ফিকিরের কারণেই তাদের এই বেশ-ভুষা। আমার দেখা একটা ঘটনার কথা বলি। একজন লেংড়া লোক এবং একজন অন্ধলোক ঝগড়া করছে। অন্ধলোকটি থাকতে চাচ্ছে একদম সদর দরোজার কাছাকাছি। যাতে লোকজন বের হবার সময় তাকে সবাই দেখতে পায় এবং ভিক্ষার ইনকামটা বেশি হয়। অপরদিকে লেংড়া লোকটাও থাকতে চাচ্ছে সেই জায়গাটায়। তারও ইচ্ছা ভিক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য। একপর্যায়ে মারামারি বেঁধে যায় তাদের মধ্যে। পরের লোকজনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সেই সময় একজন বলেছিল যখন দেখবেন কোন লোক ভিক্ষা চাওয়ার ক্ষেত্রে ঠিকমতো বলতে পারছে না, তখন ধরে নেবেন এইলোকটি সাধারণ ভিক্ষুক নয়। সে কোন অভাবগ্রন্থ। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সে ভিক্ষা করছে। পেশাদার হলে সে কায়দা করে আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছে। যাই হোক...আমি হাঁটতে হাঁটতে আরো সামনে গেলাম। নাহ। সে সেখানেও নাই। আমি মাজারের ভিতরে যাওয়ার জন্য অযু করলাম। তারপর মাজারের ভিতরে ঢুকলাম। মাজার জিয়ারত শেষ করে বের হয়ে এলাম। মনের মধ্যে কেমন যেন খস খস করছে। এতদুর হাঁটাহাঁটি করেও মনার দেখা পেলাম না।
(চলবে)

শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

মনা পাগলার খোঁজে - ষষ্ঠ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর)
আমার কাছে ভাবতে খুব অবাক লাগে যে নবী আমাদের আল্লাহ এবং তাঁর পারিপার্শ্বিকতা সর্ম্পকে জানালেন, সত্য-মিথ্যার প্রভেদ দেখালেন সেই ইসলামের নবী পরিবার নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হলেন তাঁর মৃত্যুর পর। কারবালা নামক স্থানে যে নির্মম নির্যাতনের স্ট্রীমরোলার তৎকালীন শাসক শ্রেণী চালিয়ে ইমাম হোসাইন (আঃ) কে হত্যা করেছিল তারা আর কেউ ছিল না। তারাও ছিল মুসলমান। তবে কোন্ শ্রেণীর মুসলমান, তা ইমামের একটি ভাষণের মধ্যে প্রষ্ফুটিত হয় আর সেটি হলোঃ"তোমরা কি আমাকে চেন না? চেয়ে দেখ, আমি কে? আমি রাসুল(আঃ) এর প্রিয়তম দৌহিত্র। আমি খাইবার বিজয়ী শেরে খোদা হযরত আলী (আঃ) এর ছেলে। আমি খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমাতুজ্জোহরার স্নেহের লাল। তোমরা কি নানাজানের মুখে শোননি, আমি আমার ভাই হাসান বেহেস্তের সর্দার? আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি যে তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাও? আমাকে হত্যা করে তোমরা আল্লাহ এবং তার রাসুল(আঃ) কাছে কি জবাব দেবে? তারপর তিনি যে কথাটি বললেন তা সত্য এবং মিথ্যাকে মুমিন এবং মোনাফেকদের পৃথকীকরণের জন্য সমস্ত মুসলিম জনগণের কাছে শিক্ষা হয়ে রইলো। তিনি বলেছিলেন, "আলাম তাসমাও আলাইসা ফি কুম মুসলিম?" অর্থঃ তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাওনা? তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই? "

সত্য বরাবরই তিতা। আল হাক্কু মুরুন। তাই উক্ত বিষয়ে  আর কথা বলতে মন চাইছিল না। কিন্ত্তু না বলেও পারছি না। মনাকে এ বিষয়ে একবার প্রশ্ন করেছিলাম। মনা তার স্বভাব সুলভ জবাবই দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম-কারবালা ও তার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে নানান অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়। অনেক বদনাম শুনতে হয়। অনেক গন্ঞ্জনা সহ্য করতে হয়। তার মধ্যে কমনটি হলোঃ ভাই আপনি কি শিয়া? - এই অভিযোগটি প্রায়ই শুনতে হয়। আমার কথা শুনে মনা বললোঃ শোন্ বেআক্কেল, সত্য যেটা সেটা চিরন্তন সত্য। কেউ মানুক আর না মানুক। সেই সময় ঠিক কি ঘটেছিল, আমরা যেহেতু সেসময় ছিলাম না তাই আমরা তা বিভিন্ন বই-পুস্তক হতে কিংবা কোন বিজ্ঞজনের নিকট হতে তা জানতে পারছি। বিজ্ঞজনরা তা বিভিন্ন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন। এর যেমন পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক যুক্তি তর্ক থাকতে পারে তেমনি থাকতে পারে অনেক অজানা ইতিহাস। আর ইতিহাস হচ্ছে কালের স্বাক্ষী। তাই সেখানে যে ঘটনা ঘটেছিল তা সত্য। কেউ এটা অস্বীকার করতে পারবে না। ঠিক কি ঘটেছিল তা জানতে হলে তোকে ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে হবে। তুই যদি কোন কিছু লুকিয়ে কিংবা অতিরন্ঞ্জিত করে কল্পকাহিনী তৈরী করে বাজারে পুস্তকাকারে বিক্রি করিস, তাহলে সেই বই পুস্তক পড়ে একটা শ্রেণী তৈরী হবে। সাথে তৈরী হবে এর বিপক্ষে অবস্থানকারী দল। তো পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের মাঝে কোলাহলের বীজ বুনন করলো কে? ঐ যে লেখক। যে লিখে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। কাজেই সত্য নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ হতে তুই বিচার করতে পারবি না। তবে জেনে রাখ এই ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ (রহঃ) তার এক মকতুবাদে বলেছিলোঃ 

'এই বাজে নাবী বার সারে তাজে নাবী,
এই দাদ শাহানশাহ যে তীগ্বে তো বাজে নাবী।
এই তো কে মেরাজে তো বালাতর শোদ,
ইয়েক ক্বামাত আহমদী যে মিরাজ--নাবী।'

অর্থঃ "হে নবীর দুলাল, তোমার মস্তকেই নবীর শোভা পায়, হে সম্রাট, তোমার তরবারি নবীর ন্যায বিচারের প্রতীক, হে হোসাইন, তোমার মিরাজ হয়েছে অনেক উর্ধ্ব স্তরে, আহমদ নবীর মিরাজ থেকেও এক স্তর উপরে।" [দেওয়ান-ই-মইনউদ্দিন]

সমস্ত অলী-আউলিয়ারগণ সর্বদাই ইমামদের অনুসরণ করে গেছেন। যারা তাদের অনুসারী তারাও ইমামদের অনুসরণ করে চলেছেন এবং ভবিষ্যতেও অনুসরণ করবেন। তোর কথাই যদি ধরি, তাহলে দ্যাখ সমস্ত অলীগণই শিয়া। কারণ আল্লাহ পাক শানে কালামে পাকে পাক-পান্ঞ্জাতনকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

অামি মনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি কি বুঝাতে চাইলাম আর মনা কি বুঝলো? যাক সত্য-মিথ্যার বাহারতো প্রকাশকরাই করে থাকে। বিভেদের বীজও তারাই বুনন করে। লিখেও করে আবার ছাপিয়েও করে।
আমি হাটতে হাটতে প্রায়ই মীরপুর এক নম্বর চলে এলাম। মীরপুর এক নাম্বারের কাছেই প্রিন্স বাজার নামে একটি শপিংমল আছে। আমি সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সেখান থেকে মাজার রোড কাছেই। আমি একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে আছি।
(চলবে)