পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০১৫

জোলাভাতি

সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শফিক সাহেব পার্কে থাকা বেন্ঞ্চিতে বসে পড়লেন। লেকের ঝিরি ঝিরি হাওয়া, পাতার মর্মর শব্দে আর পাখিদের কলতানে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শরীরটাকে শীতলতার পরশ বুলিয়ে দিল। কেমন যেন একটা ঘুমের আবেশ তৈরী হলো। তিনি বেন্ঞ্চে আলতোভাবে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। চোখে তখন রাজ্যের ঘুম চলে এল। পাখির ডাকে আর বাতাসের আবহনে তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। কোয়ান্টাম মেথডের মতো চোখ বুঁজে পড়ে রইলেন। 

পাশেই দেখলেন পথ শিশুরা মাটি কাদা আর কচুরি পানা দিয়ে জোলাভাতি খেলছে। তিনি তাদের কথা বার্তা শুনতে পাচ্ছেন। সেই কথা শুনতে শুনতে তিনি হারিয়ে গেলেন অতীত স্মৃতিতে........

বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট একটি খাল। খালের গভীরতা খুব বেশি না হলেও সেটাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। একটু দুরেই বাগান। বাগানের গাছ গাছালি আর পাখিদের কলতানে সব সময়ই মুখোরিত থাকতো। খালের মুখেই ঝুঁকে পড়া বাদাম গাছের একটি ডালে থোকা থোকা কাঠ বাদাম ধরেছে। সেই বাদাম পেড়ে আনতেন। কচুরি পানা দিয়ে তৈরী করতেন গরু। মাটি দিয়ে ভাত রান্না করতেন। কাদা মাটি আর কচুরি পানা দিয়ে তৈরী করতেন তরকারী। তারপর সেটা সবাই মিলে মিথ্যে মিথ্যে খাওয়ার জন্য বসতেন। কখনো মুন্নি বা তিন্নিকে বউ বানাতেন। বলতেন 

-বউ আমি গোছল সেরে আসতাছি। তুমি ভাত রাইন্ধ্যা আমারে ডাক দিও। 

-আইচ্ছা। তুমি গোছল কইর‌্যা তাড়াতাড়ি আইস্যে।

গোসল করতে খালে ঝাঁপ দিতাম। সারা খাল মাতিয়ে তুলতাম। কাঁদা মাটি দিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি খেলতাম। সারাটা দিন কেটে যেত কতো আনন্দে। গোছল শেষ করেই কখনো মুন্নিকে কখনো তিন্নিকে বলতাম

-বউ ভাত দেও। 

-এই নেও। কচুরি পাতার উপর ধুলো দিয়ে রাধা ভাত আর তরকারী দিত। কপ কপ করে মিথ্যে খাওয়ার অভিনয় করে বলতাম

-তরকারীটা স্বাদ হইছে। আরেকটু দেও...

পুরোনো সেই স্মৃতিটা যেন ভাসছে চোখের সামনে। চোখের সামনে এমন একটি ঘটনায় তার চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে এল। আজ কোথায় মুন্নি আর কোথায় তিন্নি? কোথায় মুনির, সাদেক? দেখতে দেখতে সেই সোনালী অতীতগুলো কালের স্রোতে হারিয়ে গেল।

তিনি তাকিয়ে দেখলেন - সেই পথ শিশুরাও তেমনিভাবে সেই খেলাটাই খেলছে। তিনি তাদের ডাকলেন। সেই ডাকে সারা দিয়ে একটি ছোট্র মেয়ে এসে বললোঃ

-ডাকছেন ক্যান?

-এম্মনি। কি নাম তোমার?

-সালেহা। আর ওর নাম? আমি হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালাম

-অর নাম মায়া।

শফিক সাহেব তাদের সবাইকে ডাকলেন। তারা সবাই আসতেই একশো টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন-এই টাকা দিয়ে কিছু কিনে খাও। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বাড়ীর পথ ধরলেন। পথে হাঁটতে হাঁটতে আবৃত্তি করছেনঃ

আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়।
-জীবনানন্দ দাস

[বিঃদ্রঃ # ব্যাখ্যাঃ জীবন+আনন্দ=জীবনানন্দ। আনন্দময় জীবনের অংশ যিনি তিনিইতো জীবননান্দ। দাস কথাটির অর্থ গোলামী করা। অর্থাৎ মহান সৃষ্টিকর্তার আনন্দময় কৃতির যিনি দাস হইয়া থাকিবার যোগ্য হন তিনিই হন জীবনানন্দ দাস।
প্রভুর বিভুতির স্থান হচ্ছে হৃদদেশে। সেই স্থানে আসন করিবার যোগ্য হলেই কেবল উপাসনার বিষয়ে পরিণত হন। তিনি কে? তিনিই হচ্ছেন- " আমি "। পন্ঞ্চভুতের পন্ঞ্চ দেবতার চেয়েও তিনিই বড়ো। তিনি না থাকিলে জীব চৈতন্যপ্রাপ্ত হন না। সেটা কে? সেই উত্তর জানিতে হইলে ঐ পন্ঞ্চভুতের পন্ঞ্চদেবতাদেরকে জিগ্যাসা করা হইলে তাহারাও নিঃসন্দেহে বলিবে-"আমি"। তাহার পরিচয় কি? তাহার পরিচয় হইল - সে সমস্তদেবতাদেরও দেবতা। তাই তিনি মহাদেব। সেই মহাদেবের অন্য নাম - আমি।
আলোচ্য অংশে - " অামি সব দেবতাকে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি " কথাটির সারমর্ম হইতেছে - তিনি তাহার নিজ স্থানে স্বমহিমায় উদ্ভাষিত হইয়া থাকিতে চাহেন। যখন উদ্ভাষিত হন তখনই তিনি আবার তাহাকেই প্রশ্ন করিয়া থাকেন - " বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়।"]

পুতুল খেলা

রহিম সাহেব তার মেয়ে অর্থির জন্য একটি পুতুল কিনেছেন। পুতুলগুলো চায়নার তৈরী। একটি চাবি আছে। সেটাতে চাবি দিলেই পুতুলটি নাচতে থাকে। শুধু নাচেই না একটি মিউজিকও প্লে হয়। সেই মিউজিকের তালে তালে সেটা ঘুরে ঘুরে নাচে। পুতুলটি পেয়ে তার মেয়েটি খুশিতে আটখানা। সে যখনই সময় পাচ্ছে তখনই পুতুলটিতে চাবি দিচ্ছে। ছেড়ে দিচ্ছে । সেটি মিউজিকের তালে তালে নাচছে হাতে তালি দিচ্ছে। হাতে থাকা ছাতাটি ঘুরাচ্ছে। অসম্ভব খুশিতে তিনিও বেশ প্রফুল্ল বোধ করছেন। তিনিও মেয়ের সাথে সেই পুতুল নিয়ে খেলছেন। অর্থি চিৎকার করে বলছেঃ

-বাবা বাবা ধইরো না...

তিনি মেয়ের কথা শুনছেন না। তিনি সেটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছেন। দেখলেন দুটি পেন্সিল ব্যাটারী আছে। একটি সাউন্ড বক্স আছে। একটি সার্কিট বক্স আছে। গায়ের পোষাকের নিচে একটি বক্স করে রাখা। বাহির থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই। তিনি চাবি দিচ্ছেন..সেটাকে ছেড়ে দিচ্ছেন গুনগুন করে গান গাইছে। ঘুরে ফিরে নাচছে...আবার তার পুণরাবৃত্তি করলেন। ব্যাটারী খুললেন। সেটা থেমে গেল। চালাচ্ছেন চলছে। একটু বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন। দেখা গেল সেটা কিছুক্ষণ সেখানে থেকে মোড় ঘুরিয়ে আবার চলা শুরু করছে....

তিনি যখন পুতুলটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন ততক্ষণে অর্থি কান্না শুরু করে দিয়েছে। অর্থির কান্না শুনে পাশের রুম থেকে মিতু ছুটে এসে দেখলেন তার স্বামী পুতুল খেলায় মেতে আছে। তার পাশে থাকা অর্থির দিকে তার কোন খেয়াল নেই। মেয়েটি কান্না করতে করতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। এটা দেখে মিতুর বেশ রাগ হলো। সে রহিম সাহেবকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ

-কি হলো তোমার? মেয়েটি কান্না করছে তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না?

সম্বিত ফিরে পেয়ে রহিম সাহেব মিতুকে বলছেঃ

-দ্যাখো এর মধ্যে দুটি ব্যাটারী একটি সাউন্ড বক্স একটি সার্কিট আছে। চাবি দিলেই দম পেয়ে সেটা গান গাচ্ছে। ঘুরছে..নাচছে...

-সেটা দেখার কিছু নেই। তুমি অর্থিকে পুতুলটা দাও। ওর কান্না থামাও...দেখছো না মেয়েটা কান্না করছে...

-আরে বাবা দিচ্ছি..একটু দেখতে চাইছি চীনারা এটা কিভাবে ব্রেন খাঁটিয়ে বানিয়েছে...আবার সিল মেরে দিয়েছে মেইড ইন চায়না...ওদের বেশ বুদ্ধি আছে বলতে হবে...

-ওদের বুদ্ধি দেখে তোমার কাজ নেই। তুমি পুতুলটা দাও...

এ কথা বলেই মিতু ছো মেরে পুতুলটা ছিনিয়ে নিয়ে মেয়ের হাতে দিলেন। পুতুলটা পেয়ে তার কান্না বন্ধ করে চোখ মুছতে মুছতে বগলদাবা করেই সেখান থেকে চলে গেল।

রহিম সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এটা কিভাবে সম্ভব? এতোটাতো মিল থাকার কথা না। যে সৃষ্টি করে সে হয় সৃষ্টি কর্তা। আরবীতে সৃষ্টিকর্তাকে বলা হয় খালিক।  যেমন পুতুলটি সৃষ্টি করেছে চায়না। লেখা মেইড ইন চায়না। তাহলে পুতুলটির খালিক হচ্ছে চীন। আমি যদি আমার দিকে তাকাই। তাহলে দেখি আমার সৃষ্টি কর্তা হচ্ছেন আমার পিতা। তাহলে সে হচ্ছে খালিক। আর আমার মা আমাকে লালন পালন করেছেন। আরবীতে লালন-পালন করাকে বলা হয় রব অর্থাৎ পালন কর্তা। তাহলে মা হচ্ছেন রব। তারাওতো সে একই প্রকৃয়ায় একইভাবে সৃষ্ট। তাহলে আমরা যদি প্রকৃতভাবে বিচার করি তাহলে তো সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন খালিক সেই মহান জাত পাক সুবহান। তিনিইতো আমার আহার যোগাচ্ছেন। আমার কর্মের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনিইতো রব। চিন্তার গভীরে তিনি হারিয়ে গেলেন।

রবিবার, ১৭ মে, ২০১৫

খোঁচাইল

নদী এখন পুর্ণ যৌবনা নয়া পানির নয়া ডাকে সারা না দিয়ে পারলো না কাউসার তার একটাই চিন্তা পোনা মাছ শিকার করা সে একটা ঠেলা জাল বানিয়েছে আন্ঞলিক ভাষায় সেটাকে বলা হয় খোঁচাইল সেইটা দিয়েই সে ঠেলে ঠেলে মাছ শিকার করে খোঁচাইল দেখতে অনেকটা ত্রিভুজাকৃতির তিন টুকরো বাঁশের কন্ঞি দিয়ে তৈরী মাঝখানে জাল পাতা
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে আষাঢ়ের প্রথমভাগে গাঙ্গে নতুন পানি আসে। সেই পানিতে মা মাছ ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে বের হয় মাছের পোনা। কাউসার সেই পোনা মাছ ধরায় ব্যস্ত। সে দেখলো নদীর কাছাকাছি পাড়ের ধারে গুড়া চিংড়ি মাছই বেশি ধরা পড়ছে। ছোট ছোট চিংড়ি মাছের পোনা জালে পড়তেই সেগুলো কেচে তুলছে পাত্রে। সাথে আসছে নানান ময়লা আবর্জনা। আবর্জনা পরিস্কার করেই সে পোনা মাছগুলো তুলছে। দেখতে দেখতে বেশ মাছ ধরে ফেলেছে। একটু বিরতি দিয়ে সে পাড়ে এসে বসলো। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে আপন মনে টানতে লাগলো। বিড়ি টানছে আর চিন্তা করছে আরো কিছু মাছ ধরবে। আজকে জালে বেশ মাছ ধরা পড়ছে। বিড়ি টানার ফাঁকে সে দেখতে পেল রহিম পাগলা আসছে।রহিম পাগলাকে আসতে দেখে কাউসার দ্রুত নদীতে নেমে পড়লো মাছ ধরার জন্য। তাকে নেমে পড়তে দেখে রহিম পাগলা আরো দ্রুত তার কাছে চলে এল। কাউসারের উদ্দেশ্যে রহিম পাগলা বললোঃ

-কি কাউসার কি করস? মাছ ধরস? আমাগো কাউসার মাছ ধরে হে...হে

কাউসার তার কথায় কান দিলো না। সে তার কাজ করে যেতে লাগলো। আজ জালে বেশ মাছ ধরা পড়ছে। কাজেই পাগলের কথায় কান দিলে তার সময় নষ্ট। কিন্ত্তু রহিম পাগলা নাছোড়বান্দা। সে কাউসারকে লক্ষ্য করে আবারো বলা শুরু করলোঃ

-কি রে কাউসার কি করস? মাছ ধরস । পোনা মাছ হে...হে... হাউজে কাউসার পোনা মাছ ধরে।
কিরে হাউসে কাউসার? কি দিয়া মাছ ধরস?

বিরক্ত হয়ে কাউসার বললোঃ

-দেহেন না কি দিয়া মাছ ধরি...খোঁচাইল দিয়া মাছ ধরি..

-ঐডা খোঁচাইল? ভালো কইর‌্যা দেকতো তিনকোনা দেখতে ঐডারে খোচাইল কয় নি?

-কি কয় তাইলে...আপনের মাথা...

রহিম পাগলা ক্ষেপে গিয়ে বললোঃ

-তিনকোণা নিচে তেনা তারে বুঝি কয় খোঁচাইল...আর খোঁচাইলেই দেহি আহে পোনা..
রহিম পাগলার কথা শুনে কাউসার যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো...পাগলা এইডা কি বুঝাইতে চাইলো। সে তার হাতে থাকা খোঁচাইলটা উপরের দিকে টেনে তুলে লক্ষ্য করে দেখতে পেলো সত্যিইতো সেটা দেখতে অনেকটা..তারপর যখন সেটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সেটাতে ধরা পড়ছে পোনামাছের ঝাঁক। পাগলটা তাকে কি বুঝাইতে চাইলো...আবার তাকে বলছে হাউসে কাউসার... রহস্যটা কি?
কাউসার রহিম পাগলার দিকে তাকিয়ে দেখে সে হন হন করে হেটে যাচ্ছে...আর গাইছে
নদীকে সদায় উঠে জল
ও সে করছে টলমল
রাগের ছড়ি, ছিপের বাড়ি খেলে বেটা
শুকনায় হবি তল।
কত রসিক জেলে জাল ফেলে
প্রাণ নিয়ে দিচ্ছে সাঁতার

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০১৫

কাউসারের মৎস শিকার


নদী এখন পুর্ণ যৌবনা নয়া পানির নয়া ডাকে সারা না দিয়ে পারলো না কাউসার তার একটাই চিন্তা পোনা মাছ শিকার করা সে একটা ঠেলা জাল বানিয়েছে আন্ঞলিক ভাষায় সেটাকে বলা হয় খোঁচাইল সেইটা দিয়েই সে ঠেলে ঠেলে মাছ শিকার করে ত্রিভুজাকৃতির খোঁচাইল দেখতে অনেকটা স্ত্রীজনন ইন্দ্রিয়ের মতো তিন টুকরো বাঁশের কন্ঞি দিয়ে তৈরী মাঝখানে জাল পাতা
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে আষাঢ়ের প্রথমভাগে গাঙ্গে নতুন পানি আসে। সেই পানিতে মা মাছ ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে বের হয় মাছের পোনা। কাউসার সেই পোনা মাছ ধরায় ব্যস্ত। সে দেখলো নদীর কাছাকাছি পাড়ের ধারে গুড়া চিংড়ি মাছই বেশি ধরা পড়ছে। ছোট ছোট চিংড়ি মাছের পোনা জালে পড়তেই সেগুলো কেচে তুলছে পাত্রে। সাথে আসছে নানান ময়লা আবর্জনা। আবর্জনা পরিস্কার করেই সে পোনা মাছগুলো তুলছে। দেখতে দেখতে বেশ মাছ ধরে ফেলেছে। একটু বিরতি দিয়ে সে পাড়ে এসে বসলো। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে আপন মনে টানতে লাগলো। বিড়ি টানছে আর চিন্তা করছে আরো কিছু মাছ ধরবে। আজকে জালে বেশ মাছ ধরা পড়ছে। বিড়ি টানার ফাঁকে সে দেখতে পেল রহিম ভাই আসছে। রহিমকে সবাই তত্ত্বজ্ঞানী হিসেবেই জানে। বেশ রসিক। অনেক জ্ঞান রাখেন। লালনের ভক্ত রহিম ফকির এলাকায় পরিচিত বাউল রহিম হিসেবে। সেই রহিম বাউল হাতে একতারা নিয়ে গান গাইতে গাইতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাউসারের দিকে তাকিয়ে রহিম ফকির বললোঃ

-
কি মিয়া কি মাছ ধরছো?

-
পোনা। পোনা মাছ ধরছি। এই শুমায় পোনা মাছই বেশি আহে গাঙ্গে.. কাউসার বললো।

-
গাঙ্গে তো পোনা মাছ আইবোই। নতুন জোয়ারে নতুন বানে পোনা আইবোই তো ... ত্রিবেণীতে ত্রিধারায় তিন রংয়ে পানি আহে। সেই পানিতে কেউ কুড়ায় মণি মাণিক্য। রসিক ডুবারুরা ডুব দিয়া আনে অমুল্যধন।

-
তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝি না। কি কও ত্রিবেণী রসিক ডুবারু হ্যান ত্যান...খুইল্যা কও

-
আরে মিয়া খুইল্ল্যা কওন যাইবো না রাইতে বাইত্তে আইও। পালা গানের আসর আছে। হেই সুময় কমুনে।
কাউসার আর দেরী করে না। তাড়াতাড়ি নদীতে নেমে পড়ে মাছ ধরা শুরু করে। মাছ ধরা শেষ করে দ্রুত বাড়ি চলে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতে রহিম ফকিরের বাড়ীতে যায়। রহিম ফকিরের বাড়ী কবুতরখোলায়। বাড়ির চারধারে বেশ খোলা মেলা। সেই স্থানে একটি খাট দিয়ে স্টেজ তৈরী করা হয়েছে। সেখানে বসে আছে জনা কয়েক বাউল শিল্পী আর বসির মাওলানা। তাদের মধ্যে একজন বেশ কেতাদুরস্ত। চাল চলনে বেশ। গায়ে সাদা পান্ঞ্জাবী সাদা চাদর। পরণে সাদা লুংগি। নাম সোলেমান ভান্ডারী। তার সাথে বসির মাওলানার কথা কাটাকাটি চলছে। বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে। বসির মাওলানা বলছেঃ

-
সুরা কাউসারে বলা হয়েছে - " ইন্না আতায়না কাল কাউসার। ফা সাল্লিলিরাব্বিকা ওয়ানহার। ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার।" অর্থঃ নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দান করিয়াছি হাউসে কাউসার। সুতরাং আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সালাত করুন এবং কুরবাণী করুন। যে আপনার শত্রু, সেই তো লেজকাটা, নির্বংশ।" সুরার শানে নযুলে বলা হয়েছে " পুত্রসন্তান না থাকার কারণে কাফেররা রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর প্রতি দোষরোপ করত আথবা অন্যান্য কারণে তাঁর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করত। এরই প্রেহ্মাপটে সূরা কাউসার অবতীর্ণ হয়। এতে দোষরোপের জওয়াব দেয়া হয়েছে যে, শুধু পুত্রসন্তান না থাকার কারণে যারা রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-কে নির্বংশ বলে, তারা তাঁর প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বে-খবর। রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর বংশগত সন্তান-সন্ততিও কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা কন্যা-সন্তানের তরফ থেকে হয়। অনন্তর নবী আধ্যাত্নিক সন্তান অথাৎ, উম্মত তো এত অধিকসংখ্যক হবে যে, পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের সমষ্টি অপেহ্মাও বেশী হবে। এছাড়া সূরায় রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) যে আল্লাহ্তা'আলার কাছে প্রিয় সম্মানিত তাও তৃতীয় আয়াতে বিবৃত হয়েছে।"

-
আরে ভাই আপনে তো সুরা কাউসারের বাহ্যিক ব্যাখ্যা দিলেন। বাতেনী ব্যাখ্যা তো দিলেন না? সোলেমান ভান্ডারী বললেন।

-
বাতেনী ব্যাখ্যা আবার কি?

-
ভাই শোনেন। আপনি অযথা রেগে যাচ্ছেন। প্রত্যেকটি বিষয়েরই একটি জাহের আরেকটি বাতেন তথা গোপন বিষয় থাকে। জাহেরটি সবার কাছেই বলা যায়। কিন্ত্তু বাতেনী ভেদতত্ত্ব সর্ব সমাজে বলা যায় না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দেখেন কাউসার অর্থ হচ্ছে প্রাচুর্য্য। আর হাউস বলতে পাত্র বিশেষ বা আবাসস্থল বুঝায়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসসাল্লাম এর বাহ্যিক অবস্থা তথা বাশারিয়াত সুরত মানবরুপ। আর হাকিকি হচ্ছে নুরে মুহাম্মদ। এই নুরে মুহাম্মদীই হচ্ছে সৃষ্টিজগতের নুরস্বরুপ এই জগত নুরে মুহাম্মদীই প্রকাশ এবং বিকাশ। নুরে মুহাম্মদীর মধ্যে উনিশটি গুণ বিদ্যমান থাকে যাকে তাসাউফের ভাষায় বলা হয় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এই বিসমিল্লাহ দ্বারাই জগত সৃজন।

-
তাই নাকি? পবিত্র কোরআনে আছেঃ "কুল ইন্না মা আনা বাশারুম মিস্ লুকুম ইউহা ইলাইয়া আননামা ইলাইকুম ইলাহুন ওয়াহিদুন।" [সুরা কাহাফ আয়াতঃ১১০] এইখানেই তো বলা হয়েছে -আনা বাশার অর্থ মাটির তৈরী। তোমাদের মতো। মানে আপনার আমার মতো মাটির মানুষ। আমরা যদি আপনার কথা ধরি তাহলে তো সেও সেই নুরে মুহাম্মদীতে তৈয়ারী। কি কন ভ্যান্ডারী সাব? ঠিক কইছি নি?

-
আপনারে মাওলানা কয় কোন হালায়? মাওলানা অর্থ জানেন মিয়া? মাওলা অর্থ প্রভু আনা অর্থ আমার। মাওলানা অর্থ আমার প্রভু। তাই বইল্যাা কি আপনে আমাগো প্রভু মানে আল্লাহ হইয়্যা গেছেন গা? যে আয়াতের অর্থ করলেন সেইটার প্রকৃত অর্থ হইলোঃ কুল-বলুন, ইন্না-নিশ্চয়ই, মা -(কি,না), আনা বাশারুম - আমি বাশার(মানুষ), মিস্ লুকুম-তোমাদের মতো, ইউহা -ওহি করা হয়, ইলাইয়া-আমার দিকে, আননামা-যে, ইলাইকুম-তোমাদের ইলাহা, ইলাহুন-ইলাহা, ওয়াহিদুন -এক। সম্পুর্ণ অর্থ হলো- বলুন, নিশ্চয়ই আমি কি বাশার(মানুষ) তোমাদের মতো ? আমার দিকে ওহি করা হয় যে তোমাদের ইলাহাই একই ইলাহা

উপরোক্ত আয়াতে  কোথাও বলা হয়নি -আদম সন্তান যে উপাদানে সৃষ্টি , তিনি সে উপাদানে সৃষ্টি উপরোক্ত আয়াতের প্রথম অংশ প্রশ্ন বোধক (?) ব্যাকরণ (ট্যাক কোসশেন) অনুসারে না-বোধক (Negative) হলে সে বাক্য হ্যাঁ-বোধক (Affermative) বাক্য আর হ্যাঁ-বোধক (Affermative) হলে সে বাক্য না-বোধক (Negative) হয় প্রথম অংশ- নিশ্চয়ই আমি কি বাশার (মানুষ) তোমাদের মতো? যেহেতু বাক্যংশটুকু হ্যাঁ-বোধক তাই এর মিনিং হবে না-বোধক অর্থাৎ অংশই বলে দিচ্ছে তিনি আমাদের মতো নন এর পরের অংশে বলা হচ্ছে- আমার দিকে ওহি করা হয় অংশই বলে দিচ্ছে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে ওহি আসত সুতরাং আয়াত থেকেই বোঝা গেল তিনি আমাদের মতো নন এবং তার কাছে ওহি আসত যে মহামানব অতি মানব এর কাছে আল্লাহ পাক এর তরফ হতে ওহি আসত তিনি আমাদের মতো কি করে হন ?

কোরআন পাকের একটি আয়াত উল্লেখ করছি যা থেকে আমরা জানতে পারবো রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহ পাকের জাতি নূর হতে সৃষ্টি। আল্লাহ পাক বলেন- কাদ্ জায়াকুম মিনাল্লাহে নূরি ওয়া কিতাবুম মুবিন
অর্থঃ আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর নূর এবং একটি স্পষ্ট কিতাব পাঠিয়েছি (সুরা মায়েদা,আয়াত-১৫)

আয়াতে 'ওয়া' অর্থাৎ এবং ব্যবহার হয়েছে আরবী বা বাংলা বা ইংরেজী যে ব্যাকারণ বলুন না কেন 'ওয়া(এবং)' ব্যবহার হয় -দুটি বাক্যের পৃথকতা বুঝাতে সুতরাং মিনাল্লাহে নূরি(আল্লাহর নূর) কিতাবুম মুবিন(স্পষ্ট কিতাব ) দুটি পৃথক বিষয় সুতরাং আল্লাহ পাঠিয়েছেন নূর তথা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং স্পষ্ট কিতাব তথা আল কোরআন আল্লাহ পাক নূরে তাজাল্লী তাই তার বাণী(আল কোরআন) নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে পাঠাবেন এটাই তো ঠিক কেননা আল্লাহর বাণী ধারণ করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তাই আল্লাহ তার প্রেরিত নবী-রাসূলদের কাছে পাঠিয়েছেন।(তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে রুহুল রয়ান, তাফসীরে রুহুল মা'আনী, তাফসীরে কানযুল ইমান)

বসির মাওলানা এবং সোলেমান ভান্ডারীর মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চললো নিয়ে। সেই সময় রহিম ফকির এসে দুজনকে থামতে অনুরোধ করেন। তারা থেমে গেলেও দুজনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দুজনই চরম বিরক্ত। এরপর শুরু হলো গানের আসর। শরীফ বাউল গাইলেনঃ

লয়ে গুরুর মন্ত্র ছাড় যন্ত্র
ঠিক হইয়া বও তরীর পর
প্রেমের বড়শি ফেলবি জলে খবরদার।
পাকাও এক রাগের সুতা
ছয় তারে করে একেস্তার।
ভাবের একটি টোম লাগাইয়া
গেঁথে দাও সুতায়।
নিচে সাড়া পেলে ভেসে উঠবে
আর ব্রক্ষ্মকোরা একস্তার।
নদীতে সদায় উঠে জল
সে করছে টলমল
রাগের ছড়ি, ছিপের বাড়ি খেলে বেটা
শুকনায় হবি তল।
কত রসিক জেলে জাল ফেলে
প্রাণ নিয়ে দিচ্ছে সাঁতার।।
আবার দেখে নদীর কূল
তোর লাগবে মহাভুল
টেপায় নিবে আধার কেটে
বেটা হবি নামাক্কুল।
ফকির লালনের হয় এমনি দশা রে
যেমন ভেদায় রুই করছে আহার।।

কাউসার বসির মাওলানা আর সোলেমান ভান্ডারীর কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝে নাই। কিন্ত্তু গানটির অর্থ যেন সে বুঝতে পারছে।  নদীতে সদায় ওঠে জল সে করছে টলমল। সেটা কোন্ নদীর কথা বলছে সেটা সে ধরতে পারছে। কত রসিক জেলে জাল ফেলে প্রাণ নিয়ে দিচ্ছে সাঁতার। পু্রো বিষয়টি তার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। আর হাউসে কাউসার বলতে কি বুঝাতে চেয়েছে সোলেমান ভান্ডারী তাও সে ধরতে পারছে। কিন্ত্তু বসির মাওলানার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি