পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদী তুনে-পাঁচ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঘুম হতে উঠে আমি আর দেরী করলাম না। মাহিনকে না জানিয়ে আমি সরাসরি সুফী সাহেবের খানকায় উপস্থিত হলাম। তিনি খানকাতেই অবস্থান করছিলেন। তিনি আমাকে দেখে স্মিতহাস্যে বললেন

-কেমন আছো মিয়া?

-জ্বী ভালো। আপনি ভালো আছেন তো?

-তোমাকে দেখে খুব পেরেশান মনে হচ্ছে? কি ব্যাপার?

তার কথা শুনে অামি কোন কথা না লুকিয়ে কালকে রাতের সমস্ত ঘটনা আদ্যপান্ত খুলে বললাম। আমার কথা শুনে তিনি শুধু হাসলেন। তার হাসি দেখে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম কি-না জানি না-আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তার পরণে সেই পোষাক যেটা আমি গতরাতে স্বপ্নযোগে দেখে ছিলাম। আমি কোন কিছু না ভেবে সরাসরি তার কাছে জানতে চাইলাম সেই কথাটা যেটা তিনি বলেছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি বললেনঃ


লা-ইলাহা পড় কলেমা শেরকে দুই ছাড়িরে
ইল্লাল্লাহু মুখে বল মাহমুদাতে যাইরে
রঙ্গে রঙ্গ মিশাইলে খোদা কার নহে ভীন।।

লা অর্থ শুণ্যাবস্থা। ইলাহা অর্থ উপাস্য। উপাস্য হিসাবে অধিকাংশই নারী ইলাহকেই নিতে বেশি আগ্রহী হইয়া থাকে। পুরুষ ইলাহকে কেহ নিতে রাজী নহেন। নারী ইলাহ হইল-বস্তুমোহে আকৃষ্ট উপাস্য। আর পুরুষ ইলাহ হইল মোহ শুণ্যতা। র্নিমোহ বা র্নিলোভ। মনে যখন মহাশুন্যভাব বিরাজ করে তখন তা মোহশুন্য থাকে। কলেমার লা-ইলাহা বলতে যে শিরিক তথা অংশিদারীত্ব আছে তা ছাড়িয়া পড়িতে হইবে। এরপর ইল্লাল্লাহু বলতে হবে মাহমুদাতে যাইয়া। অর্থাৎ মোকামে মাহমুদা হইল সাধনা জগতের শ্রেষ্ঠতম স্থান। সেই স্থানে পৌঁছিয়া ইল্লাল্লাহু বলতে হবে। অর্থাৎ ইল্লা=ব্যতীত আল্লাহ=প্রতিষ্ঠিত ইলাহ। আর্দ সামা। সৃষ্টির মনের কেন্দ্রবিন্দুটিই হইলেন আল্লাহ। হু=তিনিত্ব। যে তিনিত্ব তোমার রংগে মিশে আছে সেই রংগে যখন তুমি ফানা হইয়া যাইবা তখন তুমি খোদা হইতে পৃথক নহে। 

শুন মিয়া, কলেমা তৈয়ব্যা " লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ " হইলো পবিত্র বাক্য। এর হাক্কিকাত অনেক গভীরে। পুরো বাক্যটির মধ্যে যে শব্দগুলো রয়েছে সেইগুলো যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে কি দাঁড়ায়? লা+ইলাহা+ইল্লাল্লাহ+হু+মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ
লা অর্থ নাই বা নাস্তি অর্থাৎ মহাশুণ্য অবস্থা
ইলাহ অর্থ উপাস্য। যার উপাসনা করা হয়। উপ+আসন। উপ অর্থ নিকটে আর আসন অর্থ বসা
ইল্লা অর্থ ব্যতীত। ছাড়া
আল্লাহ=আল + ইলাহ। প্রতিষ্ঠিত ইলাহ। আর্দ সামা। সৃষ্টির মনের কেন্দ্রবিন্দুটিই হইলেন আল্লাহ
হু=তিনিত্ব বা নামপুরুষ। সর্বনাম পদ
মোহাম্মাদুর রাসুল্লাহ= মোহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার যে পদ্ধতি তাহা যিনি নিজের জীবনে পদ্ধতিস্থ করিয়াছেন তিনিই রসুল। কোরানের পরিভাষাগত অর্থে আল্লাহর প্রতিনিধি অথবা কোন নবীর মনোনীত প্রতিনিধি নবীর প্রতিনিধিত্ব করা আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার শামিল। হা্ক্কীকাতে নুরী মোহাম্মদী হচ্ছে- Divine character and qualities attained in the person of a Muhammad is Noore Muhammad i. যে কোন একজন মোহাম্মদ দ্বারা অর্জিত স্বর্গীয় চরিত্র এবং গুণাবলীকেই "নুরে মুহাম্মদী" বলে। আল্লাহর আপন চরিত্রই সৃষ্টির মধ্যে মহা গুরুর অভিব্যক্তিরুপে যুগে যুগে যে সকল বিকাশ হইয়া থাকে তাহাই নুরে মুহাম্মদী। নুরে মোহাম্মদী বিকাশ লাভের জন্যই সমগ্র সৃষ্টির প্রয়োজন হইয়াছে। বুঝছো নি মিয়া? তিনি আবার বলা শুরু করলেনঃ

মোহাম্মদ মোস্তফা জানে আপে খোদা নিরন্ঞ্জন
খোদে খোদাতায়ালা জানে মোস্তফা কেমন জন।

আল্লাহ তাহার যাত (ওয়াজুদুল-মুতলাক) হইতে পর্যায়ক্রমে সিফাতে (গুণাবলী) ভুষিত হইয়া নিজেকে প্রকাশ করিয়াছেন। এই প্রকাশকে তানাযুলাত (অবতরণ) বলা হয়। অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যেও তাই তাহার স্বত্তার একত্ত্ব বিদ্যমান। ওয়াজুদুল-মুতলাক্ক স্তরের অর্ন্তমুখী স্বরুপাবস্থাকে 'আমা' (অন্ধকারময়-কুহেলিকা) বলা হয় এবং বর্হিমুখী স্বরুপাবস্থাকে 'আহাদিয়াত' বলা হয়। হাদীছে কুদসীতে আছেঃ কুনতু ক্কানযাম মাগফিয়ান ফা আহবাবতু আন ওয়ারাফা, ফা খালাক্কতুল খালক্ক (অর্থাৎ আমি গুপ্ত ধনভান্ডার ছিলাম। আমার ইচ্ছা হইল-নিজেকে প্রকাশ করিব। তাই সৃষ্টি করিয়াছি) কিভাবে?
ওয়াহদাত বা হাক্কীকাতে মুহাম্মদীয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হইয়া অতঃপর সৃষ্টির ভিতর দিয়া প্রকাশিত হইয়াছেন রাসুলুল্লাহ বলিয়াছেনঃ" আউয়ালু খালাক্কাল্লাহু নুরী। আনা মিন নুরুল্লাহি ওয়া কুল্লু শাইইম মিন নুরী (অর্থাৎ সর্বপ্রথম আল্লা আমার নুর সৃষ্টি করেন। আমি আল্লাহর নুর হইতে এবং বিশ্বজগৎ আমার নুর হইতে )
ওয়াহদাত পর্যায়ে দুইটি অবস্থা বিদ্যমান থাকেঃ হু-ইয়াত (তিনিত্ব) এবং আনি-ইয়াত(আমিত্ব)স্রষ্টা যখন সকল ব্যক্তিস্বত্তার শৃংখল হইতে মুক্ত হইয়া একটি নির্দিষ্ট সত্ত্বামুখী হইয়া গভীর ধ্যানমগ্ন থাকেন তখনই এই স্তর আসে এবং যিক্কর-কালে হু শব্দে ইহাই ব্যক্ত হইয়া থাকে। মাখলুক্কের সামনে স্রষ্টা যখন নিজ সত্ত্বার দিকে ইঙ্গিত করেন, তখন 'আনিইয়াত' স্তর প্রকাশ পায়। আনিইয়াত হইলঃনিজ রুপ প্রকাশের অভিব্যক্তি। এরপর আসে ওয়াহদিয়াত।সৃষ্টির সকল স্তরই আল্লাহর একত্বের বিভিন্ন প্রকাশ। এই ওয়াহদিয়াত স্তরে আল্লার যাতপাকে যখন প্রধানগুণাবলী যথা হায়াত, আক্কল,কুদরত,ইরাদাত,সামায়াত,বাসারাত এবং কালাম বর্তে তখন তাহাকে লাহুত (ঐশ্বীত্ব) মাকাম বলে। এরপর যখন উহাতে কর্মক্ষম গুণাবলী যথাঃ সৃষ্টিকরা, জীবিত করা, মারিয়া ফেলা ইত্যাদি বর্তে তখন উহাকে জাবারুত (ক্ষমতা) মোকাম বলে। আত্মার জগতে যখন এই জাবারুত-শক্তি প্রকাশিত হয় তখন তাহাকে 'আলমে মালাকুত' (ফেরেস্তার জগৎ) এবং বস্তু জগতে যখন ইহা প্রকাশ পায় তখন ইহাকে আলমে-নাসুত (সৃষ্ট জগত) বলে। তাহলে দেখা যাইতেছে যে, রুহ তিন প্রকার। রুহে হায়ওয়ানী(জীবাত্মা) বা নফসের জগত, রুহে ইনসানী(মানবাত্মা), রুহে কুদ্দুস(বিশ্ব আত্মা)। মৃত্যুর পর জীবাত্মা বিলুপ্ত হয় কিন্ত্তু মানবাত্মা বিশ্ব আত্মার নিকট ফিরিয়া গিয়া মিলিতে চেষ্টা করে। মানবাত্মা বিশ্ব আত্মার সিফাত, যদ্বারা তাহার যাত প্রকাশিত। ইহা মানবের নিকট আমানত স্বরুপ গচ্ছিত আছে। এই সিফাতের মাধ্যমেই আল্লাহর যাতে মিশিতে হয়। সিফাতই আল্লাহর আকৃতির রুপ। যেমন আকৃতিবিহীন তড়িতের গুণই তাপ ও আলো। ঐশীগুণ হারাইয়া মানবাত্মা বিশ্বআত্মায় মিলিতে না পারিলে প্রেতাত্মা হয়। ইহাই 'আযাবুল কবর'। মানুষের মধ্যে আল্লাহ নিজ আত্মার অংশ সিফাত রুপে দিয়াছেন যেন মানুষ তাহার প্রেমাসক্ত হইয়া তাহাতে ফানা হয়। মানবাত্মাকে পুষ্ট করার জন্যই ইবাদত। আল্লাহ নিজ রুপের প্রশংসাকারী হইবার জন্য মানুষের মধ্যে প্রবিষ্ট আছেন। ইহাই প্রেম। এইজন্য ইবাদতে প্রেমই দরকার।
(চলবে....)

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদি তুনে-পর্ব চার

( পূর্ব প্রকাশের পর)
রাতে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেল। রুমে ঢুকেই আমার হটাৎ মনে পড়ে গেল - একটা মেইল পাঠানের কথা ছিল করিম সাহেবের কাছে। সেই মেইল পেলে করিম সাহেব সেটা দেখে একটা এসাইনমেন্ট তৈরী করবেন। এসাইনমেন্টটা অত্যন্ত জরুরী। কাল বোর্ড মিটিং আছে। আমার মাথা পুরোপুরি ঘুরতে লাগলো। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই করছে। আমি দেরী না করে করিম সাহেবকে কল করলাম-

-হ্যালো করিম ভাই, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসলে আমি এতো বিজি ছিলাম যে আপনাকে কল করবো সেটাও আমার মনে ছিল না?

-কি এমন বিজি ছিলেন আপনি? যে একটা কল করবেন সেই সময়টাও আপনার ছিলো না?

-ভাই আমার ছোট বোন হটাৎ অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।

- হুম। তো ভাই আমি এখন কি করতে পারি?

-ভাই, আপনি যদি সমস্ত ডকুমেন্টসগুলো জিপ করে মেইলে পাঠিয়ে দেন তাহলে আমি এসাইমেন্ট রেডি করে আপনাকে সকালের মধ্যেই আপনাকে হাতে হাতে দিয়ে দিতে পারবো? আই প্রমিজ...

-হা হা ... আপনি করবেন রেডি....

করিম ভাইয়ের কথা শুনে রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কিন্ত্তু কিছুই করার নেই। দোষটাতো তারই। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। সামান্য একটা মেইল করবো সেটাও মনে করতে পারছি না। সারাটা দিন শুধু শুধু সময় নষ্ট করলাম। আবার অনেকগুলো মিথ্যা কথার আশ্রয় নিতে হলো। এখন শুনতে হচ্ছে তার তাচ্ছিল্য পূর্ণ টিটকারী মারা কথা... কেন করিম ভাই কি জানে না আমি যে কাজটা করি সেটা সিরিয়াসলি করি...আর সেটা করি বলেই বস আমাকে তারচেয়েও অনেক বেশি পছন্দ করে...আমিই তাকে কতোবার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছি..সে কি ভুলে গেছে..

-হ্যালো, কি ব্যাপার সোহেল সাহেব, আপনি কথা বলছেন না কেন?

-ভাই কি বলবো? আপনি যদি একটু কষ্ট করে পাঠিয়ে দিতেন তাহলে...

-শুনেন সোহেল সাহেব, আমি তো আপনাকে চিনি। আপনি খেয়ালী প্রকৃতির মানুষ।আপনার মেইল না পাওয়ায় আমি বসকে কল করেছিলাম। বস বলেছে মিটিংটা ক্যানসেল হয়ে গেছে। পার্টি এখন আসবে না। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তারা আসতে চাচ্ছে না। ডকুমেন্ট রেডি করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। প্রয়োজনে ব্যাংককে বস নিজে যেয়ে পার্টির সাথে ডিড করবে। বি সিওর। সো ডোন্ট ওরি এব্যাউন্ট ইস সাবজেক্ট। বসই আমাকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে।

-তাই? সেটা আপনি আমাকে তো একটু জানাতে পারতেন? তাই না?

-অামিতো ভাবছি আপনাকে বুঝি বস জানিয়েছে। জরুরী হলে তো আমিই প্রয়োজনে আপনাকে কল করে জানিয়ে দিতাম। আপনার সাথে কথা বলতাম।

-ঠিক আছে। তো রাখি ভালো থাকবেন।

উফ! কি ভীষন বাঁচা বেঁচে গেলাম। না হলে এখন আবার কাজ নিয়ে বসতে হতো। যাক বাবা। বড্ডো বাঁচা বেঁচে গেছি। হে আল্লাহ তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে যাওয়ায় অনেকটা হাল্কা লাগছে। ফ্রেস হয়ে নিলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশের ভংগিতে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছি আর সেই মুহুর্তেই মনে পড়লো-
খন্ঞ্জন গমণ মৃগয়ালোচন ওরুপ রাশি লুকিবে কোথা
প্রেমিকও সুজন এহেনও রতন হারে কি কখন পাইলে দেখা।।
অামি কি আমার ভেতর যে রব রয়েছে তাকে কি কখনো দেখতে পাবো? পাবো কি সেই মৃগয়ালোচনের দেখা? কি করে পাবো? আমারতো সেই ঠিকানা জানা নেই। জানা নেই অনেক কিছু। আমি কে? কি আমার পরিচয়? আমি কোথা ছিলাম? কোথা হতে এলাম? আবার কোথা যাবো?.নাহ!...আমার অনেক কিছুই জানা নেই। আমাকে জানতে হবে ... আর সক্রেটিসের মতো সবাইকে বলতে হবে .....know thyself  নিজেকে জানো। 

সিগারেটটা শেষ করেই ঘুমাতে গেলাম। লাইটটা নিভিয়ে দিয়েই একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্ত্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। শুধু মনের মধ্যে ভাসছে তার চেহারাটা। কি দীপ্তিময় ! মনে হয় যেন স্বর্গীয়দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক থেকে। তার হাসিটা যেন আরো চমৎকার। মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে? কতো সুন্দরভাবে কথা বলে...আর তার মতো একটা মানুষকে মাহিন বুঝতেই পারছে না... ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া..আড়াইটা বেজে গেছে...সকালে আবার অফিসে যেতে হবে...নাহ আর কিছু্ই ভাববো না। আমাকে এখন ঘুমাতে হবে।

আমি এপাশ ওপাশ করছি। ঘুম যেন উধাও হয়ে গেছে। আমি উঠে একটা সিগারেট ধরালাম। আর মনে মনে বললাম আমাকে সকালে অফিসে যেতে হবে। অফিসে অনেক কাজ... তাড়াতাড়ি সিগারেট শেষ করেই চাদর মুড়ি দিলাম...ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। চোখ দুটি বুঁজে থাকলাম...আর ঠিক তখনোই দেখতে পেলাম শাহ্ সাহেব..মুচকি হেসে আমাকে বলছেনঃ

-কি মিয়া? ঘুম আসছে না?

-না হুজুর। চেষ্টা করছি কিন্ত্তু আসছে না..

-আসবে। চেষ্টা কর। দেখবা ঘুম চলে আসছে..

-না হুজুর। অনেক চেষ্টা করেও পারছি না..

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

-কলেমার অর্থ জানো মিয়া?

-জ্বি হুজুর। লাইলাহা ইল্লাল্রাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্রাহ। অাল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। তিনি আল্লাহর রাসুল।

আমার কথা শুনে তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন। বললেনঃ

ওহে মুসলমান রহিলি হয়রান
কলেমা পড়িয়া তুই হইলি বেইমান।
যে কলেমা পড়ে মানুষ মুসলমান বলে দাবী করে সেই কলেমারই তাৎপর্যই অধিকাংশ মানুষ জানে না। দ্যাখো মিয়া..

লা+ইলাহা+ইল্লা+আল্লাহ+হু+মুহাম্মদ+রাসুল+আল্লাহ -> কলেমাটি বিশ্লেষণ করলে ঐ শব্দগুলো পাওয়া যায়। আর প্রত্যেকটি শব্দের অর্থপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। ঐ শব্দের তাৎপর্য না জেনে কেবল মৌখিক স্বীকৃতি দিলেই কি মুসলমান বলে দাবী করা যায়?
আলমে আরওয়াহর জগতে (রুহের জগতে) যখন আমরা ছিলাম তখন তো আমাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া হয়েছে এই বলে-আলাস্তবি রাব্বিকুম (অামি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?)? আমরা বলেছিলাম-ক্কালু বালা (হ্যাঁ আপনিই আমাদের প্রভু)। আমরা তো না দেখে  সাক্ষ্য দেই নাই? তাই না? না কি দিয়েছি? অবশ্যই তার স্বাকার রুপের স্বরুপ উপস্থিতিতেই তাকে দেখেই স্বাক্ষ্য দিয়েছিলাম। সেই রুপ, সেই স্বাকারটি কোথায়? সেটা কি ভেবে দেখেছো?
কলেমা অর্থ বাক্য। তায়্যিবা অর্থ পবিত্র। আর শাহাদাত অর্থ - স্বাক্ষ্য দেয়া। না দেখে স্বাক্ষ্য হয় না। যদি না দেখে স্বা্ক্ষ্য দাও তো সেটা মিথ্যা স্বাক্ষ্যরুপে প্রতিপন্ন হবে। তাই না?
আবার দেখ যখন তুমি মারা যাবে তখন তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। মান রাব্বুকা? মান দিনুকা? মানহাজা রাজুলু? এই মানহাজা রাজুলু - এই ব্যক্তি কে? তখন তুমি কি বলবে? যদি তাকে না দেখে থাকো? সে যে জান্নাতের আশা করে ইবাদাত করেছিল সে যদি ঐ ব্যক্তিকে না দেখে থাকে তো চিনবে কিভাবে? তার কি জান্নাতে যাওয়া হবে? না সে গ্রেফতার হবে? তার ঈমান কি থাকবে নাকি সে বেঈমান হবে? একবার ভেবে দেখেছো? কলেমা শুধু মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না। তা অবশ্যই তাহকীক করে দেখাতে হবে। তবেই না সে মুসলমান। কি বুঝলা মিয়া.....

তার কথা শুনে আবার ঘুম ভেংগে গেল। ঘুমিয়েছিলাম না আমার জাগৃতি ছিল কিছুই বুঝতে পারছি না। দূর থেকে ফযরের আযানের শব্দ কানে আসছে...আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম..

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সোয়া পাঁচটা বাজে। আমি আর ঘুমালাম না। বারান্দায় দাঁড়ালাম। চারিদিকে কেমন যেন একটা আবছা আলো-আঁধারের খেলা চলছে। পাখিরা সব একটা একটা করে উড়ে যাচ্ছে। আমার বারান্দা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় তাকিয়ে থাকলাম। সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টেনে টেনে বারান্দায় বসে রইলাম সকাল হবার আশায়। দুর আকাশে আস্তে আস্তে আঁধার কেটে ভোরের আবহাওয়া আসতে শুরু করেছে। আর আমার মনের পর্দা সরে যাচ্ছে -এই আকাশের মতোই দুর কোন অতিইন্দ্রীয়ালোকের দীপ্তিলোকের ছোঁয়ায়..........

শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৫

সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদি তুনে-পর্ব তিন

(পূর্ব প্রকাশের পর)
সকাল থেকেই ভেবেছিলাম আজকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবো। কিন্ত্তু যেদিন দেখা যায় কাজ বেশি থাকে সেদিনই কোন না কোন ঝামেলা এসে উপস্থিত হয়। আমি দেখেছি বন্ধের দিন সবচেয়ে বেশি কাজ থাকে। সবাই ভাবে কাল শুক্রবার বন্ধের দিন আছে। সারাদিন রেষ্ট নেয়া যাবে। দেখা গেল সেইদিনই ঝামেলাটা বেশি হচ্ছে। মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছে। কি করি? ভাবছি....

-কি রে এমন ভাবুক ভাবে বসে আছিস কেন? মাহিন বললো।

-আরে একটা জরুরী কাজ করবো ভেবেছিলাম। কিন্ত্তু কাজটাই যে কি সেটাই মনে করতে পারছি না।

-এটা কি বললি? কি কাজ করবি সেটাই জানিস না আর বলছিস একটা জরুরী কাজ... তোর কি হয়েছে আমাকে বলতো? শ্বেতার সাথে কোন ঝামেলা করেছিস?

-না। সে রকম কিছু না।

-তাহলে

-দোস্ত আমার কিছুই ভাল লাগে না। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। ভাবছি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কোথাও চলে যাই?

-কি বলছিস আবোল তাবোল? চল তোকে নিয়ে আজকে শাহ সাহেবের কাছে যাব। সেখানে একটা অনুষ্ঠান আছে। অনেক লোকজন আসবে। কাওয়ালী হবে। সেখানে গেলে তোর ভাল লাগবে।

মাহিনের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম। আমরা একটা রিক্সা নিয়ে শাহ সাহেবের খানকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রিক্সায় বসে জিগ্যেস করলো-তোর কি হয়েছে বলতো? তোকে কেমন যেন আনমনা মনে হচ্ছে? সবকিছুতেই কেমন উদাস উদাস মনে হচ্ছে?

-নারে। তেমন কিছু না। ভাবছি।

-কি ভাবছিস?

-ভাবছি শাহ সাহেবের কাছ থেকে আসার পর তার কথাগুলো কেমন যেন আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। জগৎ সংসারের সবকিছু যেন ফাঁকা মনে হয়। মনে হয় আমি যেন একটা গোলক ধাঁধাঁয় আটকে আছি।

-দোস্ত, তুই আমার সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় মানুষ। বন্ধু হিসেবেও। তোকে একটা কথা বলি-ঐসব ফিলোসোফি ছেড়ে দিয়ে বাস্তব জীবনে ফিরে আয়। শ্বেতাকে বিয়ে করে ঘর সংসার কর। চাকরী বাকরী কর। বউ পোলাপান নিয়ে সংসারী হ। দেখবি জীবন কতো সুখের...বেঁচে থাকার আনন্দটাই আলাদা..

মাহিনের কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। একজন শাহ সাহেবের ভক্ত হয়ে এইসব কি কথা বলছে ও। যদি সংসারীই হতে হয় তাহলে শাহ সাহেবের ভক্ত হয়ে ভন্ডামী করার মানে কি? দেখাচ্ছি আমি ভক্ত। ভক্তিতে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ। আর তার থেকে আড়াল হলেই আবার সব সাবেক। আগের মতোই। তাছাড়া শাহ সাহেব কি সংসার ধর্ম পালন করেননি? তিনিওতো আমাদের মতো মানুষ। তিনিও বিয়ে থা করেছেন। ছেলে মেয়ে আছে। তাছাড়া নবীজি বলেছেনঃ লা রাহাবানিয়াত ইল্লাল ইসলাম। ইসলামে কোন বৈরাগ্যের স্থান নেই। মাহিন কি শাহ্ সাহেবকে বুঝতে পারেননি? নাকি তার দর্শন থেকে সে শুধু মৌখিকভাবেই শিক্ষা নিচ্ছে। আন্তরিক ভাবে পালন করছে না? যে শাহ্ সাহেবের কথা শুনে আমার মন মস্তিস্কে আলোড়ন তুলেছে সেই শাহ্ সাহেবের ভক্ত হয়ে মাহিন কিরুপ নির্লিপ্ত ভংগীতে বসে আছে। আমি মাহিনকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম

-তাহলে তুই বিয়ে করছিস না কেন? কেন সংসারী হচ্ছিস না?

-আমার কথা আলাদা। আমি তোর মতো না। আমি ভাবি আমার মতো। তুই ভাবিস তোর মতো।

-সেটাই কি স্বাভাবিক না?

-হ্যাঁ সেটাতো স্বাভাবিক। তবে আমি তোর মতো করে সিরিয়াসলি কোন বিষয় নেই না।

-তার মানে তুই শুধু তোর ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই শাহ সাহেবের কাছে যাচ্ছিস? তাই না?

মাহিন আমার এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো। রিক্সার টুং টাং শব্দই কেবল শোনা যেতে লাগলো আর মাঝে মাঝে প্রাইভেট কারের প্যাঁ পোঁ ভ্যাঁ ভোঁ হুস হুস করে চলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন শব্দ কানে আসছিল না। মাহিন রিক্সাওয়ালাকে বললো

-ভাই ডান দিকে যান। নীরবতা ভেংগে আমি মাহিনকে বললাম

-শোন মাহিন আমি ফিলোসোফিতে পড়ি। আমার সাবজেক্টটাই আমাকে এমন চরিত্র সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে। এই সব অতিইন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে আলাপ চারিতা প্রতিদিন করতে হয়। যা দেখা যায় না কিন্ত্তু অনুভব করা যায়। সেই বিষয় নিয়ে পড়া-শোনা করলে এমন্নিতেই একটু একটু পাগলা পাগলা ভাব চলে আসে।

মাহিন আমার কথায় কোন উত্তর দিল না। সে আগের মতোই নির্লিপ্ত। আমি আবার বললাম

-তু্‌ই কি আমার কোন কথায় রাগ করেছিস?

মাহিন আমার কোন কথার উত্তর না দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে থামার নির্দেশ দিল। দেখতে দেখতে আমরা শাহ্ সাহেবের খানকার কাছে চলে এলাম। রিক্সাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। গতবারের তুলনায় লোকজনের আনাগোনা অনেক বেশি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অগনিত মানুষের ভীড়। আমরা সেই ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম শাহ্ সাহেব তার উঁচু গদিতে বসে আছেন। তার সামনে গায়কের দল তাকে ঘিরে রেখে গান গাইছে। আর সেই গানের সুর শুনে সবাই কেমন যেন লাফালাফি করছে। আমি ভীড় ঠেলে মাহিনের সাথে সাথে গেলাম এবং একটি জায়গায় চুপ করে বসে রইলাম। শুনতে চেষ্টা করলাম কি গজল গাইছে....

আয় মেরে মাওলা তু ছবছে আলা
তুহি হ্যায় আফজাল তুহি হ্যায় আহসান।
অনাদি অনন্ত ছেফাত তোমহারি
তুমহি ছে পয়দা হ্যায় ছারে জাহান।।

আমি গানের অর্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে মনে ভাবলাম অনুষ্ঠান শেষ হলে এই গান গাওয়ার মাহাত্ম্য আমাকে জানতে হবে। আগে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করি। তারপর সুযোগ বুঝে শাহ্ সাহেবের সাথে কথা বলা যাবে। দেখলাম গায়কীর দল আরেকটি নতুন গজল গাইছে--

 উদিত শশী কিরণরাশি দুরিবে ভাতি মেঘের কালা
তুমি যেখানে নাহি সেখানে সর্বস্ব তুমি কাহারও ছায়া।।
উঠাও আবরণ দাও দরশন তোমার আমার রবে না চিনন
তুমি আসিলে রবো না আমি তোমারও আমার হবেগো দেখা।।
খন্ঞ্জন গমণ মৃগয়ালোচন ওরুপ রাশি লুকিবে কোথা
প্রেমিকও সুজন এহেনও রতন হারে কি কখন পাইলে দেখা।।

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় দশটা বেজে গেল। সবাই শাহ্ সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মাহিনও আমাকে নিয়ে ভেতরে যেতে চাইলো। কিন্ত্তু আমার ভাব-ভংগী দেখে বললো

-কি রে যাবি না?

-একটু পরে যাই। শাহ সাহেবের সাথে আমার একটু কথার প্রয়োজন আছে।

-থাক তুই। আমি গেলাম।

-আরে দাঁড়া না। তুই আমাকে নিয়ে এসেছিস। অামি না করিনি। এখন আমি বলছি একটু পরে যাব। আর তুই যেতে চাইছিস?

-ঠিক আছে। তোর কথাই রাখলাম। 

মাহিনের হাসিতেই বলে দিচ্ছে আমার দেরীতে যাওয়ায় সে যেন আনন্দিত।

লোকজন চলে যেতেই আমি মাহিনকে নিয়ে সুফী সাহেবের রুমে ঢুকলাম। তিনি আমাকে দেখে বেশ আনন্দিত ভংগিতেই বললেন

-তুমি আসছো বাবা? আমি খুব খুশি হয়েছি। তা খাওয়া দাওয়া করেছো তো?

-জ্বি।

-তো বল কি খবর তোমার? 

-হুজুর আমি জানতে চাইছিলাম এই যে আপনারা গান বাজনা করেন। সেই গান শুনে লোকজন লাফালাফি করে। এটা কেন?

আমার এ কথা শুনে শাহ সাহেব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তিনি বললেন

-একবিংশ শতাব্দিতে কেউ এ প্রশ্ন করে না গান হালাল না হারাম? জায়েজ না না-জায়েজ? বাজারে অসংখ্য লেখকের বই আছে এ বিষয়ে লেখা নিয়ে। সে কিতাব পড়লেইতো হয়। সেটা পড়লেইতো জানা যায়। আর ঐযে বললে না লাফালাফি করে কেন? আচ্ছা ধর তোমাকে নিয়ে যদি একটি নদীতে কিংবা একটি পুকুরে ফেলে দেয়া হয়, তুমি কি করবে? হাত-পা না নাড়িয়ে থাকতে পারবে? তোমাকে হাত-পা নাড়াতে হবে। শুন

ইসকের সাগরে যখন কোন আশেক তার মাশুককে খোঁজার জন্য ঝাঁপ দেয় সে কি হাত-পা না নাড়িয়ে থাকতে পারে? তাকে তো সাঁতার কাঁটার জন্য হাত পা নাড়াতেই হবে। তাই না? গানের সাথে বাদ্য বাজনা থাকায় সেই বাদ্য বাজনার তাল লয় যখন কোন আশেককে আকৃষ্ট করে ঠিক সেই তালের মাঝেই সে যিকিরে ফানা হয়ে যায়। তার হুঁস জ্ঞান বলতে কিছুই থাকে না। সে কি করে কি বলে তার কোন খেয়াল থাকে না। জগতে বিখ্যাত বিখ্যাত অলী-আল্লাহগণ এ ব্যাপারে সবাই একমত এবং চিশতীয়া খান্দানভুক্তদের জন্য এটা ফরযের পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ সামার মজলিশ থাকতেই হবে। আর সামার মজলিশে এরুপতো তুচ্ছ ঘটনা এরচেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মহত্ত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।

-আচ্ছা হুজুর আপনার অনুষ্ঠানে যে গজলগুলো গাওয়া হলো তার দু'একটা লাইন যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন?

-আমি ভাবছিলাম গতবার যখন এসেছিলে আজকে হয়তো তারচেয়েও আরো গভীরে আলোচনা করবো? কিন্ত্তু তোমার আজকের আলোচনাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে হ্যাঁ যে গজলগুলো গাওয়া হলো তার তাৎপর্য অনেক গভীরে। যেমন প্রথম গজলটার কথায় আসি।

আয় মেরে মাওলা তু ছবছে আলা
তুহি হ্যায় আফজাল তুহি হ্যায় আহসান।
অনাদি অনন্ত ছেফাত তোমহারি
তুমহিছে পয়দা হ্যায় ছারে জাহান।

হে আমার মাওলা। তুমি সবচেয়ে উপরে। অর্থাৎ তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ। মাওলা অর্থ প্রভু। প্র-প্রকৃষ্টরুপ ভু-ভুত অর্থাৎ দৃষ্টিগোচর হওয়া। প্রভু= প্রকৃষ্টরুপে দৃষ্টিগোচর হওয়া। মাওলাকে দেখে তার প্রশংসা কীর্তণ করা। না দেখলে কি তার প্রশংসা করা যায়? আফজাল-ফজল অর্থাৎ মংগলময়। কল্যাণময়ী। আহসান-হাসান অর্থাৎ সুন্দর। আলা অর্থ প্রতিষ্ঠিত (The Higher Stage)। অনাদি ন আদি অর্থাৎ যার কোন শুরু নেই। অনন্ত ন অন্ত অর্থাৎ যার কোন শেষ নেই। ছেফাত অর্থ গুণাবলী। তাহলে গজলটির অর্থ দাঁড়ায় 

হে আমার প্রভু তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ
তুমিই কল্যাণময়ী তুমিই সুন্দর
যার কোন আরম্ভ নেই শেষ নেই সর্বক্ষেত্রেই তোমারই প্রশংসা 
তুমিই পয়দা (সৃষ্টি করা) করেছো ছারে(সাড়া) জাহান (দুনিয়া)।

এই গজলে রবের দর্শন করার পর তার প্রশংসা কীর্তন করা হয়েছে। সুরা ফাতেহার সুফী দর্শনের আলোকে বর্ণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় গজলটির ব্যাখ্যাঃ

 উদিত শশী কিরণরাশি দুরিবে ভাতি মেঘের কালা
উদিত শশী অর্থ হচ্ছে চন্দ্রের উদয় হওয়া। চন্দ্র উদয় হলে সেখানে কোন রুপ কালো আবর্জনা তথা বস্তুমোহ লোভ, লালসা,হিংসা মোহ অর্থাৎ ষড় রিপুর কোনরুপ প্রবন্ঞ্চনা থাকবে না। সবকিছু দুর হয়ে যাবে। অন্ধকার কেটে যাবে।
মানব দেহের শত্রু হচ্ছে এই বস্তুমোহ যা সাধককে প্রলুব্ধ করে রাখে। তাই যেখানে পূর্ণ চন্দ্র উদয় হয় সেখানেই একটি চন্দ্র বিন্দু দেয়া হয়। অর্থাৎ বিন্দুকে তিনি জানতে পেরেছেন বা ছেদ করতে পেরেছেন।

তুমি যেখানে নাহি সেখানে সর্বস্ব তুমি কাহারও ছায়া।।
তুমি যেখানে বলতে রবকে বুঝানো হচ্ছে। নাহি সেখানে অর্থাৎ সেখানে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। সর্বস্ব তুমি কাহারও ছায়া। সর্বস্ব সর্বস্বত্ত্বা তুমি হে রব তুমি কাহারও ছায়া। অর্থাৎ যেখানে আলো থাকে সেই আলো যখন কারো উপর পতিত হয় তখন মুল বস্তুটির ছায়া প্রতিবিম্বিত হয়। অর্থাৎ মুল বস্তুটি থাকে আড়ালে তাহার ছায়া পতিত হয়। নাফাক্কতু ফি মির রুহি বলে যে রুহ ফুকেঁ দেয়া হলো মুলতঃ তাহা মুল বস্তুটির ছায়া।

উঠাও আবরণ দাও দরশন তোমার আমার রবে না চিনন
উঠাও আবরণ দাও দরশন অর্থাৎ যে পর্দা তোমাকে ঘিরে রেখেছে সেই মুল বিষয়টি তাঁকেই উদ্দেশ্য করে বলা। যে পর্দা তোমাতে আমাতে দুরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে সেটা তুলে দাও। সেটা তুলে দিলে কি হবে? তোমার আমার রবে না চিনন। অর্থাৎ যথন তুমি পর্দা হটিয়ে দেবে তখন তোমার আমার কোন পার্থক্য থাকবে না। আমি-তুমি একাকার হয়ে যাব।
এ প্রসংগে একটি কথা বলতে চাই। সেটা হলো মহর্ষি মনমোহন বলেছিলেন - অামি তুমি থেকে আ এবং তু শব্দটি বাদ দিয়ে মিমি করে মায়ের পদতলে পড়ে থাক। মা এসে ঠিকই কোলে তুলে নিবেন। তার মানে কি? তার মানে হলো - ব্যবধান দুর করে দেয়া।
বাবা তুমি বিরক্ত হচ্ছো নাতো? আমার দিকে তাকিয়ে শাহ সাহেব বললেন

- না না বিরক্ত হচ্ছি না। বরং শুনতে ভালো লাগছে। আপনি বলুনঃ

শাহ সাহেব আবার বলা শুরু করলেনঃ 

তুমি আসিলে রবো না আমি তোমারও আমার হবেগো দেখা।।
যখন তুমি আসবে তখন তোমাকে আমি দেখতে পাবো। তোমার আমার দেখা হবে। অর্থাৎ মিলন হবে। তার অর্থ আমি তোমাতে ফানা হয়ে যাব। ওয়াছেল হবে। কে তুমি কে আমি কোন পার্থক্য থাকবে না। সেই আকুতি নিয়েই আসলে মিলানাকাংখা নিয়ে বর্ণিত হয়েছে।

খন্ঞ্জন গমণ মৃগয়ালোচন ওরুপ রাশি লুকিবে কোথা
খন্ঞ্জন গমণ মৃগয়ালোচন অর্থ হচ্ছে খন্ঞ্জন মানে তলোয়ার বা ছোড়া গমন অর্থ যাওয়া মৃগ+লোচন মৃগ অর্থ হরিণ  আর লোচন অর্থ চোখ। যার অর্থ দাঁড়ায় - ছোড়া বা তলোয়ার যদিও যায় ঐ হরিণীচোখের রুপ তুমি কোথা লুকাবে। মানে তোমাকে তো আমি দেখেছি। তোমার ঐ হরিণী চোখের রুপ তোমার অবয়ব তুমি কোথায় লুকিয়ে রাখবে? তার মানে কি?  যে রবের ছায়া তথা রুহকে ফুঁকে দিয়েছিলো সেই ছায়ার মুল তথা প্রভুর রুপ আমি দর্শন করেছি।

প্রেমিকও সুজন এহেনও রতন হারে কি কখন পাইলে দেখা।।
প্রেমিকও সুজন। সু মানে সুন্দর জন। এহেনও রতন অর্থাৎ সেই প্রভুর রুপ হারে কি কখন অর্থ কখনো কি হারাতে পারে? পাইলে দেখা। দেখা যদি হয়েই যায় সেই প্রভুর রুপ কি কখনো হারাতে পারে? যে প্রেমিক সুজন হয়?

তো বাবা এই হলো গজলের সরল অর্থ। বুঝতে পারছো কিছু?

-কিছু কিছু পারছি। পুরোপুরি না। তবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।

-তোমার জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আজকাল তো অধিকাংশই আসে কেবল তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে। কেউ কোন কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে আসে না। তাদের আসা-যাওয়াই সার। যাক আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ীতে চলে যাও।

আমি শাহ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাহিরে বের হয়ে এলাম। আর আসতেই মাহিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো

-দোস্ত তোর কল্যাণেই আজকে আমি এই গজলের অর্থ বুঝতে পারলাম। দোস্ত তুই না...

-আরে বেটা ছাড়। দম আটকে মরে যাব তো? 

আমাদের পাগলামি দেখে আসে পাশের মানুষের কৌতুহল দৃষ্টি একসাথে নিবদ্ধ হলো। সবাই আমাদের দেখছে। অনেকে হাসছে। আর অনেকেই দেখলাম তাকিয়ে আছে। আর আমি মনে মনে ভাবলাম -আচ্ছা শাহ সাহেবকে তো জিগ্যাসা করা হয়নি গজলগুলো কে লিখেছে.....







সারমাদ দারদী আজাব সিকাস্তা কারদি তুনে-পর্ব দুই

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মাহিন চলে যেতেই আমি আমার পূর্বের চিন্তায় বিভোর হতে চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু কি আশ্চর্য্য। সেটা আর আসছে না। আমাকে পেয়ে বসলো-আমি সুফী সাহেবের সাথে কি নিয়ে কথা বলবো? কোন টপিক নিয়ে কথা বলবো? মনের ভেতর থেকে সাজানোর চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু যতই চেষ্টা করতে লাগলাম ততই আমাকে বিরক্ত হতে হলো। আমি কিছুতেই আর আগের ধারণায় ফিরে যেতে পারছি না। তাহলে কি পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে সময় সময় দার্শনিক বানিয়ে দেয়? মানুষের অবচেতন মন কি নিজের অজান্তেই দার্শনিক হয়ে পড়ে?

-দোস্ত আয়। তোরে ডাকছে

মাহিনের শব্দে আমার ঘোর কেটে গেল। অামি কল পাড়ে গিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে নিলাম। তারপর মাহিনের সাথে সুফী সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম

সুফী সাহেব তার খাস কামরায় একটি চেয়ারে আরাম করে বসে আছেন। সেই ঘরটা বেশ পরিপাট করে সাজানো। আগর বাতি আর আতরের গন্ধে ঘরটা মৌ মৌ করছে। সেখানে একটি আলমিরায় দেখলাম বেশ কিছু দামী দামী লেখকের বই সাজানো আছে। কোরআন শরীফের তফসীরের অনেকগুলো খন্ড টেবিলের একপাশটায় পড়ে আছে। আরেক কোণে দেখলাম একটি চকির উপর একটি জায়নামায পাতা। পাশেই রয়েছে তসবীহ। আর কোরআন শরীফ। পু্রো ঘরটায় কার্পেট দিয়ে মোড়া। তিনি আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে সেটায় বসতে বললেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। মাহিন বললো-

-বাবা, আমার বন্ধু। সোহেল। আমরা একসাথেই ঢাকা ইউনিভারসিটিতে পড়া শোনা করি

তিনি আমার দিকে তাকালেন। তার তাকানোর ভিতর কি ছিল কে জানে? তার সেই তাকানোর দৃষ্টিতে আমার ভেতরে কেমন যেন একটা  হিম শীতল ভাব চলে এল। অামি যেন সব ভুলে গেলাম। তাকে যেন কি জিগ্যাসা করতে এসেছিলাম? আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম

-তা বাবা, আমার কাছে কি জিগ্যাসা করার আছে তোমার? আমিতো তেমন কিছুই জানি না। সব তিনিই জানান। আমি শুধু বলি। সবই তিনি। তা বাবা বলো

-হুজুর আমার তেমন জানার কিছুই নেই। আমি কেবল জানতে আসছি - এই যে আপনি বললেন তিনিই সব জানেন। আমি এই তিনির সর্ম্পকেই জানতে চেয়েছিলাম। ব্যাস। এটুকুই

আমি মনে মনে টের পেলাম। আমার ভেতরটা কেমন যেন গরম হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা হটাৎ দ্রুতগতিতে লাফাতে শুরু করেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন

-শোন। আল্লাহ পাক হাদিসে কুদসিতে বলেছেন-"কুনতু কানজান মুখফিয়ান ফা আহবাবতু আনউরাফা ফাখালাকতু খালকা।" আমি একটি গুপ্ত ধনাগারে গুপ্ত ছিলাম। নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছায় প্রকাশিত হইলাম। তাছাড়া আবিদারা নামক এক সাহাবা একদিন রাসুলে পাক (সাঃ) কে প্রশ্ন করলেন-ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ পাক কিরুপ ছিলেন? তদুত্তোরে রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন-" সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ পাক আল-আমা নামক একটি কুপে কুছঝটিকা (কুয়াচ্ছন্ন) রুপে ছিলেন। সেই সময়তো কিছুই ছিল না। শুধু আল্লাহ পাক ছিলেন। তিনি নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছায় প্রকাশিত হবেন বলেইতো আমরা আল্লাহ সর্ম্পকে জানতে পারছি। তা না হলে আমাদের জানার কোন উপায় ছিল না। তিনিই সৃষ্টি তিনিই স্রষ্টা। সৃষ্টি সর্ম্পকে জানা যায় কিন্ত্তু স্রষ্টা সর্ম্পকে পুরোপুরি জানা যায় না। আবার এটাও মিথ্যা। কেননা স্রষ্টা সৃষ্টিতেই আছেন বলেই তো আমরা কথা বলতে পারছি

-সেটা কি রকম?

-বলছি শোন। আল ইনসানু সিররি ওয়া আনা সিররুহি। ইনসান আমার রহস্য এবং আমি রুহের রহস্য। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে-মান আরাফা নাফসাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু। যে তার নাফসকে চিনেছে সে তার রবকে চিনেছে। তোমাকে যদি পুরোপুরি জানতে হয় সে ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় হচ্ছে-ইনসান, রুহ, নফস এবং রব সর্ম্পকে ভালোভাবে জানা। যদি সে সর্ম্পকে তোমার পরিস্কার ধারণা জন্মায় তাহলে তুমি তোমাকে জানতে পারবে। সংক্ষেপে যদি বলি তাহলো -ইনসান উন্স শব্দ হতে এসেছে। উন্স অর্থ প্রেম। অর্থাৎ প্রেম থেকে যার সৃষ্টি সে হচ্ছে ইনসান। অন্য অর্থে গুরুভক্ত সাধককে ইনসান বলা হয়। যে মানুষ তার ত্রুটি সমন্ধে জাগ্রত; এবং একটি বাস্তব এবং সত্য মনোভাবের উপর দাঁড়ায়।  
ইনসান অলিক মনোভাবকে কোন গুরুত্বই দেয় না। ইনসানের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহা অন্যের নাই। ইনসান গুরুর গুরুত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন এবং কম-বেশি গুরুর সাহচর্যে থাকে রহমান প্রভুগুরুরুপে জিনকে কোরান শিক্ষা দিয়া ইনসানে রুপান্তরিত করেন। তারপর তাহাকে সর্ববিষয়ের ব্যাখ্যা দান করেন (৫৫ঃ১-) গুরু এবং ইনসানের সর্ম্পক আন্তরিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। গুরুর বাহিরে সে কোন আপন অস্তিত্ব মানে না। যদিও অতীত কর্মের কারণে গুরুকে পূর্ণভাবে অনুসরণ করিতে সক্ষম হয় না। এই সংজ্ঞার বর্হিভুত মন-সমুহ সবাই জিন। গুরুর বাইরে কোন ইনসান নাই। ইনসানের বহুবচন নাস। 
তাহলে প্রশ্ন হলো জিন কি?
জিন জাতি হিসাবে ইহারা মানুষ হইতে মর্যাদায় নিন্ম মানের। ইহারা সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি বিশিষ্ট আগুণের তৈয়ারী জীব। আদামের সন্তান হিসাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফেরেস্তা এবং জিনভাব উভয়ই বিদ্যমান। সুতরাং যাহাদের মধ্যে জিনভাব বেশিপ্রবল তাহাদিগকেও জিন বলা যাইতে পারে
এরপর আসো রুহ সর্ম্পকে। 
রুহ হইতেছে "সাধক-নফস" এর উপর মোহাম্মদী নুরের একটি বিকাশের অবতরণকে রুহ বলে। রুহ নাজেল হইলে উহা নফসের উপর কর্তা হইয়া যায়। রুহ সৃষ্টির অন্তর্গত নহে।  উহা সৃজনী শক্তির অধিকারী। রুহ রহস্যময়। উহার পরিচয় ভাষায় ব্যক্ত করা দুরুহ। রুহ প্রাপ্তি দ্বারা আত্মপরিচয়ের পূর্ণতা আসে। প্রভু গুরুর ভাবমুর্তি (Image of Lord Guru) সাধকের আপন চিত্তের উপর অধিষ্ঠানকে "রুহ নাযেল" বলে। 
আর নফস হইলো-চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক অভিব্যক্তি। শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়সমুহ এবং বুদ্ধি, স্বরণশক্তি ইত্যাদির গুণাগুণ নফসেরই এক একটি অভিব্যক্তি। শুদ্ধির পর্যায় অনুসারে নফস চার প্রকার। যদিও প্রধানত তিন প্রকারঃআম্মারা, লাউয়ামা এবং মোৎমায়েন্না। অর্থাৎ অশুদ্ধ, শুদ্ধি কর্মে ব্যস্ত এবং পরিশুদ্ধ। আপন বুদ্ধিতে চলিলে আম্মারা। মোমিন ব্যক্তির বা গুরুর নির্দেশিত পথে কর্মযোগে থাকিয়া চেষ্টা করিলে লাউয়ামা। ইহাদিগকে কোরানে আমানু বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন। শুদ্ধ হইয়া গেলে তাহারা মোৎমায়েন্না বা মোমিন। চতুর্থ এবং শেষ পর্যায় "নফসে ওহায়েদ" (In other words whatever you do is your Nafs. Allah does not do anything. He is above doing anything. Muhammad [A] in Nafs. or formed Muhammad, showed in his life how to do things without Nafs.) 
এবার আসো রব সর্ম্পকে। 
সৃষ্টির মুল উৎস নুরে মুহাম্মদী। আল্লাহর জাতিনুর, এই নুরে মোহাম্মদী, প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই রবরুপে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া উহার সৃষ্টিকারী, পালনকারী এবং ধ্বংসকারী রুপে আবর্তনশীল ক্রিয়া করিয়া চলিয়াছে। এইরুপে আপন সৃজিত বিবর্তনমুলক বিধান অনুযায়ী অর্থাৎ কেতাবের ধারা অনুযায়ী প্রতিটি সৃষ্টিতে অনুপ্রবিষ্ট থাকিয়া যিনি উহার সৃজন, পালন এবং বিলয় সাধন করিতেছেন তিনিই সেই সৃষ্টির রব। রবরুপে তিনি বিশ্ব ব্যাপ্ত হইয়া প্রেমময় রাব্বুল আলামিন থাকিতেছেন। তসবিহকারী জিন এবং তসবিহকারী মানুষের জন্য তাহাদের প্রত্যেকের আপন প্রেমময় রবের পরিচয়ের পথ তিনি খোলা রাখিয়াছেন
আল্লাহ মানুষের সংগে রবরুপে যে যোগসুত্র দান করেন তাহা দুই প্রকার অর্থাৎ মানুষের রবের দুইটি রুপ।একটি জাহের অপরটি বাতেন।তাহার জাহের রুপটি হইল-বিশ্বময় কামেল মুর্শেদরুপে তিনি হেদায়েতদাতা। বাতেনরুপটি হইল-মানুষের মধ্যে তাহার অদৃশ্য গোপন অবস্থান। তাহার জাহের অস্তিত্বের নিকট আত্মসমর্পণ না করিলে মানুষ তাহার আপন অস্তিত্বের মধ্যে অদৃশ্যভাবে অবস্থিত আপন রবের পরিচয় লাভ করিতে সক্ষম হয় না। আল্লাহর প্রশংসা জাহের রব হইতেই মানুষের নিকট প্রকাশিত হইয়া থাকে

সুফী সাহেবের কথা শুনে আমি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। তবে এটা বুঝলাম যে আমরা প্রচলিত ধারায় দেহতত্ত্ববাদ বলতে যা বুঝে থাকি সেক্ষেত্রে সুফীধারায় তা অন্যরুপ। নারী-পুরুষ মৈথুনাত্মক কোন তথ্য পেলাম না। তিনি বাউলদের মতো করে কোন কিছুই বলেননি। তিনি যে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ দিয়েছেন তা নিতান্তই স্বজ্ঞাপ্রাপ্ত উচ্চ স্তরের জ্ঞান। যা আমার নেই। আমি সাধারণ মানুষ। স্বল্প জ্ঞানের মানুষের কাছে আল্লাহ কি বা কেমন? নবী-রাসুল কি? তাদের কাছে স্বরণীয় বরণীয় হচ্ছে অলি-আউলিয়াদের বাণী কিংবা কেরামত বিষয়ক কল্পকথা। এসব বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম। বিপদে পড়লেই তারা আল্লাহ-ইল্লাহ বেশি করে থাকে। 
আমি সুফী সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবারো বললাম-

-হুজুর, আপনি যে হাদিসের আলোকে অর্থাৎ মান আরাফা নাফসাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু এবং আল ইনসানু সিররি ওয়া আনা সিররুহ এর আলোকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বোঝা অনেকটা কঠিন। কিন্ত্তু আমি যদি আমার মতো করে বলি যেমন বাউল সম্প্রদায়ের সাধকরা বলে-আমি যে উপাদান দ্বারা সৃজিত হয়েছি বলতে আমার দেহের উপাদান সমুহ অর্থাৎ আপ, আতস, বাত, খাক, নুর পন্ঞ্চ উপাদান দ্বারা গঠিত হয়েছে। যার মুল উপাদান হচ্ছে হিউম্যান ফ্লুইড অর্থাৎ মণি

-বুঝেছি তুমি কি বলতে চাইছে। বাউল সাধকরা যে বিষয়ের সাধনা করেন সেটা তাদের কাছে সত্য। তারা কোরআনের আলোকেই তা ব্যাখ্যা করেন। কিন্ত্তু আমি মনে করি তারা একটা বিষয়ে ঈশ্বরকে সীমিত করে ফেলেছেন। উপাদান কারণ কখনো স্রষ্টা হতে পারে না। ওটা নিমিত্ত কারণ। কার্যকারণ মতবাদানুযায়ী কার্য দ্বারা কারণ নির্ণিত হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গেলে দেখা যায় - নাফাকতু ফিহি মিররুহি অর্থাৎ আমার তরফ থেকে রুহ ফুঁকে দিলাম। সেই রুহের ছোঁয়া পেয়েই আদম জীবিত হয়ে উঠলো। এবং আদমকে শ্রেষ্ঠ দানের জন্য ফেরেস্তা দ্বারা স্বীকৃত আদায় করে নেয়া হলো সিজদাহ করার মাধ্যমে
এখানে রুহ্ ফুঁকে দেয়ার অর্থ করেন - রুহটাই হলো আল্লাহ বা রবরুপে স্বরুপ উপস্থিতি। আল্লাহ শব্দটির অর্থ হলোঃ আল+ইলাহ। আল অর্থ হলোঃ প্রতিষ্ঠিত আর ইলাহ অর্থ উপাস্য। সুতরাং আল্লাহ=প্রতিষ্ঠিত উপাস্য। এখানে উপাস্য রুপে যাকেই প্রতিষ্ঠিত করবে সেই আল্লাহরুপে স্বরুপ উপস্থিতি থাকবে। যেমনঃ ধর যে পন্ঞ্চ উপাদানের কথা তুমি একটু আগে বললে কুম্ভকার যখন মুর্তি গড়ে সেখানে কি এই পন্ঞ্চ উপাদানের উপস্থিতি থাকে না? যদি থাকে তাহলে সেই মুর্তি কিন্ত্তু জীবিত নয়। অর্থাৎ রুহ না থাকায় সে জীবিত থাকে না। অথচ দেখ যখন মুর্তি পুজক তাকে বোধন মন্ত্র দেয় তখন তাকে কিন্ত্তু পূর্ব থেকে পৃথক মনে হয়। কেন? কারণ যে মুর্তিটি গড়া হয়েছে সেটা একটা নিমিত্ত কারণ। সেই নিমিত্ত কারণেই যারা তাকে ভগবানরুপে কল্পনা করছে সে তার উপাসনা করছে সে সে রুপেই তাকে কৃপা দান করে যাচ্ছে। কারণ আল্লাহ=আর্দ + সামা অর্থাৎ আসমান এবং জমিনের প্রভু। সৃষ্টির মনের কেন্দ্রবিন্দুটি হইলেন আল্লাহ। অর্থাৎ একমাত্র উপাস্য। যে ব্যক্তি এই সত্যটি না জেনে তার উপাসনা করছে পরন্ত্তু সে তার মনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রবেরই কাছে প্রার্থনা করছে। কারণটি কি? কারণটি হচ্ছে মন্ত্র পাঠক ঠাকুর পুরোহিতরা মন্ত্র পাঠক পূর্বক তাতে ফুঁ দেয়। অর্থাৎ সে মনে করছে সে আত্মা প্রতিষ্ঠিত করছে। কারণ সে যে ফুঁ-টি দিল তার ভিতরও কিন্ত্তু রব রয়েছে। রবের ফুঁ তে সে আত্মার সন্ঞ্চারণ ঘটাতে চাইছে
এবার তুমি বিচার কর-আল্লাহ যখন আদম সৃষ্টি করলেন তখন তিনি রুহ ফুকেঁ দিলেন। এখানে ফুকেঁ দেয়ার অর্থ - হচ্ছে রব অর্থাৎ প্রতিপালক রুপে তাকে লালন পালন করা। মাটি দিয়ে যে মুর্তি গঠন করা হলো তাতে আত্মা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরোহিত যেমন করে ফুঁ দিয়ে ছিলেন আল্লাহও তেমনি আত্মাকে জাগ্রত করার জন্য ফুঁ দিয়ে ছিলেন। আর সেই ফুঁ-কে বলা হয়েছে রুহ। এখানেও কিন্ত্তু পুরোহিত যেমন তার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখছেন ঠিক তদ্রুপ আল্লাহও তার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখছেন। এজন্যই বলা হয় - সুফীবাদ যেখানে অনেক গভীরে যেতে পারে বাউলরা ঠিক ততটা গভীরে যেতে পারে না

সুফী সাহেবের কথা শুনে আমি একেবারেই মেরে গেলাম। ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কি বলবো? কারণ আমি ধর্ম জ্ঞানে অভিজ্ঞ নই। আমরা মুখে বলি আমি মুসলমান। কিন্ত্তু নিজের ধর্ম পালন করা বিষয়ে আমাদের জ্ঞান সীমিত। আমরা আমাদের ধর্ম সর্ম্পকে তেমনভাবে পড়া-শোনা করি না। জানি না শুনি না। না বুঝেই জ্ঞানের ভাব ধরি। ভাবটা এমন যেন সব কিছুই জেনে গেছি। মনে মনে ভাবলাম-নাহ! আমাকে বিষয়ে আরো পড়া শোনা করা দরকার। আমি বললাম

-ঠিক আছে। আজকে সময়ের স্বল্পতার কারণে বসতে পারলাম না। আরেকদিন আসবো। 

আমি চলে যেতে চাইছি শুনে সুফী সাহেব বললেন

- ঠিক আছে। আরেকদিন আসবে। তখন আলাপ করা যাবে। চা খাও তো
 
তার কথা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। তিনি ইশারা করতেই একজন উঠে চা আনতে চলে গেল। আর সেই ফাকে সুফী সাহেব বললেন

-তোমাকে একটা কথা বলি। ফরিদউদ্দিন আত্তার তাহার শেষ গ্রন্থ 'লিসানুল গায়িব' পুস্তকে বলেছেনঃ
আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অজুদ
হর যমাঁ খোদরা বা-নকশ ওয়া নমুদ;
জুমলা যাতে জাঁহানে মিরআতে উস্ত
হরচে বিনি মুসহাফে আয়াতে উস্ত;
"লাওহে-মাহফুয" আস্ত, দর মা'নী দিলাত
হরচে মি খাহী, শোদ যে হাসেলাত
উনচে মাতলুবে-জাঁহা শোদ দর জাহান
হাম তুরী, বায জো আজ খোদ নেশান।
অর্থাৎ তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি শরীরী-জগতে প্রতি মুহুর্তে নব নব রুপে প্রকাশিত হইতেছেন। বিশ্বের সকল অস্তিত্বই তাহার মুকুর। যাহা কিছু দেখিতেছ সমস্তই তাহার প্রকাশ-চিন্হ। প্রকৃতপক্ষে তোমার অন্তরই "লওহে মাহফুয" যাহা কিছু চাও উহা হইতেই তাহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে। যিনি এই বিশ্বে সারা দুনিয়ার কাম্য, তুমিই তিনি। তোমার নিজের ভেতর তাহার সন্ধান কর

নেও বাবা চা খাও

আমি তার কথা শুনে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার দ্যুতিময় চেহারার প্রতিবিম্বিত রশ্মি যেন আরো বেশি আলোকিত হয়ে আমার সারা অংগে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। আমি আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলাম না। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন আমার মনের হিন্দোল বহুগুণে বেড়ে গেল।অামি তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম।

-কি কেমন বুঝলি?

আমি কিছু না বলে কেবল মনে মনে বললাম

আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অজুদ....