পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

৭২টি ফেরকার (ওহাবী মতবাদ) নিকট কিছু প্রশ্নঃ-

(৩৯) ৭২টি ফেরকার(ওহাবী মতবাদ)নিকট কিছু প্রশ্নঃ-
(৩৯)(ক)সুরা কাহাব আয়াত ১৬ঃ-”আমরা তোমাদের সাহা রগের নিকটে রহিয়াছি।”আনা শব্দের অর্থ=আমি(একবচন)”আনা শব্দের বহুবচন নাহনু এর অর্থ আমরা ”এখানে আল্লাপাক আমরা বলেছেন কেন ? আল্লারাব্বুল আলামিনের সাথে আর কাহারা আছেন ? এক আপনারা আল্লাহকে কোথায় খোজকরেন ?
(৩৯)(খ) সুরা অকেয়া আয়াত ৭৭,৭৮ঃ-”নিশ্চই ইহা সম্মানিত কোরআন যাহা আছে কিতাবের মধ্যে অবস্থিত ”
এই আয়াতে কোরআন এবং কিতাব আলাদা বস্তুু তাহলে কোরআন কি ? এবং কিতাব কি ?
(৩৯)(গ) সুরা মারিয়ম আয়াত ৩০ঃ-”মা” মারিয়মের শিশু পুএ(তিন দিনের) হজরত ইসা(আঃ) লোকজনকে জবাব দিলেন ।
”আমি আল্লাহর প্রেরিত কিতাব প্রাপ্ত নবী”
তখনও তিনি নবুয়াত পাননি এবং ইঞ্জল কিতাবও পান নি। তাহলে ঐ শিশু অবস্থায় তিনি কেমন কিতাব পেয়েছেন ?
(৩৯)(ঘ)সুরা আনাম আয়াত ৭ঃ-”আমি আপনার উপর কোন লিখিত বিসয় (কাগজের কিতাব) নাজিল করিনি। যদি করিতাম তাহলে আবিশ্বাসি গন তা হাত দ্বারা স্পর্স করিত এর পরেও বলিত উহা জাদু ছারা আর কিছু নয় ”
এই আয়াতে আল্লাহ্ কাগজের কিতাব নাজিল করেন নি বলেছেন। তাহলে কিরুপ কিতাব নজিল করে ছেন ?
(৩৯)(ঙ)সুরা হিজর আয়াত ৯১,৯২ঃ-”যাহারা কোরআনকে খন্ড খন্ড বা টুকরো টুকরো করেছে, আপনার প্রভূর শপথ, আমি ওদের প্রত্যেক কে জিঞ্জাসা করবো ”
এই আয়াতে আল্লাপাক কাগজের কিতাব নাজিল করেননি। তাহলে কেমন কিতাব খন্ড খন্ড করার কথা বলেছেন ?।
(৩৯)(চ)সুরা নাজম আয়াত ৭ঃকোরান অহী যাহা প্রত্যাদেশহয় শক্তিশালী ফেরেস্তার মাধ্যমে -------সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল "
এই আয়াতে স্পস্টভাবে আল্লাপাক বলেছেন কোরআন নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে" তাহলে সেই আকৃতি খানা কেমন?
(৩৯)(ছ) হাদীসঃ-”যে তাহারা নফসকে চিনেছে,সে তার রবকে চিনেছে ”তাহলে রবের আবস্থান কোথায় ? এবং রবকে খোজ করেন কোথায় ?
(৩৯)(জ)সুরা হাদীদ(৩)আয়াতঃ-”সর্ব প্রথমেও আমি আল্লাহ্,সর্ব শেষেও আমি আল্লাহ্ , আমি প্রকাশিত আল্লা,আমি অপ্রকাশিত আল্লা বা নিরাকার আল্লা ”
এই আয়াতে আল্লাহর প্রকাশিত রুপটি কেমন ?
(৩৯)(ঝ)শেষ বিচারের দিন আল্লাপাক বিচারে জন্য কুরছিতে বসবেন। যদি আল্লাপাকের আকার নাই থাকে তাহলে কুরছিতে বসবে কেমন করে ?
(৩৯)(ঞ)"অহু অহুয়া মাকুম অইনা কুনতুম "
অর্থঃ-তুমি যখন যে অবস্থায় থাক(পাকে নাপাকে) আমি সর্ব অবস্থয় তোমার সংগে আছি "
তাহলে রবকে কোথায় খোজেন ?
(৩৯)( ট)সুরা বাকারা আয়াত১১৫ঃ- তুমি যে দিকেই তাকাও সে দিকেই আমার চেহারা(অজহু) আল্লাহর চেহারা কেমন ?
(৩৯)( ট) রুহ্ কি ? এই রুহ্ এর মৃত্যু র কথা কোরানের কোথাও বলা হয় নাই। নফছের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এই রুহ্ কে ? কোথায় খুজবেন আল্লকে ?
(৩৯)(ঠ) সুরা হিজর আয়াত ২৯ঃ- "আমি আমার রুহ্ কে আদমের মধ্যে ফুৎকার করলাম "
এই রুহ্ কে ?
(৩৯)(ড) সুরা মারিয়ম আয়াত১৭ঃ-" আমি আমার রুহ্ কে ইসার দিকে প্রেরন করলাম "
এই রুহ্ কে ? কোথায় খোজেন আল্লাকে ?
(৩৯)(ঢ)সুরা মজদালা আয়াত ৭ঃ- "তোমাদের মধ্যে তিন জনের পড়ামর্স হয় না,যেখানে আমি চর্তুর্থ জননা থাকি,পাঁচ জনেরও পড়ামর্স হয় না যেখানে আমি সষ্ঠ জন না থাকি,তদা অপেক্ষা বেশি,তদা অপেক্ষা কম " কোথায় খোজেন আল্লাহ্ কে ?
(৩৯)(ণ) সুরা নাহল আয়াত ৯২ঃ- "তোমরা কেহ ঐ মহিলার মতো হয়োনা যেন,পরিশ্রমের পর পাকানো সুতাকে খন্ড খন্ড করে ছিরে ফেলেছে "
এই আয়তে এই উপমা দ্বরা আল্লাপাক আমাদের কি বোঝাতে চেয়েছেন ? এ সকল প্রশ্নের উওর নবী পরিবার সদস্যের দল অলী,আউলিয়া,গাউস,কুতুব,পীর,মোর্শেদের নিকট একেবারেই সাধারন বিষয় । এভাবে অসংখ্য প্রশ্ন লুকিয়ে আছে ।

সংগৃহীত " প্রেমই ধর্ম "
"প্রেমই সর্গ "

মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

একত্ববাদের অনন্ত রহস্য

কাযবিন ইরানের একটি প্রদেশের নাম। কাযবিনের লোকদের নিয়ে অতীতের একটি গল্প ছিল বেশ মুখরোচক। মওলানা রুমি (রহ.) গল্পটিকে উপলক্ষ বানিয়েছেন তার জীবন দর্শন ব্যাখ্যা করার জন্য। কাযবিনীদের মাঝে রেওয়াজ ছিল, তারা শরীরে বাঘ, সিংহ, নেকড়ের নকশায় উল্কি আঁকত। এর দ্বারা তারা নিজের সাহস ও বীরত্ব প্রকাশ করত। একবার এক কাযবিনী এক আঁকিয়ের কাছে গিয়ে বলল, আমার শরীরে বাঘের একটি ছবি আঁক। আঁকিয়ে বলল, কোথায় আঁকব। কাযবিনী বলল, আমার কাঁধের উপর। আঁকিয়ে উল্কি আঁকতে গিয়ে যেই না সুই ফুটাল, কাযবিনী কঁকিয়ে উঠল। বলল, বাঘের কোন অঙ্গটি আঁকছ, এত যে কষ্ট পেলাম? আঁকিয়ে বলল, লেজ থেকে শুরু করেছি। কাযবিনী বলল, না। লেজটা বাদ দিয়ে আঁক। আঁকিয়ে দ্বিতীয়বার সুই ফুটাল। কাযবিনীর আবার আর্তচিৎকার। বলল, এখন কোন অঙ্গটি আঁকছ। ব্যথা যে সইতে পারছি না। আঁকিয়ে বলল, বাঘের কান। কাযবিনী বলল, আচ্ছা কানটি বাদ দিয়ে আক, কোনো অসুবিধা হবে না। আঁকিয়ে আবার শক্ত করে সুঁই ফুটিয়ে উল্কি আঁকা শুরু করল। এবারও কাযবিনী কঁকিয়ে উঠল। জানতে চাইল, বাঘের কোন অঙ্গটি আঁকছে, এত যে ব্যথা। আঁকিয়ে জানাল, বাঘের পেট। কাযবিনী বিনয়ে অনুরোধ জানাল, বাঘের পেটটি বাদ দিয়ে আমার শরীরে উল্কি আঁক। আঁকিয়ে দারুণ গোস্বায়, তার সুইটি ছুড়ে মারল। 

গল্পের এ স্তরে এসে মওলানা মানবজাতির দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিতে চান অন্য জগতের দিকে। বলছেন,
হে ভাই, তুমি ধৈর্য ধর সুই ফুটানোর তীক্ষ্ণ ব্যথায়, যাতে
মুক্তি পাও অবাধ্য নফসের হুলের তীব্র আঘাত হতে।

তোমার ভেতরে যে নফস হরদম তোমাকে মন্দের দিকে প্ররোচনা দেয়, তাকে বশে আনতে হবে। তার জন্য তোমাকে সাধনা করতে হবে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। কঠিন কঠোর কৃচ্ছ্রতার তালিম তোমাকে তামিল করতে হবে। কৃচ্ছ্রতার এসব কষ্ট বিষাক্ত কাঁটার দংশনের মতো বলেই মনে হবে। কিন্তু নিজের জীবনকে শুদ্ধ করতে হলে, তোমার ভেতরে অবাধ্য যে নফস হরদম তোমাকে মন্দের দিকে টানছে, তার বিরোধিতা করতে হবে। তাহলেই নফসের আঘাত থেকে তুমি রেহাই পাবে। দিনের পথে চলার, আল্লাহর পথে টিকে থাকার এটিই সহজ ও একমাত্র পথ। এরই অপর নাম জিহাদে আকবর, সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ। আধ্যাত্মিক সাধনার এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ নফসের রঙ-রূপ নিত্য বদলায়। নানা আঙ্গিকে সে মানুষের সামনে উপস্থিত হয়। কাউকে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভ গোমরাহ করে, কাউকে ইবাদত-বন্দেগির অহমিকা ও ধোঁকায় ফেলে বিচ্যুত করে। কাউকে জ্ঞানের বড়াইয়ের জালে বন্দি করে। আবার কাউকে ভোগ এবং যৌনতার অন্ধকারে আটকে রেখে সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। কাজেই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় জিহাদ হচ্ছে নফসের এ বিচিত্র ধোঁকা থেকে আত্মরক্ষার সাধনা। নিজের আত্মা, চিন্তা ও চরিত্রকে শুদ্ধ ও সংশোধন করা। কোরআনেও নিজের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য বারবার এ তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমরা কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না, তাহলে ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে।’ (সূরা নিসা : ৩৫)।

বস্তুত কামনা-বাসনার ফাঁদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ মুজাহাদা বা কৃচ্ছ্রসাধনার জাঁতাকলে নফসকে পিষ্ট করা। মওলানা বলছেন, এ জগতে ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ-নিষেধ পালনের কঠিন কষ্টভোগ কর তাহলে ওই জগতের দুঃখকষ্ট থেকে তুমি রেহাই পাবে। 

কষ্ট কর, সাধনা কর, যাতে পাও তুমি,
আম্বিয়া ও আউলিয়াদের সেই পথ খুঁজি।
আমি কাফের হয়ে যাব, মুহূর্তের জন্যও যদি
ঈমান, ইবাদতের পথে চলে হয় কারো ক্ষতি।
মওলানা বুঝিয়ে বলছেন, যারা নিজের বস্তুগত অস্তিত্ব ও স্বভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছেন, বিবেকের শাসনে প্রবৃত্তিকে আজ্ঞাবহ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মহত্ত্বের সামনে যেন আকাশ, চাঁদ, সুরুজ সিজদায় অবনত হয়েছে।
শেখ সাদি (রহ.) বলেন, এক দরবেশকে বাঘের পিঠে সওয়ার দেখে উৎসুক জনতা জিজ্ঞেস করল, কীভাবে আপনি এমন মর্তবা অর্জন করলেন? বুজুর্গ বললেন, আমি নিজেকে আল্লাহর হুকুম পালনে একান্ত বাধ্যগত করে নিয়েছি, যার ফলে আল্লাহর সৃষ্টি আমার অনুগত হয়েছে।
মওলানা রুমি আরও বুঝিয়ে বলেন, যার অন্তরজুড়ে আল্লাহর প্রেমের আগুন লেলিহান শিখায় প্রজ্বলিত হয়, সূর্যের প্রখর তাপ বা প্রাকৃতিক নানা উপাদান তার কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না।
মওলানা এ পর্যায়ে কোরআন মজিদে বর্ণিত আসহাবে কাহাফের ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন, জালেম বাদশাহর সম্মুখে সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে পালিয়ে থাকা গুহাবাসী এই যুবকদের ওপর সূর্যের তাপ ও চাঁদের আলো এমনভাবে পতিত হত, যাতে তাদের শরীরে বা আরামের ঘুমে সামান্যতম আঁচড় না লাগে।
মওলানা আরও বলছেন, কৃচ্ছ্রতার মাহাত্ম্য এতই সুদূরপ্রসারী যে, কৃচ্ছ্রতার প্রভাবে তুমি ফুলের মতো সৌরভ বিলাবে। যদিও এর আগে তোমাকে কাঁটার মতো মনে হত। তুমি মহাসৃষ্টির ক্ষুদ্র অংশ বটে; কিন্তু কৃচ্ছ্রতার বলে তুমি নিজেকে এতখানি উন্নত করতে পারবে যে, তুমি সমগ্রের মাঝে বিলীন হতে পারবে। সমগ্রের যে গুণ ও বৈশিষ্ট্য তখন তা তোমার মধ্যে সঞ্চারিত হবে। সেই সমগ্রের সামনে তুমি সত্যিকার সান্নিধ্যে উপনীত হবে। তার সম্মুখে শ্রদ্ধায় অবনত হতে পারবে। 

আমরা যে নামাজ পড়ি, আল্লাহর সামনে রুকুতে নত হই, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সিজদায় যাই, তাতে আমাদের উপলব্ধি এটাই। আমরা নিজেকে হীন, তুচ্ছ ও মাটিতে পতিত বলেই অনুভব করি মহামহিম আল্লাহর সমীপে। এটিই তাওহিদের মর্মবাণী। মওলানা রুমি বলছেন, আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ হলো, নিজেকে পরম এককের সামনে পুড়ে ছাই করা। অর্থাৎ নিজের কাল্পনিক অস্তিত্বের পতন ঘটানো এবং আল্লাহর প্রেমের অনলে দগ্ধ হওয়া আর ফানার (আত্মবিলীন) মাকাম লাভ করা।
এই মাকাম লাভ করার একটি উপায় আছে। মওলানা সেটি বুঝিয়ে বলছেন এভাবে-
চাও যদি আলোকিত হবে উজ্জ্বল দিবসের মতো
জ্বালিয়ে দাও তোমার অস্তিত্ব, যা কিনা রাতের মতো।

তুমি যদি চাও যে, দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হবে, সত্যের আলোতে দেদীপ্যমান হবে, তাহলে তোমার বস্তুগত অস্তিত্বের কিছুই যাতে নফসের কামনা-বাসনায় বন্দি হওয়ার সব জাল ছিন্ন কর।
তোমার অস্তিত্ব সেই পরম অস্তিত্ব দাতার সম্মুখে
পরশমণিতে তামার মতো বিগলিত কর জ্বালিয়ে।
তামা যেমন আগুনে জ্বলে বিগলিত হয় এবং খাঁটি স্বর্ণ উদ্ভাসিত হয়, তেমনি তুমিও তোমার অস্তিত্বের তামাকে পরম অস্তিত্ব আল্লাহর পরশে বিগলিত কর।
আমি ও আমরায় করেছ নিজকে দারুণ বিভাজিত
সব অনিষ্টের মূলে কিন্তু ক্রিয়াশীল দেখ এই দ্বিত্ব।

অর্থাৎ তুমি নিজের মিথ্যা অস্তিত্বের বন্দিত্বের মধ্যে আটকে আছ। বুঝতেই পারছ না যে, নিজকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা মনে করার কারণে সব ধরনের মানসিক ও চারিত্রিক বিপর্যয় তোমার ওপর আপতিত হচ্ছে। কাজেই আল্লাহর মোকাবিলায় নিজেকে কিছু একটা বলে ভাবার চিন্তা ঘৃণাভরে ত্যাগ কর।
(সূত্র : মসনবি শরিফ, বয়েত-১/২৯৮১-৩০১২)
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী | 

বুক চাই ব্যথায় কাতর আবেগেপূর্ণ প্রেমে

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
 
প্রান্তরভূমির মেঠো পথ বেয়ে কোথাও যাচ্ছিল এক কুস্তিগীর। যৌবনের বীরত্ব টগবগ করছিল তার শরীরজুড়ে। হঠাৎ দেখে এক অজগর দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে এক ভল্লুককে। ভল্লুক আর্তচিৎকার করছে, বাঁচাও বাঁচাও বলে। বীরের রক্তে আগুন ধরে গেল এ অবস্থা দেখে। যেভাবেই হোক ভল্লুককে উদ্ধার করতে হবে অজগের গ্রাস থেকে। মওলানা রুমি বলেন, এ জগতে অনেক বীরপুরুষ আছেন যেদিক থেকে মজলুমের ফরিয়াদ ভেসে আসে সেদিকে তারা দৌড়ে যান। তারা ইনসাফ, মানবপ্রেম পরোপকারের চেতনায় লালিত। মজলুমের সাহায্য করা তাদের স্বভাবে পরিণত। স্বভাবের তাড়নাই তাদের নিয়ে যায় মজলুম মানুষের সাহায্যের পানে। আসলে যেখানে ব্যথা ও রোগের প্রকোপ, সেদিকে ধেয়ে যায় ওষুধ। যেখানকার জমি নিচু সেদিকেই গড়িয়ে যায় পানি। মওলানা তার মূল জীবন দর্শন উপস্থাপন করে বলেন,
অ’বে রহমত বা’য়াদত রও পস্ত শো
ওয়াঙ্গাহা’ন খোর খমরে রহমত মস্ত শো
রহমতের বরিষণ যদি চাও বিনীত নিচু হয়ে যাও
রহমতের শরাব পিয়ো প্রাণ ভরে, উন্মাতাল হও।
(২খ. বয়েত-১৯৪০)।
চর্খ রা’ দর যীরে পা’ আ’র আই শোজা‘
বেশনো আয ফউকে ফলক বাঙ্গে সামা‘
ঊর্ধ্বাকাশ পদানত কর, এগিয়ে যাও হে বীর কেশরি
আকাশের ওপার হতে শোনো, আসে সুরের লহরি।
(২খ. বয়েত : ১৯৪২)।
পাম্বেয়ে ওয়াসওয়াস বীরূন কুন যে গূশ
তা’ বে গূশত আয়দ আয গার্দূন খুরুশ
কান থেকে তোমার খুলে ফেলে দাও সন্দেহের তুলা
তখনই হৃদয়ের কানে বাজবে ওপারের সঙ্গীত সুধা।
(২খ. বয়েত : ১৯৪৩)।
পা’ক কুন দো চশম রা’ আয মূয়ে আইব
তা’ বেবীনী বা’গ ও সরবেস্তা’নে গাইব
দোষখাতার লোম হতে সাফ কর দুই চোখ
অদৃশ্যের বাগানে তখন দেখবে নানা ফলফুল। (২খ. বয়েত : ১৯৪৪)।
দাফ-কুন আয মগয ও আয বীনী যুকা’ম
তা’ কে রীহুল্লাহ দর আ’য়দ দর মশা’ম
সর্দিকাশী দূর কর মস্তিষ্ক ও নাসিকা হতে
নাসিকা ইন্দ্রিয়ে আল্লাহর সুবাস ঢুকবে তবে। (২খ. বয়েত : ১৯৪৫)।
এ কথা শুনে তুমি হয়তো বলবে, বলা তো সহজ। করা কিন্তু কঠিন। আমার পক্ষে তো সম্ভবই নয়, অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। মওলানা বলেন, এই যে পারনি, সম্ভব নয়Ñ এ কথা গোপন করে রেখো না। খুলে বলো।
যা’রি ও গেরয়ে কওয়ী সরমায়েঈ আস্ত
রহমতে কুল্লি কওয়ী তর দা’য়েয়াঈ আস্ত
কান্না ও আহাজারী বিরাট পুঁজি জান এই পথের সম্বল
অপার রহমত অসহায়ের সহায় অবারিত সুফল।
(২খ. বয়েত : ১৯৫১)।
মওলানা আরও বলেন, একটু চিন্তা করো, মা ও ধাত্রী বুকের সন্তানকে দুধ দিতে চায়। এজন্য ইচ্ছা করে সন্তানকে কাঁদায়। তোমার নানা অভাব ও প্রয়োজনের তাড়না, সমস্যা। এগুলো দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কাঁদানোর বাহানা। তোমাকে কাঁদাবে, তারপর দুধ দেবে, এজন্যই তোমাকে নানা সমস্যায় জর্জরিত করার আয়োজন।
তিফলে হা’জা’তে শোমা’ রা’ আ’ফরীদ
তা’ বে না’লীদ ও শওয়াদ শীরশ পদীদ
তোমার সমস্যা, চাহিদারূপ শিশুকে সৃষ্টি করেছেন তিনি
দুধের জোয়ার আসে রহমতের বুকে যেন কাঁদলে তুমি।
(২খ. বয়েত : ১৯৫৩)।

মওলানা বলছেন, এ পথে সন্দেহ সংশয় মনে স্থান দিও না, ভয়ভীতির পরোয়া করো না। যত দিকের তাড়া আসুক কান পাতবে না। লক্ষ রাখবে, যদি মনে উপর দিকের চেতনা ও তাড়া আসে, তোমার চিন্তাকে ঊর্ধ্বাকাশমুখী করে তাহলে তা তোমার উন্নতির সহায়ক। আর যদি তোমার মধ্যে লোভ-লালসা, হিংসা ও পশুত্বের চেতনা জাগায়, তাহলে নিশ্চিত জান যে, তা নফসের প্ররোচনা।
গল্পের ধারাভাষ্যে যাত্রাবিরতি করে মওলানা আমাদের আধ্যাত্মিক সবকগুলো দিয়েছেন। এবার গল্পের ধারায় ফিরে এসে তিনি বলেন, বিপদগ্রস্ত ভল্লুকের আর্তনাদ শুনে কুস্তিগীর তার কৌশল ও বীরত্বের জোরে অজগরটিকে হত্যা করে। অজগরের গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে ভল্লুক আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত। সে কুস্তিগীরের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। বুঝিয়ে দেয়, আমি কৃতজ্ঞ, তোমার অনুগত। কুস্তিগীরের কেমন যেন ভালো লাগে। ধীরে ধীরে ভল্লুকের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। অনেক দূর পথ চলে ক্লান্তবীর পথের ধারে এক জায়গায় বসে পড়ে। মৃদুমন্দ বাতাসের পরশে ঘুমের কোলে এলিয়ে পড়ে বীর। ভল্লুক তার শিয়রে বসে, তাকে পাহারা দেয়।

সে পথ দিয়ে জাচ্ছিল এক জ্ঞানী লোক। দেখে, আজব ব্যাপার। বনের ভল্লুক পাহারা দেয় ঘুমন্ত মানুষকে। থমকে দাঁড়ায়। বীরকে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা করে, এই ভল্লুকের সঙ্গে তোমার এত সখ্য, বলো তো কী ব্যাপার? আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বীর। ভল্লুক উদ্ধারের অভিযান আর ভল্লুকের সখ্যের কথা খুলে বলে তাকে। বর্ণানা শুনে জ্ঞানী ব্যক্তি বলল, খবরদার! কোনো অবস্থাতেই ভল্লুকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না। যে কোনো উপায়ে ভল্লুককে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও। প্রস্তাব শুনে একেবারে বেজার হয়ে গেল বীরের মন। বলল, একটি বন্যপ্রাণী আমার ভক্ত হয়ে গেছে, তোমার সহ্য হয় না। তাই বুঝি হিংসায় এমন কথা বলছ। জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, মনে করো আমি হিংসার কারণে এ কথা বলছি। তবুও তো তোমার এ সত্যটি মানতে হবে যে, জ্ঞানীর শত্রুতা মূর্র্খের বন্ধুত্বের চেয়ে উত্তম।’ লোকটি বলে ফেলল, যাও তো, নিজের চরকায় গিয়ে তেল দাও। বনের ভল্লুক আমার বশীভূত, কম কথা! সমাজে আমার কী যে কদর হবে। রাখ তোমার তত্ত্বকথা।

এ কথা বলে বীর আবার আশ্রয় নিল ঘুমের কোলে। তাকে পাহারা দেয় বনের ভল্লুক। একটু পরে কয়েকটি মাছি ওড়ে এসে বসে বীরের নাকের ডগায়। ভল্লুক মাছিগুলো তাড়িয়ে দেয়, যাতে বীরের ঘুমে বিঘœ না ঘটে। কিন্তু মাছি তার নিষেধ মানে না। ওড়ে ওড়ে আসে, ভল্লুক বারবার তাড়ায়। বিরক্ত ভল্লুক এক পর্যায়ে একটি আস্ত পাথর নিয়ে আসে, অপেক্ষায় থাকে। মাছিরা যেই না ঘুমন্ত বীরের নাকের ডগায় বসে, ভল্লুক হাতের আস্ত পাথরটি সজোরে ছুড়ে মারে মাছির ওপর। নাকমুখ থেঁতলে যায়। সেখানেই বীরের জীবনাবসান।

মওলানা রুমি মানবজাতিকে পরামর্শ দেন, তুমি যদি জীবনকে সঠিক পথে অবিচল রাখতে চাও, তাহলে জ্ঞানী লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করো। তাদের উপদেশ শ্রবণ করো। তোমার আত্মার আপনজন স্বজাতি ইহকাল-পরকালের হিতাকাক্সক্ষী মুর্শিদের সাহচর্য গ্রহণ করো। যদি কোনো ভ-কে প্রকৃত বন্ধু বলে গ্রহণ করো, তাহলে তোমার পরিণতি হবে কুস্তিগীর ও ভল্লুকের মতো। প্রথম অবস্থায় ভল্লুক বিরাট অজগরের খপ্পরে পড়েছিল। এমনটি হলে কোনো দক্ষ লোক যেন তোমাকে অজগরের মুখ থেকে উদ্ধার করে আনে। তুমি হয়তো বলবে, যাপিত জীবনে নানা অসংগতির কারণে নিজে বুঝলেও ভুল পথ ছেড়ে আসতে পারি না, মন্দ ভ-দের খপ্পর থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ খুঁজে পাই না। মওলানা সে পথ বাতলে দিয়ে বলেন, ভল্লুক তার কান্নার জোরে নিজেকে মুক্ত করেছে অজগরের মুখ থেকে। তুমি কি ভল্লুকের চেয়ে কম, তুমি কেন কান্নার বানে আসমানের রহমত নামিয়ে আনতে পারবে না জমিনে। হ্যাঁ, তার জন্য তোমাকে তওবা করতে হবে, আজেবাজে যা কিছু খেয়েছ বমি করে উদ্গার করতে হবে। হারাম খেয়েছ, অবৈধ কাজ করেছ, সবকিছু ত্যাগ করতে হবে। অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদতে হবে।
(সূত্র : মসনবি শরিফ : ২খ. বয়েত : ১৯৩২-২০৭৯)।

রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নির্জন গজলের নিঃসঙ্গতার গল্প

রুবাইয়াতের বিশ্বখ্যাত লেখক ওমর খৈয়ামকে সবাই জিজ্ঞেস করতেন আপনি নির্জনতা কেন পছন্দ করেন? নিঃসঙ্গতা কেন পছন্দ করেন? তিনি বলতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভেতর নিঃসঙ্গতা তৈরি হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমার রুবাইয়াত তোমার হৃদয়ে স্পর্শ করবে না। এর কারণ যার ভেতর নির্জনতা তৈরি হয়নি সে কখনো নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করতে পারবে না।

প্রথম দিকে মূল ফারসি ভাষায় গজল লেখা হতো। তখনকার দিনে গজল শিল্পীরা ফারসি ভাষাতেই গজল পরিবেশন করতেন। যেমন হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) দরবারে আমির খুশরু ফারসি ভাষায় গজল পরিবেশন করতেন। তার গজল শুনে মহান আল্লাহর অলি হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) চোখের জল ধরে রাখতে পারতেন না। আমির খুশরু ছিলেন নির্জনপ্রিয়, নিঃসঙ্গপ্রিয় মানুষ। তাই তিনি গজল ভালোবাসতে পেরেছিলেন। নিজের জীবনে নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করতে পারতেন। প্রিয়জনের কথা যখনই মনে হয়ে যেত তখনই তিনি গজল পরিবেশন করতেন আর অশ্রুবর্ষণ করতেন। কারণ, বুকভরা যন্ত্রণাকে বের করার কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, একমাত্র অশ্রুবর্ষণ ছাড়া।

‘নিঃসঙ্গতার কবি’ খ্যাত মির্জা গালিব, তার প্রতিটি গজলে কোনো না কোনোভাবে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সুখ স্পর্শ করতে পারেননি। তাই তিনি তার গজলে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতার সঙ্গে সাকি ও শারাবকে নিয়ে আসতেন। তিনি মনে করতেন সাকি ও শারাবের মাধ্যমে প্রিয়জনের ছবি ভেসে উঠবে। প্রেমিক হৃদয় যখন প্রেমাস্পদের জন্য হাহাকার করতে থাকে তখন তার নিঃসঙ্গতা-নির্জনতা দূর করার জন্য সাকি ও শারাব ছাড়া সে আর কোনো কিছুর উপর ভরসা রাখতে পারে না। যে কারণে ফারসি গজল ও উর্দু গজলে সব গজল লেখক নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে এসেছেন, একই সঙ্গে তারা সাকি ও শারাবকে নিয়ে এসেছেন।

এক সময় মিয়া তানসেন সম্রা ট আকবরের দরবারে যখন গজল পরিবেশন করতেন তখন তিনিও তার গজলে সাকি ও শারাবকে নিয়ে আসতেন। পরবর্তীতে গজল গায়ক তালাত মাহমুদ থেকে মেহেদী হাসান পর্যন্ত প্রত্যেক গজল শিল্পী তাদের গজলে নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা, সাকি ও শারাবকে নিয়ে এসেছেন। এর ফলে গজল পূর্ণতা পেয়েছে। যারা গজল অনুষ্ঠান শুনতে গিয়েছিলেন, শুনতে যাচ্ছেন তারা যখন বিদায় নিয়ে চলে আসেন তখন সঙ্গে করে চোখ ভরা জল নিয়ে ফেরত আসেন, এটাই গজলের পূর্ণতা।
যে গজল আপনাকে হারানো মানুষকে মনে করিয়ে দিতে পারবে না, অশ্রুবর্ষণ করাতে পারবে না, বুঝতে হবে সেটি গজল ছিল না। আর যেই গজল আপনাকে স্তব্ধ করে দিবে, কথা বলার শক্তি কেড়ে নিবে, বুঝতে হবে আপনি গজল শুনেছেন। মেহেদী হাসানের পরে যেসব শিল্পী গজল পরিবেশন করেছেন তারা প্রত্যেকই মেহেদী হাসানকে অনুসরণ করেছিলেন। এদের অন্যতম হচ্ছেন জগজিৎ সিং। তাকে বলা হয় আধুনিক গজলের জনক। রোমান্টিক গজলকে তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। তার স্ত্রী চিত্রা সিংকে নিয়ে যখন তিনি গজল পরিবেশন করতেন তখন সেই গজলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মাঝে মেহেদী হাসানের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যেত।

নির্জনতায় গজল, নিঃসঙ্গতায় গজলÑ এই উপলব্ধি আপনি তখন অনুভব করবেন যখন আপনার জীবনে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা আসবে। তা না হলে অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা প্রিয় মানুষকে আর খুঁজে পাবেন না। গজল আপনার প্রিয় মানুষকে সুর-তালের সঙ্গে উপস্থিত করে দিবে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যাবেন আপনার নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা। তারপর আবারও চলে আসবে আপনার প্রিয় নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা।

সৈয়দ রশিদ আলম: গবেষক

রুবাইয়্যাৎ

“রুবাইয়্যাৎ” : এক অনুপম রচনা শৈলী
-মুহম্ম দ সোহেল ইকবাল।

রুবাইয়্যাৎ : আরবি বা ফারসী ভাষায় রচিত চতুষ্পদী কবিতা বা কবিতাসমূহ। রুবাই (رباعی‎) আরবী শব্দ। অর্থ- চতুষ্পদী অর্থাৎ চার পঙক্তি বিশিষ্ট কবিতা। এটা বিশেষ ধরনের কবিতা। কিছু কিছু কবিতা আছে বিশেষ কিছু নিয়ম-কানুন মেনে সেগুলো লেখা হয়। যেমন- সনেট, লিমেরিক, এলিজি, ওড, রুবাই ইত্যাদি। রুবাইয়ের বহুবচন রুবাইয়্যাৎ (رباعيات) ) ১০৪৮ ঈসায়ী পারস্যের (বর্তমান ইরান) কবি হযরত উমর খৈয়াম রহমতুল্লাহি আলাইহি ও কবি হযরত হাফিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের হাতে কবিতার এই বিশেষ ধরনটি চরম উৎকর্ষ লাভ করে। এটি ছড়া নয়। ছড়া হচ্ছে মূলত শিশুতোষ রচনা। রুবাই উচ্চমার্গের দার্শনিক রচনা। তাসাউফ ও দার্শনিক মতের সাথে মিল পাওয়া যায় রুবাইয়ের দর্শনের।

প্রধানত তাসাউফ দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এসব রুবাই মাত্র চার লাইনে লেখা হয়েছে। রুবাইয়ে উল্লিখিত সাকি সুরা প্রতীকী বা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সাকি বা প্রিয় হলেন মুর্শিদ আর সুরা বা শরাব হচ্ছে দিব্যজ্ঞান/পথের দিশা বা মুহব্বত-মা’রিফত। কিছু কিছু লিখাতে রোমান্টিকতাও রয়েছে। 

রুবাইয়্যাৎ-এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে একই অন্তমিল রাখা হয় তৃতীয় লাইনটি মুক্ত অর্থাৎ কোন অন্তমিল থাকে না, যেমন- ‘ককখক’। 

১৮৫৯ সালের দিকে ইংরেজ কবি এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড হযরত উমর খৈয়াম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার রুবাইসমূহ ইংরেজি অনুবাদ করার পর পাশ্চাত্য জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তারই সূত্রে ইংরেজি থেকে বাংলায় কয়েকজন কবি সেগুলো অনুবাদ করলেও কিন্তু এসব অনুবাদে মূল অন্তমিল কাঠামো বজায় রাখা হয়নি। কারণ ভাব ও ভাষা উভয়ই ঠিক রাখা কঠিন। তাই প্রচলিত কবিতার ন্যায় প্রথম দ্বিতীয় লাইনে মিল এবং তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনে আরেকটা মিল রাখা হয় (ককখখ)। তবে উল্লেখযোগ্যভাবে মূল ফারসী থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি। কাজী নজরুল ইসলাম মূল রুবাইয়ে ব্যবহৃত রচনাকৌশল ও অন্তমিলই (ককখক) ব্যবহার করেছেন। মূল ফারসী থেকে করা অনুবাদগুলোর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদগুলোই সবচেয়ে ভালো বলে বাংলার গুণীরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। সাহিত্যিক ও লেখক ডক্টর সৈয়দ মুজতবা আলী তিনি নজরুলের অনুবাদকের ভূমিকায় বলেছেন, ‘কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’

এখানে হযরত উমর খৈয়াম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার একটি ফারসী রুবাই ও কিছু অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো :

گویند کسان بهشت با حور خوش است
من می گویم که آب انگور خوش است
این نقد بگیر و دست از آن نسیه بدار
کآواز دهل شنیدن از دور خوش است

অনুবাদ : কবি কাজী নজরুল ইসলাম
(১)
প্রভাত হলো। শারাব দিয়ে করব সতেজ হৃদয়-পুর,
যশোখ্যাতির ঠুনকো এ কাঁচ করব ভেঙে চাখনাচুর।
অনেক দিনের সাধ ও আশা এক নিমিষে করব ত্যাগ,
পরবো প্রিয়ার বেণী বাঁধন, ধরবো বেণুর বিধুর সুর।

(২)
সবকে পারি ফাঁকি দিতে মনকে পারি ঠারতে চোখ,
খোদার উপর খোদকারিতে ব্যর্থ হয় এ মিছে স্তোক।
তীক্ষè সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে জাল বুনিলাম চাতুর্যের,
মুহূর্তে তা দিলো ছিঁড়ে হিংস্র নিয়তির সে নখ।

অনুবাদ : এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড

Alike for those who for TO-DAY prepare,
And those that after a TO-MORROW stare,
A Muezzin from the Tower of Darkness cries
“Fools! Your Reward is neither Here nor There!”

একই ধারায় লিখা

কত গুনাহ করেছি এ জীবনে
বাঁচাবে কে! মোরে ওই অনল যাপনে।
মুর্শিদ আমার, তিনি তো খোদার বন্ধু
দক্ষিণে পাড়ে বসবেন তিনি, নিক্তির মাপনে।

সাকী ও শারাব

''শরাব ছাড়া আমার হাতের কলম চলছে না।
ধোঁয়াহীন আগুন কোথায় তুই?''
_______ #মির্জা_গালিব

[#অনুবাদঃ(৫৫ঃ১৫)। এবং সার্বক্ষণিক জিনকে রূপান্তর সৃষ্টি করিয়াছেন ধূয়া ছাড়া আগুনের উত্তাপ হইতে।
___ #আল_কোরান]।

'#মারেজ' অর্থাৎ উত্তাপ, ধূয়া ছাড়া উত্তাপ। বস্তুগত আগুনে কিছু না কিছু ধূয়া থাকে। মনের আগুনে ধুয়া থাকে না, অথচ ইহা মনকে জ্বালাইয়া মারে। মনের আগুনে সকল মানুষই কিছু না কিছু জ্বলিয়া থাকে, কিন্তু যে ব্যক্তি সার্বক্ষণিক জিনরূপে রূপান্তর সৃষ্ট হইয়াছে সে মনের জ্বালা হইতেই সৃষ্ট হইয়াছে। অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে জৈবিক ভাব হইতে সৃষ্ট হইয়াছে। অর্থাৎ জান্নাতের স্বভাব মিশ্রণ তাহাতে নাই। জাহান্নামের আগুনের জ্বালা হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে। ইনসানের মধ্যেও জিনভাব আছে কিন্তু তাহা সীমিত পরিমাণ। কামেল গুরুর আশ্রয় ব্যতীত মানুষ এবং জিন জাতিকে অসীম জিনভাব হইতে কে রক্ষা করিবে? (দ্র.৫৫:১৫)।

____ #সদর_উদ্দিন_আহমদ_চিশতী

#সাকী_ও_শরাব
__________________
*১.
খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।।
দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ রোজার বদলাতে
চাই নে বেহেশত খোদার কাছে।।
নিত্য মোনাজার করে।।
খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে
কায়েস যেমন লায়লী লাগি লভিল মজনু খেতাব,
যেমন ফরহাদ শিরীর প্রেমে হলো দিওয়ানা বেতাব।।
বে-খুদীতে মশগুল আমি ।।
তেমনি মোর খোদার তরে।।
হায়…
খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।।
পুড়ে মরার ভয় না রাখে, পতঙ্গ আগুনে ধায়,
সিন্ধুতে মেটে না তৃষ্ণা চাতক বারি বিন্দু চায়,
চকোর চাহে চাঁদের সুধা, চাঁদ সে আসমানে কোথায়
সুরুয থাকে কোন্‌ সুদূরে সূর্যমুখী তারেই চায়,
তেমনি আমি চাহি খোদায়, চাহিনা হিসাব ক’রে।।
( https://www.youtube.com/watch?v=uOqYt_urYi8 )

*২.
এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবী সাকী
নেশায় হলাম দীওয়ানা যে, রঙ্গিন হল’ আঁখি।।
তৌহিদের সিরাজী নিয়ে
ডাকলে সবায়ঃ “যা রে পিয়ে।’’
নিখিল জগৎ ছুটে এল, রইল না কেউ বাকী।।
বসল তোমার মহফিল দূর মক্কা- মদীনাতে,
আল- কোরানের গাইলে গজল শবে কদর রাতে।
নরনারী বাদশাহ ফকির
তোমার রূপে হয়ে অধীর
যা ছিল নজরানা দিল রাঙ্গা পায়ে রাখি।।
তোমার কাসেদ খবর নিয়ে ছুটলো দিকে দিকে,
তোমার বিজয়- বার্তা গেল দেশে দেশে লিখে।
লা-শরীকের জলসাতে তাই
শরীক হল এসে সবাই
তোমার আজান- গান শুনালো হাজার বেলাল ডাকি।।

( https://www.youtube.com/watch?v=jm871xb6dYE )
---------------------------------------
*৩.
প্রেমেরি পেয়ালা পিও মনুরা শ্বাসপ্রশ্বাসে দমবদম
#ছাকি তোমরা ভরিছে পেয়ালা দিতেছে তোমায় হর কদম।
দ্বীন-দুনিয়া করি দাও সদকা আপন বন্ধুয়ার এষ্কেতে
নাহিক কামনা নাহি তামান্না তৌহিদ ঘাটে নাই ধরম।।
আমি ও তুমি ভুলিয়ে যাও হইয়া ফানা নুরেতে
একাতে বাকী হইয়া থাক দমবদম হবে করম।।
তোমার দুশমন তমাকে জানি হইবে মশগুল কর্মতে
নাহিক বাধা নাহি এরদা মাহমুদা পুরি নাই শরম।।
রহে শাহাপির সদায় দেলগীর মুর্শিদপানে হাল খারাব
কবে বাবা করিবে দয়া মিলাইয়া দিবে সেই ছনম।।

*৪.
অল্প মদে হয়না নেশা, বেশি খাইয়া লই
সাকী, পুরা বোতল দে আমারে,
নেশায় মজে রই!
সাকি পুড়া বোতল দে আমারে
নেশায় মজে রই,
নেশার গোরে থেকে যেন
মুহাম্মদের নামটি লই।
-------মাতাল রাজ্জাক।https://m.youtube.com/watch?v=vmtBoO9W4rQ

*৫. #অনুবাদঃ (৭৬:৬+৭) চক্ষু : ইহা দ্বারা আল্লাহর দাসগণ পান করেন : তাহারা ইহা সঞ্চালিত করেন এক একটি সঞ্চালন। তাহারা দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন পরিপূর্ণতা এবং ভয় করেন সেই সময়টিকে যাহার মন্দ ব্যাপক (বা বিস্তৃত) হইয়া থাকে।
___#আল_কোরান।

#ব্যাখ্যাঃ আপন #মুর্শেদের চেহারা মোবারকের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তাঁহা হইতে আপন চক্ষু দ্বারা প্রেম শরাব পান করিবার রীতি অনেক তরিকার মধ্যে ব্যবস্থা হিসাবে প্রচলিত আছে। অবশ্য নিছক বস্তুবাদী তরিকার মধ্যে ইহা থাকিবে না। তাহারা ইহাকে শেরেক বলিয়াই মনে করে।
আল্লাহর দাসগণ চক্ষু দ্বারা পান করিয়া পূণ্যবান হইয়া থাকেন। তাহারা পান করেন আপন কামেল মুর্শেদের চেহারার অমৃত সুধা। মুর্শেদের চেহারা ধ্যান করা আল্লাহর দাসত্বের প্রধান অঙ্গ। এই আমল দ্বারা যাহারা পূণ্যবান হইয়াছেন তাহারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এক এক করিয়া আগমনকারী প্রত্যেকটি বিষয়ের উপরে। ইহাতে মোহকালিমা হইতে সকল বিষয় পরিশুদ্ধ হইয়া সৌন্দর্যমণ্ডিত হইয়া উঠে। বিষয়ের বিষমুক্ত হইয়া সকলই সুন্দরমধুময় হইয়া যায়।
এইরূপে তাহার দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন জীবনের পরিপূর্ণতা। তাহারা ভয় করেন সেই সময়ের মন্দকে যাহা সংসার জীবনে সাধারণত ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করিতেছে। মানুষ জন্মলগ্ন হইতে সালাত কর্ম শুরু না করা পর্যন্ত সময়কে মন্দ সময় বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে। কারণ, মানুষ এই সময় সালাতের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে এবং বিষয় মোহের শিরিক দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে বিধায় সে পরিপূর্ণভাবে একজন মুশরেক এবং কাফের। সালাত কর্ম আরম্ভ না করা পর্যন্ত সময়ের মন্দ স্বরূপটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি করিতেই থাকে। এই কারণে সাধকগণ এই মন্দ সময়টিকে ভয় পান এইজন্য যে, পরজীবনে জ্ঞানী গুরুর সংস্পর্শে আসিবার সম্ভাবনা নাও থাকিতে পারে। কারণ, অর্জিত বিষয়মোহ এবং কুফুরী ক্রমবর্ধমান হইয়া মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে গ্রাস করিয়া ফেলে।

#টীকাভাষ্যঃ________
#সাকী#শারাব :
শারাব অর্থ ধর্মরাশি। সাকী অর্থ সম্যক গুরুরূপে যিনি পবিত্র শারাব পান করান। ইন্দ্রিয়পথে আগমনকারী ধর্মরাশি, বিষয় তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত মানুষ অহরহ পান করিতেই আছে। সালাতের সাহায্যে মোহমুক্ত হইয়া পান করিতে না পারিলে এইগুলির সকলই অপবিত্র। মোহমুক্ত পান পদ্ধতি শিক্ষাদান করেন সম্যক গুরু।
মানুষ উচ্চমানের জীব। তাহার ধর্মরাশির প্রাচুর্য যেমন অত্যধিক তেমনই উহাদের প্রতি আকর্ষণ এবং তৃষ্ণাও অত্যন্ত প্রবল। ধর্মরাশি তৃষ্ণা তাহাকে সৃষ্টির মধ্যে ধরিয়া রাখে। মুক্তপুরুষের অসীম জ্ঞানবারি হইতে তথা জ্ঞানের প্রসবণ হইতে পান করিয়া এই তৃষ্ণা নিবারণ করিতে হইবে নতুবা জন্ম-মৃত্যুর চক্র হইতে মুক্তির কোন উপায় নাই।

#তথ্যসুত্রঃ
 
★*৫.#কোরান #দর্শনঃ মাওলা সুফি সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী র.।
★*৩.#চিশতী #উদ্যানঃ মাওলানা খাজা শাহপীর চিশতী নিজামী র.।
★*১-২.#নজরুল #রচনাবলী

শরাব ও সাকি

শরাব ও সাকি দুটিই আরবি শব্দ। শরাব শব্দের আভিধানিক অর্থ মদ। ইরানের সিরাজ নগরে উত্তম শরাব তৈরী হতো। তাই এর আরেক নাম সিরাজি। সাকি শব্দের অর্থ মদ্য পরিবেশনকারী তরুণ বা তরুণী।
পার্থিব জীবনে শরাব নিষিদ্ধ- নন্দনকাননে সিদ্ধ। কুরআনের সুরা আদ দাহরে বলা হয়েছেঃ নন্দনকাননে রব স্বয়ং পবিত্র শরাব পান করাবেন। তার মানে - রব শরাব পরিবেশনকারী- সাকি।
তাহলে শরাব কি? শরাব হলো জ্ঞান। শরাব পরিবেশন করার অর্থ হলো জ্ঞান পরিবেশন করা। এই শরাব অধ্যাপকের লেকচার নয়- অধ্যক্ষের নীতিবাক্য নয়- এই শরাব প্রেমাস্পদের অমৃত বচন। যে জ্ঞানের জন্য তৃষিত ছিল প্রেমিক আজ প্রেমাস্পদ স্বয়ং নিজ হাতে সেই জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করবেন। প্রেমিকের কাছে উন্মুক্ত করে দেবেন জগতের সব রহস্য এবং প্রেমিককে আপন সত্তার অন্তর্ভূক্ত করে নেবেন।
প্রকৃতিতে এত কিছু থাকতে জ্ঞানের রূপক শরাব হলো কেন? ‘শিব-শরাব’ কেন পবিত্র? নন্দনকাননে শরাব কেন? স্বর্গে শরাবের ঝর্ণা ‘আল কাওসার‘ কেন? কারণ সম্ভবত এই যে, আঙুর থেকে শরাব হয়; আঙুরগুলো একটি থেকে অন্যটি পৃথক; শরাবে রূপান্তরিত হয়ে আঙুর বিচ্ছিন্নতা হারিয়ে ফেলে এবং একত্বকে ধারণ করে; জীবাত্মাও যখন অহং হারিয়ে ফেলে তখন একত্বের স্বাদ অনুভব করে। তাই জ্ঞানের রূপক শরাব। কারণ একত্বে থাকাই জ্ঞান- বহুত্বে থাকা অজ্ঞান।
ঈশ্বর কেন সাকি? এত ভালো ভালো শব্দ থাকতে মদ্য পরিবেশনকারী তরুণী কেন তাঁর রূপক? কারণ জ্ঞান যে পরিবেশন করে তার সঙ্গে গ্রহণকারীর থাকে প্রেমের সম্পর্ক। তরুণীর প্রেমে মত্ত তরুণ বহু দুর্গম পথ পাড়ি দেয়। সে রাতের অন্ধকারে পিচ্ছিল দেয়াল বেয়ে জানালা পর্যন্ত যায়। পড়ে গিয়ে সামান্য ব্যাথাও পায় বটে! কিন্তু কিছুই হয় না তার, রক্ত ঝরে, টের পায় না। আর মাতাল? মাতাল ছাদ থেকে লাফ দেয়, কিচ্ছু হয় না তার। কেনই বা হবে? মরে তো দেহ। আর দেহ সম্বন্ধেই সে অচেতন হয়ে গেছে। তাই মৃত্যু তার কাছে আসে না।
মানুষ মারা যায় কেন? দেহ মন আত্মা নিয়ে মানুষ। যতক্ষণ পর্যন্ত এই তিনটি এক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে- মৃত্যু অসম্ভব। দেহ থেকে মন; মন থেকে আত্মা যখন পৃথক হয়ে যায় তখনই মানুষের মৃত্যু হয়।
প্রেমাস্পদের শরাব পানকারী মাতালের দেহ মন আত্মা আবদ্ধ থাকে প্রেমের বন্ধনে তাই প্রেমিকের মৃত্যু নেই।
কীভাবে প্রেমের শরাব পান করবে তুমি, যদি অহং মুক্ত না হতে পার? কীভাবে অহংমুক্ত হবে তুমি, যদি প্রেমিক না হতে পার?
প্রেমেই কেবল দেহ মন আত্মার মিলন ঘটে, আর কোনোকিছুতে নয়।
সুফি ছাড়া আর কেউ ঈশ্বরকে ‘সাকি’ সম্বোধন করে না। ‘সুফি’ শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতরা গবেষণা করুক। শব্দটির পারিভাষিক তাৎপর্য হলো প্রেমিক। সাকি প্রেমাস্পদ। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মিলনে যা ঘটে তা হলো শরাব।
শরাব ও সাকির কথা কি খৈয়াম ছাড়া শেষ করা যায়? খৈয়াম বলেনঃ- 

“শুক্রবার আজ, বলে সবাই পবিত্র জুম্মাা যার,
হাত যেন ভাই খালি না যায়, শরাব চলুক আজ দেদার।
এক পেয়ালা শরাব যদি পান করো ভাই অন্যদিন,
দু পেয়ালা পান করো আজ, বারের বাদশা জুম্মাবার।”
- মহাত্মা ড. এমদাদুল হক