পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

ভাবনার বিষয়-পর্ব চার


(পূর্ব প্রকাশের পর)

মাহিন আমার প্রশ্ন শুনে অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। বললোঃ

- তোর কি দিনকে দিন  বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পাচ্ছে?

-কেন বলতো?

-এই যে তুই বললি নামাজ এবং কোরআনিক সালাতের কথা? সেই জন্য জিগ্যেস করলাম


-আরে আমার বুদ্ধি ঠিকই আছে। আমার জানার আগ্রহ থেকেই তোকে প্রশ্নটা করেছি। এখন তোকে যা বলছি সেটার জবাব দে?

-শোন্ আল কোরআনে নামাজের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। আছে সালাত। নামাজ - এই শব্দটি মুলত ফার্সি ভাষা হতে বাংলা ভাষায় কালের বিবর্তনের ধারায় এসেছে। 'নমঃ' ধাতু হতে এর উৎপত্তি আর এর থেকে বাংলায় দুটো শব্দ আমরা পাই। একটা নমস্কার (অর্থাৎ সালাম), অন্যটা এই নামাজ। নামাজ কথাটাও মুলতঃ সালাম অর্থে ব্যবহার করা যায়। কেননা মুলধাতু 'নমঃ' থেকে আসায় নমস্কার এবং নামাজ একই ভাব বহন করবে। অর্থাৎ নামাজ হলো কর্ম (Not Karma Lessness), অন্য আর দশটা কর্মের মতো

-শব্দগত অর্থ মিল থাকলেই যে সালাত এবং নামাজ একইভাব বহন করবে - সেটা তোকে কে বললো?

-দ্যাখ। মহাগুরু প্রভু মুহাম্মদ হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় সালাত কায়েম করেছিলেন এবং তার তাগিদও দিয়েছেন। তাই বলা হয় হেরা গুহায় মারেফাত আর কা'বায় শরীয়ত

-সেই শরীয়তও তোকে মানতে হবে। কারণ শরীয়ত বিনা মারেফত হাসিল করা যায় না। বড়ো বড়ো অলী-আউলিয়াগণ তাই করিয়ে দেখিয়েছেন

-আচ্ছা সালাত নিয়ে আরেকদিন বসা যাবে। এখন আমাদের পুর্বের কথায় ফিরে যাই। তোকেতো বলেছিলাম ০১২৩ অর্থাৎ আলিফ লাম মিম। এবার শোন বাকী অংশের ব্যাখ্যা। মানবদেহ পৃথক খন্ডিত অংশ তথা সত্ত্বা নিয়ে গঠিত। সেগুলো হলোঃ
. বস্ত্তু সংগঠন বা দেহ (Material Formation)
. অনুভুতি (Feelings)
.সজ্ঞা বা ধারণা (Perception / Knowledge)
.সংস্কার বা স্মৃতি (Mental Formation)
. স্মৃতিপ্রবাহ ( Mind)

এই হলো এর ব্যাখ্যা। কোন বস্তুু অথবা বিষয় (মনময়-দেহময়আমাদের অনুভুতিতে আসতে নিম্নোক্ত মাধ্যম ব্যবহার করে। যথাঃ-
. স্পর্শ . দেখা . শোনা . স্বাদ . গন্ধ . চিন্তা . কথা। অর্থাৎ সপ্ত ইন্দ্রিয়
তাহলে তুই পেলি ০১২৩৫৭

-হুম। 

- আবার দ্যাখ। উপরোক্ত বিষয়গুলোর দ্বারা আমরা তিনভাবে প্রভাবিত হই। যেমনঃ আমাদের (বস্তু-বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভুত হয়। বিকর্ষণ অথবা নিরপেক্ষ বা উপেক্ষা অনুভুতিও কাজ করতে পারে

সজ্ঞাকে, বিষয়জ্ঞান এবং বিষয়জ্ঞান (Knowledge) সংস্কার বা স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে। স্মৃতি প্রবাহকেই মন (Mind) বলা হচ্ছে। মানুষ নামের এই সত্তায় এই পাঁচটি অংশ ছাড়া আর কিছুই নেই। মৃত্যূতে ১ম, ২য়, ৩য় অংশ লোপ পায়। অর্থাৎ বস্ত্তু সংগঠন (হাড়, মাংস,অন্ত্র, উদরিয়, রক্ত, মল, মুত্র, কফ, থুথু, লোম্য, ফুসফুস, যকৃৎ প্রভৃতি), অনুভুতি, সজ্ঞা থাকে না। ৪র্থ এবং ৫ম অংশ পরবর্তী দেহবীজ হিসেবে থেকে যায়। যেহেতু ৫ম অংশ হচ্ছে ৪র্থ অংশের বিকাশ সেহেতু ৪র্থই জন্মবীজ বা দেহবীজ। এই ৫টি অংশের মধ্যে মধ্যে 'আমি' কোনটি? কোনোটিই 'আমি' নই। এর বাইরে কোথাও 'আমি'কে খুজে পাওয়া যাবে না। পাচ অংশের মধ্যে কোনটিই স্থায়ী নয়। সর্বক্ষণ পরিবর্তন হচ্ছে। একটা অনিত্য অবস্থা
এই পরিবর্তনশীল প্রধান পাঁচ অংশের মধ্যে 'অামি' নামক কোন কিছুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই 'আমি' বা 'আমিত্ব' সম্পূর্ণ অজ্ঞানতা মিথ্যা

-ইন্টারেটিং। এটি দেখছি নৈরাত্মাবাদ। যা বৌদ্ধগণও স্বীকার করে না

-নৈরাত্মা মানে নেই আত্মা। আত্মা মানে দেহের অতিরিক্ত কিছু আর দেহটি ৩২টি পদার্থে পরিপুর্ণ। মানে মানবদেহ। এটিই বোধ করি তোর মনা পাগলার শেষ ডিজিট

-তাতো বুঝলাম। কিন্ত্তু তুই নৈরাত্মার ব্যাখ্যা দিলি নেই আত্মা। আত্মা মানে দেহের বাইরে অতিরিক্ত কিছু নেই। তাহলে এইটা কি? আমি আমাকে দেখিয়ে বললাম

-এইটা দেহ। ৩২টি পদার্থে পরিপুর্ণ। মৃত্যূর পর তার কোন অস্তিত্ব থাকে না। 

-তোর কথা আমি মানতে পারলাম না। আমরা দেখেছি ইন্টারনেটে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবা হযরত হুজায়ফা (রাঃ) এর মরদেহ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। একটুও বিকৃত হয়নি। সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? তাছাড়া পত্র পত্রিকায়ও মাঝে মাঝে খবর পাওয়া যায় দীর্ঘ এত বছর পরও অক্ষত লাশ উদ্ধার।

-তুই যে রাজিআল্লাহুতায়ালা আনহু বললি তার মানে কি জানিস? তার মানে হলো যার উপর পরমপ্রভু রাজি আছেন। সুতরাং তার দেহ মোবারক ধ্বংস করার প্রশ্নইতো আসে না। আর যার উপর প্রভু রাজি নন তারটার কোন অস্তিত্বই তুই খুঁজে পাবি না। প্রভুকে সন্ত্তুষ্ট করার জন্যই তারা জীবদ্দশায় মৃতের ন্যায় ছিলেন। যাকে বলা হয় "মুতু কাবলা আনতা মুতু" অর্থাৎ চুড়ান্ত দেহবিচ্যুতির পূর্বে দেহ ত্যাগ করা। তাই বাহ্যিক জীবনে তারা এই দেহের কোন মুল্যই দেননাই। শুধু দিয়েছেন দেহের মধ্যে যিনি বিরাজমান সেই সাহেব সেই আত্মাকে। 

-১২ এবং ১৯ সমন্ধে কিছু বললি না?

-আরে বোকা ১২ হচ্ছে কলেমার প্রথম অংশ। লাইলাহা ইল্লাল্লাহু লিখতে ১২টি হরফ লাগে। এই কলেমার প্রথম অংশই হচ্ছে ইসবাত। প্রথম লা মানে মহাশুন্য (The No) মনের মধ্যে যখন মহাশুন্যের ভাব ওঠে তখন সেই ভাবকে বলা হয় লা অর্থাৎ নাই নফী। ইলাহা। উপাস্য। যার উপাসনা করা হয়। এর মধ্যে দুটি ভাগ আছে। একটি নারী ইলাহ অপরটি পুরুষ ইলাহ। নারী ইলাহকে নিতে সবাই পছন্দ করে। কিন্ত্তু পুরুষ ইলাহকে নিতে কেহ রাজী খুশী নহেন। নারী ইলাহ হচ্ছে - বস্তু মোহের প্রতি তীব্র আকর্ষণবোধ। এর বিপরীত হচ্ছে পুরুষ ইলাহ। অার ১৯ হচ্ছে বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম। যার দ্বারা সৃষ্টির সুচনা হয়। আর ৩৩ মানে ৩৩ কটি অর্থাৎ মেরুদন্ডের অংশবিশেষ যা সাধনার ক্ষেত্রে অন্যন্য ভুমিকা পালন করে। হিন্দু ধর্মে যে ৩৩ কটি দেবতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাহলঃ ৮ বসু ,১২ টি আদিত্য,১১ রুদ্র ইন্দ্র ও প্রজাপতি। এই ৩৩ দেবতার প্রভু হচ্ছেন মহেশ্বর অথবা ঈশ্বর যাকে শতপথ ব্রাক্ষনের ১৪ কান্ড অনুযায়ী উপাসনা করতে হবে অন্য কাউকে নয়।


-দাঁড়া দাঁড়া...দোস্ত একটু চিন্তা করতে দে। তার মানে মনা পাগলা ০১২৩৫৭১২১৯৩২ দ্বারা বুঝাতে চেয়েছে একজন ইনসানে কামিলের কথা। মানে পুর্ণ মানব। ইবনুল আরাবীর লগস বা প্রজ্ঞার কথা বলতে যেতে এই ইনসানুল কামিলের কথা বলেছিলেন

-আমার মনে হয় কি জানিস? তুই যে শাহ সাহেবের ওখানে যেতে চেয়েছিলি সেটা বুঝতে পেরেই তোকে এই নাম্বারটার কথা বলেছে

আমরা যখন কথা বলছিলাম তখন দুর হতে দেখছিলাম আড়চোখে সেই লোকটি কি করেসে আমাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনছে। আমাদের কথা শেষ হতেই সে লাফ দিয়ে নেমে এসে দোতারা বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করে দিলঃ

পড় পড় ইলম তে ফাজিল হোয়ে 
তে কাদে আপনে আপনু পড়েই নে
বাজ বাজ ওয়ার না এই মান্দির মাসজিদি
তে কাদে মান আপনে উচ ওয়ারনে না।
লারনা এই রোজ শাইতান দি নাল
তে কাদি নাফস আপনে নাল লাড়ইয়ে না
বুল্লে শাহ আসমানি উড় দিয়া পারোনদা ইয়ে
তে যারা গার বিঠা আপন পারইয়া না
বাস কারো ইয়ার
ইলমু উন বাস কারো ইয়ার
এক আলিফ তারে দারকার
বাস কারো ইয়ার
ইলমু বাস কারো ইয়ার
আল্লাহ শাইয়ান আল্লাহ শাইয়ান।
নে মান জান জোগি দি নাল
যো না জানে হাক্ক কি তাকাত
রাব্ব না দেবে উচকো হিম্মত
হামমান কি দারইয়া মে ডুবে
কেইছে নাইয়ে? ক্যা মানদার
বাস কারো ইয়ার
ইলমু বাস কারো ইয়ার
আল্লাহ শাইয়ান আল্লাহ শাইয়ান

হটাৎ এই ঘটনায় আমরা হতচকিত হয়ে পড়লাম। কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। দু'জনেই এই ঘটনায় প্রায় হতভম্ভ হয়ে তার গান শুনছিলাম। গান শেষ হতেই আমরা তার নাম জানতে চাইলাম উত্তরে জানালো তার নাম ভবা পাগলা

(সমাপ্ত)

কৈফিয়তঃ মনা পাগলা, ভবা পাগলা এবং শাহ সাহেব কল্পনা প্রসুত চারিত্রিক সৃষ্টি। বাস্তবতার সাথে এর কোন মিল নেই। কাকতালীয়ভাবে মিলে গেলেইও কিছুই করার নেই। মাহিন এবং শ্বেতা সবই কাল্পনিক চরিত্র।  

গ্রন্থ সুত্রঃ সুফী সদরউদ্দিন আহমদ চিশতী - কোরআন দর্শন এবং লোকোত্তর দর্শন-রাশেদ চৌধুরী