পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

যা'ব কোথায়?

মনের ভেতর কেমন যেন খস খস করছে কিছু প্রশ্ন।এটা অবশ্য ছিল না। এই কিছুক্ষণ পুর্বেই এটা শুরু হয়েছে। বাসে করে বরিশাল যাওয়ার পথে ফেরীঘাটে আসতেই এটা শুরু হয়েছে। ধীর গতিতে বাস চলছে। দীর্ঘ লাইন। সবাই জানালার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে-লাইনের কি অবস্থা ?
শীতের পড়ন্ত বিকেল। চারদিকে কুয়াশার পাতলা আবরণ দিয়ে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করছে প্রকৃতি। শীতের তেমন কোন প্রকোপ ছিল না। কিন্ত্তু তারই মাঝে কেমন যেন একটা ফ্যাশন শো আয়োজন চলছে। উচ্চ বিত্তের কথা আলাদা। তারা বরাবরই আলাদা। মধ্যবিত্তরা তাদের থেকে কেমন যেন একটা পার্থক্য সৃষ্টি করে চলে। আর নিম্নবিত্তরাতো মধ্যবিত্তের বন্ধুর মতো। তারা কেবল তাদের সাথেই মিতালী করতে পছন্দ করে। দান-খয়রাতে তো কথাই নেই। হকাররা চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বাদাম বিক্রি করছে। কেউ বা ডিম বিক্রি করছে। বাসটি আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোয়। আর হকাররা তার সাথে পাল্লা দিয়ে চিল্লাছে। এরই মাঝে হাতে কাগজের স্লিপ আর মাথায় টুপি নিয়ে মধ্য বয়স্ক হুজুর টাইপের এক লোক বাসে উঠেই বলা শুরু করছে। বাসটি মাঝে মাঝে টানছে। টুপি পড়া লোকটি বলা শুরু করছে- ভাইয়েরা আমার। আসসালামুআলাইকুম। ...এতিমখানায় আপনাদের দান....
লোকটির কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আবার না শুনে উপায়ই নেই। জোর করে হলেও শুনতে হচ্ছে। ভাল হতো যদি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে পারতাম। যাত্রা পথে ইয়ংদের জন্য ঝাক্কানাক্কা গান খুব পছন্দ।তারা স্বভাবত:ই চঞ্চল।মনে তাদের বিরাজ করে রাজ্যের স্বপ্ন।আর আমাদের পছন্দ রবীন্দ্র সংগীত। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি....টাইপের গানই বেশি চয়েজএবল।
ভাইয়েরা আল্লাহর ঘর মসজিদে আপনারা কিছু দান করে যান। আপনাদের দান কিয়ামত পর্যন্ত ছোয়াব দিতে থাকবে....
লোকটির কথা শুনে ঘুরে তাকাই। শোনার চেষ্টা করছি। আর মনে মনে ভাবছি আল্লাহর ঘর মসজিদ কিভাবে হয়? যতদুর জানি মসজিদ শব্দটি সুজুদ বা সেজদাহ হতে এসেছে। যেখানে মুসল্লিরা ইবাদত-বন্দেগী করে থাকে। সেইটাকেই তো মসজিদ বলে জানি। অার আল্লাহর ঘর মানে তো বায়তুল্লাহ। তাহলে লোকটি কি ভুল বলছে না অামি ভুল করছি?
এরই মাঝে বাসটি আবার টানা শুরু করছে। লোকটি তাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে আবার সামলিয়ে নেন। হাতের কাছেই পাশের সিটটি ধরে বসেন। সিটের পাশে বসা ভদ্রলোকটি তাকে সাহায্য করলো। লোকটি আবার বলা শুরু করছে। ভাইয়েরা আমার। আমরাতো এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাব। বাড়ী-গাড়ী টাকা কড়ি কিছুই সংগে নিব না। সব কিছুই পড়ে থাকবে। কাল কিয়ামতের দিনে যখন আল্লাহ পাক বিচারে বসবেন তখন কেউ আর রেহাই পাবেন না।......
লোকটির কথা শুনে একজন ভদ্র মহিলা দশটি টাকা বের করে দিলেন। দান খয়রাতে মহিলারাই এগিয়ে থাকে সব সময়। দেখা গেল ঐ মহিলা টাকা দেয়ার সাথে সাথেই আশে পাশে থেকে কেউ কেউ টাকা দিতে শুরু করেছে। টাকা দেয়ার যেন একটা ছোট খাট প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল। আর এর সাথেই লোকটির ভলিউম আরো বেড়ে গেল। ....ও ভায়েরা ...মায়েরা আমাদের মা-বাবা ভাই বোন অনেকেরই দাদা-দাদী নানা নানী অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে...
লোকটির কথা এখন কেন যেন মন কাড়ছে। তাকে আরো গভীর ভাবে শুনতে চেষ্টা করলাম। কিন্ত্তু টাকা পেয়েই লোকটি ব্যস্ত হয়ে গেল কালেকশনে। আর কালেকশনের সাথে সাথেই কেমন যেন তার ভলিউম কমে যেতে লাগলো। হেলপার বললো - অাপনারা নেমে আসুন। যার যার দরকার তারা নামুন। বেশি দুরে যাবেন না। বাসটি ভীড়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ফেরীতে উঠতে সময় লাগবে। অনেকেই বাস থেকে নামতে ব্যস্ত। সাথে লোকটি। হাসি খুসি একটা ভাব নিয়ে লোকটি নেমে গেল। আর লোকটি নেমে যেতেই খেয়াল করলাম কিছু প্রশ্ন মাথার ভেতর গেঁথে গেছে। যতই চেষ্টা করছি তাড়াতে ততই দেখছি তার মাত্রা আরো বেড়ে গেল।
এই যে দুদিনে দুনিয়া আমরা সবাই হাসি খুশি মনে বাড়ি যাচ্ছি। লাইন ধরে  বাসের টিকেট কেটেছি। সিট নাম্বার খুঁজে বের করে নিজেই নিজের আসনেই বসে আছি। বাসটি আমাদের গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে লোকটি যে বললো আমরা সবাই নিজের অজান্তেই পরকালের টিকেট কেটে বসে আছি। সময় হলেই আমাদের যেতে হবে। এর কোন ব্যত্যয় নেই। সেটাই যদি সত্যি হবে তাহলেতো বাড়ী-গাড়ি করে কি লাভ? ব্যাংক ব্যালেন্স করে কি লাভ? কোন কিছুতেই তো লাভ দেখছি না। অামিই যখন থাকবো না তখন এসব করে লাভ কি? কেন আমরা এসব করছি?
জানালা দিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম। দেখি দেখা যায় কি না? পেলাম না। বাস থেকে নামতেই দেখলাম লোকটি একটি চায়ের দোকানে ঢুকে পান খাচ্ছে। আর পানের বিল দেয়ার জন্য পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করছে।
লোকটির কাছে গিয়ে জিগ্যাস করলাম - ভাই কেমন আছেন?
লোকটি কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো-ভালো আছি। আপনে কেডা?
লোকটির কথা শুনে আমারই ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো অবস্থা। বললাম অামি এই বাসের যাত্রী। বাসে বসে আপনার কথা গুলো শুনে মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন ঘুর ঘুর করছে। তাই ভাবলাম আপনার সাথে আলাপ করি।
অত আলাপের শুময় নাই। কি কইবেন, তারা তাড়ি কন। আপনের গাড়ী ছাইড়্যা দিব।
যে লোকটি বাসে যাত্রীদেরকে মধুর বাণী শুনিয়ে হাশর নাশর কেয়ামত বিচার আচার দেখালো। কেয়ামতের ভয় ভীতি দেখিয়ে মসজিদের টাকা পয়সা নিল সেই মসজিদটি কোথায়? আর ছোয়াবের দোহাই দিয়ে শেষ বিচারে পার করার প্রতিশ্রুতি দিল, সেই লোকটির একি কথার শ্রী ?
না.. না আমি বেশি সময় নিব না। আচ্ছা আপনি যে বললেন আল্লাহর ঘর মসজিদ সেটা পেলেন কোথায়? আর আপনাদের মসজিদটি কোথায় আর এতিমখানাটিই বা কোথায়?
হেইডা দিয়া আপনের কাম কি?
তারপর কি মনে করে যেন বলা শুরু করলো - ঐযে দেখতাছেন ...ঐযে পাশে বেড়া দেওয়া...
তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম বেড়া দেয়া একটি ঘর। বোঝা যাচ্ছে না সেটা মসজিদ কি-না? এরই মাঝে বাসের হর্ণ দেয়ার আ্ওয়াজ শুনলাম। বাসটি আস্তে আস্তে চলা আরম্ভ করছে। আশ্চর্য্য হলেও সত্য যে রাস্তার ধারে যে সমস্ত মসজিদ নির্মাণাধীন থাকে সেটা বছরের পর বছর ঐ অবস্থায়ই থাকে। লেখা থাকে নিমার্ণাধীন মসজিদের দান বক্স। মুক্ত হস্তে দান করুন।
আপনার দানকৃত অর্থ আদৌ মসজিদে ব্যয় হচ্ছে কি-না সেটা দেখার লোক কোথায়? যাকে রাখা হবে দেখভালের জন্য সে কি আদৌ তা করবে কি-না? লোকটিকে জিগ্যেস করলাম - দিনে কতো পান?
ভ্যাবাচেকা খেয়ে লোকটি বললো-দুইশো ট্যাকা।
কিছু না বলে বাসে উঠে বসলাম। বাস চলতে আরম্ভ করছে। আমি জানালা দিয়ে লোকটিকে দেখতে চেষ্টা করলাম। কেমন যেন অসহায় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।