পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

মোবাইলফোন ও আমরা













-হ্যালো দোস্ত, তুই কই?
-আরে আমিতো এখন মগবাজার।তুই কই?
-ধুর ব্যাডা।তরে কইলাম আমি আমার এহানে আয় আর তুই...
বাসে বসেছিলাম।পাশের সিটে বসা ইয়ং জেনারেশনের প্রতিনিধিত্বকারী একটি স্মার্ট (?) ছেলে। হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে তার বন্ধুর সাথে কথা বলছে। কথার ধরণ শুনেই বুঝা যাচ্ছে তার খুবই কাছের বন্ধু।অর্থাৎ বোসোম ফ্রেন্ড।বাস্তব জীবনে যে বিষয়টি এখন ওতোপ্রেতভাবে জড়িত, সেটি হচ্ছে মোবাইল ফোন। সুখে-দুঃখে সমানভাবে জড়িত এ বিশেষ জিনিসটি আমাদের জীবনে এখন অংগাংগীভাবে জড়িয়ে আছে। কখনো সুখের কখনো বা দুঃখের। সব সময়ের এ বস্ত্তুটি আমাদের শেখায় - সত্য মিথ্যার অনেক গল্প। কথার খৈ কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তা বলা নিতান্তই বাতুলতা। যেমন ধরুণ প্রেমিক প্রেমিকার কথা। কিংবা কোন প্রবাসীর স্ত্রীর কথা । অথবা মায়ের সাথে তার সন্তানের কথা। কথা যেমনই হোক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এ যন্ত্রটির তুলনা অপরিসীম।
-হ্যালো, কে বলছেন ভাই? হ্যালো...হ্যালো...
লোকটির হ্যালো হ্যালো শুনতে শুনতে বিরক্ত ধরে গেল। কি করবো? কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। একদিকে বাসের ইন্ঞ্জিনের শব্দ, তার উপর আবার মোবাইলের উৎপাত। সকালে এম্মনিতেই অনেক কষ্ট করে বাসে উঠতে পেরেছি। অফিসের সময় বাসে ওঠা কি যে কষ্টকর আর তার উপর যদি থাকে ভীড়, তাহলে মোবাইলের রিংটোনের আ্ওয়াজও হয়ে যায় বিষবৎ সমতুল্য। এমন একটি ব্যাপার নাও বলা যায় না। কারণ আমারো মোবাইল আছে। তাকে যদি না করি আর আমারটা যদি এসে যায় তাহলেতো মুস্কিল।বিরক্তি চেপে কথা না শুনতে চাইলেও কিছু কথা নিজের অজান্তেই শুনতে হচ্ছে। সিটের পাশে হাত দিয়ে বালিশ বানিয়ে মাথাটা নেয়ালাম। চোখ বুজে থাকার চেষ্টা করলাম যাতে একটু ঘুমাতে পারি। কারণ কাজের চাপে আর সকালে অফিসে যাবার চিন্তায় এম্মনিতেই ঘুম চলে যায়। জীবন যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই অর্ধেকটা জীবন চলে যায় ভেজাল দ্রব্যাদি আহার করে।  তার উপর খাবারে অনিয়ম। শ্বেতা কতে করে বলেছে-তুমি দুপুরের খাবারটা নিয়ে যেও।
শ্বেতাকে কি করে বুঝাই সকালের অফিস যাত্রাকালে একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বাসে ওঠা কতো যন্ত্রণা। তার উপর থাকে নানান ফাইলপত্র। এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম জানি না। ঘুম ভাংলো কন্টাকটরের ডাকে।
স্যার ভাড়া দেন। পকেট হাতড়িয়ে ভাড়া দিলাম। ভাড়া দেয়ার পরই আবার যথারীতি অলস বদনে শুয়ে পড়লাম। মাথায় কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছে। চোখ বুজে থাকলাম। আর এরই মধ্যে স্বপ্নে বিভোর হলাম। দেখলাম একটি বটগাছের বেদীর উপর একটা স্টেজ করা। সেই স্টেজে গান গাইছে...
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি
কোন্ মিস্ত্রি বানাইয়াছে....
-কি মিয়া কি ভাবতাছো?
-না। দেখছি।
-কি দেখতাছো?
পাগল কিছিমের একটা লোক আমার কাছে এসে জিগ্যেস করলো। আজকাল কি হয়েছে কে জানে। যত পাগল ছাগলের সাথে দেখা হয়। পাগলা পাগলা কথা বলে। মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝি না।
-মোবাইল দেকছো?  মোবাইল? লোকটি নিজের দেহটি দেখিয়ে বললো।
-এইডা হইলো আমার মোবাইল আর এইডা হইলো তোমার মোবাইল। লোকটি আমার দেহে হাত দিয়ে বললো।
-এই মোবাইলে কল দিলেই সাঁইজির সাথে কথা বলা যায়। শোনা যায় সাঁইজির বাণী।মাজে মাজে মেসেজ পাডায়। বুছছো মিয়া...সাঁইজির নাম্বার জানো? লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললো। অামি সম্মোহিত হয়ে বললাম
-না। না কথাটি বলার সাথে সাথে আমাকে পেয়ে বসলো কিছু অনাকাংখিত ঘটনা। আমি যেন দেখতে পেলাম আমি নিজেই একটি মোবাইল। লোকটি বললো
-কি ভাবতাছো মিয়া? ভালা কইরা তাকাও তোমার দেহডার দিকে। অথচ আর্শ্চায্য হলেও সত্য এ যন্ত্রটির সাথে আপন দেহের যোগাযোগের একটি অবিচ্ছেদ্য সর্ম্পক এবং মিল রয়েছে। লোকটি আবার বলতে শুরু করেছে
-তুমি যদি এডারে ভাংগ তাইলে কি দেকবা? একখান বেটারী,একখান ছিম,কেছিং....

লোকটি বলতে শুরু করেছে আর আমি তার সাথে মিলাতে শুরু করেছি একটি ব্যাটারী, একটি সীম, একটি কেসিং, মনিটর বা ডিসপ্লেবোর্ড, কি প্যাড, ক্যামেরা, রেডিও এফ এম এবং এমপি থ্রি বা ফোর। এছাড়া আছে মাদারবোর্ড আর আছে কিছু কারিগরী নৈপুণ্যেভরপুর ইলেকট্রনিক্স আইটেম।
-এই যে ব্যাটারি দেকতাছো এইডা হইলো তোমার জীবন শক্তি। আর কেছিং হইল তোমার দেহখানা। বাহ! বাহ! কি আজব খেলা তার। কতো রং বেরংয়ের কেছিংরে...ওই মিয়া এই যে চোখ দুইডা দেখতাছো এইডা অইলো গিয়া তুমার ক্যামেরা। আর এইডা অইলো গিয়া তুমার বোর্ড (মাদারবোর্ড দেখিয়ে )এইযে কতো বাহারি রংচঙ দিয়া আঁকিবুকি মারা।
এইডাই অইলো আসল। বোজপার পারছোনি মিয়া...
তোমারে বুঝাইবার তরে এই সকল পয়দা করে।
সকল রুপই তুচ্ছ জান তার রুপেরই ছামনা।
লোকটি গুণগুনিয়ে গান শুরু করে দিল। আমি অবাক হয়ে শুনছি লোকটির গানের কথা। কেমন যেন একটা মায়াবী কন্ঠ অামাকে টানছে।গান গাওয়া শেষ হতেই লোকটি বলে উঠলো
-তোমারে মিয়া গান শুনাইলাম। মোবাইলে গান বাজে না হেই গান। আহা রে কে বোঝে তার খেলা। লোকটি আবার বলা শুরু করলো
-এই মোবাইলে ঠিকমতো নাম্বার দিয়া ডায়াল করলেই তাঁর সাথে যোগাযোগ করা যায়। তাঁর কথা শোনা যায়।আর নাম্বার না জাইন্যা আনতাজে রিং ঘুরাইলে কি আর যোগ অইবো? তার নাম্বার জানো মিয়া...
-না। আমি কিভাবে জানবো?
একথা শুনতেই লোকটি অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। আরে মিয়া তার নম্বর জানো না তো আমার কাছে আইছো ক্যা? লোকটি আবার অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো।তার হাসির শব্দে হটাৎ আমার ঘুম ভেংগে গেল। চেয়ে দেখি আমার পাশে বসা সেই স্মার্ট ছেলেটি তার লাভারের সাথে কথা বলছে। আর মাঝে মাঝে হাসছে। সেই হাসির শব্দই আমার কানে আসছিল।তাহলে সেই লোকটি কোথায় গেল? যে আমাকে মোবাইলের দর্শন বুঝাচ্ছিল?
পকেট থেকে মোবাইলটি হাতড়িযে বের করলাম। ভালো ভাবে দেখতে লাগলাম। আর মেলাতে শুরু করলাম স্বপ্নে পাওয়া সেই দর্শনটি যেটি কিছুক্ষণ আগেই দেখেছিলাম। মুখে এক টুকরো হাসি এসে গেল। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।
বাসটি চলছে ধীর লয়ে। মুক্ত আকাশে কিছু পাখি উড়াউড়ি করছিল। মনে মনে জিগ্যাসা করলাম - হে বিধাতা তোমার নাম্বার কতো?