পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

ভাবনার বিষয়-পর্ব তিন


 (পূর্ব প্রকাশের পর)

মাহিনের নিঃস্তব্ধতা নীরবতা দেখার মতো। কেমন যেন অবিচল অটল হয়ে বসে আছে। কি ভাবছে কে জানে? আমি শুধু জানি আমার ভাবনাগুলো কেমন যেন জড়তায় আষ্টে পিষ্টে বাঁধা পড়ে আছে। কিছুতেই সেই জট ছাড়াতে পারছি না। আর তার জন্যই আমি ব্যাকুল হয়ে আছি শাহ্ সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্ত্তু বিধাতার লীলা বোঝা বড়ো কঠিন। যতবারই যেতে চেয়েছি তত বারই একটা বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি

নীরবতা ভংগ করে মাহিন হটাৎ বলে উঠলোঃ

-চল বেড়িয়ে পরি

- কোথায় যেতে চাচ্ছিস এই পড়ন্ত বিকেলে?

-কোন পার্কে

-কেন? আমি জানতে চাইলাম। বললো

-কারণ আছে। আর তোর উত্তরটা সেখানে বসেই প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকেই দিতে চাই

আমি আর কথা বাড়ালাম না। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম একটা উদ্যানের উদ্দেশ্যে। আমার বাসা থেকে রমনা পার্ক কাছে। কাজেই আর কোন দিকে না যেয়ে সরাসরি রমনা পার্কে গিয়ে হাজির হলাম। পার্কে গিয়ে দেখলাম কোন বেন্ঞ্চই খালি নেই। কপোত-কপোতীরা জোড়া বেঁধে বসে আছে। আরো দুরে দেখলাম ডায়বেটিস রোগীরা শরীরকে সুস্থ্য সবল রাখার জন্য হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনতিদূরে দেখলাম একজন পাগল গোছের একটা লোক বেন্ঞ্চের উপর বসে কি যেন করছে। আর তার সামনের দিকে একটা বেন্ঞ্চ খালি পড়ে আছে। হয়তো পাগলের কাছে কেউ থাকতে চায়নি বলে সেটার ধারে কাছে কেউ নেই। আমরা সেটাতে বসে পড়লাম। আমরা সেখানে বসতেই সেই পাগল লোকটা আমাদের দিকে কেমন করে যেন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আমরা কোনরুপ ভ্রুক্ষেপ না করেই আমাদের কথা চালিয়ে যাবার জন্য জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমাদের কথা বলার জন্য এই স্থানটাই উপযুক্ত। আমি মাহিনকে উদ্দেশ্য করে বললামঃ

-নে শুরু কর। কি পেলি?

-শোন তুই বলেছিলি মনা পাগলা বলেছিল শুন্য অর্থ অস্তি। অর্থাৎ নাই অস্তিত্ব যার। কিন্ত্তু তুই দেখ। শুন্য আঁকতে হলে তাকে একটা আকার দিতে হয়। অর্থাৎ কেন্দ্র থাকা বান্ঞ্চনীয়। নয়তো শুন্য আঁকা যায় না। যাকে আমরা বিন্দু বলতে পারি। একটা বিন্দু কেন্দ্রে অবস্থান করে। সেই বিন্দুটা বৃহত্তর হতে হতে আমাদের দৃষ্টি সীমা ছাড়িয়ে যায়। আবার সেটা ছোট হতে হতে আমাদের দৃষ্টিতে ধরা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। কাজেই শুন্যস্থান বলতে কিছুই নেই। 

-তার মানে শুন্য হচ্ছে একটা স্থান। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায়ঃ যার আকার আছে স্থান দখল করে যার ওজন আছে সেটাকে আমরা পদার্থ বলতে পারি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শুন্যস্থান বলতে বুঝি সেটা আসলে শুন্য নয়। তার মানে সেস্থানে কোন কিছু জায়গা দখল করে আছে। অর্থাৎ শুন্যস্থানে বায়বীয় পদার্থ দ্বারা পূর্ণ থাকে। তাইতো?

-হ্যাঁ তাই। কিন্ত্তু সাধনার ক্ষেত্রে এই শুন্যস্থানতে লা মোকাম বলা হয়। মোকাম অর্থ ঘর। অর্থ শুন্য ঘর। এই শুন্য ঘরে অর্থাৎ যারা কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে আছে তারা এই বৃত্তের মাঝে বন্ধী। কোরআনের দৃষ্টিতে যদি আমরা নবী শব্দটি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাইঃ নু, বে। নবী। অর্থাৎ কেন্দ্রের সহিত। কেন্দ্রে যিনি অবস্থান নিয়েছেন তিনি নবী। কেন্দ্রে কোন কর্ম নেই। ধর্ম নেই। অর্থাৎ সংস্কার শুন্য

-তোর কথা ঠিক বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বল

-শোন। বিন্দু অখন্ডিতভাবে বিস্তৃত হয়ে রেখা হয়। রেখা অখন্ডিত হয়ে বিস্তৃত হলে দুই মাত্রার সমতল হয় এবং তদ্রুপ দুই মাত্রার সমতল অখন্ডিত হয়ে তিন মাত্রার ঘন বস্তু বা ভলিয়ম হয়। আদিতে মাত্রাহীন একবিন্দু। বিন্দুকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সরলরেখা, বৃত্ত এবং অপরাপর সবকিছু। বিন্দুকে বাদ দিয়ে এদের স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তাই বিন্দুর বর্ধিষ্ণু অবস্থাই যেন সমগ্র বিশ্ব জগত। শিরিক থাকলে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা,ঘনত্ব ইত্যাদি হয়। অর্থাৎ আকার প্রাপ্ত হবে এবং পৃথক পৃথক নাম অথবা পরিচয় থাকবে। সর্বকালে, সর্বযুগে এবং সর্ব অবস্থায় রবরুপে যিনি আছেন তিনিই বিন্দু,তিনিই গুরু। তিনিই আল্লাহ তিনিই সাহেব তিনিই আত্মা। এই হলো এর ব্যাখা। শুন্য হলো লা মোকাম। হলো এর কেন্দ্রে রব-এর অস্তিত্ব। আর হলো কেন্দ্রস্থলে আশ্রিত কোন ব্যক্তি। যিনি এই কেন্দ্রে আশ্রয় পেতে আগ্রহী-তিনি। এতে হলো অালিফ এবং মিম। তাদের প্রেমের ফসল হলো লাম। অর্থাৎ কোন আমানু। যিনি গুরুর আশ্রয় প্রশ্রয়ে লালিত পালিত হন। তার আদেশ নির্দেশ মেনে চলেন। সর্ব কালে সকল যুগে গুরুগণ জীন থেকে ইনসান পর্যায়ে আনার জন্য আমানুগণকে উপদেশ নির্দেশ দান করেন। তাতেই কোরআনের আদেশ নির্দেশ কেবল এই আমানুগণের জন্যই প্রযোজ্য। অালিম লাম মিম। অানা লতিফা মুনজিল। আমি, তুমি সে। অন্য অর্থে আলে মুহাম্মদ। অর্থাৎ মুহাম্মদের বংশধরগণ। ব্যক্তি মুহাম্মদ থেকে এই আলে মুহাম্মদ থেকে অনেক উর্ধ্বস্তরে অবস্থান করে। বরং ব্যক্তি মুহাম্মদ এর থেকে সৃষ্ট। স্রষ্টা আলে মুহাম্মদকে বুঝানোর জন্য জগতে ব্যক্তি মুহাম্মদকে এবং তার বংশধরকে সৃজন করেছেন। যেন ইনসান এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। দৃষ্টান্ত না দিলে উপমা না দিলে সহজে বুঝা যায় না। তাই দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে মহান গুরু ব্যক্তি মুহাম্মদকে সালাতী প্রকৃয়ায় অর্থাৎ ধ্যানের আশ্রয়ে রেখে রবকে ফুটিয়ে তুলে অন্যন্য দৃষ্টান্ত জগতে রেখে গেছেন। যাতে সালাত গুরুত্ব পায়। কিন্ত্তু আফসোস! সেই সালাত ক্রিয়া ভুলে নামাজের আনুষ্ঠানিকতাকেই তারা বড়ো করে দেখছে। ফলে কোরআনে বর্ণিত সালাত গুরুত্ব হারিয়ে অনুষ্ঠান সর্বোস্ব হয়ে উঠেছে

মাহিনের কিছু কথা বোধগম্য হচ্ছে। আবার হচ্ছে না। মনে হয় বুঝতে পারছি আবার মনে হয় পারছি না। দ্বৈত্ত্ববাদের শিকারে পরিণত হচ্ছি। বিষয়টি জানার আগ্রহে মাহিনকে প্রশ্ন করলামঃ

-এই যে তুই বললি সালাতের কথা যাকে প্রচলিত ভাষায় নামাজ বলা হয়। সেই নামাজ আর সালাতের পার্থক্যটা একটু বুঝিয়ে বলবি কি?

(চলবে)