পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২০ মে, ২০১৮

ধ্যান

‘ধ্যৈ চিন্তায়াম্’- অর্থাৎ ( ভ্বাদিগণীয় পরস্মৈপদী) ‘ধ্যৈ’ ধাতুর অর্থ চিন্তা করা । এই ‘ধ্যৈ’ ধাতুর উত্তর ভাবে বা করণে অনট্ ( পানিনির ‘ল্যুট’) প্রত্যয় করে ‘ধ্যান’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘ধ্যায়েতে ইতি ধ্যানম্’ ভাবে, অর্থাৎ ধ্যান মানে চিন্তন বা চিন্তা। যদিও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হ’ল চিন্তা, রূঢ় অর্থাৎ প্রসিদ্ধ অর্থ হচ্ছে প্রগাঢ় চিন্তা । আবার ‘ধ্যায়তে অনেন ইতি ধ্যানম’- ( করণে ) – যার দ্বারা , যার সাহায্যে ধ্যান করা যায় অর্থাৎ ধ্যেয় রূপ, গুণ ও চরিতাদিকেও ‘ধ্যান’ বলে । ‘কালীর ধ্যান’, ‘শিবের ধ্যান’ ইত্যাদি প্রচলিত প্রয়োগে ধ্যানের অর্থই হ’ল রূপ বা মূর্তিবিশেষের বর্ণনা , যার সাহায্যে ধ্যান করা হয় । 

পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ – সংহিতায় ‘ধ্যান’ শব্দটি নেই। ‘ধ্যয়া’ বলে একটি শব্দ , একবার মাত্রই , সেখানে পাওয়া যায়, সায়নাচার্য যার অর্থ করেছেন ‘ধ্যানেন’। ‘ধ্যা’ শব্দের তৃতীয়ার একবচনে ‘ধ্যয়া’ হয়। সুতরাং ধ্যা ও ধ্যান একার্থক । পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্যে এই ‘ধ্যা’ শব্দটি লোপ পেয়ে গেছে এবং তার পরিবর্তে ‘ধ্যান’ শব্দটির বহুলপ্রচার ঘটেছে ।



পাতঞ্জল যোগদর্শনে ধ্যানের সংজ্ঞাসূত্র হচ্ছে- ‘তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্ (৩/২) । ‘তত্র’ কথাটি থেকে সংজ্ঞাসূত্রটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে না- অব্যবহিত পূর্ব সূত্রের অনুবৃত্তি থেকে যাচ্ছে। সুতরাং আগের সূত্রটির উল্লেখ না করলে এই সূত্রটির উল্লেখ না করলে এই সূত্রটির অর্থ পরিষ্কার হবে না। আগের সূত্রটি হচ্ছে ‘দেশবদ্ধশ্চিত্তস্য ধারণা’ ( ৩/১ )। চিত্তকে বাহ্যদেশে কোন মূর্তিবিশেষে, চন্দ্র, সূর্য, ধ্রুবতারা ইত্যাদিতে, অথবা আভ্যন্তর প্রদেশে, নাভি, মূল, হৃদয়, কণ্ঠকূপ ইত্যাদিতে নিবিষ্ট রাখার নাম ধারণা। ‘তত্র’ অর্থাৎ ঐ ধারণার অবলম্বিত বিষয়টিতে প্রত্যয়ের একতানতার নাম ধ্যান। অর্থাৎ যখন চিত্তে একই চিন্তাস্রোত তৈলধারাবৎ অবিছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়, বিজাতীয় কোনও চিন্তা বাধা সৃষ্টি করে না, তখনই তাকে ধ্যান বলে, সহজ কথায় ধারণা গভীর হলেই হয় ধ্যান ; আর ধ্যান গভীর হলেই হয় সমাধি ।

আচার্য শঙ্কর গীতাভাষ্যে ( ১৩/২৪) লিখেছেন- “ধ্যানং নাম শব্দাদিভ্যো বিষয়েভ্যঃ শোত্রাদীনি করণানি মনসি উপসংহ্রতা মনশ্চ প্রত্যক্ চেতয়িতরি একাগ্রতয়া যৎ চিন্তনং তদ্ ধ্যানম্ । তথা ‘ধ্যায়তীব বকো ধ্যায়তীব পৃথিবী ধ্যায়তীব পর্বতাঃ’ ( ছান্দোগ্য ৭/৬/১ ) ইতি উপমোপাদানাৎ তৈলধারাবৎ সন্ততঃ অবিছিন্ন প্রত্যয়ো ধ্যানম্।” অর্থাৎ শব্দাদি বিষয় থেকে শোত্রাদি ইন্দ্রিয় সমূহকে মনে নিরুদ্ধ করে যে চিন্তা তার নাম ধ্যান। ‘বক যেন ধ্যান করছে পৃথিবী যেন ধ্যান করছে, পর্বতগুলি যেন ধ্যান করছে ( উপনিষদের ) এই সব উপমা থেকে বোঝা যায় যে তৈলধারাবৎ সতত অবিছিন্ন প্রত্যয় বা জ্ঞানবৃত্তিই হচ্ছে ধ্যান।”
( ধ্যান... স্বামী ধ্যানানন্দ )