পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২০ মে, ২০১৮

মূর্তিপূজা এবং কলিযুগের সাকার উপাসনা

উপাসনা বা পূজা সাকার নিরাকার উভয়ই হতে পারে।উপাসনার মূল উদ্দেশ্য সান্নিধ্য লাভ না মুক্তি।গীতাতেও ভগবান শ্রীবিষ্ণু তিনটি পথের কথা বলেছেন-কর্মযোগ,জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগ। তিনটি পথেই ঈশ্বর লাভ সম্ভব।তবে এই তিনের মধ্যে কর্মযোগ ও ভক্তিযোগ সাকার উপাসনামূলক।শুধুমাত্র জ্ঞানযোগেই নিরাকার উপাসনার সমর্থক।

সাকার উপাসনার একটি মাত্র সূত্র-তা হল,চঞ্চল মনকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কেন্দ্রিভূত করা।মন এত চঞ্চল যে একে অচঞ্চল করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।গুরুকৃপা নিজের ঐকান্তিকতা, অভ্যাস প্রভৃতি প্রয়োজন মনকে অচঞ্চল করার জন্য।

যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরাজ বক প্রশ্ন করেছিলেন- সবচেয়ে দ্রুতগামী কি?যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন-"মন"। চঞ্চল মন স্থির হলে দৃষ্টি স্থির হয়,দৃষ্টি স্থির হলেই লক্ষ্য অচঞ্চল হয়।এগুলো অভ্যস্ত করার নামই উপাসনা।


মনকে অচঞ্চল করার একটি সহজ উপায় ঋষিগণ বের করেছেন-তা হলো চোখের মধ্যে কোন বস্তুর ছবি ফেলা। ছবিটি একবার চোখে পড়লে ঐ ছবি যদি চোখের সামনে নাও থাকে,তাহলেও মনে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। এভাবেই মানুষ অতীতের স্মৃতিচারন করতে পারে। অনেক সময়ই দেখা যায় মানুষ এরূপ স্মৃতিচারণে পারিপার্শ্বিকতাও ভুলে যায়। তাতে বোঝা যায় যে,অতীতের ছবি তার মনকে আবিষ্ট করে অচঞ্চল করেছে।

মনুষ্য জন্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। তা করতে হলে ঈশ্বরীয় গুণের অধিকারী হতে হবে। ঈশ্বরের অনন্ত গুণ। এর সবই অর্জন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়,তা সত্তেও কিছু গুণ অর্জন সম্ভব বলেই আর্য ঋষিগণ ঈশ্বরীয় গুণের প্রতীক দেবতা বা দেব-দেবীর রূপ কল্পনা করেছেন। এই মূর্তিগুলো হলো ঈশ্বরের গুণের প্রতীক।

একটি দেশকে বোঝাতে আমরা যেমন সেই দেশের পতাকাকে ইঙ্গিত করি, সেইরূপ দেব-দেবীকে দেখলে ঈশ্বরের গুণকে বুঝতে পারি।


আচার্য রামানুজ শঙ্করের অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী হয়েও মূর্তিপূজা করতেন। মূর্তিপূজা দ্বৈতবাদের কথা। পরবর্তিকালে তিনি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মত প্রচার করেন।
একদিন তিনি পূজায় বসেছেন এমন সময় একজন শিষ্য তার কাছে এসে বসলেন।
আচার্য তাকে দেখে বললেনঃ আগুন আনো।
শিষ্য দৌড়ে গিয়ে একটি পাত্রে আগুন নিয়ে এলেন। তা দেখে আচার্য বললেনঃ
"দগ্ধ অঙ্গার কেন এনেছো? আগুন আনো।"
শিষ্য আবার দৌড়ে গিয়ে একটি জ্বলন্ত লাকড়ি নিয়ে এলেন। তা দেখে আচার্য আবার বললেনঃ
"প্রজ্জলিত কাষ্ঠ কেন এনেছো? আগুন আনো।"
শিষ্য এবার হতবাক। আচার্য একবার বলছেনঃ "দগ্ধ অঙ্গার" আবার বললেন "প্রজ্জ্বলিত কাষ্ঠ"। তাহলে আগুন কি করে আনব? শিষ্যের এমন অবস্থা দেখে আচার্য এগিয়ে এলেনঃ আগুন পৃথিবীর সর্বত্র আছে। কিন্তু তাকে দিয়ে যদি আমার কোন কাজ করতে হয়, তাহলে তাকে বসার আসন দিতে হবে। কাষ্ঠ হলো আগুনের বসার আসন। ঠিক একই ভাবে, ঈশ্বর পৃথিবীর সর্বত্র আছেন। তাকে দিয়ে আমার কোন কাজ করাতে হলে অর্থাৎ তার গুণাবলি আমার ভিতর সমাহিত করতে হলে তাকে বসার আসন দিতে হবে। হৃদয় মাঝে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান করাতে হবে। এইসব মূর্তিই ঈশ্বরের বসার আসন।


[সৌজন্যেঃ সনাতন সন্দেশ]

প্রতিমা পূজা কি?
-----------------
অস্থির চিত্তকে স্থিরাবিস্থায় আনয়নই উপাসনার প্রধান ও প্রথম অঙ্গ। কিন্তু মন স্থির করতে হলে স্থির বস্তুর ধ্যান আবশ্যক,চঞ্চল বস্তুতে মন স্থির হয় না। তাই প্রতিমা বা প্রস্তর খন্ডকে ধ্যানের আশ্রয় বস্তু হিসেবে গ্রহন করা হয়।

চার প্রকার ভাব অবলম্বন করে সাধকগণ চার শ্রেণির সাধন ভাবে ঈশ্বরে মন স্থাপন করেন অর্থাৎ ঈশ্বর আরাধনা করেন।
যথা-

১. বৈষ্ণবভাবঃ তুমি সুখে থাক,যত দুঃখ যন্ত্রণা আমার উপর দিয়ে( সাধকের) বয়ে যাক।

২. শাক্তভাবঃ তুমি সুখে বা দুঃখে থাক আমি জানি না।যেমন করে হোক আমাকে সুখী কর। সন্তান যেমন মায়ের কাছে আবদার করে।

৩. ব্রহ্মজ্ঞানীভাবঃ যার সর্বভূতে ভগবান বোধ হয়েছে,সে বলে-তোমাকে কি দিব? যা দেখি সকলই তুমি।পূজার উপকরণ ফুল,জল চন্দন,নৈবদ্য যা কিছু সবই তুমি।সুতরাং তোমাকে দেবার কিছু নাই। আমিই তুমি,তুমিই আমি।

৪. শিশুভাবঃ শিশু যেমন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে,মাও শিশুকে কোলে করে আছেন,কখনই শিশু মার কোল ছাড়া হতে ইচ্ছুক নয় অর্থাৎ সাধক সর্বদাই ঈশ্বরে স্থিত থাকতে চান। শিশু রোগ শয্যায় যেমন মা মা বলে কাদে সাধকের অবস্থাও তেমন।


 শ্রী গণেশঃ
-----------
সমাজের উচুনিচু ধনী দরিদ্র সকলের শক্তিকে সমন্বিত করাই সংঘ শক্তি। ধনী অভিজাত পণ্ডিত শক্তিমান নাগরিকের সাথে দরিদ্র অবনত,মূর্খ,দুর্বল ব্যক্তিদের ঐক্য সাধনাই জাতীয় সংহতি। সিদ্ধিদাতা গণেশ তাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎজীব হস্তীর মুখ ও অতিশয় ক্ষুদ্র ও উপেক্ষিত মুষিককে গ্রহন করেছেন নিজদেহে ও বাহন রূপে।

গজ অর্থ এখানে হাতি বা বন্যজন্তু নয় শুধু প্রতীকের সাহায্যে শব্দ উচ্চারন করে ব্রহ্মবিদ্যা অধ্যয়ন করা।
গ+জ=গজ।
গ অর্থে গতি
জ অর্থে জন্মের উৎসভূমি প্রকৃতিরূপা মায়াময় এই পৃথিবী।
মুণ্ড অর্থ এখানে ম+উ+ণ্ড=মুণ্ড। ম অর্থে ব্রহ্মা এবং হরকেই বোঝানো হয়েছে। ব্রহ্মারূপে সৃজন করেন আর হর না শিবরূপে হরন বা ধ্বংস করেন। জন্ম মৃত্যুর এই যে গতাগতি উ অর্থে স্থিতি।
কিন্তু কোথায় স্থিতি? এই মায়াময় পৃথিবীতে।


গ+জ+ম+উ+ণ্ড=গজমুণ্ড অর্থাৎ জন্মের উৎসভূমিই এ প্রকৃতিরূপা সুন্দর মায়াময় পৃথিবী।

এখানেই জন্ম মৃত্যুর গতাগতি। জন্ম এবং মৃত্যুর যন্ত্রনায় জীবকুল অস্থির। জঠর জ্বালায় জর্জরিত, জরা ব্যাধিতে মুমূর্ষ, শোকতাপে তাপিত আর এজন্যই মানবদেহে গজমুণ্ড সংযোজিত এবং ওই শুণ্ড দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন এই মায়াময় শু+অণ্ড=শুণ্ড।

শুণ্ড অর্থ অতীব সুন্দর আর অণ্ড অর্থ ডিম্ববৎ গোলাকার পৃথিবী।
মায়ামোহ দিয়ে ভরা এ অতীব সুন্দর পৃথিবীতে সুন্দর প্রকৃতি আমাদের আকৃষ্ট করে রেখেছেন। রোগ শোক আমাদের নিত্য সঙ্গী। এই নরক যন্ত্রনা থেকে বাচতে হলে আমাদের সকল অসার বস্তু ত্যাগ করে একত্বে এসে পৌছাতে হবে।

গণেশের দাঁত একটি। গণেশ মুণ্ডে এক দন্ত।
দ+অন্ত=দন্ত। এখানে দ অর্থ আনন্দ আর অন্ত অর্থ অসীম। যেখানে গেলে অপার আনন্দলাভ হয়,তাই এখানে দন্ত। মুষিক যেমন অসার আবর্জনা কেটে পথ পরিষ্কার করে অগ্রসর হয় তদ্রুপ মানুষেরও উচিত প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বা স্বীয় চেষ্টায় সংসারের মায়ামোহ অসার বস্তু ত্যাগ করে পথ সুগম করা।