অনেকদিন হয়ে গেল মাহিনের
সাথে দেখা হয় না। মাহিনকে
বলেছিলাম আসার জন্য।
কিন্ত্তু কেন জানি মাহিন
আসছে না। মনটা
আমার উথাল পাথাল করছে। ফোন
করেছিলাম। শুনলাম
বলছে--এই মুহুর্তে আপনার
কাংখিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব
হচ্ছে না... কি হলো
কে জানে? ইচ্ছে ছিল
মাহিনকে নিয়ে শাহ্ সাহেবের
সাথে একবার দেখা করবো। কিন্ত্তু
সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। কি
যে করি...। চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দিয়ে
রেড়ি হয়ে নিলাম।
উদ্দেশ্যহীন যাত্রা শুরু করবো। যে
দিকে দুচোখ যায় শুধু
হেঁটে বেড়াব। এই
থিওরীর নাম মেনটাল থিওরী। এই
মেনটাল থিওরীর প্রথম সুত্রানুসারে,
"যদি আপনার কোন কারণে
মন বিক্ষিপ্ত হয় তখন এমন
কোন জাগয়ায় চলে যাবেন
যেখানে আপনাকে কেউ চিনে
না। হাঁটা
শুরু করবেন আনমনে।
দেখবেন আপনার মন ভালো
হয়ে গেছে।"
আমি সেই থিওরী মতো
আনমানে হাঁটা শুরু করলাম।
উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। হাঁটছি আর হাঁটছি।
মনে হলো এই পথ
যে আর শেষ হবে
না। মনে পড়লো জীবনান্দ
দাসের কবিতা।
হাজার বছর ধরে আমি
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের
অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও
দুর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে
জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি
দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।।
মনে পড়লো শ্বেতার কথা।
ফোন করতে চেয়েছিলাম। কিন্ত্তু
করবো না। কেননা আমি
এক অনির্দিষ্ট পথে যাত্রা শুরু
করেছি। উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। এ যাত্রায় কোন
প্রিয় মানুষের সাথেও কথা বলা
নিষেধ। কারণ তাতে মন
ভালো হলেও মেন্টাল থিওরীর
ফর্মুলার সুত্র দ্বিতীয় সুত্র
ভংগ হতে পারে। ২নং
সুত্রে বলা হয়েছে-"কোন
প্রিয় মানুষকে সাথে নেয়া যাবে
না। যদি কোন প্রিয়
মানুষ সাথে যায় তো
সেক্ষেত্রে তুমি তোমার ভ্রমণ
পথ প্রমোদবিহারে পরিণত হবে। কেননা
উদ্দেশ্যহীন যাত্রা মানে তো
কোন উদ্দেশ্য থাকা চলবে না।
আমি আবার হাঁটা শুরু
করলাম। যে জায়গায় যাচ্ছি
সেটার নাম জানিনা। সেটার
নাম দিতে পারি অদৃষ্ট
নগর। সেই অদৃষ্ট নগর
পেরিয়ে অনেক দুর চলে
আসলাম। চায়ের বড্ডো তেষ্টা
পেয়েছে। একটু পানি খেয়ে
চা খেলে মন্দ হতো
না। পথ্যিমধ্যে দেখতে পেলাম একটা
খুপরির মতো চায়ের দোকান।
একটা গাছের নীচে বেন্ঞ্জ
পেতে বসার আয়োজন করা
হয়েছে। গাছের নীচে হওয়ায়
একটু শীতলতার পরশও পাওয়া যাবে।
আমি সেই দোকানে গেলাম।
দেখলাম আরো কয়েকজন সেখানে
বসে আছে। দোকানী একটি
গানের ক্যাসেট ছেড়ে গান শুনছে।
আমি কান পেতে রইয়ের
মতো অবস্থা।
কান পেতে শুনলাম গুরু
লালন সাঁইয়ের দেহতত্ত্ব ভিত্তিক গান বাজছে। সেই
গান শুনে সবাইকে বোঝাচ্ছেন
বয়স্ক এক লোক। লোকটিকে
ভালো ভাবে লক্ষ্য করলাম।
তার চুল দাঁড়ি পেকে
সফেদ রং ধরেছে। সেই
চুলে বেণী করার মতো
করে তিনি একটি পাক
দিয়ে রেখেছেন। বুঝাই যায় লোকটি
দীর্ঘদিন যাবৎ এই লাইনে
আছেন। আমি তার পাশে
গিয়ে বসলাম। দোকানীকে পানি
দিতে বললাম। দোকানী পানি
দিল। পানি দিয়ে চোখে
মুখে ছিটিয়ে মুখটা ভালোভাবে
পরিস্কার করে নিলাম। আবার
পানি দিতে বলায় দোকানীর
মনে কেমন যেন বিরক্তির
ছাপ দেখলাম। বুঝা গেল আমি
আসায় তারা সবাই আমার
উপর কিছুটা হলেও বিরক্ত।
আমি তাদের বিরক্ত আরো
বাড়িয়ে দিলাম। বললাম চা
দাও। চা খাব। আর
এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট দাও। তারপর বয়স্ক
লোকটির দিকে তাকিয়ে মৃদু
হেসে জিগ্যেস করলাম-
- চা খাবেন?
-বাবা আমিতো চা সিগারেট
খাই না। গুরুর মানা
আছে?
-ওহ! তাই? আমি বেশ
অবাক হলাম। এই প্রথম
কোন লোক পাওয়া গেল
যাকে চা সিগারেট খেতে
দেখছি না।
-তাহলে পান খান। পান
খেতেতো মানা নেই।
-না বাবা তা নাই।
কিন্ত্তু এখন খাব না।
-ঠিক আছে। না খান।
অাপনি কি যেন বলছিলেন?
সেটাই না হয় শুনি?
-বাবারে আমি পাগল ধরণের
মানুষ। নানান কথা মনে
ভাসে। সেই কথাই মানুষেরে
শুনাই। কেউ শোনে কেউ
শোনে না। যেমন ধর-নবীজি যখন হেরা
পর্বতের গুহায় ধ্যান করেছিলো
তখন জিব্রাইল আইস্যা নবীজিরে ধইর্যা ছিনায় চাপ
দিয়া বিদ্যা শিখাইলো। আবার
কোরানে আছে আল্লাহ আদমরে
বিদ্যা শিখাইছে। সেই বিদ্যার কথাই
মানুষরে শোনাই। মানুষতো আর
মানুষ না। সব হইলো
গিয়া জীব। জীবেরে জ্ঞান
দিলে জীবেরা সেই জ্ঞান
নিতে পারে না। জীবেরা
কেবল ভোগেই মত্ত থাকতে
চায়।
-ইন্টারেষ্টিং। ভালো কথা বলেছেন।
তারপর..
-এই জীবেরে শিক্ষা দিয়া
সুপথে আনার জন্যই এতো
নবী অলি গাউস কুতুব
আইছে।
-তাই?
-বাবারে মানুষের মন হইলো গিয়া
বানরের মতো। খালি লাফায়।
একটা বান্দরের দিকে তাকাইলে দেখবা
বান্দরটা একবার লাফ দিয়া
এইহানে যায়তো আবার লাফ
দিয়া অন্যহানে যায়। লাফালাফি করাই
বান্দরের ধর্ম।
-তার মানে লাফালাফি করা
ধর্ম।
-বাবা বান্দরের ধর্ম।
-ওহ। বান্দরের ধর্ম।তারপর..
-ঐ বান্দরের ধর্ম ত্যাগ কইর্যা মনুষ্য ধর্ম
গ্রহণ করার জন্যই নবীজি
এই দুইন্যাইতে আইছে। সে আইস্যা
দেখাইছে ধ্যান কইর্যা
আগে মনটারে নিজের মইধ্যে
আনো। তারপর ধর্ম পালন
কর।
-তার মানে আগে ধ্যান
কইর্যা তারপর ধর্ম
মানন লাগবো। ঠিক না
চাচা?
আমার কথা শুনে সে
বুঝতে পারছে না। আমি
কি ঠাট্টা করছি? না
কি মনোযোগী শ্রোতার মতো তার কথা
শুনছি? আশে পাশে বসা
মানুষগুলোকে দেখলাম তাদের দৃষ্টি
আমার দিকে নিবদ্ধ হয়েছে।
মেন্টাল থিওরীর তৃতীয় সুত্রে
বলা হয়েছেঃ "তুমি যদি কারো
দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাও
তো তাহার কথায় এমনভাবে
মগ্ন হয়ে যাও যেন
সে বুঝতে পারে তুমি
তার কথা শুনছো। যদি
ভীরের মধ্যে থাকো-মনোযোগ
আকর্ষণ করার জন্য তোমাকে
তাহার দৃষ্টির প্রতি তোমার দৃষ্টি
নিবদ্ধ কর এবং তাহার
কথার পুণরাবৃত্তি করো। তাহা হইলে
সকলেই উৎসুক্য দৃষ্টি নিয়া তোমার
দিকে তাকাইবে।" আমি এখন সেই
ফমুর্লা ইউজ করছি। দেখলাম
কাজ হচ্ছে। মনে মনে
উদ্দেশ্য হলো দেখি সে
কতক্ষণ বক বক করতে
পারে। দোকানী আমার দিকে
তাকিয়ে বললো - আপনের চা
নেন। আমি চায়ে চুমুক
দিয়ে আবার চাচার কথার
প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
-আচ্ছা চাচা। আপনে যে
পূর্বে বলেছিলেন-হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
কে জিব্রাইল (আঃ) জরাইয়্যা ধইর্যা চাপ দিয়া
বিদ্যা শিখাইছে। সেই সময় কি
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জিব্রাইল ফেরেস্তারে
দেখছিলেন?
-না দেকলে কেমতে চাপ
দিলো। আর কেডা কইলো
"ইকরা বিসমি রাব্বিকালাজ্জি খালাক্"?
পড় তোমার প্রভুর নামে।
-চাচা মুহাম্মদ তো পড়তে জানতো
না। সে পড়লো কেমতে?
-আরে বাবা জিব্রাইল ফেরেস্তা
তো কইছে পড়। সে
পড়ছে...
-তাই? আচ্ছা চাচা আপনে
মনে কিছু কইরেন না।
ঠিক আছে। আপনি কতদুর
লেখা পড়া করছেন?
-বাবা কেলাস ফাইপ পর্যন্ত
লেহা পড়া করছিলাম। তারপর
আর পারি নাই। বাবার
লগে ক্ষেতে খামারে কাম
করছি।
-আচ্ছা, তাই না?
আমি দোকানের ভেতর উঁকি ঝুঁকি
দিয়ে দেখলাম কোন ইংরেজী
পত্রিকা বা এ জাতীয়
কিছু পাওয়া যায় কি-না? কোন ইংরেজী
পত্রিকা পাওয়া গেল না। পকেটে হাত দিয়ে গোল্ডলিফের প্যাকেটটা বের করে যেখানে ইংরেজীতে লেখা ছিল চাচার সামনে ধরে বললামঃ
-পড়েন?
-কি পড়মু বাজান?
-এই যে এই লেখাটা?
-কেমতে পড়মু বাজান? আমিতো ইংরাজী পড়তে পারি না।
-চাচা এখন আমি যদি আপনারে চাইপ্যা ধইর্যা বলি পড়েন? আপনি কি পড়তে পারবেন?
চাচা মিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে রাগে ফেটে যাচ্ছে। আর সেই রাগ সামলাতে না পেরে আমার দিকে শানিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললোঃ
-ঐ মিয়া, আপনে কি জিব্রাইল ফেরেস্তা নি? যে আপনে চাপ দিলেই আমি পড়তে পারমু?
-নাহ। আমি জিব্রাইল ফেরেস্তা না।
-তাইলে আপনে চাপ দিবেন ক্যা?
-ঐ
যে বলছিলেন না জিব্রাইল ফেরেস্তা চাপ দিয়া হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে শিক্ষা
দিয়েছিল আমি আপনাকে সেই বিষয়টাই রুপভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম। আর তার
জন্য প্রথমেই আপনার কাছে বলেছিলাম কিছু মনে করবেন না। বাস্তব সত্যটা আপনি
উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা উমাইয়া-আব্বাসিয়া রাজ শক্তি
কর্তৃক প্রকাশিত অনুমোদিত কোরআনের তফসীর পড়ে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে
যাচ্ছেন। নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে বিসর্জ্জন দিয়ে জ্ঞানকে না খাঁটিয়ে তোতা
পাখির মতো অন্ধ অনুকরণ করে যাচ্ছেন।
-তাইলে বাজান আপনে কি কইবার চান,একটু বুঝাইয়া কন, আমরা শুনি। কি কন আপনেরা?
আশে পাশে তাকিয়ে চাচা মিয়া অন্যদের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করলো। চাচার কথা শুনে অন্যরাও সম্মতি দিয়ে বললোঃ
-ঠিক আছে অাপনে বলেন দেহি। আপনি কি বুজাইতে চান? পাশের থেকে একজন বলে উঠলো।
তাদের কথা শুনে আমি তাদের উদ্দেশ্য করে বললামঃ
-ভাইয়েরা
আপনারা আমার কথা শুনতে চাচ্ছেন সেটা ভালো কথা। কিন্ত্তু কথা হলো-আমি যা
বলবো তা আপনারা আপনাদের চিন্তা-শক্তি দ্বারা বিবেচনা দ্বারা যাচাই-বাছাই
করবেন। বুঝার চেষ্টা করবেন। অযথা হই-চই করে লাভ নেই। তাই না?
-হই-চই করমু কেন্? আপনে যদি হই চই মার্কা কতা কন তাইলেতো আমরা চুপ কইর্যা বইয়্যা থাকমু না?
লোকটির
কথা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। কারণ এদের যা অবস্থা দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে
হয় অযথা ভেজাল কাঁধে নিয়েছি। মেন্টালের চতুর্থ সুত্রানুসারে-যদি কোন অযাচিত
পরিস্থিতির সম্মুখীন হও তাহলে বাঁচার উপায় হলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া। অথবা
তারা যেভাবে বুঝতে পারে সেভাবে মনের আদান-প্রদান করা। এক্ষেত্রে মোক্ষম
অস্ত্র হলোঃ যাকে বুঝাতে চাচ্ছেন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তার মনের ভেতর
ঢুকে যাওয়া। কিভাবে ঢুকতে হয়? তার সুত্রটা হলোঃ নিজেকে সে পর্যায়ে নিয়ে
যাওয়া। অর্থাৎ তাদের একজন হয়ে যাওয়া। আমি সেই সুত্রটাই কাজে লাগাতে চেষ্টা
করলাম।
চা টা শেষ করেই একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললামঃ
(চলবে)