পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৭ মার্চ, ২০১৫

অজানা গন্তব্যে একদিন-দ্বিতীয় পর্ব

(প্রথম পর্বের পর)
চা টা শেষ করেই একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললামঃ
-আচ্ছা চাচা মিয়া, আপনি বলেন সুরা আলাক সর্বপ্রথম নাজিল হয়েছিল। তাই না? শানে নুযুল অংশে আমরা জানতে পারি যে সুরা আলাকের প্রথম যে কয়টি আয়াত নাযিল হয়েছিল ঠিক তার কত দিন পর বাকী অংশ নাযিল হয়েছিল? যে সুরা আগে নাযিল হয়েছিল সর্বপ্রথম সেই সুরাই কোরআনের প্রথমে থাকার কথা। সেটা না হয়ে সেটা স্হান পেল ৯৬ নম্বরে। কোন সুত্র ধরে?
-সেইটাতো বাবা জানি না। শুনছি সুরা আলাকের প্রথম আটটি আয়াত প্রথম নাযিল হয়েছিল। আর কতোদিন পর বাকী অংশ নাযিল হয় তা আমার জানা নাই।
-আটটা না প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়েছিল। চাচা মিয়া যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলি। যেহেতু আমি সিগারেট খেয়েছি আমাকে একটু ওযু করার সময় সময় দিন। আমি আসছি।
আমার কথা শুনে চাচা মিয়া হা হা করে উঠলেন। বলেন ঐ বাচ্চু মিয়াভাইরে পানি দে। এইহানেই সে ওযু করে নিক। বাচ্চু পানি দিল। আমি তাড়াতাড়ি ওযু করে নিলাম। মুখ হাত মুছে তারপর বললাম
-সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত হলোঃ 
১)اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ 
 [ইকরা বিসমি রাব্বিকাল রাজি খালাক]
২)خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ
[খালাকাল ইনসানা মিন আলাক]
৩)اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ
[ইকরাওয়া রাব্বুকাল আকরামুল]
৪)الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ
[আললাজি আল্লামা বিল কলম]
৫)عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
[আল্লামা ইনসানা মা লাম ইয়ালাম]
শুনেন,
মুহাদ্দিসগণ অহীর সূচনা পর্বের ঘটনা নিজের নিজের সনদের মাধ্যমে ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম যুহরী এ ঘটনা হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে এবং তিনি নিজের খালা হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহীর সূচনা হয় সত্য স্বপ্নের (কোন কোন বর্ণনা অনুসারে ভালো স্বপ্নের) মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, মনে হতো যেন দিনের আলোয় তিনি তা দেখছেন। এরপর তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়েন। এরপর কয়েকদিন হেরা গুহায় অবস্থান করে দিনরাত ইবাদাতের মধ্যে কাটিয়ে দিতে থাকেন। হযরত আয়েশা (রা., তাহান্নুস تحنث শব্দ ব্যবহার করেছেন। ইমাম যুহরী তা’আব্বুদ تَعَبُّدُ বা ইবাদাত-বন্দেগী শব্দের সাহায্যে এর ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে তিনি কোন ধরনের ইবাদাত করতেন? কারণ তখনো পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবাদাতের পদ্ধতি তাঁকে শেখানো হয়নি । ঘর থেকে খাবার- দাবার নিয়ে তিনি কয়েকদিন সেখানে কাটাতেন। তারপর হযরত খাদীজা (রা.) এর কাছে ফিরে আসতেন। তিনি আবার কয়েক দিনের খাবার সামগ্রী তাঁকে যোগাড় করে দিতেন। একদিন তিনি হেরা গুহার মধ্যে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ওপর ওহী নাযিল হলো। ফেরেশতা এসে তাঁকে বললেনঃ “পড়ো” এর পর হযরত আয়েশা (রা.) নিজেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ আমি বললাম, “আমি তো পড়তে জানি না।” একথায় ফেরেশতা আমাকে ধরে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চেপে ধরলেন। এমনকি আমি তা সহ্য করার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেল্লাম। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ো।” আমি বললাম “আমি তো, পড়তে জানি না।” তিনি দ্বিতীয় বার আমাকে বুকের সাথে ধরে ভয়ানক চাপ দিলেন। আমার সহ্য করার শক্তি প্রায় শেষ হতে লাগলো। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ো।” আমি আবার বলালাম, “আমি তো পড়া জানি না।” তিনি তৃতীয় বার আমাকে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চেপে ধরলেন আমার সহ্য করার শক্তি খতম হবার উপক্রম হলো। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, اقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّكَ الَّذِىۡ خَلَقَ‌ۚ‏ (পড়ো নিজের রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন) এখানে থেকে مَا لَمۡ يَعۡلَمۡؕ‏ (যা সে জানতো না) পর্যন্ত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে ফিরলেন। তিনি হযরত খাদীজা (রা.) এর কাছে ফিরে এসে বললেন, আমার গায়ে কিছু (চাঁদর-কম্বল) জড়িয়ে দাও! আমার গায়ে কিছু (চাঁদর-কম্বল) জড়িয়ে দাও! তখন তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেয়া হলো। তাঁর মধ্য থেকে ভীতির ভাব দূর গেলে তিনি বললেনঃ “হে খাদীজা! আমার কি হয়ে গেলো? তারপর তিনি তাঁকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমার নিজের জানের ভয় হচ্ছে।” হযরত খাদীজা বললেনঃ “মোটেই না। বরং খুশী হয়ে যান। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমাণিত করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। সত্য কথা বলেন। (একটি বর্ণনায় বাড়তি বলা হয়েছে, আপনি আমানত পরিশোধ করে দেন, ) অসহায় লোকদের বোঝা বহন করেন। নিজে অর্থ উপার্জন করে অভাবীদেরকে দেন। মেহমানদারী করেন। ভালো কাজে সাহায্য করেন।” তারপর তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাথে নিয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই। জাহেলী যুগে তিনি ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আরবী ও ইবরানী ভাষায় ইঞ্জিল লিখতেন। অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন। হযরত খাদীজা (রা.) তাঁকে বললেন, ভাইজান! আপনার ভাতিজার ঘটনাটা একটু শুনুন। ওয়ারাকা রসূলুল্লাহকে(সা., বললেনঃ “ভাতিজা! তুমি কি দেখেছো ?” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু দেখেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকা বললেনঃ “ইনি সেই নামূস (অহী বহনকারী ফেরেশতা) যাকে আল্লাহ মূসার(আঃ) ওপর নাযিল করেছিলেন। [অন্য বর্ণনায় আছে-কুদ্দুসুন! কুদ্দুসুন। অর্থাৎ পবিত্র আত্মা। পবিত্র আত্মা বলে - স্প্রিরিট অফ ইসলাম] হায়, যদি আমি আপনার নবুয়াতের জামানায় শক্তিশালী যুবক হতাম! হায়, যদি আমি তখন জীবিত থাকি যখন আপনার কওম আপনাকে বের করে দেবে।” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “এরা আমাকে বের করে দেবে?” ওয়ারাকা বললেনঃ “হাঁ, কখনো এমনটি হয়নি, আপনি যা নিয়ে এসেছেন কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে এবং তার সাথে শত্রুতা করা হয়নি। যদি আমি আপনার সেই আমলে বেঁচে থাকি তাহলে আপনাকে সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবো।” কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই ওয়ারাকা ইন্তিকাল করেন।
উক্ত ঘটনাটি বর্ণিত আছে তাফহীমুল কুরআন সুরা আলাকের শানে নুযুল অংশে। এছাড়া স্পিরিট অফ ইসলাম -স্যার সৈয়দ আমীর আলী রচিত পুস্তকে। এছাড়া অন্যান্য ইমামদের মধ্যেও মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। সেগুলো হলোঃ-
প্রথম ও প্রাধন অভিমতঃ কুরআনুল কারীমের সর্বপ্রথম যা অবতীর্ণ হয় তা হল সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত।
এই মতের পক্ষে যারা অভিমত পেশ করেছেন তাদের দলীল হল- ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেন। ইমাম হাকেম রহ. এবং ইমাম বায়হাকী রহ. তাদের গ্রন্থে উক্ত মতের পক্ষেই দলীল পেশ করেন।
আল্লামা তিবরানী রহ. কাবীর নামক গ্রন্থে আবু রাজা আতারাদী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, যখন আবু মুসা আশয়ারী রা. আমাদেরকে পড়াতেন তখন আমাদেরকে বৃত্তাকারে বসাতেন, আর তার পরনে থাকত সাদা দুটি জামা। তারপর যখন সূরা আলাকের প্রথম আয়াতগুলো পড়াতেন তখন বলতেন এটা হল প্রথম সূরা যা হযরত মুহাম্মদ সা. -এর উপর নাযিল হয়েছিল। হযরত মুজাহিদ, ইবনে শিহাব যুহরী, ওবায়েদ ইবনে ওমায়ের রা. প্রমুখ উক্ত মতের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয় মতঃ কারো মতে কুরআনের সর্বপ্রথম সূরা ফাতিহা নাযিল হয়। ইমাম বায়হাকী তার দালায়েল গ্রন্থে এর পক্ষে একটা দলীল পেশ করেন। অনেকে একে এ ব্যাপারে দুর্বল মনে করেছেন।

তৃতীয় মতঃ একদল আলেমের মতে, সর্বপ্রথম কুরআনের অবতীর্ণ আয়াত হল সূরা মুদ্দাচ্ছির।

চতুর্থ মতঃ হযরত ইকরামা ও হাসান বসরী রহ. বলেন-সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত হল- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
উক্ত বিষয়টি বর্ণিত আছে - মাওলানা  নুর হোসাইন কর্তৃক রচিত প্রবন্ধ মুসলিম উম্মাহর একমাত্র জীবন ব্যবস্থা আল কোরআন নামক অংশে মাসিক আল-জান্নাত নামক পত্রিকায়। প্রকাশ কালঃ ১০ই ডিসেম্বর,২০১৪।

উপরোক্ত ঘটনাবলী শুনতে এবং বলতে ভালো লাগে। কারণ ঘটনা প্রকাশকাল হচ্ছে নবুয়তের প্রারম্ভিককাল। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন হেরা গুহায় ধ্যান করতেন এবং হযরত খাজিদাতুল কোবরা (রাহঃ) যখন তার স্বামী ছিলেন। সেই সময় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাহঃ) নবীজি (সাঃ)এর সাথে বৈবাহিক সুত্রে আবদ্ধ হননি। তাছাড়া তাঁর বয়স ছিল নয় বছর। যখন হযরতের সাথে তার বিয়ে হয়। সে তখনো নাবালিকা। সুতরাং তার নবুয়ত তথা সুরা নাযিলের এ সমস্ত আধ্যাত্মিকতা বুঝার কথা নয়। কিন্ত্তু রাবি (হাদীছ বর্ণনাকারী) হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঞঃ) কে দিয়ে সেই ঘটনার বর্ণনা করলেন এমন একটি সুত্র ধরে যাকে সরাসরি অস্বীকার করতে গেলে ভয়াবহ বিপদের এবং নানান অপবাদ ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া রাবি যে ঘটনা তথা সুত্রের কথা বলেছেন সেই সুত্রটি পর্যলোচনা করলে দেখা যায় - ওহী নাযিলের সুত্রপাত হয় - স্বপ্নের মাধ্যমে। আর ওয়াকারা বিন নাওফেল নামক একজন খ্রীষ্টান পাদ্রী কর্তৃক ফেরেস্তা জিব্রাইল তথা নামুসের সুত্রপাত হয়। যিনি আরবী ও ইবরানী ভাষায় ইঞ্জিল লিখতেন।
উক্ত ঘটনাবলী থেকে কি বুঝলেন চাচা মিয়া? আমি চাচা মিয়ার দিকে দৃষ্টি দিলাম। তিনি বলেন এ ব্যাপারে। তার মতামতটাও জানা জরুরী (চলবে)