পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬

স্বরলিপি-সর্বেসত্ত্বার প্রকাশরুপঃ প্রথম পর্ব

আমি যেদিকে থাকি, সেদিকটা হচ্ছে মীরপুর ১নং গোলচত্ত্বরের পিছনের দিকটায়। অর্থাৎ কলওয়ালাপাড়া মসজিদের গলি। সেই গলিটা থেকে কিছুদুর আগালেই পড়ে লন্ডন হারবার। তার ঠিক পেছনটায় একটা টিনশেডের একটা মেছ আছে। সেই মেছে। গলিটার মাথায় বেশ কিছু ল্যাম্পপোষ্ট আছে। কিন্ত্তু সেই ল্যাম্পপোষ্টের অধিকাংশ ল্যাম্পই ফিউজ। তাই গলিটা অন্ধকারে ঢেকে থাকে। মাঝে মাঝেই ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। তাই আমি ভয়ে ভয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছি। যেহেতু আজ দেরী হয়ে গেছে...তাই দ্রুতই হেঁটে যাচ্ছি। ঠিক সেই সময় একটা ডাক শুনতে পেলামঃ

-এই খোকা, এই দিকে আয়...

আমি চার ধারে তাকালাম। কাকে ডাকছে? কে ডাকছে? তাছাড়া আমাকে তো খোকা বলার কোন কারণ নেই। আমি আবারো তাকালাম। নাহ্ কাউকেই তো দেখছি না....তাহলে কে ডাকছে এই খোকা বলে...আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমার মতো করে। যখন আমি হাঁটছি...ঠিক তখনই আবার সেই ডাকটা শুনতে পেলাম...এই খোকা এইদিকে আয়তো বাবা....

অামি আবারো পিছন দিকে তাকালাম। ভালো করে খুঁজে দেখার জন্য একটু পেছনের দিকেও আগালাম। ঠিক তখনই দেখতে পেলাম-একটা লোক জীর্ণ শীর্ণ কংকালসার দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লোকটিই আমার দিকে ইশারা করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকছে...এই খোকা বলে...কিন্ত্তু আমাকে ডাকার কারণ কি? আমিতো খোকা নই...তাহলে আমাকে ডাকার কারণ কি? আর ডাকলেই কি? আমি কেন যা'ব? এই রকম সাত-পাঁচ ভাবছি আর ঠাঁয় দাড়িয়ে আছি।
 লোকটাকে দেখলাম কিছুটা স্মীত হাস্যবদনে আমার দিকে তাকিয়ে আবারো ইশারা করে ডাকলো। এবার আর সাত-পাচ না ভেবেই তার কাছে গেলাম এবং জিগ্যাসা করলামঃ

-আপনি কি আমাকে ডাকছেন?

-হ বাজান।
 লোকটা কথাটা বলতে বলতে মনে হলো হাঁপাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মনে হয় পড়ে যাবে।  আমি তাকে ধরে বসিয়ে দিলাম। সে বসে বললঃ

-বড়ো খিদা লাগছে...আমারে একটা কলা আর একটা পাউরুটি কিন্ন্যা দিবি?

-এত রাতে?  কোথা থেকে কলা রুটি কিনবো?
অামি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় পৌণে একটা বাজে। এত রাতে কি দোকান পাট খোলা থাকবে?

-থাকবো? 

-কি থাকবো?

-দোকান পাট খোলা থাকবো। 

-আপনে জানলেন কিভাবে? আমি বেশ অবাক হয়েই তাকে জিগ্যাসা করলাম।

-অামি কেমতে জানলাম, হেইডা তর জাননের দরকার নাই। বাজান,তুই মেন রাস্তার ঐপারে যা। যেই রাস্তাটা শাহ্ আলী বাবার মাজারের দিকে গেছে। ঐ জায়গায় গেলে দেখবি দোকান-পাট খোলা আছে।যা, বাবা । আমার বড্ড খিদা লাগছে...


লোকটির কাতর কন্ঠ আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিল। অামি না করতে পারছি না। আমার লোকটাকে এভাবে ক্ষুধার্ত দেখে তাকে ছেড়ে আসতেও পারছি না। ভাবলাম তাকে কিছু টাকা দিয়ে অামি বিদেয় হই। কিন্ত্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, লোকটি যদি হাঁটতেই পারতো, তাহলে সেতো বহু আগেই সেইদিকটায় চলে যেতো। অামি চিন্তা করতে করতে হাঁটছি আর মনে মনে বলছি কথাগুলো। আবার ভাবছি আমার মনের কথা লোকটা কিভাবে জানতে পারলো? তাহলে লোকটা কি মাইন্ড রিডার? অর্থাৎ মানুষের মনের কথা রিড করতে পারে? দেখাই যাক না...যা হয় হবে...আমি জোড় পায়ে হেঁটে মুল রাস্তাটা পার হয়ে ও পাড়ে গেলাম। দেখলাম সত্যি সত্যিই দোকান পাট খোলা আছে। আমি একটা দোকান থেকে এক বোতল পানি, একটা রুটি ও দুটা কলা কিনে আবার হাঁটা দিলাম লোকটার উদ্দেশ্যে। 
মেইন রাস্তা পাড় হয়ে পৌছালাম লোকটার কাছে। তার হাতে দিলাম কিনে আনা জিনিসগুলো। দেখলাম সে বেশ পরিতৃপ্ত। খেতে খেতে আমাকে বললোঃ

-তুই খাবি না?

-নাহ্ । আপনি খান।

-বাবা তোরে একটা কথা বলি। অামি কারো কাছ থেকে কোন কিছু নেই না...যারে পছন্দ হয়, তার কাছে থিক্ক্যা চাইয়্যা খাই। তোরে দেইখ্যা আমার খুব পছন্দ হইছে। তাই তর থিক্ক্যা চাইয়্যা খাইলাম। সব পাগল সমান না। আবার সব পাগলই তার পাগল না...

-তার মানে আপনে আমাকে পছন্দ করেছেন। কিন্ত্তু কেন? 

-তোর ভিতর একটা জিগ্যাসু মন আছে। হেইডা খালি জানতে চায়। বুঝছে চায়। শিখতে চায়। তুই তারে শিখা। দেখবি হেই শিক্ষা এক সুময় তোরেই শিক্ষা দিব। 

-আমাকে শেখাবে মানে?

 -মানে অইলো তর মনটারে তুই যুদি এক জায়গায় কেন্দ্রীভুত করতে পারস, তাইলে কি অয়? একটা বিন্দু অয়। হেইডা অইলো সেন্টার। তারে হেইহানে বহাইয়্যা দে। তার পর হোন হেয় কি কয়?

 -কি সব আজে বাজে কথা বলছেন? আপনার কথার আগা মাথাতো কিছুই বুঝতে পারছি না...

অামার একথা শুনে দেখলাম লোকটি হাসছে। তারপর খাওয়া শেষ করে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেড়টা বাজে। এখন বাসায় যাওয়া যাক। আমি যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, ওম্মনি সে বললোঃ

 -বস। তোরে কি কইছি..হেইডা তো বুঝবার পারস নাই...তাই না...

-জ্বি।

-তাইলে শোন। তর মন অইলো চৈতন্য বা চেতন সত্ত্বা।  হেয় সব সময় উথাল পাথাল থাকে। কারণ কি? জানস?

-না?

-কারণ অইলো মায়া। এই মায়ারে কয় খান্নাস মানি কুমন্ত্রণাদাতা।  যে কুমন্ত্রণা দেয়। কেমতে দেয়? জানস?

-না?

-কেন্ ? তুই সুরা নাস পড়স নাই? হেই হানেইতো লেখা আছে মিন সাররিল ও্য়াসু বিসুফিছুদুরহিন নাস। মিনাল জিন্নাতিওয়ান নাস। হেই ছুদুর মোকামেই থাকে খান্নাস।
 (চলবে)