পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

স্বরলিপি-স্বর্বেসত্ত্বার প্রকাশরুপঃ শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

-খান্নাস মানে কি? জানস?

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যাসা করলেন। আমি বললামঃ

-জানি না।

-খান্নাস মানে অইলো যে কুমন্ত্রণা দেয়? কেমতে দেয়? দেখবি খেয়াল কইর‌্যা-তুই যদি কোন একটা বিষয়ের দিকে গভীর মনোযোগ দেস, তখন তর মনোযোগ নষ্ট করার জন্য হেইড্যা আরেকদিকে লইয়্যা যাইব। ধর, তুই একটা মাইয়্যার দিকে তাকালি। তারপর হেই মাইয়্যার দিকে তাকানোর পর ঐ মাইয়্যাডার ছবি তর মনে কামনার ভাব জাগাইলো। তোরে কে যেন কইবো-দ্যাখছস কি সুন্দর একটা খাসা.....এই যে তোরে একটা খারাপ কাজের দিকে নিয়্যা যাইত্যাছে......এইডাই অইলো খান্নাসের কাজ। 
হোন, মানুষের মইধ্যে ছয়ডা খারাপ জিনিস আছে। হেইগুলিরে কয় রিপু। হেইগুলি অইলোঃ কাম,ক্রোধ,লোভ,মোহ,মদ, মাৎসর্য্য। এই ছয়ডারে কোন কোন গানে কইছে চোরা...ছয় চোরা...এইগুলিরে দুর করার চেষ্টা করবি। বুঝলি....

-এই গুলো দুর করলে কি হবে?

-এইগুল্যা দুর অইলে তোর মনডা পবিত্র অইয়্যা যাইবো গা। এইডারে কয় তাজকিয়ায়ে নফস। তুই পাক পবিত্র অইয়্যা হের (সৃষ্টিকর্তার) কাছে থিক্ক্যা আইছোস। আবার হের কাছেই ফিরর‌্যা যাইতে অইবো পাক পবিত্র অইয়্যা। যতক্ষুণ তুই তোরে পবিত্র না কইর‌্যা দুইন্ন্যা থিক্ক্যা বিদায় না নিবি...ততবার তোর পুনঃজন্ম  অইবো। খালি বার বার এই দুইন্ন্যার মইধ্যেই আওয়া যাওয়্যার মইধ্যেই থাকবি। খালি আবি আর যাবি...যত আবি তত তোর দুঃখ বারবো।

-আচ্ছা ঠিক আছে। সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্ত্তু আপনে যে কথাগুলো বলছেন, সেটা কি কোরআনে আছে?

-থাকবো না ক্যা..তুই কি সুরা ফজর পরস নাই...ইয়্যা অাইয়্যাুহাল নাফসুল মুতমাইন্ন্যা...ইরজিইলা রাব্বিকি রাদিয়াতুমমারজিয়্যাতাম। ফা ইদখুলি ফি ইবাদি ওয়াদখুলি জান্নাতি। হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।

-না। অামি সত্য কথাটাই বললাম। 

-হুম। তুই কি জানিস, কোরআন কি?

-কোরআন অাল্লাহর বাণী। কোরআন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপর অাল্লাহ পাক হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর মাধ্যমে নাযিল করেছেন।

-যেইখানে আল্লাহ পাক বলতাছেঃ ওয়া ফি আনফুসিকুম আফালা তুবছিরুন। নাহনু আকরাবু ফি ইলাহি হাবলিল ওয়ারিদ। আমি তোমার সাথেই আছি অতঃপর তোমরা কি দেখতে পাও না? আমরা তোমার শাহ রগের নিকটেই আছি....আর তুই কস আল্লাহর বাণী আননের লিগ্যা হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর দরকার অইছে? ক্যা, হেয় কি কতা কইতে পারে না?...মাঝ খান থিক্ক্যা জিব্রাইলরে আনলি.....তুই কি জানস বাণী কি? বাণী মানি অইলো কতা। কতা কওনের লিগ্যা মুখ লাগে। মুখের লগে স্বরনালী লাগে। আইচ্ছা তুই ক স্বরবর্ণ কি? নাহ্ তর কওনের দরকার নাই। স্বর বর্ণ অইলো যেই বর্ণ উচ্চারণের লিগ্যা স্বরযন্ত্র লাগে। স্বর যন্ত্র কারে কয়, জানস? স্বরযন্ত্র অইলো - মুখ,দাঁত,তালু, জিহ্বা, আলজিহ্বা ইত্যাদি মিল্ল্যা অয় স্বরযন্ত্র। হেই স্বরযন্ত্র উচ্চারণের স্থানের কারণে বিভিন্ন নাম অইছে। যেমুন সরে অ, সরে আ হ্রঅ ই, দীর্ঘ হ্রঅই.........এইগুলি কই থিক্ক্যা আহে...ক দেহি....এই গুলা আহে অন্তরের অন্তঃস্থল থিক্ক্যা...হেই হানেই হেয় বইয়্যা কতা কয়..ধ্যানে বইলেই তুই দেকতে পারবি....কইথিক্ক্যা কতার উৎপত্তি অয়...কেডা কতা কয়...চাইরট্যা পবিত্র শক্তি জাগাইতে পারলেই কোরআন নাজিল অয়...হেই চাইরডা পবিত্র শক্তি অইলোঃ আলমে লাহুত, আলমে জবরুত, অালমে হা-হুত, আলমে নাসুত। সবগুলির মইধ্যেই চারজন ফেরেস্তা থাকে..হেই ফেরেস্তা অইলো....

-হালার পো...ফাইজলামির আর জায়গা পাও না...এতক্ষণ তর বকবকানি শুনছি। তুই আমারে স্বরবর্ণ ব্যান্ঞ্জন বর্ণ শিখাস? আমি কি লেখা পড়া করি নাই? নাকি না শিখেই চাকরি করছি...তোর মতন পাগল ছাগলের সাথে বসাটাই আমার ভুল হইছে...কেন যে তোর কাছে বসলাম...যা ব্যাটা...তুই কি বেশি জ্ঞানী অইয়্যা গেছস...
আমি কথাগুলো বলে ঐ ব্যাটার কাছ উঠে দাঁড়ালাম।

-কি রে জাহিদ...তুই কার সাথে কথা বলছিস...আর এই কলা, রুটি, পানি নিয়ে এই অন্ধকারে তুই কি করছিস...

আমি পেছনে তাকাতেই দেখি সাদেক আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখে। সাদেক আমার রুমমেট। সাদেককে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও মনে সাহসের সঞ্চয় হলো। আমি সাদেকের দিকে তাকিয়ে বললামঃ

-এই হালার পাগল ছাগল আমারে কি সব আজে বাজে কথা বলছে...পবিত্র কোরআনের বাণীর অবমাননা করছে...কি সব বকবকানি..যত্তসব ছাগল পাগলের দল....গাধা কোনখানের...

-কই? আমিতো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না..কেউ তো সেখানে নাই। তুই তো একা একা বির বির করছিস। তোর কথা শুনে আমি দেখতে চাইলাম....তুই কার সাথে কথা বলছিস...

-এই যে....এই যে এইখানেই....
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই। পানির বোতলটা সেখানেই পড়ে আছে। রুটি, কলাগুলো সেখানেই পড়ে আছে। তাহলে আমি কার সাথে কথা বললাম....কে আমাকে বললোঃ আমার খুব খিদে লেগেছে..আমাকে রুটি কলা কিনে দে....আমি প্রায়ই জ্ঞান হারাতে বসেছিলাম...ঠিক সেই মুহুর্তে সাদেক আমাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ

-চল...বুঝেছি। আর দাঁড়াস না...তাড়াতাড়ি কর। চল্ মেছে যাই....

যেতে যেতে সাদেক বললো-শোন, বছর প্রায় চার/পাচ হবে। এই এলাকায় একটা পাগল গোছের লোক থাকতো। সে কি সব তরীকত ফরিকত করতো। আর লোকজনের দেখা পেলেই নানান সব কথা বলতো। পাগল মানুষ। কেউ তার কথা আমলে নিতো না। লোকজনের কাছে চেয়ে চিন্তে এটা ওটা খেতো। লোকজনও তাকে খাওয়াতো। কোন একটা কারণে লোকজন তাকে চোর ভেবে পিটিয়ে আধ মরা করে ফেলে। তার হাত পা ভেঙ্গে যায়। চলতে পারে না। কিছুদিন সেই লোকটা মারা যায়। তারপর শুরু হয় অন্য কাহিনী। নির্জনে কাউকে একা পেলেই সে দেখা দেয় এবং কিছু খায়নি বলে এটা ওটা অানায়। তারপর একসময় দেখা যায়...যে লোকটার সাথে কথা বার্তা বলছিল, সেই লোকটা সেখানে নাই....এই হলো এই পাগলের কাহিনী। তুই মনে হয় তাকেই দেখছিলি...

সাদেকের কথা শুনে আমি কেমন যেন ঘাবড়ে গেলাম। রুমে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেলাম। তারপর বাতি নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়লো। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্ত্তু ঘুম আসছে না। মনে হলোঃ আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। লোকটি আমার কাছে খাবার চাইলো। আনলাম। সে আমার সামনেই খেল। তারপর সে পবিত্র কোরআন শরীফের তরজমা করে শোনালো...কথা বললো। কথার শব্দ মালা কোথা থেকে উৎপত্তি হয়, সেটা বললো। কে কথা বলে.....সেটাও বললো......আমিতো সব কথাই নিজ কানেই শুনেছি। কিন্ত্তু লোকটি গেল কোথায়......কিভাবে গেল.......রাত প্রায় পৌণে চারটা বাজছে। আমার পাশে কেউ নেই। সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ...তাদের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে...আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর চোখ বুঁজে সেই কথা চিন্তা করছিলাম। কোন শব্দ নেই...সুশান নীরবতা...আমি চোখ বুঁজতেই শুনতে পেলাম আমার হৃদস্পন্দন লাব..ডুব...লাব...ডুব....লাব...ডুব .......কে বলছে....কে শব্দ করছে....তাহলে কি সে.ই এই শব্দ করছে.......