পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বুক চাই ব্যথায় কাতর আবেগেপূর্ণ প্রেমে

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
 
প্রান্তরভূমির মেঠো পথ বেয়ে কোথাও যাচ্ছিল এক কুস্তিগীর। যৌবনের বীরত্ব টগবগ করছিল তার শরীরজুড়ে। হঠাৎ দেখে এক অজগর দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে এক ভল্লুককে। ভল্লুক আর্তচিৎকার করছে, বাঁচাও বাঁচাও বলে। বীরের রক্তে আগুন ধরে গেল এ অবস্থা দেখে। যেভাবেই হোক ভল্লুককে উদ্ধার করতে হবে অজগের গ্রাস থেকে। মওলানা রুমি বলেন, এ জগতে অনেক বীরপুরুষ আছেন যেদিক থেকে মজলুমের ফরিয়াদ ভেসে আসে সেদিকে তারা দৌড়ে যান। তারা ইনসাফ, মানবপ্রেম পরোপকারের চেতনায় লালিত। মজলুমের সাহায্য করা তাদের স্বভাবে পরিণত। স্বভাবের তাড়নাই তাদের নিয়ে যায় মজলুম মানুষের সাহায্যের পানে। আসলে যেখানে ব্যথা ও রোগের প্রকোপ, সেদিকে ধেয়ে যায় ওষুধ। যেখানকার জমি নিচু সেদিকেই গড়িয়ে যায় পানি। মওলানা তার মূল জীবন দর্শন উপস্থাপন করে বলেন,
অ’বে রহমত বা’য়াদত রও পস্ত শো
ওয়াঙ্গাহা’ন খোর খমরে রহমত মস্ত শো
রহমতের বরিষণ যদি চাও বিনীত নিচু হয়ে যাও
রহমতের শরাব পিয়ো প্রাণ ভরে, উন্মাতাল হও।
(২খ. বয়েত-১৯৪০)।
চর্খ রা’ দর যীরে পা’ আ’র আই শোজা‘
বেশনো আয ফউকে ফলক বাঙ্গে সামা‘
ঊর্ধ্বাকাশ পদানত কর, এগিয়ে যাও হে বীর কেশরি
আকাশের ওপার হতে শোনো, আসে সুরের লহরি।
(২খ. বয়েত : ১৯৪২)।
পাম্বেয়ে ওয়াসওয়াস বীরূন কুন যে গূশ
তা’ বে গূশত আয়দ আয গার্দূন খুরুশ
কান থেকে তোমার খুলে ফেলে দাও সন্দেহের তুলা
তখনই হৃদয়ের কানে বাজবে ওপারের সঙ্গীত সুধা।
(২খ. বয়েত : ১৯৪৩)।
পা’ক কুন দো চশম রা’ আয মূয়ে আইব
তা’ বেবীনী বা’গ ও সরবেস্তা’নে গাইব
দোষখাতার লোম হতে সাফ কর দুই চোখ
অদৃশ্যের বাগানে তখন দেখবে নানা ফলফুল। (২খ. বয়েত : ১৯৪৪)।
দাফ-কুন আয মগয ও আয বীনী যুকা’ম
তা’ কে রীহুল্লাহ দর আ’য়দ দর মশা’ম
সর্দিকাশী দূর কর মস্তিষ্ক ও নাসিকা হতে
নাসিকা ইন্দ্রিয়ে আল্লাহর সুবাস ঢুকবে তবে। (২খ. বয়েত : ১৯৪৫)।
এ কথা শুনে তুমি হয়তো বলবে, বলা তো সহজ। করা কিন্তু কঠিন। আমার পক্ষে তো সম্ভবই নয়, অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। মওলানা বলেন, এই যে পারনি, সম্ভব নয়Ñ এ কথা গোপন করে রেখো না। খুলে বলো।
যা’রি ও গেরয়ে কওয়ী সরমায়েঈ আস্ত
রহমতে কুল্লি কওয়ী তর দা’য়েয়াঈ আস্ত
কান্না ও আহাজারী বিরাট পুঁজি জান এই পথের সম্বল
অপার রহমত অসহায়ের সহায় অবারিত সুফল।
(২খ. বয়েত : ১৯৫১)।
মওলানা আরও বলেন, একটু চিন্তা করো, মা ও ধাত্রী বুকের সন্তানকে দুধ দিতে চায়। এজন্য ইচ্ছা করে সন্তানকে কাঁদায়। তোমার নানা অভাব ও প্রয়োজনের তাড়না, সমস্যা। এগুলো দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কাঁদানোর বাহানা। তোমাকে কাঁদাবে, তারপর দুধ দেবে, এজন্যই তোমাকে নানা সমস্যায় জর্জরিত করার আয়োজন।
তিফলে হা’জা’তে শোমা’ রা’ আ’ফরীদ
তা’ বে না’লীদ ও শওয়াদ শীরশ পদীদ
তোমার সমস্যা, চাহিদারূপ শিশুকে সৃষ্টি করেছেন তিনি
দুধের জোয়ার আসে রহমতের বুকে যেন কাঁদলে তুমি।
(২খ. বয়েত : ১৯৫৩)।

মওলানা বলছেন, এ পথে সন্দেহ সংশয় মনে স্থান দিও না, ভয়ভীতির পরোয়া করো না। যত দিকের তাড়া আসুক কান পাতবে না। লক্ষ রাখবে, যদি মনে উপর দিকের চেতনা ও তাড়া আসে, তোমার চিন্তাকে ঊর্ধ্বাকাশমুখী করে তাহলে তা তোমার উন্নতির সহায়ক। আর যদি তোমার মধ্যে লোভ-লালসা, হিংসা ও পশুত্বের চেতনা জাগায়, তাহলে নিশ্চিত জান যে, তা নফসের প্ররোচনা।
গল্পের ধারাভাষ্যে যাত্রাবিরতি করে মওলানা আমাদের আধ্যাত্মিক সবকগুলো দিয়েছেন। এবার গল্পের ধারায় ফিরে এসে তিনি বলেন, বিপদগ্রস্ত ভল্লুকের আর্তনাদ শুনে কুস্তিগীর তার কৌশল ও বীরত্বের জোরে অজগরটিকে হত্যা করে। অজগরের গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে ভল্লুক আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত। সে কুস্তিগীরের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। বুঝিয়ে দেয়, আমি কৃতজ্ঞ, তোমার অনুগত। কুস্তিগীরের কেমন যেন ভালো লাগে। ধীরে ধীরে ভল্লুকের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। অনেক দূর পথ চলে ক্লান্তবীর পথের ধারে এক জায়গায় বসে পড়ে। মৃদুমন্দ বাতাসের পরশে ঘুমের কোলে এলিয়ে পড়ে বীর। ভল্লুক তার শিয়রে বসে, তাকে পাহারা দেয়।

সে পথ দিয়ে জাচ্ছিল এক জ্ঞানী লোক। দেখে, আজব ব্যাপার। বনের ভল্লুক পাহারা দেয় ঘুমন্ত মানুষকে। থমকে দাঁড়ায়। বীরকে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা করে, এই ভল্লুকের সঙ্গে তোমার এত সখ্য, বলো তো কী ব্যাপার? আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বীর। ভল্লুক উদ্ধারের অভিযান আর ভল্লুকের সখ্যের কথা খুলে বলে তাকে। বর্ণানা শুনে জ্ঞানী ব্যক্তি বলল, খবরদার! কোনো অবস্থাতেই ভল্লুকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না। যে কোনো উপায়ে ভল্লুককে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও। প্রস্তাব শুনে একেবারে বেজার হয়ে গেল বীরের মন। বলল, একটি বন্যপ্রাণী আমার ভক্ত হয়ে গেছে, তোমার সহ্য হয় না। তাই বুঝি হিংসায় এমন কথা বলছ। জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, মনে করো আমি হিংসার কারণে এ কথা বলছি। তবুও তো তোমার এ সত্যটি মানতে হবে যে, জ্ঞানীর শত্রুতা মূর্র্খের বন্ধুত্বের চেয়ে উত্তম।’ লোকটি বলে ফেলল, যাও তো, নিজের চরকায় গিয়ে তেল দাও। বনের ভল্লুক আমার বশীভূত, কম কথা! সমাজে আমার কী যে কদর হবে। রাখ তোমার তত্ত্বকথা।

এ কথা বলে বীর আবার আশ্রয় নিল ঘুমের কোলে। তাকে পাহারা দেয় বনের ভল্লুক। একটু পরে কয়েকটি মাছি ওড়ে এসে বসে বীরের নাকের ডগায়। ভল্লুক মাছিগুলো তাড়িয়ে দেয়, যাতে বীরের ঘুমে বিঘœ না ঘটে। কিন্তু মাছি তার নিষেধ মানে না। ওড়ে ওড়ে আসে, ভল্লুক বারবার তাড়ায়। বিরক্ত ভল্লুক এক পর্যায়ে একটি আস্ত পাথর নিয়ে আসে, অপেক্ষায় থাকে। মাছিরা যেই না ঘুমন্ত বীরের নাকের ডগায় বসে, ভল্লুক হাতের আস্ত পাথরটি সজোরে ছুড়ে মারে মাছির ওপর। নাকমুখ থেঁতলে যায়। সেখানেই বীরের জীবনাবসান।

মওলানা রুমি মানবজাতিকে পরামর্শ দেন, তুমি যদি জীবনকে সঠিক পথে অবিচল রাখতে চাও, তাহলে জ্ঞানী লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করো। তাদের উপদেশ শ্রবণ করো। তোমার আত্মার আপনজন স্বজাতি ইহকাল-পরকালের হিতাকাক্সক্ষী মুর্শিদের সাহচর্য গ্রহণ করো। যদি কোনো ভ-কে প্রকৃত বন্ধু বলে গ্রহণ করো, তাহলে তোমার পরিণতি হবে কুস্তিগীর ও ভল্লুকের মতো। প্রথম অবস্থায় ভল্লুক বিরাট অজগরের খপ্পরে পড়েছিল। এমনটি হলে কোনো দক্ষ লোক যেন তোমাকে অজগরের মুখ থেকে উদ্ধার করে আনে। তুমি হয়তো বলবে, যাপিত জীবনে নানা অসংগতির কারণে নিজে বুঝলেও ভুল পথ ছেড়ে আসতে পারি না, মন্দ ভ-দের খপ্পর থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ খুঁজে পাই না। মওলানা সে পথ বাতলে দিয়ে বলেন, ভল্লুক তার কান্নার জোরে নিজেকে মুক্ত করেছে অজগরের মুখ থেকে। তুমি কি ভল্লুকের চেয়ে কম, তুমি কেন কান্নার বানে আসমানের রহমত নামিয়ে আনতে পারবে না জমিনে। হ্যাঁ, তার জন্য তোমাকে তওবা করতে হবে, আজেবাজে যা কিছু খেয়েছ বমি করে উদ্গার করতে হবে। হারাম খেয়েছ, অবৈধ কাজ করেছ, সবকিছু ত্যাগ করতে হবে। অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদতে হবে।
(সূত্র : মসনবি শরিফ : ২খ. বয়েত : ১৯৩২-২০৭৯)।