পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নির্জন গজলের নিঃসঙ্গতার গল্প

রুবাইয়াতের বিশ্বখ্যাত লেখক ওমর খৈয়ামকে সবাই জিজ্ঞেস করতেন আপনি নির্জনতা কেন পছন্দ করেন? নিঃসঙ্গতা কেন পছন্দ করেন? তিনি বলতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভেতর নিঃসঙ্গতা তৈরি হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমার রুবাইয়াত তোমার হৃদয়ে স্পর্শ করবে না। এর কারণ যার ভেতর নির্জনতা তৈরি হয়নি সে কখনো নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করতে পারবে না।

প্রথম দিকে মূল ফারসি ভাষায় গজল লেখা হতো। তখনকার দিনে গজল শিল্পীরা ফারসি ভাষাতেই গজল পরিবেশন করতেন। যেমন হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) দরবারে আমির খুশরু ফারসি ভাষায় গজল পরিবেশন করতেন। তার গজল শুনে মহান আল্লাহর অলি হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) চোখের জল ধরে রাখতে পারতেন না। আমির খুশরু ছিলেন নির্জনপ্রিয়, নিঃসঙ্গপ্রিয় মানুষ। তাই তিনি গজল ভালোবাসতে পেরেছিলেন। নিজের জীবনে নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করতে পারতেন। প্রিয়জনের কথা যখনই মনে হয়ে যেত তখনই তিনি গজল পরিবেশন করতেন আর অশ্রুবর্ষণ করতেন। কারণ, বুকভরা যন্ত্রণাকে বের করার কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, একমাত্র অশ্রুবর্ষণ ছাড়া।

‘নিঃসঙ্গতার কবি’ খ্যাত মির্জা গালিব, তার প্রতিটি গজলে কোনো না কোনোভাবে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সুখ স্পর্শ করতে পারেননি। তাই তিনি তার গজলে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতার সঙ্গে সাকি ও শারাবকে নিয়ে আসতেন। তিনি মনে করতেন সাকি ও শারাবের মাধ্যমে প্রিয়জনের ছবি ভেসে উঠবে। প্রেমিক হৃদয় যখন প্রেমাস্পদের জন্য হাহাকার করতে থাকে তখন তার নিঃসঙ্গতা-নির্জনতা দূর করার জন্য সাকি ও শারাব ছাড়া সে আর কোনো কিছুর উপর ভরসা রাখতে পারে না। যে কারণে ফারসি গজল ও উর্দু গজলে সব গজল লেখক নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে এসেছেন, একই সঙ্গে তারা সাকি ও শারাবকে নিয়ে এসেছেন।

এক সময় মিয়া তানসেন সম্রা ট আকবরের দরবারে যখন গজল পরিবেশন করতেন তখন তিনিও তার গজলে সাকি ও শারাবকে নিয়ে আসতেন। পরবর্তীতে গজল গায়ক তালাত মাহমুদ থেকে মেহেদী হাসান পর্যন্ত প্রত্যেক গজল শিল্পী তাদের গজলে নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা, সাকি ও শারাবকে নিয়ে এসেছেন। এর ফলে গজল পূর্ণতা পেয়েছে। যারা গজল অনুষ্ঠান শুনতে গিয়েছিলেন, শুনতে যাচ্ছেন তারা যখন বিদায় নিয়ে চলে আসেন তখন সঙ্গে করে চোখ ভরা জল নিয়ে ফেরত আসেন, এটাই গজলের পূর্ণতা।
যে গজল আপনাকে হারানো মানুষকে মনে করিয়ে দিতে পারবে না, অশ্রুবর্ষণ করাতে পারবে না, বুঝতে হবে সেটি গজল ছিল না। আর যেই গজল আপনাকে স্তব্ধ করে দিবে, কথা বলার শক্তি কেড়ে নিবে, বুঝতে হবে আপনি গজল শুনেছেন। মেহেদী হাসানের পরে যেসব শিল্পী গজল পরিবেশন করেছেন তারা প্রত্যেকই মেহেদী হাসানকে অনুসরণ করেছিলেন। এদের অন্যতম হচ্ছেন জগজিৎ সিং। তাকে বলা হয় আধুনিক গজলের জনক। রোমান্টিক গজলকে তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। তার স্ত্রী চিত্রা সিংকে নিয়ে যখন তিনি গজল পরিবেশন করতেন তখন সেই গজলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মাঝে মেহেদী হাসানের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যেত।

নির্জনতায় গজল, নিঃসঙ্গতায় গজলÑ এই উপলব্ধি আপনি তখন অনুভব করবেন যখন আপনার জীবনে নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা আসবে। তা না হলে অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা প্রিয় মানুষকে আর খুঁজে পাবেন না। গজল আপনার প্রিয় মানুষকে সুর-তালের সঙ্গে উপস্থিত করে দিবে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যাবেন আপনার নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা। তারপর আবারও চলে আসবে আপনার প্রিয় নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা।

সৈয়দ রশিদ আলম: গবেষক