পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

মোরাকাবা বা ধ্যান সাধনা

ধ্যানের দ্বারা প্রেমাগুণ প্রজ্জ্বলিত হয়। যে ধ্যান করে না সে প্রেম থেকে বঞ্চিত। আল্লাহ বলেনঃ "যারা আমাকে পাওয়ার সাধনা করে আমি তাকে তাদেরকে সেই পথ প্রদর্শন করি" - [সূরা আনকাবুত—৬৯]।

এবার আসি মূল আলোচনায়। এ আলোচনা অতি দীর্ঘ। অবশ্যই আত্মার জ্ঞান অন্বেষণকারীগণ ধৈর্য নিয়ে পড়বেন এবং তা থেকে আলোর সন্ধান পাবেন। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কারণ সবকিছু সত্যের ফলশ্রুতি তে প্রকাশিত।

মুর্শিদকে দেখলে মৃত অন্তর সজীব হয় বা রোগাক্রান্ত অন্তর আরাম বোধ করে এবং চিন্তিত হৃদয়ের চিন্তা দূর হয়। মুর্শিদের আসল এবং প্রকৃত রূপ যে দেখে, সে মরে না। যেমনঃ আযরাঈলের ( আঃ) আসল রূপ যে দেখে, সে বাঁচে না। তবে এ দেখা কয়েক প্রকার হতে পারে। যেমন- বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখা এবং অন্তর দৃষ্টিতে বা ধ্যানে দেখা।

বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য সামনা-সামনি হওয়া প্রয়োজন। ধ্যানে দেখার ব্যাপরে কাছে বা দূরে, অতি দূরেও কোন পার্থক্য নেই। কারণ এটা মুর্শিদের বৈশিষ্ট্য। তবে যার ধ্যানশক্তি উম্মোাচিত হয়েছে, তাঁর জন্য মুর্শিদের রূপের ধ্যান একটা বিরাট নিয়ামত। এর ন্যূনতম উপকারিতা হলো এই যে, এ ধ্যানে আপন মুর্শিদের সাহচর্যের উপকারিতা পাওয়া যায়। অর্থাৎ মুর্শিদের অবর্তমানে মুর্শিদের রূপের ধ্যান মুরিদকে তাঁর সাহচর্যের উপকারিতা প্রদান করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, মুর্শিদের আসলরূপ আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত। নবী করীম (সঃ) বলেনঃ "যে আমাকে দেখেছে, বস্তুতঃ সে আল্লাহকে দেখেছে"। সুতরাং যে আল্লাহকে দেখেছে, সে আলমে লাহুত বা ঐশী জগতের অধিকারী হয়েছে। আর আলম-এ লাহুতে মৃত্যুর প্রবেশাধিকার নেই। অতএব, যে নশ্বর জগৎ অতিক্রম করে অমর জগতে প্রবেশ করেছে, তার আর মরণ নেই। বরং সে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে যায়। এ জন্য আল্লাহর অলিগণ ছাড়া অন্যরা এ বিষয় বুঝে না। না বুঝে ভাল কথা, কিন্তু বিপদ এই যে, তারা মুর্শিদ সাধনার ঘোর বিরোধী।

এখানে স্মরণীয় যে, মুর্শিদের রূপ আল্লাহর গুণাবলীতে পরিপূর্ণ। যার ধ্যানের মাধ্যমে শত সহস্র্র সংকেত ও গোপন রহস্য সম্পর্কে আলোক লাভ হয়। যেখানে আল্লাহর অলিগন আল্লাহর জাত সত্তা গুনে গুনাম্বিত, রূপ রসে স্বভাবে একাকর। আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান, ফানা ফিল্লায় উপনীত। তাই হাদিসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দার হাত, পা, চোখ মূখ সমস্ত ইন্দ্রীয়তে পরিনত হয়, যা দ্বারা সে কার্য সম্পাদন করে, মূলত তা আল্লাহই করেন। আর এই মুর্শিদের ধ্যান সাধানা মুলতঃ আল্লাহর সাধনা। তা না হলে আল্লাহর ধ্যান কি উপায় কোন রূপে করবে বল? অনেকের মতে মুর্শিদের ধ্যান করা শিরক হারাম। তবে তারা বলুক আল্লাহর ধ্যান কি ভাবে করতে হয়? মোট কথা এদের ঈমান একিন সম্মান্ধে কোন ধারনাই নেই। আল্লাহর এবাদত তো পরের কথা।
যা হোক, চুড়ান্ত সত্য হল এই যে, মোরাকাবাতে মুর্শিদের চেহারা ধ্যান করলে উপকার হয়। কারণ, মুরিদ যখন ধ্যানে আপন মুর্শিদের চেহারার মুখোমুখি হয়, তখন তার ভিতর বিশ্বাস, প্রেম, এবং ধ্যান শক্তি—এ তিনটি মনাকর্যক ও মহৎগুন সৃষ্টি হয়। এ তিনটি গুন একই সঙ্গে যখন মুর্শিদের নূরী অন্তর এবং প্রেমের দৃঢ়তার রাজ্যের আওতায় প্রবেশ করে এবং এর প্রতিক্রিয়া মুরীদের অন্তরে এক প্রকার চুম্বক ও আকর্ষণ জন্মলাভ করে এবং প্রতিক্রিয়া মুরীদের আত্মার মধ্য দিয়ে তার সমগ্র দেহে ত্বরাঙ্গিত হয়। তখন আত্মাসহ মুরীদের সারা দেহ তা দ্বারা আলোকোদ্ভাসিত হয়। তাতে দিশারীরূপ ধ্যানের চাবির বদৌলতে মহামূল্যবান সম্পদ মুর্শিদের ইচ্ছার ভান্ডার খুলে যায় এবং মুর্শিদের ভিতর যে অনন্ত সম্পদ নিহিত রয়েছে, মুরীদ তা থেকে অংশ পেতে শুরু করে।

আতরের সুবাস দূর থেকেই পাওয়া যায় এবং অনুভবও করা যায়। অনুরূপভাবে বারুদ ও দিয়াশলাইর মধ্যে সুপ্ত আগুনের মতো মুর্শিদের ভিতরও নেয়ামতসমূহ মজুদ রয়েছে। এ কারণে যথাযোগ্য মুর্শিদের সত্তাও বারুদেরই মতো তেজোদীপ্ত। এর সাথে প্রেমাগুন যুক্ত হলে তা আতশবাজির ন্যায় স্বীয় শক্তিতেই অন্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে এবং পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে। ধ্যানের দ্বারা প্রেমাগুণ প্রজ্জালিত হয়। যে ধ্যান করে না, সে প্রেম থেকে বঞ্চিত। প্রেমাগ্নি যখন মাশুকের বারুদগ্নির সাথে মিলিত হয়, তখনই প্রেমিক আতশবাজির আনন্দ অনুভাব করে। আতশ বাজির সময় যেমন রং বেরং এর ঝাড় ফুল এবং আলো বিচ্ছুরিত হয়, তেমনই মুর্শিদের ধনাগারেও নানারূপ ইস্কে এলাহীর নূর প্রজ্জ্বলিত হয়। এটা মুর্শিদের রূহের প্রভাব এবং বৈশিষ্ট্য।

কোর’আনে আল্লাহর নামের সাথে সাথে যে সব অনুকম্পার কথা বর্ণিত হয়েছে, ঠিক সে রকম মুর্শিদের সত্তাও আল্লাহর সে সব মহত্ব, পূর্ণতা এবং মহব্বত দ্বারা পরিপূর্ণ। অতএব, মুর্শিদের সত্তার ধ্যান ও চর্চ্চা করা হলে পবিত্র সূক্ষ্ম রূহের সূক্ষ্ম প্রভাব মুরীদের রূহ বা আত্মাকে প্রভাবিত করতে থাকে। যেমনই প্রেম আন্দোলিত হয় মাশুকের স্মরণে। এভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন হয়, তার আত্মা প্রেমাগুনে দগ্ধ হয় এবং এর ফলে মাশুকের নূরী রং তার মধ্যে চমকাতে থাকে। আশিক ও মাশুকের মধ্যে এরূপ একাত্মতার সম্পর্ক অবশ্যই বর্তমান রয়েছে। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক ভাব থাকতেই পারে না। এটা করো কাছেই গোপন নেই যে, মূলের বিরোধী হয়ে মূলে পৌঁছা যায় না। প্রত্যেক বস্তুই স্ব স্ব মূলের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং মূলের দিকেই আকৃষ্ট।

ইশককে এলাহীর উৎস স্বয়ং আল্লাহ ও পরমসত্তা। বিধায় ইশক্ বা প্রেম উক্ত সত্তারই গুণ ও ফল। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ভক্ত তাঁর থেকে তিনি যে শক্তি, সামর্থ, জ্ঞান-গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হন, তা সবই তাঁর সেই প্রেমাস্পদ আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। মাশুক স্বত্তার আকর্ষণ গুণেই এরূপ হয়। যে ব্যক্তি ‘শরাফতে হক্ক’ প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি অতি সৌভাগ্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যের অধিকারী। এ ‘শরাফতে হক্ক’ এর প্রভাবে যার অন্তর আলোকিত হয়, তাঁর জ্ঞান গরিমা, গুণাবলী ও স্বত্তা সবই নূরময় রূপ ধারণ করে। ফলে তাঁর দেহও নূরময় হয়। এটাই মাশুকের প্রেমের মর্ম ও রূপায়ণ। অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা ও বৈশিষ্ট্যবলী তাঁর প্রেমিকের সত্তায় রূপান্তরিত হয়। এ কারণেই তাঁকে ‘ফানা ফিল্লাহ’ অথবা ‘ বাকা বিল্লাহ’ বলা হয়। অর্থাৎ তাঁর দেহ-মন মাশুকের সাথে লীন হয়ে স্থিতিপ্রাপ্ত হয়ে যায়।
লেথক - সেখ আসাদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী