পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫

পাখিদের কথোপকথন-তৃতীয় পর্ব

সোবহান সাহেব ঘরেই ছিলেন। তিনি একটি চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চা খাচ্ছিলেন। আর গজল শুনছিলেন। অনুপ জালোটার গাওয়া -
 মেহেফিলে হুসনে সাজাও তো কয়ি বাত বানে....
দওলতে ইশক লুটাও তো কয়ি বাত বানে....
জাম সাগারছে গাওয়া নেহি পিনা মুঝকো..
আপনি আখোছে পিলাওতো কয়ি বাত বানে...
সকালটা তার কাছে বেশ উপভোগ্যই মনে হচ্ছিল। কিন্ত্তু হটাৎ কলিংবেলের শব্দে তার মেজাজটা বিগড়ে যায়। কে এলো এই সকাল বেলা....তিনি বেশ বিরক্ত হয়েই উঠে গেলেন দারোজার কাছে। যেয়ে দেখলেন রহিম সাহেব কেমন গোমড়ামুখো হয়ে তার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন যেন বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। চোখের কোণে ক্ষানিকটা ময়লা জমে আছে। তার বুঝতে বাকী রইলো না যে কিছু একটা হয়েছে। কিন্ত্তু কি হয়েছে? সেটাতো জানা গেল না। যাই হোক..সোবহান সাহেব দরোজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে রহিম সাহেবকে ভেতরে আসতে বললেন। রহিম সাহেব কোন কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করলেন।

সোবহান সাহেব দরোজাটা লাগিয়ে দিয়ে রহিম সাহেবকে বসতে বললেন। রহিম সাহেব বসতেই সোবহান সাহেব তাকে জিগ্যেস করলেনঃ
-কি ব্যাপার রহিম ভাই? আপনাকে কেমন যেন বিষর্ম মনে হচ্ছে? কোন সিরিয়াস কিছু?
রহিম সাহেব সোবহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
-তেমন সিরিয়াস কিছু না? আবার সিরিয়াসও।
-কি রকম? পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুনতো?
রহিম সাহেব সমস্ত ঘটনা আদ্যপান্ত খুলে বললেন। ঘটনাটা শুনে সোবহান সাহেব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তিনি বললেন-এই ঘটনার জন্য আপনি এত পেরেশান হয়ে গেছেন। আপনারতো উচিত ছিল সমস্ত ঘটনার পেছনে যে কার্যকারণটা রয়ে গেছে সেটা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা।

-আরে ভাই সেটা পারছি না  বলেইতো আপনার কাছে আসা.. 
-ভালোই করেছেন। সমস্যা নেই। সব বলবো। তার আগে চলেন বারান্দায় যেয়ে বসি। চা খাই আর আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজি। যদিও আমি স্বপ্ন বিশারদ নই

বারান্দায় সোবহান সাহেব একটি লাইব্রেরী তৈরী করেছেন। চার দিকে বইয়ের সারি। আলমিরার তাকে থরে থরে সাজানো বই। সেখানে চেয়ার পাতানো আছে। অবসর সময়ে তিনি এইখানে বসে বই পড়েন আর গজল শোনেন।বারান্দায় এসে তিনি রহিম সাহেবকে বসতে বললেন। রহিম সাহেব বসতেই সোবহান সাহেব বললেনঃ
আত্তার যে গল্পটি লিখেছেন-তা মুলতঃ সাধনার জগতে সাতটি স্তর। সাধনার সাতটি স্তর হলোঃ সন্ধান, প্রেম, জ্ঞান, নির্লিপ্ততা, একত্ব, বিষ্ময় ও আত্মবিনাশ। আত্তার মুলতঃ যা দেখাতে চেয়েছিলেন তাহলো মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন। আর আত্তারের গল্পটি পড়ে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী বলেনঃ “আত্তার সাধনার সাতটি রাজ্য ভ্রমণ করেছেন। আর আমি এখনও আঁধারের গলিতেই ঘুরে মরছি।“ মজার কথা হলোঃ ফরিদউদ্দিন আত্তার একবার তার দোকানে বসে আছেন। এমন সময় এক ভিক্ষারী এলো তার দোকানের সামনে। আত্তার তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না। তখন ভিক্ষারী তাকে বলছেন, "আশ্চর্য লোকতো আপনি। আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। খোদা জানেন, কিভাবে আপনার মৃত্যু হয়।" আত্তার ভিক্ষারীকে জবাব দিলেন, "তোমার যেভাবে মৃত্যু হয়, আমারও সেভাবে মৃত্যু হবে।" জবাবে ভিক্ষারী বললেন-"আপনি কি আমার মতো মরতে পারবেন?" একথা বলেই ভিক্ষারী ভিক্ষার পাত্রটি একপাশে রেখে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। তারপর আল্লাহ উচ্চারণ করে ভিক্ষারী মারা গেলেন।এঘটনা আত্তারকে ভাবিত করে তোলে। পরবর্তীতে আত্তার সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাধনা করা শুরু করেন। এতো গেল আত্তারের কথা।
এবার আসি আপনার কথায়। আপনি তার বইটি পড়ে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইছেন – সেই ফানার জগতে। তাই আপনি নিজেকে দেখেছেন বন-মোরগ হিসেবে।পুরো বিষয়টি ছিল আপনার অতিন্দ্রিয় চিন্তার ফসল। যেমন ধরুন আপনি জানেন ভাবী সবসময় আপনার কাজের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে এবং আপনার সাথে সবসময় একটা না একটা বিষয় নিয়ে কলহে লিপ্ত থাকে। তাই তাকে দেখেছেন দাঁড়কাক হিসেবে। আর আপনার ছোট মেয়েটি যেহেতু চন্ঞ্চলমতি তাই তাকে দেখেছেন টুনটুনি হিসেবে। 
আর বাজারে যাদের দেখলাম-তাদেরকে কেন ঐ অবস্থায় দেখলাম? রহিম সাহেব বললেন।
-পুরো ঘটনাটাই আপনার মস্তিষ্কের খেলা। আমাদের মস্তিষ্কে নিউরোন নামক যে স্নায়ুকোষটি আছে তা এক একটা সুপার কম্পিউটারের চেয়েও বেশি গতিতে কাজ করে। সেই সুপার কম্পিউটারটিই আপনার পুরো ঘটনাটা এভাবে সাজিয়ে আপনাকে দেখিয়েছে। যেমন ধরেন - গোস্ত বিতানের কথা। সেখানে আপনি দেখলেন একটা শকুন বসে আছে। আপনি জানেন – শকুন মরা গরু খেতে পছন্দ করে। যে বিক্রেতা মাংস বিক্রি করছিলো তাকে শকুনরুপে দেখার কারণ হলো - আপনি নিজেও জানেন না যে গরুটি জবেহ করা হয়েছে তা বিধিমোতাবেক জবেহ করা হয়েছে কি-না? সে সন্দেহ থেকেই আপনার এরুপ ধারণা হয়েছে।
- কিন্ত্তু বাজারে মাছ বিক্রেতাদের ঐরুপ দেখার কারণ কি?
- সেটাও আপনার অতিচিন্তনীয় বিষয়ের ফল। আপনি জানেন-মাছ বক পাখি, চিল কিংবা বাজ পাখিদের প্রিয় খাদ্য। সেই চিন্তা থেকেই আপনি তাদের দেখেছেন বক, চিল আর বাজ পাখিরুপে।
কথা বার্তার একফাঁকে আট-দশ বছরের একটি ছেলে ট্রেতে চা বিস্কুট আর পানি নিয়ে এল। সোবহান সাহেব তা টেবিলের পাশে রেখে রহিম সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন-রহিম ভাই চা খান।
আনমনা রহিম সাহেব ভাবছিলেন তিনি সোবহান সাহেবের কাছে আধ্যাত্মিক টাইপের কিছু শুনবেন। কিন্ত্তু সেটা হলো না দেখে রহিম সাহেব খানিকটা মিয়্রমান হয়ে গেলেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি বললেন
-কিন্ত্তু আত্তারের একটি বিষয় আমার মাথায় ঢুকছে না। সেটা হলোঃ তারা যখন শেষ স্তরে যায় তখন তারা ভাষাহীন এক ঐশী বাণী শুনতে পেলো "হে সত্যন্বেষী পথিক, তোমরা দর্পনে প্রতিবিম্ব দেখছো, আমি দর্পন, সত্য সী-মোরগ তোমাদের অন্তরে। দৃষ্টিভ্রমে তোমরা এক কে বহু রুপে দেখছো। পরম সত্য এক"।

সোবহান সাহেব রহিম সাহেবের কথাটা শুনে কিন্ঞ্চিৎ নড়ে চড়ে বসলেন। চশমার গ্লাসটা পরিস্কার করে আবার তা পড়লেন। এরপর আড়চোখে তাকালেন রহিম সাহেবের দিকে। ক্ষানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করলেন - রহিম ভাই কি সত্যিই বিষয়টি উপলব্ধি করতে চায়? না-কি জানার আগ্রহ থেকে জানতে চাচ্ছে?
তিনি লক্ষ্য করলেন-রহিম সাহেব কেমন যেন ভাবিত হয়ে বসে আছে। তিনি তাকে বললেন-চা খান তারপর বলছি।
(চলবে)