পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৫

পাখিদের কথোপকথন-ষষ্ঠ পর্ব


(পূর্ব প্রকাশের পর)
সোবহান সাহেব বেশ শ্লেদমেশানো গলায় বললেন।
রহিম সাহেব ক্ষানিকক্ষণ  নীরব থেকে বললেনঃ
-ভাই আসলে আমার জানার আগ্রহটা একটু বেশি বলেই আপনার কাছে আসি। তাছাড়া আমি দর্শন এমন্নিতেই কম বুঝি। নিজের জন্য যতটুকু জানা প্রয়োজন সেই আগ্রহ থেকেই জানার চেষ্টা করি।
রহিম সাহেবের কথা শুনে সোবহান সাহেব কিছুটা আশ্বস্থ হলেন। তিনি চায়ের জন্য বলে আবার তার আলোচনা শুরু করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। ফাঁকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেনঃ
-ফরিদউদ্দিন আত্তার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় নিজেকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
"আসলে তুমিই সমগ্র জগতের প্রাণ, তুমিই উভয় জগতে। তোমার আত্মাই "লাওহে মাহফুজে" যেখানে আল্লাহর বাণী লেখা থাকে। তুমি যা চাও, তা তুমি তোমার আত্মা হতেই পাবে। আসলে তুমিই পবিত্র কোরআন। তুমি নিজে নিজের মধ্যে নিজ প্রকাশভংগী লক্ষ্য কর। তুমিই পরম সত্তার প্রতিরুপ ও বস্তুর আসল স্বরুপের প্রকৃত জ্ঞাতা।"
আর অন্যদিকে আরণি তার পুত্র শ্বেতকেতুকে উপদেশ দিয়ে সেই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন। আপনি যদি স্রষ্টার প্রতি আসত্তি থাকেন, তো জেনে রাখেন তিনিও আপনার প্রতি আসক্ত হবেন। তার আগে আপনাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এটাকেই বলা হয় সবরে জামিল।
-ভাই, একটা বিষয় বুঝলাম না। সেটা হলোঃ তুমিই পবিত্র কোরআন। আবার বলেছেঃ"তোমার আত্মাই "লাওহে মাহফুজ যেখানে আল্লাহর বাণী লেখা থাকে।"

সোবহান সাহেব দেখলেন-রহিম সাহেবের মধ্যে ক্ষাণিকটা আগ্রহ বোধ জন্মেছে এবং আগের চেয়ে আরো বেশি মনোযোগী শ্রোতা হয়ে সে তার কথাগুলো শুনছে। এরমধ্যে সেই ছেলেটি চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে তিনি রহিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন-নিন। চা নিন। খেতে খেতে বলি।
চায়ে চুমুক দিয়ে সোবহান সাহেব বললেনঃ
-দ্যাখেন আত্তার ধ্যানের জগতে গিয়ে কথাগুলো বলেছেন। অর্থাৎ তিনি আত্মদর্শন করেই কথাগুলো বলেছেন। তার মানে কি দাঁড়ালো? তিনি তাকেই দেখেছেন এবং তিনি কিভাবে ক্রিয়া করেন-সেটাও লক্ষ্য করেছেন। আর সেই অনুভুতির আলোকেই তার উপরোক্ত উক্তিগুলো বলা। যে আত্মাকে তিনি লওহে মাহফুজ বলেছেন - সেই একই আত্মাকে লক্ষ্য করে আল্লামা ইকবালও একই কথা বলেছেন। ইকবাল বলেছেনঃ "খুদিকো কর এতনা বুলন্দ কে হার তাকদিরছে পেহলে খুদ খোদা বান্দাহ ছে পুছে বাতা তেরা রেজা ক্যা হে"। অর্থাৎ তুমি তোমার আত্মাকে এত উন্নত কর যেন তোমার তকদির রচনা করার পূর্বে খোদা যেন জিগ্যেস করে, বল তোমার এখন কি প্রয়োজন?" 
-এটা কিভাবে সম্ভব?
-শুনেন একটা ঘটনা বলি। একবার দুজন দরবেশ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার মধ্যে একজন নাচতে নাচতে বলছে-"ওগো আল্লাহ তুমি আমার দাস আর আমি তোমার প্রভু।" এ কথা শুনে পাশের দরবেশটি তাকে মারতে উদ্যত হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে ঐ দরবেশটি তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললে সে ক্ষান্ত হলো। বিষয়টি কি ছিল? বিষয়টি ছিল যদি নজরুলের ভাষায় বলি, তাহলে বলতে হয়ঃ
বন্ধু তোমার দুচোখে লোভ, স্বার্থভরা ঠুলি
নতুবা দেখিতে তোমাকে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।
বন্ধু বলিনি ঝুট। এইখানে এসে লুটায়ে পড়ে সকল রাজমুকুট। 
ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলি তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে আবদুন এবং আবদুহুর মধ্যে পার্থক্যটা। এ ব্যাপারে আল্লামা ইকবাল(রঃ) বলেনঃ-
আবদু দিগার আবদুহু চিজে দিগার।
ই-ছেরাপাঁ এন্তেজার উঁ মুন্তাজার।
অর্থাৎ ‘আবদুন’ এক জিনিস আর ‘আবদুহু’ অন্য জিনিস। আল্লাহকে রাজি বা সন্তুষ্ট করানোর জন্য যিনি ব্যস্ত থাকেন তিনি আবদুন, আর যাকে রাজি বা সন্তুষ্ট করানোর জন্য স্বয়ং আল্লাহ ব্যস্ত থাকেন তিনি আবদুহু [সোবহানাল্লাহ] এতে বুঝা যায় সব মোমিন ‘আবদুন’, আর নবীয়েদোজাহাঁ শাফিয়ে মজরেমা হলেন, ‘আবদুহু’। যেমন কলেমায় বলা হয়েছে- আবদুহু ওয়ারাসূলুহু। কোরআন পাকে বলা হয়েছে- আসরা বিআবদিহি। সেই মোহাম্মদের শানেই তিনি আরো বলেছেনঃ-
“কী মুহাম্মদ সে ওয়াফা তুনে, তো হাম তেরে হ্যায়,
ইয়ে জাহা চিজ হ্যায় কেয়া? লওহ কলম তেরে হ্যায়”।।
এই বাক্যটিকেই আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেনঃ
“আল্লাহ্‌ কে যে পাইতে চায়, হযরতকে ভালবেসে,
আরশ-কুরসী,লওহ-কলম না চাহিতে পেয়েছে সে।”
এই পর্যন্ত বলে সোবহান সাহেব একটু দম নিলেন। 
সুফীদের ফানাফিল্লাহ বা আল্লাহময় হয়ে যাওয়ার যে ঘটনা তা ইকবাল (রঃ) বলেছেন নিম্নভাবেঃ
মিটাদো আপনি হাস্তি কো আগর কুছ মরতবা চাহিয়ে,
কে দানা খাকপে মিল কর গুলে গুলজার বনতি হ্যায়”।
অর্থ- ‘হও যদি তুমি প্রত্যাশী ভবে মর্যাদার,
মিটিয়ে দাও তবে নিজের অস্তিত্বের পাহাড়,
বীজের চরম আত্ম বলিদান,
গড়ে তোলে সুশোভিত ফুল বাগান’।
এই মোহাম্মদই হচ্ছেন ইনসানে কামিল। যিনি সেই সত্য পথ প্রদর্শনের জন্য দুনিয়াতে আগমণ করেছিলেন। তার অন্তঃকরণ থেকেই উৎসরিত বাণীই হচ্ছে আল্লাহ পাকের বাণী। তিনিই সেই - সেই তিনি। তার মহিমাই সর্বত্র বিরাজিত।

সোবহান সাহেব লক্ষ্য করলেন-রহিম সাহেব চোখ বুঁজে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে? তিনি তাকে আস্তে করে ডাকলেন-রহিম ভাই? কি হলো? কি দেখার চেষ্টা করছেন?
ডাকার শব্দ পেয়ে রহিম সাহেব চোখ মেলে তাকালেন। তার পর বললেনঃ
-না । আপনার কথা শুনে আমি আমার পাখিটির কথা ভাবছিলাম। দেখার চেষ্টা করছিলাম।
-আরে ভাই আল্লাহ পাকের একটি নাম হলো "হাদি । কোরআনপাকে বলা হয়েছেঃ"মান হাদিআল্লাহু ফাহুয়াল মুহতাদি ওয়ামাইয়ুদলিল ফালান তাজিদালাহু ওয়ালিয়াম মুর্শিদা"।সুরা কাহাফ। এই সুরাটা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন হাদি এবং মুর্শিদ নামক দুটো শব্দ রয়েছে। যার অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য আপনাকে বুঝতে হবে। কারণ

হাদি আল্লাহর একটা সুফি নাম—এর অর্থ হলোঃ পথপ্রদর্শক। সকল পথনির্দেশনা আসে আল্লাহর তরফ থেকে এবং এই নির্দেশনা সর্বদা আসছে—আমাদের কেবল শিখতে হবে কীভাবে সে নির্দেশনা শুনতে হয়। এটা হৃদয়ের ক্ষীণ প্রশান্ত স্বর। যদি মন অত্যন্ত শোরগোলপূর্ণ হয়ে থাকে তবে আপনি সে কণ্ঠস্বর শুনতে সক্ষম হবেন না। একদিন যখন এই মন নীরব হবে তখন এই ক্ষীণ কণ্ঠস্বরের উদয় হবে এবং সেটা সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট শোনা যাবে। কোন দ্বিধা থাকে না কোন দোদুল্যমানতা থাকে না। এর কোন বিকল্প নেই। বেছে নেবার প্রশ্ন নেই। এটা খুবই সুস্পষ্ট।  
পথপ্রদর্শক বাইরে নন। তিনি তোমার ভিতরেই আছেন। মানুষকে তার সত্তার অন্তরতম স্তরে পৌঁছতে হবে আল্লাহ এবং পথপ্রদর্শককে খুঁজে পেতে হলে। যখন অন্তরের সেই পথপ্রদর্শককে খুঁজে পাওয়া যাবে তখন আর কোন ভুল নয়, কোন অনুশোচনা নয়, কোন অপরাধবোধ নয়। তখন আর ভালো বা মন্দ কিছু করার প্রশ্ন নেই। তখন মানুষ যা কিছু করবে তাই কল্যাণকর। তখন সেটা আর নৈতিকতারও প্রশ্ন নয়। তখন ব্যক্তির পরম সত্তা কল্যানকর এবং সেখান থেকে যা কিছু আসে তা কল্যানকর হয় এবং যখন একজন মানুষ এমন আলোয় লঘু পদচারণা করে, তখন জীবন হয়ে ওঠে হাস্য, প্রেম, আনন্দ।
অন্তরের পথপ্রদর্শককে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত একজন গুরুর প্রয়োজন। একবার মাত্র পথপ্রদর্শকের দেখা পেলে, আপনি আপনার মাঝের গুরুকে খুঁজে পাবেন। আপনার হৃদয় ইতোমধ্যে যে কথাগুলো বলেছে সে কথা গুলো সরলে আপনাকে বলার জন্য আপনার গুরু আপনার মাঝেই অবস্থান করছে। কিন্তু আপনি সে কথা শুনতে পাচ্ছেন না। সুতরাং আপনাকে বাইরে থেকে বলতে হচ্ছে। কারণ ভিতর থেকে আসা কথার চেয়ে বাইরে থেকে বলা কথা আমরা অধিক সহজে শুনতে পাই।
বাইরের গুরু কেবল তোমার ভিতরের পথপ্রদর্শকের প্রতিনিধিত্ব করেন। সুতরাং আপনার ভিতরের পথপ্রদর্শক এবং আপনার বাইরের গুরু কোন আলাদা বিষয় নয়। তাঁরা একই ভাষায় কথা বলেন। আপনার বাইরের গুরুর কাছে সমর্পণ করা প্রকৃতপক্ষে আপনার নিজের ভিতরের গুরুর কাছেই সমর্পিত হওয়া, কারণ বাইরের গুরু কেবল একটা প্রতিধ্বনির বিন্দু হিসেবে কাজ করেন, একটা আয়নার মতঃ তিনি আপনাকে প্রতিবিম্বিত করেন। যে বিষয়গুলো আপনার কাছে স্পষ্ট নয় তিনি সে বিষয়গুলোকে আপনার কাছে স্পষ্ট করে তোলেন, এর বেশি কিছু নয়। তিনি সেই কথাগুলোকেই উচ্চরবে বলেন। যে কথাগুলো আপনার হৃদয় নীরবে বলেছে। আপনার হৃদয়ের ক্ষীণ স্বরকে তিনি উচ্চস্বরে তুলে ধরেন।"

সুতরাং বুঝতেই পারছেন-আত্তারের পাখিদের কথোপকথনগুলো ছিল আধ্যাত্মিকতার এক মাইল ফলক। যারা আত্মিক প্রশান্তির জন্য নীরবতা পালন করেন তারাই শোনেন সেই পাখির কথোপকথন। আর যারা তা শুনতে পান না তারা তাদের আত্মাকে কলুষিত করেছেন। তাদের জন্য কোন পথ-প্রদর্শক নেই। তাই আপনাকে সেই পাখির কথা শুনতে হলে তাদের পথেই যেতে হবে। তখনই আপনি দেখবেন - ফানার দৃষ্টিতে সকলেই সেই মহান জাত পাক থেকে উৎসরিত। যতক্ষণ আপনি তা দেখতে না পারছেন - ততক্ষণ আপনি এককে বহুরুপে দেখবেন। এই একমবে দ্বিতীয়মই হচ্ছে সার কথা।