পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫

পাখিদের কথোপকথন-পন্ঞ্চম পর্ব


(পূর্ব প্রকাশের পর)
-দ্যাখেন শামস তাব্রীজ শোকর গোজার করছেন এই বলে যে - আলহামদুলিল্লাহ তু মেরি মোহাম্মদ কা খোদা হে...
সকল প্রশংসা হে আল্লাহ  যে তুমি আমার মোহাম্মদের প্রভুএখানে যে মোহাম্মদের কথা বলা হয়েছে তার স্বরুপ কি?
-তিনিতো আমাদের মতোই মানুষ। রহিম সাহেব বলেন।
রহিম সাহেবের কথা শুনে সোবহান সাহেব হাসতে হাসতে বিষম খেলেন। তিনি বললেনঃ
-অধিকাংশ মানুষের তথা সাধারণ মুসলমানদের ধারণা তাই। সেই সাধারণ মুসলমানের মতোই আপনি উত্তর দিলেন। সাধারণ মানুষের মতোই তিনি জীবন-যাপন করেছেন। ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন। বিয়ে থা করে সংসার করেছেন। আবার নির্দিষ্ট সময়ে তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন। পার্থক্য হলো – তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল এবং কলেমা তৈয়ব্যায় তার নাম আছে এবং কলেমা শাহাদাতে বা সাক্ষ্যমুলক বাক্যে তাতেও তার নাম আছে। প্রশ্নটা হলোঃ যে মুহাম্মদের কথায় আপনি আল্লাহ সর্ম্পকে জানতে পারছেন হাসর-নসর-বেহেস্ত দোযখ সবই চিনলেন, তাকে আপনি নিয়ে আসলেন আমাদের মতো সাধারণ পর্যায়ে। অথচ কোরআন বলছে – “ লাওলাকা লামা খালাকতু আফলাফ ”। আরো বলছেঃ ইন্নালাহা ওয়ামালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান নাবী ইয়া আয়ুহাললাযিনা আমানু ইউসাল্লুনা ওয়া তাছলিমা। আরো আছেঃ ওয়াইউরেদুনা আইয়্যু ফারক্কু বাইনাল্লাহি ওয়া রাসুলিহি উলাইকাহুমুল কাফেরুনা হাক্কা। এছাড়া ইয়ানজুরুনা ইলাইকা লাহুম ইউবসিরুন। সাধারণ মানুষ হলে তিনি মেরাজে যান কিভাবে? মেরাজে যেতে হলে কয়টি স্তর পাড়ি দিতে হয়? জানেন? দ্যাখেন প্রথমে তিনি ছিলেন উম্মে হানীর ঘরে। সেখান থেকে তিনি যখন বোরাকে চরে আরশে মোয়াল্লার দিকে যাত্রা করেন তখন জিব্রাইল বোরাক বলে সে আর যেতে পারবে না। এরপর রফরফ নামক আরেকটি যানে চড়ে যখন সপ্তম আসমানে আসেন তখন জিব্রাইল বলেন তার আর যাওয়ার অনুমতি নাই। এরপর মুহাম্মদ আরশে মুয়াল্লায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কি বুঝলেন?

প্রথম যাত্রায় তিনি ছিলেন মানবীয় স্বত্ত্বাধিকারী। এরপর যখন তিনি ফেরেস্তাদের জগতে যান তখন তিনি হন মালাইকা স্বত্তাধিকারী । পরবর্তীতে তিনি মালাইকার স্বত্তা হারিয়ে তিনি হয়ে যান আল্লাহময় তথা নুরিল্লাহর স্বত্ত্বাধিকারী। এ ঘটনাটা শামস তাব্রীজ বলেছেন-
পৌঁছে মেরাজ মে আরশে তক মুস্তফা
তাব মাবুদ না বান্দা মে পর্দা রাহা
তাব মালায়েকনে হযরতছে ঝুঁককার কাঁহা 
ছারি মাখলুকমে হকনোমা তুহি তু
অর্থঃ মেরাজে যখন পৌঁছলেন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন মাবুদ আর বান্দার মাঝখানে কোন পর্দা ছিল না। তখন মালাইকা (ফেরেস্তা) হযরতের সামনে মাথা নত করে বললেনঃ সারা মাখলুকাতে সত্যই হচ্ছেন - তুমি। তার মানে তিনি আল্লাহকে দেখেছেন। তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন। এছাড়া হযরতকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে - রহমাতুলিল আলামিন হিসেবে। তিনি বলেছেন-"অামি তোমাদের মাঝে প্রেরিত হয়েছি উত্তম গুণাবলী ফুটিয়ে তোলার জন্য " কারণ, ফিতাতুল্লাতি ফাতারান নাসা আলাইহা - আল্লাহর সেই স্বভাব যৎদ্বারা মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির পরবর্তী পর্যায়ে মানব জাতি সেই স্বভাব বা গুণাবলী হারিয়ে পশু স্বত্তার গুণাবলী ধারণ করে আছে। আলমে নাসুতের কারণে দৃষ্টিভ্রমে পতিত মানব জাতি নফসে আম্মারার গুণগুলো ধারণ করায় স্রষ্টার স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে। বলা হয়েছে-ইন্নামাল নাফসুল আম্মারা বিসসুয়ে। 
-তার মানে নফসে আম্মারার গুণাবলীর কারণেই মানুষ পশুস্বত্তায় পরিণত হয়? রহিম সাহেব বললেন
-অবশ্যই। কেননা আত্তার যে সাতটি স্তরের কথা বলেছেন সেই সাতটি স্তর অতিক্রম করা তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা নফসে আম্মারার আদেশ লংঘন করে থাকে। তাই দেখা গেছে সুফীরা তাদের পার্থিব চাহিদার চেয়ে অপার্থিব বিষয়েরই প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন
-হুম। তাহলে দেখা যায় যারা পশু সত্ত্বা লালন করছে তারা পারতঃপক্ষে নফসে আম্মারার হুকুমই তামিল করছে
-অনেকটা তাই
-ভাই একটা কথা বলি?
-বলেন
-একই স্রোতধারা থেকে উৎসরিত আমরা সবাই। কিন্ত্তু তারপরও দেখা যায় যে কাজে কর্মে কথা বার্তায় চাল চলনে কারো সাথে কারো মিল নেই। এটা কেন?
-কারণ কোন খরস্রোতা ঝর্ণার প্রবাহিত পানি যখন প্রবাহিত হয় তখন প্রবাহিত পানির গুণাবলী বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়। যখন তা খালে থাকে বলি খালের পানি। বিলে বিলের পানি। নদীতে নদীর পানি। সাগরে সাগরের পানি। এই পানিই আবার তার পূর্বস্থানে ফিরে যায় পরিশুদ্ধ হয়ে। অর্থাৎ যতদিন সেই পানি তার উৎপত্তিমুলে ফিরে যেতে না পারছে ততদিন সে যে স্থানে আছে সেই স্থানেরই গুণগুলো ধরে রাখে। একারণেই আত্তার সাতটি স্তরের কথা বলেছিলেন। কি বুঝলেন রহিম সাহেব?

রহিম সাহেব কিছু না বলে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন। আমি আত্তারের ভাষ্য পড়ে সত্য-সী মোরগের কথা জানতে চাচ্ছিলাম। আর উনি কি-না আত্তারের কথাটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা শুরু করে দিল। শিক্ষকতার এই এক দোষ। তারা সবাইকে ছাত্র মনে করে। সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়া শুরু করে
-ভাই আমি আপনার কাছে আসছিলাম সত্য-সীমোরগের কথা জানতে। আর আপনি দেখি আত্তারের উক্তিটির ব্যাক্ষ্যা বিশ্লেষণ দেয়া শুরু করে দিয়েছেন?

-তা যথার্থই বলেছেন। কেন করেছি? তাও বলি। সত্য সী-মোরগ থাকে দেহের অন্তঃকরণে। দেহের অন্তঃকরণে যে বসে আছে তার কথা শুনতে হলে তাকে বুঝতে হলে নুরে মুহাম্মদীকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে আপনার আপন দেহকে। চিনতে হবে তাকে। স্বামী বিবেকানন্দ যখন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করেন-প্রভু, আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন? উত্তরে পরমহংসদেব বলেন-দেখেছি কি রে? তার সাথে কথা কয়েছি। এই যেমন তোর সাথে কথা বলছি। তখন স্বামীজি জিগ্যেস করলেন-ঈশ্বর এক না বহু? উত্তরে তিনি বললেন-যদি সমাধির দৃষ্টিতে দেখিস তাহলে এক আর যদি সেইদৃষ্টি ভিন্ন অন্য দৃষ্টিতে দেখিস-তাহলে বহু। উপনিষদে ঋষি আরণি তার পুত্র শ্বেতকেতুকে বললো-বাবা, তুমিতো অনেক বিদ্যান হয়েছে। কিছু গর্বও তোমার হয়েছে। তুমি কি তোমার সেই বিদ্যা দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্দি করতে পেরেছো? উত্তরে শ্বেতুকেতু বললো-সেটা কি সম্ভব? ঋষি আরণি তার পুত্রকে একগ্লাস জল আর একটু লবন আনতে বললেন। পুত্র নিয়ে এল। এরপর তিনি পুত্রকে বললেন-এটা কি? পুত্র স্ফটিক তথা দানাদার লবনের কথা বললেন। পিতা সেই লবন জলে ফেলে পানির সাথে মিলিয়ে ফেললেন। তার পর বললেন-লবন কোথায়? লবনতো মিশে গেছে। পিতা পুত্রকে পানির স্বাদ নিতে বললেন। স্বাদ নিয়ে পুত্র বললো-লবনের স্বাদতো ঠিকই আছে। তার মানে তুমি তাকে দেখছো না। কিন্ত্তু তার উপস্থিতি টের পাচ্ছ। তাই না? ঠিক তাই। মহাবিশ্বে তার সর্বোময় উপস্থিতি। 

তদ্রুপ আপনার দেহেও তার সর্বোময় উপস্থিতি। অাপনার কি কখনো মনে হয় না-যখন কোন গর্হিত কাজ করতে যান তখন কে যেন আপনার ভেতর থেকে বলে-খবরদার ওটা করিস না। বলে কি-না? যদি না বলে তবে ধরে নিতে হবে আপনার জমির মৃত। আর যদি বলে-তাহলে ধরে নিতে হবে-এটা সে যাকে আপনি সী-মোরগ বলেন। যাকে আপনি জানতে চাচ্ছেন। তো সেই ব্যাপারটাই আমি আপনাকে ভাগে ভাগে আলোচনার মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছি। এখন আপনিই বলুন-এ আলোচনা চলবে না বণ্ধ করে দেব?
(চলবে)