পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৫

পাখিদের কথোপকথন-প্রথম পর্ব

রহিম সাহেবের বাড়িটি ভারী সুন্দর। চার শতাংশের একটি জায়গার মধ্যে তিনি তার বাড়িটি তৈরী করেছেন। বাড়ির চতুর্দিকে তিনি নানা প্রকার গাছ গাছালি লাগিয়েছেন। বাড়িটির প্রবেশ পথের দু'ধারে তিনি ফুলের বাগান তৈরী করেছেন। বাড়িটির মুল গেটটিতে গেটফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। সেটি কালে ভদ্রে বড়ো হয়ে গেটটিকে পেঁচিয়ে দুধার দিয়ে উঠে গেছে। যখন ফুল ফোটে তখন পুরো বাড়িটি ফুলের ঘ্রাণে মম মম করে। এমন একটি বাড়ির বারান্দার একধারে তিনি একটি টেবিল ও তার বই পত্র রেখেছেন। অবসর সময়ে তিনি বই পড়ে সময় কাটান। তার বইপত্রগুলোর মধ্যে অধিকাংশই সুফী সাহিত্যে ভরা। সুফীদের জীবন-যাত্রা ও তাদের সাধন পদ্ধতি জানার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ আছে। তিনি প্রায়ই সোবহান সাহেবের সাথে কথা বলেন সুফীমতবাদ নিয়ে। সোবহান সাহেব হাবিবপুর ডিগ্রি কলেজের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি প্রায়ই রহিম সাহেবের বাড়ীতে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। সেই দিন তিনি একটি বই পড়ছিলেন। বইটির নাম মনতাকুত তয়ের বা পাখিদের কথোপকথন। লিখেছেন ফরিদ উদ্দিন আত্তার। তিনি বইটি হাতে পেয়ে ভাবলেন - পাখিদের কথোপকথন আর কি হতে পারে? পাখিরা চিকির মিচির করে ডাকাডাকি করে। তাদের ভাষা কি আমরা বুঝতে পারি? আর পারলেই বা আমরা কিভাবে তাদের জীবন পদ্ধতি বুঝতে পারি? আমরা যেভাবে সংসার করি পাখিরাও কি ঠিক সেই ভাবে সংসার করে ? যাক দেখি বইটিতে কি লিখেছে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বইটি পড়া শুরু করলেনঃ
বনের সকল পাখি এক হয়ে জ্ঞানবৃদ্ধ হুদহুদ পাখির সভাপতিত্বে আলোচনা সভা আরম্ভ করে। পাখিরা একজন বাদশা নির্বাচনের ঐক্যমত্য প্রকাশ করে। হুদহুদ বললো পাখির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো সী-মোরগ এবং সে সপ্ত উপত্যাকার পরপারে কাফ নামক স্থানে অবস্থান করে। সকল পাখি সী-মোরগকে দেখার অভিলাষ প্রকাশ করলে হুদহুদ জানায় যে সেখানে যাবার পথ অত্যন্ত দুর্গম। আলোচনা শেষে পাখিরা হুদহুদকে পথ প্রদর্শক হিসাবে মনোনীত করে। যাত্রারম্ভ সময় উপস্থিত হলে দেখা গেল প্রায় সকল পাখি মুখ ভার করে বসে রয়েছে। বুলবুল গোলাপ বাগান ছেড়ে যেতে চায় না, তোতা অপরূপ দেহ নিয়ে বিদেশে যেতে নারাজ, হাঁস জলপথ চায়, পেঁচা চায় রাতের অন্ধকার ও ভাঙ্গা বাড়ি এবং বাজপাখি রাজার প্রিয় বলে তার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। হুদহুদ যুক্তি দিয়ে পাখীদের আপত্তি খন্ডন করলে হাজার হাজার পাখি যাত্রা শুরু করে। সী-মোরগের কাছে পৌঁছতে যে সাতটি উপত্যকা অতিক্রম করতে হয় তা নিম্নরূপঃ-

(১) সন্ধানঃ এখানে সঠিকপথ নির্বাচনের জন্য ধৈর্য ধারন করে কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং জড় জগতের আকাঙ্খা ত্যাগ করতে হয়। অনেক পাখি এসব মেনে চলতে না পেরে এ উপত্যকায় বাদ পড়ে যায়।

(২) প্রেমঃ অবশিষ্টরা এ উপত্যকায় পৌঁছে। কিন্তৃু এটি আরো কঠিন। এখানে প্রেমিকের ধৈর্য,সহনশীলতা,দারিদ্র ও বিশ্বাসের অগ্নি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেকে প্রান ত্যাগ করে এবং অনেকে সম্মুখে অগ্রসর হতে অস্বীকার করে। ফলে এ উপত্যকায়ও অনেকে পাখি বাদ পড়ে যায়।

(৩) জ্ঞানঃ প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকার আকর্ষনে এ উপত্যকায় উপনীত হয়। এ জ্ঞান ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতামুলক বা প্রজ্ঞামুলক জ্ঞান নয়। এ জ্ঞান হলো হৃদয় ঐশী আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে আত্না পরমাত্মার সন্দর্শন লাভ করে এবং প্রেমিক প্রেমাস্পদের অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। যারা এ জ্যোতি বহনের ক্ষমতা লাভ করে না তারা সম্মুখ পানে আর অগ্রসর হতে পারে না।

(৪) নির্লিপ্ততাঃ এ উপত্যকায় সকল প্রকার প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা, আশা-আকাঙ্খা, অভাব -অনটন, লোভ-লালসা, মোহ-মায়া থেকে পথিক মুক্ত হয়ে যায়।

(৫) একত্বঃ পার্থিব জগতের সকল আকর্ষন মুক্ত হয়ে পথিক একত্ব উপত্যকায় উপনিত হয়। এখানে সে সকল বৈচিত্র্য ও বহুত্বের মাঝে পরম ঐক্য উপলব্দি করতে পারে।

(৬) বিস্ময়ঃ এ উপত্যকায় পথিক এত বিহবল হয়ে পড়ে যে, আমি, তুমি, এক ও বহু ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করতে পারে না। তারা নিজেরা বেঁচে আছে কিনা তাও জানে না। তাদের প্রেমিকাকে তারা চিনে না এবং কেন ভালোবাসে তাও জানে না। কেন এ পথ অবলম্বন করে পাড়ি জমিয়েছে তাও বোঝে না। তাদের ধর্ম কি সে কথার উত্তর তাদের কাছে পাওয়া যায় না।

(৭) আত্ন বিলোপনঃ এ উপত্যকায় উপস্থিত হয়ে প্রেমিক সকল আত্নচেতন হারিয়ে ফেলে এবং কালা, বোবা, নির্বাক,নিঃসাড় হয়ে পড়ে। প্রেমাস্পদ ছাড়া অন্য সকল সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রেমাস্পদে ফানা হয়ে যায়। এ অবস্থায় প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ এক ও অভিন্ন হয়ে যায়।

যাত্রার প্রতিটি উপত্যকায় বাদ পড়তে পড়তে হাজার হাজার পাখির মধ্যে মাত্র ত্রিশটি পাখি সী-মোরগের সদর্শন লাভ করে। সী-মোরগের সম্মুখে উপস্থিত হলে তারা দেখতে পেলো যে, তারা প্রত্যেকই এক একটা সী-মোরগ। তারা প্রত্যেকেই বিস্ময়ে চিন্তা করতে লাগলো তাহলে প্রকৃত সী-মোরগ কে?  তখন ভাষাহীন এক ঐশী বাণী শুনতে পেলো "হে সত্যন্বেষী পথিক, তোমরা দর্পনে প্রতিবিম্ব দেখছো, আমি দর্পন, সত্য সী-মোরগ তোমাদের অন্তরে। দৃষ্টিভ্রমে তোমরা এক কে বহু রুপে দেখছো। পরম সত্য এক"। আসলে তুমিই পবিত্র কুরআন। তুমি নিজেই নিজের মধ্যে নিজ প্রকাশভঙ্গী লক্ষ্য কর। তুমিই পরম সত্তার প্রতিরুপ ও বস্তুর আসল স্বরুপের প্রকৃত জ্ঞাতা।

এ পর্যন্ত পড়ে রহিম সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। সাতটি সাধনার স্তর অতিক্রম করার পর পাখিরা দেখতে পেলো যে তারা নিজেরাই এক একেকজন সী-মোরগ। তিনি নিচের লাইনটি আবারো পড়া শুরু করলেনঃ-

তখন ভাষাহীন এক ঐশী বাণী শুনতে পেলো "হে সত্যন্বেষী পথিক, তোমরা দর্পনে প্রতিবিম্ব দেখছো, আমি দর্পন, সত্য সী-মোরগ তোমাদের অন্তরে। দৃষ্টিভ্রমে তোমরা এক কে বহু রুপে দেখছো। পরম সত্য এক"। আসলে তুমিই পবিত্র কুরআন। তুমি নিজেই নিজের মধ্যে নিজ প্রকাশভঙ্গী লক্ষ্য কর। তুমিই পরম সত্তার প্রতিরুপ ও বস্তুর আসল স্বরুপের প্রকৃত জ্ঞাতা।
তার মানে কি? তার মানে আমার ভেতরই সী-মোরগ রয়েছে? কিন্ত্তু সেটা কোথায়? সেটা কি কথা বলে? যদি বলে থাকে তো কি ভাষায় কথা বলে? তার ভাষা কি আমরা বুঝতে পারি?

রহিম সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। (চলবে)