পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী-পর্ব চতুর্থ



(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)
ডায়েরীটা পড়ার পর মজিদ স্যার বেশ দোটানায় পড়ে গেলেন। তিনি চিন্তা করে ভেবে পেলেন না, নিষাদের বাবা যে ডায়েরীটা লিখে রেখেছে, নিষাদকে দেয়ার জন্য। সেটা পড়ে তো নিষাদের ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে যাবে। কি করা যায়? এমন একটা বদ্ধ উম্মাদ তার ছেলের ভবিষ্যৎটা এভাবে নষ্ট করবে? এটা হতে দেয়া যায় না। তিনি ঠিক করলেন, ডায়েরীটা তিনি নিজের কাছে রেখে দেবেন। সেটা কি ঠিক হবে? কি করা যায়...না...কি...নিষাদের সাথে কথা বলবেন?
কি বলবেন নিষাদকে? তোমার বাবা কি পাগল ছিল? না কি বদ্ধ উম্মাদ ছিল? বাবা সম্পর্কে ছেলেকে কি এভাবে জিগ্যাসা করা শোভনীয় দেখায়?
নাহ্....ডায়েরীটা পড়াই ভুল হয়েছে। আবার তার মনটা বলছে...পড়েই দেখা যাক না...কি আছে তাতে....তিনি আবারো ভাবতে ভাবতে ডায়েরীটা খুলে পড়া শুরু করলেনঃ

প্রিয় নিষাদ,
বাবা, তুমি কেমন আছো?
তোমাকে না বলেছি, কখনো কোন চিন্তা করবে না। চিন্তার কি আছে? অামি নেই তো কি হয়েছে? তোমার মা নেই তো কি হয়েছে? জগতের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে। এটা বিধাতার নিয়ম।
কেন এই নিয়ম? তাইতো? তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে না? নিশ্চয়ই করছে।
শুন বাবা, মৃত্যুটা হলো একটা পরিণতি। এই পরিণতির কারণ-নতুন কিছু সৃষ্টি করা। অাল্লাহ পাক প্রতিটি বস্ত্তুকে নিত্যনতুনরুপে সৃষ্টি করে চলেছেন। আরেকটা কথা বাবা। তুমি যাকে অাল্লাহ বলে জানো, সেই অদৃশ্য আল্লাহ নিরাকার। নিরাকার অাল্লাহকে সকলেই মানে। কিন্তু সাকার আল্লাহকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। সাকার হলো একটা গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। মহান আল্লাহ পাক মোটেও সীমাবদ্ধ নন। তিনি অসীম। তিনি অনাদি অনন্ত। তাই মানুষ যখন নিজেকে আল্লাহ বলে প্রচার করে, তখন সাধারণ মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ কি? কারণ, তিনি কি রুপ, তা ঐসমস্ত লোকেরা জানে না। তারা মেনে নিতে চায় না। মহান আল্লাহ বলে যাকে জানে, সে মানুষের মতো কেউ হোক, তা তারা চায় না। কারণ, তাদের মনটা সেই মহান জাত পাককে দেখেনি। যদি দেখতো, তো তারাও হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) এর মতো বলে উঠতোঃ

অায় মেরে মাওলা তু ছবছে আলা,
তুহি হ্যায় আফজাল তুহি হ্যায় আহসান
অনাদি অনন্ত ছেফাত তোমহারি,
তুমহিছে পয়দা হ্যায় ছারে জাহান।
জমি জমামে মকি মোকামে হর এক জাগামে তোমারি জালুয়া
কুদরত কা তেরি নাহি কিনারা
ছবহি হ্যায় শাষদার ছবহি হ্যায় হয়রান।
অর্থঃ হে আমার প্রভু! তুমি সবকিছুর চেয়েও সুন্দর।
অনাদি হতে অনন্ত তোমারই সমস্ত প্রশংসা।
তুমি.ই এই বিশ্বজাহান সৃষ্টি করেছো।
প্রত্যেকটি স্খানেই তোমার প্রতাপ বিদ্যমান।
তোমার কুদরতের কোন কিনারা নেই।

শুন বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। ফরিদউদ্দিন আত্তার তাহার শেষ গ্রন্থ 'লিসানুল গায়িব' পুস্তকে বলেছেনঃ
আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অজুদ
হর যমাঁ খোদরা বা-নকশ ওয়া নমুদ;
জুমলা যাতে জাঁহানে মিরআতে উস্ত
হরচে বিনি মুসহাফে আয়াতে উস্ত;
"লাওহে-মাহফুয" আস্ত, দর মা'নী দিলাত
হরচে মি খাহী, শোদ যে উ হাসেলাত।
উনচে মাতলুবে-জাঁহা শোদ দর জাহান
হাম তুরী, ও বায জো আজ খোদ নেশান।।
অর্থাৎ তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি শরীরী-জগতে প্রতি মুহুর্তে নব নব রুপে প্রকাশিত হইতেছেন। বিশ্বের সকল অস্তিত্বই তাহার মুকুর। যাহা কিছু দেখিতেছ সমস্তই তাহার প্রকাশ-চিন্হ। প্রকৃতপক্ষে তোমার অন্তরই "লওহে মাহফুয"। যাহা কিছু চাও উহা হইতেই তাহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে। যিনি এই বিশ্বে সারা দুনিয়ার কাম্য, তুমিই তিনি। তোমার নিজের ভেতর তাহার সন্ধান কর।
মনে রেখো বাবা, সুফীরা আল্লাহ পাকের দীদারে থাকেন। তাঁদের কালামে অনেক রহস্যাবলী লুকিয়ে আছে। তাঁদের ধ্যান সাধনায় তারা তন্ময় থাকেন কেবল প্রভুর দীদার লাভের অাশায়। জগতে যত দর্শন আছে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দর্শন হচ্ছে সুফীদর্শন। প্রাচ্যে এর সমাদর দিনকে দিন বাড়ছে। আর আমাদের দেশে কমছে। কারণটা হলোঃ ধর্মীয় গোঁড়ামী। গোঁয়ার্তুমি করা। এরা কখনো দর্শন পড়েনি। দর্শন বোঝার চেষ্টাও করেনি। তাই, তুমি কখনো কোনো ঝগড়া বিবাদে যেও না। জোর করে কাউকে বোঝাতে যেও না। কথা বলবে মেপে মেপে...জন বুঝে.....কুতর্কে জড়িও না....কারণ হেদায়েত কেবল মাত্র আল্লাহ পাকের হাতে...তিনি যাকে হেদায়েত দেবেন, তিনিই হেদায়েত প্রাপ্ত হবেন। আজ এ পর্যন্তই ।
ভালো থেকো বাবা
ইতি
তোমার বাবা

লেখাটা পড়ে মজিদ স্যার ভ্রু কুঁচকালেন। সুফী দর্শন....সেটা আবার কি?
(চলবে)