পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী - তৃতীয় পর্ব


(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মজিদ স্যার একবার ভাবলেন-তিনি নিষাদকে ডাকবেন এবং জিগ্যেস করবেন, তার বাবা কোথায় মুরিদ হয়েছেন? আর কেনই বা তিনি নিষাদকে মুরিদ হতে বলেছেন?  আবার ভাবলেন, নাহ্ এটা করা ঠিক হবে না। কেননা, নিষাদ বুঝে ফেলবে। তার বাবার ডায়েরীটা আমি পড়েছি। আর পড়লেই বা কি? শিক্ষক হিসাবে আামার একটা দায়িত্ব আছে। ছেলেরা ক্লাসে কে,কি পড়ছে, তা দেখার। কাজেই সে ডায়রিটা পড়তেই পারে। এটাতে তিনি কোন দোষ দেখছেন না। তিনি আনমনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছেন। আর নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।  তিনি আড়চোখে নিষাদের দিকে তাকালেনঃ
দেখলেন, ছেলেটা ঠিক মতোই পড়া শোনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর নিষাদের পাশে বসা ছেলেটি ফিসফিস করে কি যেন বলছে? তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, তৃতীয় বেন্ঞ্চের কর্ণারে বসা ছেলেটি খাতা বের করে কি যেন লিখছে? তারপাশে বসা অন্য আরেকটি ছেলে সেটা দেখছে....একদম শেষের কর্ণারের দিকে একটি ছেলে বইয়ের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে...তিনি হুংকার দিয়ে বললেনঃ

-সবার পড়া হয়েছে?
 ছাত্ররা সমস্বরে বললোঃ

-জ্বী স্যার...

-ঠিক আছে। বই বন্ধ কর। এ্যাই ছেলে, তুমি দাঁড়াও...বলো আজকের পড়া বলো দেখি...হাটতে হাটতে তিনি সেই ছেলেটির কাছে গেলেন।

ঘুমিয়ে থাকার কারণে সে বুঝতেই পারছে না...কি পড়ানো হচ্ছিল...সে মজিদ স্যারের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো...সেটা দেখে মজিদ স্যার বেজায় রেগে গেলেন। তিনি ঠাস করে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন ছেলেটির গালে...চড়ের ভার সামলাতে না পেরে ছেলেটির গালটি লাল হয়ে গেল....এবং সে কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়লো। মজিদ স্যার, জিগ্যেস করলেনঃ

-কি নাম তোর?

-স্যার রাব্বি.....কাঁদো কাঁদো ভারী গলায় ছেলেটি তার নাম বললো। 

-নে ঠিক মতো পড়। বই বার কর। তারপর দেখে দেখে পড়া মুখস্ত হলে বলবি...এ্যাই তোরা এই চাপ্ট্যারটা ভালো ভাবে পড়বি। বুঝলি...এইটা খুব ইমপটেন্ট...পরীক্ষায় আসতে পারে..নে সবাই আবার পড়...
ছেলেরা সবাই বই বের করে পড়তে লাগলো....


পুরো ক্লাসে একটা গুণ গুণ ভাব উঠলো। ছেলেরা দুলে দুলে স্বর করে পড়তে লাগলো...মজিদ স্যার ঘড়ি দেখলেন। দুটা চব্বিশ...আরো বিশ মিনিট হাতে আছে। ক্লাস শেষ হতে। তিনি আবারো তার আসনে বসলেন এবং সেই ডায়েরীটা হাতে নিলেন। তারপর চিন্তা করলেন....পড়বেন কি-না? তিনি আবারো ডায়েরীতে হাত দিয়ে মাঝখান থেকে পৃষ্ঠা বের করলেন এবং পড়া শুরু করলেন...

বাবা নিষাদ,
তোমাকে কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ কথা বলবো। তুমি কথা কয়টি খুব মনোযোগ সহকারে বার বার অধ্যয়ন করিবে। বুঝিবার চেষ্টা করিবে, কেন তোমাকে এই গুরুত্ব পুর্ণ কথা কয়টি বললাম? শুনো সেই গুরুত্বপুর্ণ কথাঃ

"জগতে কোন কিছুই বিধাতা অযথা সৃষ্টি করেন নাই । সমস্ত সৃষ্টিই দুইটা ভাগে বিভক্ত। একটা হিজবুল্লাহ তথা আল্লাহ্ তায়ালার দল আর অন্যটি হলো হিজবুত শয়তান তথা শয়তানের দল। আল্লাহ পাক তাহার নিজের দলকে তিনি নিজেই হাদিরুপে হেদায়েতের দায়িত্ব নিয়াছেন। বলা হইয়াছেঃ লি কুল্লি কাওমিন হাদিন। প্রত্যোকটি সম্প্রদায়ে হাদিন তথা পথ প্রদর্শক প্রেরণ করা হইয়াছে। এছাড়া আরো বলা হইয়াছেঃ "মান হাদি আল্লাহু ফা হুয়াল মুহ্ তাদি ওমাইয়ুদ দলিল ফালান তাজিদালাহু ওয়ালিয়াম মুর্শিদা"। সুরা কাহাফে আল্লাহ পাক বলিতেছেনঃ আমি যাহাকে হেদায়েত দান করি সে.ই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। আর যাহাকে গোমরাহিতে রাখি, তাহার জন্য কোন অলীয়ে মুর্শিদ রাখি নাই। কাজেই, যে তোমার মুর্শিদ সেই তোমার রসুল এবং সে.ই আল্লাহ হয়। সেইটা কিভাবে হয়, সেইটা তোমাকে বুঝিতে হইবে। মনে রাখিবে - এই বিষয়টা নিয়া জগতে মারামারি, কাটাকাটি পর্যন্ত হইয়াছে। অনেককে মারিয়া ফেলা হইয়াছে....অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিতে হইয়াছে.... অর্থাৎ নানান বিপদের মধ্যে পতিত হইতে হইয়াছে। কাজেই, সাবধান থাকিবে। আর গাধার দলের সাথে তর্কে মাতিও না। তাহা হইলে তোমাকেও সেই দলের মধ্যে গণ্য করা হইবে।"

বাবা, নিষাদ তুমি ভালো থাকিও। আর দুঃচিন্তা করিও না....কেন না, আল্লাহ পাক বলিয়াছেনঃ ইল্লালল্লাহ মাস সাবেরীন। তিনি সবরকারীর সাথেই আছেন। যার সাথে আল্লাহ থাকেন, তার কি কোন ভয় বা দুঃচিন্তা থাকে? থাকে...না...থাকবেও....না...ভালো থাকো।

ইতি 
তোমার বাবা

বিঃদ্রঃ
তোমাকে সাহায্য করার জন্য জগত বিখ্যাত কিছু অলীআউলিয়াগণের মন্তব্য প্রদান করিলাম।
হজরত মুজাদ্দেদে আলফেসানি বলেছেন, পীরে তাস্ত আউয়াল মাবুদ তাস্ত অর্থাৎ ‘তোমার পীরই তোমার প্রথম মাবুদ।' (মাতলাউল উলুম ৮৬ পৃ)।
হজরত হাফিজ সিরাজিও এরকম কথাটিই বলেছেন। তবে ভাষাটি অন্যরূপ। হজরত হাফিজ সিরাজি বলেছেনঃ
আপন পীরের ধ্যানে নিরিখে-বরজখে, বছরের পর বছর নির্জনে ধ্যানসাধনা করার পর যখন আপন পীরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ফানা হয়ে গেলাম এবং কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না, তখনই দেখতে পেলামঃ আমার পীরও আমি, আমার মুরিদও আমি।
ফারসি ভাষায় বাক্যটি এই রকমঃ
‘চু খুদরা বিনগারাম দিদাম হামু নাস্ত জামালে খুদ জামালে ইয়ারে দিদাম।'
অন্যত্র হজরত হাফিজ সিরাজি, যাঁর নামাজে জানাজা সেই দিনের মোল্লারা পড়ে নি, সেই হাফিজ সিরাজি ফারসি ভাষায় বলছেন,
‘নামাজে মোলা মেহরাবে মিম্বার,
নামাজে আশেকা বারদারে দিদাম।' অর্থাৎ ‘মোল্লার নামাজ মেহরাব থেকে মিম্বারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর প্রেমিকেরা নামাজ পড়েন ঠাট্টা-তামাশার শূলের উপর দাঁড়িয়ে।' আরও উলেখ করা যায় যে, হজরত হাফিজ সিরাজি তাঁর রচিত বৃহৎ দিওয়ান-টির প্রথমেই উলেখ করেছেনঃ শুরু করলাম আপন পীর ও মুরশিদের নামে।

মজিদ স্যার বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেনঃ এটা কেমন কথা? মানুষ আল্লাহ হয় কিভাবে? নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক। এই লোকটার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ ছিল। মাথা থারাপ না থাকলে কিভাবে বলতে পারে - মানুষ নবী, মানুষই আল্লাহ....এ কথা ভাবাও তো পাপ...তিনি অসতাগফিরুল্লাহ মিন জালিক বলে বেশ কয়েকবার আউরালেন। আর আল্লাহ পাকের কাছে পানাহ চাইলেন...হে আল্লাহ, তুমি আমাকে হেদায়েত দান কর...ফেতনা ফ্যাসাদ থেকে বেচে থাকার তওফিক দান কর। আমিন।
(চলবে)