পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০১৭

বাবার ডায়েরী-দ্বিতীয় পর্ব

 (পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

মজিদ স্যার বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ডায়েরীটার ভুমিকা অংশে দেখতে পেলেন সেখানে লেখা আছেঃ

' অামি আমার যাবতীয় জ্ঞান এবং উপলব্দি দিয়ে যা বুঝেছি, তা হলোঃ ঈশ্বরকে উপলব্দি করা। 
ঈশ্বর কি? এবং কেন তিনি এ বিশ্ব জাহান তৈরী করলেন? এর পেছনে কি উদ্দেশ্য আছে? তা জানা প্রতিটি মানবেরই মহান দায়িত্ব। কেননা, তাকে না জানলে এবং না বুঝলে কেন তিনি এই বিশ্ব জাহান তৈরী করেছেন, সেই মুল উদ্দেশ্য জানা সম্ভবপর নয়। তাই প্রতিটি মানবেরই প্রধান এবং প্রথম দায়িত্ব হলোঃ ঈশ্বরকে জানা এবং তার এই বিশ্ব জাহান সৃষ্টির মুল উদ্দেশ্য জেনে সেই অনুপাতে কর্ম করা। আমি এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমার পুত্রকে কিছু উপদেশনামা এবং করণীয় কর্তব্য সমুহ তুলে ধরার জন্যই এই ডায়েরীতে তা লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। যাতে আমি না থাকলেও তার যেন চলতে ফিরতে কোন প্রকার সংশয় উপস্থিত না হয়। সে যেন বিনা দ্বিধায় এই ধরণীর কর্ণ্টকময় পথ অতিক্রম করে যেতে পারে।'

মজিদ স্যার বুঝতে পারলেন না, এই এতটুকু শিশুর কাছে এই ডায়েরীতে যা লেখা আছে, তা সে কিভাবে উপলব্ধি করবে? ছেলেটি সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। এই ছেলের বুঝই কতোটুকুই হয়েছে? সে কিভাবে এই মহান ঈশ্বরকে উপলব্দি করবে? তিনি মনে মনে ভাবলেনঃ লোকটির কি মাথা খারাপ ছিল না-কি? মাথা খারাপ না হলে এই এতটুকু ছেলের হাতে কেউ এমন দার্শনিকভংগীতে লেখা ডায়েরীটা তুলে দিতে পারে না....আমার ধারণা, লোকটার মাথা খারাপ ছিল এবং অবশ্যই উদভ্রাণ্ত এবং পাগল প্রকৃতির কেউ ছিলেন। এ কথাটা মনে করে তিনি হাসলেন। তারপর তাকালেনঃ নিষাদের দিকে...দেখলেন, ছেলেটি মাথা নিচু করে পড়ছে। তিনি আর তাকে ডাকলেন না। তিনি আবারো সেই ডায়েরীটার পাতা উল্টালেন। দেখতে চাইলেন, ভেতরে কি লেখা আছে? পরের পাতা উল্টাতেই তার চোখে পড়লোঃ

প্রিয় নিষাদ,
বাবা, তুুমি কেমন আছো?
তোমার নিশ্চয়ই চিন্তা হচ্ছেঃ এই এতো বড় বিশ্বে তুমি কিভাবে চলবে? তোমার তো মা-বাবা কেউ নেই। কে তোমাকে লালন পালন করবে? কে তোমাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে? কে তোমাকে বাবার মতো শাসন করবে? আদর করবে? 
ভয় পেও না বাবা। জেনে রাখো, আমি এবং তোমার মা, তোমাকে জন্ম দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু তুমি এই ধরণীতে এসছো কেবল সেই পরম প্রভুর হুকুমে। সেই পরম প্রভুই তোমার প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা। তিনিই তোমার উত্তম অভিভাবক।
সার্বিকভাবে, আমরা তাঁকে চিনি না, জানি না, দেখি না, শুনি না অথচ তিনি আছেন। সেই উপলব্দিটা আমরা টের পাই যখন উপরের আসমানের দিকে তাকাই। আমরা যখন রাতের আকাশের দিকে তাকাই, তখন আমাদের মনে চিন্তা রেখাটা স্পষ্ট হয়। এই যে, মাথার উপর একটি অপরুপ আকাশ দিয়েছেন, নক্ষত্র খোচিত সুন্দর একটি চাঁদ দিয়েছেন, লালন-পালনের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস দিয়েছেন। প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন তারই মতোন করে সুন্দররুপে। তিনি নিশ্চয়ই সুন্দর। তাই, তাঁর সৃজিত প্রতিটি বস্তুই সুন্দর। শুধু্ উপলব্ধি করার মতো একটা সুন্দর হৃদয় পেলেই তুমি তাকে তোমার ভেতর আবিষ্কার করতে পারবে। কিভাবে? তাইতো ভাবছো? তাই না, বাবা....
শুন বাবা হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) তাঁর রচিত চিশতী উদ্যানে বলেছেনঃ

খোদার প্রেমে শরাব যদি করিতে চাহ পান ওহে মন
গড়িয়ে তোলো হৃদয়খানি, নহেতো হবে মিছে বিড়ম্বন।।
তনমন আপনা বিদায় কর ধরিয়া মুর্শিদের চরন
রাহাতে বসি থাকো সর্বদা যদি সে চাহ তার মিলন।।

তোমাকে একজন গুরুর কাছে যেতে হবে। যে তোমাকে এই শিক্ষাটা দেবেন। সেই শিক্ষানুযায়ী তুমি পথ চলিবে। তোমার ভেতর লূকিয়ে থাকা খান্নাসকে বের করে তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, তোমার সেই চিরাচরিত মহান সৃষ্টিকর্তাকে। সেই মহান সৃষ্টিকর্তা তোমার ভেতরই আছে। সেটা কোথায় লুকিয়ে আছে, তা তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। এই জন্যই বলা হয়েছেঃ 'রাহাতে বসি থাক সর্বদা, যদি সে চাহ তার মিলন' । তোমার মনে সেই অাশাটা পুষিয়ে রাখার জন্যই সর্বদা কথাটির উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে তুমি সবসময় তারই স্বরণে থাকো। শুন বাবা, তিনি আরো বলেছেনঃ

কাঁহা ছে আনা, কাঁহা ছে জানা, নাই নিশানা, নাই ঠিকানা
সে কিভাবে আসে, কিভাবে যায়.....তা তুমি নিজেই উপলব্দি করিতে পারবে...তখন তুমি আর তুমি থাকবে না...তোমার ভেতর থাকবে অন্য তুমি....এই অন্য তুমিটা টের পাবে তোমার ভেতর যে লাবডুব শব্দটা হচ্ছে....সেটার মাধ্যমে.....ইমানুয়েল কান্ট-এর ভাষায়ঃ
দুটি জিনিস আমার ভেতর ভয় ধরিয়ে দেয়। একটা হলো মাথার উপর খোলা অাকাশ অার অন্যটা হলোঃ আমার ভেতর যে কথা কয়.....
বাবা, আজ এ পর্যন্তই। যাবার আগে আবারো বলছি, তোমার প্রথম কাজ কি? তোমার প্রথম কাজ হলোঃ একজন গুরু তালাশ করা। পরিশেষে তোমার মঙ্গল কামনায়-

ইতি
তোমার বাবা


পুরো লেখাটা পড়ে মজিদ স্যারের ভ্রুু কুচকে গেল....তিনি মনে মনে ভাবলেনঃ এতো দেখছি মহান পুরুষ বানানোর দীক্ষা দেয়া হচ্ছে....তিনি আবারো নিষাদের দিকে তাকালেন...ছেলেরা কি পড়ছে না পড়ছে....তিনি তা বেমালুম ভুলে গেলেন...তিনি একবার ডায়েরীটার দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার নিষাদের দিকে তাকাচ্ছেন....
(চলবে)