পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

বাইয়াতঃ ইসলামী শরীয়তের আলোকে পীর-মুরিদ

ইসলামী শরীয়তের আলোকে পীর-মুরীদির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় দলিলঃ

পীর-মুরীদিঃ

পীর শব্দটি ফার্সি, আরবীতে বলা হয় মোর্শেদ । মোর্শেদ শব্দের অর্থ হল পথপ্রদর্শক। যিনি তরীকতের রাস্তায় খোদা-প্রাপ্তির প্রশিক্ষণ দেন তিনিই মোর্শেদ বা পথপ্রদর্শক, যাকে ফার্সীতে পীর বলা হয় ।
“মুরীদ” শব্দটি আরবী, যার অর্থ হল ইচ্ছাপোষণকারী, যিনি তরীকতের রাস্তায় বা খোদা-প্রাপ্তির রাস্তায় মোর্শেদ বা পথপ্রদর্শকের অধীনে থেকে খোদা অন্বেষণের শপথ / অঙ্গীকার করেন তিনিই মুরীদ ।

আর পীর মুরীদির এ পদ্ধতি রাসূল (সাঃ) থেকে চলে আসছে, রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের খোদামুখী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতেন, সাহাবা (রাঃ)-গণ রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে প্রশিক্ষণ নিতেন । তাই বলা যায় রাসূল (সাঃ) পীর, ও সাহাবা (রাঃ)-গণ হলেন মুরীদ।

ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক বাইয়াত প্রধানত পাঁচ প্রকার । যথাঃ

১.মাওলাইয়াতের বাইয়াত / খিলাফাতের বাইয়াতঃ - যা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্বের প্রতীক হিসেবে নেয়া হয়ে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা তার নিযুক্ত / মনোনীত ব্যাক্তির নিকট বাইয়াত গ্রহন করতে হবে । এক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই আওলিয়া পর্যায়ের মহা মানব হতে হবে । মুয়াবিয়া ও এজিদী চক্রান্তের কারনে বর্তমানকালে সময়ে এমন রাষ্ট্রনায়ক পাওয়া দুষ্কর । তবে রাসূল সাঃ ও তার আহলে বাইয়াতের মাওয়্লাইয়াতের / খিলাফাতের ধারা বর্তমানেও প্রবাহমান ও চিরকাল বিরাজ থাকবে অতএব রাসূল সাঃ ও তার আহলে বাইয়াতের মাওয়লাইয়াতের / খিলাফাতের ধারা অনুস্মরণ করে অলী পর্যায়ের মহা-মানবের নিকট বাইয়াত গ্রহন করা অত্যাবশ্যক ।

২.বাইয়াতে ইসলামঃ - তথা ইসলাম গ্রহণের জন্য বাইয়াত নেয়া । অন্য ধর্মের অনুসারী বা কোন ধর্মের অনুসারীই নয় এমন কেহ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করিতে চাইলে, রাসূল সাঃ ও তার আহলে বাইয়াতের মাওলাইয়াতের / খিলাফাতের ধারা অনুস্মরণ করে বাইয়াত গ্রহন করিতে হইবে ।

৩.শপথের বাইয়াতঃ - তাকওয়া পরহেযগারীতে অগ্রগামী হবার জন্য একাধিকবার বাইয়াত গ্রহন করার বিধান রয়েছে, যাকে বাইয়াতে তাসাওউফ-ও বলা হয় । একাধিকবার বাইয়াতের বিধান থাকিলেও এর মানে এই নয় যে পুঃন পুঃন বাইয়াতের শর্ত ভঙ্গ করিয়া নতুন করিয়া বাইয়াত গ্রহন করিবে । শুধুমাত্র তাকওয়া ও পরহেযগারীতে দৃঢ় থাকিবার জন্যই এই প্রকারের বাইয়াত গ্রহন করিবার বিধান রয়েছে ।

৪.বাইয়াতে যিহাদ ও হিজরতঃ - রাসুল সাঃ, যিহাদে গমন অথবা কাফেরদের জুলুম ও অত্যাচারে অতিষ্ট হইয়া রাষ্ট্র বা ঐ অঞ্চল ছেড়ে অন্যস্থানে চলে যাওয়ার প্রাকালে এই প্রকার বাইয়াত করিতেন ।

৫.জিহাদের ময়দানে দৃঢ় থাকার বাইয়াতঃ - যদি কখনো যিহাদের ময়দানে ভয়ে পালিয়ে যাবার শংকা দেখা দেয়, তখন আমীরে জিহাদের তথা যিহাদের নেতৃত্ব-দানকারীর হাতে দৃঢ়তার বাইয়াত গ্রহণ আবশ্যক ।

প্রথম প্রকারের বাইয়াত গ্রহন করা প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কোরআন ও হাদীসে উক্ত বাইয়াতের উপরে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে যা গ্রহন না করিলে তার মৃত্যু হবে জাহেলের ।

পবিত্র কোরআনে আলোকে বাইয়াতঃ

সুরাঃ মায়েদা-র ৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ " হে ঈমানদার-গণ ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, এবং তার নৈকট্য লাভের জন্য অছিলা ( অলী পর্যায়ের মুর্শীদ ) তালাশ কর। "

সুরা নিসা-র ৫৯ নং আয়াতে বলেনঃ " হে ইমানদার-গণ ! তোমরা অনুস্মরণ কর, আল্লাহ্ পাক এর, তাঁর রাসুল পাক (সাঃ) এর এবং তোমাদের মধ্যে যারা উলিল আমর (ধর্মীয় নেতা)। "

সূরা বনি ইসরাইল-র ৭১ নং আয়াতে বলেনঃ " স্মরণ কর! সেই দিনকে যেদিন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাঁদের (ইমাম) নেতা সহ আহবান করব। "

সুরা লোকমান-র ১৫ নং আয়াতে বলেনঃ " যে বিশুদ্ধ চিত্তে আমার অভিমুখি হয়েছে তাঁর পথ অনুস্মরণ কর। "

সুরা আম্বিয়া-র ৭ নং আয়াতে বলেনঃ " জিকির সম্বন্ধে তোমাদের জানা না থাকলে (আহলে জিকির / জিকিরের মধ্যে বসবাসকারীদের) যিনি জানেন তাঁর নিকট হতে জেনে নাও।"

সুরা তাওবাহ-র ১১৯ নং আয়াতে বলেনঃ " হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (ছাদেকিন) সত্যবাদী গণের সঙ্গী হয়ে যাও। "

সুরা  কাহাফ-র ১৭ নং আয়াতে বলেনঃ " আল্লাহ্ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত হয় এবং তিনি (আল্লাহ্) যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন পথপ্রদর্শনকারী (অলি-মুরশিদ) পাবে না ।"

সুরা ইউনুছ-র ৬২-৬৪ আয়াতে বলেনঃ "সাবধান! নিশ্চয় আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নেই, এবং তারা কোন বিষয় এ চিন্তিতও নহে, তাঁদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর কথার কোন পরিবর্তন হয় না, উহাই মহা সাফল্য। "

সূরা ফাতিহা-র ৬,৭ আয়াতে মহান আল্লাহ প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন এই বলে যে, "আমাদের সরল সঠিক পথ (সীরাতে মুস্তাকিম) দেখান, যা আপনার নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের পথ ।"

সূরা ফাতহ-র ১০ নং আয়াতে বলেনঃ "হে রাসুল,যাহারা আপনার হাতে বাইয়াত (আনুগত্যরে শপথ) করে, তারা-তো আল্লাহর হাতেই আনুগত্যেরে শপথ করে, আল্লাহর হাত তাহাদের হাতরে উপর রয়ছে, অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে, অতি অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যই করে এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার র্পূণ করে আল্লাহ সত্ত্বরই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন।"

হাদিসের আলোকে বাইয়াতঃ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ "আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা রাখবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি । আমার বান্দা আমি তার উপর যা ফরয করেছি তার চেয়ে আমার কাছে বেশী প্রিয় কোন ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জণ করতে পারে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জণ করতে থাকে, এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অব্যশই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে এটাতে কোন রকম দ্বিধা সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা সংকোচ মু'মিন বান্দার প্রাণ হরণে করি। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট অপসন্দ করি।"
==> সহীহ বুখারী ৬৫০২

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, "যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে হাত সরিয়ে নেয় সে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন দলীল বিহীন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে । আর যে ব্যক্তি বাইয়াত গ্রহণ করা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করল, সে ব্যক্তি জাহিলী যুগের ন্যায় মৃত্যুবরণ করল ।“
==> মুসলিমঃ হাদীস নং- ৪৮৯৯

আউফ বিন মালিক আশজাঈ রাঃ বলেন, আমাদের সাত বা আট নয়জন লোকের উপস্থিতিতে রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা কেন রাসূল (সাঃ) এর কাছে বাইয়াত হচ্ছো না? অথচ আমরা ইতোপূর্বে বাইয়াত গ্রহণের সময় তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছি। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরাতো আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, তোমরা কেন রাসূল সাঃ এর কাছে বাইয়াত হচ্ছো না? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ইতোপূর্বে বাইয়াত হয়েছি। তিনি পুনরায় বললেন, তোমরা কেন রাসূল সাঃ এর কাছে বাইয়াত হচ্ছো না?

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরাতো ইতোপূর্বে আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি। এখন আবার আপনার কাছে কিসের বাইয়াত নিবো? তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না, সালাত কায়েম কর এবং আল্লাহর আনুগত্ব কর। তিনি আর একটি কথা বললেন চুপে চুপে। তা হল-লোকের কাছে কোন কিছুর জন্য হাত পাতবে না। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমি দেখেছি, সেই বাইয়াত গ্রহণকারী দলের কারো কারো উটের পিঠে থাকা অবস্থায় হাত থেকে চাবুক পরে গেছে কিন্তু সে কাউকে তা তুলে দিতে অনুরোধ করেনি, বরং সে নিজেই নিচে নেমে তুলে নিয়েছে।
==> সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১০৪৩

উরওয়া থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহিলাদের বাইয়াত বিষয়ে আম্মাজান আয়শা (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (সাঃ) কখনোই মহিলাদের হাত স্পর্শ করেননি। বরং তিনি মুখে মুখে বাইয়াত নিয়ে নিতেন। বাইয়াত হয়ে গেলে বলতেন, যাও! তোমাকে আমি বাইয়াত করে নিয়েছি।
==> সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৬৬

ফাতেমা বিনতে মুসা ইবনে জাফার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ "জেনে রাখ! যে ব্যক্তি আহলে বাইত তথা অলি-আউলিয়ারদের এর ভালবাসা অন্তরে নিয়ে মৃত্যুবরণ করে , তার মৃত্যু শহীদের মৃত্যুর ন্যায় হবে ।"
==> তিরমিজি শরিফ

হযরত আহমদ বিন হাম্বল (রাঃ) ও হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত - রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ "আল্লাহর অলি-আওলিয়ারা বিনা হিসাবে ৭০ লাখ ভক্ত বা মুরিদানকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবেন ।"
==> বায়হাকি শরিফ

[কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হোসাইন অাল অামিন ]