পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭

তুমি র'বে নীরবে-শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)
আজানের শব্দ শুনে মুসল্লীগণ মসজিদের পানে ছুটছে। অনেকেই তাড়াহুড়ো করছে জামাত ধরার জন্য। মুসল্লীদের জন্য নামাজের আহব্বান যেন মহান প্রভুর সান্নিধ্য পাবার জন্য নির্ধারিত। যাদের অন্তরে প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা আছে, আছে ভক্তি - বিশ্বাস, কেবল তারাই জানেন, মহান আল্লাহ পাক রব্বুল অালামিন কতোটা দয়া পরবশতঃ হয়ে এই নামাযের ব্যবস্থা করেছেন। অামি তেমন একটা নামায পড়ি না। অধিকাংশ সময়ই শুক্রবার দিন জু্ম্মাার নামায পড়তে চেষ্টা করি। আর ঈদের নামাজতো আছেই। কাজেই এই অামার সালাত হলো সালাতুল বছর। 

অামি দেখলাম, শ্বেতা তার ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। অাজান শুনলে কেন জানি না, অনেক মেয়েকেই দেখি, মাথায়ঘোমটা টেনে দেয়। কিন্তু কোন পুরুষকে মাথায় টুপি পড়তে দেখা যায় না...বিষয়টা কেমন যেন মনে হলেও বাস্তব।

ঘোমটা দেয়া শ্বেতাকে বেশ লাগছে। কপালে লাল রংয়ের টিপ দেয়ায় কেমন যেন একটা হিন্দুয়ানীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে শ্বেতা যেন হিন্দুঘরানার কোন কুল বধু। আমি শ্বেতাকে বললামঃ

-চলো ওঠা যাক।

-কোথায় যাবে?

-বললাম না...যেদিকে দু'চোখ যায়...নিজের ইচ্ছে মতো চালাব। অজানার উদ্দেশ্যে। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...মনে মনে...

-এ্যাই বলো না কোথায় যাবে?

-জানি না। কেন? তুমি কোথাও যেতে চাও?

-নাহ্। আজ আমি তোমার সাথেই থাকতে চাই। তবে অবশ্যই রাত আটটার মধ্যেই আমাকে বাড়ী যেতে হবে।

-ঠিক আছে। অামি তোমাকে সাতটার মধ্যে ছেড়ে দেব। ইচ্ছে করলে তোমাকে বাড়ী পর্যন্ত পৌছে দিতে পারি? যদি তুমি রাজী থাকো?

-না বাবা। অামাকে যদি দেখে তোমার সাথে বাইকে চড়ে বাড়ীতে অাসছি, তাহলে বাবা আমাকে অাস্ত রাখবে না....

-আরে বাবা, কেউ দেখতেও পারবে না....তোমাকে তোমার বাড়ীর কাছাকাছি একটা স্থানে নামিয়ে রিক্সা ধরিয়ে দেব। সেটাতে চড়ে তুমি বাড়ী চলে যেও....এখনতো সবে মাত্র সন্ধ্যা হলো। মাত্র বাজে ছ'টা দশ। এখনো অনেক সময় বাকী আছে...তুমি দেরী করো নাতো....তাড়াতাড়ি বাইকে চড়ে বসো। 

-কোথায় যাবে?

-এই শ্যুটিং ক্লাবের দিকে। একটা চক্কর দিয়েই তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দেব।

আমার কথা শুনে শ্বেতা কিছু বললো না। সে নীরবে আমার সাথে হাঁটা আরম্ভ করলো। আমরা রাস্তাটা পার হয়ে পার্ক করা স্থানে গেলাম। সেখানে গিয়ে বাইকে চেপে বসলাম। পিছন ফিরে শ্বেতাকে দেখলাম, সে যেন মোবাইলে কি যেন খুঁজছে। হয়তো কোন গান হবে। দেখলাম হেড ফোন লাগিয়ে মোবাইলটা তার পার্সে রেখে দিল। মোবাইলের তারটি বের হয়ে কানের নিচে ঝুলে রইলো। দু'কান হতে গলার নিম্নভাগে বুকের কাছে সেটা সমতা বিধান করে নিচের দিকে নেমে গেছে। অামি শ্বেতাকে বললামঃ

-প্লিজ, একটু তাড়াতাড়ি করো না...অাকাশটা হটাৎ কেমন যেন বদলে গেছে...মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।

-অারে বাবা আসছি তো... 

শ্বেতার আমার বাইকে চড়ে বসলো। আমি বাইক স্ট্যাট দিয়ে শুটিং ক্লাবের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেই চিরচেনা নিয়মে মাঝে মাঝে ব্রেক কষছি। আর শ্বেতার নরোম বুকের স্পর্শ আমার পিঠে আঘাত করছে। শ্বেতা কিছুটা ভয় পেয়েছে কি-না কে জানে? সে হটাৎ করেই আমাকে জাপটে ধরলো। তার বুকের স্পর্শ আমাকে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে। সে আমার ঘাড়ের দিকে নোখ দিয়ে আঁচড় কাটছে। আবার জপটে ধরে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর মতো ভংগী করছে...আমি মাঝে মাঝেই অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছি। শ্বেতাকে বললামঃ

-একটা বিষয় খেয়াল করেছো?

-কি?

-আজ আমরা কোন ছবি তুলিনি। কোন সেলফিও তুলিনি...মনে হয় যেন সব ভুলে বসে আছি...

-তাহলে এখন তুলি....

-নাহ থাক্....তুমি কি গান শুনছো?

-রবীন্দ্র সংগীত। মোনালি ঠাকুরের গাওয়া....কেন? তুমি শুনবে? 
একথা বলেই শ্বেতা তার কানের একটা হেড ফোন লাগিয়ে দেয় আমার ডান কানে। আমি ও শ্বেতা দু'জনেই শুনছি-

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
 মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
 তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥

হটাৎ করেই বৃষ্টি পড়ার মাত্রাটা বেড়ে গেল। আমি বাইকটার স্প্রীড বাড়িয়ে দিলাম। সামনে যে ব্রীজটা আছে সেটা তাড়াতাড়ি পাড় হতে হবে। ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হলে হয়তো জ্বর আসতে পারে। তাছাড়া শ্বেতা ভিজে গেলে আরো বিপদ। আমি তখন স্প্রীড তুলে দিয়েছি প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি...যখন ব্রীজটা পার হলাম ঠিক সেই মুহুর্তে কোথা হতে একটা প্রাইভেট কার সামনে এসে পড়লো। আমি টাল সামলাতে না পেরে সরাসরি প্রাইভেট কারের সংগে লাগিয়ে দিলাম। একটা বিকট শব্দ হলো। এরপর আমার কিছু মনে নেই।

দুদিন পর আমার জ্ঞান ফিরলো। নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে। আমার বাঁ পা'টা ভেংগে গেছে। মাথায় ব্যান্ডজ। মুখের বাঁ দিকটা মনে হয় প্রচন্ড ব্যাথায় কাতর হয়ে যাচ্ছি। কথা বলার শক্তি পাচ্ছি না। ডানে বামে তাকালাম। শ্বেতা কোথায়? তাকে তো দেখছি না? দেখছি কেবল আমার মা-বাবা ভাই বোনকে। আত্মীয়-স্বজন সবাই ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ খুলতেই সবাই কেমন যেন চমকে উঠলো। আমার ছোট বোনটা চিৎকার করে কেঁদে ফেললো।

-দাদা, তুই বেঁচে আছিস?

আমি ফিসফিস করে বললামঃ

-শ্বেতা কোথায়?

-ও আছে। বেঁচে আছে। এই হাসপাতালেই ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে।

-আমাকে নিয়ে চল। অামি ওকে দেখবো?

-তুই কিভাবে যাবি? তোরতো পা তো.......একথা বলেই মুন্নি কেঁদে ফেললো।

মুন্নি আমার ছোট বোন। ছোট হলেও সে ইঁচড়ে পাকা...আমার আর শ্বেতার ব্যাপারটা ও জানে। আমি আমার পরিবার থেকে সম্পুর্ণ পৃথক থাকি। তারা থাকে বনানীতে। আর আমি হাজিপাড়ার একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকি। পড়া শোনা করার জন্য। আমি একসিডেন্ট করেছি শুনে তারা সবাই এসেছে। কিন্তু খবর পেলো কিভাবে? কে তাদের খবর দিল? আর কে-ই বা হাসপাতালে নিয়ে এলো? এ সমস্ত প্রশ্নগুলো যেমন ঘুরপাক খাচ্ছে, তেমনি ঘুরপাক খাচ্ছে শ্বেতা কেমন আছে? তাকে দেখতে মন চাইছে....আমি বললাম 

-একটা হুইল চেয়ার নিয়ে আয়...

একটা হুইল চেয়ারে আমাকে বসানো হলো। আমি সেটাতে চড়ে বসলাম। সাথে আমার ছোট বোন। আর আমার এক খালাতো ভাই মানিক। মানিক ঠেলে ঠেলে হুইল চেয়ারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ইনটেনসিভ কেয়ারের রুমটার দিকে। যেখানে শ্বেতাকে রাখা হয়েছে। অামি সেখানে ঢুকতে চাইলাম। কিন্তু ডাক্তার আমাকে ভেতরে ঢূকতে দিলো না। অামি বাহির থেকে শ্বেতাকে দেখছি। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে। পুরো শরীরটা সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। পাশের মেশিনটাতে একটা সবুজ রেখা আপ-ডাউন করছে। সু-সান নীরবতা চারদিকে। কেউ কোন কথা বলছে না। শ্বেতার পাশে বসা একজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শ্বেতার মা। আমি ওর মা-বাবাকে কখনো দেখিনি। কথাও হয়নি কোন দিন। অার কোনদিন হবেও না। মানিকের কাছে শুনলামঃ শ্বেতাকে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা করেছে ডাক্তাররা। যে কয়দিন বেঁচে থাকবে,এভাবেই থাকতে হবে ওকে। 

ডাক্তার যা-ই বলুক, শ্বেতা বেঁচে থাকবে চিরদিন চির জীবন। যতো দিন আমি বেঁচে থাকবো, ততোদিন শ্বেতাও বেঁচে থাকবে। আমি মানিককে বললামঃ

-তোরা চলে যা। আমাকে একটু একা থাকতে দে..

ওরা সবাই চলে গেল।আমি কান্নায় ভেংগে পড়লাম। চোখের দু'ধার দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অজস্র্র জলরাশি। সেই জলস্র্রোত যেন শ্বেতাকে স্পর্শ করছে না...হৃদয়ের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আমার মন-প্রাণ। কিন্তু তাতেও সাড়া মিললো না শ্বেতার। আমি আবারো আস্তে আস্তে করে ডাকলাম......শ্বেতা। নাহ্ ওর ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গছে না...ও ঘুমাক। 

অামি ইনটেনসিভকেয়ারের সামনের কাঁচের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার শ্বেতাকে। শ্বেতাকে স্পর্শ করতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে আমি এক পালক ভাংগা কপোত হয়ে আমার কপোতীর কাছে যেতে পারছি না। 

কেন আমি বেঁচে রইলাম? কেন আমি শ্বেতার মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারলাম না...যমদুত কেন আমাকে দেখলো না...স্র্রেফ আমার ভুলের কারণেই কি আজকে শ্বেতার এই অবস্থা....এর জন্য কি আমি দায়ী.....না আমার গতি...কোন টা....যেটাই হোক শ্বেতা...তুমি আমার। কেবলই আমার। আমার নিঃশ্বাসে, আমার বিশ্বাসে। আমার প্রাণে...আমার হৃদয়ে....তুমি র'বে নীরবে।