পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩ মে, ২০১৫

পরিযায়ী পাখির গল্প

তোমাকে একটা গল্প শোনাই। শোনঃ
এই বলে রহিম ভাই তার গল্প আরম্ভ করলো-
শান্ত সবুজ এক ছোট্ট গ্রাম। ফসল ভরা মাঠ, গোয়াল ভরা গরু আর উঠোন ভরা হাঁস-মুরগি নিয়ে সচ্ছল গ্রামের প্রতিটি ঘর। এ গ্রামেরই এক গৃহস্থের বাড়িতে একবার এক মুরগি তা দিয়ে ফোটালো অনেকগুলো ছানা। কিন্তু একি! মুরগিছানাদের সঙ্গে ডিম ফুটে বেরোনো এই কিম্ভূতকিমাকার ছানাটি কে? দেখতে হাঁসের মতো। কিন্তু কী কুশ্রী আর কদাকার! কী করে এলো এখানে? কেনই বা সে অন্যদের চেয়ে আলাদা?
গৃহস্থ বাড়ির এক চিলতে উঠোনে জীবন শুরু হলো তার। কেউ তাকে ভালবাসে না। সুযোগ পেলেই ছোট ছেলে-মেয়েরা খোঁচায়, মুরগিছানারা তাড়া করে, কাক ভয় দেখায়। খাবার তার আবর্জনা আর গৃহস্থের ফেলে দেয়া ঝুটাকাঁটা, তা-ও বাকিরা খেয়ে যাবার পর যা পাওয়া যায়। একমাত্র আপন তার মা-মা মুরগি। সব ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও এই মায়ের কাছেই খুঁজে পায় একটু আশ্রয়।
এভাবেই চলছিলো জীবন। আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে সে। মাঝে মাঝে সে অনুভব করতো জোরে দৌড়াতে গিয়ে সে যেন খানিকটা ভেসেও যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি সে।
একদিনের কথা। কোনো কারণে সব মুরগিছানারা মিলে তাড়া করলো তাকে। প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে এক হ্রদের ধারে গিয়ে থমকে গেল। এখন সে কী করবে? আর একটু এগুলেই যে হ্রদে পড়ে যাবে। কিন্তু সে তো কখনো পানিতে নামে নি। পেছানোরও কোনো উপায় নেই। এদিকে তার মা-মুরগিও পেছন পেছন ছুটে এসেছে।
হঠাৎ পানিতে চোখ গেল তার। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলো সে। এরপর দৃষ্টি গেল ঐ পাড়ের এক ঝাঁক হাঁসের দিকে। কী আশ্চর্য! হুবহু তার মতোই দেখতে। অবাক বিস্ময়ে সে একবার তাকাচ্ছে ঐ হাঁসদের দিকে, একবার তার মায়ের দিকে, আর একবার হ্রদের পানিতে তার প্রতিবিম্বের দিকে। সে তো তার মায়ের মতো নয়, নয় এতদিন যাদের সাথে কাটিয়েছে সেই মুরগিছানাদের মতো। বরং মেরুদেশ থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা ঐ পরিযায়ী পাখিদের একজন সে। শীতার্ত পরিবেশ থেকে বাঁচতে নাতিশীতোষ্ণমন্ডলে উড়ে আসা এক মা-পাখির ডিম থেকে ঘটনাচক্রে যার জন্ম হয়েছিলো ঐ গৃহস্থের বাড়িতে।
কী অবলীলায় হাঁসগুলো উড়ছে, পানিতে নামছে! সে-ও তো তা-ই পারে! বুঝলো সে-এই তাড়া খাওয়া, আবর্জনা খুঁটে খাওয়ার জীবন তার নয়, নীল আকাশের উঁচুতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়ার দৈহিক সামর্থ্য নিয়ে জন্মেছে সে।
প্রথমবারের মতো সে নিজেকে জানলো। বুঝলো, গৃহস্থের উঠোনের ক্ষুদ্র গন্ডি ছেড়ে তাকে উড়াল দিতে হবে অনন্ত আকাশে। দুফোঁটা চোখের জল ফেলে মা-মুরগিও তাকে বিদায় জানালো। কারণ ক্ষুদ্র মমতার বন্ধন দিয়ে সে তার ছানার সম্ভাবনাকে গন্ডিবদ্ধ করতে চায় নি। নভোনীলিমায় ডানা মেলে দিলো হাঁসছানা আত্মপরিচয় সৃষ্টির নতুন অভিযাত্রায়।

-কি বুঝলেন? সোলেমানের দিকে তাকিয়ে রহিম ভাই জিগ্যেস করলো।
- ভাই কি কমু? গল্পতো গল্পই। এর মইধ্যে বোঝাবুঝির কি আছে?
-আরে ভাই না থাকলে কি আপনাকে জিগ্যেস করছি? আছে বলেইতো আপনাকে জিগ্যেস করলাম। না থাকলেতো আপনাকে কথাটা জিগ্যেস করতাম না। যদি আপনি গল্পটা ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তাহলে এর মধ্যে পেতেন একটা মুল্যবান শিক্ষা।

-শিক্ষা !

-আরে ভাই অবাক হওয়ার কিছুই নাই। আল্লাহ পাক জগতে সকল কিছুর মধ্যেই কিছু না কিছু গোপন রহস্য রেখে দিয়েছেন। আর সেই রহস্যগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে বলেছেন। সুরা ইউসুফের ১০৫ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ-
وَكَأَيِّن مِّن آيَةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ يَمُرُّونَ عَلَيْهَا وَهُمْ عَنْهَا مُعْرِضُونَ
অনেক নিদর্শন রয়েছে নভোমন্ডলে ও ভু-মন্ডলে যেগুলোর উপর দিয়ে তারা পথ অতিক্রম করে এবং তারা এসবের দিকে মনোনিবেশ করে না। [সুরা ইউসুফ: ১০৫]
আপনি হচ্ছেন তাদের মধ্যে একজন যে মাটির উপর দিয়ে হেঁটে যায় অথচ কোন শিক্ষা নেয় না।
রহিম ভাইয়ের কথা শুনে সোলেমান কিছুটা লজ্জা পায়। কিন্ত্তু গল্পটার মধ্যে কি শিক্ষনীয় আছে তা জানার জন্য সে পুণরায় রহিম ভাইয়ের কাছে আরয করলোঃ
-ভাই, আল্লায় কি সবাইরে সব গ্যান দিছে? আল্লায় আপনেরে গ্যান দিছে দেইখ্যাইতো আপনার কাছে আহি। দুইডা ভালা কতা হুনার লাইগ্যা। নাইলে কি আর আপনার কাছে খালি খালি আহি?
সোলেমানের কথা শুনে খাণিকটা রহিম সাহেব একটু নড়ে চড়ে বসেন। তারপর সে গল্পের বিষয়বস্তুটা খুলে বলার চেষ্টা করে। 
শোনো-এই গল্পটার মধ্যে যে হাঁসের ছানার কথা বলা হয়েছে-সেটা হলো আমাদের রুহ। রুহ জাগ্রত হলে সে তার আপনরুপ ধারণ করে। আমাদের দেহের মধ্যে যে আত্মা আছে সেই আত্মার সাথেই রুহ দেহে প্রবেশ করে। সেই রুহ হচ্ছে পরআত্মার অংশ যা মুহিত অবস্থায় বিরাজিত । তাকে জানতে হলে তার অংশ দিয়েই তাকে চেনা যাবে। সেই অংশটাই হলো - রুহ। কারণ রুহ কোন সৃষ্টিজাত পদার্থ নয়। সেটা হলে বিজ্ঞানীরা বহু পূর্বেই রুহকে আবিস্কার করে ফেলতেন। পন্ঞ্চ উপাদানে যে দেহ তৈরী - তা বিজ্ঞানীরা সিনথেটিক পদার্থ দ্বারা তৈরী করতে পারেন। একজন কুম্ভকার মৃত্তিকা দ্বারা পুতুল তৈরী করতে পারেন। কিন্ত্তু রুহ না থাকার কারণে তারা প্রাণচাঞ্চল্য পায় না। অর্থাৎ তারা জীবিত নয়। কারণ "নাফাকতু ফি মিররুহ" না থাকার কারণে সেটা মৃতবৎ পদার্থ। আর রুহ সর্ম্পকে জানার আগ্রহ নিয়ে যখন ইহুদীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াস সাল্লামকে জিগ্যেস করলো তার প্রতি উত্তরে নবীজির জবানে আল্লাহ বললেন-কুল্লির রুহ মিন আমরি রাব্বি। এই আমর তখনই কার্যকর হয় যখন সেটার উপর তাওয়াক্কুল করা হয়। সেটাই রব। সেটাই পালনকর্তা। তার হুকুম আহকাম মেনে তার নির্দেশিত পথে চললেই সেই সৃষ্টি হয়ে যায় একটা আয়াত তথা নির্দশন। এই রবই হচ্ছে সেই পরিযায়ী পাখি। যা আপন দেহে মুহিত অবস্থায় আছে। তাকে জানলেই সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পাওয়া সম্ভব। নচেৎ নয়।

রহিম সাহেবের কথা শুনে সোলেমান হা করে রহিম সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।