পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০১৫

দেহ নৌকা


শ্রাবণের বারিধারায় সিক্ত করিম মাঝি তার নাও খান নিয়ে প্রতিদিনের ন্যায় পদ্মায় যাত্রী পারাপার করে। যাত্রীরা তাকে যা দেয় তাতে তার সংসার কোনরকম চলে যায়। সংসার বলতে তার এক মেয়ে দুই ছেলে এবং তার স্ত্রী জমিলা খাতুন। পাঁচ সদস্যের সংসার। সংসারে রোজগার পাতি বলতে ঐ নৌকাখানিই তার ভরসা। মালিকের দয়ায় কোন রকম চলে যায়। কিন্ত্তু টানাটানি লেগেই থাকে। এ নিয়ে সংসারে মাঝে মধ্যে তার স্ত্রীর সাথে কথাকাটি হয়। কিন্ত্তু কি করবে? সেতো নৌকা চালানো ছাড়া অন্য কোন কাজই জানে না। আর এই যান্ত্রিক যুগে সবাই বোটে চড়েই নদী পার হয়। আগে যা আয় হতো এখন তাও হয় না। ভাবনায় করিম মাঝি একপ্রকার হারিয়ে যায় অদুর ভবিষ্যৎ নিয়ে। কি করবে সে? তার ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন কবির সিকদার ডাক দেয়। কবির সিকদার গ্রামে বিচার আচার করে। সিকদার বংশের মান রক্ষা করা যেন তার দায় হয়ে পড়েছে। সে দায় সে যথাযথভাবেই পালন করছে। দু'চার গ্রামের মানুষ এখন তাকে চেনে। তার ডাক শুনে করিম মাঝি সাড়া দেয়।

-আরে ভাই আপনি সাত সকালে কি মনে কইর‌্যা?

-তোমার নাও লইয়া আমি রহিমপুর যামু। আমার পীর সাহেব আসবে। সে নৌকা নিয়ে আসতে বলেছে। তাই ভাবলাম তোমারে লইয়া যাই। তাছাড়া তুমিতো আমাগো গেরামেরই মানুষ। তোমারে লইয়া গেলে আমি নিশ্চিত থাকতে পারি আর কি? এই জন্যই তোমার কাছে আইছি। তুমি কি যাইব্যা?

করিম মাঝি যেন অকুল দরিয়ায় কুলের সন্ধান পেয়েছে। সে সানন্দে রাজি হয়ে যায়। বলে

-কখন যাইবেন ভাই?

-এই ধরো সাতটার দিকে।

-ঠিক আছে। আমি নাও লইয়্যা তৈরী থাকুম নে। আপনে আইস্যা সবকিছু রেড়ী পাইবেন।

কবির সিকদার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে জানে করিম ভাই ভালো মানুষ। সব কিছুতেই তার আগ্রহ। তাছাড়া সে গুরু ধরা মানুষ। তার সাথে দু'চার কথা শোনাও যেতে পারে। তিনি আর দাঁড়ালেন না। হন হন করে হেঁটে বাজারের দিকে চলে গেলেন। তখন বাজে প্রায় সাড়ে ছয়টা। বাজার থেকে কিছু খাবার কিনলেন। পথে খিদে লাগলে খেয়ে নেবেন। তাছাড়া তার পীর সাহেব আসছেন। তাকেতো আর উপোষ রাখা যায় না। তাই তাড়াতাড়ি খাবার কিনে তিনি ঘাটে আসলেন। এসে দেখেন করিম ভাই নৌকাটা ভালো ভাবে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখছে। ঝক ঝক করছে নৌকাটি। কবির সিকদার আর অানোয়ার তার নৌকায় উঠলেন। করিম মাঝি গুরুকে স্বরণ করে নৌকাখানি ছাড়লেন।

নৌকাটি রহিমপুর আসতে ঘন্টা তিনেক লেগেছে। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। রহিমপুরে তার পীর সাহেব দবির শাহ্ ও তার চারজন সংগী অপেক্ষা করছে। কবির সিকদারকে দেখে তারা আনন্দে উদ্দেলিত হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর তারা নৌকায় উঠলেন।

করিম মাঝি দবির শাহ্ কে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাকে ভক্তিভরে কদমবুছি করলেন। তারপর তাকে বললেনঃ

-হুজুর আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার নাম করিম মাঝি। অামি এই নাও চালাইয়া সংসার চালাই।

-ফি আমানিল্লাহ। আল্লাহ কারিম। তোমার নাওখানতো বেশ পরিপাটি দেখছি।

-হুজুর আপনে আসবেন শুইন্যা নৌকাটা ভালোভাবে ধুইয়্যা পরিস্কার করছি।

-তা বেশ।

-তা তোমার সংসারে ছেলে মেয়ে কয়জন?

-হুজুর, দুই ছেলে এক মেয়ে। মাইয়্যাটা বড়।

-হুম। ভালো।

করিম মাঝি সেখান থেকে উঠে নৌকা ছাড়লেন। নৌকাখানি স্রোতের টানে তর তর করে এগিয়ে চলছে।  বৈঠার শব্দ আর জলতরংগের শব্দ ছলাৎ ছলাৎ শুনতে দবির শাহ্ কি যেন চিন্তা করলেন। গভীর ধ্যানের মতো তন্ময় হয়ে চোখ বুজেঁ রইলেন। ক্ষাণিক বাদে তিনি তাকিয়ে করিম মাঝিকে বললেনঃ

-ও মিয়া। নুহ নবীর কিস্তির কাহিনী জানো?

-নাহ্ হুজুর। তয় ভাসা ভাসা হুনছি।

-শুন মিয়া। হযরত নুহ নবী (আঃ) আল্লাহর পয়গাম যখন দুনিয়াতে তার কওমের কাছে পৌঁছাইলেন তখন তার কওমের লোকেরা তার কথা না শুনে অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকলো। অনেক বলা কওয়ার পরে কিছু লোক তার উপর এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনলো। আর বাকী যারা তারা যখন আল্লাহর পয়গাম গ্রহণ করতে চাইলো না, তখন নুহ (আঃ) আল্লাহর কাছে এর প্রতিকার চাইলেন। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তাকে জানাইলেন যে খুব শীঘ্রই তিনি প্লাবন দিবেন। অর্থাৎ দুনিয়া তলাইয়া দিবেন। আর নুহ নবী(আঃ) কে হুকুম করলেনঃ জোড়ায় জোড়ায় প্রত্যেকটি জীব জন্ত্তু তার নৌকায় উঠানের জন্য। নুহ(আঃ) সেই বার্তাও তার কওমের লোকদের জানাইলেন। কিন্ত্তু তারা তার কথা যথারীতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলো। বুঝছো নি মিয়া?

এরপর আল্লাহ যথাসময়ে প্লাবণ দিলেন। দুনিয়া তলাইয়া দিলেন। সমস্ত কিছু পানির নীচে তলাইয়া গেল। চল্লিশ দিন তামাক বৃষ্টি বাদলায় পুরা দুনিয়া তখন পানির নিচে। যখন পানি নামলো তিনি ও তার সাথীরা নৌকা থিক্কা নামলেন। আবার দুনিয়া আবাদ করলেন। এজন্য নুহ নবীরে কয় সানি আদম। সানি আদম বুঝনি ও মিয়া?

-জ্বে না হুজুর। করিম মাঝি মাথা নেড়ে জানায়।

-সানি আদম হইলো দ্বিতীয় আদম। প্রথম আদম দুনিয়া আবাদ করছেন। এরপর নুহ নবী দ্বিতীয়বার আবাদ করলেন। এইজন্য নুহ নবীকে দ্বিতীয় আদম বা সানি আদম কয়। মিয়ারা তোমাগে যে এই তাজকেরাতুল আম্বিয়ার কথা হুনাইলাম তাতে তোমরা কিছু বুঝবার পারছো নি?

-জ্বে না হুজুর। কেমতে জানমু? কেউ কি আমাগো ধারে কিছু কয়?

-আরে মিয়া। নৌকা বলতে রুপকার্থে এই দেহরে বুঝাইছে। আর তার সংগীসাথী বলতে তার ভেতরের বস্তুরে বুঝাইছে। চল্লিশদিন বলতে গন্ঞ্জে মুখফিরে বুঝাইছে। এই গন্ঞ্জ এ মুখফির গোপন ইরাদায় সৃষ্টি হয়। আর বৈঠা বা লগি বলতে পুংলিংগরে বুঝাইছে। নৌকা তথা দেহখানি কে বায়? মালেক সাঁই তিনিইতো সব। সবই তিনি। তিনার দয়া না হইলে ঐ প্লাবনের মাঝে ডুব্ব্যা মরতে অয়। কামকামিনীগণ সদাই নৌকাখানি ডুবানোর জন্য তৎপর থাকে। তয় যারা গুরুর কাছ থিক্কা গোপন মন্ত্র নিয়া ঐ নদীতে নৌকা বাইতে যায় তারা নুহের কিস্তির মতোই ভাইস্যা বেরায়। তাগো ডুবার ভয় নাই।

-হুজুর, তাইলে এইহানে সানি আদম কেডা ? মাইনে আমি...

-বুঝবার পারছি তুমি কি কইবার চাও? হুন মিয়া। তুমি যখন দীক্ষা না নিছ তখন তুমি তোমার দেহের রত্নভান্ডার চিনতা? চিন্তা না। যখন তুমি দীক্ষা নিয়া জানছো তোমার দেহখানিরে তহনই তুমি দ্বিতীয় আদম অর্থাৎ সানি আদম হইছো। বুঝাবার পারছো?

-জ্বে হুজুর।

দবির শাহের নুহের গল্প শুনে করিম মাঝির যেন অন্তঃদৃষ্টি খুলে গেল। সে যেন সবকিছুই দেখতে পাচ্ছে। তার কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে সবকিছু। সে কোন দিকে না তাকিয়ে বাউল আব্দুল করিমের গানটি গাইতে আরম্ভ করেছে।

কোন মেস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
চন্দ্র-সূর্য বান্ধা আছে নাওয়েরই আগায়
দূরবীনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
রঙ-বেরঙের যতো নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
জারি গায়ে ভাটি বায়ে করতাল বাজায়
মদন মাঝি বড়ই পাজি কতো নাও ডুবায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
হারা-জিতা-ছুবের বেলা কার পানে কে চায়
পাছের মাঝি হাল ধরিয়ো ঈমানের বৈঠায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।

নৌকাখানি আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে। পানির স্রোতে আর বৈঠার তালে তালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এক অভাবনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। পড়ন্ত বিকেলে নরোম সুর্যের আলো নদীর পানিতে পড়ায় আলোর ঝর্ণাধারা সৃষ্টি হলো। আর সেই পরিবেশে করিম মাঝির গান...এ এক অভাবনীয় স্বর্গীয় অনুভুতির সৃষ্টি করছে সবার মনে।