পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫

চর্যাপদ-দ্বিতীয় পর্ব

(পূর্ব প্রকাশের পর)

শবরপাদানাম্
রাগ - বল্লাড্ডি

উঞ্চা উঞ্চা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল  সবরো মা কর গুলী গুহারী।
তোহেরী ণিঅ ঘরণী ণামে সহজসুন্দরী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী।।
তিঅ ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুহে সেজি ছাইলী।
সবরো ভুঅঙ্গ ণইরামণি দারী পেহ্ম রাতি পোহাইলী।।
হিআ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই।
সুণ ণইরামণি কন্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই।
গুরুবাক ধনুআ বিন্ধ  ণিঅ মণে বাণেঁ।
একে সরসন্ধাণেঁ বিন্ধহ বিন্ধহ পরম নিবাণেঁ।।
উমত সবরো গরুআ রোসে।
গিরিবর সিহর সন্ধি পইসন্তে সবরো লোড়িব কইসেঁ।।

[ শব্দার্থ : উঞ্চা উঞ্চা= উঁচু উঁচু,পাবত=পর্বত,তঁহি=তথায়,বসই=বাস করে, সবরী=শবরী,বালী=বালিকা,মোরঙ্গি পীচ্ছ = ময়ূর পুচ্ছ,পরহিণ = পরিধান করেছে, গীবত = গ্রীবায়/গলায়, গুঞ্জরী = গুঞ্জা/কুঁচ ফল, মালী = মালিকা, উমত = উন্মত্ত, সবরো = শবর, মা কর =করিস না, গুলী =গোলমাল, গুহারী = গুহা বাসী, তোহেরী= তোর, ণিঅ = নিজ, ণামে=নামে,ণাণা=নানা/বিভিন্ন, তরুবর =গাছ, মৌলিল=মুকুলিত হলো, গঅণত=গগনে/ আকাশে, লাগেলি=লাগলো/ ঠেকলো, ডালী=শাখা, একেলী=একা, হিণ্ডই=ঘুরে বেড়ায়, তিঅ=তিন, ধাউ=ধাতু,মহাসুহে=মহাসুখে,সেজি= শয্যা, ছাইলী=পাতলো/রচনা করলো, ভুঅঙ্গ=ভুজঙ্গ/নাগর, দারী = রমণী, পেহ্ম রাতি = প্রেমময় রাত্রি, হিআ=হিয়া/হৃদয়, তাঁবোলা= তাম্বুল / পান, কাপুর = কর্পূর, সুণ=শূণ্য, ণইরামণি = নৈরাত্মা, গুরুবাক=গুরুবাক্য, ধনুআ=ধনুক, বিন্ধ=বিদ্ধ করো, নিবাণেঁ= নির্বাণ কে, সিহর = শিখর, পইসন্তে = প্রবেশ করে, লোড়িব=লড়াই করিব ]

প্রাকৃত সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ টি কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :-
উঁচু উঁচু পর্বতের উপরে বাস করে শবরী বালিকা। শবরীর পরনে ময়ূর পুচ্ছ গলায়  গুঞ্জার মালা। উন্মত্ত শবর,পাগল শবর গোলমাল রো না। তোমার নিজ ঘরণী লো সহজসুন্দরী। বিভিন্ন গাছপালা মুকুলিত লো, তাদের ডালপালা গিয়ে ঠেকলো আকাশে। একলা কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী  শবরী বনে ঘুরে বেড়ায়। তিন ধাতুর খাট পেতে শবর মহাসুখে শয্যা রচনা করলো। শবর ভুজঙ্গ নৈরামণির সঙ্গে প্রেমের রাত্রি কাটালো। হৃদয়রূপী তাম্বুলে মহাসুখে কর্পুর খেলো। শূণ্যদেহ নৈরাত্মা কে গলায় জড়িয়ে মহা সুখে রাত কাটালো।  গুরু বাক্যের ধনুকে নিজের মন কে বাণ বিদ্ধ করো। এক শর সন্ধানে বিদ্ধ করো পরম নির্বাণ কে। গিরিবর শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করে উন্মত্ত শবর লড়বে কি ভাবে ?

বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির আলোকে বিচার করে চর্যাপদটির বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্রকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, যেন পাঠকেরা দ্বৈত অর্থ সম্বলিত চর্যাপদের স্থূল বাহ্যিক সূক্ষ্ম বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের মাধুর্য রস উপলব্ধি করতে পারেন।

উঁচু উঁচু পর্বতের উপরে বাস করে শবরী বালিকা” -এই মানব দেহ যেন সুমেরু পর্বত,মস্তিস্ক হলো পর্বতের শিখর। সেই শিখরে বাস করে সহজানন্দ পানে প্রমত্ত  শবরের সহজ সুন্দরী গৃহিণী  নৈরামণি বা নৈরাত্মা দেবী। মস্তকে অবস্থিত পারমার্থিক বোধি চিত্তই হলো এই নৈরামণি।  প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব বৃত্তি থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়,তাকে ঊর্ধ্ব দিকে মহা বিদ্যুত আধার মস্তিস্কে প্রেরণ করতে পারলে, সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌন শক্তিওজঃবা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত হয় মানব দেহের সমস্ত পাশব যৌন শক্তি ওজঃশক্তি তে পরিণত হয়ে গেলে মানুষ নির্বাণ লাভ করে মহাপুরষের পর্যায়ে উপনীত হয়।

শবরীর পরনে ময়ূর পুচ্ছ গলায় গুঞ্জার মালা” - শবরী একই অঙ্গে বিলাস বৈভব কৃচ্ছসাধন এই দুইটি প্রতীক নিত্য বর্তমান। বিলাসের ভাববিকল্প রূপ বর্ণময় ময়ূর পুচ্ছ কৃচ্ছসাধনের গুহ্য মন্ত্ররূপ হলো গুঞ্জার মালা।

উন্মত্ত শবর,পাগল শবর গোলমাল রো না। তোমার নিজ ঘরণীহলো সহজসুন্দরী” - বিষয় আনন্দে মত্ত শবর রূপী চিত্তকে সতর্ক করা হচ্ছে, যেন সে শবরীরূপী পারমার্থিক চিত্ত নৈরাত্মা কে চিনতে ভুল না করে। একমাত্র তার সঙ্গেই শবরের মিলন হওয়া উচিত।

বিভিন্ন গাছপালা  মুকুলিত লো, তাদের ডালপালা গিয়ে ঠেকলো আকাশে। একলা কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী  শবরী বনে ঘুরে বেড়ায়” - মানব দেহ রূপী সুমেরু পর্বতে অযত্নে কাম, ক্রোধ,মোহ, লালসা প্রভৃতি অবিদ্যা রূপ তরু মুকুলিত হয়েছে।তাদের শাখা প্রশাখায় মনের আকাশ অন্ধকার। তাদের ভেদ করে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করতে পারছে না। সেই অন্ধকার কাননে নৈরাত্মা একাকিনী ঘুরে বেড়ায়। তাকে চেনার একমাত্র উপায়, তিনি বজ্রের অগ্নির মত আলোকময়, জ্ঞান মুদ্রারূপী কুণ্ডল শোভিত হয়ে ঘুরে বেড়ান।

তিন ধাতুর খাট পেতে শবর মহাসুখে শয্যা রচনা করলো” - তিন ধাতুর খাট বলতে এখানে কায়, মন বাক বুঝানো হয়েছে। কায়, মন বাক সংযম হলো সাধনার প্রথম ধাপ। জীবাত্মা রূপী শবরের সঙ্গে পরমাত্মা রূপী শবরীর মিলনের জন্য উপযুক্ত শয্যা চাই। তাই শবর কায়, মন বাক্য সংযমের খাট বা বেদীর উপর শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্ম রূপী মহাসুখের শয্যা বিছালেন।

শবর ভুজঙ্গ  নৈরামণির সঙ্গে প্রেমের রাত্রি কাটালো” - শবর শবরী প্রেমের রাত্রি কাটালো, অর্থাৎ অবশেষে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন হলো।

হৃদয়রূপী তাম্বুলে মহাসুখে কর্পুর খেলো,শূণ্যদেহ নৈরাত্মা কে গলায় জড়িয়ে মহা সুখে রাত কাটালো”- জীবাত্মা রুপী শবর পরমাত্মা রূপী শবরীর সঙ্গে সম্ভোগ চক্রে মিলিত হলেন, ফলে ব্রহ্মজ্ঞানানন্দতুল্য নির্বাণ সুখ ভোগ করলেন। এর পরে শবর হৃদয় রূপ তাম্বুলে মহাসুখ রূপী কর্পুর খেলেন,অর্থাৎ চিত্ত কে অচিত্ততায় লীন করলেন।

গুরুবাক্যের ধনুকে নিজের মন কে বাণ বিদ্ধ করো। এক শর সন্ধানে বিদ্ধ করো পরম নির্বাণ কে”_- শবরপাদ জানাচ্ছেন  গুরুর বাক্য রূপ ধনুকে সাধকের মন রূপী শর যোজনা করে নিক্ষেপ করায় একবার শর সন্ধানেই নির্বাণ কে বিদ্ধ করা গেছে, অর্থাৎ গুরু প্রদর্শিত পথে মন প্রাণ দিয়ে সাধনা করায় এক বারেই  নির্বাণ সুখ লাভ হয়েছে।

গিরিবর শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করে উন্মত্ত শবর লড়বে কি ভাবে ?” - নির্বাণ লাভের পর সহজানন্দ পানে প্রমত্ত জীবাত্মা মস্তকে অবস্থিত মহাসুখ চক্রে এমন ভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে যে তার আর  বিষয় বিষে দুষ্ট ক্লেদাক্ত জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।