পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫

চর্যাপদ-প্রখম পর্ব

খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে লুই,কুক্কুরী, বিরুবা, গুণ্ডরী, চাটিল্ল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি,  মহিণ্ডা, বীণা, সরহ,শবর, আজদেব, ঢেন্ঢণ, দারিক, ভদ্র, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী,লাড়ীডোম্বী প্রভৃতি চব্বিশ জন সহজিয়া বৌদ্ধ  সিদ্ধাচার্য বৌদ্ধ ধর্মের সাধন তত্ত্বের প্রকৃত গূঢ় তত্ত্বগুলিকে সাংকেতিক রূপকের আশ্রয়ে সঠিক রূপে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রাকৃত বাংলা ভাষাতে কতগুলি পদ রচনা করেছিলেন পদ  গুলিতে পদকর্তা দের নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর উল্লেখ থাকায় বোঝা যায় পদগুলিকে সুর সহযোগে গাওয়া তো যে প্রাচীন পুঁথি তে পদগুলি সঙ্কলিত হয়েছিল তার  নামচর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, তাই গান বা পদগুলিকে গবেষক রাচর্যাগীতিবাচর্যাপদ  নামে অভিহিত করেন চর্যাপদ গুলি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার এক মূল্যবান নিদর্শন বর্তমান কাল পর্যন্ত আবিস্কৃত বাংলা ভাষার সমস্ত নিদর্শনের মধ্যে চর্যাপদের বাংলা ভাষাই প্রাচীনতম চর্যাপদ গুলিতে সন্ধ্যা ভাষার আবরণে দ্বৈত অর্থ সম্বলিত উচ্চ স্তরের ধর্মতত্ত্ব সাধনতত্ত্বের চর্চা করা তো চর্যাপদ গুলির বাহ্যিক রূপ সাদামাটা অনাড়ম্বর হলেও ভাবগত অর্থ ছিল কাব্য সুষমা সম্পন্ন বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের নানা দিগদর্শনে পরিপূর্ণ

সহজিয়া বৌদ্ধ তান্ত্রিক বা সিদ্ধাচার্য রা চর্যাপদের মধ্যে তাদের তন্ত্র সাধনার মন্ত্র গোপনে বেঁধে রাখতেন। যারা তান্ত্রিক সাধনা করেন, কেবল তারাই সেই মন্ত্র বুঝতে পারতেন। অন্যদের কাছে সেই গান ভিন্ন অর্থবহ মনে তো। যোগ সাধনা বলে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করতে পারলে যে অজর অমর হওয়া যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধাচার্য  বিরুবা একটি অদ্ভুত চর্যাপদ রচনা করেন, যার সাধারণ অর্থ ভাবগত অর্থ উভয়ই ভীষণ জটিল অর্থবহ।

বিরুবাপাদানাম্
রাগগবড়া

এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ।।
সহজে থির করি বারুণী সান্ধঅ।
জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধঅ।।
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখইআ।
আইল গরাহক অপণে বহইয়া।।
চউশটি ঘড়িএ দেল পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা ।।
এক সে ঘরলী সরুই নাল
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল।।

[শব্দার্থ : শুণ্ডিনি = মদ্য বিক্রেতা স্ত্রী লোক, সান্ধঅ = প্রবেশ করলো,চীঅন =চিক্কণ/সূক্ষ্ম, বাকলঅ = বল্কলের দ্বারা,বারুণী = মদ, বান্ধঅ = বানালো/তৈরী করলো, থির= স্থির, অজরামর = জরাহীন মৃত্যুহীন, হোই = হয়, দিঢ়কান্ধঅ = দৃঢ়স্কন্ধ, দশমি দুয়ারত = দশমী দ্বারে, দেখইয়া = দেখে, আইল = এলো, গরাহক = গ্রাহক/খরিদ্দার, অপণে = নিজে, বহইয়া = পথ বেয়ে, চউশটি = ৬৪ চৌষট্টি, ঘড়িএ = ঘড়ায়, দেল= দেখালো,পসারা = পসরা/বিক্রয় যোগ্য দ্রব্যাদি,পইঠেল = প্রবেশ করলো, নিসারা = নিষ্ক্রমণ, ঘরলী = ছোট ঘড়া, সরুই= সরু, ভণন্তি = বলেন, চাল = চালো/ চালনা করো ]

প্রাকৃত সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ টি কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :-
একই মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো আর সূক্ষ্ম বল্কলের সাহায্যে মদ চোলাই করলো। সহজে চিত্ত স্থির করে মদ চোলাই করো,যেন মদ্য পানকারী জরাহীন অমর দৃঢ়স্কন্ধ হয়। দশমীর দুয়ারেতে আমন্ত্রণের সঙ্কেত দেখে গ্রাহক নিজেই পথ বেয়ে চলে এলো। মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি চৌষট্টি টি ঘড়ায় সাজানো মদের পসরা গ্রাহক কে দেখালো। খরিদ্দার ভিতরে প্রবেশ করার পরে আর বের হবার নাম নেই। একটাই ছোট ঘড়া, তার মুখ সরু। বিরুবা বলেন,ধীরেধীরে চালনা করো।

প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদটি এমনই অদ্ভুত যে, এর সাধারণ অর্থের ক্ষেত্রে যেমন কঠিন সব ইঙ্গিত রয়েছে, তেমনই সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির ভাবগত অর্থেও দুর্বোধ্য সব ইঙ্গিত রয়েছে। বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্র কে বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, যেন পাঠকেরা দ্বৈত অর্থ সম্বলিত চর্যাপদের স্থূল বাহ্যিক সূক্ষ্ম বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের মাধুর্য রস উপলব্ধি করতে পারেন।

একই মদবিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো আর সূক্ষ্ম বল্কলের সাহায্যে মদচোলাই করলো” - মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো, কারণ দুই ঘরে তার দুইটি পেশা একসঙ্গে চলছে। একটা ঘরে সে বকযন্ত্র বা চোলাই যন্ত্র দিয়ে উত্তম মদ  প্রস্তুত করে এবং তা সাজিয়ে রাখে। সহজ আনন্দ লাভের আশায় যারা আসেন, তাদের মদের যোগান দিয়ে উচ্চ মার্গের তুঙ্গ আনন্দ দেওয়াই তার প্রধান পেশা। অপর ঘরে সে গ্রাহক কে দেহ মিলনে তৃপ্ত করে, এটি তার দ্বিতীয় পেশা।

সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন তত্ত্ব মতে মানব দেহে মেরুদণ্ডের নিম্ন দেশে গুহ্য লিঙ্গের মধ্য স্থলে কুন্দস্থানে রয়েছে মূলাধার চক্র। এই মূলাধার চক্র সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। বৌদ্ধ তান্ত্রিক শাস্ত্রে সুষুম্না লো নৈরামণি বা নৈরাত্মা, বোধিচিত্ত, অবধূতী বা যোগীনির প্রতীক। সুষুম্না নাড়ীর বাম দিকে ইড়া ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নামক আরও দুইটি নাড়ী। ইড়া পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি শিবের প্রতীক। মানব দেহে সঞ্চারমান  প্রাণবায়ূ ইড়া পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্য দিয়ে সতত চক্রাকারে আবর্তিত হয়। ইড়া পিঙ্গলাকে সংযত করার সাধনাই তন্ত্র সাধনা। ইড়া পিঙ্গলাকে সাধনার মাধ্যমে সুষুম্না তে মিশিয়ে দিতে পারলে সাধনা বলে সুষুম্না পরিণত হয় সহস্রায় বা মহাসুখ চক্রে, সেখানেই আছে মহা সহজানন্দ, অর্থাৎ সেখানেই শক্তি শিব রূপী জীবাত্মা পরমাত্মার মিলনে নির্বাণ সুখ লাভ হয়। সুষুম্নাই হলো স্থলে শুণ্ডিনি। তার একটি ঘর হলো ইড়া অপর ঘরটি হল পিঙ্গলা। সাধনতত্ত্বের রসে আপ্লুত সাধক কে সুষুম্না প্রথমে ইড়া তে সাধনার সুরায় আসক্ত করে,তারপরে পিঙ্গলাতে মিলন সুখে তৃপ্ত করে। কাম প্রবৃত্তি থেকে যে যৌন শক্তির উদ্ভব হয় তাকে সাধকেরা কুম্ভক প্রক্রিয়ায় ইড়ার মাধ্যমে উর্ধ্ব পথে মস্তিস্কে পাঠায়। মস্তিস্কে সঞ্চিত যৌন শক্তি সাধনার প্রভাবে ওজঃ বা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত হয়ে পিঙ্গলার পথে মূলাধার চক্রে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়ায় সমস্ত যৌন শক্তি ওজঃ শক্তিতেরূপান্তরিত হলে মোহ মুক্তি ঘটে এবং সহস্রায় জীবাত্মা পরমাত্মার মিলনের ফলে মহা সহজানন্দ লাভ হয়।

 সহজে চিত্ত স্থির করে মদ চোলাই করো,যেন মদ্য পানকারী জরাহীন অমর দৃঢ়স্কন্ধ হয়” – মদের চোলাই যত ভালো হয়, গ্রাহকেরা তত বেশী তৃপ্ত হয়, তাই মন স্থির করে মদ চোলাই করতে বলা হয়েছে, যেন মদ্য পানকারীরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।
আসলে বৌদ্ধ সাধকদের বলা হয়েছে, তারা যেন একাগ্র চিত্তে কুম্ভক সমাধির মাধ্যমে মূলাধার চক্রে কুল কুণ্ডলিনী কে জাগ্রত করে সাধন পর্ব সমাধা করেন, যাতে তারা জরা হীন মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারেন।

দশমীর দুয়ারেতে আমন্ত্রণের সঙ্কেত দেখে গ্রাহক নিজেই পথ বেয়ে চলে এলো” - মানব দেহে দশটি ছিদ্র বর্তমান, যাদের দশ দুয়ার বলা হয়। দুইটি চক্ষু ছিদ্র, দুইটি কর্ণ ছিদ্র,দুইটি নাসিকা ছিদ্র, একটি গ্রাস নালী ছিদ্র, একটি পায়ু ছিদ্র, একটি রেচন ছিদ্র একটি জনন ছিদ্র মিলিয়ে মোট দশটি ছিদ্র লো দশ দুয়ার। দশমীর দুয়ার অর্থাৎ যৌনাঙ্গে আমন্ত্রণের সঙ্কেত পেয়ে গ্রাহক নিজেই শুণ্ডিনির কাছে এলো।
বৌদ্ধ ধর্মমতে জগতের কল্যাণ সাধনের জন্য যিনি স্বয়ং নির্বাণ লাভ থেকে বিরত থেকে অপরকে নির্বাণ লাভে সহায়তা করেন, তাকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। বুদ্ধত্ব লাভেরজন্য বোধিসত্ত্বগণকে জন্ম জন্মান্তরে দশ পারমী পূর্ণ করতে হয়। এই দশ পারমী হলো - দান,শীল, নৈষ্কম্য,ক্ষান্তি, বীর্য, সত্য, অধিস্থান, মৈত্রী, উপেক্ষা প্রজ্ঞা। সাধকেরা বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করতে গিয়ে জানতে পারলেন এই দশ পারমীর কথা, এবং এই দশ পারমী লাভের উপায় সুষুম্না তে নিহিত আছে জানতে পেরে সাধকেরা নিজেই সুষুম্নার শরণাপন্ন লেন।

মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি চৌষট্টি টি ঘড়ায় সাজানো মদের পসরা গ্রাহক কে দেখালো” - নর নারীর যৌন জীবন কে সুখী, তৃপ্তিকর সন্তোষজনক করার জন্য নারীদের কণ্ঠ সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কণ, নৃত্যকলা, কেশ শয্যা, হস্ত শিল্প, রন্ধন প্রভৃতি চৌষট্টি প্রকার গুণে দক্ষ হতে হয়। এদের বলা হয় চৌষট্টি কলা। এই চৌষট্টি কলার কয়েক টি তে পারদর্শিনী হলেই নারী রা পুরুষ দের হৃদয়ে গভীর অনুরাগের সৃষ্টি করতে পারেন। শুণ্ডিনি কে  পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়, তাই শুণ্ডিনি গ্রাহকের মন বুঝে এই চৌষট্টি কলার কোন না কোন একটির সাহায্যে তার মন জয় করে।
আসলে এখানে বলা হয়েছে, নারীদের চৌষট্টি প্রকার কাম কলার সবগুলি থেকে মুক্ত হতে না পারলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ অসম্ভব। সুষুম্নার সহায়তায় কুলকুণ্ডলিনী কে জাগ্রত করে দীর্ঘ সাধনায় এক একটি করে কাম কলার মোহ হতে মুক্ত হতে হয়। সুষুম্না রূপী নৈরাত্মা সাধকদের এক এক করে চৌষট্টি প্রকার কাম কলা হতে মুক্ত করে।

খরিদ্দার ভিতরে প্রবেশ করার পরে আর বের হবার নাম নেই” - শুণ্ডিনির সান্নিধ্য পেয়ে গ্রাহকেরা এতই মত্ত যে আর বাইরে আসার নাম নেই।
আসলে বলা হয়েছে উপযুক্ত সাধন পথের সন্ধান পেয়ে সাধকেরা একবার যদি নৈরাত্মার সাহচর্যে সহজানন্দের সন্ধান পান, তবে আর গৃহী জীবনে ফিরে আসেন না।

একটাই ছোট ঘড়া, তার মুখ সরু। বিরুবা বলেন,ধীরে ধীরে চালনা করো ” – মিলনের পথ সংকীর্ণ, তাই অহেতুক তাড়াহুড়ো অনুচিৎ।
সুষুম্না নাড়ী মানব দেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। সুষুম্নার সূত্রাকার পথ অতিসূক্ষ্ম। এই সূক্ষ্ম পথেই জীবাত্মা পরমাত্মার মিলন ঘটে তাই বিরুবা উপদেশ দিচ্ছেন অতি ধীরে ধীরে সাধনার পথে এগিয়ে চলো।

এই ভাবে আমরা যদি ক্রমাগতঃ ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের সমস্ত চর্যাপদগুলিকে বৌদ্ধশাস্ত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যাবে, সব গুলিতেই সাধন তত্ত্বের কোন না কোন গূঢ় রহস্য দক্ষতার সঙ্গে মানব জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির আবরণে সুন্দর কাব্যিক রূপে বর্ণিত

বৌদ্ধ সহজপন্থী সাধকেরা মনে করতেন ললনা রসনার মিলনে সংবৃত বোধি চিত্ত উৎপন্ন হয় তা নির্মাণ কায়ে অবস্থান করে। নির্মাণ কায়ে অবস্থান কালে সংবৃত বোধি চিত্ত নিচের দিকে ধাবিত হতে চায়। কিন্তু যোগ সাধনা বলে একে উর্ধ্বগামী করতে পারলে তা রূপান্তরিত  হয় পারমার্থিক বোধি চিত্তে। এই পারমার্থিক বোধি চিত্তকেই চর্যাপদে নৈরামণি বলা হয়। চর্যাপদের আদি কবি শবরপাদ একটি চর্যাপদ রচনা করেন, যা তে এই নৈরামণির উল্লেখ আছে। আাপাতদৃষ্টিতে একে নর নারীর প্রেম মিলন চিত্র মনে হলেও, এর মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান সাধন পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
[তথ্যসুত্রঃ সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি ]