(পূর্বপ্রকাশের পর)
মায়াপ্রপঞ্চ ও দ্বৈতবোধের উর্ধ্বে স্থিত যে ‘বোধিচিত্ত’, তাকে সকল প্রকার দ্বৈতবোধ পরিহার করে সাধন যোগে অবধূতিকা মার্গের পথে ‘মহাসুখকমল ’-এ স্থিত করে যদি সাধক মহাসুখ লাভ করেন, তবে মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞানরহিত হন। কুক্কুরীপাদ নামক এক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এই তত্ত্বের ভাবকল্পে গবড়া রাগে গীত এই চর্যাপদটি রচনা করেন:
মায়াপ্রপঞ্চ ও দ্বৈতবোধের উর্ধ্বে স্থিত যে ‘বোধিচিত্ত’, তাকে সকল প্রকার দ্বৈতবোধ পরিহার করে সাধন যোগে অবধূতিকা মার্গের পথে ‘মহাসুখকমল ’-এ স্থিত করে যদি সাধক মহাসুখ লাভ করেন, তবে মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞানরহিত হন। কুক্কুরীপাদ নামক এক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এই তত্ত্বের ভাবকল্পে গবড়া রাগে গীত এই চর্যাপদটি রচনা করেন:
কুক্কুরীপাদানাম্
রাগ–গবড়া
দুলি
দুহি
পীঢ়া
ধরণ
ন
জাই
।
রুখের
তেন্তলি
কুম্ভীরে
খাই
॥
আঙ্গন
ঘরপণ
সুন
ভো
বিআতী।
কানেট
চোরে
নিল
অধরাতী।।
সসুরা
নিদ
গেল
বহুড়ী
জাগই।
কানেট
চোরে
নিল
কা
গই
মাগই।।
দিবসহি
বহুড়ী
কাউহি
ডর
ভাই।
রাতি
ভইলে
কামরু
জাই।।
অইসনী
চর্য্যা
কুক্কুরীপা
এঁ
গাইল।
কোড়ি
মাঝেঁ
একু
হি
অহি
সমাইল।।
[ শব্দার্থ:দুলি = কাছিম, দুহি =দোহন করে,পীঢ়া = পাত্র/ ভাঁড়, ধরণ = ধারণ করা, রুখের = গাছের, তেন্তলি = তেঁতুল, কুম্ভীর= কুমীর, আঙ্গণ = প্রাঙ্গন/আঙ্গিনা, সুন = শোনো, ভো=ওহে, বিআতি = বাদ্যকরী, কানেট = কানের
অলঙ্কার,
অধরাতী
= মধ্য
রাত্রি,
সসুরা
=শ্বশুর,
বহুড়ী
= বধূ,
মাগই
= চাইবে,
কাউ
= কাক,
ডর
= ভয়,
কামরু
= কামরূপ,
অইসনী
= এইরকম,
কোড়ি
= কোটি,
একু
= একজন,
সমাইল
= বুঝতে
পারলো।]
প্রাকৃত
বাংলা
ভাষায়
লিখিত
এই
চর্যাপদ
কে
বিশুদ্ধ
বাংলায়
রূপান্তর
করলে
সাধারণ
অর্থ
দাঁড়ায়
:
মাদী
কাছিমের
দুধ
দোহন
করে
ভাঁড়ে
ধরে
রাখা
যাচ্ছে
না।
গাছের
তেঁতুল
কুমীরে
খায়।
ওগো
বাদ্যকরী
শোনো,
ঘরে
আর
অঙ্গনে
প্রভেদ
নেই,
ঘরের
মধ্যেই
অঙ্গন।
অর্ধ
রাত্রিতে
চোরে
কানের
অলঙ্কার
চুরি
করে
নিয়ে
গেল।
শ্বশুর
ঘুমিয়ে
পড়ল
আর
বধূ
জেগে
রইল।
চোরে
যখন
কানের
অলঙ্কার
নিয়েই
গেল,
তখন
কার
কাছে
গিয়ে
আর
চাইবে
? দিনের
বেলায়
বধূ
কাক
দেখে
ভয়
পায়,
অথচ
রাত্রি
হলেই
সে
কামরূপ
যায়।
কুক্কুরীপাদ
এমন
চর্যাপদ
গাইলেন,
যা
এক
কোটি
মানুষের
মধ্যে
হয়
তো
একজন
ই
বুঝতেপারবেন।
সাধারণ
ভাবে
কবিতাটিকে
বিশ্লেষণ
করলে
মনে
হয়
–“এক
পরপুরুষে
আসক্ত
বধূ,
দিনের
বেলায়
এমন
ভাব
দেখায়
যে
কাকের
ডাকেও
ভয়
পায়,
অথচ
রাত
হলেই
সে
কামরূপ
যায়
অর্থাৎ
কামস্পৃহা
চরিতার্থ
করে।
বধূটি
মধ্য
রাত্রে
শ্বশুরের
নিদ্রার
সুযোগে
ঘরের
বাইরে
এসে
পরপুরুষের
সঙ্গে
সম্ভোগ
ক্রিয়া
করছে।
তার
দুর্বলতার
সুযোগে
চোরের
মত
স্বভাবের
পুরুষ
তার
যৌবনের
সঙ্গে
সঙ্গে
তার
কানের
অলঙ্কার
ও
হরণ
করেছে।
বধূ
এখন
কার
কাছে
কানের
অলঙ্কার
চাইবে
?
বৌদ্ধ
সিদ্ধাচার্য
গণ
মানব
শরীরের
ষটচক্র
স্থিত
অখিল
পদ্ম
কে
“মহাসুখ
কমল"
রূপে
ও
কুন্দস্থানে
সুষুম্না
নাড়ীর
মুখদেশে
মূলাধার
চক্র
কে
“বজ্রমণিরূপ
আসন”
রূপে
কল্পনা
করেন।
তাদের
মতে
গভীর
রাত্রে
ইন্দ্রিয়াদির সুষুপ্ত অবস্থায় কুম্ভক সমাধি দ্বারা দেহের প্রকৃতি দোষ খণ্ডন করে, নির্বিকল্প সমাধিতে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করে অর্থাৎ মহাসুখ কমল কে বজ্রমণিরূপ আসনে স্থাপন করে বোধি চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়।
এই
তত্ত্বজ্ঞানের আলোকে এবং পদকর্তার ইঙ্গিত অনুসরণ করে চর্যাপদের প্রতিটিছত্র কে বিশ্লেষণ করলে চর্যাপদটির এই রপ ভাবগত অর্থ পরিস্ফুট হয়ঃ
“ মাদী কাছিমকে দোহন করে দুধ ভাঁড়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না ” - ‘মহাসুখ কমল’ কে জাগ্রত করে বজ্রমণি রূপ আসনে ধরে রাখা যাচ্ছে না অর্থাৎ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী কে বশীভূত করে মনের দ্বৈত ভাব দূর করে জ্ঞানের আধার মন কে নির্বাণের পথে চালিত করা যাচ্ছে না, ফলে স্বাভাবিক নির্মল আনন্দ লাভ সহজ হচ্ছে না।
“গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়” - মানব দেহকে যদি গাছ বলে কল্পনা করা হয়, তবে তেঁতুল রূপী অম্ল ফল হলো তার অন্তরের অবদমিত বিকৃত বাসনা। তেঁতুল কে কুম্ভীরে খায় অর্থে ইঙ্গিত
করা
হয়েছে
কুম্ভক
সমাধি
র
সাহায্যে
মনের
বিকৃত
বাসনা
কে
নিবৃত্ত
করা
যায়।
“ঘরে আর অঙ্গনে প্রভেদ নেই, ঘরের মধ্যেই অঙ্গন” - দেহ যদি মনের ঘর হয়, তবে তার অঙ্গনে অর্থাৎ মনের মধ্যেই মহাসুখরূপ অঙ্গনে নির্বাণ
লাভ
সম্ভব
হয়
যদি
দেহ
ও
মন
এক
হয়ে
যায়।
“অর্ধ রাত্রিতে চোরে কানের অলঙ্কার চুরি করে নিয়ে গেল” - অর্ধ রাত্রিতে
ইন্দ্রিয়
গুলি
সুষুপ্ত
অবস্থায়
থাকে,
সেই
সময়
প্রজ্ঞা
বা
জ্ঞানের
অভিষেকের
সময়।
কানেট
বা
কানের
অলঙ্কার
হলো
এক
জাগতিক
বস্তু
র
প্রতীক
যার
প্রতি
মানুষের
মোহ
জন্মে।
চুরি
করা
অর্থে
ভাবের
ঘরে
চুরি
করা।
মধ্য
রাত্রে
ইন্দ্রিয়
গুলি
যখন
সুপ্ত
অবস্থায়
থাকে,
তখন
কুম্ভক
সমাধির
সহায়তায়
মন
প্রজ্ঞার
দ্বারা
ভাবের
ঘরে
চুরি
করে
মনের
প্রকৃতি
দোষ
অর্থাৎ
পার্থিব
বস্তুর
প্রতি
মোহ
কে
হরণ
করে।
“শ্বশুর ঘুমিয়ে পড়ল আর বধূ জেগে রইল” - এই ইঙ্গিতের
দ্বারা
বোঝানো
হয়েছে
শ্বাসবায়ু
যখন
ঘুমিয়ে
পড়ে
অর্থাৎ
স্থির
থাকে
তখন
পরিশুদ্ধ
প্রকৃতি
রূপিণী
আত্মা
জেগে
থাকে।
“দিনের বেলায় বধূ কাক দেখে ভয় পায়, অথচ রাত্রি হলেই সে কামরূপ যায়” - কাক প্রকৃতির আবর্জনা খেয়ে জীবন ধারণ করে , তাই কাক বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতির প্রতীক। কামরূপ অর্থে বোঝায় মহাসুখ সঙ্গম বা নির্বাণ লাভের মহা আনন্দ। দিনের বেলা যখন সকল ইন্দ্রিয় সজাগ অবস্থায় থাকে তখন পরিশুদ্ধ আত্মা বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতি দেখে ভয় পায়, অথচ গভীর রাত্রে ইন্দ্রিয়গুলি যখন সুপ্ত অবস্থায় থাকে, তখন পরিশুদ্ধ আত্মা নির্বিকল্প সমাধিতে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করে চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়।
"কুক্কুরীপাদ এমন চর্যাপদ গাইলেন, যা এক কোটি মানুষের মধ্যে হয় তো একজন ই বুঝতে পারবেন” - অবশেষে কুক্কুরীপাদ
সংশয়
প্রকাশ
করেছেন,
তিনি
যে
চর্যাপদ
গাইলেন,
তা
এক
কোটি
মানুষের
মধ্যে
একজন
ও
বুঝতে
পারবেন
কি
না
সন্দেহ
আছে।
আজ
বিশ্বের
জ্ঞান
ভাণ্ডার
যখন
আমাদের
হাতের
মুঠোয়,
তখন
রাশি
রাশি
পুস্তকপড়েও
যখন
চর্যা
পদের
ভাবগত
অর্থ
উদ্ধারে
হিমশিম
খাচ্ছি,
সেই
নিরিখে
খ্রীষ্টীয়
দশম
থেকে
দ্বাদশ
শতাব্দীর
মধ্যবর্তী
সময়ে
বাংলা
সাহিত্যের
জন্ম
লগ্নে
রচিত
এই
চর্যাপদ প্রসঙ্গে করা উক্তি টি মোটেই অতিশয়োক্তি নয়।
[তথ্যসুত্রঃ
সমর
কুমার
সরকার
/ শিলিগুড়ি
]