চিন্ময় আত্মা, স্থুল জড় দেহ নয়। আর জীবাত্মা হলো পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভগবান হচ্ছেঃ পূর্ণ আর আত্মা তার অংশ অর্থাৎ অপুর্ণ। তাই জীবাত্মার নিত্য ধর্ম হচ্ছেঃ ভগবানের সেবা করা। কেননা অংশের কাজ হলোঃ পুর্ণের সেবা করা। মনের ধর্ম হলোঃ সংকল্প ও বিকল্প এবং দেহের ধর্ম হলোঃ ভোগ আর ত্যাগ। দেহের ছয়টি পরিবর্তন হলোঃ জন্ম-বৃদ্ধি -স্হিতি-সন্তান/সন্ততি সৃষ্টি-ক্ষয়-মৃত্যু। জীবের স্বরূপ হলোঃ কৃষ্ণের 'নিত্যদাস' - শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। আত্মার আকার চুলের অগ্রভাগের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ। তা এতই ক্ষুদ্র যে এই জড় চক্ষু দিয়ে বা যন্ত্রের সাহায্যে আত্মাকে দর্শন করা যায় না। এ ছাড়া আত্মা জড় পদার্থ নয়। তাই জড়ীয় ইন্দ্রিয় ও যন্ত্র দিয়ে তা দেখা অসম্ভব। এই জড় জগৎটি ভগবানের বহিরঙ্গা ত্রিগুনাত্মিকা মায়া শক্তির প্রকাশ। ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহংকার-এই আটটি উপাদান নিয়ে এই জড় জগৎ তৈরী হয়েছে। পঞ্চ মহাভূত হচ্ছেঃ - ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও বোম। ইন্দ্রিয় পাঁচটি বিষয় হলোঃ - রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শ। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় হচ্ছেঃ- নাক, জিভ, চোখ, কান ও ত্বক। পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় হলোঃ -বাক, পানি, পাদ, উপস্থ ও বায়ূ। জীবের স্হূল শরীরটি ভূমি, জল,বায়ূ, অগ্নি ও আকাশ দিয়ে তৈরী। এবং সূক্ষ শরীরটি মন, বুদ্ধি ও অহংকার নিয়ে গঠিত। জীবের প্রকৃত সমস্যা হলো - জন্ম জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু।
আত্মা শরীরের হৃদ্দেশে অবস্থান করে। দেহে আত্মার অবস্থানের লক্ষন হচ্ছে দেহে পরিব্যাপ্ত চেতনা। আত্মা দেহ হতে নিষ্ণ্ক্রান্ত হলে দেহ একটি অচেতন, পচনশীল, জড়পীণ্ডে পরিনত হয়। এই জড় জগৎ এ ৮৪ লক্ষ প্রকারের জীব যোনি রয়েছে। এদের মধ্যে কীটপতঙ্গ ১১ লক্ষ, জলচর ৯ লক্ষ, উদ্ভিদ ২০ লক্ষ, পশু ৩০ লক্ষ, পাখি ১০ লক্ষ এবং মানুষের মধ্যে রয়েছে ৪লক্ষ প্রজাতি। জীবাত্মা যে শরীরের মধ্যে অবস্হান করে সেই শরীর কৌমার থেকে যৌবন, যৌবন হতে বার্ধক্য অবস্হায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হতে থকে। কিন্তু দেহস্থ আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। ঠিক যেমন পুরানো কাপড় পরিত্যাগকরে নতূন কাপড় পরিধান করা হয়,ঠিক তেমনি জীবাত্মা অব্যবহারযোগ্য জরাজীর্ণ শরীর ত্যাগ করে তার কর্ম এবং বাসনা অনুযায়ী নতুন শরীর গ্রহন করে। আত্মার এই নতুন শরীর ধারনকে বলা হয় পুনঃজন্ম । জীবের চরম লক্ষ্য হচ্ছেঃ – পরমেশ্বর ভগবানের সংগে তার হারানো সম্পকর্কে পুনঃস্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হওয়া, কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা। সর্ব আনন্দের উৎস হচ্ছেন সচ্চিদানন্দময়ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জীব যে নিত্য আনন্দ লাভের আশা করছে, তার জন্য তাকে পরম পুরুষ ভগবানর সাথে তার নিত্য, অবিচ্ছেদ্য, প্রেমময় সম্পর্কের পুনঃস্থাপন করতে হবে। যা অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়া যায় কিন্তু ক্ষনস্থায়ী কিন্তু অন্তিমে দুঃখজনক তাকে প্রেয় বলে। আর যা লাভ করা পরিশ্রম সাপেক্ষ, কিন্তু চিরস্থায়ী ও সুখজনক তাকে শ্রেয় বলে। জীবনের প্রকৃত শ্রেয় হচ্ছে নিজের স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দে অহৈতুকী ভক্তিভাবে তার সেবায় নিযুক্ত হওয়া। জীবের দুঃখের মূল কারন কৃষ্ণবিস্মৃতি। জীব যখন কৃষ্ণের সংগে তার নিত্য সম্পর্কের কথা ভূলে যায়, তখন তার নিত্য স্বরূপ চিন্ময় আত্মা, এ বিষয়ে বিস্মৃতির ফলে এবং এই দেহকে আত্মবুদ্ধি করার ফলে এ জগতে জীব প্রতিনিয়ত দুঃখে জর্জরিত হয় ।
পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছে ভগবান, যার থেকে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। যিনি সমস্ত বিশ্ববহ্মান্ডের পালন করেন এবং সংহারের কারণ হন, তিনিই হচ্ছেন ভগবান। যাহার মধ্যে সমগ্র ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী,জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি গুন পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে, তাকে ভগবান বলা হয়। ভগবান সাকার। তার রূপ রয়েছে। তবে তা জড় নয়, অপ্রাকৃত। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, তিনি নিত্য, জ্ঞান ও আনন্দময় মূর্তিবিশিষ্ট। যোগী চার প্রকার – কর্মযোগী, জ্ঞানযোগী, ধ্যানযোগী ও ভক্তিযোগী।
জ্ঞানযোগী নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন। অষ্টাঙ্গ যোগী বা ধ্যানযোগী ধ্যানের মাধ্যমে পরমাত্মার উপাসনা করে থাকেন। ভক্তিযোগ অবলম্বনকারী ভগবানের ভক্তরাই ভগবানের উপাসনা করে। ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ লাভ করবার জন্য আমাদের শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। শাস্ত্র থেকে আমরা বুঝতে পারব যে ভগবান আছেন। ভগবান হচ্ছেন তিনি যিনি এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ। সৃষ্টির পেছনে কারও না কারও হাত আছেন। যিনি বুদ্ধি প্রদান করেছেন, এই সমস্ত উপাদান প্রদান করেছেন এবং যিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন ভগবান। ভগবানের সাথে জীবের
সম্পর্ক হচ্ছে নিত্যপ্রভু ও নিত্যদাস । জড়জগৎ ভগবানের অনুৎকৃষ্টা বহিরঙ্গা শক্তি থেকে উৎপন্ন ।