পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫

সোনার মানুষ-অষ্টম পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর) 

এরপর আসি আহাদ আল্লাহ প্রসংগে।  

আহাদ আল্লাহঃ আল্লাহ্‌র প্রকাশিত রূপের মধ্যে এটি নিম্নমানের দুর্বল স্তর। ‘আহাদ’ শব্দটি মূলতই বহুবচন। যেমন ইংরেজি শব্দ ‘আর্মি’ তেমনই আহাদ শব্দটিও। একজনকে নিয়ে ‘আর্মি’ হয় না। ‘আহাদ’ শব্দটি অর্থ এক বললে ভুল হবে। এর অর্থ একক বলা-ই উত্তম। এককের সংজ্ঞা এমনভাবে দেয়া যেতে পরে যে, যে-বহুর সমষ্টি এক মূলের সহিত যুক্ত তাই একক। এই দৃশ্যমান জগতে জীব, জড় ও শক্তিরূপে আল্লাহ্‌ নিজেই বহুরূপে রূপায়িত। তাঁর বাইরে কোন অস্তিত্ব নাই। সমগ্র সৃষ্টি তাঁর সেফাত হতে আগত এবং তাঁর নিকট হতে প্রাপ্ত সেফাত সাময়িক। সৃষ্টি তার আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হলেও স্রষ্টার সেফাতের বাইরে তার আপন বা নিজস্ব কোন সেফাত নাই।

মুলতঃ আহাদ জগত নারী প্রকৃতি। যা উৎপাদনশীল তাই প্রকৃতি। তবে যে-সত্ত্বা মহিমান্বিত আল্লাহ্‌র শক্তিতে শক্তিমান হয়ে সৃজনী শক্তির অধিকারী হয়েছেন, তিনি উৎপাদনশীলতার সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও আহাদ জগতের অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি যদি আহাদ জগতের বাসিন্দা তবুও সামাদ জগতের ব্যক্তিত্ব। আহাদ জগতের প্রতিটি সত্ত্বা দুর্বল, অস্থায়ী, অধম, মন্দ। জড় জগত, জীব জগত, মনুষ্য জগত এবং মনুষ্য জগতের মধ্যকার জাহান্নাম ও জান্নাত সকলই আহাদ জগতের অন্তর্ভুক্ত। আহাদ জগতের প্রতিটি সত্ত্বা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পরস্পরের নির্ভরশীলতায় আহাদের সবাই একধর্মী। একজনকে ব্যতিরেকে অপরজন অচল। তাই আহাদ জগত দুঃখময়। বস্তুজগতের যাহা কিছু আমরা দেখি, শুনি ও অনুভব করি তা আহাদ আল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। জন্ম, মৃত্যু, জরা, রোগ, শোক, আনন্দ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি এই আহাদ জগতের উপাদান ও গুণাবলী। কোরানে আল্লাহ্‌র এই স্তরকে তাই বলা হয়েছে ‘দুনাল্লাহ’ অর্থাৎ দুর্বল বা মন্দ আল্লাহ্‌। সুতরাং মানুষের মুক্তি পথে দুর্বল আল্লাহ্‌ হতে কোন অভিভাবক বন্ধু এবং সাহায্যকারী নাই। জীব সত্ত্বা ক্রমোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে বুদ্ধিমত্তায় উন্নত পর্যায়ে অর্থাৎ মানব-রূপে আসে। মানব হইতে ক্রমশ আত্মোন্নতির সাহায্যে সামাদিয়াত অর্জন করতে পারে। আহাদ জগতের দুর্বল সত্ত্বা কর্তৃক দুর্বল সত্ত্বার বা দুর্বল আল্লাহ্‌র উপর আজীবন নির্ভরতা বা দাসত্বের পরিনাম— জাহান্নাম। অপর পক্ষে দুর্বল সত্ত্বা কর্তৃক কোন শক্তিশালী সত্ত্বা অর্থাৎ সামাদ আল্লাহ্‌র উপর নির্ভরতা ও দাসত্বের ফল— প্রাথমিক পর্যায় জান্নাত এবং তদ্‌পরবর্তীতে মুক্তি। এই মুক্তি জাহান্নাম হতে মুক্তি, এই মুক্তি সৃষ্টির বন্ধন হতে মুক্তি।

এতো গেল আহাদ আল্লাহ সম্পর্কে কিছু কথা। এবার আসা যাক সামাদ আল্লাহ প্রসংগে।

সামাদ আল্লাহঃ আল্লাহ্‌র প্রকাশিত রূপের মধ্যে এটি শক্তিশালী স্তর। কোরানে আল্লাহ্‌র যত গুণাবলী ও শক্তির বর্ণনা আছে তা ‘সামাদ আল্লাহ্‌’ স্তরের গুণাবলী ও শক্তি। কোরানে সামাদ আল্লাহ্‌ ‘আমরা’ সম্বোধন করে কথা বলেছেন। বিশ্বের যত নবি, রসুল, উলিল-আমর মহাপুরুষ, অলি-আউলিয়া আছেন— তাঁরা এই ‘আমরা (নাহানু)’ দলের সদস্য। তাঁরাই এই জগতের লালন-পালন ও হরণকারী। আহাদ জগতের জ্বিন ও ইনসানকে সালাত শিক্ষা তথা ধ্যান শিক্ষা দিয়ে হেদায়েত করার জন্য নবি, রসুল, অলি-আউলিয়া ও আধ্যাত্মিক গুরু রূপে আল্লাহ্‌ নিজেই নর-মাংসের দেহে অবতীর্ণ হন। তাঁরাই হচ্ছেন সামাদ আল্লাহ্‌। সামাদ সত্ত্বা— পুরুষ। যে মানব সত্ত্বার মন-মস্তিষ্কে কোন উৎপাদন নাই অর্থাৎ যাঁর মন-মস্তিষ্কে মরুভূমির ন্যায়— যেখানে মোহ রূপ গাছ-পালা জন্মায় না অর্থাৎ যে মন-মস্তিষ্কে কেবলই মহাশূন্যতা সেখানেই উচ্চ পর্যায়ের সামাদ সত্ত্বা কর্তৃক রুহ ফুঁৎকার করা হলে তাঁকে সামাদ সত্ত্বার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। আহাদ ও সামাদ একে অপরের পরিপূরক। আহাদ নারী জগত। এর সাহায্য-সহযোগিতা দ্বারা এবং লালন পালনের সুষ্ঠু পরিচর্যা দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে স্বাধীন সামাদ সত্ত্বার উদ্ভব হয়। অপর পক্ষে, সামাদ সত্ত্বা আহাদ জগতের (সৃষ্টির) নিয়ন্ত্রক প্রভু হয়ে জাহান্নাম ও জান্নাতের উৎকর্ষ সাধন করেন এবং সমগ্র আহাদ জগতকে রূপে রসে লীলাময়, রহস্যময়, অর্থপূর্ণ এবং সার্থক করে তোলেন এবং নিরাকারের লীলা আকার সাকারে পরিপূর্ণ করে তোলেন। মায়া বিজড়িত অখণ্ড নারীজগত আহাদ। এটি হতে বিখণ্ডিত, মোহবন্ধন মুক্ত, পুরুষ সত্ত্বা সামাদ। জান্নাতবাসীগণ সালাতকর্মের সাহায্যে সংস্কাররাশির উপর সম্পূর্ণরূপে ভাসমান থেকে মুক্ত পুরুষ তথা সামাদে পরিণত হন। জীবদ্দশায় তাঁরা দেহ-মনের চাহিদা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে মরার আগে মরে গেছেন। সুতরাং তাঁদের কর্মকাণ্ডের তাঁদের নহে বরং দেহ-মনের। এজন্যই সামাদ সত্ত্বা “লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ”. তাঁরা নিজেরা জন্ম দেন না, জন্ম নেয়ার কর্মও করেন না। বিষয় বাসনা হইতে মুক্ত। সামাদ সত্ত্বা লা-শরিক, স্বাধীন, স্বনির্ভর, নিরপেক্ষ, মুক্ত, বন্ধনহীন, বেনেয়াজ। তাঁরাই সৃষ্টি পরিচালনা করে থাকেন। এজন্য লক্ষ করা যায়, কোরানে যেক্ষেত্রে আল্লাহতা’য়লার শান-মানের কথা বলা হয়েছে সেক্ষেত্রে এক বচনে ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে আবার যেক্ষেত্রে রূপান্তর সৃষ্টি (খালাকা) করা, হেদায়েত দান করা, রিজিক বণ্টন করা, রুহ ফুঁৎকার করা, জীবন দান করা, মৃত্যু ঘটানো, তৈরী (জাআলনা) করা, সংহার করা, নাজেল (অবতীর্ণ, উদয়) করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে সেক্ষেত্রে বহুবচনে ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। [গ্রন্থসুত্রঃ কোরআন দর্শন - সুফী সদরউদ্দিন আহমদ চিশতী ] 
(চলবে)