পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৬

নিজ দর্পণ ও দর্শনঃ অনুভবের নতুন দিগন্ত

মনা আমাকে ডেকে বললোঃ
-কি রে কি করছিস?
-তেমন কিছু না। বসে আছি।
-একটা গল্প শুনবি।
-বলো। তার আগে বলো তুমি কেন আমাকে গল্প শুনাতে চাইছো?
-গল্পটির মধ্যে একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। দেখি তুই ধরতে পারিস কি-না?
-ঠিক আছে। বল....
মনা তার গল্প বলা শুরু করলোঃ শোন তাহলে-
এক বনে ভেতর মনের সুখে বাস করতো পশু-পাখিরা। তাদের মধ্যে কোন মনমালিন্য ছিল না। ছিল না কোন বিভেদ। বনের রাজা সিংহ মশাই তাই আরামেই দিন গুজরান করছিল। তার মন্ত্রী মশাই বাঘ মামা নাকে তেল দিয়ে অঘোরে ঘুমাতো। কিন্ত্তু বিপদে ছিল পন্ডিত মশাই শিয়াল মামার । রাজার আদেশ ছিল প্রজাদের খোঁজ খবর নেবার। সে দুর দুরান্তে প্রত্যন্ত অন্ঞ্চলে ঘুরে ফিরে প্রজাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরে খবরাখবর নিত। কে কেমন আছে?
একদিন সেই শিয়াল গেল দুরের কোন এক গ্রামে। মাথার উপর তখন প্রচন্ড রোদের তাপ। উত্তাপে শিয়াল বেশ কাহিল হয়ে পড়লো। আশে পাশে কারো কাছে যে আশ্রয় নেবে সেই উপায়ও নেই। কি করা...বেচারা কষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছ তলায় আশ্রয় নিল। সেই সময় সে চিন্তা করলো ক্ষাণিকক্ষণ বিশ্রাম নিলে মন্দ হতো না। কিন্ত্তু তার আগে পেট পুরে পানি খাওয়া দরকার। কোথায় পানি পাওয়া যায়...কিছু দুর হাঁটার পর সে একটা পুকুর দেখতে পেল। পরিস্কার স্বচ্ছ পানি। সে আজলা ভরে পানি পান করলো। হটাৎ সে দেখতে পেল সেই পানিতে তারই মতো দেখতে অবিকল আরেকটি শিয়াল। আরে..এটা আবার কে...প্রথমে সে ঘাবড়ে গেল। তারপর সে আবারো উঁকি দিল সেই পুকুরে। দেখলো-তারই মতো দেখতে...অবিকল সে-ই যেন। নিজেকে নিজে দেখতে পেয়ে শেয়ালের মনে আনন্দ আর ধরে না..সে নাচতে নাচতে গাইতে শুরু করে দিলঃ-
আমি দেখেছি আমারে, গভীর কালো পদ্মজলে
আমার আমিকে খুঁজে ফিরে পেয়েছি আজ সদ্যমুলে।
গান গাইতে গাইতে সে যাচ্ছে আর নাচছে। শেয়াল পন্ডিত বলে কথা। আশে পাশের বনের সমস্ত পশু-পাখি শেয়ালের গান শুনে হতভম্ভ হয়ে গেল..তারা বুঝতে পারলো না...তার সেই গীত নৃত্যের মর্ম কথা।
এদিকে সেই কথা বনের রাজা সিংহ মশাইয়ের কানেও গেল। সে মন্ত্রীকে আদেশ করলোঃ যাও...এক্ষুণি ঐ ব্যাটাকে ধরে নিয়ে এস। যথা আজ্ঞা বলে মন্ত্রী মহাদয় বেরিয়ে পড়লো। তারপর সে শিয়াল ব্যাটাকে ধরে নিয়ে আসা হলো রাজ সভায়। সিংহ মশাই শেয়ালের কাছে জানতে চাইলো-মুল বিষয়টি কি?
শেয়াল সবিস্তারে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। শুনে সিংহ মশাইও সেটা দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলো। সাথে অনেকেই গেল।
সত্যিইতো...সিংহ তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে নিজেকে দেখা যায়...বাঘও বাদ গেল না..একে একে সকলেই নিজেকে দেখার আগ্রহ নিয়ে যখন দেখা শুরু করলো-ঠিক তখনই পুকুরটির পাড় ভেঙ্গে হুড়মুড় করে সবাই পানিতে পড়ে গেল। তারপর কে কার আগে উঠবে, সে প্রতিযোগীতায় মত্ত হয়ে সকলেই ডুবে মরলো।
দুরে দাঁড়িয়ে শেয়াল তখন বললোঃ
"যখন আমি আমাকে দেখলাম - একা দেখলাম। যখন সকলকেই দেখলাম - আমরা হলাম। তাও ঠিক ছিল। কিন্ত্তু সকলই যখন সকলকে দেখতে চাইলো তখনই সর্বনাশ হলো।"
এখন বল। এই গল্পটি থেকে তুই কি শিখলি?
-গল্পতো গল্পই। এর থেকে শেখার কি আছে?
-আছে রে বোকা। সব গল্পই কেবল গল্প নয়। গল্পের ভেতরও রহস্যময়তা লুকিয়ে থাকে। তুই যদি ভালো করে লক্ষ্য করিস, তাহলে দেখবি ধর্মগ্রন্থগুলিও বিভিন্ন নবী-রসুলদের কেচ্ছা-কাহিনীর বর্ণনা আছে। আবার যদি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ দেখিস,তো সেখানেও পাবি গল্প। যেমনঃ গীতায় অর্জুনের সাথে শ্রীকৃষ্ণের কথোপকথন। আবার রামায়ণে সীতার কাহিনী বর্ণিত আছে। প্রতিটি ধর্মগ্রণ্থেই গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। এছাড়া মসনবী শরীফেও গল্প আছে।
-তাই না-কি?
-হ্যাঁ ঠিক তাই। তুই পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি ভালো করে পড়ে দেখিস। তাহলেই আমার কথার সত্যতা পাবি। এখন বল্ এই গল্প থেকে তুই কি শিখলি?
-শিখলাম এটাই যে, মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামিন রব রুপে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই নিহিত আছেন সুপ্তাবস্থায়। এই রবকে দেখার জন্য নির্জন সাধনা একান্ত প্রয়োজন। যখন সাধনায় সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়, তখন রব জাগ্রত হয়ে তার সম্মুখে জাহির হয়। সেটাকে তখন হুর বলে। এই হুর দর্শন তথা আমাকে আমি দর্শন করার সমতুল্য। যেমন শিয়াল মহাশয় একা পানি খেতে যেয়ে নিজেকে দেখেছে। এইটাই তার দর্শন। সে তার ভেতর যে আমি রুপী রব আছে, সেটা অনুভব করতে পেরেছে। একে একে সবাই তা অনুভব করতে পেরেছে। কিন্ত্তু সকলেই সেই রবের দর্শন পায়নি। কাজেই নির্জন সাধনা ব্যতীত রবের দর্শন সম্ভবপর নয়।
-শিয়াল কি বলেছিল? শিয়াল বলেছিলঃ যখন আমি আমাকে দেখলাম - একা দেখলাম। তার মানে সে নিঃস্ব। নিজেই নিজের মধ্যে বন্ধী ছিল। যখন সকলকেই দেখলাম - আমরা হলাম। অর্থাৎ যখন সকলেই একসাথে দেখলো তখন তারা তাদের মধ্যে নিজেেদরকে দেখে আমরা হয়েছে। যেমনঃ সিংহ দেখেছে আমি, বাঘ দেখেছে আমি, হরিণ দেখেছে আমি। এই আমি-এর সমষ্ঠিই হচ্ছে আমরা। অর্থাৎ আমরা-আমি, তুমি, সে। আনা-লতিফা-মুনজিল। এরুপে প্রকাশ। প্রথমে হযরত আদম (আঃ)। এরপর হযরত হাওয়া (আঃ)। তারপর তাদের মাধ্যমে জগতের প্রকাশ। আমরা আসলাম। বুঝা গেছে কিছু?

আমি আর কিছু বললাম না। কেবল তাকিয়ে দেখলাম মনার দিকে.....কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে মনাকে।