পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

করিম সাহেবের চিন্তা-ভাবনা ও হাঁস-মুরগীর ছানাপোনা-শেষ পর্ব

(পুর্ব প্রকাশের পর হতে)

করিম সাহেব রিক্সাতে উঠতেই রিক্সাওয়ালা টানা শুরু করে দিল। টুনটুন করে কয়েকবার বেল বাজিয়ে কাদের যেন সর্তক করলো। ভাংগা চোরা রাস্তাতে রিক্সার ঝাঁকুনির মাত্রা বেড়ে গেল। করিম সাহেব জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন একটা কোণে। শীতের দাপটে তিনি রীতিমতো ঠক ঠক করে কাঁপছেন। রিক্সার হুট ধরবেন কখন? ঝাকুনিতে তিনি প্রায়ই পড়েই যাচ্ছিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ধমকের সুরে রিক্সাওয়ালাকে বললেনঃ

-আরে একটু আস্তে চালা না বাপ? বুড়া মানুষ। এই রাইত বিরাইতে যদি রাস্তার মধ্যে পড়ি তাইলে কি উপায় আছে?

-চাচা মিয়া। একটু শক্ত হইয়া বসেন। রিক্সাটা মাটির রাস্তা ছাইড়্যা মেইন রাস্তায় উটলে আর কোন ঝামেলা থাকবো না। টাইন্ন্যা চইল্যা যামু গা। মেলা রাইত হইছে।

-হেইড়া নাইলে বুঝলাম। তাই বইল্যা কি এত জোরে টানা লাগে...বেশি জোর খাটাইলে তো কাহিল হইয়্যা যাইব্যা মিয়া..বোঝো না ক্যা...

-আরে আপনে চুপ কইর‌্যা বহেনতো....খালি পেচ্যাল পাড়তাছে...

করিম সাহেব অগত্যা চুপ করে চাদর মুড়ি দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে শক্তভাবে বসে রইলেন। দুপাশে তখন ঘন কুয়াশা। সবে মাত্র কামারগাঁও বাজারে আসছে। দোকান পাট সব বন্ধ। রাস্তায় অবশ্য লাইট জ্বলছে। কিন্ত্তু সে আলো ম্লান দেখাচ্ছে। সবকিছু ছাপিয়ে কুয়াশা তার চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। রিক্সার নিচে হ্যারিকেনের আলোয় মুল রাস্তাটা কেমন যেন দেখাচ্ছে।রিক্সাটা হেলে দুলে চলছে। বলেছিল টানের চোটে সে মান্দ্রা চলে যাবে। কিন্ত্তু শীতের দাপটে সেও কেমন কাবু হয়ে গেছে। করিম সাহেব আকাশের পানে তাকালেন। দেখলেন...আকাশটা বেশ পরিস্কার। চাদটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্ত্তু তারপরও কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে...

যে বিধাতা এত সুন্দর করে তার প্রকৃতিকে সাজাতে পারে সে নিশ্চয়ই আরো সুন্দর। কেন নয়। তিনিতো বলেছেনঃ মানুষকে তিনি তার অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে মাঝে মাঝে যে কিছু কুৎসিত মানব দেখা যায়, সেই অবয়বও কি তিনিই সৃষ্টি করেছেন। যদি ধরে নেয়া হয়, তিনিই সৃষ্টি করেছেন। অন্য কেউ নয়। কারণ লা মউজুদা ইল্লাল্লাহ...অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কিছুই নেই। সবই আল্লাহময়। তাহলে তো নানান সমস্যায় পড়তে হয়। নানা প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দেয় মনের মধ্যে। মনের যে কেন্দ্র বিন্দু, সেই কেন্দ্র বিন্দুতে কে অবস্থান করে? কে প্রশ্ন করতে শেখায়? কে ভাবিয়ে তোলে? এই যে নীরবতা..এই যে নিশ্চুপ প্রকৃতি...হাজার হাজার বছর পুর্বে যে সমস্ত আল্লাহর অলিগণ নীরবে ধ্যান সাধনা করতেন কিংবা রেয়াজত পালন করতেন...কিভাবে কিসের টানে তারা তাদের পৈতৃক ভিটে মাটি ছেড়ে কেবল মাত্র ধ্যান করেই বছর বছর পার করে দিয়েছেন? কি দেখেছেন ধ্যান সাধনায়? আর এই ধ্যান করার পদ্ধতিটাই বা কে শেখালো? কোথ্থ থেকে এর উৎপত্তি? কে কাকে শেখাচ্ছে? সবইতো তিনি। তিনিময় ছাড়াতো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনের মাঝে তিনি। গানের মাঝে তিনি...প্রাণের মাঝে তিনি...তিনিই তো সবকিছু...সবই তিনি। জগত বড়ো বিচিত্রময়। 

করিম সাহেবের মনে পড়লো তিনি চিশতী উদ্যান নামক হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) এর গজলে পড়েছিলেনঃ

উপহার দিব কিগো, কি আছে আমারও নাথ...
তোমারইতো দেওয়া সবই, কোথায় কি পাব সই?
যাহা কিছু সব তুমি, তুমি বিনে আমি নই।।

প্রিয় মানুষটিকে কোন কিছু উপহার দিতে হলে তাকে তার পছন্দমত জিনিসই দিতে হয়। জগতের নিয়মে তাই হয়ে আসছে। যার যেরুপ পছন্দ, সে তার প্রিয়সীকে সেটাই উপহার হিসেবে দিতে চায়। কিন্ত্তু কোন্ জিনিসটি তার নাথ তথা প্রভুকে উপহার দেবেন? সমস্ত কিছুইতো তারই দেয়া। তার দেয়া জিনিস থেকে কিভাবে তাকেই উপহার দেয়া যায়? তিনি সর্বত্রই তাকেই উপলব্ধি করছেন। সমস্ত কিছুতেই তারই সরব উপস্থিতি। এমন কি তার নিজের জীবন পর্যন্ত। সবই তার দেওয়া। কাজেই তাকে নতুন করে দেওয়ার কিছুই নেই। কারণ তিনি সামাদ। আহাদ নন। আহাদ হচ্ছি আমি। আমি সবর্দাই তোমার মুখাপেক্ষী। তাই তুমি সামাদ। তুমি আমি মিলেই হয় নাহনু। আমরা। আমি,তুমি এবং সে। আমি-পুং লিঙ্গ/স্ত্রী লিঙ্গ। তুমি-স্ত্রী লিঙ্গ/পুংলিঙ্গ। দুটির মিলনে উৎপত্তি তৃতীয় শক্তি - সে। আমি,তুমি এবং সে। একটি পরিবারেরই অংশ। সমগ্রই বিশ্বটাই আল্লাহর পরিবার। তাই তিনিই মালিক। তিনিই খালিক। তিনিই হুব্বুন। এই প্রেম হৃদয়ের গভীরে বসবাসরত কোন অজানা উৎস থেকে আসা এক অচিন পাখি। যাকে পরিপুর্ণরুপে দর্শন করাটাই সালাতুল মেরাজ। মেরাজ তখনই হয় যখন মুল সত্ত্বাটি তার স্বরুপে হাজির হন। তথা দর্শন দেন। তাইতো তারা সেই প্রেমেরই কারণে ঘর বাড়ি ছেড়ে সংসার ধর্ম পালন না করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর তারা পার করে দিতে পেরেছিলেন কেবল স্বরুপ দর্শনেই। "প্রেমিক সুজন এহেনও রতন, হারে কি কখন পাইলে দেখা" -এই স্বরুপের কোন ধ্বংস নেই। লয় নেই। প্রলয় নেই। তাই তারা মরেও অমর। তারা মিশে যান সেই চিরন্তন সত্ত্বার সাথে। যার সম্পর্কে বলা হয়েছে বলা হয়েছেঃ " ইয়া আইয়্যুতুহান নাফছুল মুতমাঈন্নাহ। তোরজেয় ইলা রব্বেকি।রাদিয়াতাম মারজীয়া।ফাদখুলিফি ইবাদি ওয়াদখুলি জান্নাতি। (সুরা আল ফজর ২৭-৩০)। অর্থঃ ওহে প্রশান্ত চিত্ত নফস।তুমি তোমার রবের দিকে ফিরে এসো সন্ত্তুষ্ট ও মর্জী চিত্তে। আমার দাসদের দাসত্ব করো আর জান্নাতে প্রবেশ করো। 

করিম সাহেব আবারো তাকালেন সেই প্রকৃতির দিকে। রিক্সাটা তখন বালাশুর চৌরাস্তার মোড়ে বাঁক দিতে যাচ্ছে। দু পাশের খালি জায়গায় দেখলেন.....কুয়াশা বিস্তৃতি ছাড়িয়েছে...রিক্সাটা যেই মান্দ্রার দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে..তখনই দেখলেন কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে উঠলো। রিক্সাটা তখন চলতে শুরু করেছে...আর করিম সাহেব সেই মহাপ্রভুর অপরুপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করে মনে মনে হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ)-এর একটি কবিতা আবৃত্তি করছেনঃ

আঁ খোদাওন্দ, কে দর আরদে অযুদ
হর যমাঁ খোদরা বা-নকশ ওয়া নমুদ;
জুমলা যাতে জাঁহানে মিরআতে উস্ত
হরচে বিনি মুসহাফে আয়াতে উস্ত;
"লাওহে-মাহফুয" আস্ত, দর মা'নী দিলাত
হরচে মি খাহী, শোদ যে উ হাসেলাত।
উনচে মাতলুবে-জাঁহা শোদ দর জাহান
হাম তুয়ী, ও বাঘ জো আজ খোদ নেশান।

অর্থঃ " তিনিই সেই আল্লাহ! যিনি শরীরী-জগতে প্রতি মুহুর্তে নব নব রুপে প্রকাশিত হইতেছেন। বিশ্বের সকল অস্তিত্বই তাহার মুকুর। যাহা কিছু দেখিতেছ, সমস্তই তাহার প্রকাশ চিন্হ। প্রকৃত পক্ষে তোমার অন্তরই "লওহে-মাহফুয"। যাহা কিছু চাও, উহা হইতেই তাহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে। যিনি এই বিশ্বে সারা দুনিয়ার কাম্য, তুমিই তিনি, কেনই বা এদিক সেদিক ঘুরে সময় নষ্ট করছ, তুমি তোমার নিজের ভিতর তাহার সন্ধান কর।