পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনা পাগলার আত্মবিলাপ-পর্ব পন্ঞ্চম

(চতুর্থ পর্বের পর হতে)

আমি মনা পাগলার ঘুম ভাংগার অপেক্ষায় রইলাম। এক সময় তার ঘুম ভেংগে গেল। আর আমি বসে থাকতে থাকতে আমার ঘুম চলে এল। ঢুলুঢুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ খুলেই বললোঃ

-কি রে বসে আছিস?

-হ্যাঁ... কি করবো?

-তোর হাতে ওটা কি?

-বই।

-বই! কিসের বই? 

-দর্শন শাস্ত্রের একটা বই।

- ওহ...কিতাব...

কিতাবতো ভাই মানুষ নয়
নিত্য নতুন কথা কয়
ভবের ভাবুক হইয়া কেন কিতাব দেখ না।।
[সুত্রঃ হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী (রহঃ) কর্তৃক প্রনীত চিশতী উদ্যান হতে সংগৃীত]

ভবের ভাবুক হইয়া কিতাব দেখ। ঐসব দর্শন ফর্শন পড়ে কিছুই পাবি না। যা পাবি তা হলো তোতা পাখি। অর্থাৎ মুখস্ত বিদ্যা দিয়া জগতে খ্যাতি কামাতে পারবি। সবাই তোকে জ্ঞানী বলে সম্মান করবে...ভাববে তুই অনেক জানলেওয়ালা হয়ে গেছিস। তোকে সবাই বেশ সমাদার টমাদর করবে। তোকে একটা গল্প বলি শোনঃ

একদিন এক দরবেশ বনের ধার দিয়ে কোন দুর দেশে যাচ্ছিলেন। সেই বনের পাখিরা সবাই বল্লাহ বল্লাহ বলে বেশ গুণ-গান করছিল। দরবেশ বল্লাহ বল্লাহ ডাকটি শুনতে পেয়ে পাখিটির উদ্দেশ্যে বললেনঃ তোমরা যে বল্লাহ বল্লাহ বলে ডাকছো..সেটা বল্লাহ বল্লাহ হবে না। সেটা হবে আল্লাহ। তোমরা আল্লাহ আল্লাহ বলে তারই গুণগান করো। পাখিরা সেই ডাক ভুলে দরবেশের দেয়া বল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহ আল্লাহ বলে ডাকতে লাগলো। সেই ডাক শুনে দরবেশ বেশ পরিতৃপ্ত হলেন। ভাবলেন বেশ ভালো একটি কার্য তার দ্বারা সমাধা হয়ে গেছে। তারা যেখানেই ডাকুক যেখানেই থাকুন তার ছোয়াব অবশ্যই তিনি পাবেন। পথিমধ্যে তিনি বেশ ক্লান্ত হয়ে একটা গাছ তলায় আশ্রয় নিলেন। এবং কিছুদিন এখানে এবাদত বন্দেগী করে কাটাবেন বলে মনোস্থির করলেন। তিনি সেই গাছতলাতেই ধ্যানমগ্ন রইলেন। একদিকে সেই পাখিটার মুখে বল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহ ডাক শুনে অন্যান্য স্বজাতীয় পাখিরা ঘাবড়ে গেল। বললোঃ তুই এই আল্লাহ কোথ্থথেকে এনেছিস? পাখিটি বললোঃ এক দরবেশের কাছ থেকে এনেছি। তারা বেশ অবাক হলো। কিছুদিন পর সেই দরবেশ দেখতে পেলেন যে, সমেত পাখিরা গাছের ডালে মাথা ঠুকছে। তিনি জিগ্যেস করলেন, তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা এমন করছো কেন? পাখিরা বললোঃ তুমি আমাদের কি নাম শেখালে? আমরা তো সব ভুলে গেছি। আগে যা বলে প্রাণখুলে ডাকতাম, তাওতো ভুলে গেছি? যখন আমরা তাকে আমাদের ভাষায় ডাকতাম তখন আমাদের রব আমাদের কথা শুনতেন। এখন তিনি আমাদের কথা শুনছেন না। তাই আমরা পেরেশান হয়ে মাথা ঠুকছি। দরবেশ বললেনঃ তোমরা প্রথমে বল্লাহ বল্লাহ বলে ডাকতে। আমি তোমাদের বল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহ ডাকতে বলেছি। এমন সময় এলহাম এলোঃ হে দরবেশ! এই পক্ষীকুল যতবার আমাকে "বল্লাহ " নামে ডেকেছে , প্রতিবারই আমি তাদের সুমধুর ডাক শুনেছি আর আমি সাড়া দিয়েছি  কারণ তারা আমাকে মন থেকে ডেকেছে ! আমি সবার মনের খবর জানি ! কাজেই তারা আমাকে "আল্লাহ" বা "বল্লাহ" যে নামেই ডাকে আমি তাদের ডাক শুনি ! "আমাকে ডাকতে চাইলে প্রাণ খুলে ডাকতে হবে ! সেটাই বড় কথা !"
দরবেশ নিজের ভুল বুজতে পেরে আল্লাহর দরবারে লজ্জিত হলেন এবং ক্ষমা চাইলেন আর পাখিদের বললেনঃ"তোমরা প্রভুকে যেভাবে ডেকে শান্তি লাভ কর , সেভাবেই ডাক " !!

-আপনি যে গল্প শোনালেন, সেটাতো আপনিই আমার অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে চাইছেন।

-না রে বোকা...দর্শন মনকে ভাবিয়ে তোলে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তোলে..কোন সমাধান দিতে পারে না...যেটা কোন সমাধান দিতে পারে না...সেটা কিভাবে তোকে কুলে তরী ভেড়াবে?

-কুলে তরী ভেড়াবার জন্যইতো দর্শন উপযুক্ত বিষয়। সমস্ত দার্শনিকগণ তো তাদের বাস্তব উপলব্দ জ্ঞান আরোহন করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। অামরা তো সেইটাই পড়ে জানতে চেষ্টা করছি।

-শোন দর্শন প্রত্যেকটি মানুষের মনের ভেতরই আছে। মনের ভেতর যে দর্শন লুকিয়ে আছে তাকে জানার চেষ্টা করাটাইতো সবচেয়ে বড়ো দর্শন। তাছাড়া দার্শনিকগণের মনে যে প্রশ্নের তথা ভাবের উদয় হয়েছে, তা কোথা থেকে উদয় হয়েছে? এই মন থেকেইতো উদয় হয়েছে। মনের বাইরে থেকে নয়। বস্ত্তু দেখে জ্ঞান লাভ করাটাই সত্য জ্ঞান। এই সত্য জ্ঞান তোর ভেতরেই আছে। 

মনার কথা শুনে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। সে আবার কোন্ দর্শনের কথা বলছে? আমার দর্শন আমার ভেতরই লুকিয়ে আছে? তো কোথায় সেটা? সেটা তো জানতে হবে। কিভাবে মনাকে প্রশ্ন করি? 

মনা বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে। তার বসার ভংগীটা সাধু সন্ন্যাসীদের মতো। পায়ের ভাঁজে পা রেখে বেশ আয়েশ করেই বসেছে। বাবা লোকনাথের ছবিতে দেখেছি এইভাবে বসতে।  আমি তাকে প্রশ্ন করলামঃ 

-এই যে বললেনঃ সত্য জ্ঞানের কথা..যা আমার ভেতরই লুকিয়ে আছে? সেটা কোথায় লুকিয়ে আছে?

-সেটা লুকিয়ে আছে তোর হৃদয়ের মাঝে। মনের মাঝে। তাকে পাবার জন্য সাধনা করতে হয়। সবকিছু বাদ দিয়ে তুই সাধনার পথে এগিয়ে চল। তুই কেন সাধনা করবি? না, পরমপুরুষ চাইছেন, তাই সাধনা করবি। এই যে পরমপুরুষের ইচ্ছা- এই ইচ্ছারপুর্তির জন্যেই সাধনা করবি। আর সেই সাধনা করবার সময় দেখবি যে পরমপুরুষ হয়ে যাচ্ছে তোর মনের বিষয় আর তুই হয়ে যাচ্ছিস তাঁর বিষয়ী। মানুষ হয়ে যায় কর্তা (Subject) আর পরমপুরুষ হয়ে যান কর্ম (object) । যদিও পরমপুরুষ চরম সত্তা (Supreme Subjectivity), সব কিছুর নিয়ন্ত্রী সত্তা, সব কিছুর পরিচালক সত্তা।

পরমপুরুষ হলেন সব কিছুর বিষয়ী আর মানুষ হ’ল তাঁর বিষয়। এমনিতে মানুষ পরমপুরুষকে মনের বিষয় বানাতে পারে না। এই জন্যে যখন তুই তাঁর জপ বা ধ্যান করবি, তখন মনে এই ভাবটা রাখবি যে তুই তাঁর বিষয় আর পরমপুরুষ তোর বিষয়ী। অর্থাৎ ধ্যানে তুই পরমপুরুষকে দেখছিস না, পরমপুরুষ তোকে দেখছেন। ভাবনাটা এমনই হওয়া উচিত- অতীতেও আমার উপর পরমপুরুষের নজর ছিল, আজও রয়েছে, আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আমি কোন অবস্থাতেই একলা নই, নিঃসঙ্গ নই। যতক্ষণ এটা আমার মনে থাকবে যে পরমপুরুষ আমায় দেখছেন, ততক্ষণ বিশ্বের কোন শক্তিই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেবল এতটুকুই নয়, আব্রহ্মস্তম্ব ব্রহ্ম অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা থেকে শুরু করে একটা ঘাসের পাতা পর্যন্ত সব কিছুই তোর সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কেন না, পরম পুরুষের বিধানই এই যে জীব পরস্পর মিলেমিশে এই পৃথিবীতে বাস করুক; কেউ যেন কারুর উপর অবিচার বা অত্যাচার না করে; আর যাকে যতটা শক্তি দেওয়া হয়েছে সে যেন ততটা শক্তির সদ্ব্যবহার করে।

এখন, পরমপুরুষের কাছ থেকে যতটা শক্তি পেয়েছিস, আর সেই সঙ্গে আর যা’ যা’ পেয়েছিস, সব কিছুকে পুরোপুরি কাজে লাগা। তারপর যখন তোর শক্তি-বুদ্ধি-সিদ্ধি কোন কিছুই থাকবে না, তখন পরমপুরুষ তোর প্রয়োজন বুঝে তোকে সব কিছুই দেবেন। এই জন্যে মানুষের পরমপুরুষের কাছে ‘এটা দাও’, ‘ওটা দাও’ বলে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আর সেই সঙ্গে এই কথাটা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে মানুষ অবশ্যই কখনো একলা নয়। তাই মানুষের কখনো ভীত বা শঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। ‘আমার কী হবে গো’, ‘আমার কী হবে গো’, – এ ধরণের চিন্তা একেবারেই বাজে চিন্তা। যা হবে পরমপুরুষ দেখবেন ও প্রয়োজনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। যেমন ছোট্ট শিশু নিজের সম্বন্ধে একেবারেই ভাবে না, যা’ ভাববার তা’ সেই শিশুর মা-বাবা ভাববেন ঠিক তেমনই তোর নিজের ব্যাপারে তুই কোন কিছুই ভাবিস না। তোর সম্বন্ধে পরমপুরুষকে ভাবতে দে। তুই শুধু নির্ভয়ে , নিঃশঙ্ক চিত্তে ও সানন্দে নিজের কর্ত্তব্য করে যা। দেখবি , পরমপুরুষ তাঁর স্নেহের পুত্র-কন্যাদের জন্যে যা কিছু করবার অবশ্যই করবেন।

কারুর মনে কোন প্রকার হীনমন্যতা থাকা উচিত নয়। তুই কারো চেয়ে ছোট নস, কারো চেয়ে হীনও নস। আর একটা কথাঃ পিতার কাছে তার পুত্র-কন্যারা সমান আদরের, সমান স্নেহের। কন্যা পুত্রের চেয়ে বা পুত্র কন্যার চেয়ে কোন অংশে হীন নয়। উভয়েই সমান। কেউ যদি কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তো বুঝতে হবে, সে পরমপুরুষের বিরুদ্ধাচরণ করছে, তাতে তার নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনছে।
(চলবে)